সকালে একটা ভারী প্রাতরাশ, নটার মধ্যে স্নান, সাড়ে নটা বাজতে না বাজতে টুপুর পুরোপুরি তৈরি। ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে মিতিনও প্রস্তুত। আরতি রান্না করছিল, বেরোনোর আগে তাকে কয়েকটা টুকিটাকি নির্দেশ দিল মিতিন। বুমবুম স্কুল থেকে এলে তাকে কী খেতে দেবে, ম্যাগির বায়না জুড়লেও আরতি যেন কানে না তোলে, খেলতে যাওয়ার আগে বুমবুম যেন অবশ্যই পোশাক বদলায়, এই সব। রাতে টুপুরের প্রিয় কষকষে আলুর দমও বানিয়ে রাখতে বলল আরতিকে। তারপর ক্যাবিনেটের দেরাজ থেকে বের করল গাড়ির চাবি। হ্যাঁ, আজ গাড়িটা লাগবে।
পার্থ দাড়ি কামাচ্ছিল। কাল রাতে ঘটনাটা শোনার পর থেকে সেও বেশ উদ্বিগ্ন। কোনওরকম মজা, রসিকতা করছেনা। বাথরুমের দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, বেরোচ্ছ?
হ্যাঁ। পারলে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরো।
আমিও কিন্তু তোমাদের সঙ্গে যেতে পারতাম।
দরকার কী ভিড় বাড়ানোর! অনর্থক তোমার প্রেসের কাজ ফেলে…!
সারাদিন খুব টেনশনে থাকব। কাজে মনই বসবে না।
চিন্তা কোরো না। প্রয়োজন বুঝলে তোমায় ডেকে নেব। টুপুরকে নিয়ে নীচে এল মিতিন। পার্কিং-স্পেস থেকে লাল মারুতিখানা বের করে চলল অভিযানে। আধঘণ্টাতেই পৌঁছে গেল সেন্ট পিটার্সে। চার্চের লাগোয়া পুরনো বনেদি স্কুল। ইমারতখানা প্রাচীন, তবে চেহারা এখনও বেশ শক্তপোক্ত। উঁচু পাঁচিলের মাঝখানে সবুজ রঙের প্রকাণ্ড লোহার ফটক বন্ধ। কোনও কলরব নেই, অন্দরে ক্লাস চলছে জোর কদমে।
বড় গেটের এক কোণে বেঁটে লোহার দরজা। সেখান দিয়েই ঢুকল মিতিন আর টুপর। অমনি কোত্থেকে এক খাকি উর্দিধারী বেরিয়ে এল। প্রায় পথ রোধ করে বলল, কোথায় যাবেন?
মিতিন ভারিক্কি স্বরে বলল, প্রিন্সিপাল-ম্যাডামের কাছে। প্রাইমারি সেকশনের।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?
রুস্তমজির চিঠিটা হাতে তুলে দেখাল মিতিন। দরোয়ান কী বুঝল কে জানে, বলল, চলে যান। অফিসের গায়েই ম্যাডামের ঘর।
ভ্রূ কুঁচকে দরোয়ানটিকে জরিপ করে নিল টুপুর। রোগা, লম্বা, বছর চল্লিশেক বয়স, ব্যাকব্রাশ করা চুল, মুখটা খানিক চোয়াড়ে চোয়াড়ে। এই লোকটাই কি রনিকে ছেড়েছিল কাল? আর-একজন দরোয়ানকেও অবশ্য দেখা যাচ্ছে। বিশাল ছাতিমগাছটার তলায় বসে আয়েশ করে খইনি ডলছে মোটাসোটা লোকটা। গাছের ওপাশে চার-চারটে ঢাউস স্কুলবাস দাঁড়িয়ে। না, রুস্তমজির ছেলের স্কুলটি যথেষ্ট ওজনদার।
প্রিন্সিপালের দরজায় পিতলের ফলকে নাম জ্বলজ্বল করছে অমিতা রায়। বাইরে এক বেয়ারা বসে ছিল, তার হাত দিয়ে চিঠিটা পাঠাতেই, কী কাণ্ড, মিসেস রায় স্বয়ং বেরিয়ে এলেন। ধবধবে সাদা বয়কাট চুল, ছোটখাটো চেহারার মহিলাটি মিতিনদের খাতির করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। আন্তরিক সুরে বললেন, আপনারা মিস্টার জরিওয়ালার কাছ থেকে আসছেন….,ইউ আর ভেরি মাচ ওয়েলকাম। চা খাবেন? না কফি? নাকি কোল্ড ড্রিঙ্কস?
থ্যাঙ্কস। কিচ্ছু না।
তা বললে চলে? আপনি জানেন না, মিস্টার জরিওয়ালাকে আমরা কতটা শ্রদ্ধা করি। প্রাক্তনী হিসেবে তিনি সেন্ট পিটার্সের গর্ব। শুধু তাই নয়, আমাদের স্কুলের যে-কোনও অনুষ্ঠানে উনি অকৃপণভাবে সাহায্য করেন।
দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, উনি কিন্তু স্কুল থেকে যথোচিত প্রতিদান পাননি।
মিতিনের কেটে-কেটে উচ্চারণ করা বাক্যটিতে জোর ধাক্কা খেলেন অমিতা। হতভম্ব মুখে বললেন, কেন, কী হয়েছে?
কাল ওঁর ড্রাইভার স্কুলে এসে রনি, আইমিন রৌণককে পায়নি এবং মিসেস জরিওয়ালা উৎকণ্ঠিত হয়ে আপনাকে ফোন করেছিলেন।
হ্যাঁ তো। আমি তো খবর নিয়ে ওঁকে জানিয়েও দিলাম মিস্টার জরিওয়ালার অন্য গাড়িটা এসে ওকে নিয়ে গিয়েছে!
আপনি শিয়োর, ওঁদের অন্য গাড়িটা এসেছিল?
আমাকে তো দরোয়ান সেরকমই বলল… অমিতা সহসা থমকালেন, এনিথিং রং?
ভীষণ-ভীষণ রং। রৌণক কাল কিডন্যাপড হয়েছে।
অ্যাঁ? ভদ্রমহিলা প্রায় চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন, পরক্ষণে ধপাস করে বসে পড়লেন। সপ্রতিভতা ঝরে গিয়ে রীতিমতো তোতলাচ্ছেন, ও মাই গড! পুলিশ জানে?
রুস্তমজি এখনও পুলিশকে কিছু জানাননি। উনি ঘটনাটা স্ট্রিক্টলি কনফিডেন্সিয়াল রাখতে চান। আশা করি, আপনিও আপাতত খবরটা পাঁচকান করবেন না।
নিশ্চয়ই। কিন্তু,.. আপনি…?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ। মিতিন নিজের একটা কার্ড বাড়িয়ে দিল, কিডন্যাপাররা মুক্তিপণ হিসেবে এক কোটি টাকা চেয়েছে। পরশু সন্ধের মধ্যে। আমি ক্রিমিনালদের ধরার চেষ্টা করছি।
ও। তা আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
ভুলে যাবেন না ম্যাডাম, ঘটনাটা আপনার স্কুলের সামনেই ঘটেছে। আপনাদেরই দরোয়ান রৌণককে কিডন্যাপারদের হাতে তুলে দিয়েছে।
দরোয়ান তো আই-ডি কার্ড দেখে তবে…!
বুঝলাম। কিন্তু স্কুলের আই-ডি কার্ড বা তার নকল ক্রিমিনালদের হাতে গেল কী করে?
