বাংলোর অদূরে একটা ব্যারাক মতো বাড়ি। টিনের চাল, টানা লম্বা দাওয়া। সেখানেই পরপর তিনখানা রান্নাঘর। গ্যাস, কেরোসিনের ব্যবস্থা নেই, জঙ্গলের শুকনো কাঠ স্তূপ করা আছে দাওয়ায়। ইচ্ছেমতো কাঠ নিয়ে যে যার রান্না সারো।
সেই কাজই চলছিল এখন। ধরানো হয়েছে কাঠের আঁচের উনুন, চলছে রাতের রান্নার প্রস্তুতি। রান্নাঘরের দিকটায় বিদ্যুৎ নেই, জ্বলছে বন দফতরের হ্যাজাক। যথেষ্ট চড়া আলো, কাজ করতে কোনও অসুবিধে হয় না। বিভূতির উপর পুরো ভার ছেড়ে না দিয়ে মিতিন নিজেই নেমে পড়েছে রান্নাবান্নায়। টুপুর আর বিভূতি তাকে সাহায্য করছে হাতে হাতে। পথশ্রমে আজ ক্লান্ত সবাই, তাই আর রুটিটুটির হাঙ্গামা নয়, সোজা ভাত বসিয়ে দেওয়া হবে। সঙ্গে অল্পস্বল্প কিছু ভাজাভুজি আর ডিমের ডালনা, ব্যস।
রান্নাঘরগুলোর পাশে পাশে ছোট ছোট খুপরি। একটায় মালপত্র জড়ো করে রেখেছিলেন বিভূতি। আছে বনবিভাগের বাসনকোসনও। তারই একটা ডেকচিতে চাল ধুচ্ছিল টুপুর কচলে কচলে।
তখনই জিক্স, টিশার্ট পরা এক তরুণের আবির্ভাব। ফরসা রং, সুন্দর স্বাস্থ্য, মাথার চুল কোঁকড়া কোঁকড়া। ভুরু কুঁচকে মিতিন, টুপুরকে সে দেখল একটু। তারপর বিভূতির দিকে চোখ পড়তেই তার ঠোঁটে হাসি ফুটেছে। ঈষৎ বিস্ময়ের সুরে বলল, আরে বিভূতিবাবু, আপনি?
এই তো আজ আবার চলে এলাম এঁদের সঙ্গে, মিতিন আর টুপুরকে দেখালেন বিভূতি। স্মিত মুখে বললেন, তা আপনাদের তো আরও ছ’-সাত দিন পরে ফেরার কথা, তাই না?
টুপুর ফস করে বলে উঠল, এঁরাই বুঝি পরশু আপনার সঙ্গে এসেছিলেন?
হ্যাঁ, বিভূতি মাথা নাড়লেন। যুবকটিকে ফের জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মাস্টারমশাই কোথায়?
স্যার বাংলোয়। সারাদিন জঙ্গলে প্রচুর ঘোরাঘুরি হয়েছে, এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। বলেই মিতিনকে প্রশ্ন, আপনারা বুঝি আমাদের পাশের বাংলোয় এলেন?
একদম ঠিক। এই খানিক আগে ঢুকেছি, মিতিন ভদ্রতা করে হাসল, আমরা চারজন। আমি প্রজ্ঞাপারমিতা, এই আমার বোনঝি ঐন্দ্রিলা, আমার বর আর ছেলে ঘরে। কী করছে তা অবশ্য জানি না।
মিতিনের কথা বলার সহজ ভঙ্গিতে যুবকটি হেসে ফেলেছে। হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে বলল, আমি সুবাহু চৌধুরী। আমার স্যার ইন্দ্রজিৎ সেনের লেজুড় হয়ে এসে পড়েছি এই সাতকোশিয়ায়।
এখন, এখানে আগমন নিশ্চয়ই রান্নাবান্নার জন্যে?
উপায় কী বলুন! রাতে তো কিছু পেটে দিতে হবে। সুবাহুর মুখে সামান্য লজ্জা লজ্জা ভাব, কী যে ঝকমারিতে পড়েছি। এখানে আসার পরদিন থেকে চৌকিদারটি গায়েব। অগত্যা সেলফ হেলপের পালা চলছে। সকালে ভাতের সঙ্গে ডিমসেদ্ধ, আলুসেদ্ধ আর রাতে ডিমসেদ্ধ, আলুসেদ্ধ ভাত। এই এখন আমাদের দু’বেলার মেনু।
খুব কষ্টে দিন কাটছে তা হলে? মিতিনের যেন একটু মায়া হয়েছে। বলল, এক কাজ করুন না, আমি ডিমের ডালনা বানাচ্ছি। আজ রাত্তিরটা আমাদের সঙ্গে খেয়ে নিন।
সুবাহু যেন হাতে চাঁদ পেল। খুশি খুশি মুখে বলল, তা হলে তো খুব ভালই হয়। কিন্তু আপনি বেড়াতে এসে আমাদের জন্যেও পরিশ্রম করবেন?
আরে দুর। পাঁচজনের রান্না, সাতজনের রান্নায় খাটুনির হেরফের হয় নাকি? বলেই মিতিন নির্দেশ ছুঁড়েছে বিভূতিকে, আরও কয়েকটা ডিম, আলু এনে সেদ্ধয় ফেলে দিন তো। ওটা হলে ভাত চাপিয়ে দিয়ে বেসন গুলে ফেলুন। বেগুনিটাও আমি ভাজব।
টুপুর ফুট কাটল, আমিও চেষ্টা করে দেখতে পারি।
থাক। সেদ্ধ ডিম, আলুর খোসা ছাড়িয়ে দে, তা হলেই যথেষ্ট। মিতিন পেঁয়াজ, রসুন, আদা একসঙ্গে থেঁতো করতে করতে বলল, তা ভাই সুবাহু, হঠাৎ চৌকিদারটি পালাল কেন?
কী জানি। সাত দিন রেঁধে দেওয়ার জন্যে পাঁচশো টাকা অ্যাডভান্স দিয়েছিলাম। সেটা নিয়েই তো চৌপাট।
মাত্র পাঁচশো টাকা চোট করে আজকাল কি কেউ পালায়? নিশ্চয়ই অন্য কোনও কারণ আছে। স্থানীয় বিট অফিস কী বলছে?
