কুড়িয়ে পাওয়া পেনড্রাইভ – মিতিনমাসি – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
শিবালিক পর্বতমালা ধরে ছুটছিল গাড়িখানা। গাছগাছালিতে ছাওয়া সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে। চক্রাকার রাস্তা কখনও চড়াই তো কখনও উতরাই। পথের কিনারে গভীর খাদ এই যদি বাঁয়ে তো এই ডাইনে। ভয়ংকর ওইসব খাদের পানে তাকালে গা শিরশির করে, মাথা ঘুরে যায়। টুপুরের অবশ্য চক্কর টক্কর লাগে না। তা ছাড়া আনন্দে সে এখন রীতিমতো ডগমগ।
পুজোর ছুটিটা যা জমে উঠেছে এবার! জব্বর একখানা চমক দিল বটে পার্থমেসো। আগে কিচ্ছুটি জানায়নি, হঠাৎ সপ্তমীর সকালে ট্রেনের টিকিট নিয়ে হাজির। শুধু টুপুর নয়, টুপুরের মা-বাবাকেও যেতে হবে। দশমীর সন্ধেয় দিল্লি-কালকা মেলে যাত্রা শুরু, তারপর কটা দিন হিমাচল প্রদেশে চরকি খেয়ে লক্ষ্মীপুজোর পরে ব্যাক। টুপুরের তো পোয়াবারো। কলকাতার দুর্গাপুজোটাও মিস হল না, আলটপকা একটা ভ্রমণও জুটে গেল কপালে। তাও হেঁজিপেঁজি বেড়ানো নয়, কুলু, মানালি, রোটাং! টুপুরের স্বপ্নের দেশ!
আজ কাকভোরে ট্রেন থেকে নেমেছে টুপুররা চণ্ডীগড়ে। সেখানেই ভাড়া করা হল এই সাত আসনের গাড়ি এবং তৎক্ষণাৎ রওনা। ভাকরা নাঙ্গাল বাঁধ পেরিয়ে পঞ্জাবের রোপারে ব্রেকফাস্ট, তারপর দুপুর দুপুর মান্ডি পৌঁছে মধ্যাহ্নভোজ। এবার তাদের গন্তব্য কুলু।
গাড়ির একদম পিছনের সিটে মিতিন আর বুমবুম। পথশ্রমে বুমবুম বেশ ক্লান্ত, মায়ের কোলে মাথা রেখে দিব্যি ঘুমোচ্ছে সে। মাঝের আসনে টুপুর, সহেলি আর অবনী। পার্থ বসেছে ড্রাইভারের পাশে, হাতে হিমাচল প্রদেশের একখানা প্রকাণ্ড ম্যাপ। তীক্ষ্ণ চোখে কাগজখানা দেখছে পার্থ, আর হঠাৎ হঠাৎ চোখ তুলে তাকাচ্ছে ইঁতিউতি। যেন মানচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছে পথঘাট!
ম্যাপখানা মুড়ে পার্থ আচমকা চালকের পানে ঘাড় ঘোরাল, ভাইসাব, অভি তক হম কিতনা কিলোমিটার আয়া?
চালকটি এক তরুণ শিখ। নাম টিঙ্কু সিং। তারস্বরে পঞ্জাবি গান চালিয়েছে টিঙ্কু। গান না বাজালে পাহাড়ি রাস্তায় তার নাকি চোখ বুজে আসে। স্পিকারের আওয়াজ সামান্য কমিয়ে টিঙ্কু বলল, চণ্ডীগড়সে মান্ডি দোশো কিলোমিটার। উসকে উপর তিস-চাল্লিশ জোড় লিজিয়ে।
তার মানে কুলু এখনও পঁচিশ-তিরিশ কিলোমিটার। পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধে হয়ে যাবে।
সহেলি খানিক ঝিমোচ্ছিলেন। ধড়মড়িয়ে সোজা হয়ে বললেন, এই সেরেছে। তার মানে অন্ধকারের মধ্যে পৌঁছোব? একটা অচেনা, অজানা জায়গায়?
তো? জঙ্গলে গিয়ে পড়ছি নাকি? এত বিখ্যাত একটা টুরিস্ট প্লেস! হিমালয়ের একটা প্রধান গেটও বলা যায়।
কিন্তু গিয়ে হোটেল খুঁজতে হবে যে। আমাদের তো কোনও বুকিং টুকিং নেই!
ওটা কোনও সমস্যা নাকি? অবনী এবার ঢাউস বই থেকে মুখ তুলেছেন। নিশ্চিন্ত সুরে বললেন, তোমার গ্রেট সিস্টার আছে না টিমে? প্লাস, এমন ওস্তাদ ভগ্নিপতি পার্থ?
বাহ-বাহ, সব দায় বুঝি ওদের, অ্যাঁ? তুমি খালি বসে বসে ঠ্যাং নাচাবে। আর থান ইট গিলবে?
