সকাল হতে না-হতেই মিতিনের ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছে হঠাৎ। টুপুরকে ডাকাডাকির বালাই নেই, ঘুম থেকে উঠেই কোথায় না-কোথায় বেরিয়ে গেল। ফিরেই বুমবুমকে বিছানা ছাড়াল, সে মুখ ধুতে না ধুতেই তার হাতে ধরিয়ে দিল দুধের গ্লাস। ঝটাঝট ফোন করল বেশ কয়েকখানা, স্মার্টফোনে নিবিষ্ট হয়ে ঘাঁটল কী যেন, তারই মধ্যে আরতিকে জলখাবার তৈরি করার তাড়া লাগাচ্ছে। টুপুর আর পার্থকে তৈরি হয়ে নিতে বলল চটপট, কারণ জিজ্ঞেস করতে গিয়ে একচোট ধমক খেল পার্থ। ফ্রেঞ্চটোস্ট আর কফি শেষ হতেই সে সালোয়ার-কামিজ পরে প্রস্তুত, পার্থকে গাড়ি বের করতে বলে আবার কাকে যেন ফোন করছে।
মাসির এই ব্যস্ত রূপটা টুপুরের দারুণ প্রিয়। বুঝতে পারে মাসির মগজটা এখন প্রবল সক্রিয়, নিজের মস্তিষ্কের সঙ্গে তাল রাখতেই বেজায় ছটফট করছে মাসি। মনে মনে একটা কিছু আঁচ করে নিয়েছে, এবার শুধু ধাপে ধাপে সেটাই মেলানোর পালা। এক্ষুনি জিজ্ঞেস করে কোনও লাভ নেই, জবাব মিলবে না, সুতরাং নীরবে মাসির কাজকর্ম দেখে যাওয়াই ভাল।
অবশ্য তাড়াহুড়োর ফাঁকে সকালের খবরের কাগজটায় চোখ বুলিয়ে নিয়েছে টুপুর। জৈন ধর্মশালার চুরির ঘটনাটা মোটামুটি ফলাও করেই বেরিয়েছে। চুরি যাওয়া পার্শ্বনাথের মূর্তিটি নাকি রুপোর, ওজন প্রায় দেড় কেজি, দু’চোখে দুখানা পান্না বসানো আছে, তার দামও নেহাত কম নয়। তা ছাড়া বেশ প্রাচীন বলে একটা ঐতিহাসিক মূল্যও আছে মূর্তিটার। পুলিশ যথেষ্ট তৎপর, কালই ধর্মশালার এক কর্মচারীকে সম্ভাব্য চোর হিসেবে গ্রেফতার করেছে। তবে মূর্তিটার কোনও হদিশ মেলেনি এখনও।
বুমবুমেরও আজ স্কুল বন্ধ। জন্মাষ্টমীর ছুটি। তাকে অঙ্ক করতে বসিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল মিতিন। টুপুর আগেই গাড়িতে, পার্থমেসোর পাশে।
পার্থ স্টার্ট দিল গাড়িতে। নীরবে চালাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কোনও ব্যাপারেই যেন তার আগ্রহ নেই। গাড়ি গলি ছেড়ে মেনরোডে, অমনি মিতিনের স্বর শোনা গেল, প্রথমে আমরা সোজা বড়বাজার যাব।
পার্থর গলা থেকে একটা সংক্ষিপ্ত ধ্বনি ঠিকরে এল, হুম।
বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই, আমাদের গন্তব্যস্থল জৈন ধর্মশালা।
আমার বোঝাবুঝির কোনও প্রয়োজন আছে কি? পার্থর গলা আরও গোমড়া শোনাল, ধর্মশালায় যাও, পাঠশালায় যাও, আমার কী?
এখনও চটে আছ, মিতিন ফিক করে হাসল, আরে বাবা, মেজাজ গরম থাকলে আমাকে হেল্প করবে কীভাবে?
আমার মতো গোবরগণেশের সাহায্যের কোনও দরকার আছে কি?
লাগে লাগে, কাজে লাগে বই কী, মিতিন ঠোঁট টিপে হাসল, এক-আধটা বোকাসোকা লোক পাশে না থাকলে চলে? বুদ্ধিমানদের তা হলে সার্ভিস দেবে কারা?
পার্থ রাগে ফেটে পড়তে যাচ্ছিল, হঠাৎ কী ভেবে তার ভুরুতে ভাঁজ। সন্দিগ্ধ স্বরে বলল, তুমি আমায় ইচ্ছে করে তাতাচ্ছ, তাই না?
যাক, ঘটে ঢুকেছে এতক্ষণে। এবার আন্দাজ করো দেখি, তোমাকে আজ প্রেসে যেতে না দিয়ে টেনে আনলাম কেন?
গাড়ি চালাতে চালাতে গর্বিত স্বরে পার্থ বলল, আত্মবিশ্বাস বাড়াতে।
ভুল অনুমান। নেক্সট গেস।
মূর্তিটা খুঁজতে আমার টিপস কাজে লাগাবে?
নো চান্স। খুবই মোটা দাগের কাজে তোমাকে লাগাব আজ। দেখি, তার মধ্যেই তোমার বুদ্ধির ছাপ রাখতে পারো কিনা।
মানে? কী করাতে চাও আমাকে দিয়ে?
খুব সিম্পল জব। আমি আর টুপুর যখন আহিরচাঁদজির সঙ্গে মোলাকাত করব, সেই সময়টায় তুমি অন্যদের জবানবন্দিগুলো নোট করে ফেলবে। ইন ডিটেল৷
যা থেকে তুমি মূর্তিচুরির কেসটা সল্ভ করতে পারো, তাই তো?
