৩-৪. উড়োজাহাজ থেকে

উড়োজাহাজ থেকে বাইরের পৃথিবীটা দেখছিল টুপুর। জানলার কাচে চোখ লাগিয়ে। আকাশ আজ পুরো নির্মেঘ বলে নীচের মাঠ-ঘাট-প্রান্তর-নদীনালা দিব্যি দেখা যায়। ঠিক দেখা নয়, বোঝা যায়। ভূপৃষ্ঠের রং বদলে যাচ্ছে ক্রমশ। দিল্লি থেকে প্লেন ছাড়ার পর বেশ খানিকক্ষণ সবজেটে ছিল, তারপর কখনও খয়েরি, কখনও বাদামি। এবড়োখেবড়ো পাহাড় উঁচু হয়ে গেল আচমকা। তার মাথায়-মাথায় বরফের রেখা। কী সুন্দর, কী সুন্দর, তাকিয়ে থাকলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কলকাতা থেকে দিল্লি আসার সময়ে বুমবুম জানলার ধারে বসেছিল। শ্রীনগর পর্যন্ত বাকি পথটুকু টুপুরের পালা। ভাগ্যিস টুপুর বুদ্ধি করে এই বন্দোবস্তটা করেছিল, নইলে নিসর্গের এমন অপরূপ ভোলবদল তার অদেখাই থেকে যেত।

টুপুরের পাশে পার্থ। হঠাৎ মেসোর গলা কানে এল টুপুরের, কী রে, খাবি কিছু?

প্লেনের সরু প্যাসেজে ট্রলি নিয়ে হাজির দুই বিমানসেবিকা। ফিরে তাদের ঝলক দেখল টুপুর। মাথা নেড়ে বলল, আমার তেমন খিদে পায়নি।

আমার কিন্তু থোড়া থোড়া ভুখ লাগছে। দিল্লির ফ্লাইটে লাঞ্চটা তেমন জমেনি। চিকেনের পিসগুলো কেমন ছিবড়ে-ছিবড়ে ছিল।

খাও না যা ইচ্ছে। স্যান্ডউইচ নিই, কী বল? সকাল থেকে তোর মাসি যা ঘোড়ায় জিন লাগিয়ে ছুটছে… শ্রীনগর পৌঁছে হয়তো আবার দৌড়বে… মুখে কিছু গোঁজারই টাইম মিলবে না। ভাল চাস তো পেটে কিছু লোড কর। চিপস, কাজু, এনিথিং।

বুমবুম আইল সিট থেকে বলল, আমার দু’প্যাকেট চিপস চাই বাবা। আমি একা খাব।

না। দুটোই কিনছি। একটা তোমার, একটা দিদির। ঠিক আছে?

ঠোঁট উলটে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে, বিচিত্র ভঙ্গি করছে বুমবুম। টুপুর হেসে ফেলল। ঝুঁকে দেখল ওদিকের আইল সিটে বসে থাকা মিতিনকে। ল্যাপটপ খুলে গভীর মনোযোগে কী যেন পড়ছে মাসি। ফ্লাইটেও সারাক্ষণ ল্যাপটপে ডুবে ছিল। মগজে কী কী যে ঢোকাচ্ছে কে জানে।

চিপসের প্যাকেট হাতে নিয়ে টুপুর ফের চোখ রাখল জানলায়। আবার পার্থর গলা, তোর মাসিটা বহুৎ চালু আছে, বুঝলি।

মিতিনমাসি যে বুদ্ধিমতী, এ আর নতুন কী কথা?

 তার সঙ্গে এখন নাটক করার প্রতিভাও যুক্ত হয়েছে রে।

 মানে?

দেখলি না, মনোজবাবুকে প্রথমে একপ্রস্থ দাবড়ানি, তারপর হেব্বি গ্র্যাভিটি দেখিয়ে ভদ্রলোককে কৃতার্থ করার ভান… ব্যস, তাতে মনোজও ফ্ল্যাট। দিব্যি কাজের ছুতোয় ফুল ফ্যামিলির কাশ্মীর বেড়ানোর বন্দোবস্ত হয়ে গেল। খরচখরচা সমেত।

গতকাল মনোজবাবুর সঙ্গে মিতিনমাসির রুক্ষ ব্যবহার যে অনেকটাই অভিনয়, তা টুপুরও মানে। তবু মেশোর কথার প্রতিবাদ করে বলল, ছুতো বলছ কেন? মাসি তো কাজেই যাচ্ছে।

আরে ছাড়। একটা পঁচিশ-ছাব্বিশ বয়সের ছেলেকে পাহাড়পর্বতে ভরা কাশ্মীরে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নাকি? সন্তর্পণে স্যান্ডউইচের মোড়ক খুলতে খুলতে পার্থ চোখ টিপল, এবার আমাদের আসল কাজে নামতে হবে, বুঝলি।

সেটা কী?

কাশ্মীরের প্রতিটি টুরিস্ট স্পট চষে ফেলা। গুলমার্গ, সোনমার্গ, খিলানমার্গ, পহেলগাঁও… চার-চারখানা মুঘল গার্ডেন… উলার লেক… কিচ্ছুটি বাদ দেওয়া চলবে না।

যাহ, তা হয় নাকি? মাসি কি বেড়াতে যাচ্ছে?