অভিযোগটা একশো ভাগ সত্যি। পরশু সন্ধেয় ট্রেনে চড়ার পর থেকে কুটোটি নাড়েননি অবনী। মালপত্র তোলা নামানো, রাতে শোওয়ার বন্দোবস্ত, খাওয়ার জোগাড়, চণ্ডীগড়ে নেমে গাড়ির জন্য ছোটাছুটি, সমস্ত ঝক্কি মিতিন আর পার্থ পালা করে সামলেছে। এদিকে অবনী বইই পড়ে চলেছেন একটানা। সম্প্রতি সমুদ্র সম্পর্কে বেজায় আগ্রহ জেগেছে অবনীর, তাই তিন-তিনখানা ওশিয়ানোগ্রাফির বই নিয়ে চলেছেন পাহাড়ে। টুপুরের বাবার এ হেন বিদঘুটে খেয়ালে টুপুরের মা তো বিরক্ত হতেই পারেন।
অবনী অবশ্য গ্রাহ্যেই আনলেন না সহেলিকে। হাই মাইনাস পাওয়ার চশমাখানা ঠিক করতে করতে বললেন, আরে বাবা, ওরা অল্পবয়সি, ওসব কাজ তো ওদেরই মানায়। তার উপর মিতিন হল গিয়ে ডিটেকটিভ। সুপারস্মার্ট লেডি। পার্থও যথেষ্ট চালাকচতুর বিজনেসম্যান। আমার মতো আজীবন ছাত্র ঠেঙানো এক সাধারণ কলেজ মাস্টারের সঙ্গে ওদের তুলনা হয় নাকি?
সহেলি রেগে টং। তর্জনী উঁচিয়ে বললেন, তোমার কায়দাবাজির কথা রাখো। সাফ বলে দিচ্ছি, কুলুতে কিন্তু মিতিন-পার্থ মোটেই গাড়ি থেকে নামবে না। তুমি একা গিয়ে একটা ভাল হোটেলের ব্যবস্থা করবে।
রাতটা তা হলে গাড়িতেই কাটবে রে দিদি, মিতিন মুচকি হেসে ফোড়ন কাটল, তারপর ভোর হলে আমাদেরই বেরোতে হবে অবনীদাকে খুঁজতে।
পার্থ হা-হা হেসে উঠল। টুপুরও হাসছে মিটিমিটি। চোয়াল শক্ত রেখেও নিজেকে সামলাতে পারলেন না সহেলি, হেসে ফেলেছেন ফিক করে। ব্যস, অবনীকে আর পায় কে! ফের তিনি বইয়ের পাতায় মনোযোগী।
অপাঙ্গে তাঁকে একবার দেখে নিয়ে পার্থ বলল, এবার জায়গা বুঝে কোথাও একটু দাঁড়ালে হয় না?
টুপুর জিজ্ঞেস করল, কেন?
স্ন্যাকস ব্রেক। এক কাপ গরম চায়ের সঙ্গে শিঙাড়া কিংবা চপ।
তুমি এখন খেতে পারবে? দুপুরে না দশ-এগারোখানা রুটি সাঁটালে?
সর্বনাশ, তুই গুনছিলি নাকি? পার্থ হ্যা-হ্যা হাসল, এমন চমৎকার পাহাড়ি জায়গা! নির্মল বাতাস, নো পলিউশন, যা খাচ্ছি তুরন্ত হজম। পেট ফের হাঁক পাড়ছে রে।
পেট ছাড়া আরও অঙ্গ আছে মশাই, মিতিন কুটুস হুল ফোটাল, চোখ দুটোকেও একটু ইউজ করো। সিনসিনারিগুলো দ্যাখো।
দেখার এখন আছেটা কী? মান্ডির পর সেই যে শুরু হল, শুধু পাহাড় আর পাহাড়, পাহাড় আর পাহাড়। দু’ঘণ্টা ধরে তো পাহাড়ই গুনে যাচ্ছি। তাও যদি একখানা আইস-পিক চোখে পড়ত!
সঙ্গে সঙ্গে যে বিপাশা নদীটা চলেছে, সেটা নজরে পড়ছে না?
বিপাশা তো এখন সারাক্ষণ পাশে পাশে থাকবে ম্যাডাম। কুলু-মানালি ছাড়িয়ে সেই রোটাং পাস পর্যন্ত। কতবার যে ওর সঙ্গে মোলাকাত হবে!
বেশ তো। কিন্তু খানিকক্ষণ আগে যে লেকটা পড়ল, সেটাও তোমার মনে ধরল না?
উহল নদীর পান্ডো-ড্যাম? পার্থর উদাসী জবাব, মন্দ নয়, তবে কুলু হল গিয়ে ভ্যালি অফ গডস। দেবদেবীদের উপত্যকায় আমি আরও সুন্দর কিছু এক্সপেক্ট করি।
মিলবে মিলবে, মিতিন আশ্বাস দিল, পৌঁছে দেখো।
কথোপকথনের মাঝেই সূর্য ঢাকা পড়েছে এক পাহাড়ের আড়ালে। মাথার উপর ঝকঝক করছে আকাশ, তবু আলো যেন মরে এল সহসা। দ্রুত ছায়া ঘনাচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে, দূরে দূরে, দেখা যায় ছোট ছোট গ্রাম। আলোছায়া মাখা চাষের খেতগুলোও যে এখন কী অপরূপ!
টুপুর একদৃষ্টে বাইরেটা দেখছিল। অস্ফুটে বলে উঠল, বিউটিফুল। ঠিক যেন পটে আঁকা ছবি!
পার্থ ফের ম্যাপে ডুবেছে। জিজ্ঞেস করল, কী রে?