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না মিতিন। ঘাড় হেলিয়ে দেখছে কাচের বাইরেটা। সকাল দশটার কলকাতা, পথেঘাটে থিকথিকে ভিড়। খানিকক্ষণ সেই এলোমেলো জনতার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার ফিরিয়েছে মুখ। ঠান্ডা গলায় বলল, একটা কথা তোমাদের দুজনকে বলে রাখা ভাল। মূর্তিচুরির কেসটা সমাধান কিন্তু আমার মূল লক্ষ্য নয়।
তবে? টুপুর আর পার্থর গলা একসঙ্গে বেজে উঠল, আমরা তা হলে যাচ্ছি কেন?
শালিনীর স্বপ্নটার অর্থ উদ্ধার করতে।
টুপুর ফ্যালফ্যাল চোখে পার্থর দিকে তাকাল। পার্থর দৃষ্টিও কেমন বিস্ফারিত। মিতিনের কথার মানে উদ্ধার করতে বেহাল দু’জনে। তবু সাহস করে প্রশ্ন করতে পারছে না কেউ। পাছে বোকা প্রতিপন্ন হতে হয়।
মিতিনও কিছু ভাঙল না। মোবাইল ফোনে কী যেন খুঁজছে মন দিয়ে। যানজট কাটিয়ে কাটিয়ে পার্থ মহাত্মা গাঁধী রোডে ঢুকে পড়েছে। এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে গলাখাঁকারি দিল, অমনি মিতিনও সজাগ। মোবাইলকে ঘুম পাড়িয়ে নেমে এল। দেখাদেখি টুপুরও।
রিকশা, ঠেলা, মানুষের উথালপাথাল ঢেউয়ে টলমল করছে বড়বাজার। শহরের অজস্র ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। এই ব্যস্ত সময়ে বাস-ট্রাম ট্যাক্সি-প্রাইভেট গাড়ি যেন একটু ঠাঁই পাওয়ার জন্য গুঁতোগুঁতি করছে আদ্যিকালের রাস্তাটায়।
পার্থ ঈষৎ উদ্বিগ্ন মুখে বলল, আমাদের বাহনটি যে কোথায় পার্ক করি?
মিতিন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, এখানেই থাক।
রাস্তাটা তো চওড়া নয়। পুলিশ যদি ঝামেলা করে?
কেউ কিচ্ছুটি বলবে না মশাই। বড়বাজার থানাকে খবর দেওয়া আছে। সো, এটাও আজ পুলিশের গাড়ি। আর সময় নষ্ট কোরো না, লক করে নিশ্চিন্তে চলে এসো।
এই না হলে মিতিনমাসি। পাছে উটকো অশান্তিতে পড়তে হয়, আগেভাগেই মাসি আটঘাট বেঁধে নেয়।
পাশেই জৈন ধর্মশালা। গাড়িবারান্দাওয়ালা বেশ বড়সড় পুরনো ধাঁচের বাড়ি। তিনধাপ সিঁড়ি উঠে পিতলবসানো প্রকাণ্ড কাঠের দরজা। খোলা দরজার ওপারে ডাইনে এক কাচঘেরা ঘর, সেখানে বসে হিন্দি খবরের কাগজ পড়ছেন এক ফরসা প্রৌঢ়। গলা বাড়িয়ে নিচুস্বরে তাকে কী যেন বলল মাসি, অমনি প্রৌঢ় তটস্থ। কাগজ মুড়ে রেখে হন্তদন্ত পায়ে হাঁটা দিলেন সিঁড়ির পানে। সামান্য দুলে চলেছেন উপরতলায়।
টুপুর সামনের খোলামতো জায়গাটা দেখছিল। প্রাচীন হলেও জীর্ণ অপরিচ্ছন্ন নয় বাড়িটা, বরং একটা হালকা সুগন্ধ ভাসছে বাতাসে। দেওয়ালে একটা পিতলের বোর্ডে হিন্দিতে সার সার নাম, পাশে টাকার অঙ্ক। এঁদের অর্থেই গড়ে উঠেছে ধর্মশালাটি, সম্ভবত দেখভালও হয় এঁদের পয়সায়।
নামগুলো পড়তে পড়তে টুপুর বলল, একজনও তো বাঙালি নেই!
থাকবে কোত্থেকে? পার্থর টুকুস মন্তব্য, জৈনধর্মটাই তো রাজস্থানিদের। আরও সঠিকভাবে বলা যায়, মারোয়াড়িদের।
একদম ভুল ধারণা, মিতিন ঝটিতি প্রতিবাদ জুড়ল, ভারতের প্রায় সব প্রদেশেই অল্পবিস্তর জৈন আছেন। তাঁরা সকলে মোটেই রাজস্থানের লোক নন। তামিল, কর্ণাটকিদের মধ্যে একসময় ভাল প্রচার হয়েছিল ধর্মটা। ওঁদের অনেক রাজামহারাজাও তখন জৈন ছিলেন যে। এমনকী, আমাদের এই বাংলাতেও হাজার দুই বছর আগে বেশ রমরমা হয়েছিল জৈনধর্মের। বিশেষত, পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-বীরভূম অঞ্চলে।
এখন তো চিহ্নই নেই, পার্থর স্বরে অবিশ্বাস প্রকট, সেই জৈনরা সব উবে গেল নাকি?