তারা নাকি কিছুই জানে না। ছুটিফুটিরও কোনও দরখাস্ত দিয়ে যায়নি।
অর্থাৎ ছুটি নেয়নি। স্ট্রেঞ্জ তো!
টুপুর বলে উঠল, হয়তো বাড়ি থেকে কোনও খারাপ খবরটবর এসেছিল। তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ..।
হতে পারে, সুবাহু কাঁধ ঝাঁকাল, তবে বনদফতরের তো তেমন একটা গা দেখলাম না। আমারও ওকে নিয়ে অত ইন্টারেস্ট নেই। শুধু একটু অসুবিধেয় পড়ে গেলাম, এই যা। তবে ম্যানেজ তো করেই নিচ্ছি। সেদ্ধ খাচ্ছি, স্টকে পাঁউরুটি ফাউরুটি আছে, তেমন দরকার পড়লে চলে যাব পুরানাকোট। সেখানে দোকান তো আছেই।
হুম, থেঁতো করা পেঁয়াজ, আদা, রসুন একটা বাটিতে রেখে মিতিন বলল, কখন আবিষ্কার করলেন লোকটা নেই?
সেভাবে তো বলা কঠিন। সকালে চা দিল না, ব্রেকফাস্টও পাচ্ছিলাম না। রাজু রাজু করে কয়েকবার ডাকাডাকি করলাম, সাড়া নেই। তারপর কোয়ার্টারে গিয়ে দেখলাম, তালা ঝুলছে।
অথচ তার আগের রাত্তিরেও তো সে…
দিব্যি ছিল। কী যে হয় এদের, কখন পাখা গজায়! বলতে বলতে ঘড়ি দেখল সুবাহু। একটু যেন ব্যস্ত মুখে বলল, যাই, স্যারকে গিয়ে নেমন্তন্নর সুখবরটা দিই।
সেই ভাল। আমরা ততক্ষণ কাজকর্মগুলো সারি। রান্না হয়ে গেলে বিভূতিবাবু আপনাদের ডেকে আনবেন। আমাদের বাংলোতেই সবাই মিলে খাব একসঙ্গে।
ঢুক করে ঘাড় নেড়ে চলে গেল সুবাহু। মিতিনরাও ব্যস্ত হয়ে পড়ল রান্নাবান্নায়। যখন যে কাজটা করে মিতিনমাসি, সে গোয়েন্দাগিরিই হোক বা ডিম রান্না, সমান মনোযোগে করে। দেখেছে টুপুর। হাতও চলে কী দ্রুত, বাব্বা! ঝটাঝট বেগুন কাটছে, কচাকচ লঙ্কা কুচোচ্ছে। টুপুর চারখানা ডিম ছাড়ানোর আগেই একডজন খোসা জড়ো করে ফেলল। শসা, টম্যাটোয় নুন, লেবু মাখিয়ে স্যালাডও রেডি হয়ে গেল একপ্লেট। তারই সঙ্গে অবিরাম টুকিটাকি নির্দেশও দিচ্ছে টুপুর আর বিভূতিবাবুকে।
মশলা কষিয়ে, কড়ায় ডিম আলু ছেড়ে একটু বুঝি ফুরসত মিলেছে মিতিনের। হাত ধুতে ধুতে বিভূতিকে জিজ্ঞেস করল, চৌকিদারটিকে তো আপনি চিনতেন, তাই না?
নিশ্চয়ই। এখানে প্যাসেঞ্জার নিয়ে প্রায়ই আসা-যাওয়া করি, রাজুর সঙ্গে আলাপ না হয়ে পারে!
অল্পবয়সি ছেলে বুঝি?
একেবারেই ছোকরা। বয়স বড়জোর পঁচিশ-ছাব্বিশ। ওর বাবা ভগীরথ ছিল এখানকার চৌকিদার। হঠাৎ ক’বছর আগে খারাপ ম্যালেরিয়ায় সে মরে গেল, তার জায়গায় চাকরি পেয়েছিল ছেলে।
রাজু এমনিতে কেমন? বেশ চটপটে? বুদ্ধিমান?
বুদ্ধি কতটা আছে জানি না, তবে খুব ছটফটে। সাহসীও বটে। রাতবিরেতে নাকি একা-একাই জঙ্গলে চরে বেড়াত।
ওর কোয়ার্টারটা কোথায়?
ওই তো, আপনাদের বাংলো দুটোর পিছনেই।
মিতিন আর কিছু বলল না। ডিমের ঝোলে গরম মশলা দিয়ে নাড়ল একটু, তারপর ঢালল গামলায়। বেশি টম্যাটো ফম্যাটো দিয়ে খাসা রং বানিয়েছে। বেসনে কালোজিরে মিশিয়ে বেগুনি ভাজাও শেষ। ভাতের দায়িত্বটা বিভূতির উপর ছেড়ে বলল, এবার এটা আপনি দেখুন, আমি বাংলোয় ফিরি।
বিভূতি বললেন, হ্যাঁ ম্যাডাম, খুব ধকল গেল আপনার, ঘরে গিয়ে একটু জিরিয়ে নিন।
খাবারদাবার, থালা, গ্লাসগুলো কি আমরা এসে নিয়ে যাব?
না, না। ছি, ছি। আমি সব পৌঁছে দেব।
তখন তা হলে আমার অতিথিদেরও ডেকে দেবেন প্লিজ।
সে কি আপনাকে বলতে হবে? আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
বিভূতিবাবুর গলা শুনেই বোঝা যায়, তিনি যথেষ্ট বিগলিত। না হয়ে বোধহয় উপায়ও নেই। একদিকে মিতিনমাসির কর্মকুশলতা, অন্য দিকে সুন্দর ব্যবহার। বিভূতিবাবুর মতো একজন সাধারণ মানুষকে তো বশ করবেই। টুপুরের ভাবতে অবাক লাগে, হঠাৎ রুদ্রমূর্তি ধারণ করলে মিতিনমাসির এই ঠান্ডা ঠান্ডা, গিনি গিন্নি ভাবটা যে কী আমূল বদলে যায়!
