মাত্র বিশ-তিরিশ ফিট নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা বিপাশা। ঝুমঝুম শব্দ বাজিয়ে। এবড়োখেবড়ো ঢাল বেয়ে সেদিক পানে নামছিল টুপুর। সঙ্গে বুমবুম। মিতিন-পার্থও আসছে পিছন পিছন। সতর্ক পায়ে। চার মূর্তিরই পোশাকে আজ ভারী মিল। পরনে জিন্স আর জ্যাকেট। পায়ে স্নিকার। সহেলি-অবনী উপরে দাঁড়িয়ে। দু’জনেই দেখছেন টুপুর-মিতিনদের অবতরণ।
সহেলি চেঁচিয়ে বললেন, অ্যাই, সাবধানে সাবধানে। নীচে শুধু পাথর! একটা হোঁচট খেলেই কেলেঙ্কারি ঘটবে।
কিছু হবে না মা, টুপুর গলা তুলে বলল। আরও নেমে একটা বড়সড় প্রস্তরখণ্ডের উপর ব্যালান্স করে দাঁড়িয়েছে। ঝুঁকে সন্তর্পণে ছুঁল বহতা ধারাকে। পলকে আঙুল সরিয়ে নিয়েছে। হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, উপস, কী ঠান্ডা!
পার্থর কাঁধে ক্যামেরা। শাটার টিপছে পটাপট। নদীর গতিপথে ক্যামেরা তাক করে বলল, হবে না? ডাইরেক্ট বরফগলা জল। রোটাং-এর হিমবাহ থেকে রওনা দিয়ে কতটুকুই বা এসেছে!
কী স্বচ্ছ গো জলটা! কাচের মতন। তলার নুড়িপাথর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়।
নদী যতক্ষণ পাহাড়ের কোলে, ততক্ষণ সে এরকমই। নোংরা তো হয় সমতলে গিয়ে।
তা বটে।
নিজের মনে মাথা দোলাল টুপুর। সত্যি, পাহাড়ে বুঝি কোনও মালিন্যই টিকতে পারে না। নদীর জলে, নদীর পারে, কত ছোট-বড় পাথর, তারাও যেন চকচক করছে। সূর্য এখন পশ্চিম গগনে। তার নরম রোদ্দুর যেন পালিশ মারছে পাথরে। জলেও সোনালি আভা ঝিকমিক।
সকাল থেকে টুপুর যা দেখছে, সবই তো অপরূপ। ঘুম থেকে উঠে যেই না জানলার পরদা সরাল, অমনি সামনে সবুজ পাহাড়। পাইন আর দেবদারুতে ছাওয়া। নীচে শ্যামল উপত্যকা, মধ্যিখান দিয়ে বয়ে চলেছে রুপোলি আঁকাবাঁকা নদী। তাকিয়ে থাকলে চোখ জুড়িয়ে যায়। তারপর তো জলখাবার খেয়ে নটা নাগাদ বেরোনো হল, তখন থেকে ডুবে আছে নিসর্গশোভায়। মেন রোডে গাড়ি থেকে নেমে তিন-চার কিলোমিটার হেঁটে বৈষ্ণোদেবীর মন্দিরে গেল। ওই পথটাও কী সুন্দর! দু’পাশে পাহাড়ের গায়ে অজস্র নাম না-জানা ফুল, কত যে তাদের রঙের বাহার! বিজলেশ্বর মন্দিরে যাওয়াটাও বৃথা হয়নি। বিপাশা আর পার্বতী নদী যেখানে মিলেছে, সেই জায়গাটাও যে কী দারুণ লাগে উপর থেকে। বাড়তি জুটল মন্দিরের গল্পটা। প্রতি বছর নাকি বাজ পড়ে শিবলিঙ্গটি চুরমার হয়ে যায়। আর পুরোহিত নাকি ছাতুর সঙ্গে মাখন মিশিয়ে সেটিকে ফের জুড়ে দেন। ওই রাস্তাটা খানিক গোলমেলে ছিল। সঙ্গে টিঙ্কু সিং থাকায় অবশ্য তেমন অসুবিধে হয়নি। এই গোটা উপত্যকাটাই এমন হাতের তালুর মতো চেনে টিঙ্কুভাই।
সেই টিঙ্কুই এবার হাত নেড়ে-নেড়ে ডাকছে টুপুরদের। সহেলি বিকেল বিকেল মেলায় ঘোরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অবনীও বুঝি তাড়াতাড়ি মেলা দেখে কটেজে ফিরতে চান। ওশিয়ানোগ্রাফির বই বোধহয় টানছে তাকে।
পার্থ-টুপুর কারওরই কিন্তু এখন নদী ছেড়ে নড়ার ইচ্ছে নেই। দুপুরে পেট পুরে পরোটা-কাবাব খেয়েছে, এখন একটু পাথরে বসে রোদ পোহালে ভাল লাগবে। তবে সহেলি অধৈর্য হলে তো উপায় নেই। পায়ে পায়ে সকলকে উপরে উঠতেই হয়।
গাড়িতে বসে বুমবুম একটা ছোট্ট পাথর বার করেছে পকেট থেকে। পার্থকে দেখিয়ে বলল, একদম ফিশের মতো দেখতে না?