আরে, আমরাও কি বেড়াব? পার্থ খিকখিক হাসছে, ঘোরাঘুরি তো তদন্তেরই পার্ট। কে বলতে পারে, দেবল ওই সব জায়গায় লুকিয়ে নেই? অভিযানের গপ্পো ফেঁদে, বাবাকে ঘাবড়ে দিয়ে, হয়তো সে এখন ঝিলাম নদীতে ট্রাউট মাছ ধরছে?

ইস তুমি কী যে বলো না! টুপুরও হাসছে। একটু-একটু যেন কৌতূহলও ফুটল গলায়, তা যদি এদিক সেদিক যাই, কীভাবে ঘুরব? কন্ডাক্টেড টুর?

আরে ছোঃ। সঙ্গে একটা গাড়ি না থাকলে জমে? তোর মাসি যে অত টাকা পেল… খরচা করতে হবে না? প্রয়োজনে সিনিক স্পটগুলোয় নাইট হল্ট করব। তন্নতন্ন করে খুঁজব ছেলেটাকে। হা হা।

তুমি কি দেবল বড়ুয়ার গায়েব হওয়াটাকে একবারেই পাত্তা দিচ্ছ না?

দেওয়ার তো কোনও কারণ দেখি না।

তা হলে মাসি বুঝি এমনি এমনি সিরিয়াস হয়ে গিয়েছে? স্রেফ অকারণে?

তোর মাসির তো এটাই রীতি রে। একটা অতি সরল ঘটনাকে ক্রমশ জটিল করে বাহবা কুড়োয়, পার্থ স্যান্ডউইচে প্রকাণ্ড কামড় বসাল। পেপার ন্যাপকিনে ঠোঁট মুছে বলল, তুই নিজেই ভেবে দ্যাখ, কেসটায় কী আছে? লেখাপড়া নিয়ে পাগল এক ছেলে, কিছুর একটা গবেষণায় মেতে, হুট করে কাশ্মীরে চলে এসেছে। বাবা-মাকে হয়তো জানিয়ে আসেনি, তাতেই বা কী? সাচ্চা গবেষকদের ওসব হুঁশ থাকে নাকি? এখানে এসে ছেলেটা কোথাও একটা যাচ্ছে, তা নিয়ে তার বাবা-মা উৎকণ্ঠিত থাকতে পারে, কিন্তু মিতিনের সেখানে কী ভূমিকা? এ যেন পয়সা দিয়ে তোর মাসিকে ছেলেটার বডিগার্ড ফিট করে দিল। থার্ড আইয়ের মালকিন বিখ্যাত গোয়েন্দা প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জিকে কি এই কাজ মানায়?

না মেসো। তুমি বোধহয় ঠিক বলছ না। এই কেসে কোনও এক সাহেবের লেখা বৌদ্ধদের কী সব পুঁথিটুথির ব্যাপার আছে। তার উপর মনোজবাবুর বাড়িতে পুঁথি সরানোর জন্য চোর ঢুকেছিল…

মনোজবাবুর সব ইনফরমেশনে অনেক ভেজাল আছে রে টুপুর। তোর মাসি হয়তো এখনও ধরতে পারেনি, কিন্তু আমি এক-এক করে বলে দিতে পারি।

কীরকম?

তা হলে গোড়া থেকেই বলি। ছেলে মঙ্গলবার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে আর বাড়িই ফিরল না, তখন কি বাবা-মা’র টনক নড়েছিল? উত্তরটা যদি ‘না’ হয়, তা হলে বুঝতে হবে ছেলে মাঝে-মাঝেই রাতে বাড়ি ফেরে না। সুতরাং সে হঠাৎ কাশ্মীর গেল, কী কামস্কাটকা, তা নিয়ে মনোজবাবুদের উচাটন হওয়ার কোনও মানে হয় না। খেয়াল করে দ্যাখ, মঙ্গলবার রাতের প্রসঙ্গটা কিন্তু মনোজবাবু এড়িয়ে গিয়েছেন।… তারপর ধর, বুধবার ছেলের ফোন এল। আবার বুধবার রাতেই চোর বাড়িতে হানা দিল। এটা যেন কেমন কেমন লাগে না? ছেলের ব্যাপারে থানায় না যান। চোরের কথা কি মনোজবাবুর পুলিশকে জানানো উচিত ছিল না?

টুপুর অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল, কেন জানাননি বলো তো?

আমারও তো সেটাই প্রশ্ন। তা ছাড়া চোরের আগমন কখন ডিটেক্ট করলেন, সে ব্যাপারেও তিনি আশ্চর্য রকমের নীরব। শুধু তাই নয়, ছেলে যে পুঁথির বাক্সখানা নিয়ে গিয়েছে, তা তিনি কবে আবিষ্কার করলেন? শুক্রবার। অথচ চোর বুধবার রাতে ঘর লন্ডভন্ড করে গিয়েছে। এবং পুঁথির বাক্স তো তখনই নেই। গল্প দুটো মিলছে কি? গোঁজামিল মনে হচ্ছে না?

হ্যাঁ গো। গোলমেলেই ঠেকছে, টুপুরকে মানতেই হল। তাও সংশয়মাখা স্বরে বলল, কিন্তু মেসো, মনোজবাবু মিছিমিছি গল্প ফাঁদলেন কেন? পাঁচলাখ টাকা দেবেন বলেছেন, তা-ই বা কী কারণে?