জঙ্গলে অন্ধকার বেশ গাঢ় এখন। কৃষ্ণপক্ষের রাত, আকাশে এখনও চাঁদ ওঠেনি। ফটফট করছে তারা। সারাদিন যথেষ্ট তাপ ছিল আজ, এখন একটা নরম হাওয়া বইছে। অনেকটা নীচে নদীর আওয়াজ যেন আরও বেশি প্রকট। ওই শব্দ, স্নিগ্ধ বাতাস আর আলোআঁধার, মিলেমিশে পরিবেশটাই কেমন অলৌকিক।
লন মাড়িয়ে বাংলোয় এসে টুপুর হাঁ। বুমবুম ঘুমিয়ে পড়েছে, আর তার পাশে পার্থমেসো কানে ইয়ারফোন গুঁজে নিমীলিত চোখে মাথা দোলাচ্ছে।
হতবাক মুখে টুপুর বলল, এ কী গো? আমরা ওদিকে খেটে খেটে মরছি আর তুমি মজাসে মোবাইলে গান শুনছ?
গলা পেয়ে ঝটিতি ইয়ারফোন খুলেছে পার্থ। ছোট্ট একটা আড়মোড়া ভেঙে বলল, আমিও কাজ করছিলাম রে!
মিতিন মুখ বেঁকিয়ে বলল, দেখেছি, বিট অফিসারের সঙ্গে আড্ডা মারছিলে।
একেই বলে টিকটিকির নজর। রাঁধতে রাঁধতেও চোখ ঘোরে।
কী করি বলো, যে পেশার যা অভ্যেস! ঠাট্টাটা গা থেকে ঝেড়ে ফেলল মিতিন। জিজ্ঞেস করল, তা কী কী ইনফরমেশন বাগালে?
অনেক কিছু, অনেক কিছু, পার্থ টানটান। উত্তেজিত মুখে বলল, জানো তো, এখানে নৌকোয় বোটিং করা যায়।
বোটিং তো লোকে নৌকোতেই করে। নয় কি?
টিজ কোরো না। কাল ভাবছি একটা বোটিং ট্রিপ নেব। তারপর দুপুরে লবঙ্গি। ওখানে নাকি একটা হাতির পাল ঘুরঘুর করছে। গেলে দর্শন মেলা নিশ্চিত।
হ্যাঁ, তোমাকে অভ্যর্থনা জানাতে তারা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবে।
ওফ, এত কমেন্ট করো কেন? এখানে নাকি একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে। জঙ্গলের একদম মধ্যিখানে। দিনের বেলা সেখানে খুব একটা থ্রিল নেই। বড়জোর হরিণটরিন চোখে পড়ে। কিন্তু একটু বেশি রাত্তিরে যদি যাওয়া যায়…
ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে বাঘ এসে তোমার সঙ্গে কানামাছি খেলবে, তাই তো?
ফের বিদ্রূপ? আরে, আমাদের চার ব্যাটারির টর্চ আছে না? ওটা জ্বাললে সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পাবে।
আচ্ছা, আচ্ছা। সে দেখা যাবে’খন। কালকের ভাবনা কালকে। চৌকিদারের খোঁজ মিলেছে? বিট অফিসার কিছু বললেন?
উনি পাত্তাই দিলেন না। ছেলেটা নাকি উড়ুউড়ু টাইপ। মাঝে মাঝেই দু’-দশ দিনের জন্য উধাও হয়ে যায়। ফিরেও আসে। তবে কাজের ছেলে বলে চাকরিটা খোয়া যায় না। এখানকার ঘড়িয়াল সংরক্ষণ কেন্দ্রটা তো ওই দেখাশোনা করে। খাঁচাটাচাগুলো পরিষ্কার রাখা তো সহজ কাজ নয়। সকলে ভিতরে যেতে সাহস পায় না।
ও! ভুরু কুঁচকে মিতিন দু’-এক সেকেন্ড ভাবল কী যেন। তারপর সহজ স্বরে বলল, তা এবারে একটু গা ঝাড়া দাও। একটা অন্তত দায়িত্ব নাও।
কী?
বুমবুমকে জাগিয়ে তুলে খাওয়াও।
শুনেই মুখ শুকিয়ে গিয়েছে পার্থর। একবার ঘুমিয়ে পড়লে বুমবুমকে তোলা যে কী কঠিন! টানাহেঁচড়া করে তাকে উঠিয়ে বসালেও পরক্ষণেই সে ফের কাত। ফের লুটিয়ে পড়ে বিছানায়। অতি কষ্টে তাকে খাড়া করা হল, অমনি সে কান্না জুড়েছে। পার্থ ছুটল তার খাবার আনতে। ভাত, আলু, ডিম চটকে ঝপাঝপ গরাস তোলা হচ্ছে মুখে, চোখ বুজেই গিলছে বুমবুম। কোনওমতে পাত খালি করে আবার সে ঢলে পড়ল ঘুমে।
ইতিমধ্যে টুপুরদের নৈশাহারের ব্যবস্থাও সারা। সবকিছু পরিপাটি ভাবে গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছেন বিভূতি। টুপুর টেবিলে প্লেট সাজাচ্ছে, সুবাহুও তার মাস্টারমশাইকে নিয়ে উপস্থিত।
ইন্দ্রজিতের চেহারাটি বেশ দশাসই। গায়ের রং শ্যামলা, কিন্তু মাথার চুল ধবধবে সাদা। গাল জুড়ে শুভ্র দাড়ি ঝকঝক করছে আলোয়। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা মানুষটাকে প্রথম দর্শনেই বেশ ওজনদার পণ্ডিত বলে মনে হয়।
নেমন্তন্নর কথা জানত না বলে পার্থ বেশ অবাক হয়েছিল প্রথমটায়। তারপর সামলে নিয়ে দিব্যি আলাপ জমিয়ে ফেলল সুবাহু আর ইন্দ্রজিতের সঙ্গে। কথায় কথায় জানা গেল, পরিবেশবিদ্যা নিয়ে স্বাধীনভাবে গবেষণা করছেন ইন্দ্রজিৎ। সুবাহু তাঁর ছাত্র এবং সহকারী।
খেতে বসে পার্থ জিজ্ঞেস করল, তা প্রোফেসরসাহেব কি এখানে গবেষণার কাজেই এসেছেন, নাকি নিছক ভ্রমণে?