সেটা আমি কী করে বলব? অমিতার গলায় এবার আত্মরক্ষার সুর। চোখ ঘুরিয়ে বললেন, বাচ্চা জানে কিংবা বাচ্চার গার্জেন।
স্কুলে আইডি কার্ডের কোনও কপি থাকে না? ক্লাসটিচারের জিম্মায়?
না। দুটো কার্ডের একটা বাচ্চার গলায় ঝোলে, অন্যটা থাকে বাড়ির লোকের কাছে।
বেশ। কিন্তু প্রতি বছরই নিশ্চয়ই নতুন কার্ড ইস্যু হয়?
হ্যাঁ। পুরনো কার্ডগুলোও গার্জেনদের জিম্মাতেই থাকে। তবে এ বছর…!
কী হয়েছে এ বছর?
এবার স্কুলের একটা ফাংশান ছিল। অ্যানুয়াল এঞ্জাম আর সেশনের মাঝে। বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুরনো কার্ডগুলো গার্জেনদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম। এ বছর নতুন কার্ড ইস্যু করার পরও ওগুলো আর ফেরত দেওয়া হয়নি।
অর্থাৎ আগের বছরের কার্ড আপনাদের হেপাজতে?
হ্যাঁ। ক্লাসটিচারদের। আমি অবশ্য ওঁদের বলেছি ডেসট্রয় করে দিতে।
কাজটা হয়েছে কি?
এতক্ষণে অমিতা যেন সামান্য গুটিয়ে গেলেন। দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন, নিশ্চয়ই হয়েছে…!
আপনি নিশ্চিত নন, তাই তো?
অমিতা চুপ। পিরিয়ড শেষের ঘণ্টা পড়ল, বাইরে মৃদু কোলাহল। দুজন শিক্ষিকা ঢুকছিলেন অমিতার ঘরে, হাতের ইশারায় তাঁদের আসতে মানা করলেন অমিতা। দুই শিক্ষিকাই কিঞ্চিৎ বিস্মিত, তবে চলেও গেলেন তৎক্ষণাৎ।
মিতিন ঘুরে তাঁদের দেখছিল। ফের সিধে হয়ে বলল, আপনার বক্তব্য তো মোটামুটি শুনলাম। এবার যে রৌণকের ক্লাসটিচারের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার।
ডেকে পাঠাব?
যদি না খুব অসুবিধে হয়। মিতিনের স্বর সামান্য নরম, তবে কাইন্ডলি তাঁর সামনে অপহরণের প্রসঙ্গটা তুলবেন না।
সে আমার মাথায় আছে। বলেই কলিংবেলে চাপ। পলকে বেয়ারা হাজির। অমিতা ভার-ভার গলায় বললেন, প্রিয়াঙ্কাম্যাডামকে এক্ষনি আসতে বলো তো। আর শোনো, এখন কাউকে ঘরে অ্যালাও করবে না।
ঘাড় নেড়ে চলে গেল বেয়ারা। হঠাৎই যেন টুপুরের দিকে নজর পড়ল অমিতার। মুখে আলগা হাসি ফুটিয়ে বললেন, এটি কে? মিস্টার জরিওয়ালার পরিবারের কেউ?
আমার বোনঝি। ঐন্দ্রিলা।
যাক, তাও ভাল। আমি ভাবলাম যদি…! অমিতাকে কেমন অসহায় দেখাল। প্রায় আপন মনে বললেন, পারসিরা অনেকেই এই স্কুলটা খুব পছন্দ করেন। তাঁরা খবরটা পেলে ছেলেদের হয়তো স্কুল থেকে সরিয়ে নেবেন। স্কুলের পক্ষে সেটা যে কী লজ্জার!
স্কুলের মানসম্মানটাই আপনার কাছে বড় হল ম্যাডাম? মিতিনের স্বর তীক্ষ্ণ, বাচ্চাটার বিপদ নিয়ে আপনি ভাবিত নন?
তা কেন, ছি ছি। রৌণককে আমরা সবাই খুব ভালবাসি। তার উপর সে মিস্টার জরিওয়ালার একমাত্র ছেলে…। এই স্কুল থেকে সে কিডন্যাপড হল, ভাবলেই বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে।
কথার মাঝেই দরজায় এক তরুণী। ছিপছিপে লম্বা, শ্যামলা রং, পরনে সালোয়ার-কামিজ। কাঁধে দোপাট্টা।
অমিতা গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, প্রিয়াঙ্কা, মিট দিস লেডি। ইনি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবেন। ভেবেচিন্তে ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিয়ো।
প্রিয়াঙ্কা অবাক মুখে বসলেন চেয়ারে। মিতিনকে দেখছেন। টুপুরকেও। সপ্রতিভ স্বরেই মিতিনকে বললেন, হ্যাঁ, বলুন?
মিতিন ঈষৎ ঘুরে বসল। প্রায় প্রিয়াঙ্কার মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি তো ক্লাস ফোরের এ সেকশনের ক্লাসটিচার?
হ্যাঁ।
বাচ্চাদের স্কুল থেকে ছাড়ার সময় আপনি প্রেজেন্ট থাকেন?
এটা তো আমার ডিউটি ম্যাডাম।
ঠিক কী পদ্ধতিতে বাচ্চাদের ছাড়েন, একটু যদি বিশদে বলেন।
ছুটির পর আমরা সেকশনের বাচ্চাদের লাইনে দাঁড় করাই। যারা স্কুলবাসে যায়, নাম ডেকে ডেকে তাদের বাসে পাঠিয়ে দিই। আর যাদের বাড়ির লোক নিতে আসে, তাদের গেটের কাছে নিয়ে যাই। বাড়ির লোক আইডি কার্ড দেখালে দরোয়ান বাচ্চা হ্যান্ডওভার করে দেয়।
আপনি সামনে থাকেন?
শেষ বাচ্চাটি যতক্ষণ না যায়, আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
কার্ড কে দেখে? আপনি, না দরোয়ান?
দুজনেই। দরোয়ান তো পাশেই থাকে।
ভাল করে ভেবেচিন্তে বলুন, প্রতিটি কার্ড আপনি দেখেন তো?
প্রিয়াঙ্কা সামান্য থতোমতো। ঝলকে প্রিন্সিপালকে দেখে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, মানে… সেশনের প্রথম এক-দুসপ্তাহ খুবই কড়াকড়ি বজায় রাখি। তারপর মোটামুটি চেনাজানা হয়ে গেলে…!
কার সঙ্গে চেনাজানা?
যাঁরা নিতে আসছেন…। অবশ্য সব সময়ই কার্ড দেখা হয়।
গতকাল কি এই নিয়ম পালন করা হয়েছিল?
প্রিয়াঙ্কা আবার যেন হোঁচট খেলেন। অস্বস্তি মাখা গলায় বললেন, কেন ম্যাডাম, কোনও কমপ্লেন আছে নাকি?
কমপ্লেনের কোনও কারণ ঘটেছিল কি?
সেরকম কিছু তো মনে পড়ছে না।
একটি বাচ্চাকে কিন্তু কাল বাড়ির ড্রাইভার ছাড়া অন্য একজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
এমন তো হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া অচেনা লোকের কাছে ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চা যাবেই বা কেন? সে তো আপত্তি জুড়বে।
রৌণক জরিওয়ালার বাবা কিন্তু বলছেন, তাঁর গাড়ি এখানে আসার আগেই…!
কাল তো রৌণকদের অন্য গাড়িটা এসেছিল। কালো রঙের হন্ডা সিটি। রৌণকের মা যে গাড়িটা নিয়ে আসেন মাঝে মাঝে। ড্রাইভার কার্ড দেখিয়ে নিয়ে গেল, রৌণকও কিছু বলল না…!
লোকটা যে ওই গাড়িটিরই ড্রাইভার বুঝলেন কী করে?
কারণ, গাড়িটা সে-ই চালাচ্ছিল।
আপনি তাকে স্টিয়ারিং-এ দেখেছেন?
তা নয়। আসলে ড্রাইভারই তো সাধারণত বাচ্চাদের নিতে আসে। রৌণকও লাফাতে-লাফাতে লোকটার সঙ্গে চলে গেল… তাই অন্য কিছু ভাবার অবকাশ হয়নি।
ও। তা কাল হন্ডা সিটিটাই এসেছিল, জানলেন কী করে? গাড়িটা আপনি দেখেছিলেন?
সত্যি বলতে কী, ওই সময় অতশত খেয়াল করার সুযোগ কোথায়? এত বাচ্চা…এমন ক্যালোর-ব্যানোর…। তবে কে যেন একটা চেঁচিয়ে বলল…। প্রিয়াঙ্কা পলকে চিন্তা করলেন, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সোহম রৌণককে বলছিল, আজ তোদের হন্ডা সিটিটা এসেছে রে।
সোহম কি রৌণকের ক্লাসমেট?
দুজনে খুব বন্ধু। পাশাপাশি ছাড়া বসবেই না।
হুম। আচ্ছা, শেষ বাচ্চাটাকে যখন কাল ছেড়েছিলেন তখন কটা বাজে?
সাড়ে তিনটে তো বটেই। প্রিয়াঙ্কাকে খানিক ব্যাকুল দেখাল, এত কথা জানতে চাইছেন কেন ম্যাডাম?
জবাব না দিয়ে প্রিয়াঙ্কার চোখে চোখ রাখল মিতিন, আপনার সেকশনের বাচ্চাদের গত বছরের কার্ডগুলো তো আপনার হেপাজতেই ছিল?
এখনও আছে। আমার ড্রয়ারে।
সে কী! অমিতা প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ওগুলো না নষ্ট করে দেওয়ার কথা?
হয়ে ওঠেনি ম্যাডাম। প্রিয়াঙ্কা আমতা-আমতা করছেন, বাচ্চাদের ফোটো থাকে তো, তাই ছিঁড়তে, পোড়াতে মায়া লাগে। আমরা প্রাইমারির টিচাররা, সবাই মিলে ঠিক করেছি, গরমের ছুটিতে সব পুরনো কার্ড একসঙ্গে জড়ো করে জ্বালিয়ে দেব।
বুঝলাম। মিতিন সহসা গম্ভীর। অমিতার মুখও থমথম করছে। ভুরু কুঁচকে তাঁকে দু-এক সেকেন্ড দেখে নিয়ে মিতিন বলল, প্রিয়াঙ্কা, এবার আপনাকে কটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?
বলুন?
আপনি থাকেন কোথায়?
টালিগঞ্জ।
বাড়িতে কে কে আছেন?
মা, দুই ভাই…। বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, ছোট হায়ার সেকেন্ডারি দিল।
বাবা…?
বছর দুয়েক আগে মারা গিয়েছেন। রোড অ্যাক্সিডেন্টে।
আপনি চাকরি কত দিন করছেন?
দেড় বছর।
অর্থাৎ বাড়িতে এখন আপনি একাই রোজগেরে? মিতিনের ঠোঁটে চিলতে হাসি, সোহম আজ এসেছে?
হ্যাঁ।
কাইন্ডলি তাকে একটু পাঠিয়ে দেবেন?
প্রিয়াঙ্কার মুখ শুকিয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, রৌণকের কী হয়েছে বলুন না, প্লিজ!
সময় হলে জানতে পারবেন এবং এখন কলিগদের সঙ্গে নো আলোচনা। মিতিনের গলা কাঠ-কাঠ, আর হ্যাঁ, এক্ষুনি ড্রয়ার চেক করে জানান পুরনো সমস্ত কার্ড ঠিকঠাক আছে কি না।
ঢক করে ঘাড় নাড়লেন প্রিয়াঙ্কা। উঠে বেরিয়ে গেলেন সন্ত্রস্ত পায়ে।
.
০৫.
মিলিটারি অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়াল ছেলেটা। হাত, পা, মাথা নড়ছে না এতটুকু। এমনকী, চোখের পলকটাও পড়ছে না। তবে চোখের মণি দুটো ঘুরছে টুপটাপ, ধীর গতিতে টেনিসকোর্টে বল ছোটার মতো। কখনও টুপুরে গিয়ে থামছে, কখনও অমিতায়। দেখছে মিতিনকেও, তবে সেভাবে যেন গুরুত্ব দিচ্ছে না।
মিতিন মিটিমিটি হাসছে। হাসিমুখেই বলল, তুমি তো মনে হচ্ছে ভারী লক্ষ্মী ছেলে?
সোহম জবাব দিল না। যেন এরকম একটা ফালতু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মানেই হয় না।
তুমি কী খেলতে ভালবাসো? ফুটবল? না ক্রিকেট?
ক্রিকেট।
ব্যাটিং? না বোলিং?
এবার ঘাড় একটু ঘুরল, আমি পেস বল করি।
ও মা, তাই নাকি? কে তোমার ফেভারিট বোলার?
ব্রেট লি।
কোনও ব্যাটসম্যানকে তোমার ভাল লাগে না?
লাগে। ম্যাথু হেডেন।
সে কী! ভারতের কোনও খেলোয়াড়কে পছন্দ নয়? সচিন তেন্ডুলকর?
সর্বদাই সচিন ভাল, তবে আমি অস্ট্রেলিয়ার সাপোর্টার।
বাঃ, বাঃ। মিতিন জোরে হেসে উঠল, ভারতীয় হলে ভারতের ক্রিকেটটিমকে সাপোর্ট করতে হবে, এমন তো কোনও রুল নেই!
সোহমের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটল এতক্ষণে। কৌতূহলী স্বরে বলল, তুমিও অস্ট্রেলিয়ার দলে?
একটু একটু।
মিতিন এলোমেলো গল্প করেই চলেছে। টুপুর অবাক হয়ে দেখছিল, কীভাবে সোহমের আড়ষ্টতা কাটিয়ে দিচ্ছে মিতিনমাসি। মিনিট দু-তিন পর মূল প্রসঙ্গে এল। সোহমকে কাছে টেনে বলল, রৌণক তোমার খুব বন্ধু, তাই না?
ফাস্ট ফ্রেন্ড। বলেই সোহমের চোখ পিটপিট, তুমি রৌণককে চেনো?
চিনি তো। রৌণকের বাবা আমার বন্ধু।
ও। রৌণক আজ আসেনি কেন?
শরীরটা ভাল নেই।
কী হয়েছে রৌণকের?
সিরিয়াস কিছু নয়। কাল-পরশুর মধ্যে সেরে যাবে।
কাল তো রৌণক ভালই ছিল! যাওয়ার সময় বলল, আজ আমার জন্য ভিডিয়ো গেমসের নতুন একটা সিডি আনবে…!
কাল বুঝি রৌণকদের গাড়ি আগে এসেছিল?
হ্যাঁ। ও যে হন্ডা সিটিটায় গেল…!
যে হন্ডা সিটি মানে? ওটা তো রৌণকদেরই আর-একটা গাড়ি!
উঁহু। ওটা রৌণকদের সেই গাড়িটা নয়।
বলো কী, অ্যাঁ?
অমিতা চুপচাপ কথোপকথন শুনছিলেন, এবার প্রায় আঁতকে উঠলেন, প্রিয়াঙ্কাম্যাডাম এইমাত্র বলে গেলেন, কাল তুমি নাকি চেঁচাচ্ছিলে, রৌণক, তোদের হন্ডা সিটিটা এসেছে।
আমার মিসটেক হয়েছিল ম্যাম। রংটা সেম তো, তাই…!
কী করে বুঝলে ওটা অন্য গাড়ি? মিতিনও বেশ উত্তেজিত, নম্বর দেখে?
হ্যাঁ তো। রৌণকদের হন্ডা সিটির নাম্বার থ্রি থ্রি ফোর ফোর। কালকের গাড়ির নাম্বারে কোনও থ্রি ছিলই না। ফোরও না।
তাও রৌণক ভুল গাড়িতে উঠে গেল?
তাই তো দেখলাম। যে আঙ্কলটা নিতে এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে লাফাতে-লাফাতে…?
আঙ্কলটাকে তুমি চেনো?
উঁহু। কখনও দেখিনি।
তার মানে যে আঙ্কল হন্ডা সিটি চালান, ওই আঙ্কলটা তিনি নন?
কী জানি! আমি তো সেই ড্রাইভার আঙ্কলকে ভাল করে দেখিইনি।
কেন? হন্ডা সিটি তো মাঝেসাঝে রৌণককে নিতে আসে?
হন্ডা সিটি যেদিন আসে, আন্টি নিজেই নেমে রৌণককে নিয়ে যান। ড্রাইভার আঙ্কল গাড়িতেই থাকেন। তা ছাড়া অনেক সময় তো আন্টি নিজেই গাড়ি চালান।
বুঝলাম। মিতিন সামান্য ঝুঁকল, আচ্ছা সোহম, কালকের আঙ্কলটা কি ইউনিফর্ম পরা ছিলেন?
না। গ্রিন শার্ট। আর জিন্স।
দেখতে কেমন?
গোঁফ আছে, চশমা আছে, হাইট শর্ট…! বলতে-বলতে থমকাল সোহম। চোখ সরু করে বলল, এত কোয়েশ্চেন করছ কেন? রৌণক কি মিসিং?
না না, তোমার মেমারি টেস্ট করছিলাম। মিতিন আলগা হাসল, এবার বলো তো, যে গাড়িটা এসেছিল, তার নাম্বার কত?
পুরোটা পড়তে পারিনি। তার আগেই তো হুস করে বেরিয়ে গেল। তবে নাম্বারটায় সিক্স আর নাইন ছিল। পাশাপাশি। লাস্টে।
দারুণ চোখ তো তোমার! তা গাড়িতে রৌণক আর ওই আঙ্কল ছাড়া আর কি কেউ ছিল?
দেখতে পেলাম কোথায়! রৌণকও উঠল, গাড়িও ধাঁ।
যাঃ, এই আনসারটা তা হলে তুমি দিতে পারলে না! মিতিন আবার একটু হাসল, যাক গে, তুমি মেমারি টেস্টে পাশ করে গিয়েছ। আজই রৌণককে গিয়ে বলছি, তোমার জন্য সিডি যেন অবশ্যই নিয়ে আসে।
থ্যাঙ্ক ইউ।
তুমি কিন্তু এখন রৌণককে ফোন কোরো না। শুয়ে থাকতে হচ্ছে তো, বন্ধুদের ফোন পেলে মন খারাপ হবে। যাও, ক্লাসে যাও।
দুপা গিয়েও সোহম দাঁড়িয়ে পড়ল। সন্দিগ্ধ চোখে মিতিনকে বলল, তুমি কি পুলিশ?
কেন বলো তো?
এত ক্রস করলে! নিশ্চয়ই রৌণকের অন্য কিছু একটা হয়েছে?
এ মা, তুমি কী বোকা! পুলিশ কি এরকম একটা দিদিকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরে? টুপুরকে দেখাল মিতিন। হাসি-হাসি মুখেই বলল, আমি রৌণকের একটা আন্টি। রৌণক কদিন স্কুলে আসবে না তো, খবরটা তাই প্রিন্সিপালম্যামকে দিতে এসেছিলাম।
সোহম তবু যেন বিশ্বাস করল না। তবে চলে গেল পায়ে-পায়ে। মিতিন আর টুপুরকে দেখতে-দেখতে।
ছেলেটা ঘর থেকে বেরনোমাত্র অমিতা কপাল চাপড়ালেন, কী হবে এখন? রৌণককে কীভাবে উদ্ধার করা যাবে?
মিতিন নীরব। মুখে একটি শব্দও নেই। একটুক্ষণ গুম হয়ে বসে টুপুরকে চেয়ার ছাড়ার ইঙ্গিত করল। কোনও বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়েই বেরিয়ে পড়ল অমিতার ঘর থেকে।
স্কুল কম্পাউন্ডের বাইরে ফুটপাথ ঘেঁষে মিতিনের মারুতি। সেদিকে এগোতে গিয়েও টুপুরের পা সহসা নিশ্চল। উত্তেজিত মুখে বলল, প্রিয়াঙ্কাম্যাডামের কাছ থেকে আই-ডি কার্ডের খবরটা তো নেওয়া হল না!
ব্যাগ থেকে গাড়ির চাবি বের করছিল মিতিন। ভাবলেশহীন গলায় বলল, প্রয়োজন নেই।
কেন?
পুরনো কার্ড যদি নকল হয়ে থাকে, আর সেই কাজে যদি স্কুলের কেউ জড়িত হয়…!
তা হলে সেই কার্ড এখন ফেরতও চলে এসেছে।
তবু জেনে নিলে…!
নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই টুপুর।
কিন্তু…, যে দরোয়ান কাল রনিকে ছেড়েছিল, তাকে তো একবার ট্যাপ করতে পারতে?
দরকার পড়লে নিশ্চয়ই করব। তবে আগের কাজ আগে। মিতিন গাড়ির স্টিয়ারিং-এ বসল। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে মোবাইল বের করল। বোতাম টিপে চাপল কানে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে পার্থর গলা ঠিকরে এল, কী নিউজ? কী হল স্কুলে? জানা গেল কিছু?
পরে শুনো। এক্ষুনি একটা কাজ করে দিতে হবে তোমাকে। মোটর ভেহিকল ডিপার্টমেন্টে তোমার এক বন্ধু আছে না?
শ্যামল বসাক। ডেপুটি ডিরেক্টর।
চটপট তার সঙ্গে যোগাযোগ করো। একটা গাড়ির ডিটেল ইনফরমেশন চাই। কালো হন্ডা সিটি। শেষ দুটো নাম্বার ছয় আর নয়। কবে রেজিষ্ট্রেশন হয়েছে, মালিকের নাম, ঠিকানা, ফোন, নাম্বার, সব জোগাড় করে ফেলো। যদি কলকাতায় রেজিস্ট্রেশন না হয়ে থাকে, সেটাও জানাও। কতক্ষণ লাগবে?
ধরে নাও অন্তত ঘন্টাদুয়েক।
চেষ্টা করো যাতে এক ঘণ্টার মধ্যে হয়। বলো, এক্সট্রিমলি আর্জেন্ট। একটা বাচ্চার জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে।
দেখছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব…! ব্যস, কথার মাঝখানেই মোবাইল অফ। মিতিনের দৃষ্টি উইন্ডস্ক্রিনে স্থির।
টুপুরের উত্তেজনার পারা আরও চড়ছিল। উৎসাহিত চোখে বলল, সোহম কিন্তু জব্বর একটা ক্লু দিয়েছে।
হুম। সূত্রটা ইম্পট্যান্ট। এগোতে সুবিধে হবে।
শুধু সুবিধে? গাড়ির মালিকের সন্ধান পেলেই তো কালপ্রিট কট।
অত সহজ বোধহয় নয় রে। অপরাধী অনেক ভাবনাচিন্তা করেই এগিয়েছে। হিসেব ছকে।
কী হিসেব?
তলিয়ে ভাব। মিতিনের মারুতি চলতে শুরু করল। মৌলালি মোড়ের আগে ঘুরল বাঁয়ে, এসপ্ল্যানেড অভিমুখে। হালকা যানজট ঠেলে এগোচ্ছে। গিয়ার বদলাতে-বদলাতে মিতিন বলল, হাতে তো এখন খানিকটা সময় আছে, লাইট লাঞ্চ সেরে নিবি নাকি?
যা বলবে।
মিনিট দশ-পনেরোর মধ্যে গাড়ি মধ্য কলকাতার এক স্ন্যাকবারের দরজায়। সবে বারোটা বাজে, দোকানে এখন তেমন ভিড় নেই। সকালের পরোটা-আলুচচ্চড়িতে পেট এখনও গজগজ, মাসি-বোনঝি কারওই তেমন খিদে পায়নি, তবু একপ্লেট করে স্যান্ডুইচের অর্ডার দেওয়া হল। সঙ্গে কফি।
মনে মনে ঘটনা পরম্পরা সাজানোর চেষ্টা করছিল টুপুর। স্যান্ডুইচ হাতে তুলে বলল, একটা ব্যাপার কিন্তু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। কোনও পেশাদার অপরাধী রনিকে অপহরণ করেনি। যে করেছে, সে রনির যথেষ্ট পরিচিত।
বটেই তো। নইলে রনি নির্বিবাদে তার সঙ্গে যাবে কেন!
ইস, রনি যদি একবার গাড়ির নাম্বারটা খেয়াল করত।
বড়রাই করেন না, ও তো একটা বাচ্চা। আমাদের বাড়ির তলায় যদি একটা লাল মারুতি দাঁড়িয়ে থাকে, তুই কি প্রথমে ধরে নিবি না গাড়িটা মিতিনমাসির? নাম্বার মেলানোর কথা কি আগে মাথায় আসবে?
তা ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হল, সেই চেনা লোকটি রনির আই-ডি কার্ড পেল কোত্থেকে? স্কুলের কারও সঙ্গে যোগসাজশ করেই কি পুরনো কার্ডটা…!
কার্ড জোগাড় করার আরও নানান উপায় আছে রে। যাক গে, তোর যা মনে হচ্ছে বলে যা, শুনছি।
আমার ধারণা…। টুপুর ঢোক গিলল, দুষ্কর্মের প্ল্যানটা ছকা হয়েছে অনেক আগে। যখন পুরনো কার্ডগুলো ক্লাসটিচারের জিম্মায় এসেছে, তখনই…!
তার মানে বলছিস প্রিয়াঙ্কাও এর সঙ্গে জড়িত?
সরাসরি যোগ না থাকলেও, কিছু দায় তো তাঁর আছেই। প্রথমত, কার্ডগুলো তিনি নষ্ট করেননি। দ্বিতীয়ত, নিশ্চয়ই তিনি কার্ডগুলোকে যথেষ্ট সাবধানে রাখেননি। আর সেই সুযোগ নিয়েই কেউ… হয়তো ওই দরোয়ানটাই রনির পরিচিত লোকের কাছে কার্ডটা পাচার করেছিল। যেহেতু সে অপরাধের অংশীদার, তাই হয়তো ছুটির সময় ইচ্ছে করে কার্ডটা ভাল করে চেক করেনি। প্রিয়াঙ্কাম্যাডাম তো কিছুই দেখেন না, অতএব লোকটাকে সন্দেহের মুখে পড়তেও হয়নি৷ টুপুর আশান্বিত চোখে তাকাল, কী গো, ভুল বললাম?
না। সেভাবে দেখতে গেলে তো প্রিয়াঙ্কা স্বয়ং জড়িয়ে থাকতে পারেন। গোটা সংসারের দায় তাঁর কাঁধে, পরিবার চালাতে তাঁর খরচ-খরচাও কম নয়…! প্রলোভনে উনি পড়তেই পারেন।
তবে? টুপুর আরও উৎসাহিত, প্রশ্ন এখন একটাই। নাটের গুরুটি কে? আমার তো মনে হয় রাকেশ। মানে মিস্টার জরিওয়ালার হন্ডা সিটির ড্রাইভার।
সে বেচারাকে সন্দেহ করার কারণ?
তার ছুটি নেওয়া এবং রনি-অপহরণ একই সঙ্গে ঘটল, এটা কি কাকতালীয়? দুটো ঘটনার মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই? যেমন পুরনো কার্ড এ বছর ক্লাসটিচারের হেপাজতে থাকা আর রনিকে গুম করা, দুটো ঘটনা একই সময়ে ঘটা মোটেও আকস্মিক হতে পারে না।
উম, তোর মগজ তো দেখছি পাকছে! বেশ পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে ভাবতে শিখেছিস! মিতিন মুচকি হাসল, আর-একটা ঘটনাও কিন্তু ঘটেছে রে। সেটাও কাকতালীয় না হতে পারে।
কী বলো তো?
প্রিয়াঙ্কার স্টেটমেন্ট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে করার চেষ্টা কর। টুপুরের পুরো গুলিয়ে গেল। স্টেটমেন্টের কোন অংশটার কথা বলছে মিতিনমাসি? উপযাচক হয়ে হন্ডা সিটির খবর শোনানোটা, নাকি…?
ভাবনার মাঝেই মিতিনমাসির মোবাইল বাজল। মনিটরে নাম দেখে তাড়াতাড়ি ফোন কানে ধরল মিতিনমাসি, হ্যাঁ অনিশ্চয়দা, বলুন? ও, ফোনবুথটা লেক টাউনে? বাঙ্গুর অ্যাভেনিউ? হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি। থ্যাঙ্ক ইউ দাদা। পরে বলব। সম্ভবত পরশু আপনার সাহায্য লাগবে। সময় আর জায়গা আপনাকে জানিয়ে দেব।
চলভাষযন্ত্র নীরব হওয়ার পর টুপুর কলকল করে উঠল, রনিকে তা হলে লেক টাউনে রেখেছে?
উঁহু। ফোনটা ওখান থেকে এসেছিল। এবং এর থেকে কিছুই প্রমাণ হয় না। মিতিন ব্যাগের চেন টানল। মাথা নেড়ে বলল, তবে একবার তো যেতে হবেই। যদি বুনো হাঁসের পিছনে তাড়া হয়, তবুও।
বিল মিটিয়ে ফের লাল মারুতি ফের ছুটল গাড়ি। মূল শহর ছেড়ে বাইপাস পৌঁছোতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লেগে গেল। এত জ্যাম রাস্তায়!
উলটোডাঙার মুখে এসে আবার মিতিনের মোবাইল ঝনঝন।
গাড়ি চালানোর সময় ফোন ধরে না মিতিন, মাসির ব্যাগ খুলে টুপুরই বোতাম টিপল। ও প্রান্তে মিসেস জরিওয়ালা। গলা থরথর কাঁপছে, ম্যাডাম, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে!
নিজের পরিচয় দিতে ভুলে গেল টুপুর। উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, নতুন কী ঘটল আবার?
এইমাত্র একটা ফোন এসেছিল। আই মিন, রনির কিডন্যাপারের।
কী বলছে?
রুস্তমজি যে আপনাকে অ্যাপয়েন্ট করেছে, সেটা ওরা জেনে গিয়েছে।
তো?
খুব শাসাচ্ছিল। কেউ কোনওরকম গোয়েন্দাগিরি চালালে রনিকে ওরা মেরে দেবে।
তা আমরা এখন কী করব?
আমি রুস্তমজিকে বলছি আপনাদের রুপিয়া দিয়ে দিতে। আপনারা আর কিচ্ছু করবেন না, প্লিজ! অনুগ্রহ করে আমার রনিকে নির্বিঘ্নে ফেরত পেতে দিন।
টুঁ শব্দটি না করে লীলার বক্তব্য শুনল মিতিন। চোয়াল শক্ত হল ক্রমশ। জ্বলছে চোখ জোড়া। তবে গাড়ি কিন্তু চালাচ্ছে একই গতিতে। এতটুকু ছন্দপতন নেই।
টুপুর নিচু গলায় ডাকল, মিতিনমাসি?
উঁ?
ফোনবুথ-টুথে গিয়ে আর লাভ আছে কোনও?
লাভ-লোকসানের হিসেব কষা গোয়েন্দার কাজ নয়। কেস যখন নিয়েছি, শেষ না দেখে ছাড়ব না।
বাচ্চাটার যদি কোনও ক্ষতি হয়ে যায়?
হবে না।
কী করে জোর দিয়ে বলছ?
যারা ভয় দেখায়, তাদের কলজের জোশ কম। জানবি, তারা নিজেরাই ভয় পেয়েছে।
.
০৬.
সবে ফাল্গুন মাস চলছে। তবে দুপুরের রোদ এখনই যথেষ্ট কড়া। বেলা আড়াইটে বাজে, বাঙ্গুর অ্যাভেনিউয়ের পথঘাটে লোক নেই বিশেষ। মিতিনদের অবশ্য কপাল ভাল, খুব একটা খোঁজাখুঁজি করতে হল না, সহজেই সন্ধান মিলল ফোনবুথখানার।
বড় রাস্তার উপরেই খুপরি দোকান। বাইরে জ্বলজ্বল করছে সাইনবোর্ড। দোকানের অর্ধেকটা কাঁচ দিয়ে ঘেরা টেলিফোন-ঘর, বাকি জায়গাটুকুতে চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে এক প্রৌঢ় মানুষ। টেবিলে খাতাপত্র আর বিলিং মেশিন।
গাড়ি থেকে নেমে সটান দোকানে ঢুকল মিতিন। ফাঁকা বুথে একা-একা ঢুলছিলেন ভদ্রলোক। ভরদুপুরে মিতিনদের আগমনে ধড়মড়িয়ে উঠলেন। চোখ কচলে বললেন, লোকাল কল করবেন?
এস টি ডি?
কোনওটাই নয়। মিতিন নিজের কার্ড বাড়িয়ে দিল, একটা ইনফরমেশন চাই।
ভদ্রলোক কার্ড উলটেপালটে দেখলেন বটে, তবে যেন ঠিকঠাক বুঝতে পারলেন না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।
মিতিন ভারিক্কি গলায় জিজ্ঞেস করল, বুথে কি আপনিই থাকেন সারাদিন?
কেন বলুন তো?
আমার জানা দরকার, কাল বিকেল-সন্ধেয় এখানে কে ছিল?
আমিই তো থাকি। কালও নিশ্চয়ই আমিই ছিলাম।
ভালভাবে মনে করে দেখুন তো, কাল বিকেল সাড়ে ছটা নাগাদ কে বা কারা এখানে ফোন করতে এসেছিল।
অত খেয়াল থাকে নাকি? কত লোক ঢুকছে, বেরোচ্ছে…! আর বিকেল-সন্ধেতে তো ভাল ভিড় থাকে।
এখান থেকে কোথায় ফোন যাচ্ছে না যাচ্ছে, তার রেকর্ড থাকে নিশ্চয়ই?
বিলে নাম্বার থাকে। আমি ওসব রেকর্ড রাখি না। অযথা কাগজের জঞ্জাল কে বাড়ায়?
কিন্তু কাল এখান থেকে এমন একটা কল হয়েছে, যার জন্য আপনি ঝামেলায় পড়তে পারেন।
কেন? কী হয়েছে? ভদ্রলোক এতক্ষণে যেন সন্ত্রস্ত, কে ফোন করেছে এখান থেকে?
ভয়ংকর এক অপরাধীর গ্যাং। মিতিন গলাটাকে বেশ রহস্যময় করল, পুলিশ কিন্তু আপনাকে এসে ধরবেই।
এ কী ফ্যাসাদ রে বাবা! ভদ্রলোকের মুখ-চোখ শুকিয়ে গেল, ব্যাপারটা কী, খুলে বলবেন তো!
এক্ষুনি জানানো যাবে না। শুধু এটুকু বলতে পারি, এসেছিল দুজন। তারা একসঙ্গে বুথে ঢুকেছিল। ঠিক সাড়ে ছটায়। মিতিনের চোখ সরু, কিছু স্মরণে আসছে কি?
দাঁড়ান, দাঁড়ান। ভদ্রলোক চোখ বুজে ভাবলেন একটু। তারপর ঘাড় নাড়তে-নাড়তে বললেন, সময়টা আমি অত দেখিনি, তবে সন্ধের মুখে-মুখে… সাইকেল নিয়ে… দুটো কল করল দুজনে…!
দুজনই ছিল তো?
হ্যাঁ। ওই মোড়ের বাড়ির ভদ্রমহিলা তখন বুথে। আই এস ডি করছিলেন। লোক দুটো এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল, এই টেবিলের সামনে। একজনের কাঁধে কিটব্যাগ ছিল। ঘড়ি দেখছিল ঘনঘন। আমাকে দু-একবার তাড়াও লাগাল।
কীরকম বয়স তাদের?
নিখুঁতভাবে বলি কী করে? তবে ধরুন গিয়ে… পঁয়ত্রিশ চল্লিশটল্লিশ…!
কেমন দেখতে?
অর্ডিনারি। চেহারায় তো সন্দেহ করার মতো কিছু দেখিনি।
পোশাক কী ছিল বলতে পারবেন?
না ম্যাডাম। অত আমি লক্ষ করি না। তবে খুব একটা উৎকট পোশাক ছিল না, এটুকু জানাতে পারি। তেমন হলে তো চোখে লাগত।
হুম। ফোন শেষ হওয়ার পর তারা কী করেছিল?
বিল পেমেন্ট করল। তারপর সাইকেল ফুটপাথে দাঁড় করানো ছিল, চড়ে চলে গেল।
দুজনের দুটো সাইকেল?
হ্যাঁ। না, না, সাইকেল বোধহয় একটাই ছিল।
টুপুর আর চুপ থাকতে পারল না। ভুরু কুঁচকে বলল, তার মানে একটা সাইকেলেই দুজনে…?
তাই হবে। কে জানে, আমি হয়তো ভুলও বলতে পারি।
যেটুকু স্মরণ করতে পারলেন, সেটুকুই যথেষ্ট। মিতিন চিলতে হাসল, আপনাকে একটি অনুরোধ আছে।
বলুন?
আমার কার্ডটা ড্রয়ারে রেখে দিন। যদি লোক দুটো আবার আসে বা পথেঘাটে তাদের দেখে চিনতে পারেন, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খবর দেবেন।
অবশ্যই। ভদ্রলোক জোরে জোরে মাথা নাড়লেন। তারপর হঠাৎই দৃষ্টি সরু, লোক দুটো কি কাউকে খুনটুন করেছে ম্যাডাম?
ওই গোছেরই কিছু। এখন বলা বারণ।
ভদ্রলোককে আর কোনও প্রশ্নের অবকাশ না দিয়ে মিতিন সোজা দোকানের বাইরে। গাড়ি স্টার্ট করে টুপুরকে বলল, তোর মেসোকে একটা ফোন লাগা তো। দ্যাখ তো, কদ্দূর এগিয়েছে।
মাসির ব্যাগ খুলে মোবাইলটা বের করতে-করতে টুপুর বলল, এখান থেকে কিন্তু খানিকটা দিশা পাওয়া গেল।
যেমন?
সাইকেলে যখন এসেছিল, লোক দুটো নির্ঘাত কাছাকাছি কোথাও থাকে।
অসম্ভব নয়।
অতএব রনিকেও ধারেকাছে কোথাও রেখেছে।
হুম। নে, এবার ফোনটা লাগা।
মেসোর নাম্বার টেপার আগেই মোবাইলে বাজনা। স্বয়ং রুস্তমজির কল।
চমকে গিয়ে মিতিনমাসিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিতে যাচ্ছিল টুপুর, মিতিনের ইশারায় নিজের কানেই চাপল, মাসি এখন ড্রাইভ করছেন মিস্টার জরিওয়ালা। কিছু খবর থাকলে আমায় দিতে পারেন।
তিন-চার সেকেন্ড পর রুস্তমজির গলা শোনা গেল, ওয়েল, লীলা একটু আগে আমায় ফোন করেছিল। ওকে কিডন্যাপাররা খুব ভয় দেখিয়েছে।
জানি! ম্যাডাম মাসিকে বলেছেন।
ইয়েস, আমি সেটাও শুনেছি।
ও।
আমার এখন জানার বিষয়, আপনার… আই মিন তোমার মাসি এখন কী করতে চান? আর এগোবেন? না তদন্তটা এখানেই স্টপ করে দেবেন?
আড়চোখে মিতিনমাসিকে দেখে নিয়ে টুপুর বলল, কোনও ইনভেস্টিগেশন শুরু করে মাঝপথে থেমে যাওয়াটা মাসির স্বভাবে নেই, মিস্টার জরিওয়ালা।
এটা খুবই প্রশংসনীয়। আমি এই অ্যাটিটিউডটাই বেশি পছন্দ করি। তবে উনি যদি এখানেই থেমে যেতে চান, তা হলেও আমার আপত্তি নেই। আমি ওঁকে যথাযথ ফিজ দিয়ে দেব। লীলার উপর দিয়ে যে মানসিক ঝড়টা যাচ্ছে, তার কথাও তো মাথায় রাখতে হবে।
তা ঠিক। তবু…! টুপুর মুহূর্তের জন্য থামল। গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল, কাজ না করে ফিজ নেওয়াটাও আমার মাসির ধাতে নেই, মিস্টার জরিওয়ালা। তা ছাড়া মাসি এই কেসটায় বেশ খানিকটা এগিয়েছেন, এখন কিডন্যাপারদের না ধরে আগেই থেমে যাওয়াটা তাঁর পক্ষে অত্যন্ত অসম্মানজনক।
ও প্রান্তের স্বর একটুক্ষণ নীরব। তারপর আবার বাজল, ঠিক আছে, ম্যাডাম যা ভাল বুঝবেন তাই করুন। আমিও তো অপরাধীদের শাস্তি চাই। বাই দ্য বাই, উনি কদ্দূর কী এগোলেন, জানতে পারি কি?
এতক্ষণের সমাচার উগরে দিতে যাচ্ছিল টুপুর, হঠাৎ কাঁধে মিতিনের মৃদু চাপ। ইঙ্গিত বুঝে থমকাল টুপুর। আমতা-আমতা করে বলল, মাসি আপনাকে সব জানাবে।
ওকে। নো প্রবলেম। ম্যাডামের ফোনের অপেক্ষায় রইলাম। ৬০।
ফোনটা ছাড়তেই মিতিন হালকা গলায় বলল, তোকে তো দেখছি এবার রেমিউনারেশন দিতে হবে রে।
কেন গো?
যা ওস্তাদ হয়ে উঠছিস দিনদিন! কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বললি রুস্তমজির সঙ্গে।
মিতিনমাসির মুখে এমন তারিফ শুনলে টুপুরের পুলক না জেগে পারে! একগাল হেসে বলল, মানছ তা হলে আমি তোমার যোগ্য সহকারী?
অনেকটা। তবে আরও দু-চারটে কথা রুস্তমজিকে বলা উচিত ছিল।
কীরকম।
কিডন্যাপারদের ফোন আবার আসবে। রুস্তমজি যেন প্রতিটি কলের নাম্বার আর টাইম নোট করেন এবং অবিলম্বে আমাকে জানিয়ে দেন।
ঠিকই তো! এটা তো মাথায় আসেনি? টুপুর ঝটিতি মোবাইলটা হাতে নিল, বলে দিই রুস্তমজিকে?
হুটোপুটির দরকার নেই। ফোন এলে উনি নিজেই করবেন।
তা হলে আমাকে দোষ দিচ্ছ কেন?
যেটা বলা উচিত ছিল, সেটা তোকে শেখাচ্ছি। লেক টাউন ছেড়ে ভি আই পি রোডে পড়ল গাড়ি। বাঁয়ে গাছপালা আর সরু খালের ওপারে সল্টলেকের বাড়িঘর। একটা ফুটব্রিজও গিয়েছে সেদিকপানে। আলগাভাবে ফুটব্রিজটাকে দেখে নিয়ে মিতিন বলল, তুই কিন্তু দরকারি ফোনটার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিস টুপুর।
এ তো রীতিমতো কর্তব্যে গাফিলতি। টুপুর জিভ কাটল। পার্থমেসোর লাইনটা টিপে মাইক্রোফোনটাও চালু করে দিল।
কী গো মেসো, সাড়াশব্দ নেই কেন?
আর বলিস না। শ্যামলকে তো ফোনে ধরতেই পারছিলাম না। এনগেজড, এনগেজড…।
তা হলে?
পেয়েছি শেষ পর্যন্ত। শ্যামল একটু টাইম চাইল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ডিটেল পেয়ে যাব। তোরা কোথায়?
এবার টুপুর নয়, মিতিনের জবাব। গলা তুলে বলল, আমরা তোমার প্রেসে যাচ্ছি। ট্রাফিক নরমাল থাকলে মিনিট কুড়ির মধ্যে পৌঁছে যাব।
লাগল অবশ্য প্রায় এক ঘণ্টা। দুপুরবেলা প্যাসেঞ্জার তোলার জন্যে বাস-মিনিবাসগুলো যেভাবে যত্রতত্র রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাদের টপকে এগোনোর সাধ্য আছে গাড়িঘোড়ার? তার উপর বউবাজারের রাস্তা তো অকহতব্য। ট্রাম, বাস, টানারিকশা, ট্যাক্সি, ঠেলাগাড়িতে তো থিকথিকে জ্যাম। পার্থর প্রেস পর্যন্ত তো পৌঁছেতেও পারল না গাড়ি। যানজট আর ভিড়ের চোটে বেশ খানিকটা আগে মারুতিকে রাখতে হল। তারপর ধাক্কা খেতে-খেতে বাকি পথটুকু হন্টন।
পার্থর প্রেসে আগে কখনও আসেনি টুপুর। চেহারা দেখে একটু বুঝি হতাশই হল। আদ্যিকালের এক জীর্ণ বাড়ির নীচের তলায় দুখানা ঘর নিয়ে পার্থর ছাপাখানা। রাশিরাশি কাগজ গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেয়, কোণেও দাঁড় করানো আছে নানান রঙের কাগজের রোল। তার মাঝেই কম্পিউটার, ডি টি পি মেশিন, চেয়ার, টেবিল, কাঠের র্যাক…। একটা ঘরে কম্পোজের কাজ চলছে, অন্যটায় মুদ্রণ। ভিতরে নড়াচড়ার জায়গা এত কম, পা রাখলেই যেন দমবন্ধ হয়ে আসে। দুটো ঘরেই অবশ্য এ সি চলছে, এটাই যা বাঁচোয়া!
মিতিন-টুপুরকে দেখে পার্থ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চা, কফি, না ঠান্ডা পানীয় কী আনাবে ভেবে পেল না। শেষে বুদ্ধি করে ডাব আনতে পাঠাল একজনকে। টুপুরকে বলল, তোদের পেটে কিছু পড়েছে? নাকি খাবার আনাব?
আমাদের নিয়ে চিন্তা পরে। মিতিনের কেজো প্রশ্ন, কাজটা হল কি?
ও শিয়োর। শ্যামল আমার মান রেখেছে। এইমাত্র ফোন করেছিল। বলতে-বলতে টেবিল থেকে একটা চিরকুট তুলে পড়ল পার্থ, লাস্টে ছয় আর নয় নাম্বারওয়ালা একটা কালো হন্ডা সিটির সন্ধান মিলেছে। পুরো নাম্বার টু ওয়ান সিক্স নাইন। দু হাজার আট সালের গাড়ি, রেজিস্ট্রেশনটা কমার্শিয়াল, অর্থাৎ ভাড়া খাটে। মালিকের নাম দ্বিজেন হালদার। কার রেন্টের ব্যবসা আছে। ঠিকানা, সেভেন বি, মিডলটন রো! ফোন নাম্বার…!
লাগবে না। মিতিন একটা টুল টেনে বসে ছিল, তড়াক উঠে দাঁড়াল, চল টুপুর, বেরিয়ে পড়ি। দ্বিজেন হালদারকে এক্ষুনি মিট করতে হবে।
আহা, ডাবটা তো খেয়ে যাও।
সময় নেই, পার্থ। মিডলটন রো যেতে কতক্ষণ আবার লাগে! গিয়ে লোকটাকে পাব, কি পাব না, কে জানে! মিতিন ঘড়ি দেখল, তুমিও সঙ্গী হতে পারো। যদি অবশ্য কাজের প্রেশার না থাকে।
পার্থ বুঝি মুখিয়েই ছিল। কর্মচারীদের নির্দেশ দানের পালা সেরে সে তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত। চোখে রোদচশমা চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল প্রেস ছেড়ে। গাড়িতে এসে নিজেই চালকের আসনে বসল।
ছুটল গাড়ি। দক্ষিণ মুখে।
ভিতরে ভিতরে দারুণ একটা উত্তেজনা অনুভব করছিল টুপুর। কী চমৎকার সরল গতিতে এগোচ্ছে তদন্ত। কিডন্যাপারের কল থেকে একটা ফোনবুথের সূত্র মিলেছিল, সেখানে হানা দিয়ে তাদের পুরোপুরি নিরাশ হতে হয়নি। অন্তত এটুকু তো অনুমান করা গেল, অপরাধীরা কোন অঞ্চলের! মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গাড়ির হদিশও হাতের মুঠোয়। এবার নিশ্চয়ই অপরাধীর টুটি চেপে ধরতে অসুবিধে হবে না! বেচারা রনিটাকে যদি আজই উদ্ধার করা যায়…!
সাতের বি মিলটন রো মোটেই দ্বিজেন হালদারের বসতবাড়ি নয়। ঠিকানাটি কার রেন্টাল অফিসেরই। আরও অনেক অফিস আর দোকানপাটের মাঝে ফালি ঘরে স্টার টুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস। খুদে অফিসটি রীতিমতো ঝাঁ চকচকে। দ্বিজেন হালদার মানুষটিও বেশ কেতাদুরস্ত। সবুজ সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপারে ঘোরানো-চেয়ারে আসীন। সামনে ল্যাপটপ। চারপাশে সুদৃশ্য কাঠের প্যানেলিং করা দেওয়ালে পৃথিবীর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের ফোটো। একটি গণেশের মূর্তিও আছে। দ্বিজেন হালদারের ঠিক মাথার উপরে, কাচের তাকে। টাটকা মালা পরানো। ধূপের গন্ধও আবছাভাবে নাকে আসে যেন।
ল্যাপটপে আঙুল চলছিল দ্বিজেন হালদারের। মিতিনদের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুললেন সুট-টাই পরা বছর পঞ্চাশের মানুষটি। চেয়ারে হেলান দিয়ে কেতাবি ঢঙে বললেন, ইয়েস? হাউ ক্যান আই হেলপ ইউ?
পার্থকে শেখানোই ছিল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে পার্থ বলল, আমাদের একটা গাড়ি চাই। কাল দুপুরে।
আপনারা কে? কোত্থেকে আসছেন?
সেটা জানা বুঝি খুব জরুরি? পার্থও কায়দা মেরে বলল, ওয়েল, আমি হরিসাধন সরকার, ইনি আমার স্ত্রী তারাসুন্দরী সরকার, আর এই মেয়েটি হল…!
এক সেকেন্ড। দ্বিজেন হাত তুলে থামালেন পার্থকে।
তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, সরি স্যার। আমরা পার্সোনালি কাউকে গাড়িভাড়া দিই না।
সে কী? কালই তো এখান থেকে একটা কালো হন্ডা সিটি, যার নাম্বার টু ওয়ান সিক্স নাইন, কোনও একজনকে ব্যক্তিগতভাবে ভাড়া দিয়েছিলেন।
দ্বিজেন হালদারের ভ্রূ-তে ভাঁজ। বিরক্ত স্বরে বললেন, আপনারা ঠিক কে বলুন তো? কী চান, অ্যাঁ?
পার্থ নয়, এবার মিতিন মুখ খুলল। আই-ডি কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে শীতল গলায় বলল, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, অকারণে আসিনি? আশা করি আপনার সহযোগিতা পাব?
যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হলেন দ্বিজেন। একটুক্ষণ গুম থেকে কাঠ কাঠ গলায় বললেন, আপনাদের প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। তবে আমি কোনও ঝঞ্ঝাট-ঝামেলাও চাই না। বলুন আপনাদের কী জানার আছে?
ওই বিশেষ গাড়িটি কাল ভাড়া খাটতে গিয়েছিল কি?
হ্যাঁ।
রাতে নিশ্চয়ই ফিরেছে?
না। পার্টি চারদিনের জন্য নিয়েছে গাড়িটা। তাদের কোনও গেস্ট এসেছে ফরেন থেকে, গাড়ি নিয়ে অতিথিরা মন্দারমণি গিয়েছে।
কাল কখন থেকে ভাড়া ছিল গাড়ি?
দুপুর থেকে। বেলা দুটোয় রিপোর্টিং ছিল।
কোথায়?
এটাও বলতে হবে? দ্বিজেনের স্বর রুক্ষ, বেলেঘাটা। টাওয়ার অফ সাইলেন্সের গেটে।
মিতিনের দৃষ্টি চকিতে স্থির, আপনার পার্টির নাম জানতে পারি?
দ্বিজেন ক্ষণকাল চুপ। তারপর যেন খানিক ইতস্তত করে বললেন, এঁরা আমার খুব পুরনো ক্লায়েন্ট। প্রায়শই অফিশিয়াল কাজে আমার গাড়ি নেন…! কার্পেট ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের ব্যবসা তো, মাঝে মাঝেই বাইরে থেকে লোক আসে…!
আপনি কাদের কথা বলছেন?
রুস্তমজি জরিওয়ালা। যাঁদের ফ্যান্টাসি ব্র্যান্ডের কার্পেট আছে।