এটাও বুঝলি না? যে-কোনও ভাবেই হোক, ছেলের পিছনে তিনি গোয়েন্দা লাগাতে চান। আর তার জন্য একটা জুতসই যুক্তি খাড়া করতে হবে তো। ওই পুঁথির কাহিনি দিয়ে দিব্যি একটা রহস্যের টোপ তৈরি হল, তোর মাসিও অমনি খপাৎ করে বঁড়শি গিলে নিল, পার্থ ভুরু নাচিয়ে বিজ্ঞের মতো বলল, আর পাঁচলাখের কথা বলছিস? টাকাটা বউয়ের চাপে পড়ে খরচ করতে মনোজবাবু বাধ্য হচ্ছেন।

পার্থমেসোর কথাগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তবু টুপুরের মনে যেন খটকা থেকেই যাচ্ছে। মিতিনমাসি তো এত কাঁচা কাজ করে না। কাল মনোজবাবু যাওয়ার পর কাদের যেন রাশি রাশি ফোন করল, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের আই জি আঙ্কলের সঙ্গে কথা বলল প্রায় দেড়ঘণ্টা। লালবাজারের সাইবার ক্রাইম বিভাগের সঙ্গেও ফেসবুক নিয়ে কী যেন আলোচনা করছিল মাসি। এসবের পিছনে নিশ্চয়ই মাসির নিজস্ব যুক্তি আছে। আছেই।

টুপুরকে অবশ্য এখনও কিছুই বলেনি মিতিনমাসি। বাড়ির কুলুঙ্গি থেকে পুঁথি উদ্ধার হওয়া নিয়ে মাসিকে শুনিয়ে-শুনিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল টুপুর। মাসি গ্রাহ্যই করল না। যাক গে, ওসব ভেবে কী লাভ। টুপুর তো মাসির লেজে-লেজেই আছে। যা হবে, সে তো দেখতেই পাবে।

বিমানের প্রপেলারের গর্জন চলছে একটানা। তারই মাঝে বেজে উঠল মাইক। প্লেন এবার নামবে শ্রীনগরে, যাত্রীদের সিট বেল্ট বাঁধার নির্দেশ দিচ্ছেন পাইলট। ঘুমন্ত ঘুমন্ত গলায়। কোমরে ঝটপট ফাঁস এঁটে টুপুর চোখ চাপল কাচে। আহা, কী মনোরম দৃশ্য। সামনে বরফে ঢাকা পীরপাঞ্জাল পর্বতমালা, নীচের ঢালে এক গাঢ় সবুজ উপত্যকা। নাগরদোলার মতো নামছে বিমান। গাছপালা, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট মিলিয়ে পটে আঁকা ছবিটা কাছে আসছে ক্রমশ, আরও কাছে এল। আরও কাছে। ঢক করে মাটি ছুঁল চাকা। তরতরিয়ে ছুটছে এবার। গতি কমাচ্ছে, থামল অবশেষে।

ছোট্ট বিমানবন্দরটির বাইরে এসে সামান্য হতাশই হল টুপুর। কোথায় স্বর্গের নন্দনকানন? চারদিক তো রীতিমতো ধুধু। বাতাসে ঠান্ডার লেশমাত্র নেই, বিকেল সাড়ে চারটেতেও গরম লাগছে বেশ।

লাগেজ ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে বেরিয়েছে বুমবুম। টুপুরের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আমরা এখন কোন হোটেলে যাব রে দিদি?

টুপুরের খুব ইচ্ছে হাউজবোটে থাকার। জলের মাঝে নৌকোর মধ্যে বাস করছে, ভাবনাতেই যে কী রোমাঞ্চ! তবু বাসনাটা গোপন করে আলগা ভাবে বলল, সে মাসি জানে।

দীর্ঘক্ষণ পর সুযোগ পেয়ে সিগারেট ধরিয়েছিল পার্থ। বড় একটা টান মেরে বলল, কাল নেটে দেখলাম ডাল লেকের ধারে বেশ কয়েকটা দেখনবাহার লজ আছে। সবাই চাইলে কোনও একটা রিসর্টেও ওঠা যায়। লেকের একেবারে মধ্যিখানে, দ্বীপের উপর।

বুমবুম বলল, আমরা পাহাড়ের মাথায় থাকতে পারি না? ওখান থেকে সানরাইজ, সানসেট দেখব।  

পার্থ আলগা চাপড় দিল বুমবুমের পিঠে। তরল সুরে বলল, দূর বোকা, শ্রীনগর তো একটা উপত্যকা। চারদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। এখানে সূর্য ওঠা, ডোবা কোনওটারই তেমন চার্ম নেই। ভাল সানরাইজ দেখতে হলে…

বাক্যটা শেষ হল না। একটা ট্যাক্সি ধরে এনেছে মিতিন। হাত নেড়ে ডাকছে।

ট্যাক্সিচালক এক প্রবীণ। পাক্কা কাশ্মীরি চেহারা। টকটকে রং, টিকলো নাক, নিখুঁত কামানো দাড়ি। পরনে ঢোলা কুর্তা-পাজামা, মাথায় ফেজ টুপি। দরজা খুলে নেমে এসে নিজেই তিনখানা সুটকেস তুলে দিলেন ডিকিতে। টুপুররা সিটে বসার পর স্টার্ট দিয়েছেন গাড়ি। তার পাশের আসনে মিতিন, তাকেই নম্র স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, হাঁ বহেনজি, বোলিয়ে কাঁহা জায়েঙ্গে আপ?

মিতিন কেজো গলায় বলল, আমন গেস্ট হাউজ।

ও কাঁহা পর হ্যায়? লালচকমে?

নেহি। রিসেপশন সেন্টারকে বাদ লেফট ঘুমকে শেরওয়ানি রোড পকড়কে সোনাওয়ার বাগ তক চলনা। উঁহা হোটেল তরানুমকে বগলমে এক গল্লি হ্যায়। উসকি অন্দরমে চার বিল্ডিং ছোড়কে ডাহিনা। সমঝ গয়ে না?

হাঁ জি। আপ ইধারমেই কঁহি রহতে হ্যায় কেয়া, বহেনজি?

নেহি তো ম্যায় তো পহেলি দফা শ্রীনগরমে আ রহি হু।

 তাজ্জব কি বাত! হমারা শহরকো ইতনা আচ্ছা পেহচানতা হ্যায়…

মোবাইল ফোন কী কামাল, হাতের আইফোনটা দেখাল মিতিন। স্মিতমুখে বলল, ইসমে জি পি এস হ্যায় না…

তবু যেন বিশ্বাস হচ্ছে না প্রবীণ কাশ্মীরির। গাড়ি চালাতে-চালাতেই বারবার টেরিয়ে তাকাচ্ছেন মিতিনের দিকে। মিতিন কিন্তু মোটেই বিব্রতবোধ করল না। ঘাড় ঘুরিয়ে সহজ ভাবে টুপুরকে বলল, গেস্ট হাউজটা তেমন আহামরি নয়। খাট-বিছানা মোটামুটি, বাথরুম চলেবল, রুমে টিভি নেই, খানা একেবারেই বাঁধাগতের।

টুপুর কিছু বলার আগেই পার্থর প্রশ্ন ধেয়ে এল, নেটে বুক করলে?

ওই আর কী।

এর চেয়ে ভাল কিছু চোখে পড়ল না?

তাকাইনি। এই গেস্ট হাউজে ওঠাটাই আমার কাছে জরুরি ছিল।

 কেন? অতিথিশালাটির কোনও বিশেষত্ব আছে বুঝি?

গেলেই মালুম হবে।

 বাতাসে জবাব ভাসিয়ে দিয়ে আইফোন ব্যাগে চালান করল মিতিন। পুরনো আদ্যিকেলে মডেলের একটা মোবাইল বের করেছে। টিপছে খুটখাট, পরীক্ষা করছে কী যেন।

টুপুর জিজ্ঞেস করল, এটা বাতিল করে দিয়েছিলে না?

উঁহু, চালুই ছিল, ব্যবহার করতাম না। বড্ড ঘ্যাড়ঘ্যাড় করে তো। এখন এর সিমটা ভরব আইফোনে আর আমার নম্বরটা চলে যাবে এই ফোনে। ফেরার সময়ে দিল্লিতে আবার বদলাবদলি করে নেব।

টুপুর চোখ পিটপিট করল, এত ঝামেলা ঝঞ্জাট করবে কেন?

ওটাতে বি এস এন এল-এর কানেকশন আছে যে। পোস্টপেড। এই কাশ্মীর ভ্যালিতে আর কোনও সার্ভিস প্রোভাইডার কাজ করে না। সুতরাং এখন থেকে ওই সিম দিয়েই বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে।

হ্যাঁ, ঠিকই তো, পার্থ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, আমি তো নিয়মটা জানতাম, তবু কেন যে বাড়িতে আগের সিমটা ফেলে এলাম…

এখন আর আফশোস করে লাভ আছে? বাইরে তাকাও, মন দিয়ে প্রকৃতি দ্যাখো।

মিতিনের এই কথাটাও টুপুরের কানে ঠাট্টার মতো শোনাল। কোথায় প্রকৃতি? নিসর্গ চুলোয় গিয়েছে, শহরে ঢোকার পর থেকেই অফিস ছুটির বেমক্কা ভিড়। ট্র্যাফিক জ্যামে ট্যাক্সি প্রায় নিথর। ধুলোয় ঢেকে গিয়েছে বাতাস। পোড়া পেট্রল-ডিজেলের গন্ধে বন্ধ হয়ে আসছে নিশ্বাস। কোলাহলেও কানে তালা লাগার জোগাড়। এ যদি ভূস্বর্গ হয়, কলকাতাও তো তা হলে অমরাবতী!

যানবাহনের চাপে হাঁসফাস করতে-করতে আমন গেস্ট হাউজের সামনে থেমেছে ট্যাক্সি। সাধারণ একটা দোতলা বাড়ি, সাইনবোর্ড না থাকলে খুঁজে বের করা যেত কিনা সন্দেহ।

তিনধাপ সিঁড়ির পর একটা খোলা দরজা। টুপুর আর বুমবুমকে নিয়ে ভিতরে ঢুকেছে মিতিন।

জিনস টি-শার্ট পরা এক তরুণ কম্পিউটারে মগ্ন। মিতিনকে দেখে চোখ তুলল, ইয়েস ম্যাম, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?

মিতিন বলল, পারহ্যাপস ইউ হ্যাভ রিসিভড মাই ইমেল লাস্ট নাইট?

মুহূর্ত থমকে থেকে ছেলেটি উঠে দাঁড়াল, ও, আপ হি মিজ মুখার্জি। রুম আপকা রেডি হ্যায়, বলেই গলা ওঠাল, কলিমভাই, ম্যাডামলোগকা সামান তিন নাম্বারমে পউছা দো। জলদি, জলদি।… আইয়ে আইয়ে আপ সব আইয়ে। ওয়েলকাম টু কাশ্মীর। আই অ্যাম মিলাপ, রানিং দিস স্মল জয়েন্ট।

চলছে কাশ্মীরি আপ্যায়ন, এক মধ্যবয়সি জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছেন ভিতরে। পিছনে পার্থ আর বুমবুম। মিতিন দাঁড়িয়েই আছে। মিলাপ বলল,

আপ ভি যাইয়ে ম্যাডাম, হোড়া আরাম কিজিয়ে…

এক সেকেন্ড, মিতিন ব্যাগ খুলে দেবলের একটা ফোটো এগিয়ে দিল, ক্যান ইউ রিমেমবার দিস ম্যান?

একবার তাকিয়েই মিলাপ বলল, ওহ শিয়োর। লাস্ট উইক হি কেম টু দিস প্লেস।

অ্যান্ড দিস ম্যান?

আইফোনটা বাড়িয়ে দিয়েছে মিতিন। মনিটরে বছর পঁয়তাল্লিশের একটা মুখ। সরু গোঁফ, ফোলা গাল, একমাথা চুল, চোখে সানগ্লাস।

টুপুরের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এটা কার ফোটো? মিলাপকে কেনই বা ফোটোটা দেখাচ্ছে মাসি!

.

০৪.

উত্তেজনায় পেট ফুলছিল টুপুরের। গেস্ট হাউজের কামরায় ঢুকে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, জানো পার্থমেসো, এখানে পা রেখেই মিতিনমাসি কিন্তু তদন্তের কাজ স্টার্ট করে দিয়েছে।

পার্থ বিছানার চাদর সরিয়ে দেখছিল কী যেন। হালকা চালে বলল, সে তো আমিও শুরু করেছি রে। খাটে ছারপোকা আছে কিনা খুঁজছি। মনে হচ্ছে পেয়ে যাব। বসামাত্র কামড়াচ্ছিল।

আহা, মজা কোরো না। কথাটা শোনো। দেবল বড়ুয়া নাকি এই গেস্ট হাউজেই উঠেছিল।

বটে? আমিও এরকমই একটা কিছু আন্দাজ করেছিলাম।

কী দারুণ ব্যাপার, তাই না? একদিনেই সঠিক জায়গাটাকে লোকেট করা…

মোটেই এটা কঠিন নয় টুপুর। দেবল যেখান থেকে ফোন করেছিল, তোর মাসি মনোজবাবুর কাছ থেকে সেই নম্বরটা নিয়েছে। তারপর ওই নম্বরে ফোন করলেই তো…।

এদের ফোন খারাপ হয়ে আছে মেসো। গত বৃহস্পতিবার থেকে।

তা হলে আর কী। নেটে একটা-একটা করে হোটেল, গেস্ট হাউজ ঘেঁটে বের করেছে। বুকিং-এর জন্যে এরা নেটে ফোননম্বর, ইমেল আইডি, সব দিয়ে রাখে।

মাসি আর-একটা খবরও জোগাড় করেছে।… দেবল বড়ুয়া নাকি এখানে একা আসেনি। সঙ্গে আর-একজন ভদ্রলোক ছিলেন।

তাই নাকি? এবার যেন পার্থ একটু চমকেছে, কে ভদ্রলোক?

রেজিস্টারে নাম আছে গো। চন্দ্রকুমার ত্রিবেদী।

 তিনি কে? কোনও প্রোফেসার টোফেসার নাকি?

মাসি বলল উনি নাকি একজন হিস্টোরিয়ান। ভুবনেশ্বরে থাকেন।

তাঁর সঙ্গে দেবলের কনট্যাক্ট হল কী করে?

 কে জানে, টুপুর ঠোঁট ওলটাল, দেবল এখন কোথায়, তাও ধরে ফেলেছে মাসি৷।

পার্থর গলা থেকে বিস্ময় ঠিকরে এল, ইজ ইট?

মাসিকে তুমি আন্ডার এস্টিমেট কোরো না মেসো। মাথা খাঁটিয়ে এই গেস্ট হাউজে এল বলেই না চটপট সমাধানটা পেয়ে গেল, টুপুরের চোখের তারা ঝিকমিক করে উঠল, ওই ভদ্রলোক আর দেবল একসঙ্গে লাদাখ গিয়েছে। লেহ-তে।

ওয়াও। এ তো কেল্লা মার দিয়া কেস, পার্থ উল্লসিত, কতকাল ধরে ভাবছি লেহ, লাদাখ যাব। ঝকঝকে নীল আকাশের নীচে পাহাড়ের ধারে টলটলে হ্রদের পাড় ধরে হাঁটছি! সেই স্বপ্ন তা হলে সার্থক হতে চলেছে?

মনে তো হয়। মাসি আর-একটা ভেলকি দেখিয়েছে, বুঝলে। মাসির আইফোনে সেই চন্দ্রকুমার ত্রিবেদীর ফোটো পর্যন্ত মজুত। একদিনের মধ্যে কীভাবে যে জোগাড় করল!

ওই ক্যালিটা আছে বলেই না তোর মাসি করে খাচ্ছে, তরল সুরে মিতিনের উদ্দেশে তারিফ ছুড়ল পার্থ, তা মহারানি কোথায়? এখনও আসছেন না কেন?

কাউন্টারে মিলাপ ছেলেটার সঙ্গে বকরবকর করছিল। আমায় রুমে পাঠিয়ে দিল। বলল, গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি বুমবুমকে নিয়ে একটু বেরোব, কিছু কেনাকাটা আছে।

একবার ঘরে এল না। কোনও মানে হয়? পার্থ নাক কোঁচকাল, তোর মাসির জাগতিক ব্যাপারে জ্ঞানট্যানগুলো বড্ড কম।

মিতিনমাসির নামে এরকম উলটোসিধে কিছু বললে টুপুরের বড় গায়ে লাগে। ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, কী গলতিটা দেখলে মাসির?

একবার সরেজমিন করে যাবে না, কোন ছিরির গলতায় এনে তুলল? খাটে ভাল গদি পর্যন্ত নেই। খসখসে কয়্যার গায়ে ফুটছে। বাথরুমে নো শাওয়ার। কলের জলে বালতি ভরে চান করতে হবে। কমোড পর্যন্ত রাখেনি, ভাব তুই?

টুপুর একটু ফাঁপরে পড়ে গেল। কমোড না থাকাটা সত্যিই সমস্যা। ছোটবেলা থেকে যা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। পরক্ষণেই ধমকাল নিজেকে। সে না ভবিষ্যতে গোয়েন্দা হতে চায়? কী বলেছে মিতিনমাসি? ডিটেকটিভ হওয়ার একদম প্রাথমিক শর্ত, যে-কোনও প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারা। কোনও ফ্যাচাং চলবে না। মনের মতো খাবার নাও জুটতে পারে, মাথার উপর ছাদ না থাকাও অসম্ভব নয়, সব সইতে হবে হাসিমুখে। তাহলে তুচ্ছ দু-চারটে সুবিধে নেই বলে আজ দুশ্চিন্তা করা কি সাজে টুপুরের?

মনকে প্রবোধ দিল বটে টুপুর, কিন্তু খচখচানি একটা থাকছেই। তাদের ক্লাসের সংহিতা গত পুজোয় বেড়াতে এসেছিল কাশ্মীর। উঠেছিল চশমেশাহি নামের মুঘল গার্ডেনের সরকারি অতিথিশালায়। সেখানে চারদিকে ফুলের বাগান। রংবেরঙের গোলাপ দেখে-দেখে চোখ নাকি ধাঁধিয়ে গিয়েছিল সংহিতাদের। আর টুপুররা কিনা থাকছে এঁদোগলির ভিতর এক অগামারা ছপ্পড়ে? সিনসিনারি বলতে শুধুই পাশের আস্তাবল, যেখান থেকে ঘোড়ার নাদি উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে! ফিরে তো কাউকে গল্পও করতে পারবে না টুপুর!

ছোট শ্বাস ফেলে টুপুর বাথরুমে ঢুকল। জল ছিটোল মুখে-চোখে। সেই কোন সকাল আটটায় ঢাকুরিয়া থেকে বেরিয়েছিল, এখন প্রায় ছ’টা বাজে। সারাদিনের লম্বা দৌড়ে শরীর গরম হয়ে গিয়েছে, শীতল জলের ছোঁয়ায় আরাম হল ভারী। বেরিয়ে দেখল ওই বিছানাতেই লম্বা হয়েছে পার্থমেসো।

অন্য শয্যায় গড়িয়ে না পড়ে কোণের হাতল ছাড়া চেয়ারে বসল টুপুর। অল্প গলা উঠিয়ে বলল, কী গো, ঘুমোলে নাকি?

উঁহু, চোখ না খুলেই পার্থ বলল, নতুন করে প্ল্যান ছকছি।

কীরকম?

লাদাখের পথে পা বাড়ানোর আগেই কীভাবে কম সময়ে ঝটাকসে কাশ্মীরটা ঘুরে নেওয়া যায়, পার্থ উঠে বসল। ঠোঁট টিপে বলল, ধর, একদিনে গুলমার্গ খিলানমার্গ প্লাস বাগানগুলো দেখে নিলাম, আর-একদিনে যদি যদি সোনমার্গ-পহেলগাঁও সারতে পারি… সঙ্গে উলার হ্রদটাও যদি মেরে দেওয়া যায়…

দড়াম করে দরজা খুলে গেল। তিরবেগে প্রবেশ করল বুমবুম। পিছনে পিছনে মিতিন। তার দু’হাতে ইয়া-ইয়া প্লাস্টিকের ঝোলা।

পার্থ অপ্রসন্ন স্বরে বলল, সাত তাড়াতাড়ি শপিং করতে ছোটার কী দরকার ছিল। আমরা সবাই মিলে বেরিয়েই না হয়…।

আমার শিক্ষা একটু অন্য রকম স্যার, মাথা থেকে ক্লিপ খুলে চুল ছড়িয়ে দিল মিতিন। খাটের ধারে বসে বলল, হাতের কাজ আমি ফেলে রাখতে পারি না।

কেনাকাটা তোমার হাতের কাজ? কিনলেটা কী?

একটা কোল্ডড্রিঙ্কসের বোতল নিয়ে বুমবুম নেচে বেড়াচ্ছে ঘরময়। টুপুরকে গিয়ে ঠেলা মারল, অ্যাই দিদি, ওঠ না। কী এনেছি দ্যাখ না।

খপ করে বুমবুমের হাত থেকে বোতলটা কেড়ে নিল টুপুর। ভাই বাধা দেওয়ার আগেই চোঁচো টান দিল কয়েকটা। বোতল ফের বুমবুমকে ধরিয়ে দিয়ে ঝোলা দুখানা ঘাঁটছে। অবাক সুরে বলল, এসব কী এনেছ মাসি?

গ্লাভস, মোজা, ফুলহাতা গেঞ্জি…।

সবগুলোই খাঁটি পশমের। সঙ্গে টুপিও আছে। প্রত্যেকের জন্য সানগ্লাসও।

কিন্তু কেন? আমাদের সুটকেস তো সোয়েটার-জ্যাকেট-মাফলারে বোঝাই।

তবু লাগবে। লাদাখের ঠাণ্ডা খুব সাংঘাতিক। একটু অসাবধান হলেই ফ্রস্টবাইট বাঁধা। আর কালো চশমাটা স্টাইল করার জন্য নয়, ওটাও ভীষণ ভীষণ জরুরি।

জানি ম্যাডাম, পার্থ গলা ঝাড়ল, পলিউশন নেই বলে লাদাখে সান রে বেজায় চড়া। অতিবেগুনি রশ্মির পরিমাণও বেশি। তাই দিনের বেলায় চোখকে প্রোটেক্ট করতে ওই চশমাটি ব্যবহার করতে হয়। ঠিক বলেছি?

তোমার অসীম জ্ঞান। এবার একটা আনন্দ সংবাদ দিই?

টুপুর আমায় শুনিয়ে দিয়েছে।

 সরি, টুপুর এটা জানে না। বুমবুম, বাবাকে বলে দে তো।

এক্ষুনি গরম-গরম চিকেন পকোড়া আসছে, বুমবুম উচ্চস্বরে ঘোষণা করল, সঙ্গে কফি।

এই একটা কাজের কাজ করেছ, পার্থর খুশি আর ধরে না। দু’গাল ছড়িয়ে বলল, আরও একটা ভাল কাজ করে ফেলো।

কী?

আমন গেস্ট হাউজে আসার উদ্দেশ্য তো সফল হয়েছে, মোটামুটি হদিশ মিলেছে দেবলের। কষ্ট করে এখানে থাকার আর কী দরকার। এখন যে ক’টা দিন শ্রীনগরে আছি, একটু বেটার কোথাও স্টে করলে হয় না? যেখানে পটিটা অন্তত শান্তিতে করতে পারি?

আই এগ্রি, মিতিনের মুখ ভাবলেশহীন, কাল আমরা আমন গেস্ট হাউজ ছেড়ে দেব।

থ্যাঙ্ক ইউ। সন্ধেবেলায় আজ তা হলে হোটেল খুঁজি?

 প্রয়োজন নেই। মোটামুটি বন্দোবস্ত করে এসেছি। রাতটা কাটতে দাও।

 এই আমনের চেয়ে কমফর্টেবল তো?

জবাব না দিয়ে মিতিন হাসল একটু। এদিকে খাবার নিয়ে এল কলিম। ট্রে থেকে শুধু প্লেট নামার অপেক্ষা, তারপরই টকাটক তুলছে সবাই। টম্যাটো সস মাখিয়ে পার্থর চিকেন পকোড়া গালে পোরা দেখে কে বলবে মাত্র ঘণ্টা দেড়েক আগে গোবদা স্যান্ডউইচ সাঁটিয়েছে মানুষটা।

আহ্লাদিত স্বরে পার্থ বলল, এদের রান্নাবান্নার মান খারাপ নয়। তা হলে রাতে এখানে খেতে পারি?

মেনুটা যদি মনোমতো হয়, তো কীসের আপত্তি? মাটন রেজালা আর লাচ্ছা পরোটা। কী রে টুপুর, জমবে না?

টুপুর অন্য কথা ভাবছিল। মেসোর প্রশ্নে ঘাড় নেড়ে দিয়ে মিতিনকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মাসি, দেবল বড়ুয়া যে আমন গেস্ট হাউজে একা আসেনি, জানলে কীভাবে?

বুঝলি না, ঝড়ে বক কেস, পার্থই জবাব দিল, মাসি ওয়াইল্ড গেস ছুঁড়েছিল, লেগে গিয়েছে।

তা কী করে হয়? আন্দাজই যদি হবে, মাসির কাছে সেই ভদ্রলোকের ফোটো এল কী করে?

এটা অবশ্য একটু ভাবার বিষয়, পার্থও প্রশ্ন জুড়ল মিতিনকে, কোথায় পেলে গো ফোটোটা?

যেভাবে কলকাতা ছাড়ার আগেই জানতে পেরেছিলাম, দেবল একা কাশ্মীর পাড়ি দেয়নি, ফোটোও মোবাইলে এসেছে ঠিক সেই ভাবেই।

ট্যানজেন্ট হয়ে গেল যে। তোমার জানার পদ্ধতিটা কী, সেটা তো বলবে।

খুব সিম্পল। শুধু মগজটাকে খাটানো, মিতিন মুচকি হাসল, অবশ্য সেই মগজে ঘিলু নামক বস্তুটি থাকা একান্তই জরুরি।

মাসির তির সঠিক স্থানে বিঁধেছে। পার্থ পলকে গুম। বুমবুম বাবার প্লেট থেকে একখানা পকোড়া তুলে নিল, দেখতেই পেল না যেন। চুপচাপ কচর কচর মুরগি চিবোচ্ছে।

মিলাপ স্বয়ং কফি নিয়ে হাজির। কাপ-প্লেট টেবিলে রেখে মিতিনকে বলল, ম্যাডামজি, ও গাড়িওয়ালা নাসিরভাই আ গয়া। ইঁহা ভেজ দু ক্যায়া?

জরুর। আয়্যাম ওয়েটিং ফর হিম।

মিলাপ বেরিয়ে যেতেই টুপুর বলে উঠল, তুমি একদম গাড়ি ফিট করে এসেছ!

পার্থর উদাস স্বর ভেসে এল, টুপুর, তোর মাসিকে বলে দে, কাল কিন্তু অনেক জায়গায় ঘুরতে হবে রে। ড্রাইভারের সঙ্গে যেন অন্তত দশঘণ্টার চুক্তি করে নেয়।

মিতিনও পালটা শুনিয়ে দিল, টুপুর, তোর মেসোকে জানিয়ে রাখ, আপাতত অন্তত টানা তিনদিনের জন্য ড্রাইভারসমেত গাড়ি বুক করা হবে। আশা করি, বাবুর আপত্তি নেই?

ব্যস, পার্থ গলে জল। উৎসাহী গলায় বলল, তা হলে কখন বেরোনো হবে কাল?

রহু ধৈর্যং। এক্ষুনি জানতে পারবে, বলতে বলতেই রুমে বছর পঁয়ত্রিশের এক রোগাসোগা যুবকের আবির্ভাব। মিতিনই বলল, সালাম আলেকুম নাসিরভাই।

যুবক মাথা ঝোঁকাল, আলেকুম সালাম, ম্যাডাম। আপ মুঝে ঢুনড রহি থি? লাদাখ যানে কে লিয়ে?

হ্যাঁ ভাইজান, উর্দু মেশানো চোস্ত হিন্দিতে বাতচিত শুরু করল মিতিন, মিলাপ বলছিল, আপনিই নাকি আমন গেস্ট হাউজ থেকে দু’জন বোর্ডারকে লাদাখ নিয়ে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ ম্যাডাম। গত বৃহস্পতিবার।

 তা হলে লেহ পৌঁছেছিলেন তো শনিবার। সোমবারের মধ্যে ফিরলেন কী করে? খুব ধকল গিয়েছে নিশ্চয়ই?

ওঁরা তো লেহ যাননি ম্যাডাম। কারগিলেই আমাকে ওঁরা ছেড়ে দিলেন। শুক্রবার সকালে।

সে কী! ওঁরা তা হলে গেলেন কোথায়?

তা তো জানি না। শুধু বললেন, এখন এক-দু’দিন নাকি কারগিলেই থাকবেন। কন্ট্রাক্টের গাড়িতে এমন হয় না। নিয়ম নেই বলে কারগিল থেকে প্যাসেঞ্জার তুলতে পারলাম না, আমাকে ফাঁকাই শ্রীনগর ফিরতে হল। ওঁরা কিছু রুপিয়া বাড়তি দিয়ে দিলেন বলে আমি আর কিছু বলিনি। তা আপনারা তো লেহ পর্যন্ত যাবেন নিশ্চয়ই।

ইচ্ছে তো সে রকমই। পুরোটা যাই না-যাই, ভাড়া আমরা পুরোই দেব। তা আমন গেস্ট হাউজের ওঁরা কারগিলে গিয়ে উঠেছিলেন কোথায়?

সরকারি টুরিস্ট বাংলোয় ওঁদের বুকিং ছিল। আপনারা ভি ওখানেই থাকবেন, আমি বন্দোবস্ত করে দেব।

থ্যাঙ্ক ইউ নাসিরভাই। তা হলে কাল সকালে আমরা ক’টায় রওনা হচ্ছি? পাহাড়ি রাস্তায় তো সকাল-সকাল স্টার্ট করতে হয়।

জরুর। ছ’টার মধ্যে তৈরি থাকবেন, আমি এসে যাব। বাদ মে নাস্তা করেঙ্গে, রাস্তেমে। ঠিক হ্যায়।

বিলকুল।  

সবাইকে সেলাম জানিয়ে বিদায় নিল নাসির। দেবলরা লেহ যায়নি শুনে টুপুর যেন সামান্য হতাশ। মাসির পরিকল্পনা কি খানিকটা গুলিয়ে গেল না? কারগিলে গিয়ে কি আদৌ সন্ধান মিলবে তাদের?

পার্থর ভারিক্কি গলায় টুপুরের চিন্তা ছিঁড়ে গেল, বুঝলি টুপুর, কপালে না সইলে ঘি, ঠকঠকালে হবে কী?

 হঠাৎ প্রবাদ আওড়াচ্ছ কেন?

 মনের দুঃখে। কাশ্মীরে এসেও কাশ্মীর দেখা হবে না, এ কি ভাবা যায়?

আহা আফশোস করছ কেন? মিতিন চিমটি কাটল, তোমার সব আবদারই তো মানা হয়েছে বাপু। কাল থেকে এই হোটেলে নো স্টে, গাড়ি ড্রাইভার সারাদিন তোমার হাতের মুঠোয়…।

অনেক হয়েছে। এবার কি আমরা একটু বেরোব? অন্তত ডাল লেকটাও যদি দেখতে পারি?

ঘুরে এসো। তবে আটটার মধ্যে ফিরো। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে।

তুমি যাবে না?

আমি তো বেড়াতে আসিনি স্যার। এখন নিরিবিলি ঘরে আমি একটু হিসেবে বসব।

কীসের হিসেব? কত কী খরচা হতে পারে, তার? সে নয় আমিই রাত্রিবেলায় এস্টিমেট করে দেব।

উঁহু, এ হল জমা খরচের হিসেব। তুমি পারবে না।

টুপুর ঠিক মানে বুঝতে পারল না কথাটার। এ তো টাকাপয়সার প্রসঙ্গ নয়, অন্য কিছু! দূর ছাই, এক-এক সময়ে কী যে বলে মাসি!