ইন্দ্রজিৎ গমগমে গলায় বললেন, এক ঢিলে দুই পাখি মারছি বলতে পারেন। রেনফরেস্ট নিয়ে কাজ করছি, সাতকোশিয়া দেখারও খুব ইচ্ছে ছিল। ভারতের বৃহত্তম গিরিখাত বলে কথা!
পার্থ বলল, তাই বুঝি? এটা তো জানতাম না!
অনেকেই জানে না। একমাত্র উত্তর আমেরিকার কলোরাডোতেই এর চেয়ে বড় গিরিখাত আছে। তাও সেটা মোটেই সবুজ নয়। একেবারে ন্যাড়া। এমন ঘন জঙ্গল আর পাওয়া যাবে কোথায়!
আপনি বুঝি অনেক দেশ ঘুরেছেন?
ওই আর কী! কাজের সূত্রে এ মহাদেশ, ও মহাদেশ তো চরে বেড়াতেই হয়। তবে আমাদের ভারতই সবার সেরা। এত বৈচিত্র্য আর কোথাও নেই।
শুনে বেশ লাগল টুপুরের। বিদেশ ঘুরে আসা মানুষরা এ দেশের শুধু নিন্দেই করেন। ইন্দ্রজিৎ সেন তো বেশ অন্যরকম।
কৌতূহলী মুখে টুপুর প্রশ্ন করল, তা সাতকোশিয়ায় এখনও পর্যন্ত আপনি কী-কী দেখলেন স্যার?
জন্তুজানোয়ার। একটা চিতল হরিণ আর খান পাঁচেক বুনো শূকর, ইন্দ্রজিৎ মৃদু হাসলেন, তবে আমি জন্তু দেখতে আসিনি। আমার ইন্টারেস্ট পাহাড়। ছোটনাগপুরের মালভূমি কীভাবে এসে পূর্বঘাটে মিশছে, সেটাই দেখতে চাই। প্লাস, এখানকার গাছপালা স্টাডি করব। পাখিও।
এখানে অনেকরকম পাখি আছে বুঝি?
ভ্যারাইটির এখানে শেষ নেই, বুঝলে। পাখি আছে এখানে একশো আঠাশ প্রজাতির। গাছ আছে একশো ছাব্বিশ টাইপের। আটানব্বই রকমের গুল্ম। একান্ন ধরনের লতা। এ ছাড়া ওষধি গাছ আছে একশো পঁচিশ রকমের। সামনে যে নদীটা রয়েছে, তাতে তো প্রায় দুশো রকমের মাছ আছে, জানো?
পার্থ ঝুপ করে জিজ্ঞেস করল, সেই জন্যই কি এখানে ঘড়িয়াল প্রকল্প? যাতে ওরা প্রাণ ভরে মাছ খেতে পারে?
বোধহয়। তবে ওইসব সরীসৃপে আমার আগ্রহ নেই। তার চেয়ে প্রজাপতি দেখে বেড়াতে আমার বেশি ভাল লাগে।
গল্প করতে করতে খাওয়া শেষ। নৈশভোজের জন্য ইন্দ্রজিৎ বারবার ধন্যবাদ দিলেন মিতিনকে। পার্থ চোয়াল এঁটো করা হাসি উপহার দিল অধ্যাপককে। কাল কোথায় কোথায় ঘুরবে পার্থরা জেনে নিয়ে বিদায় নিলেন গুরু-শিষ্য।
ওঁরা চোখের আড়াল হতেই পার্থর অন্য মূর্তি, তোমার আক্কেলটা কী?
কেন? কী হয়েছে?
হিসেব করে ডিম এনেছি। ওঁদের দু’খানা করে খাওয়ালে। শেষ দিকে যদি কম পড়ে যায়?
তখন ঘড়িয়ালের ডিম এনে দেব। এখনই তো ওদের ডিম পাড়ার সময়, মিতিন হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল, বিশাল বড় বড় সাইজ। কুমিরকুলে এদের ডিমই সবচেয়ে প্রকাণ্ড। এক-একখানার ওজন দেড়শো গ্রামেরও বেশি। ভাবতে পারো? নদীর পারেই পেয়ে যাবে, গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।
থাক, ওই খেয়ে মরি আর কী, বলে বেজার মুখে সরে গেল পার্থ। শুয়ে পড়েছে বুমবুমের পাশে। মশারির ভিতরে। টুপুরেরও আর শরীর চলছিল না, সেও শয্যা নিয়েছে পাশের ঘরে। জঙ্গলে মশারি টাঙানোর মতো জরুরি ব্যাপারটাও খেয়াল নেই।
ভালমতোই তন্দ্রা এসে গিয়েছিল টুপুরের। হঠাই মৃদু ধাক্কা। মিতিনমাসির গলা পেল টুপুর, কিছু শুনতে পাচ্ছিস?
কান পাতল টুপুর। অস্ফুটে বলল, একটা ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। রাতচরা পাখির ডাক বুঝি?
উঁহু, ওটা নয়। একটু ভাল করে শোন।
হ্যাঁ, তাই তো। একটা গিটার বাজছে যেন! ইংরিজি গানের সুর।
হুঁ মনে হচ্ছে পাশের বাংলোয়।
নির্ঘাত সুবাহু। টুপুর একটু মজাই পেল। আজব পড়শি জুটেছে তো, মাঝরাতে জঙ্গলে গিটার বাজায়!
.
০৪.
চার ভাগ করা মোটা জালের খাঁচার ভিতরে ঝিম মেরে পড়ে আছে ঘড়িয়ালগুলো। কোনওটা এক-দেড় ফুটিয়া বাচ্চা, কোনওটা মাঝারি, কোনওটা বা বেশ বড়সড়। দু’খানা তো রীতিমতো প্রকাণ্ড। লেজ সমেত হাত পাঁচেকের কম নয়। খাঁচায় ছোট-বড় জলাধারও আছে বেশ কয়েকখানা। সিমেন্ট বাঁধানো। নানারকম মাছ ছাড়া আছে জলাধারে। ঘড়িয়ালদের আহারের তোফা বন্দোবস্ত।
কলকাতার চিড়িয়াখানায় আগে ঘড়িয়াল দেখেছে টুপুর। বুমবুমের জীবনে ঘড়িয়াল দর্শন এই প্রথম। সক্কালবেলায় এমন একটি জীবকে দেখে সে ভারী উত্তেজিত। বড় ঘড়িয়াল দুটোর নট নড়ন চড়ন ভাব তাকে যেন বেশ ধন্দে ফেলেছে। ফিসফিস করে টুপুরকে জিজ্ঞেস করল, অ্যাই দিদি, ওরা জ্যান্ত না মরা?