পাথরটা নাড়াচাড়া করে পার্থ নাক চুলকে বলল, জীবাশ্ম হতে পারে।
মানে?
মাছের ফসিল।
টুপুর অবাক গলায় বলল, কুলুতে মাছের ফসিল?
থাকতেই পারে। গোটা হিমালয়টাই তো এককালে সমুদ্রের তলায় ছিল। মাত্র কয়েকশো কোটি বছর আগে একটা স্থলভূমি যখন এসে এশিয়ায় জুড়ে যায়, তখনই ধাক্কার চোটে হিমালয় ঠেলে উঠেছে। অতএব সামুদ্রিক মাছের ফসিল হিমালয়ে পাওয়া কোনও আশ্চর্যের নয়।
মিতিন অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল। এতক্ষণে তার গলা বেজেছে, কল্পনাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল বোধহয়।
কেন? হিমালয় তৈরি হওয়ার ইতিহাসটা কি ভুল?
না। তবে মাছের ফসিল টসিল কুলুর মতো জায়গায় মিলবে না। সেগুলো পাওয়া যেতে পারে আরও অনেক উঁচুতে, বরফের রাজ্যে।
পার্থ আমতা আমতা করে বলল, একটা-দুটো পিস হয়তো নদীর স্রোতে চলে এসেছে।
জলে ভাসতে ভাসতে? নাকি গড়াতে গড়াতে?
ব্যঙ্গটা শুনে গুম হয়ে গেল পার্থ। আর কথাটি বলছে না। গাড়ি ঢালপুর ময়দান পৌঁছে গিয়েছে। বেজার মুখে নামল সিট থেকে। একে একে অন্যরাও। বুমবুম তো তিরবেগে ছুটেছে মেলার পানে, টুপুর ধাওয়া করল তাকে। সকালে অনেকটা হেঁটে কাহিল হয়ে পড়েছিলেন সহেলি, সামনে দেদার দোকানপাট দেখে তার হাঁটু-কোমরের ব্যথা উধাও, জ্বলজ্বলে মুখে কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
মেলাখানা সত্যিই তারিফ করার মতো। হরেক জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছে পাহাড়ি মানুষরা। মুখোশ, টুপি, শাল, শাড়ি, সোয়েটার, জ্যাকেট আর গয়না তো আছেই, সঙ্গে হাতে বানানো আরও কতরকম যে সামগ্রী! বেশ কিছু তাঁবু পড়েছে মেলার মাঠে। একটি তো রীতিমতো জমকালো। মাথায় অনেক পতাকা উড়ছে। ওই তাঁবু নাকি কুলুর রাজার। এক জায়গায় সিমেন্টের গ্যালারিতে চলছে নাচাগানা। কোথাও নানান ঠাকুর-দেবতার মূর্তি।
টুপুর মূর্তিগুলোর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বুমবুমের হাত খামচে ধরে একটা পিতলের প্রতিমা দেখিয়ে পার্থকে জিজ্ঞেস করল, ওটা কোন ঠাকুর গো মেসো?
সম্ভবত মানালির হিড়িম্বা টেম্পলের দেবী, পার্থর গোমড়া জবাব, ঠিক বলছি কিনা তোর মাসির কাছে জেনে নে।
মিতিন হেসে ফেলল, না-না, ঠিকই বলছে। ওটা হিড়িম্বা মন্দিরের দুর্গা।
এখানে আনা হয়েছে কেন?
কুলুর দশেরা মেলায় এটাই তো রেওয়াজ, পার্থর জ্ঞানী জ্ঞানী ভাবটা ফিরে এসেছে। চোখ নাচিয়ে বলল, গোটা উপত্যকার নানান গ্রাম থেকে এখানে দেবদেবীদের আনা হয় দশমীর দিন। টানা দশ দিন দেবদেবীরা এখানেই থাকেন।
দশেরায় রাবণবধ হয় না?
হয়। তবে দশমীতে নয়, মেলার শেষ দিন। স্টাইলটাও আলাদা রকম। রাবণের কোনও পুত্তলিকা পোড়ানো হয় না। তার বদলে রাবণের সিম্বল হিসেবে ঘাসের স্তূপে আগুন ধরানো হয় বিপাশার পারে। আর সেদিন বসে দেবতাদের দরবার। লোকাল লোকজন যে যার পছন্দমতো দেবতার কাছে মনস্কামনা জানায়। সেদিন নাকি মহা ধুমধাম…
পার্থর বক্তৃতায় বাধা পড়ল। বুমবুম টানছে বাবাকে। এক্ষুনি তার নাগরদোলা চাই, ক্যান্ডিক্লস চাই, রঙিন টুপি চাই।
মিতিন বলল, তুমি যাও বুমবুমকে নিয়ে। আমি আর টুপুর একটু চরকি মারি।
কেন? টুপুর জায়েন্ট হুইল চড়বে না?