প্ৰায় তাই, মিতিন সায় দিল, বৌদ্ধ আর হিন্দু রাজাদের চাপে পড়ে জৈন ধর্ম এ রাজ্য থেকে পিঠটান দিয়েছিল। আবার ফিরল মাত্র তিনশো বছর আগে। রাজস্থানি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। আমরাও অমনি ধরে নিলাম, ধর্মটা শুধু ওদেরই।
মিতিন সিঁড়ির দিকে তাকাল। আপনমনেই বলল, মহাবীর জৈনদের একজন প্রধান ধর্মগুরু। তিনি জন্মেছিলেন বিহারে, রাজস্থানে নয়। সুতরাং…
আর এগোতে পারল না মিতিন, ভদ্রলোক ডাকছেন ইশারায়। কাছে যেতেই মিতিনকে বললেন, বেশিক্ষণ টাইম লিবেন না প্লিজ।
মিতিন কপাল কুঁচকাল, আহিরচাঁদজি কোথাও বেরোবেন নাকি?
ও বাত জানি না। আমি শুধু ওঁর ইচ্ছেটা জানালাম। ভদ্রলোক মিতিনদের আর-একবার জরিপ করলেন। মৃদু আপত্তির সুরে বললেন, আপনারা সবাই ওঁর ঘরে যাবেন?
না। ওরা দু’জন যাক, আগ বাড়িয়ে বলল পার্থ, আপনাতে-আমাতে ততক্ষণ না হয় গল্প করি। ভদ্রলোকের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য তিলমাত্র বিলম্ব করল না মিতিন, ঘরের নম্বর জেনে নিয়েই হরিণপায়ে উঠে গিয়েছে দোতলায়। লম্বা করিডরের দু’পাশে সার সার ঘর, বাঁদিকের শেষ দরজার সামনে গিয়ে থামল। সামান্য গলা উঠিয়ে বলল, ভিতরে আসতে পারি?
একটা জলদগম্ভীর স্বর ভেসে এল, আসুন।
টুপুর অবাক। কাল টিভিতে মোটেই গলাটা এমন ভারী শোনাচ্ছিল না তো? জৈন সাধুটি কি নিজেকে ওজনদার করতে চাইছেন? কণ্ঠের ভারে?
দরজা ঠেলে ঢুকল মিতিন। টুপুরও। একেবারেই বাহুল্যবর্জিত রুম। খাট, ছোট একখানা কাঠের আলমারি আর একসেট চেয়ার-টেবিল। মেঝেয় একফালি সাদা কার্পেট, ওটুকুই যা বিলাসিতার উপস্থিতি।
আহিরচাঁদ বসে আছেন শুভ্র বিছানায়, পদ্মাসনে। পরনে সাদা ধুতি, খালি গা। তাঁর চোখজোড়া তিলেক মিতিনকে দেখল, ঝলক টুপুরকে। বিশুদ্ধ বাংলায় বললেন, কলকাতা পুলিশের অনেক উন্নতি হয়েছে তো? বারো তেরো বছরের মেয়েদেরও তদন্তে পাঠায়।
মিতিন নম্রভাবে বলল, আমি পুলিশ নই। আমি পেশাদার গোয়েন্দা, এ আমার সহকারী। আমরা পুলিশকে সাহায্য করছি মাত্র।
অ। তা পুলিশকে তো আমার স্টেটমেন্ট দেওয়া আছে। নতুন আর কী বলব?
যেমন ধরুন, অত দামি একটা মূর্তি আপনি কেন সঙ্গে নিয়ে ঘুরছিলেন?
আইনগত কোনও বাধা আছে কি? আমি তো যদ্দুর জানি, নেই।
ততক্ষণই নেই যতক্ষণ না কোনও অপরাধ ঘটছে। আই মিন, যদি মনে হয় যিনি মূর্তি নিয়ে ঘুরছেন, তাঁর কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আছে। যেমন ধরুন চোরাচালান, বা বিদেশে পাচার…
আপনার স্পর্ধা তো কম নয়, স্থৈর্য ভেঙে স্বর চড়ে গেল আহিরচাঁদের, জানেন আমি কে? জৈন সমাজে আমার কোথায় স্থান? আমাকে আপনি চোর বাটপাড়দের সঙ্গে এক আসনে বসাচ্ছেন?
ছি ছি তা কেন? আমি শুধু একটা সম্ভাবনার কথা বলছিলাম, মিতিনের কণামাত্র উত্তেজনা নেই। ঠান্ডা স্বরে বলল, আপনার তা হলে বদ মতলব কিছু ছিল না? এমনি এমনিই মূর্তিটা নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন? যেমন তেমন বেড়ানো নয়, দীর্ঘ কুড়ি বছর পর কলকাতায় আসা। খুবই মামুলি ঘটনা, নয় কি?
কটমট চোখে মিতিনকে দেখলেন আহিরচাঁদ। সামান্য গলা নামিয়ে বললেন, আমি মূর্তিটা একটা বিশেষ কাজে এনেছিলাম।
একটা মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন, সেখানে পার্শ্বনাথের মূর্তিটা বিরাজ করবে। তাই তো?
আপনি জানলেন কী করে? আহিরচাঁদের গলা দিয়ে বিস্ময় ঠিকরে এল, আমি তো পুলিশকে একথা বলিনি।
আমি এও জানি, আপনি বলবেন, পার্শ্বনাথের মূর্তিটি ছিল আপনার রনকপুরে। মানে, অম্বামাতার মন্দিরের পাশে যে জৈন আশ্রমটিতে আপনি এখন অবস্থান করেন, সেখানে। কিন্তু মূর্তিটি ওই মনোরম পরিবেশ থেকে এনে হঠাৎ কলকাতায় বসানোর জন্য কেন ব্যগ্র হয়ে পড়লেন, সেটা কিন্তু ধাঁধা রয়ে যাবে। মিতিনও স্বর নামাল, আপনি কি সমাধানটা বলবেন?
