১-২. ফাঁপরে পড়েছে টুপুর

এবার গরমের ছুটিতে মিতিনমাসির বাড়িতে বেড়াতে এসে ভারী ফাঁপরে পড়েছে টুপুর। ভেবেছিল শুয়ে-বসে-গড়িয়ে বেশ কেটে যাবে দিনগুলো। আয়েশ করে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোবে, চলবে অফুরন্ত গল্প-আড্ডা, শখ করে নিত্যনতুন পদ রাঁধবে মিতিনমাসি, মাঝেমধ্যে হোটেল-রেস্তরাঁয় ভূরিভোজ খাওয়াতে নিয়ে যাবে পার্থমেসো। আর যদি কোনও কেস টেস এসে গেল তো সোনায় সোহাগা। উত্তেজনার আঁচে সেঁকে নিতে পারবে নিজেকে। কিন্তু কোথায় কী? মিতিনমাসির হাত এখন বেবাক ফাঁকা এবং এক আজব ভূত চেপেছে মাথায়। টুপুর নাকি বেজায় প্যাংলা হয়ে যাচ্ছে, তার শরীরস্বাস্থ্য মজবুত করা নাকি বেজায় জরুরি। ব্যস, ভাবামাত্র কাজ। তৈরি হয়ে গেল টুপুরের ডেলি রুটিন। আর তারই জের সামলাতে বেচারা টুপুরের রীতিমতো নাজেহাল দশা।

কী যে সব ফতোয়া জারি করেছে মিতিনমাসি! কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটায় শয্যাত্যাগ, আদা-গুড় ভেজানো ছোলা সহযোগে খানিক কাঠবাদাম ভক্ষণ, তারপর বেরিয়ে পড়ো মাসির সঙ্গে প্রভাতী ভ্রমণে। নামেই ভ্রমণ, আসলে হাড়ভাঙা খাটুনি। পেল্লাই রবীন্দ্র সরোবরটিকে হনহনিয়ে দু’বার পাক মারা, তারপর হরেকরকম শারীরিক কসরত…। বাড়ি ফিরে দুধ-কর্নফ্লেক্স, ডিমসেদ্ধ, কলা। দু’ঘণ্টা পরে ফলের রস। দুপুরে প্রচুর শাকসবজি, কম তেলমশলার মাছ, সঙ্গে এক বাটি টক দই। বিকেল চারটেয় এক ঘণ্টা যোগাসন। ফের ফল-দুধ। লুচি-পরোটা-চপ-কাটলেট একেবারে বন্ধ। তার বদলে স্টু-সুপ কিংবা ইডলি ফিডলি গোছের কিছু। নৈশাহারেও প্রায় একই ধরনের অখাদ্য। তাতেও মুক্তি নেই, খাওয়ার পর ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদে গিয়ে হাঁটতে হচ্ছে আধঘণ্টা। বুমবুম তো খাবার দেখলেই ওয়াক তুলছে। একমাত্র পার্থমেসোরই কোনও হেলদোল নেই। প্রেসে গিয়ে মোগলাই খানা সাঁটাচ্ছে দেদার, শুধু বাড়িতে ভালমানুষটি সেজে থাকছে। এমন একটা গরমের ছুটি এ বাড়িতে কখনও কাটেনি টুপুরের। সাত দিনেই মনটা পালাই পালাই করছে।

আজও সকালটা একই ভাবে শুরু হয়েছিল। রবীন্দ্র সরোবরে চক্কর কেটে, ব্যায়াম ট্যায়াম করতে করতে জিভ প্রায় বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। গাছে গাছে কোকিল ডাকছে, ফুরফুরে হাওয়াও দিচ্ছে, কিন্তু টুপুর যেন কিচ্ছু টের পাচ্ছিল না। খানিক তফাতে লাফিং ক্লাবের একদল সদস্য বিকট কায়দায় হাসির অনুশীলন চালাচ্ছে, সেদিকেও তাকানোর অবকাশ নেই। ঘামে ভিজে জ্যাবজ্যাবে হয়ে গেছে তার ট্র্যাকসুট, তবু মাসির নির্দেশ মতো হাত-পা ছুড়ছে এক মনে।

হঠাৎই শরীরচর্চায় বিঘ্ন ঘটল। বড় বড় পা ফেলে কে উনি আসছেন এদিকে? অনিশ্চয় আঙ্কল না?