টুপুরের খুব ইচ্ছে ছিল যাওয়ার। কিন্তু মিতিনমাসির সঙ্গ ছাড়তেও মন চাইছে না যে। কালকের পেনড্রাইভখানা দেখার পর থেকে মিতিনমাসি কী ভাবছে, কী করবে, বুঝতে হবে তো। সারাদিন মাসির সঙ্গে সেঁটে না থাকলে যদি কিছু মিস হয়ে যায়!
মাথা ঝাঁকিয়ে টুপুর বলল, এখন থাক। পরে না হয়…
অ্যাজ ইউ উইশ!
বুমবুম-পার্থ চলে গেল। অবনী আর সহেলিও কোথায় হারিয়ে গিয়েছেন কে জানে! মিতিনের পাশে পাশে হাঁটছিল টুপুর। এক প্রকাণ্ড চেহারার তিব্বতি কুলুর পোশাক বিক্রি করছে। মেয়েদের হাঁটুঝুল উলের জামাগুলো বেশ বাহারি। দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করছিল টুপুর, হঠাৎ কাঁধে মিতিনের চাপ।
টুপুর ঘাড় ফেরাল, কী গো?
ওই দ্যাখ।
মিতিনমাসির দৃষ্টি অনুসরণ করে টুপুরের চোখ বড় বড়। খানিক তফাতে, একটু ফাঁকা মতো জায়গায়, এক দাড়িওয়ালা সাহেবকে চেয়ারে বসিয়ে কে তার প্রতিকৃতি আঁকছে?
টুপুরের স্বর ঠিকরে উঠল, কালকের সেই বৈজনাথ রাই না?
ইয়েস। আয় তো আমার সঙ্গে।
আঁকায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে বৈজনাথের ঠিক পিছনটাতে গিয়ে দাঁড়াল মিতিন। নিঃশব্দে দেখছে শিল্পীর কারিকুরি। বৈজনাথও সাহেবের মুখোমুখি একটি টুলে আসীন, হাতে পিচবোর্ডের উপর সাদা কাগজ, একবার করে চোখ উঠিয়ে দেখছেন সাহেবকে, পরক্ষণে চলছে তার স্কেচ পেনসিল। এতই মগ্ন, মিতিন-টুপুরদের উপস্থিতি টেরই পাচ্ছেন না তিনি। মিনিট দশেক মতো সময় লাগল, সাহেবের পোর্ট্রেট তৈরি। তেমন তাক লাগানো না হলেও সাহেবকে দিব্যি চেনা যায় ছবিতে। সাহেবও বেজায় খুশি। মানিব্যাগ খুলে ঝটাকসে দু’খানা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন বৈজনাথকে। তারপর করমর্দন সেরে স্কেচখানা নিয়ে হাঁটা লাগিয়েছেন।
সাহেব সরে যেতেই মিতিনের স্বর বেজে উঠল, আপ তো বহুত বড়িয়া আর্টিস্ট হ্যায় বৈজনাথজি!
পাজামা-পাঞ্জাবির উপর হাতকাটা কুলু-জ্যাকেট পরিহিত বৈজনাথ টাকাটা রাখছিলেন পকেটে। চমকে তাকিয়ে বললেন, আপলোগ? আপলোগ কো কঁহি দেখা হ্যায়?
হ্যাঁ, মিতিন হিন্দিতেই বলল, বিভব শর্মাজির কটেজে। গতকাল সন্ধেবেলা আপনি গিয়েছিলেন।
সন্দিগ্ধ চোখে মিতিনকে একবার জরিপ করলেন বৈজনাথ। টুপুরকেও। তারপর গুমগুমে গলায় বললেন, হ্যাঁ, যেতে হয়েছিল। কিন্তু আপনারা কে?
টুরিস্ট। বাঙালি। কলকাতা থেকে আসছি, বলে একটুক্ষণ অপেক্ষা করল মিতিন। তারপর নরম স্বরে বলল, কাল শর্মাজির মুখে আপনার ঘটনাটা শুনলাম, খুব খারাপ লেগেছে। আপনার মতো একজন শিল্পীকে এভাবে চিট করাটা ভীষণ খারাপ কাজ।
বৈজনাথ খুশি হয়েছেন কথাটা শুনে। ঠোঁটে এক চিলতে দার্শনিক হাসি ফুটে উঠল। হাত উলটে বললেন, কী আর করা? আমাদের নসিবই তো এরকম। ঠকাটাই তো শিল্পীদের নিয়তি।
কিন্তু লোক দুটোর তো শাস্তি পাওয়া উচিত। পুলিশে কমপ্লেন করেছেন?
লাভ কী? তারা তো হাওয়া! তা ছাড়া আমার তো কোনও লিখিত চুক্তিও নেই।
আপনার সঙ্গে ওদের যোগাযোগ হয়েছিল কীভাবে?