একবার চোখটা ঘোরাও না। দৃশ্যগুলো মনে হচ্ছে, কেউ যেন তুলি দিয়ে এঁকেছে।
ন্যাচারাল বিউটি তো আছেই রে। নইলে এখানকার মানুষরা এমনি এমনি জন্ম আর্টিস্ট হয়! পার্থ বিজ্ঞ স্বরে বলল, জানিস নিশ্চয়ই, কুলু উপত্যকায় পেন্টিং-এর একটা নিজস্ব ধারা আছে। লোকাল শিল্পীরা এক একজন তো রীতিমতো তুখোড়। এমন এমন ছবি আঁকে, সাহেবরা পর্যন্ত ভিরমি খেয়ে যায়। কত বিদেশি টুরিস্ট যে এখান থেকে ছবি কিনে নিয়ে যায়।
সহেলি নড়েচড়ে বসলেন, আমরাও দু-একটা কিনতে পারি। ড্রয়িংরুমে একটাও ভাল পেন্টিং নেই, যদি পছন্দসই কিছু পাওয়া যায়।
নো প্রবলেম। এখন তো কুলুতে বিখ্যাত দশেরার মেলা চলছে, ওখান থেকেই বেছেবুছে নিতে পারবেন।
বিখ্যাত কেন বলছ? খুব বড় মেলা নাকি?
অতি বৃহৎ। ভারতে যে ক’টি আন্তর্জাতিক মেলা বসে, তার মধ্যে কুলুর দশেরার মেলা অন্যতম। দেখবেন, কী এলাহি আয়োজন!
সত্যি, কুলুতে পৌঁছে চোখ যেন ধাঁধিয়ে গেল। পাহাড়ে ঘেরা শহরখানা আলোয় আলোয় ঝলমল করছে। বড় রাস্তার গায়েই সমতলে বিশাল এক মাঠ, সেখানেই বসেছে মেলা। গিজগিজ করছে মানুষ, মাইক বাজছে, লোকজনের হইহল্লায় চতুর্দিক গমগম।
রাস্তার একধারে গাড়ি লাগিয়েছে টিঙ্কু। জানলার কাচ নামিয়ে পার্থ উল্লসিত স্বরে বলল, ওয়াও! মেলা তো জমে ক্ষীর!
টুপুর চকচকে চোখে বলল, ঝপ করে এক পাক ঘুরে নিলে হয় না?
উঁহু, এখন কোথাও নয়। আগে হোটেল। পরশু বিকেল থেকে শুধু দৌড় চলছে, খানিক জিরিয়ে তবে ঘোরাঘুরি, বলেই সহেলি ঠেলছেন অবনীকে, কী গো, এবার থাকার ব্যবস্থাটা করো।
অবনী কাঁচুমাচু মুখে বললেন, আ-আ-আমি? এই ভিড়ে কোথায় যাব?
পার্থ হেসে বলল, আহা, থাক থাক। অবনীদাকে রেহাই দিন। আমি দেখছি।
তড়াক লাফিয়ে পার্থ রাস্তায়। তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক। মিতিন গলা বাড়িয়ে বলল, মেলার মাঠটার নাম ঢালপুর ময়দান। এটাই কুলুর সেন্ট্রাল প্লেস। কাছেই গভর্নমেন্টের টুরিস্ট সেন্টার পাবে, আগে সেখানে খোঁজ নাও।
হনহনিয়ে এগোল পার্থ। এদিকে বুমবুমের ঘুম ভেঙেছে, জেগেই তিনি একের পর এক বায়না জুড়ছেন! চিপস চাই, কোল্ডড্রিঙ্ক খাবে। অদূরে মেলায় অতিকায় নাগরদোলা দৃশ্যমান, এক্ষুনি তাতে চড়বে বলে রীতিমতো ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিল। মিতিন তাকে ধমকে ধামকে থামাচ্ছিল, পার্থ ফিরে এসেছে। হাত উলটে বলল, নো চাক্স। সরকারি সমস্ত লজ ভরতি।
তা হলে কী হবে?
ঘাবড়াচ্ছেন কেন? ঢালপুর ময়দানের আশপাশে অসংখ্য হোটেল, একটা না-একটাতে ঠিক ঢুকে যাব। আপনারা গাড়িতে বসুন, আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে জায়গা ফিট করে ফেলছি।
মিতিন জিজ্ঞেস করল, আমি যাব?