টুপুর বিজ্ঞের মতো বলল, দুর বোকা, মরবে কেন! ওরা বিশ্রাম নিচ্ছে। হয়তো ঘুমোচ্ছে।
যাহ, চোখ তো খোলা!
কুমির-ঘড়িয়াল চোখ খোলা রেখেই ঘুমোয়।
ধারণাটা পুরো ঠিক নয় রে টুপুর।
ভাই-বোনের কথার মাঝে নাক গলিয়েছে পার্থ। বলল, কুমিরঘড়িয়ালের আমাদের মতো চোখের পাতা নেই। আছে মণির উপর পাতলা আঁশের মতো একটা স্বচ্ছ আস্তরণ। অতএব ঘুমোচ্ছে না জেগে আছে বোঝা অসম্ভব।
টুপুর জিজ্ঞেস করল, মাছদের মতো?
অনেকটা সেরকম, পার্থ মাথা দোলাল, ভাল করে লক্ষ কর টুপুর। কুমির পরিবারের মধ্যে ঘড়িয়াল কিন্তু ইউনিক। এক অদ্ভুত চিজ। দেহের তুলনায় মুখখানা কত সরু দেখেছিস তো? কতখানি লম্বা? পুরো লম্বাটে মুখখানা জুড়ে সার সার দাঁত। আমাদের মতো বত্রিশ পাটি নয়, একশো দশখানা এবং ভয়ংকর ধারালো।
বুমবুম বলল, ওই দাঁত দিয়েই ওরা মাছ কুচিকুচি করে?
না রে, মাছ খেতে দাঁত ওদের কাজেই লাগে না। ওদের তো আমাদের মতো কষের দাঁত নেই, তাই চিবোতে পারে না। ওরা খপাত করে ধরে আর গপাত করে গেলে।
তা হলে দাঁতগুলো কী কাজে লাগে?
মেনলি চোয়াল দুটো ধরে রাখার জন্য। নইলে তো মুখটা ল্যাতপ্যাত করবে। ঘড়িয়ালের বয়স হলে ওই দাঁতগুলো ক্রমশ ছোট আর মোটা হতে থাকে।
মিতিন পালা করে একবার ছোট ঘড়িয়াল, একবার বড় ঘড়িয়ালগুলোকে নিরীক্ষণ করছিল। হালকা হেসে পার্থকে বলল, তুমি যে ঘড়িয়াল এক্সপার্ট, তা তো জানা ছিল না।
গুণ আমার অনেক আছে ম্যাডাম। তুমিই যা পাত্তা দাও না।
তা গুণটা তোমার, না গুগুলবাবুর?
পার্থ হেসে ফেলল, সত্যি, গুগল সার্চ করে করে যে কত কিছু জানছি।
আর কী-কী শিক্ষা লাভ করেছ?
এই যেমন ধরো, এখনও পর্যন্ত যে বৃহত্তম ঘড়িয়ালটিকে পাওয়া গিয়েছে তার দৈর্ঘ্য তেইশ ফুট। সেটাকে উনিশশো চব্বিশ সালে উত্তর প্রদেশের কোশী নদীতে গুলি করে মারা হয়েছিল। তার পরেরটি ছিল জলপাইগুড়ির চেকো নদীতে। তিনিও উনিশশো চব্বিশ সালে মানুষের গুলিতে অক্কা পান। একসময়ে এই ঘড়িয়াল আমাদের উপমহাদেশের নদীতে নদীতে গিজগিজ করত। সিন্ধু, ইরাবতী, ব্রহ্মপুত্র, কোথায় না ছিল! এখন চম্বল, শোন আর মহানদী, ব্যস। আর ছুটকোছাটকা কিছু আছে নেপালে। ষাট বছর আগে যাদের সংখ্যা ছিল দশ হাজার, দু’হাজার ছ’য়ে তারা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র দুশো পঁয়ত্রিশে।
এত কমে গিয়েছে? টুপুরের গলা দিয়ে বিস্ময় ঠিকরে এল, কেন?
আমাদের দোষে। এত বেশি মাছ ধরছি, নদীনালা থেকে ওদের খাবার গিয়েছে কমে। ওদের ডিমগুলো পর্যন্ত লোকে উদরস্থ করছে। তা ছাড়া মেরে ফেলাফেলি তো চলছেই অনবরত। ওদের নাড়িভুড়ি দিয়ে নানা ওষুধ তৈরি হয়। আর ওদের চামড়া তো ভীষণ ভীষণ দামি। শুধু শৌখিন ব্যাগ জুতো আর বেল্টের চামড়া জোগাতে জোগাতে কত ঘড়িয়াল যে ফুড়ুৎ হয়ে গেল!
টুপুরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। মানুষের সুখ বিলাসিতার জোগান দিতে গিয়ে কত পশুপাখি যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে! কমে এসেছে বাঘ, লোপ পাচ্ছে গন্ডার। এরকম সংরক্ষণ কেন্দ্র না থাকলে ঘড়িয়ালও পৃথিবী থেকে না মুছে যায়!
পার্থ ক্যামেরা বের করেছে। একটা ছোট ঘড়িয়ালের দিকে তাক করতে করতে বলল, সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানিস? আমরা কথায়-কথায় বলি, লোকটা কী ঘড়িয়াল রে বাবা! অর্থাৎ লোকটা মহা দুষ্টু। অথচ ঘড়িয়াল মোটেই তেমন চালাকচতুর নয়। একটু কায়দা করে মাছ ধরে বটে, কিন্তু বাস করে খোলা বালির উপর। পা চারখানা এতই দুর্বল যে, জোরে নড়াচড়াও করতে পারে না। তাই এদের পটাপট মেরে ফেলাটাও সহজ।
টুপুর জিজ্ঞেস না করে পারল না, তা হলে খামোখা এদের ঘড়িয়াল বলে কেন?