আমি কাছেই থাকি, শাস্ত্রীনগরে। ওরা নিজেরাই আমার বাড়িতে এসেছিল।
কবে?
দিন পনেরো আগে।
ওরা আপনার ঠিকানা কী করে…?
দেখুন ম্যাডাম, আমি এক নগণ্য শিল্পী, বৈজনাথ সামান্য হাসলেন, তবে একেবারে ফ্যালনা নই। আমার কয়েকটা পেন্টিং-এর ফোটো ইন্টারনেটে আপলোড করা আছে। তাই দেখে কেউ কেউ আমার ছবি কিনতেও চায়। তাদের কথা ভেবেই ইন্টারনেটে নাম-ঠিকানা দিয়ে রেখেছি।
ও, তার মানে নেট থেকে জোগাড় করেছে? আমি ভাবলাম, বিভব শর্মাই হয়তো আপনার কথা…
না-না। ওরা তো প্রথমে আমার কাছে এসেছিল। আমিই ওদের কটেজের হদিশটা দিই। বলেছিলাম, ওখানে আমার কিছু ভাল কাজের স্যাম্পেল পাবে। ওগুলো দেখে আমার কাজের দাম ঠিক করুক।
কিছু মনে করবেন না। আপনার ছবি মোটামুটি কীরকম দামে বিক্রি হয়?
ঠিক নেই। পাঁচ হাজার, দশ হাজার, পনেরো, বিশ…। এখানে আর তো কেউ জলরঙে আঁকে না, আমার ছবির তাই একটা ডিমান্ড আছে, বৈজনাথের কণ্ঠে বেশ গর্বের সুর। পলকে কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন, আসুন না, এখানে আমার স্টল আছে, আপনারাও দেখতে পারেন।
দোকানটা পাশেই। খুপরি মতো জায়গা। গোটা দশেক বাঁধানো পেন্টিং ঝুলছে সেখানে। সবই কুলুর আশপাশের দৃশ্য।
ছবিগুলোয় চোখ বোলাতে বোলাতে মিতিন জিজ্ঞেস করল, লোক দুটো আপনাকে কি এই ধরনের ছবিই আঁকতে বলেছিল?
না-না। ওরা তো কপি করতে দিয়েছিল, ম্যাডাম।
কপি? মিতিন চোখ কুঁচকেছে, কার ছবি?
রোয়েরিখ সাহেবের।
কুলুর কাছে যাঁর আর্ট গ্যালারি ছিল?
এখনও আছে। নজ্ঞরে। তারই কয়েকটা পেন্টিং আমায় দেখাল কম্পিউটারে। বলল, ওর মধ্যে থেকে তিনখানা আমায় বানিয়ে দিতে হবে।
আপনি রাজি হয়ে গেলেন?
প্রথমটায় আপত্তি করেছিলাম। কারও ছবি নকল করা তো আমার পেশা নয়। আমি করিও না। রোয়েরিখ সাহেবের মতো ফেমাস পেন্টারের ছবি হলেও না। কিন্তু ওরা এমনভাবে ধরল, প্রায় জোর করে কুড়ি হাজার টাকা হাতে গুঁজে দিল। বলল, আরও চল্লিশ দেবে, বৈজনাথ ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললেন, আমারই কসুর। ছবি ডেলিভারির সময় পুরো টাকা বুঝে নেওয়া উচিত ছিল।
বৈজনাথের বিরস মুখখানা দেখে খারাপ লাগছিল টুপুরের। অনুচ্চ স্বরে মিতিনকে বলল, মা তো ছবি ছবি করছিল, এখান থেকে একটা কিনে ফেলবে নাকি?
মিতিন পলক ভাবল কী যেন। তারপর বলল, থাক, পরে দেখা যাবে।
কিন্তু কাল সকালেই তো আমরা মানালি চলে যাচ্ছি।
আবার আসতেও তো পারি।
কেন?
বা রে, এই পথ দিয়েই তো ফেরা। মেলা তো তখনও চলবে। তা ছাড়া আমার সিক্সথ সেন্স বলছে…।
কী?
কিছু না। চল, তোর মা-বাবা কোথায় গেল খুঁজি। দেখি গিয়ে, কী কেনাকাটা হল।
টুপুর টের পাচ্ছিল, মিতিনমাসি কী যেন একটা চেপে গেল। মনে মনে একটু অভিমানই হল টুপুরের। কেন যে মিতিনমাসি ঝেড়ে কাশে না!
.
০৪.
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সহেলিদের ঘরে আড্ডা বসেছে। গায়ে কম্বল টম্বল জড়িয়ে বেশ একখানা জম্পেশ আসর। বৈজনাথজির দুখভরা কহানি শোনাল টুপুর। অবনী জানালেন, কীভাবে আজ মেলায় তার পকেট ফাঁক হয়েছে। সহেলির দরাদরির দাপটে কেমন নাস্তানাবুদ হচ্ছিল পাহাড়ি দোকানদাররা, তাও বর্ণনা করলেন রসিয়ে রসিয়ে। বুমবুমের তো এখনও নাগরদোলার ঘোর কাটেনি, সে বসে বসেই দুলছে। পার্থর উচ্ছ্বাস পাহাড়ি নাচাগানা নিয়ে। ডিজিটাল ক্যামেরায় ষাট-সত্তরটা ফোটো তুলেছে, ডিসপ্লের বোতাম টিপে টিপে দেখাচ্ছে সকলকে।
অবনী জিজ্ঞেস করলেন, ওই জায়গাটার ফোটো তুলেছ? যেখানে পশুবলি হয়?