না, মানে…আমাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল…
কে আপনাকে কথা দিয়েছিলেন? আপনার কোনও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়?
চমকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন আহিরচাঁদ। জবাব নেই।
আমি কি একটু ধরিয়ে দেব? মিতিনের স্বর মিহি, আকাশচাঁদ, না আলোকচাঁদ?
আহিরচাঁদ ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন, আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই৷
এতে কিন্তু আপনার সুবিধেই হত। হয়তো মিলে যেত আপনার পার্শ্বনাথ।
আমার চাই না ফেরত, আহিরচাঁদ প্রায় ফেটে পড়লেন, আমার ওই মূর্তিতে আর কোনও আগ্রহ নেই। যেখানকার জিনিস, সেখানেই ফেরাতে চেয়েছিলাম। পার্শ্বনাথজি বোধহয় তা চান না।
নাকি আরও বড় কিছু চাইছেন পার্শ্বনাথ? মিতিনের ঠোঁটে বাঁকা হাসি, এবং তার সন্ধান মিলতে চলেছে?
আপনি বড্ড বাজে বকছেন। আচমকা পদ্মাসন ছেড়ে খাট থেকে নেমে এলেন আহিরচাঁদ। সৌম্য মুখখানিও সহসা রুক্ষ, আপনি এবার আসুন। বললাম তো, ওই মূর্তি আমি আর চাই না।
সে বললে হয়? আহিরচাঁদজির রাগকে গ্রাহ্য করল না মিতিন। অচঞ্চল ভঙ্গিতে বলল, জানেনই তো, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ। সেই পুলিশ কেস যখন হয়েছে, তার শেষ তো আপনাকে দেখতেই হবে গুরুজি।
আহিরচাঁদের মুখমণ্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘাম। টকটকে গৌরবর্ণ কপালে চিন্তার ভাঁজ।
হঠাৎ মিতিনের স্বর অস্বাভাবিক নরম, আমি কি আপনাকে অন্য বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারি?
কীরকম?
যেমন ধরুন, লেখাপড়ায় তো আপনি দারুণ চৌকস ছিলেন। সব ছেড়েছুঁড়ে হঠাৎ সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন কেন?
প্রশান্তি ফিরেছে আহিরচাঁদের। স্মিতমুখে বললেন, ধর্ম আমাকে টানল যে।
কীভাবে?
আমাদের পুরনো পুঁথি পড়ে। সেখানে স্পষ্ট ভাবে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা আছে, আমাদের জ্ঞান কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে না। যতই চেষ্টা করি না কেন, জ্ঞান হবে অন্ধের হাতি দেখার মতো। আংশিক। তাই ওই পথ পরিত্যাগ করে নিজেকে ভগবান পার্শ্বনাথের চরণে নিবেদন করে দিলাম। আমার জ্ঞানচর্চা অসমাপ্ত রইল বটে, কিন্তু মনের শান্তি তো মিলল।
হুম। আপনার বাংলাটি কিন্তু চমৎকার। এত বছর দেশের বাইরে, তবু কী নিখুঁত!
ভাষাজ্ঞান আমার বরাবরই উচ্চমানের। গর্ব করছি না, আমি যে ভাষা একবার শিখেছি, আমার মধ্যে সেটি গেঁথে গিয়েছে।
আপনি তো ভাল ফারসিও জানেন, তাই না?
অবশ্যই, বলেই যেন জোর হোঁচট খেলেন আহিরচাঁদ, আমতা আমতা করছেন হঠাৎই, না, মানে এখন আর তেমন চর্চা নেই…
তা বটে। আবার মূল কথায় আসি, মিতিনের গলায় ফের কেজো সুর, কাল বিকেলে আপনি ঠিক চারটেয় বেরিয়েছিলেন, তাই তো? আর ফিরেছিলেন সাতটার পরে?
হ্যাঁ। প্রায় সাড়ে সাতটায়।
এই সাড়ে তিন ঘণ্টা আপনার রুম অরক্ষিত ছিল?
তা কেন? আমি তো চাবি দিয়েই…
সত্যি বলছেন তো? জৈনধর্মে সত্য বলাকেই কিন্তু শ্রেষ্ঠ গুণ বলা। হয়।
পলকে আহিরচাঁদের মুখ বিবর্ণ। মাথা নামিয়ে নাড়ছেন দু’দিকে।
টুপুর থ। মাসি টের পেল কী করে? আন্দাজে ঢিল? নাকি অন্তর্যামী!
শুনলাম, চুরির অপরাধে এই ধর্মশালার এক কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন, অল্প চড়ল মিতিনের স্বর, কাজটা কি ন্যায্য হয়েছে? আপনার ধর্মজ্ঞান কী বলে?
আমি এমনটা চাইনি, আহিরচাঁদ বিড়বিড় করছেন, কিন্তু কী যে হচ্ছে!
মিতিন মৃদুগলায় বলল, আমরা কি আর একটু খোলামেলা কথা বলতে পারি আহিরচাঁদজি?
আহিরচাঁদ নীরব। মিতিন দেখছে আহিরচাঁদকে। মিতিনকে দেখছে টুপুর।
.
০৮.
নতুন করে শুরু হয়েছে প্রশ্নোত্তর পর্ব, ঠিক জেরা নয়, নরম করেই জিজ্ঞেস করছে মিতিন, থেমে থেমে জবাব দিচ্ছেন আহিরচাঁদ।
মন্দির প্রতিষ্ঠাই তা হলে আপনার এত বছর পর কলকাতায় আসার একমাত্র কারণ?