ঘড়িয়াল নামটা এসেছে ঘড়া থেকে। কলসি ঘড়া, সেই ঘড়া।
মানে? এদের তো মোটেই ঘড়ার মতো দেখতে নয়?
ভাল করে প্রাণীগুলোর দিকে তাকা। মুখের উপরের দিকটা কেমন শুঁড়ের মতো লম্বা না?
হ্যাঁ।
ওরই ডগায় একটা ফোলা মতন জায়গা দেখছিস?
আছে তো।
তার ঠিক নীচেই ওদের নাকের ফুটো। জোরে শ্বাস ফেললে ওই ফোলা জায়গাটা খুলে গিয়ে ঘড়ার আকার নেয়। শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ ওরা ওই ঘড়ার সাহায্যে ইচ্ছে মতো বাড়াতে পারে। সেই আওয়াজ কখনও কখনও এতই প্রচণ্ড যে, এক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত শোনা যায়। যাকে তুই বলতে পারিস ঘড়িয়ালের বৃংহণ।
বুমবুম মন দিয়ে বাবার কথাগুলো গিলছিল। ভুরু কুঁচকে বলল, তা এখন ওরা ডাকছে না কেন?
ইচ্ছে হচ্ছে না, তাই। ওরা তো সার্কাসের জন্তু নয় যে, আমরা চাইলেই খেলা দেখাবে।
ওরা তো খাচ্ছেও না। হাঁ পর্যন্ত করছে না।
করবে, করবে। এত অধৈর্য হচ্ছিস কেন? দেখবি, একবার হাঁ করলে মুখ আর বন্ধই হচ্ছে না। তখন দাঁতগুলো গুনে নিস, কেমন।
বুমবুমের বুঝি প্রস্তাবটা তেমন মনে ধরল না। দৌড়ে চলে গিয়েছে মা’র কাছে। মিতিন প্রদক্ষিণ করছিল খাঁচাখানা, তার আঁচল ধরে হাঁটছে বুমবুম।
হঠাৎই পিছন থেকে একটা ডাক, গুড মর্নিং। সকাল সকালই আপনারা বেরিয়ে পড়েছেন দেখছি!
একসঙ্গে সবাই ঘুরে তাকিয়েছে। সুবাহু। পরনে কাল রাতের জিক্স টিশার্ট। হাত দু’খানা পকেটে ঢুকিয়ে কায়দা মেরে দাঁড়িয়ে।
ফোটো তোলা থামিয়েছে পার্থ। হেসে বলল, সাতকোশিয়ার পয়লা নম্বর দ্রষ্টব্যটিকেই চাখছি।
কেমন টেস্ট?
খুব একটা জুতসই নয়। ব্যাটারা একবারও মুখ খুলছে না।
ওই তো, ওই তো খুলছে।
সত্যি তো! চোয়াল ক্রমশ ফাঁক হচ্ছে বড় ঘড়িয়াল দুটোর। প্রায় একসঙ্গে! ঈষৎ বাঁকা ছোট-বড় দাঁতগুলো বিকশিত হচ্ছে ক্রমশ।
অমনি পার্থকে আর পায় কে! পলকে ক্যামেরা চালু। এদিক থেকে শাটার টিপছে, ওদিকে গিয়ে শাটার টিপছে। টুপুর আর বুমবুমের চোখেও মুগ্ধ বিস্ময়।
মিতিন হাসি হাসি মুখে সুবাহুর সামনে এল, আপনি একা যে, প্রোফেসরসাহেব কোথায়?
স্যার তৈরি হচ্ছেন। এবার বেরিয়ে পড়ব।
কোথায় যাবেন এখন?
ঠিক নেই, স্যার যেদিকে বলবেন। কয়েকটা রেয়ার টাইপের প্রজাপতি ট্রেস করেছেন স্যার। সম্ভবত ওগুলোরই সন্ধান চলবে আজ।
ও। কাল রাতে গিটার কে বাজাচ্ছিল, আপনি?
আপনারা শুনতে পেয়েছেন?
নির্জনতার মধ্যে কানে না এসে পারে? তা ছাড়া পাশাপাশি বাংলো।
তা বটে, সুবাহু লজ্জা লজ্জা মুখে হাসল, কাল দিনভর একদম বসা হয়নি তো, তাই মাঝরাতে। আপনাদের ডিসটার্ব করিনি তো?
না না, গভীর রাতে বেশ লাগছিল। আপনার হাত তো খুব ভাল। পেশাদার শিল্পীদের মতো।
তেমন কিছু নয়। নিয়মিত চর্চাটা করি, এই যা।
কথার মাঝে কখন যেন মুখ বন্ধ করে ফেলেছে দুই ঘড়িয়াল। এক তালে। বুমবুম চেঁচিয়ে উঠল, কই, ওরা তো কিছু খেল না?
ওদের যা খাওয়ার ঠিক খেয়ে নিয়েছে, পার্থ বলল, নিশ্চয়ই খাঁচার পোকামাকড় সব এখন ওদের পেটে।
পকেট থেকে হাত বের করে সুবাহু ঘড়ি দেখল, এবার তবে আমি যাই? আপনারাও প্রাণ ভরে জঙ্গলে চক্কর মারুন।
পার্থ বলল, ভাবছি সকালের দিকে একটু নৌকোয় চড়ব।
পাবেন কি? একটাই তো নৌকো। সে কখন থাকে, কখন থাকে না।
সুবাহু চলে গিয়েছে বাংলোর দিকে। টুপুররাও ঘড়িয়াল সংরক্ষণ কেন্দ্র ছেড়ে বেরিয়ে এল। পায়ে পায়ে পৌঁছোল পাহাড়টার কিনারায়। সামনে পাথর কেটে কেটে নেমে গিয়েছে সিঁড়ি, নীচে সেই মহানদী পর্যন্ত। পাহাড়ের কিনারা থেকে প্রায় শ’দেড়েক ফুট তো হবেই।
মিতিন টুপুরকে বলল, কী রে, নামবি নাকি? যাবি নদীতে?
ইচ্ছে তো করছে টুপুরের। আবার একটু-একটু ভয়ও লাগছে যে। মহানদী এখানে মোটেই তেমন সরু নয়। গর্জনেই মালুম হয়, স্রোতও আছে যথেষ্ট। একবার পা পিছলে পড়লে আর রক্ষে নেই।
টুপুর ঢোক গিলে বলল, কী হবে গিয়ে?
মহানদীর জলে একটু চরণ ছুঁইয়ে আসি। এলেবেলে নদী তো নয়, আসছে সেই মধ্যপ্রদেশের রায়পুর থেকে। কোন এক হ্রদ থেকে যেন বেরিয়েছে।
হ্যাঁ, হ্রদটা ফরশিয়া গ্রামে। এই নদীতেই রয়েছে ভারতের দীর্ঘতম বাঁধ। পার্থ বুক ফুলিয়ে বলল, বাঁধটার নাম নিশ্চয়ই সবাই জানো, হীরাকুঁদ।
মিতিন মুখ টিপে বলল, এটাও কি তোমার ইন্টারনেটের টিপস?
না ম্যাডাম, জেনারেল নলেজ, বলে পার্থ ঝুঁকল সামান্য, বলল, যাও, নদীতে ঘুরে এসো।
আর তুমি?
আমার এতটা নামা ওঠার কোনও বাসনা নেই। আমি এখান থেকে ফোটো তুলব।
মিতিন চটি খুলে তৈরি। দেখাদেখি টুপুরও। বুমবুম বাবার দলে, সে পার্থর হাত ধরেছে। তখনই বিট অফিসারের আগমন। বছর চল্লিশ বয়স, তেলচুকচুকে চেহারা, পরনে নীল প্যান্ট, সাদা বুশশার্ট।
পার্থ বলে উঠল, গুড মর্নিং স্যার। কাল অত গল্প হল, অথচ আপনার নামটাই জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছি।
আমি পূর্ণচন্দ্র বেহেরা, ওড়িয়া ছাঁচের হিন্দিতে বললেন, বিট অফিসার। মিতিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ম্যাডাম কি স্নানে নামছেন নাকি?
ভাবছি। নদীতে ডুব দিলে মন্দ হয় না, কী বলেন?
খুব সাবধান। জলে ঘষা খেয়ে পাথরগুলো বড় পিছল হয়ে থাকে কিনা, পূর্ণচন্দ্র একবার নদীর দিকে তাকিয়ে নিলেন, ভুলেও কিন্তু সাঁতার কাটার চেষ্টা করবেন না। বিপদ ঘটতে পারে।
তাঁবুটা তো দেখছি নদীর পারে। ওই জায়গাটা বোধহয় সেফ, না?
সামান্য ইতরবিশেষ আর কী। স্রোতটা কম, তবে ওদিকে ঘড়িয়ালের সংখ্যা বেশি।
আহা, ঘড়িয়াল তো মাছ খায়। মানুষ তো ধরে না।
সে তো ঠিকই। কিন্তু গায়ের কাছে চোদ্দো-পনেরো ফিট ঘড়িয়াল ঘুরে বেড়ালে জলে নেমে স্বস্তি পাবেন কি?
তা হলে ওখানে তাঁবু খাঁটিয়ে থেকে কী লাভ?
যার যেমনটা পছন্দ। ওখানে আমরা একটা নেচার স্টাডি ক্যাম্প খুলেছি। অনেকেই বাংলোর বদলে টেন্টে থাকাটাই প্রেফার করেন।
পার্থ দুম করে বলল, আমরা কেন তাঁবু নিলাম না মিতিন?
চেয়েছিলাম তো। আঙুলে বলল, এখন নাকি তাঁবুর অ্যাকোমোডেশন নেই।
ছিল না তো, পূর্ণচন্দ্র বললেন, দিন পনেরো আগে একটা ঝড় হয়েছিল, তখন তাঁবুর ছত্রাকার দশা। তারপর থেকে আর দেওয়াই হচ্ছিল না। কাল দুপুরে হঠাৎ দুই ভদ্রলোক এসে হাজির। কাকে ধরেকরে যেন ম্যানেজ করেছেন। তাঁবু তো খাটানোই ছিল না, অফিস থেকে নিয়ে গিয়ে নিজেরাই লাগিয়ে ফেললেন।
ওঁরা কারা? কিছু জানেন?
হবে কোনও কর্তাব্যক্তির জান পহেচান। নিজেরা নিজেদের মতো আছেন, এদিকে আসছেনও না, পূর্ণচন্দ্র একটা তাচ্ছিল্যের মুখভঙ্গি করলেন। পার্থকে বললেন, ও হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে যাচ্ছি। নৌকো চড়ায় যথেষ্ট ঝুঁকি আছে, জলের তোড়ে বোট ডুবে যায়। ফ্যামিলি নিয়ে এসেছেন তো, বুঝেশুনে চলবেন।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। মনে থাকবে।
হেলেদুলে অফিসের দিকে চলে গেলেন পূর্ণচন্দ্র। মিতিনদেরও আর নীচে নামা হল না। জলখাবার বানিয়ে বিভূতি ডাকাডাকি করছেন। ঘোরানো রাস্তা বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে টুপুরের নজরে পড়ল, জঙ্গল পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়েছেন ঝোলা পিঠে ইন্দ্রজিৎ। সুবাহু চলেছে পিছু পিছু, কাঁধে গিটারের বাক্স। আজ জঙ্গলেই বাদ্যচর্চা করবে নাকি? হরিণ, বাইসনদের গিটার শোনাবে? দুনিয়ায় কত ধরনের পাগল যে থাকে!
রান্নাঘরের দাওয়ায় বসেই প্রাতরাশ সেরে নিল টুপুররা। একটু তেড়াবেঁকা হলেও পরোটা বেশ ভালই বানিয়েছেন বিভূতি। লঙ্কা, পেঁয়াজ সহ আলুভাজাটাও মন্দ নয়। তার সঙ্গে কলা আর ডিমসেদ্ধ খেয়ে সকলেরই পেট জয়ঢাক। কালই স্থির হয়েছে দিনের রান্নাটা বিভূতিই সারবেন, মিতিন হাতাখুন্তি ধরবে রাতে। দায়িত্ব পেয়ে বিভূতি দারুণ উৎসাহিত। নিজেই উদ্যোগী হয়ে ভোরবেলা কাকে যেন বলে এসেছেন, একটু পরেই এসে যাবে মাছ। মহানদীর। দুপুরে তাই ডিম নয়, ডাল, ভাজাভুজির সঙ্গে আজ মাছের ঝোলের আয়োজন।
এবার নৌকো চড়ার পালা। ঘাটটা বাংলো থেকে খানিক দূরে, তাঁবুর সামনেটায়। মোরাম বিছানো পথ ধরে গিয়ে নামা যায় নদীর দিকটায়। ফুরফুরে মেজাজে শিস দিতে দিতে দলপতির মতো চলেছে পার্থ। বুমবুম ছুটছে লাফিয়ে লাফিয়ে। তাকে আজ দুধ খেতে হয়নি, তাই যেন আহ্লাদে ডগমগ। টুপুর হাঁটছিল মিতিনের পাশে পাশে, তার হাতে মাসির বাইনোকুলার।
তাঁবুর কাছাকাছি এসে ট্রেনের লোক দুটোর সঙ্গে দেখা। ঝোলা পিঠে বেঁধে তাঁরাও বেরোনোর জন্য প্রস্তুত।
তাগড়াই গোঁফ মানুষটি টুপুরকে দেখে বললেন, তোমরাও এখানে? বাহ, বাহ। কখন এলে কাল?
প্রায় সন্ধের মুখে। আপনারা তো কাল দুপুরেই?
হ্যাঁ, কটকে নেমে আর দেরি করিনি। জিপ ভাড়া করে প্রায় তক্ষুনি।
খুব তাড়া ছিল বুঝি?
তা ছিল একটু। ওই বাংলোর সামনে কি তোমাদেরই গাড়ি?
হ্যাঁ। এবার পার্থ জবাব দিল, সঙ্গে গাড়ি থাকলে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানোর সুবিধে হয়। আপনারা বোধহয় পৌঁছেই জিপ ছেড়ে দিয়েছেন?
আমাদের তো হেঁটে হেঁটেই কাজ, গুঁফো লোকটা সঙ্গীকে বললেন, তাই না কর্মবীর?
এতক্ষণে স্বর ফুটেছে মিতিনের। গুম্ফধারীকে বলল, ও, আপনিই তা হলে শক্তিধর সমাদ্দার?
কর্মবীর বিস্মিত মুখে বললেন, আপনি ওর নাম জানলেন কী করে?
ওঁকে দেখে শক্তিধর বলে মনে হল কিনা, মিতিন চোখ তেরচা করল, আপনি বছর দশেক আগে বক্সিং-এ একবার ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। সম্ভবত মিডল ওয়েটে। ঠিক বলছি?
শক্তিধরের ভুরু জড়ো হল, হ্যাঁ, তখন কাগজে ফোটো বেরিয়েছিল বটে। কিন্তু অ্যাদ্দিন পরও আপনার মনে আছে?
না, না। এখানকার রেজিস্টারেও তো আপনাদের নাম দেখলাম। তা আপনারা এখানে কী কাজে?
কাজ? কই না তো, কর্মবীর তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আমরাও বেড়াতেই এসেছি। আমাদের দুজনেরই জঙ্গল খুব প্রিয় কিনা। এই তো, এখন নৌকো নিয়ে বেরোচ্ছি।
সে কী, আপনারা নৌকো ভাড়া করে ফেলেছেন? পার্থ হতাশ মুখে বলল, আমরা যে ভাবছিলাম! তা ফিরছেন কখন?
ঠিক নেই। হয়তো সারাদিনই ঘুরব। ড্রাই লাঞ্চ মজুত করে নিয়েছি।
বুমবুম হায় হায় করে উঠল, এ মা, তা হলে আমাদের নৌকো চড়ার কী হবে?
তোমরা কাল যেয়ো, শক্তিধর বুমবুমের গাল টিপে দিলেন। খানিকটা যেন তড়িঘড়ি করে বললেন, আমরা আসি তা হলে?
অদূরে অপেক্ষা করছিল ডিঙি নৌকো। দু’জনে গিয়ে চড়তেই বয়স্ক মাঝি যাত্রা শুরু করেছেন। স্রোতের টানে ভালই গতি নিয়েছে ডিঙি। টুপুররা সেদিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে।
একটু পরে পার্থ বলল, অতঃ কিম?
টুপুর বলল, আমরা তা হলে লবঙ্গিতেই রওনা হয়ে যাই।
তুৎ, সে তো যাব দুপুরে। খাওয়াদাওয়ার পর। গাড়ি ছাড়া তো লবঙ্গি যাওয়া যাবে না, সুতরাং বিভূতিবাবুকে চাই।
কেন, তুমি ড্রাইভ করতে পারবে না? কিংবা মিতিনমাসি?
আমরা রাস্তা চিনি নাকি? বনেজঙ্গলে কোথায় ঘুরে মরব? তার চেয়ে বরং বাংলোর আশপাশেই চরে বেড়াই। বাংলোর পিছন থেকেই তো ফরেস্টের শুরু, ওদিকেও খানিকটা ঢুঁ মারতে পারি।
সকালটা ফালতু ফালতু গড়িয়ে যাক, কারওই কাম্য নয়। সুতরাং সকলেই রাজি। চটপট বাংলোয় ফিরে পিছনে যাওয়ার রাস্তা ধরেছে। সামান্য একটু চড়াই, তারপর বনপথের শুরু।
উঠতে গিয়ে থমকাল টুপুর। তাদের বাংলোর পিছনে একটা শ্রীহীন ছোট্ট কোয়ার্টার। সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েছে মিতিনমাসি৷ ঝুঁকে কী যেন করছে।
টুপুর দৌড়ে এল, কী গো? কী দেখছ?
মাটি থেকে একচিলতে গুঁড়ো তুলল মিতিন। আঙুলে ঘষে পরীক্ষা করে দেখছে গাঢ় সবুজ রঙের পাউডার। বিড়বিড় করে বলল, ক্রোমিয়াম সালফেট!
সেটা কী?
জবাব না দিয়ে মিতিন বলল, এখন জঙ্গলে ঢুকে কাজ নেই। চল, আবার ঘড়িয়ালগুলোকে দেখি।