পার্থ বলল, এমা, না তো! মিস হয়ে গেল?
সহেলি বললেন, ভালই হয়েছে। ওই রক্তারক্তির ফোটো ক্যামেরায় থাকার কোনও দরকার নেই।
তা বললে হবে? অবনী বললেন, কুলুতে রক্তপাত তো কম হয়নি। কখনও শিখরা অ্যাটাক করেছে, তো কখনও ব্রিটিশরা। এখানকার বহু শান্তিপ্রিয় মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে কুলু রাজ্যকে বাঁচাতে গিয়ে।
আহা, ওই খুনজখমের ফোটো তো কবেই ইতিহাস। ওসব প্রসঙ্গ এখন আবার তোলা কেন?
কিন্তু একটা জায়গাকে চিনতে গেলে তার সব দিকই জানতে হয়। মনে রেখো, আমোদ-আহ্লাদ, নাচাগানা, পুজো-আচ্চা, কেনাবেচা যেমন মেলার অঙ্গ, তেমনই ছাগল-ভেড়া-শুয়োর-মোষ হত্যাও আর একটা অঙ্গ। পার্থর ক্যামেরায় সমস্ত কিছুরই এভিডেন্স থাকা উচিত। অবনী লেকচারটা দিয়ে ভারী পুলকিত হয়েছেন। চোখ নাচিয়ে মিতিনকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হে প্রজ্ঞাপারমিতা, আই মিন, জ্ঞানের দেবী, আমি কি ভুল বলছি?
মিতিন আলগা হাসল। তারপর হঠাৎই আলটপকা বলে উঠল, আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলাম অবনীদা।
কী বলো তো?
কালকের টুর প্ল্যানটা যদি একটু বদলাই।
পার্থ প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল, কীরকম? কীরকম?
ধরো, যদি সোজা মানালি না গিয়ে আমরা একবার নজ্ঞরে ঢুঁ মেরে যাই? খুব একটা অফ-রুটে তো যেতে হবে না, পথে কাতরেইন থেকে মাত্র ছ’ সাত কিলোমিটার ঢোকা।
কী আছে সেখানে?
অনেক কিছুই। এককালে কুলুরাজ্যের রাজধানী ছিল নজ্ঞর। আপ টু সেভেনটিথ সেঞ্চুরি। রাজা সি সিংহের তৈরি পাঁচশো বছরের পুরনো একটা দুর্গ রয়েছে। কাসলটার বিশেষত্ব হল, ১৯০৫ সালের ভূমিকম্পেও ওটার কিসসু হয়নি। প্লাস, রাজার প্রাসাদ। বেশ কয়েকটা মন্দির। রোটাং পাস আর হিমালয়ের কিছু চুড়োও দেখা যায় নজ্ঞর থেকে। সুন্দর সুন্দর আপেলবাগানও আছে, মিতিন একটা বালিশ কোলে টানল, তবে ওগুলো দেখার জন্যে আমি তত আগ্রহী নই। আমার ইন্টারেস্ট, রোয়েরিখের আর্ট গ্যালারি।
নজ্ঞরেই বুঝি গ্যালারিটা? অবনী নড়েচড়ে বসলেন, তা হলে তো যেতেই হয়। এত কাছে এসে ওটা না দেখা তো গ্রেট লস।
টুপুর জিজ্ঞেস করল, রোয়েরিখ কি খুব বিখ্যাত শিল্পী?
পার্থর পালটা প্রশ্ন, তুই বুঝি আগে ওঁর নাম শুনিসনি?
না। আজ অবশ্য বৈজনাথজি বলছিলেন।
দেবিকারানি কে জানিস নিশ্চয়ই?