বলতে পারেন। তবে আর-একটা উদ্দেশ্যও ছিল। আমাদের বংশের একটা পুরনো নথি অনেককাল ধরেই আমার কাছে পড়ে ছিল, ভেবেছিলাম সেটাও এই উপলক্ষে আমার ভাইপোদের দিয়ে যাব।
কী নথি? গোপন কিছু?
ঠিক তা নয়, একটু সময় নিয়ে আহিরচাঁদ বললেন, আসলে একটা বিক্রিবাটার কাগজ। এক আর্মানি বণিক আমার এক পূর্বপুরুষকে কিছু মূল্যবান জিনিস বেচেছিলেন। সেই পূর্বপুরুষটির হাতে তখন নগদ অর্থ ছিল না, টাকাটা তিনি পরে মেটাবেন এইসব লেখা ছিল আর কী।
লেখাটা কি ফারসি ভাষায়? সেই আর্মানি বণিকটির নাম খাজা ওয়াজেদ? আর আপনার পূর্বপুরুষটি সম্ভবত ফতেচাঁদ, অর্থাৎ প্রথম জগৎ শেঠ।
আ-আ-আপনি কী করে জানলেন? আহিরচাঁদের দৃষ্টি বিস্ফারিত৷
আমি তা হলে ভুল বলিনি, মিতিন কায়দা করে জবাবটা এড়িয়ে গেল। পালটা প্রশ্ন জুড়ল, তা সেই নথি আপনার কাছে গেল কী করে?
আমি গৃহত্যাগের সময় ওটি নিয়ে গিয়েছিলাম।
কেন?
আমার বড় ভাইসাব, মানে দাদাকে, লোভের হাত থেকে মুক্ত করতে।
কীভাবে?
আমার বড় ভাইজির ধারণা ছিল, ওই কাগজে যে জিনিসগুলোর কথা লেখা আছে, সেইসব হিরে, জহরত, বাড়িতেই কোথাও আছে। তাই ওই নথি উনি সারাক্ষণ বুকে আঁকড়ে থাকতেন। মায়ার বাঁধন কাটাতে ওই নথি সরিয়ে ফেলা আবশ্যক ছিল। শুধু তাই নয়, আমার তখন মনে হয়েছিল, ভগবান পাশ্বর্নাথজির মূর্তিও আমাদের ঘরে বেমানান। সেইজন্য পাশ্বর্নাথজির মূর্তিটিও আমি সঙ্গে নিয়েছিলাম, আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে গেল আহিরচাঁদের মুখমণ্ডল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, লাভ হল না কিছুই, শুধুই লোকসান।
টুপুর চোখ সরু করে সওয়াল-জবাব গিলছিল। ফস করে বলে উঠল, ওই মূর্তিই কাল চুরি গেল বুঝি?
হাঁ বেটি, আহিরচাঁদ ম্রিয়মান, আমাদের বংশে আর ভাল কিছু হবে না। যে দাদার লোভের মায়া কাটাতে সোনাদানার কাগজ নিয়ে গেলাম, সেও তো শেষ জীবনে পাগল হয়ে গেল। ওই গুপ্তধন খুঁজে না পেয়েই নাকি তাঁর মাথা বিগড়েছিল।
তা সেই কাগজ ভাইপোদের দেওয়ার কথা ভাবলেন কেন?
ওরা চেয়েছিল।
জানত বুঝি কাগজ আপনার কাছে আছে?
না। ওরা জানত কাগজ বহুকাল আগেই হারিয়ে গিয়েছে। আলোক, আকাশ দুই ভাইই আমার আশ্রমে যায়। আকাশ তো বছরে বছরে, আলোকও মাঝে মাঝে। কথাচ্ছলে বলেছিলাম ওদের, তখন ওরাই বলল কাগজটা বাড়ির সম্পদ, সুতরাং ওটি কলকাতাতেই থাকা উচিত। আমিও ভেবে দেখলাম, একটা তুচ্ছ কাগজের মায়ায় কেন আটকে থাকি? ভগবান পার্শ্বনাথ দ্রব্যের আসক্তি থেকে মুক্ত হতেই তো উপদেশ দিয়েছেন। ওরা প্লেনের টিকিট পাঠাল, আমিও চলে এলাম।
তা কাগজটি এখন কোথায়?
আমার কাছেই আছে।
একটু দেখতে পারি?
সামান্য ভেবে বিছানা ছেড়ে নামলেন আহিরচাঁদ। আলমারি থেকে একটা কাপড়ের পুঁটলি বার করলেন। গিট খুলে একটা জীর্ণ চামড়ার পুঁথি বাড়িয়ে দিলেন মিতিনকে। সন্তর্পণে পাতা ওলটাচ্ছে মিতিন। শেষ পৃষ্ঠায় এসে থামল। ঝুঁকে কী যেন দেখল চোখ কুঁচকে। ঝোলাব্যাগ থেকে আতসকাচটা বের করে আরও গভীর ভাবে নিরীক্ষণ করতে করতে বলল, একটা নবাবি পাঞ্জা রয়েছে মনে হচ্ছে?
উঁহু ওটা শাহি পাঞ্জা। খোদ মুঘল সম্রাটের। ওই পাঞ্জার বলেই জগৎশেঠদের যে কোনও চুক্তি তখন তামাম ভারতবর্ষে মান্যতা পেত।
আমি কি পাতাগুলোর ফোটো নিতে পারি?
অল্প ইতস্তত করে আহিরচাঁদ সায় দেওয়ামাত্র স্ন্যাপ উঠে গেল মিতিনের স্মার্টফোনে। পুঁথিটা ফেরত দিয়ে মিতিন বলল, ফারসি লিপি কিন্তু আড়াইশো বছর পরেও খুব স্পষ্ট আছে এখনও। বেশ আশ্চর্যজনক,তাই না?
জবাব ছাড়াই কাপড়ের পুঁটলি ফের চালান হয়ে গেল আলমারির অন্দরে।
মিতিনও খোঁচাল না। আবার ফিরে গিয়েছে পুরনো প্রসঙ্গে।
আপনার মন্দিরটি তো পৈতৃক বাড়িতেই করবেন?
আর হবে কী করে? স্বয়ং পার্শ্বনাথজিই উধাও হয়ে গেলেন।
ভাইপোদের বলুন। তারা নতুন মূর্তি গড়িয়ে দেবেন।
তা হয় না ম্যাডাম। মন্দির প্রতিষ্ঠা একজন জৈনসন্ন্যাসীর জীবনে সবচেয়ে মহৎ কাজ। এ কাজ জোড়াতালি দিয়ে যেমন তেমন করে হয় না। ওই মূর্তিটি আমার মন্দিরের জন্য চিহ্নিত করা ছিল, অন্য মূর্তি আমি বসাব কী করে?
যদি মূর্তিটা ফেরত পাওয়া যায়?
পার্শ্বনাথজি আর ফিরবেন না।
তবু যদি মিলে যায়?
সে তখন ভাবা যাবে। প্রকৃত জৈন আকাশকুসুম কল্পনায় বিশ্বাস করে না।
কিছু মনে করবেন না, আহিরচাঁদজি, একটা কথা বলব?
বলুন।
মূর্তিটি যখন এতই মূল্যবান, আপনার কি আর-একটু সতর্ক থাকা উচিত ছিল না? মিতিনের স্বরে অনুযোগ, দরজা ঠিকমতো বন্ধ না করে আপনি বেরোলেন কী করে?
জৈন ধর্মশালা থেকে ভগবান পার্শ্বনাথের বিগ্রহ চুরি হতে পারে, এ যে আমার কল্পনাতেও ছিল না ম্যাডাম, আহিরচাঁদের ঠোঁটে করুণ হাসি। মলিন গলায় বললেন, আমার তো ঘরে তালা লাগানোর অভ্যেসই নেই। আমাদের রনকপুরের আশ্রমেও তালা চাবি লাগানোর প্রথা নেই কিনা।
ও, মিতিন বুঝদারের মতো ঘাড় দোলাল। দুঃখী দুঃখী গলায় বলল, আপনার এতদিন পর কলকাতায় ফেরাটা সুখের হল না।
তা বটে। ভগবান পার্শ্বনাথের হয়তো ইচ্ছে নয় আমি আবার পুরনো শহরে ফিরে আসি, ছোট্ট শ্বাস পড়ল আহিরচাঁদের। পরক্ষণেই প্রায় স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, একটাই লাভ, ঘটনাচক্রে আকাশের স্ত্রী কন্যার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
কেমন লাগল তাদের?
ভাল। ভালই তো, আহিরচাঁদের মুখমণ্ডলে হালকা প্রসন্নতার আভা, আকাশের মেয়েটি তো অতি চমৎকার। এমন সরল বিস্ময় নিয়ে প্রথমদিন আমাকে দেখছিল! আমাদের বদ্রিদাস টেম্পল স্ট্রিটের বাড়িটার নানান গল্প শোনালাম, ও তো আবিষ্ট হয়ে ঘুমিয়েই পড়ল!
টুপুর টানটান। আহিরচাঁদজিকে শালিনীর স্বপ্নের কথাটা জিজ্ঞেস করে ফেলবে কিনা ভাবছে, আচমকা মিতিন বলে উঠল, এবার তা হলে চলি আহিরচাঁদজি?
কেন? আহিরচাঁদের স্বরে আলগা ঠাট্টা, প্রশ্নের ভাঁড়ার কি ফুরিয়ে গেল?
মিতিন ব্যঙ্গটা গায়েই মাখল না। চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল, এখনকার মতো এইটুকুই যথেষ্ট।
আমার ভগবানজির মূর্তি কি মিলবে? চান্স আছে কোনও?
দেখা যাক।
উঠে দরজা পর্যন্ত গিয়েও আচমকা দাঁড়িয়ে পড়েছে মিতিন। ঘুরে এসে ভারী নরম গলায় বলল, আপনার কাছে আরও একটা বিষয় জানার ছিল। তদন্তের ব্যাপার নয়… আপনি একজন জ্ঞানী মানুষ বলেই…
টুপুর তাজ্জব। কী কথা রে বাবা! মিতিনমাসি আমতা আমতা করছে যে বড়!
আহিরচাঁদ কিন্তু বেশ বিগলিত। ভারিক্কি ভঙ্গিতে বললেন, আমি মোটেই জ্ঞানী নই। সত্যের সন্ধানে হাঁটছি মাত্র। তবু শোনা যাক, কী জানতে চান?
মানুষ তো নানান রকম স্বপ্ন দেখে। সব স্বপ্নের কি অর্থ হয়?
অবশ্যই। মানুষ তো এমনি এমনি স্বপ্ন দেখে না, তাদের স্বপ্ন দেখান জিনেরা। মানে আমাদের ধর্মীয় অবতাররা। যাদের আমরা বলি তীর্থঙ্কর। ওঁরা স্বপ্নের মধ্যে দিয়েই তো আমাদের সুপথে চলার রাস্তা চেনান।
ভাল-খারাপ সব ধরনের স্বপ্নই তা হলে জিনদের অবদান?
না, না তা কেন? খারাপ খারাপ স্বপ্ন তো আসে মার, মানে অশুভ শক্তি থেকে।
বুঝেছি। আমার স্বপ্নটা তা হলে মারই দেখাচ্ছেন। প্রায় রোজ রাতেই।
কী স্বপ্ন?
বলব? আপনি হয়তো হাসবেন।
কখনও না। আপনি নিঃসংকোচে বলুন।
দেখছি কী, আমি হঠাৎ ছোট্ট এইটুকুন হয়ে গিয়েছি। ঢুকেছি একটা প্রকাণ্ড ঘরে, একটা দশাসই চেহারার লোকের হাতে…
দিব্যি গড়গড়িয়ে শালিনীর স্বপ্নটাই হুবহু আওড়ে দিল মিতিন। শুনতে শুনতে আহিরচাঁদের মুখখানাই বদলে গেল। টকটকে ফরসা গালে সহসা কালচে ছায়া। দু’চোখে ঘোর অবিশ্বাস। ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনি এই স্বপ্ন দেখেছেন?
হ্যাঁ, পর-পর পাঁচ রাত। সেই কাল রোববারের আগের রোববার থেকে।
অসম্ভব। হতেই পারে না, স্থানকালপাত্র ভুলে চেঁচিয়ে উঠলেন আহিরচাঁদ।
কেন হতে পারে না আহিরচাঁদজি? এমন স্বপ্ন কি কেউ দেখে না? আপনি এত উত্তেজিতই বা হচ্ছেন কেন?
মিতিনের নিরীহ জিজ্ঞাসায় আহিরচাঁদ যেন গুটিয়ে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে বললেন, আপনার অনুমান সঠিক। স্বপ্নটি মারের। অর্থাৎ অশুভ।
কোনও বিপদের সংকেত?
হওয়া অসম্ভব নয়।
তা হলে পাঁচজনকে বলে না বেড়ানোই ভাল, কী বলেন?
তীব্র চোখে মিতিনকে দেখলেন আহিরচাঁদ। তারপর গুমগুমে গলায় বললেন, আমি কি এবার ধ্যানে বসতে পারি?
মিতিন আর কথা বাড়াল না। ছোট্ট করে ঘাড়টি নেড়ে টুপুরকে নিয়ে ঘর ছেড়েছে। একতলায় নেমে টুপুর দেখল ধর্মশালার সামনের ফুটপাথে পায়চারি করছে পার্থমেসো। ওখান থেকেই অধৈর্য স্বরে চেঁচাচ্ছে, কী এতক্ষণ ভ্যাজরং ভ্যাজরং করছিলি? কেস তো আমি সলভ করেই ফেলেছি।
মিতিন ঠোঁটে তর্জনী ছুঁইয়ে চুপচাপ গাড়িতে ওঠার ইঙ্গিত করল পার্থকে। স্টার্ট দেওয়ার পর বলল, কাকে কাকে জেরা করলে?
পর পর পাঁচজনকে। ওই কেয়ারটেকার মনোহর সোলাঙ্কি, কুক কাম ভাঁড়াররক্ষক হরদেও প্রসাদ, রুম সার্ভিসের তিন ওস্তাদ, বালুরাম, গঙ্গাধর, মুরলী। প্রত্যেককে অ্যাভারেজ চার মিনিট। ব্যস, এতেই সমাধান হাতের মুঠোয়।
বটে? তা কীরকম উত্তর বেরোল শুনি?
তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না কে এই দুষ্কর্মটি করেছে? নাটুকে ভঙ্গিতে কাঁধ বেঁকিয়ে টুপুরের দিকে তাকাল পার্থ, বল তো কে সেই পামর?
টুপুরের চোখ পিটপিট, ওই ভালমানুষ চেহারার কেয়ারটেকার?
আজ্ঞে না। উফফ, কত কী যে জানলাম! ভাবতে পারিস, বিকেল চারটে থেকে সাতটা পর্যন্ত ধর্মশালায় একজন কর্মচারীও প্রেজেন্ট থাকে না। চোর তাই ওই সময়েই মূর্তিটা হাপিস করেছে।
কে সে?
এমন কেউ, যে ধর্মশালার এই লুপহোলটা জানে!
আরে বাবা সেটা কে বলবে তো? টুপুর ছটফট করে উঠল, ধর্মশালার বাইরের কেউ?
ধীরে বালিকা, ধীরে, চৌরঙ্গির মোড় টপকে গাড়ির গতি সামান্য বাড়াল পার্থ, ওই ধর্মশালায় দু’জন অতিথি বিকেলের ওই সময়টাতেই আসত রোজ। আহিরচাঁদের সঙ্গে মোলাকাত করতে। কোনওদিন এ, তো কোনওদিন ও। আবার কোনওদিন দু’জন হাত ধরাধরি করে।
তারা কারা? বলেই টুপুরের মগজ ঝিলিক, আহিরচাঁদজির দুই ভাইপো?