নো নিড। পার্থ মুখার্জি এই কেসে একাই কাফি।
মেসো চলে যাওয়ার পর টুপুর নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। নেমেছে বুমবুমকে নিয়ে মিতিনও। দোকান থেকে মিতিন চা এনে দিল দিদি-জামাইবাবুকে। টুপুর আর বুমবুমকে চিপসের প্যাকেট। টিঙ্কুকেও চা খেতে ডাকল মিতিন। গেলাস হাতে গল্প জুড়েছে দু’জনে।
টুপুরের অল্প-অল্প শীত করছিল। গায়ে কার্ডিগান চাপানো, তবুও। হাত দুটো সামনে জড়ো করে টুপুর দেখছিল মেলাটাকে। স্থানীয় মানুষদের গায়ে কী রং-বেরঙের পোশাক! ছেলেদের মাথায় রঙিন টুপি, মেয়েরা সেজেছে রুপোর গয়নায়। ওই টুপিগুলো নিশ্চয়ই কুলু টুপি? দেশি-বিদেশি পর্যটকরাও টুপি পরে ঘুরছে। মেলায় এসে ছেলেমানুষ বনে গেছেন বড়রাও, অনেকেই ভেঁপু বাজাচ্ছেন। এমনকী, সাহেব-মেমরাও। বিচিত্র বাজনা বাজাতে বাজাতে একদল পাহাড়ি মেয়ে-পুরুষ পাক খাচ্ছে মেলাটাকে। কেউ কেউ নাচ জুড়েছে।
সবাই মিলে গানও গাইছে কী একটা। কচিকাঁচাদের উল্লাসের অন্ত নেই, তারাও চলেছে পিছু পিছু।
জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কতক্ষণ কেটেছে কে জানে, হঠাৎই হন্তদন্ত পায়ে পার্থর আবির্ভাব। গোমড়া মুখে বলল, ব্যাড নিউজ। ভেরি ব্যাড নিউজ। কোত্থাও ঠাঁই নেই। সব ক’টা হোটেল উপচে পড়ছে। সমাচার শুনে সহেলির মুখ পাংশু। কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। ট্রেনে কতবার বললাম, হোটেল বুকিং না করে বেরোনোটা মোটেই উচিত হয়নি।
প্যানিক করিস না তো দিদি। পার্থর এলেম বোঝা গেল, এবার আমি একটু চেষ্টা করি? মিতিন গাড়ির দরজা খুলে ধরল, এসো এসো, উঠে পড়ো সকলে। জলদি জলদি।
পার্থ অবাক মুখে বলল, কোথায় যাবে?
কোয়েশ্চেন পরে। চটপট বোসো তো সিটে।
ফের চলা শুরু। মাঠ ছাড়িয়ে, শাঁ শাঁ আরও খানিকটা গিয়ে বাঁয়ে ঘুরল গাড়ি। খাড়াই বেয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। এদিকটায় তেমন আলো টালো নেই, বেশ অন্ধকার অন্ধকার। সরু পথের দু’ধারে ঘরবাড়ি আছে বটে, তবে লোকজন দেখা যায় না বিশেষ। এক-আধজন যাও চোখে পড়ল, তাও সাদা চামড়ার। চড়াই বেয়ে উঠছে হেঁটে হেঁটে।
টুপুর চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, এদিকেও হোটেল আছে নাকি? এত নির্জনে?
মিতিনের নির্বিকার জবাব, মনে হয় না।
পার্থ অসহিষ্ণু স্বরে বলল, তা হলে আমরা চলেছি কোথায়?
প্রাইভেট কটেজে।
মানে?
এখানকার অনেক স্থানীয় মানুষ টুরিস্টদের ঘর ভাড়া দেয়। আমাদের টিঙ্কু সিং এরকম তিন-চারটে কটেজের সন্ধান জানে।
তাই নাকি?
ইয়েস। এতক্ষণ তো টিঙ্কুর কাছ থেকে এসবই জানছিলাম। এখন দেখি কপাল ঠুকে।
প্রথম বাড়িটায় বিফল মনোরথ হতে হল। দ্বিতীয়টাতেও। অবশেষে তৃতীয় একটি কাঠের বাড়ির দোতলায় দু’খানা ঘর মিলেছে। নীচে সপরিবার বাড়িওয়ালার বাস। খাবার দাবার তারাই বানিয়ে দেবে। তবে দর অতি চড়া। অবনী বললেন, রাতটুকু এখানেই ঘাঁটি গাড়া যাক, সকালে অন্য কিছু ভাবা যেতে পারে।
পার্থ-মিতিনেরও তাই মত। একমাত্র সহেলি যা একটু খুঁতখুঁত করছেন। মেলাটা এখান থেকে অনেকটা দূর হয়ে যাবে কিনা। অবশ্য শেষমেশ মেনেও নিলেন। এই কটেজ ছাড়া এখন আর গতি কী!
বাড়িওয়ালার নাম বিভব শর্মা। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। কথাবার্তায় সজ্জন। নিজে দোতলায় উঠে খুলে দিলেন ঘর দুটো। পার্থ আর টিঙ্কু মালপত্র নামাল গাড়ির ছাদ থেকে। সকলে মিলে ধরাধরি করে তুলল উপরে।
সুটকেস টুটকেস ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে পার্থ হাত-পা ছড়িয়ে বসেছে সোফায়। অলস মেজাজে বলল, এখন একটু কফি পেলে দারুণ হত।
মিতিন বলল, যা তো টুপুর, নীচে গিয়ে বলে আয়।
টুপুর উঠতে গিয়েও থমকেছে। নীচ থেকে একটা গলার আওয়াজ আসছে? কে যেন গাঁকগাঁক করে চেঁচাচ্ছে? বিভব শর্মা কী যেন বললেন অনুচ্চ স্বরে, পরক্ষণে চিৎকার আরও চড়ে গেল।
টুপুর সভয়ে বলল, ঝগড়া বেধেছে নাকি?
তাই তো মনে হচ্ছে। মিতিনের ভুরুতে হালকা ভাঁজ, চল তো দেখি।
মিতিনের পিছন পিছন একতলায় নেমে আরও কুঁকড়ে গেল টুপুর। একটা রোগা, ঢ্যাঙামতো লোক চড়াও হয়েছেন বিভব শর্মার ঘরে। বয়স বছর পঞ্চাশ। টিকলো নাক। বাবরি চুল। পরনে চুস্ত-পাঞ্জাবি, গায়ে কুলু শাল। সভ্যভব্য চেহারার মানুষটা আঙুল তুলে শাসাচ্ছেন বিভবকে। নরম গলায় তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে চলেছেন বিভব শর্মা। কিছুই শুনলেন না ভদ্রলোক, হঠাৎ দুদ্দাড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে।
মাথা নামিয়ে বসে আছেন বিভব শর্মা। হলটা কী?
.
০২.
কটেজের দু’খানা ঘরই ভাড়ার সঙ্গে মানানসই। ফায়ারপ্লেস, ইংলিশ খাট দিয়ে সাজানো দিব্যি আরামদায়ক কামরা। দরজা-জানলায় লম্বা লম্বা পরদা, মেঝেয় মোটা কার্পেট, এক সেট সোফা, কারুকাজ করা সেন্টারটেবিল, ওয়ার্ডোব, ড্রেসিংটেবিল, টিভি, শাওয়ার-গিজার-কমোড বসানো ঝকঝকে বাথরুম, সবই মজুত। এমনকী, লেখাপড়া করার চেয়ার-টেবিলও। সেখানে শোভা পাচ্ছে কম্পিউটার। বিদেশি পর্যটকদের মন কাড়ার জন্যই বুঝি এতসব বন্দোবস্ত। দেওয়ালে খান দুয়েক পেন্টিংও ঝুলছে। পাহাড়ের দৃশ্য, পাহাড়ি মানুষের মুখ, বিপাশা নদী। আঁকার মান নেহাত মন্দ নয়, তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগে।
সারাদিন পর এমন একটা আস্তানা পেয়ে সকলেরই শরীর বেশ ছেড়ে গিয়েছে। কেউ আর বেরোনোর নামটি করছে না। উষ্ণ উষ্ণ জলে হাতমুখ ধুয়ে যে যার মতো তরতাজা হয়ে নিল খানিকটা। এখন সকলে মিলে জড়ো হয়েছে এক ঘরে। কফি আর গরম গরম চিকেন পকোড়াও হাজির, হাত মুখ দুইই চলছে সমান তালে। বসেছে গল্পের আসর।
নীচের ঘটনাটা নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। যে ভদ্রলোক এসে চেঁচামেচি করছিলেন, তিনি নাকি একজন স্থানীয় শিল্পী। নাম বৈজনাথ রাই। এই কটেজেই নাকি দু’জন লোক এসে উঠেছিল, তারা তিনখানা ছবি আঁকতে দিয়েছিল বৈজনাথকে। আজ সকালে বৈজনাথের বাড়ি থেকে ছবি তিনটে নিয়েও এসেছে লোকগুলো। তখন নাকি বলেছিল, সন্ধেবেলা কটেজে এসে টাকা নিয়ে যেতে। এখন বৈজনাথ এসে দেখছেন, চিড়িয়া উধাও। মাঝখান থেকে বেচারার কড়কড়ে চল্লিশ হাজার টাকা চোট! এর পরেও বৈজনাথ ক্ষিপ্ত না হয়ে পারেন?
অবনী ভারী মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, ছি-ছি, শিল্পীকে কেউ এভাবে ঠকায়? লোকগুলো মহা পাজি তো!
সহেলি বললেন, ওরকম বদমাশ টুরিস্টও আসে তা হলে?
টুরিস্টদের মধ্যে সব ধরনের চিজই থাকে, পার্থ টুপুরের দিকে ফিরল, লোকগুলো এ দেশি না ফরেনার?
খাঁটি ভারতীয়। মিস্টার শর্মা তো বললেন, দু’জনেই নাকি মুম্বইওয়ালা। পরিচয় দিয়েছিল বিজনেসম্যান।
চিটিংবাজির কারবার করে বোধহয়। তা হোটেলে না উঠে এখানে আড্ডা গেড়েছিল যে বড়?
কে জানে! হয়তো আমাদের মতোই জায়গা না পেয়ে।
কবে এসেছিল?
বারো দিন নাকি ছিল এখানে।
মানে পুজোর আগে থেকে? স্ট্রেঞ্জ! তখন তো মেলাও শুরু হয়নি? বারো দিন ধরে টাউনের কোনও হোটেল না পাওয়াটা যেন কেমন কেমন লাগছে! পার্থ মিতিনের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল, কী গো, তোমার ইনটিউশন কী বলে?
ওদের হয়তো এরকম জায়গাই পছন্দ, মিতিন হাত উলটোল, অনেকেই তো ভিড়ভাট্টা পছন্দ করে না। বেড়াতে এসে নির্জনতা খোঁজে।
মিটারও তো এখানে কম ওঠেনি! শুধু রুম-চার্জই দিয়েছে প্রায় লাখ খানেক!
দিয়েছে। তাদের খেয়াল।
তুমি কি এর মধ্যে কোনও রহস্য পাচ্ছ না?
মিতিন হেসে ফেলল, তুমি কি আমাকে খোঁচাচ্ছ?
নাহ। জাস্ট তোমার ডিডাকশানটা বুঝতে চাইছি।
সরি। একটা মাত্র সমীকরণ থেকে এক্স-ওয়াই-জেডের সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব নয়।
টুপুর বলল, আমার কিন্তু মনটা খচখচ করছে, মিতিনমাসি। যারা লাখ টাকা শুধু ঘরভাড়াই দেয়, তারা বৈজনাথ রাইয়ের মাত্র চল্লিশ হাজার টাকা মেরে দেবে?
এই প্রশ্নটায় দম আছে, মিতিন কফিতে শেষ চুমুক দিল, তবে কী জানিস, মানুষ বড় আজব জীব রে। কোটি কোটি টাকা যার রোজগার, অথচ সেও হয়তো কাজ করিয়ে লোককে পয়সা দেয় না। হায়দরাবাদের নিজামের কথাই ভাব। লাখ লাখ টাকা খরচা করে পার্টি দিতেন, কিন্তু অনুষ্ঠানের শেষে এঁটো খাবারও ফেলে দেওয়ার জো ছিল না। তার কর্মচারীদের ওসব গিলতে হত। অথচ তিনি তখন পৃথিবীর এক নম্বর বড়লোক। গ্যারাজে তার লাইন দিয়ে রোলস রয়েস।
বুঝেছি। তুমি ব্যাপারটাকে আমল দিচ্ছ না, পার্থকে কিঞ্চিৎ হতাশ দেখাল। পরক্ষণে সামান্য উজ্জীবিত স্বরে বলল, আর একটা স্ট্রাইকিং পয়েন্ট আছে কিন্তু। তোমরাই বললে, বৈজনাথ রাই বিশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স নিয়েছিলেন। পাওনা আরও চল্লিশ। অর্থাৎ তিনটে ছবির জন্য মোট ষাট হাজার। লোকাল একজন আর্টিস্টের পক্ষে দামটা কি একটু বেশি ঠেকে না?
আমার মনে হয় না।
কেন জানতে পারি?
কারণ, বৈজনাথজির পেন্টিং-এর হাত যথেষ্ট ভাল। ওইরকম একটা অ্যামাউন্ট উনি দাবি করতেই পারেন।
বৈজনাথজি কেমন আঁকেন, তুমি জানলে কী করে?
দেওয়ালের ছবিগুলো দেখে।
এগুলো বৈজনাথজির আঁকা নাকি?
ইয়েস স্যার। শুধু কান নয়, চোখ দুটোও খোলা রাখো। ছবির কোনায় বৈজনাথ রাইয়ের দস্তখত আছে মশাই৷
পার্থ ফ্যালফ্যাল তাকাচ্ছে। টুপুরও হাঁ। ইস, মিতিনমাসির পর্যবেক্ষণ শক্তিটা যে কেন এখনও টুপুর আয়ত্ত করতে পারল না?
চিকেন পকোড়া শেষ। সহেলি একটা হাই তুলে বললেন, তোমাদের রহস্য খোঁজা এবার থামাও। একটু কাজের কথা হোক।
পার্থ জিজ্ঞেস করল, যেমন?
এখানে যাব, ওখানে যাব, বললেই তো হবে না। আমাদের এগজ্যাক্ট টুর-প্ল্যানটা কী?
কালকের দিনটা আমরা কুলুতেই থাকছি। লোকাল যা-যা দ্রষ্টব্য তা তো দেখবই। খানতিনেক মন্দির আছে, তার মধ্যে বিজলেশ্বর মহাদেব টেম্পল তো যথেষ্ট ফেমাস। বিপাশার পারেও ঘুরব। তারপর বিকেল থেকে মেলা। আপনিও প্রাণ খুলে শপিং করতে পারবেন।
আমি কিন্তু জায়েন্ট হুইল চড়বই, বুমবুম প্রায় লাফিয়ে উঠেছে, আর আমার একটা লাল-সবুজ টুপিও চাই।
হবে হবে, হাত তুলে ছেলেকে আশ্বাস দিল পার্থ। ফের সহেলিকে বলল, তারপর ধরুন, পরশু সকালে আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি। স্ট্রেট টু মানালি। সেখানে থ্রি নাইট হল্ট। একদিন তো রোটাং পাস যেতে আসতেই কেটে যাবে। একদিন চুটিয়ে মানালি সফর। হিড়িম্বার মন্দির, বশিষ্ঠ-আশ্রম, গোল্ডেন আপেলের বাগান, টিবেটিয়ান মনাষ্ট্রি।
পার্থ একটু সময় নিয়ে বলল, এরপর যে প্ল্যানটা আছে, আমরা দু’ভাবে বাকি টুরটা সারতে পারি। রোটাং পেরিয়ে যেতে পারি কেলং। লাহুল-স্পিতির একমাত্র শহর। রুটটা একটু টাফ, তবে জায়গাটা নাকি দারুণ। ন্যাড়া পাহাড়ের মধ্যিখানে ভ্যালি অফ গ্লেসিয়ার। মানে বুঝছেন তো? হাতের নাগালে বরফ। তা ছাড়া চন্দ্রভাগার ভাগা নদীটাকে ওখানে পেয়ে যাবেন।
কেলং-এর নাম আর একটা কারণেও করা যায়, মিতিন বলে উঠল, কলকাতায় লর্ড হার্ডিঞ্জকে বোমা ছোড়ার অপরাধে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ধরা পড়েছিলেন ওই কেলং-এ।
হ্যাঁ। ওখানে তার একটা স্ট্যাচুও আছে বলে শুনেছি, পার্থ মাথা নাড়ল, যাই হোক, কেলং একটা অপশন। দ্বিতীয় চয়েস, আমরা মানালি থেকে সিমলা চলে যেতে পারি। মোটামুটি আরও তিনটে দিন সিমলা আর তার চারপাশটা উপভোগ করে ট্রেনে ব্যাক টু কালকা। চণ্ডীগড়ের বদলে কালকা থেকেই নয় কলকাতা ফিরব।
মন্দ নয় আইডিয়াটা, সহেলি বললেন, সিমলা-কালকা ট্রেনজার্নিটা নাকি খুব সুন্দর। একশো-দেড়শোখানা টানেল পড়ে পথে, সেটাও এক অভিজ্ঞতা।
মিতিন ফুট কাটল, প্লাস, তুই সিমলাতে প্রাণের সুখে শপিং করতে পারবি।
অবনী হা-হা করে হেসে উঠলেন, খাসা বলেছ। তোমার দিদি বাজার করা ছাড়া তো কিছু বোঝে না। ওর কাছে ভ্রমণ মানেই কাড়ি কাড়ি জিনিস কেনা। আর ফিরে গিয়ে ডেকে ডেকে সকলকে বিলোনো।
তোমার তাতে কী? তুমি চুপ করো তো। হাতে করে ছোটখাটো কিছু নিয়ে গেলে লোকে কত খুশি হয় জানো?
এখান-ওখান থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার কী আছে? কলকাতায় তো সবই পাওয়া যায়। চাইলে কুলুর পেন্টিংও।
কর্তা-গিন্নিতে জোর তর্ক বেধেছে। তাদের থামাতে পার্থ তড়িঘড়ি বলে উঠল, এক সেকেন্ড। এক সেকেন্ড। আমার একটা থার্ড প্ল্যানও আছে।
মিতিন জিজ্ঞেস করল, যথা?
গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্ক। দুরন্ত জঙ্গল। সিমলা, কল্পা, কাজা, মানালি আর কুলুর ঠিক মধ্যিখানে। ওখানে প্রচুর ভাল ভাল স্পট আছে। নানা ধরনের বন্যপ্রাণীরও দর্শন মিলবে।
ওরে বাবা, আমি ওসব জঙ্গল টঙ্গলে নেই, সহেলি প্রতিবাদ করে উঠলেন, মানালি থেকে সিমলার পরিকল্পনাটাই থাক।
আমি বলি কী, অবনী গলা ঝাড়লেন, এত ছোটার কি কোনও প্রয়োজন আছে? কুলুতেই দু-তিন দিন জিরোই, তারপর নয় মানালি ঘুরে বাড়ির পথে রওনা দেব। তিন-চার দিন না থাকলে কি কোনও জায়গা ঠিকঠাক চেনা যায়, তোমরাই বলো?
অ্যাই, তোমার আয়েশিপনা ছাড়ো তো। সকলের সঙ্গে যখন বেড়াতে বেরিয়েছ, তাল রেখে দৌড়োতে হবে। রুমে আরামসে বই নিয়ে বসে থাকবে, ওটি হচ্ছে না।
শুধু কি নিজের জন্য বলছি? বাচ্চাদের ধকলের কথা একবার ভাবো।
টুপুর আর মোটেই ছোট নেই। বুমবুমও তোমার মতো ইয়ে নয়, যথেষ্ট শক্তপোক্ত।
আবার একচোট বিবাদ বাধার উপক্রম। সামাল দিতে ফের ঝাঁপিয়েছে পার্থ। প্রসঙ্গ বদলাতেই বুঝি রাতের মেনুর কথা পাড়ল। মিতিন পুটুস পুটুস টিপ্পনী কাটছে। ঘরের পরিবেশ পলকে ঝরঝরে। সহেলি উঠে গেলেন পাশের ঘরে। নৈশাহার আসা পর্যন্ত খানিক গড়িয়ে নেবেন। অবনীও জাবদা বইখানা খুলেছেন। বুমবুম টিভি চালিয়ে দিল। রিমোট টিপে টিপে ঠিক একটা কার্টুন চ্যানেল বার করে ফেলেছে। কলকাতায় হলে টুপুরও হয়তো পরদায় চোখ রাখত, কিন্তু হিমালয় ভ্রমণে এসে ইচ্ছে করছে না। পায়ে পায়ে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। বাইরের সরু প্যাসেজটুকু জুড়ে টানা কাচের জানলা। বন্ধ জানলার কোনও এক ফাঁক দিয়ে হাওয়া আসছে ঠান্ডা ঠান্ডা। আজ অক্টোবরের এগারো। অর্থাৎ এখনও আশ্বিন। আর মাসখানেকের মধ্যে নিশ্চয়ই এই কুলু উপত্যকা ঢেকে যাবে বরফে। ঢালপুর ময়দানখানা কেমন যে দেখাবে তখন?
ছবিটা কল্পনা করতে করতে টুপুর কাছে চোখ রেখেছে। অদুরে আর একটা পাহাড়। অন্ধকারে পাহাড়টা নজরে পড়ার কথা নয়, তবে এমন বিন্দু বিন্দু আলো ফুটে আছে গায়ে! নিশ্চয়ই বাড়িঘরের আলো। কিন্তু মনে হয় আকাশের তারাগুলো যেন নেমে এসেছে নীচে। নাকি আকাশটাই তারাদের নিয়ে!
কী রে, কাচে নাক ঠেকিয়ে কী দেখছিস?
টুপুর চমকে তাকাল। মিতিনমাসি৷
হেসে টুপুর বলল, সামনের পাহাড়টাকে গো। কী দুর্দান্ত লাগছে!
কুলু ভ্যালির তো এটাই বিশেষত্ব। যেদিকে তাকাবি, সেই দিকটাই বিউটিফুল। কোন কোন হিমালয়ান রেঞ্জ কুলু ভ্যালিকে ঘিরে রেখেছে, ভাব। উত্তরে পীরপঞ্জাল, পুবে পার্বতী, পশ্চিমে বরাভাঙ্গাল আর দক্ষিণে ধৌলাধার। এদের মাঝখানে কুলু কার্পেটের মতো ছড়িয়ে আছে। একসময়ে এটা ছিল সেন্ট্রাল এশিয়ার গেটওয়ে। কুলু, মানালি, রোটাং, কেলং পেরিয়ে লাদাখ হয়ে ব্যবসায়ীর দল যাতায়াত করত নিয়মিত। এই পথের নাম ছিল গ্রেট ইন্ডিয়ান সিল্ক রুট।
এখন আর রাস্তাটা নেই?
ব্যবহার হয় না। আজকাল তো প্লেনেই লোকে যাতায়াত করে, খামোখা এত দুর্গম পথ কেন পাড়ি দেবে? একমাত্র ট্রেকিং যারা করে তারাই এখন…
কথার মাঝেই হঠাৎ বুমবুমের উত্তেজিত ডাক, মা, তাড়াতাড়ি এসো, দেখে যাও কী পেয়েছি।
মিতিন-টুপুর দৌড়োল ঘরে। গিয়ে দেখল বুমবুম কম্পিউটারে বসে। তার হাতে একটি পেনড্রাইভ।
ভুরু কুঁচকে মিতিন বলল, ওটা কোত্থেকে পেলি?
এই তো, টেবিলের ড্রয়ারে ছিল।
পার্থ একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। উঠে এসেছে। বুমবুমের হাত থেকে পেনড্রাইভটা নিয়ে দেখল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। বলল, আট জি বি মেমারি। নির্ঘাত আগের লোক দুটো ফেলে গিয়েছে।
খুবই সম্ভব। হয়তো তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েছে, খেয়াল করেনি।
দেখব নাকি, কী আছে এতে?
অবনী বই পড়া থামিয়ে পিটপিট তাকাচ্ছিলেন। বললেন, অন্যের প্রাইভেট ডকুমেন্ট দেখা কি শোভন হবে? আমাদের উচিত বিভব শর্মার কাছে ওটা জমা করে দেওয়া।
রাখুন তো আপনার উচিত-অনুচিত। তারা কোন নীতিটা মেনেছে? যত সব ফোরটোয়েন্টি! বলতে বলতে বুমবুমকে হটিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল পার্থ। কম্পিউটার চালু করে পেনড্রাইভ লাগাল জায়গা মতো। উৎসাহী গলায় বলল, দেখা যাক, ব্যাটাদের কোনও গোপন তথ্য আবিষ্কার করা যায় কিনা!
কম্পিউটার সচল হতেই পেনড্রাইভখানা লোড করে ফেলল পার্থ। মাউস টিপতেই বিস্ময়। ছবি, সার-সার ছবি। নিছক ফোটোগ্রাফ নয়, ক্যামেরাবন্দি একগুচ্ছ পেন্টিং, সবক’টারই বিষয়বস্তু পর্বত। সম্ভবত হিমালয় নিয়ে আঁকা। অনভিজ্ঞ চোখও বলতে পারে, কোনও দক্ষ শিল্পীর কাজ। একটি ছবিতেও রং চড়া নয়। নীল, বাদামি, লাল, সবুজ, সবই বেশ হালকা-হালকা। আলোছায়ার খেলাও আছে ছবিতে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়।
অবনী বললেন, এ তো কোনও বড় আর্টিস্টের এগজিবিশন থেকে তোলা ফোটো।
হুম, মিতিন বিড়বিড় করল, খুব পাওয়ারফুল ডিজিটাল ক্যামেরায় এবং সবকটা ছবিই মনে হয় জলরঙে আঁকা।
পার্থ বলল, মোট সাঁইত্রিশটা আছে। তার মধ্যে তিনটেতে ক্রস মার্ক। কেন বলো তো?
হ্যাঁ। কেমন অদ্ভুত ঠেকছে, মিতিনকে যেন সামান্য চিন্তিত দেখাল, বৈজনাথ রাইকে তিনখানা ছবি আঁকার অর্ডার দিয়েছিল না লোক দুটো?
তাই তো। ঠিকই তো, পার্থ ঢকঢক মাথা নাড়ল, কিন্তু আঁকা ছবি কেন আবার আঁকতে বলবে? কপি করাচ্ছিল?
হতে পারে, অবনী বললেন, অনেকে তো ভাল ছবির কপি দিয়েও ঘর সাজায়।
তাই কি? মিতিন ঠোঁট টিপল, ব্যাপারটা নিয়ে তো এবার ভাবতে হচ্ছে–।
মিতিনমাসির এই স্বর ভীষণ চেনা। টুপুরের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। নির্ঘাত রহস্যের গন্ধ পেয়েছে মিতিনমাসি।