উঁহু।
ফেমাস অ্যাকট্রেস। উনিশশো তিরিশ আর চল্লিশের দশকে গোটা ভারতবর্ষ কাঁপিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ফ্যামিলির মেয়ে। দারুণ রূপসি ছিলেন। রোয়েরিখ ছিলেন সেই দেবিকারানির বর।
তুমি বোধহয় পুরোটা জানো না পার্থ, অবনী নাক গলালেন, তুমি যাঁর কথা বলছ, তিনি সভেতোস্লাভ রোয়েরিখ। ইনিও পেন্টার ছিলেন, কিন্তু তাঁর বাবার খ্যাতি ভুবনজোড়া। নাম নিকোলাস রোয়েরিখ। দুনিয়ার বহু নামী-দামি গ্যালারিতে নিকোলাসের আঁকা ছবি আছে। আমার অনুমান, পেনড্রাইভের ছবিগুলো নিকোলাস সাহেবেরই পেন্টিং। কারণ যত দূর জানি, নিকোলাসের সব ছবিরই বিষয়বস্তু হিমালয়। তার ছেলে সভেলোস্লাভও হিমালয় নিয়ে ছবি এঁকেছেন বটে, তবে পাহাড়ের মানুষ আঁকায় তার উৎসাহ বেশি ছিল। তা ছাড়া তাঁর পেন্টিং-এর সংখ্যাও অনেক কম।
মিতিন বলল, আপনার আন্দাজটাই ঠিক। নিকোলাসেরই সাঁইত্রিশটা ছবি থেকে বেছে বেছে তিনখানা কপি করতে দেওয়া হয়েছিল বৈজনাথজিকে।
তো? পার্থর চোখ সরু, তার সঙ্গে আমাদের নজ্ঞর যাওয়ার কী সম্পর্ক?
আছেও বটে। আবার নেইও বটে।
হেঁয়ালি করছ কেন? সাফ সাফ বলো।
দ্যাখো, বিখ্যাত শিল্পীর ছবি কপি করা কোনও গর্হিত কাজ নয়। এরও একটা বাজার আছে এবং মোটামুটি ভাল দামেই বিক্রি হয়। লোক দুটোর কাছে নিকোলাস রোয়েরিখের পেন্টিং-এর ফোটো ছিল, ওরা তা থেকে কপি করাতেই পারে। তবু কয়েকটি প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
কীরকম?
প্রথমত, অ্যাকর্ডিং টু শর্মাজি, লোক দুটো এসেছিল মুম্বই থেকে। কেন? মুম্বই শহরে কি কপি করার লোকের আকাল পড়েছে? এই সাধারণ কাজটা করাতে তাদের কিনা ছুটে আসতে হল সুদূর কুলুতে? ইন্টারনেট ঘেঁটে একজন কুলুর আর্টিস্টের সন্ধান করে তাকে দিয়ে আঁকাতে হল? দ্বিতীয়ত, কাজটার জন্য তারা যে পারিশ্রমিক অফার করল, সেটাও মোটেই স্বাভাবিক নয়, অর্থাৎ কিনা বৈজনাথজিকে টাকার টোপ ঝুলিয়ে প্রলুব্ধ করা হল। কেন?
টুপুর উত্তেজিত মুখে বলল, শুধু তাই নয় মিতিনমাসি, ছবি তিনটের জন্য তারা বারো দিন ধরে এত দামি কটেজে রয়ে গেল!
কারেক্ট। এখান থেকেই আসে তিন নম্বর প্রশ্ন। যদি বৈজনাথজির টাকা মারার হিসেবটা বাদও দিই, তা হলেও লোক দুটোর খরচখরচা, ইনক্লুডিং মুম্বই-কুলু যাতায়াত কম-সে-কম আড়াই তিন লাখের ধাক্কা। এক-একটা কপি তবে তারা কত দামে বেচবে? লাখ টাকার কমে তো পোষাবেই না। কিন্তু তা কি সম্ভব? কেউ কি কোনও ছবির কপি অত টাকা দিয়ে কেনে? কিনবে?
তাই তো। ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে, পার্থ দু’-এক সেকেন্ড ভেবে বলল, আচ্ছা, এমন কি হতে পারে, ওরা ছবি তিনটেকে আসল পেন্টিং বলে বেচবে? ছবিগুলোকে যথাসম্ভব নিখুঁত করার জন্য এখানকার একজন শিল্পীর দ্বারস্থ হয়েছিল?
সেই সম্ভাবনা তো আছেই। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি, যদি তার চেয়েও কোনও খারাপ মতলব এঁটে থাকে।
আর কী হতে পারে?