হ্যাঁ, জাঁদরেল পুলিশ অফিসার অনিশ্চয় মজুমদারই বটে। একেবারে সামনে এসে একগাল হাসলেন অনিশ্চয়, জানতাম ম্যাডামকে এখানেই পাব।

মিতিন ধনুকের মতো বাঁকাচ্ছিল দেহটাকে। সিধে হয়ে বলল, সুপ্রভাত। আপনি হঠাৎ লেকে যে বড়? মর্নিংওয়াক ছেড়ে দিয়েছিলেন না?

আবার ধরেছি। মধ্যপ্রদেশটা যে হারে বেড়ে চলেছে…!

তো? ওই মধ্যপ্রদেশই তো আপনাদের শোভা দাদা। ভুঁড়ির সাইজ দিয়েই তো আপনাদের কর্মদক্ষতা মাপা হয়।

অনিশ্চয় সন্দিগ্ধ চোখে বললেন, ঠাট্টা করছেন না তো?

ছি ছি, তাই কখনও করতে পারি? মিতিন মজা করার সুরে বলল, তো এখন রোজই আসছেন নিশ্চয়ই?

এভরি সানডে। কোনও রোববারই বাদ দিই না।

গুড। ভেরি গুড। ওয়েস্টলাইনের উন্নতি কিছু হল?

পাক্কা তিন মিলিমিটার কমেছে। খুব একটা মন্দ নয়, কী বলেন? নিজের রসিকতায় নিজেই হা হা হেসে উঠলেন অনিশ্চয়। হাসিমুখে তাকালেন টুপুরের দিকে, কী গো মিস ওয়াটসন, তোমার কী সমাচার? এক্সারসাইজ করে কতখানি তাগদ বাড়ল? পারবে মাসির সঙ্গে কুস্তি লড়তে?

জবাব দিল না টুপুর। লাজুক লাজুক মুখে হাসল একটু।

অনিশ্চয় ফের ফিরেছেন মিতিনে, তা আপনার প্রফেশনের হালচাল কেমন? জালে এখন ক’খানা ক্লায়েন্ট?

একটিও না। কলকাতার লোকজন হঠাৎ খুব ভাল হয়ে গিয়েছে। ক্রাইম করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। অগত্যা সারাদিন মাছি তাড়াচ্ছি।

অর্থাৎ সুখেই আছেন। এদিকে আমরা পুলিশরা তো চুরিডাকাতি, খুনখারাপি সামলাতে সামলাতে জেরবার হয়ে যাচ্ছি, বলেই কয়েক সেকেন্ড চুপ। কী যেন ভাবছেন অনিশ্চয়। বললেন, আপনার হাত তা হলে এখন শূন্য?

বিলকুল।

একটা কেস আপনাকে দিতে পারি, বুঝলেন। একেবারেই ফাঁপা। তবে আপনাকে চালান করলে আমার মাথা একটু হালকা হয়।

কীরকম? কীরকম?

এক পাগলা বুড়ো আমায় বহুত বোর করছেন। তাঁর ফোনের ঠেলায় আমি জেরবার। অথচ ভদ্রলোকের সমস্যায় পুলিশের কিছুই করার নেই। সত্যি বলতে কী, আদৌ কোনও সমস্যা আছে বলে আমার মনেও হয় না। তা আপনি তো পেশাদার গোয়েন্দা, দেখুন যদি ওঁকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে আশ্বস্ত করতে পারেন।

অর্থাৎ আমাকে কাউন্সেলারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে?

অনেকটা সেই রকমই। তবে ওঁর কথাবার্তা থেকে যদি কোনও রহস্য খুঁজে বার করতে পারেন, সেটা আপনার বাড়তি লাভ।

কোথায় থাকেন ভদ্রলোক?

মাকুইস স্ট্রিটে। নাম ডেভিড যোশুয়া।

মিতিন ভুরু কুঁচকোল, ইহুদি নাকি?

ঠিক ধরেছেন তো। কলকাতায় এখন ইহুদিরা ডোডো পাখির মতো দুর্লভ। ইনি সেই বিরল প্রজাতিরই একজন।

হুঁ, এ শহরে এখন ইহুদির সংখ্যা সাকুল্যে একশো হবে কিনা সন্দেহ, মিতিন ঘাড় নাড়ল, তা প্রবলেমটা কী ভদ্রলোকের?