যাক মাসির চামচাগিরি করে একটু উন্নতি হয়েছে। গোবরের জায়গায় ঘিলুর পরিমাণ বাড়ছে।
মেসোর ব্যঙ্গটা প্রশস্তি হিসেবে গায়ে মেখে নিল টুপুর। কিন্তু মনে সন্দেহের খচখচ। জিজ্ঞেস করেই ফেলল, কিন্তু ওঁরা নেবেন কেন? কাকা অতদূর থেকে মূর্তিটা এনেছেন মন্দির গড়ে সেখানে পার্শ্বনাথজিকে স্থাপন করবেন বলে।
অ। এইসব ব্যাপার আছে নাকি? পার্থ ঈষৎ থমকাল। পরক্ষণেই বলল, মন্দির মানেই তো পাবলিক প্রপার্টি। ভাইপোরা হয়তো মূর্তিখানা নিজেদের দখলে রাখতে বেশি আগ্রহী ছিল। তাই বিকেলের অরক্ষিত সময়ে এসে মাল ঝাপ্পুস করে নিতেই পারে।
দু’জনে মিলে? একজোট হয়ে?
সেটা বলা শক্ত। ওদের যে-কোনও একজন হয়তো…
এক সেকেন্ড, বহুক্ষণ পর মিতিন সরব, মূর্তিটা দেখতে কেমন, সাইজে কত বড়, সে বিষয়ে কে কী বলল?
ওরা কেউ দেখেছে নাকি? ওদের কথা শুনে তো তেমনটা মনে হল না।
তুমি জিজ্ঞেসও করোনি?
ধুস! ওটা কোনও প্রশ্ন নাকি? জেনে লাভ কী হত?
মূর্তিটা উনি রেখেছিলেন কোথায়?
নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারল না। কেউ বলে আহিরচাঁদজির ঝোলায়, কেউ বলে রুমে একটা নাকি কাঠের আলমারি আছে, হয়তো তার মধ্যেই রাখা ছিল।
গাড়ি ভবানীপুর ঢুকেছে, ভিড় থিকথিক পথ দেখতে দেখতে পার্থ আপন মনেই বলল, যেখানেই থাকুক, আলোক, আকাশের তো অজানা নয়। সুতরাং সন্দেহের তিরটা ওদের দিকেই যায়। তা ছাড়া ভেবে দেখো, এত ভ্যালুয়েবল একটা জিনিস গায়েব হয়েছে, টিভি খবরের কাগজ সর্বত্র বেরিয়েছে খবরটা, অথচ দুই মূর্তিমানের টিকি নেই। এটাও নিশ্চয়ই একেবারে নিরামিষ ঘটনা নয়।
হুম। তা দুই ভাইয়ের কোনও একজনও যে কাল বিকেলে ধর্মশালায় এসেছিল, এমন কোনও তথ্য প্রমাণ মিলেছে কি?
আরে, ওইটুকুর জন্যেই তো আটকে আছে। নয়তো আমিই অনিশ্চয়বাবুকে জানিয়ে দিতাম। কেস ক্লোজড, আসামিকে গারদে পুরে দিন। বাই দা বাই, অনিশ্চয়বাবুর পুলিশ তাড়াহুড়ো করে মিছিমিছি যে লোকটাকে ফাটকে ঢোকাল, আশা করি তাকে অন্তত…
ওটা একটা গল্প, মিতিন মিচকে হাসল, আমিই ডি সি ডি ডি সাহেবকে ছড়াতে বলেছি গল্পটা, যাতে সাংবাদিকরা না জ্বালাতে পারে।
কী ডেঞ্জারাস গেম। জানতে পারলে তো মিডিয়া পুলিশকে তুলোধোনা করবে।
প্রথমত, জানতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, জানতে পারলে পুলিশ বলবে আসল চোরকে ধরার জন্য ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছে।
এরকম কৌশল মাসি হরবখত করে, মাসির মগজের উপর অগাধ আস্থার দরুন অনিশ্চয় আঙ্কলও নিশ্চিন্তে অংশ নেয় খেলাটায়, জানে টুপুর। তবু আজ একটু অবাকই হল। মাসিও কি তবে নিশ্চিত, মূর্তিটা শালিনীর বাবা জ্যাঠারাই নিয়েছেন? কিন্তু মাসি একবারও আহিরচাঁদজিকে ওই লাইনে প্রশ্ন করল না। হঠাৎ নিজের নাম করে শালিনীর স্বপ্নটা শোনানোর বা কী অর্থ? শুধুই সন্ন্যাসীটিকে চমকে দেওয়া? নাকি অন্য কোনও গুঢ় উদ্দেশ্য আছে মাসির? বিদঘুটে স্বপ্নটার কোনও মানে খুঁজে পেল কি? আহিরচাঁদজির ঘরে অতটা সময় কাটানো কি শেষপর্যন্ত মাসির কোনও কাজে লাগবে? ভদ্রলোক থুড়ি, সন্ন্যাসীটিকে যেন বড্ড বেশি পরখ করছিল মাসি৷ কেন?
অ্যাই টুপুর, ঢুলছিস নাকি?
মাসির ডাকে টুপুরের ভাবনাটা ছিঁড়ে গেল। তাড়াতাড়ি টুপুর বলল, কই না তো? আমি ভাবা প্র্যাকটিস করছি।
গুড… তা কাল থেকে তো তোর স্কুল?
বেজার গলায় টুপুর বলল, হু।
ওবেলা তো তা হলে তোকে হাতিবাগানে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে।
আরে আমি তো আছিই, পার্থ তুরন্ত সবাক, অ্যালেক্স কিচেনের কাটলেট অনেকদিন চাখা হয়নি, আজ নয় সেটাও…
সুখাদ্যের চিন্তায় গাড়ি চালাতে চালাতেও পার্থর চোখ জ্বলজ্বল। পিছন থেকে আচমকা মিতিনের ঘোষণা, উঁহু, আজ আমি যাব। শুধু আমি আর টুপুর।
মাসির বলার ভঙ্গিটা যেন অচেনা অচেনা। স্বরে যেন আমিষ আমিষ গন্ধ।