ভাবছি। নজ্ঞরে গিয়ে দেখি না একবার, মিতিন বালিশ ফের পাশে রেখে বলল, আবার এমনও হতে পারে, আমি মিছিমিছি টেনশন করছি। লোক দুটো হয়তো সত্যিই বড়লোক ব্যবসাদার। ছবি টবির শখ আছে। নিকোলাস রোয়েরিখের অরিজিনাল পেন্টিং তো পাওয়া দুরূহ, তাই আসার আগে নেটে খোঁজখবর করে নিয়ে বৈজনাথজিকে কপির অর্ডার দিয়েছিল। তারপর যখন মনে হয়েছে বেশি টাকা দেওয়া হয়ে যাচ্ছে, তখন ছবি হাতিয়ে ভাগলবা। অর্থাৎ সিম্পল কেস অফ চিটিংবাজি। আবার বৈজনাথজিও সম্পূর্ণ ঠকেছেন তাও নয়। তিনটে ছবি কপি করার জন্য কুড়ি হাজার তো মিলেছে।
পার্থ বলল, তুমি তো এবার ব্যাপারটাকে গুলিয়ে দিচ্ছ! একবার বলছ লোক দুটোর ধান্দা খারাপ, আবার বলছ বদমতলব নাও থাকতে পারে।
নিশ্চিত হতে পারছি না।
অবনী বললেন, সে যাই হোক, নিকোলাস রোয়েরিখের পেন্টিং এর ব্যাপারে আমার কিন্তু যথেষ্ট আগ্রহ আছে। কিছুদিন আগে একটা ম্যাগাজিনে ওঁর লাইফটা পড়ছিলাম। ভেরি ইন্টারেস্টিং! আদতে তো উনি রাশিয়ান। কিন্তু দেশে যথেষ্ট খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও বলশেভিক বিপ্লবের পর উনি ভারতে পালিয়ে আসেন বউ হেলেনা আর দুই ছেলেকে নিয়ে। সভেতোস্লাভ, মানে যিনি দেবিকারানিকে বিয়ে করেন, তিনি হলেন গিয়ে ছোট ছেলে। ভারতে এসে নিকোলাস এমনই হিমালয়কে ভালবেসে ফেলেছিলেন, বাকি জীবনটা ওই নজ্ঞরেই কাটিয়ে দেন। একটা আশ্রম মতো করে থাকতেন, পরে সেখানেই হয় তার আর্ট গ্যালারি। কুলুর লোকদের হস্তশিল্পও তাকে খুব টানত। সেগুলো সংগ্রহ করে নজ্ঞরে একটা মিউজিয়ামও বানিয়েছিলেন নিকোলাস। নামটা সম্ভবত উরুসবতী সংগ্রহশালা। এমনভাবে পাহাড়িদের সঙ্গে তিনি মিশে গিয়েছিলেন যে, সবাই তাকে মুনি-ঋষিদের মতো সম্মান করত। নামই হয়ে গিয়েছিল, মহর্ষি নিকোলাস। উনি মারা গিয়েছিলেন…
তুমি এবার থামবে? সহেলি মৃদু ঝামরে উঠলেন, কলেজে ক্লাস নিয়ে নিয়ে এমন অভ্যেস হয়েছে, বক্তৃতা শুরু করলে একটা পিরিয়ডের কমে বাক্যি বন্ধ হয় না।
নিকোলাস সম্পর্কে যদি তুমি পড়ো…
আমার দরকার নেই। কাল তো নজ্ঞর যাবই, সেখানে গিয়েই নয় তাঁকে বুঝে নেব।
বক্তৃতা শেষ করতে না পেরে অবনী যেন মনঃক্ষুণ্ণ। বেজার মুখে বাথরুমে চলে গেলেন।
পার্থ বলল, আমরাই বা আর বসে থাকি কেন? ও ঘরে আমাদের কম্বলগুলো তো ওয়েট করছে, গিয়ে এবার ঢুকে পড়লেই হয়।
মিতিন বলল, তার আগে ঝামেলাটা মিটিয়ে এলে হত না?
কোনটা?
কটেজের পেমেন্ট টেমেন্টের ব্যাপারটা।
সে তো কাল সকালেই সারতে পারি। ব্রেকফাস্ট-টেকফাস্ট না করে তো বেরোচ্ছি না।
সকালের জন্য ফেলে রাখার দরকার কী? তখন তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকব, মিতিন উঠে দাঁড়াল, চলো না, শর্মাজির সঙ্গে একটু গপ্পোসপ্পোও করে আসি।
পার্থ হাত ওলটাল, ওকে। মহারানির যা মর্জি।
টুপুর গোঁ ধরল, আমিও যাব।
চল।
নীচের অফিসঘরটি ছেড়ে অন্দরে ঢুকে গিয়েছিলেন বিভব শর্মা। দরজায় টোকা দিতে বেরিয়ে এসেছেন। সুট-টাইয়ের বদলে পরনে ঘরোয়া পোশাক। চোস্ত সাহেবি উচ্চারণে জিজ্ঞেস করলেন, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ স্যার?
একগাল হেসে পার্থ বলল, তেমন গুরুতর কিছু নয়। হিসেবপত্র চোকাতে এলাম।
এখন? বিভব স্মিত মুখে বললেন, আমার তো এখনও বিল তৈরি হয়নি।
বানিয়ে ফেলুন। আমরা বসছি ততক্ষণ, মিতিনের ঠোঁটেও হাসি, কাল সকালের ব্রেকফাস্ট চার্জটা আমরা নগদ দিয়ে যাব।
যা আপনাদের অভিরুচি৷
কুলু শালখানা গায়ে ভাল করে সাপটে টেবিলে বসলেন বিভব। ক্যালকুলেটরে হিসেব কষছেন দু’রাত্তিরের থাকার সঙ্গে ডিনার, ব্রেকফাস্ট, চা-কফি।
উলটো দিকের চেয়ার থেকে ঝুঁকে দেখছিল মিতিন। কাজের মাঝেই আলাপ জুড়ল, আজ মেলায় বৈজনাথজির সঙ্গে দেখা হল।
তাই নাকি? এখনও নিশ্চয়ই খুব রেগে আছেন?