কিছুই না। আবার অনেক কিছু। ওঁর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে, কেউ সারাক্ষণ ওঁর উপর নজর রাখছে। সে মিস্টার যোশুয়া আর তাঁর স্ত্রীকে না মেরে ছাড়বে না। মাঝে মাঝেই নাকি তাঁর কাছে ঘোস্ট কল আসে। কে নাকি তাঁকে শাসায়। অথচ ওই নম্বরে মিস্টার যোশুয়া কল করে দেখেছেন, নম্বরটাই নাকি নেই।

যে ভয় দেখাচ্ছে, সে কেন মারবে তা কি বলেছেন মিস্টার যোশুয়া?

তিনি তো এক-এক সময়ে এক-এক কথা বলেন। কখনও বলেন আমার বাড়িটাকে গ্রাস করতে চায়। কখনও বলেন, আমার গোটা বংশটাকেই নিকেশ করে দেবে। আমার তো মনে হয়, সব কিছুই ওঁর মনগড়া ধারণা। যদিও ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় হয়নি, তবে খোঁজখবর নিয়ে যা জেনেছি উনি এমন কিছু অর্থবান ব্যক্তি নন যে, ওঁকে হত্যা করে কারও কোটি কোটি টাকা নাফা হবে।

তবু উনি যখন ভয় পাচ্ছেন, পুলিশের তরফ থেকে তো ওঁকে একটা প্রোটেকশন দেওয়া উচিত।

তুৎ, কী প্রোটেকশন দেব? যে কেউ ওরকম বললেই কি বাড়ির দরজায় চারজন করে পুলিশ দাঁড় করিয়ে রাখা যায়? পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কি খেয়েদেয়ে আর কোনও কাজ নেই? অনিশ্চয় মুখ বাঁকালেন, বরং এই সব ঝুটঝামেলা আপনারা সামলাতে পারবেন।

মিতিন একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ভদ্রলোক করেন কী?

একসময়ে গ্রেট ইন্ডিয়া হোটেলের চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। পোদ্দার কোর্টের কাছে আরও দু’খানা বাড়িও ছিল। সেখান থেকে কিছু ভাড়া টাড়াও পেতেন। সেই বাড়ি দুটো এখন বেচে দিয়েছেন। ব্যাঙ্কে জমানো টাকার সুদ থেকে সংসার চলে।

কে কে আছেন সংসারে?

 এখন তো শুধু বৃদ্ধ-বৃদ্ধাই থাকেন। একটিমাত্র ছেলে, সে বিদেশে সেটল্ড।

ও। তা এই ভদ্রলোকের মৃত্যুভয় কবে থেকে শুরু হয়েছে?

এগজাক্টলি বলতে পারব না। তবে মনে হয় দু-তিন মাস, অনিশ্চয় একটু থেমে থেকে বললেন, অবশ্য ভয় পাওয়ার বোধহয় একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। মিস্টার যোশুয়া আর তাঁর স্ত্রী লন্ডনে ছেলের কাছে গিয়ে বেশ কিছুদিন ছিলেন। ফিরেছেন বছর খানেক আগে। তিনি ফেরার পরপরই তাঁর ভগ্নিপতি মারা যান, তার মাস কয়েক পরে দিদি। দুটোই প্লেন ডেথ। হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু কেন যেন মিস্টার যোশুয়ার ধারণা হয়েছে, তাঁরা স্বাভাবিক ভাবে মারা যাননি। আর সেই ধারণা থেকেই মৃত্যুভয়ের সূত্রপাত। আপনিই বলুন ম্যাডাম, কেউ যদি এরকম অযথা ভয় পেতে শুরু করে পুলিশ কী করবে?

তা বটে। মিতিনকে একটু যেন চিন্তান্বিত দেখাল। কপাল কুঁচকে বলল, ঠিক আছে, ভদ্রলোকের ফোন নম্বরটা আমায় দিন, আমি যোগাযোগ করে নেব। তার আগে আপনি মিস্টার যোশুয়াকে আমার কথাটা জানিয়ে রাখুন।

শিয়োর। আমি আজই বলে দিচ্ছি। মোবাইল থেকে মিস্টার যোশুয়ার নম্বরটা বার করে মিতিনকে দিলেন অনিশ্চয়। তিনি চলে যাওয়ার পর টুপুর বলল, কেসটা তুমি নিয়ে নিলে?

হাতে তো এখন তেমন কাজকর্ম নেই। দেখি না ব্যাপারটা একটু নাড়াচাড়া করে।

কী দেখবে? মানে এখন তুমি কী করবে?

জানি না। আগে মিস্টার যোশুয়ার সঙ্গে মোলাকাত তো হোক, তারপর তো বোঝা যাবে।

বাড়ি ফিরে পার্থকে বলামাত্র সে রীতিমতো উত্তেজিত। চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞেস করল, কী নাম বললে? ডেভিড যোশুয়া? ইনি কি এলিস যোশুয়ার কোনও রিলেটিভ?

মিতিন জিজ্ঞেস করল, কে এলিস যোশুয়া?

কিছুই জানো না দেখি। জেনারেল নলেজটা একটু বাড়াও, পার্থ পায়ের উপর পা তুলে নাচাচ্ছে, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময়ে জাপানিরা যখন দক্ষিণ এশিয়ায় বম্বিং শুরু করে, তখন বার্মা, মানে এখন যাকে বলে মায়ানমার, সেখান থেকে অনেক ইহুদি পালিয়ে এসেছিল কলকাতায়। এলিস যোশুয়া ছিলেন তাঁদেরই একজন। কলকাতায় এসে তিনি প্রথমে গ্র্যান্ড হোটেলে চাকরি নিয়েছিলেন। তবে জানোই তো, ব্যবসা করাটা ইহুদিদের রক্তেই আছে। তাই কিছুদিন পরে চাকরি বাকরি ছেড়ে পার্ক স্ট্রিটে তিনি একটা ঘ্যামচ্যাক রেস্তরাঁ খুলে বসেন। কোন রেস্তরাঁ জানো? ট্রিঙ্কাস।

টুপুর অবাক হয়ে বলল, ওমা, সে তো এখনও চলছে।

তবে এখন বোধহয় অন্য কেউ কিনে নিয়েছে, পার্থ গলা ঝাড়ল। তারপর বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভঙ্গিতে মিতিনকে বলল, যাক গে, গোড়াতেই তোমাকে একটা ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া ভাল। টাকাপয়সার ব্যাপারে ইহুদিরা কিন্তু খুব হিসেবি। ভয়ংকর প্র্যাকটিকাল। ওরা নগদানগদি ছাড়া লেনদেন করে না। আশীর্বাদ পর্যন্ত ধারে দেয় না। সুতরাং কেস হাতে নিলেই টাকাপয়সার ব্যাপারটা ফয়সালা করে নেবে।

মিতিন হেসে বলল, আহা, দেখি আগে কেসটার কোনও সারবত্তা আছে কিনা?

ওই দেখতে যাওয়ার জন্যও ফি চার্জ করবে।

সে হবে খন। এখন বলো আজ ব্রেকফাস্টে কী খাবে?

 নতুন একটা কেস পাচ্ছ, সেই অনারে একটু মুখবদল হোক।

উত্তম প্রস্তাব। সেদ্ধ ডিমের বদলে আজ তা হলে পোচ হতে পারে।

আহা, বদলের কী ছিরি! কেন, একদিন লুচি তরকারি খেলে কী হয়? রবিবারের সকালে টোস্ট ফোস্ট পোষায়?

বেশ। আজ না হয় রুটিন ব্রেক।

বুমবুম ‘ইয়ায়া’ করে উল্লাস দেখিয়ে উঠল। পার্থ আহ্লাদে আটখানা। মুচকি হেসে অন্দরে চলে গেল মিতিন।

টুপুরের মনে হল একটা কাজের খোঁজ পেয়ে মিতিনমাসিও বেশ পুলকিত। কিন্তু কাজটা যে ঠিক কী? কোনও রহস্য আছে কি আদৌ?

.

০২.

প্রথম দর্শনে বাড়িখানা হতাশই করল টুপুরকে। জাদুঘরের পিছন দিকের এই রাস্তাটায়, শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে, এত জীর্ণ এক অট্টালিকা এখনও যে টিকে আছে টুপুর ভাবতেই পারে না। সত্যি বলতে কী, পেল্লায় উঁচু পাঁচিলটার অন্দরে আদৌ ঘরবাড়ি আছে কিনা তাই তো ঠাহর করা মুশকিল। ভাগ্যিস ভাঙাচোরা গেটের ধারের থামটায় পাথরের ফলকের উপর বড় বড় হরফে বাড়ির নম্বর লেখা। নইলে বোধহয় ঠিকানাটা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হত।

গাড়িটাকে ফটকের দিকে ঘুরিয়ে মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে রইল মিতিন। তারপর ঘড়ি দেখে বলল, সাড়ে পাঁচটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এখন সবে পাঁচটা দশ।

পাশেই পার্থ। আজ রবিবার বলে সেও যোগ দিয়েছে অভিযানে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, সো হোয়াট? চলো, ঢুকে পড়ি।

খোলা ফটকের ভিতরে এসে গাড়ি থেকে নামল টুপুররা। এদিক-ওদিক চোখ চালিয়ে টুপুর আরও নিরাশ। মূল বাড়িখানা ঘিরে জমি আছে অনেকটা। কিন্তু সেখানে ফুল নেই, বাগান নেই, শুধু ঝোপঝাড় আর আগাছা। বোঝাই যায় মোটেই রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। বাড়িটারই বা কী দশা! আকারে যথেষ্ট ঢাউস এবং দোতলা। গায়ে চেকনাই তো দূরস্থান, পলেস্তারা পর্যন্ত খসে খসে পড়ছে। এমন একটা ভগ্নস্তূপে এসে আজকের বিকেলটাই বরবাদ হল না তো?

অদূরে এক গাড়িবারান্দার মতো জায়গা। সম্ভবত গাড়ির আওয়াজ পেয়ে এক দীর্ঘাকৃতি প্রবীণ আবির্ভূত হয়েছেন সেখানে। মুখমণ্ডলে ধবধবে সাদা দাড়ি, পরনে ঢলঢলে পাজামা আর এই গরমেও লম্বা ঝুলের কোট। মাথায় ফেজটুপি, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। সব মিলিয়ে যেন কেমন কেমন। সময়ের সঙ্গে যেন নিতান্ত বেমানান।

হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এলেন ভদ্রলোক। বিচিত্র বাংলা উচ্চারণে বললেন, আমিই ডেভিড যোশুয়া। অধীনের গৃহে পদধূলি দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

মিতিন হাতজোড় করে নমস্কার করল। পার্থ আর টুপুরের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিল মিস্টার যোশুয়ার। গাড়িবারান্দার লাগোয়া তিন ধাপ লাল সিঁড়ি। গৃহকর্তার সাদর আহ্বানে সিঁড়ি পেরিয়ে ড্রয়িংহলে এল টুপুররা।

বিশাল হলঘরখানায় পা রেখে টুপুরের চক্ষুস্থির। বাইরের হতশ্রী রূপের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। দেওয়াল খানিক রংজ্বলা বটে, তবে আসবাবপত্র ঝকঝক করছে। কাঠের সাবেকি প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সোফাসেট, পাথর বসানো সেন্টারটেবিল, পুরনো কিন্তু পরিচ্ছন্ন কার্পেট, সিলিং থেকে ঝুলছে কাচের বাতিদান, কারুকাজ করা স্ট্যান্ডল্যাম্প, প্রাচীনতার গন্ধ মাখা শোকেস, লম্বা লম্বা জানলায় ভারী ভারী পরদা…। এক পাশে একটি গ্র্যান্ড পিয়ানো শোভা পাচ্ছে। দেওয়ালে খান চারেক অয়েল পেন্টিং। সব ক’টা ছবিতেই দাড়িওয়ালা টুপিধারী পুরুষ। তাঁদের পরনেও মিস্টার যোশুয়ার ছাঁদেরই পোশাকআশাক। বেশ টের পাওয়া যায়, ঘরের আবহাওয়া একটু অন্যরকম। সময় যেন বহু বছর ধরে থমকে আছে এখানে।

টুপুরদের বসতে বলে ডেভিড জিজ্ঞেস করলেন, এখন তো গরমের দিন, প্রথমে একটু শরবত নেবেন কি?

মিতিন বিনয়ের সুরে বলল, যদি আপনার অসুবিধে না হয়…।

কী বলছেন ম্যাডাম? অতিথিদের আপ্যায়ন করা তো ইহুদিদের ধর্ম, স্মিত মুখ ডেভিডের স্বর সামান্য উচ্চগ্রামে উঠল, যতীন, একবার শুনে যাও তো।

বাক্য ফুরোনোর আগেই বছর তিরিশের যতীন উঁকি দিয়েছে দরজায়। চেহারা একেবারেই কাজের লোকের মতো নয়, বরং দেখে বাড়ির একজনই মনে হয়। পরনে তার জিক্স-টিশার্ট, হাতে ঘড়ি, চুল বেশ কায়দা করে ছাঁটা।

মনিবের নির্দেশ নিয়ে সে চলে যেতেই মিতিন জিজ্ঞেস করল, ছেলেটি বাঙালি মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ। আমার এক বাঙালি বন্ধু জোগাড় করে দিয়েছেন। ভাল ছেলে। আমাদের এই বুড়োবুড়ির দেখভাল করে।

পার্থ অনেকক্ষণ ধরেই কথা বলার জন্য উসখুস করছিল। ফস করে বলে উঠল, যদি কিছু মনে না করেন… মিস্টার এলিস যোশুয়া কি আপনাদের কেউ হন? মানে যিনি ট্রিঙ্কাসের মালিক ছিলেন?

পদবি যখন যোশুয়া, আত্মীয় তো বটেই, কাঠের দোলচেয়ারে বসলেন ডেভিড। হেলান দিয়ে বললেন, এলিস ছিলেন আমার দূরসম্পর্কের কাকা। এলিসের ঠাকুরদা ছিলেন আমার বাবার ঠাকুরদার ফার্স্ট কাজিন। আমরা সিরিয়া থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলাম। ওঁর পূর্বপুরুষ গিয়েছিলেন রেঙ্গুন। ওঁরা কলকাতায় আসার পর আমার বাবাই তো এলিসকে চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিলেন। সেই ১৯৪৪ সালে। তখন আমি খুবই ছোট। বছর দশেক।

আপনার তো তা হলে অনেক বয়স? সেভেনটি এইট চলছে। দেখে কিন্তু বোঝা যায় না। মনে হয় বড়জোর সত্তর টত্তর…

শুনে ভারী খুশি হয়েছেন ডেভিড। দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, নিয়ম কানুন মেনে চলি, শরীরের যত্ন নিই, তাই অসুখবিসুখ বড় একটা কাছে ঘেঁষে না।

আপনারা তো বাগদাদি ইহুদি, তাই না?

কলকাতায় প্রায় সব ইহুদিই তো বাগদাদি। অল্প কয়েক ঘর বেনে ইজরাইলিও ছিল। তবে এখন তারা প্রায় সকলেই ভারত থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে। একমাত্র টিকে আছেন জ্যাকব পরিবার। তারাও তো শুনলাম আমাদের পবিত্র ভূমিতে চলে যাচ্ছেন।

মানে ইজরায়েলে?

মৃদু ঘাড় নাড়লেন ডেভিড। একটু উদাস স্বরে বললেন, কলকাতায় আমরা এখন ইহুদিরা আছি উনচল্লিশ জন। সংখ্যাটা এবার ছত্রিশে নেমে যাবে।

ঘরের পরিবেশ একটু যেন ভারী হয়ে যাচ্ছিল, কথা ঘোরানোর জন্যই মিতিন সরব হয়েছে, মিস্টার যোশুয়া, আমরা কি এবার আপনার সমস্যাটার ব্যাপারে একটু আলোচনা করতে পারি?

অবশ্যই। আপনার মূল্যবান সময়ের অপচয় ঘটানো তো ঠিক নয়।

ডেভিড সোজা হয়ে বসলেন, আপনাকে নিশ্চয়ই মিস্টার অনিশ্চয় মজুমদার খানিকটা বলেছেন?

আমি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। বিশদে।

একটুক্ষণ চিন্তা করলেন ডেভিড। তারপর দু’দিকে মাথা নেড়ে বললেন, কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু আমি সত্যি সত্যি বড় বিপন্ন বোধ করছি।

কেন?

গত সাত-আট মাসের মধ্যে এমন কয়েকটা ঘটনা ঘটল…।

যেমন?

প্রথমে আমার দিদির হাজব্যান্ডের মৃত্যু।

কী হয়েছিল তাঁর?

আমাদের ডাক্তার তো বলল হার্ট অ্যাটাক। যদিও তাঁর বয়স হয়েছিল ছিয়াশি, কিন্তু আব্রাহামের শরীর-স্বাস্থ্য ছিল আমার চেয়েও মজবুত। নো প্রেশার, নো সুগার, নাথিং।

এরকম তো হয় মিস্টার যোশুয়া। কোনও সিম্পটম নেই, অথচ দুম করে করোনারি অ্যাটাক হয়ে গেল।

সে আমি জানি ম্যাডাম। কিন্তু আব্রাহামের মৃত্যুটা…। সেদিন এ বাড়িতে একটা পরব চলছিল। প্রার্থনার পর খানিকক্ষণ গানবাজনাও হল। আমাদের ইহুদি সমাজের বাইরেরও অনেকে সেদিন এসেছিলেন। আব্রাহাম তাঁদের সঙ্গে কত হাসিগল্প করলেন। আমাদের ডাক্তারের বাঁশি বাজানো শুনে দারুণ তারিফ করলেন। অথচ সেই মানুষটাই অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পনেরো-বিশ মিনিটের মধ্যে ধড়ফড়িয়ে শেষ।

হার্ট অ্যাটাকের কেসে এমনও তো হরবখতই ঘটে মিস্টার যোশুয়া। আপনার জামাইবাবুর যথেষ্ট বয়স হয়েছিল। হয়তো ওঁর শরীর সেদিনকার আমোদ-আহ্লাদের ধকল নিতে পারেনি…।

ডাক্তারেরও একই অভিমত। আমি কিন্তু মানতে পারিনি। তখনই মনে হয়েছিল মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়।

সঙ্গে সঙ্গে জানাননি কেন?

পুলিশকে তো জানিয়েছিলাম। পোস্টমর্টেমও হয়েছিল।

 টুপুর জোর চমকেছে। অনিশ্চয় আঙ্কল এ তথ্যটা তো দেননি!

মিতিনেরও চোখে বিস্ময়, তাই নাকি? তা পোস্টমর্টেমে কী পাওয়া গেল?

কিছুই না। সেই ডাক্তারও বললেন, হার্ট বন্ধ হয়েই…।

হুম। মিতিনের কপালে পলকা ভাঁজ পড়েই মিলিয়ে গেল, এর পর আপনার দিদির মৃত্যু?

ইয়েস। দিদি মারা গেলেন আর একটা পরবের দিন। সেদিন তো অনুষ্ঠান চলাকালীনই ক্যাথলিন হঠাৎ…। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এ ঘরে সবে ঢুকেছে, অমনি কেমন যেন একটা আওয়াজ করে উঠল, তারপরই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। সেদিনও ডাক্তার বাড়িতে মজুত। আমাদের অনুষ্ঠানেই ছিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করলেন তিনি। কিন্তু তখন আর ক্যাথলিন বেঁচে নেই। এমনই কপাল, চিকিৎসা করানোর সুযোগটা পর্যন্ত মিলল না।

এই মৃত্যুটাও আনন্যাচারাল মনে হয়েছে আপনার?

 হ্যাঁ।

এবারও পোস্টমর্টেম করিয়েছিলেন?

তুলেছিলাম কথাটা। তবে উপস্থিত সবাই আমাকে ধমকে ধামকে থামিয়ে দিল। আমারও মনে হল এবারও যদি কাটাছেঁড়া করে কিছু না পাওয়া যায়…, ক্ষণকাল নীরব থেকে ডেভিড ফের বললেন, আচ্ছা ম্যাডাম, স্বামী-স্ত্রী দুজনই দুটো উৎসবের রাতে প্রাণ হারালেন, এর মধ্যে কি আপনি কোনই যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছেন না?

আপনি কি পেয়েছেন?

কিছু তো পেয়েছি। নইলে আর ছটফট করছি কেন? ঘটনা পরম্পরা বিচার করলে আপনিও হয়তো…।

কীরকম?

তা হলে আর একটু ডিটেলে বলি। আমার দিদির হাজব্যান্ড আব্রাহাম মাটুক, যাঁর পুরো নাম আব্রাহাম এলিজা এজিকিয়েল মাটুক, ছিলেন এক বিখ্যাত ইহুদি ব্যবসায়ী পরিবারের বংশধর। এককালে চিনদেশে আফিম পাঠানোর কারবার ছিল তাঁদের। নিজস্ব জাহাজও ছিল। আফিমের ব্যবসা নিষিদ্ধ হওয়ার পর ওঁরা কাপড়ের কারবার শুরু করেন। এখন সব বেচেবুচে দিয়েছিলেন, তবে আব্রাহামের টাকাপয়সা কম ছিল না। যেহেতু আব্রাহাম আর ক্যাথলিনের কোনও ছেলেপুলে নেই, আব্রাহামের মৃত্যুতে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি চলে আসে আমার দিদির নামে এবং দিদি মারা যাওয়ার পর আমিই এখন ওঁদের ধনসম্পদের মালিক। এই ব্যাপারটা আমার কেমন গোলমেলে ঠেকছে।

পার্থ অবাক মুখে বলল, সে কী? কেন?

কারণ ক্যাথলিন আগে মারা গেলে আব্রাহামের কানাকড়িও আমার নামে আসত না। আইন অনুযায়ী আব্রাহামের ভাইপোরা পেত সব কিছু।

আব্রাহামরা ক’ ভাই?

 তিন। দু’ভাই অনেককাল আগে অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়েছিলেন। এখন ভাইপোরা সব সিডনির পাকাপাকি বাসিন্দা।

তারা এ দেশে আসে না?

 একেবারেই না। তাদের এই শহরের উপর কোনও টানই নেই। যদিও এখানেই তারা স্কুলজীবনটা কাটিয়েছে। পার্ক স্ট্রিটের ইহুদি স্কুল থেকে তারা পাশ টাশ করেছিল।

উম, পার্থ বিজ্ঞের মতো মাথা দোলাল, তা হলে তো একটা কথা বলতেই হচ্ছে মিস্টার যোশুয়া। যদি ওই দুটো মৃত্যুতে সত্যিই কোনও গড়বড় থাকে…!

আছে। আমি নিশ্চিত।

তা হলে সাসপেক্টের তালিকায় প্রথম নামটা কার হবে জানেন তো? আপনার। পার্থ ডেভিডের দিকে আঙুল দেখাল, কারণ, মৃত্যুর ক্রম অনুসারে আপনিই একমাত্র লাভবান ব্যক্তি।

জানি তো। সত্যি বলতে কী, আব্রাহামের ভাইপোরা তো আমার উপর যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। আভাসে ইঙ্গিতে সে কথা জানিয়েওছে ফোনে, একটু যেন নিষ্প্রভ শোনাল ডেভিডের গলা, তবে এতে আমি দোষের কিছু দেখি না। আব্রাহামের পর ক্যাথলিন মারা যাওয়াতে লাভ তো আমার হয়েছেই। বিপুল লাভ। টাকাপয়সার কথা বাদই দিন, এই বাড়িখানা, চারপাশের জমি সবই তো ছিল আব্রাহামের। ভাগ্যের খেলায় সবই এখন আমার।

পার্থ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, বলেন কী? তা হলে আপনার নিজের বাড়িটা কোথায়?

ছিল। এজরা স্ট্রিটে। একটা অংশে থাকতাম, বাকিটুকু দোকান টোকানকে ভাড়া দেওয়া ছিল। তিন বছর আগে বেচে দিয়ে উঠে এসেছিলাম এ বাড়িতে। আব্রাহাম আর ক্যাথলিনের জোরাজুরিতে। বুড়ো বয়সে একসঙ্গে থাকলে দিনগুলো খানিক আনন্দে কাটবে, এরকমই ভেবেছিলাম আমরা। জিহোভা সেই সুখটাও বেশিদিনের জন্য দিলেন না। এখন মনে হয় আমরা যদি এ বাড়িতে না আসতাম, তা হলে হয়তো…

কথা শেষ হল না, শরবতের ট্রে নিয়ে ঢুকেছে যতীন। সঙ্গে এক বয়স্কা মহিলা, তাঁর হাতে আর একখানি ট্রে। তাতে কাজু কিশমিশ খেজুর সাজানো। ট্রে দু’খানা টেবিলে নামিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন মহিলা। ইংরেজিতে বললেন, আমি র‍্যাচেল যোশুয়া। ডেভিডের স্ত্রী।