রাগের চেয়েও বোধহয় দুঃখ পেয়েছেন বেশি।
আমারও তো বদনাম হয়ে গেল।
কেন?
আমাদের কুলুতে বৈজনাথজির খুব সম্মান। তাকে কিনা দাগা দিল আমারই দু’জন বোর্ডার?
আপনি কি ওদের আগে থেকে চিনতেন?
একেবারেই না। আমার কটেজে তো এই প্রথম উঠল এবং আগেও নাকি কখনও কুলুতে আসেনি।
দু’জনেই তো মুম্বইয়ের? মরাঠি?
পদবি দেখে মনে হয় একজন মহারাষ্ট্রের, নবীন তারকুণ্ডে। অন্যজন পঞ্জাবি, সুখদেব ভাটিয়া, বিভবের আঙুল থেমেছে। চোখ তুলে বললেন, দু’জনকেই তো ভদ্রলোক বলে মনে হয়েছিল। কথাবার্তা খুব সুন্দর, কোনওরকম বেলেল্লাপনা করেনি। সঙ্গে একটা মারুতি ভ্যান ছিল বটে, তবে বড় একটা বেরোত না। এই হয়তো আশপাশে হেঁটে হেঁটে ঘুরছে, ক্যামেরায় ফোটো তুলছে।
তার মানে আর পাঁচটা টুরিস্টের মতো নয়?
এখানে সবরকম লোকই আসে। অবশ্য আমার বোর্ডাররা বেশির ভাগই বিদেশি। কেউ হয়তো সারাদিন টো টো করে, আবার কেউ হয়তো একটি বারের তরেও ভ্যালিতে নামে না। এই তো, পরশু সকালের ফ্লাইটে এক ইতালিয়ান ভদ্রলোক আসছেন, রবার্তো জোয়ান্নি। গত বছরও একবার এসেছিলেন এরকমই সময়ে। উনি আবার শুধুই শিল্পকলার ভক্ত। দশেরার মেলা থেকে কত কী যে কিনে নিয়ে গেলেন। তার মধ্যে বৈজনাথজির ছবিও তো ছিল।
ফের হিসেবে মাথা নামাল বিভব শর্মা। একটা কাগজে বকেয়া টাকার অংশটা লিখে বাড়িয়ে দিলেন পার্থকে। হেসে বললেন, কাল কম্পিউটারে পাকা বিলটা বানিয়ে দেব। অসুবিধে নেই তো?
কিছুমাত্র না।
টাকা মিটিয়ে উপরে এল তিনজন। বুমবুম ঘুমিয়ে পড়েছে, তাকে তুলে নিজেদের বিছানায় নিয়ে গেল পার্থ। টুপুরকে শুভ রাত্রি জানিয়ে মিতিনও গেল শুতে।
অবনী-সহেলির নাক ডাকছে। টুপুরের কে জানে কেন ঘুম আসছিল না। বাইরে একটানা ঝিঁঝির আওয়াজ। হঠাৎ হঠাৎ থেমে যাচ্ছে শব্দ, আবার শুরু হচ্ছে পূর্ণোদ্যমে। কম্বল সরিয়ে টুপুর জানলায় এল৷ বন্ধ কাচের ওপারে এক মনোরম জ্যোৎস্না। চাঁদের কিরণ ছড়িয়ে পড়েছে চরাচরে। অদূরে, পাহাড়টার গায়ে আলোর পাতলা সর। চোখ যেন ফেরানো যায় না। তাকিয়ে আছে টুপুর, তাকিয়েই আছে।
পরদিন বেরোতে খানিকটা বেলা হয়ে গেল। এক বিকেলেই যা রাজ্যের জিনিস কিনেছেন সহেলি, গোছগাছ করতে প্রাণান্ত। এটা যেন না ভাঙে, ওটা যেন দুমড়ে না যায়। তারপর জলখাবার সেরে, সকলকে তৈরি করে মালপত্র গাড়ির ছাদে তোল রে, বাঁধো রে, সেও তো কম হাঙ্গামা নয়।
কুলু থেকে নজ্ঞর, পথে চড়াইটাই বেশি। কাতরেইনের পর বিপাশা পেরোল গাড়ি। তারপর থেকে রাস্তা বেজায় ভাঙাচোরা। যথেষ্ট সাবধানে চালাচ্ছে টিঙ্কু, তবু সহেলি সিঁটিয়ে বসে। বাইরে চন্দ্রখনি পাহাড়ের অপরূপ শোভা, সেদিকেও তাকাচ্ছেন না।
নজ্ঞরে পৌঁছে পথঘাটের খানিক উন্নতি হল। কংক্রিটের চড়াই, কুলুরাজার দুর্গ পেরিয়ে, যখন গাড়ি রোয়েরিখের আর্ট গ্যালারির কাছে এল, সূর্য তখন মাঝ আকাশে।
কিন্তু দোতলা বাড়িটার সামনে এ কী দৃশ্য?
দু’-দুখানা পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে! নিকোলাস রোয়েরিখের আর্ট মিউজিয়াম পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ!