মন্দিরে উঠে গেলেন অনঙ্গমোহন। জোর-জোর ঘণ্টা বাজিয়ে আরতি সারছেন। পিছনের লোহার ফটক পেরিয়ে মিতিন আর টুপুর গঙ্গার ধারে এল।
নদীতে ভাটা চলছে। বাঁধানো পাড়ের অনেকটা নীচ থেকে ঢাল বেয়ে নেমে গিয়েছে থকথকে এঁটেলমাটির কাদা। দেখে আন্দাজ করা যায়, জোয়ারে কতদূর পর্যন্ত জল আসে। ওপারে পশ্চিম আকাশে সুর্য প্ৰায় ড়ুবুড়ুবু, তার লালচে আভায় চিকমিক করছে গঙ্গা। ফেরিঘাট থেকে এই বুঝি একটা লঞ্চ ছাড়ল, ঢেউ কেটেকেটে যাত্রীবোঝাই জলযান চলেছে গেঁওখালির দিকে। ওপারে স্থলভূমির ছায়া-ছায়া গাছগাছালি যেন জলরঙে আঁকা ছবি।
টুপুর উচ্ছসিত স্বরে বলল, কী দারুণ লাগছে গো মাসি! অপূর্ব!
মিতিনের দোপাট্টা হাওয়ায় উড়ছিল। গায়ে সাপটে নিয়ে বলল, স্পটটা কিন্তু ভারী মজাদার। কাছেই দক্ষিণবঙ্গের দু-দুখানা বিখ্যাত নদ এসে মিলেছে গঙ্গায়। রূপনারায়ণ, আর দামোদর। রূপনারায়ণের মোহনার এক তীরে গেঁওখালি, অন্য পারে গাদিয়াড়া। আবার নুরপুর যদিও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়, গেঁওখালি পূর্ব মেদিনীপুরে আর গাদিয়াড়া হাওড়ায়। তিনটে জেলার সীমানায় নদী। মানেটা বুঝতে পারছিস? চাইলে ঘন্টাখানেকের মধ্যে লঞ্চে লঞ্চে তিনটে জেলা ছুঁয়ে আসতে পারিস।
টুপুর ভুরু কুঁচকে বলল, গঙ্গা-রূপনারায়ণের সঙ্গম তো দেখতে পাচ্ছি। দামোদর কোথায়?
খানিক ডাইনে। গঙ্গা ক্রস করে গাদিয়াড়া যেতে চোখে পড়ে।
টুপুর প্রায় বলতে যাচ্ছিল, ঝপ করে ঘুরে এলে হয়! গিলে নিল ইচ্ছেটা। দরকারি কাজে এসে এই ধরনের বায়না জোড়া মানায় না। তা ছাড়া তদন্ত তো আজই চুকছে না। আবার আসতে হবে, তখনই না হয়…!
ভাবনায় ছেদ পড়ল। পিছনে মীনধ্বজের গমগমে গলা, গঙ্গার শোভা দেখছেন নাকি ম্যাডাম?
টুপুর, মিতিন একসঙ্গে ঘুরছে। পার্থকে নিয়ে এদিকেই আসছেন মীনধ্বজ। পাশে এক দীর্ঘকায় তরুণ।
ফিসফিস করে টুপুর বলল, সন্দীপনবাবু নাকি?
মনে তো হচ্ছে। বাগচীসাহেবের বোধ হয় তর সইল না। ডেকে নিয়েছেন।
হ্যাঁ, অনুমান সঠিক। ছেলেটি সন্দীপনই। বেশ ঝকঝকে চেহারা, বয়স বোধ হয় তিরিশও ছোঁয়নি, গায়ের রং ফরসাই বলা যায়, চুল ঈষৎ কোঁকড়া, বাদামি ফ্রেমের চশমার আড়ালে চোখ দুটো যথেষ্ট উজ্জ্বল। কালো ট্রাউজারস পরে আছে সন্দীপন, গায়ে হালকা নীল বুশশার্ট।
আলাপ করিয়ে দিতেই সন্দীপন স্মিত মুখে বলল, কাকাবাবু আমার পরামর্শটা শুনেছেন দেখে ভাল লাগল। আমি তো প্রথম থেকেই বলছি, এ বাড়িতে যদি কোনও রহস্য থাকে, সেটি উদঘাটন পুলিশের কম্মো নয়। দরকার একজন পেশাদার গোয়েন্দার। আপনার মতো।
মিতিন হেসে বলল, আপনি আমায় চেনেন নাকি?
নাম শুনেছি। আপনি তো বিখ্যাত মানুষ। ইলিয়ট রোডের সেই ভুতুড়ে বাড়ির কাণ্ডকারখানা আপনি যেভাবে সলভ করেছিলেন… খবরের কাগজে তো ফলাও করে বেরিয়েছিল নিউজটা।
কপাল দেখুন, আবার সেই ভূতের বাড়ির সমস্যাই এসেছে।
এ বাড়ির কথা বলছেন?
অবশ্যই। মিস্টার বাগচী প্ৰায় রাতেই তো ভৌতিক শব্দ শুনছেন।
হ্যাঁ, কাকাবাবু বলছেন বটে। সন্দীপন অল্প হাসল, মজার ব্যাপার কী জানেন তো? আমি রাতে থাকলে কোনও আওয়াজই হয় না। শুধু তাই নয়, আমি তো অন্তত পৌনে তিন বছর এই বাড়িতে একা-একা থেকেছি। কোনওদিনই ওইসব বিদঘুটে সাউন্ড কানে আসেনি।
মীনধ্বজ বললেন, আমি তো মানছি ওটা হয়তো মনের ভুল।
কিন্তু আপনি ভয় তো পাচ্ছেন।
মোটেই না। অবাক হচ্ছি।
মনের ভুলটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন কাকাবাবু, প্লিজ। না হলে, রাতে নয় আমি এখানে থাকি। যদি একটাও সাউন্ড হয়, সোর্সটা আমি ধরে ফেলবই।
ঠিক আছে, সে দেখা যাবেখন। আলোচনাটা যেন মীনধ্বজের পছন্দ হচ্ছে না, কথা ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, গঙ্গার ধারটা কেমন লাগছে ম্যাডাম?
দুর্দান্ত! এখানে ঘণ্টার পর-ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা যায়। বলতে বলতে মিতিনের দৃষ্টি হঠাৎ ঢালের কাদায় স্থির। আঙুল তুলে বলল, ভাঙা-ভাঙা থামের মতো ওগুলো কী মিস্টার বাগচী?
ওখানে এককালে বাঁধানো জেটি ছিল। সেই অলমিডাসাহেবের যুগে। জাহাজটাহাজও নাকি ভিড়ত। আমি অবশ্য জন্ম থেকে জেটির ধ্বংসাবশেষই দেখছি। তবে একটা জিনিস এখনও টিকে আছে। মীনধ্বজ দুপা এগোলেন। খাড়া পাড়ের কিনারে গিয়ে সন্তৰ্পণে ঝুঁকলেন সামান্য। বললেন, নীচের দিকটা দেখুন। ওই বাঁয়ে।
দর্শনীয় বস্তুই বটে। টুপুররা যেখানে পঁড়িয়ে, তার থেকে খানিক তফাতে, বাঁ দিকে পাড়ের গায়ে এক চৌকো লোহার গেট। মরচে ধরা, কাদামাখা। আকারে রীতিমতো বিশাল। পাড় থেকে শুরু হয়ে খাড়া চলে গিয়েছে ঢাল পর্যন্ত। অন্তত ফুটদশেক চওড়া তো হবেই, উচ্চতাও পনেরো ফুটের কম নয়।
পার্থ গোল-গোল চোখে বলল, ওটা কী?
গেস করুন।
স্লুইস গেট?
রাইট। সামনে নাকি পরপর আরও তিনটে ছিল। সবই এখন নদীর গর্ভে।
এত লকগেট? কেন?
এককালে নদী তো এখানে যথেষ্ট তেজিয়ান ছিল, তখন নাকি জলের চাপ কমাতে খুলে দেওয়া হত একটার পর একটা। শেষ গেটটি ওপেন করলে জল নাকি চলে যেত আমাদের বেসমেন্টে। বোধ হয় ওটা ছিল বাড়িটাকে রক্ষা করার কৌশল। জলের লেয়ার নেমে গেলে বেসমেন্ট আবার ক্লিয়ার হয়ে যেত।
টুপুর অত্যুৎসাহী মুখে বলে ফেলল, যেখানে যিশু আর মা মেরির মূর্তি রাখা আছে?
না না, ওগুলো তো বেসমেন্টের ঘরে। জল আসত ঘরগুলোর নীচে, চাতালে। সেখানে আউটলেটও ছিল। জলের হাইট বেশি বেড়ে গেলে, আউটলেট দিয়ে নাকি বেরিয়েও যেত। বলেই মীনধ্বজ থমকালেন, বেসমেন্টের কথা তোমাদের কে বলল?
ঠাকুরমশাই!
তার সঙ্গে পরিচয় হল কখন?
এই তো, একটু আগে। মিতিন আবার লকগেটের প্রসঙ্গে ফিরল, বেসমেন্টে তা হলে জল ঢোকানোর ব্যবস্থা আছে?
ছিল। এখন আর নেই। ওই লকগেট বহুকাল ধরেই অচল। খোলা-বন্ধ করার সিস্টেমটাও কোথায় ছিল কে জানে! মীনধ্বজ গলা ঝাড়লেন, তখন বললাম না, শিখিধ্বজ কোনওদিনই এখানে বাস করেননি…! তখন থেকেই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জাহাজঘাটা, লকগেট, সবই পঞ্চত্ব পেয়েছে। নেহাত আমার ঠাকুরদা নদীর পাড়টা বাঁধিয়েছিলেন, তাই অতীতের স্মৃতিটুকু আছে কোনওরকমে। এ ছাড়া, ভিতরে যাতে জল না ঢেকে, ঠাকুরদা বেসমেন্টে পুরু দেওয়ালও তুলে দেন। সুতরাং লকগেট ব্যবহারেরও আর প্রশ্ন নেই।
স্ট্রেঞ্জ! সেই প্রোটেকশান সিস্টেম ছাড়াই বাড়ি অক্ষত আছে?
তাই তো দেখছি। জলও অনেক কমে গিয়েছে যে! পদ্মা যত ফুলেফেঁপে উঠেছে, ভাগীরথী তত নিস্তেজ হয়েছে। সেই জন্যই হয়তো আর বিপদটিপদ ঘটেনি।
হুঁ। মিতিন ভাবল কী যেন। বলল, বেসমেন্টে একবার যাওয়া যায় না?
এখন? অন্ধকার হয়ে এল..আমি তো খুব একটা নীচেটিচে যাই না…কারেন্টও নেই! দিনেরবেলা স্কাইলাইটের আলোয় দেখলে বোধ হয় সুবিধে হত।
সন্দীপন মৃদু স্বরে বলল, এখনও অসুবিধে নেই। টর্চ তো আছে।
মীনধ্বজ বললেন, তুমি তা হলে নিয়ে যাও। আমি আর নামছি না, নীচটা বড্ড স্টাফি।
বাড়ির সামনে যে দশ ধাপ সিঁড়ি, তার তলাতেই বেসমেন্টের দরজা। তালা খুলে ঢুকল সন্দীপন। টর্চ হাতে চলেছে আগে-আগে। উপরতলার মতো একেবারেই খোলামেলা নয়, বরং সত্যিই খানিকটা দমচাপা ভাব। তবে আঁধার এখনও তেমন ঘুরঘুট্টি হয়নি। ছোটছোট ঘুলঘুলি দিয়ে চুঁইয়ে-চুঁইয়ে আসা অন্তিম সূর্যালোক একটা আবছায়া রচনা করেছে অরে। ছায়াই বেশি, ক্ষীণ আলোটুকু চাপা পড়ে যাচ্ছে টর্চের দাপটে।
টানা লম্বা প্যাসেজের গায়ে পরপর তিনখানা ঘর। প্রথমটায় তো ঢোকারই জো নেই, রাশি রাশি ভাঙাচোরা আসবাবে বোঝাই। একটা পায়াভাঙা চেয়ারের হাতল ছুঁয়ে টুপুর টের পেল, কী পুরু ধুলোর আস্তরণ। দ্বিতীয় ঘরখানায় আদ্যিকালের কিছু লোহালক্কড় পড়ে আছে। তিন নম্বরটিতে চ্যাপেলের মূর্তি আর কিছু আসবাব। ছোট যিশুকে কোলে মাটির মা মেরির পাশেই বড়সড় একটি পিয়ানো। একটা-দুটো লম্বা বেঞ্চও আছে। ছবি আছে বেশ কিছু। অধিকাংশই ডাঁই করা, দু-চারটে দেওয়ালে ঝুলছে। মানুষপ্রমাণ ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ছবিখানা একদিকের দেওয়াল জুড়ে দাঁড়িয়ে। এ ঘরেও প্রাচীন-প্ৰাচীন গন্ধ।
টর্চের আলোর সঙ্গে-সঙ্গে চোখ ঘুরছিল মিতিনের। বলল, পেন্টিংগুলো তো বেশ ভাল কোয়ালিটির। উপরে নিয়ে গিয়ে টাঙাননি কেন?
সন্দীপন টৰ্চটা আবার ঘুরিয়ে বলল, মন্দিরের যিনি প্রথম পূজারি, তাঁর নাকি বারণ ছিল।
পার্থ আক্ষেপের সুরে বলল, এত ভাল একখানা পিয়ানো, তাও কেমন অযত্নে নষ্ট হচ্ছে!
উপায় কী বলুন? পূর্বপুরুষদের স্থির করা নীতি তো কাকাবাবু ভঙ্গ করতে পারেন না।
তা বটে। মিতিন জিজ্ঞেস করল, বেসমেন্টের সেই চাতালটা কোথায়, যেখানে জল আসত?
আসুন, দেখাচ্ছি।
তৃতীয় কামরাটির পিছনে আর-একটি দরজা খুলতেই ঘোরানো লোহার সিঁড়ি নেমে গিয়েছে। বেশি নয়, দশ-বারো ধাপ। আলো দেখিয়ে-দেখিয়ে মিতিনদের নীচে নিয়ে এল সন্দীপন। খুব একটা বড় নয় চাতালটা। সামনে খাড়া দেওয়াল, পিছনেও খাড়া দেওয়াল। প্রকাণ্ড একটা বাক্সের মতো চেহারা।
সামনের দেওয়ালে আলো ফেলে সন্দীপন বলল, কাকাবাবুর ঠাকুরদা এই দেওয়ালটাই গেঁথেছিলেন।
মিতিন একবার চোখ চালিয়ে নিয়ে বলল, জল বেরনোর জায়গা ছিল শুনছিলাম?
বোধ হয় সাইড ওয়ালে ছিল। নিশ্চয়ই তখনই আটকে দিয়েছেন, এখন তো আর বোঝার কোনও উপায় নেই।
সবকটা দেওয়ালেই একটু টোকা মেরে দেখল মিতিন। দেওয়ালে কান পেতে কিছু যেন শোনারও চেষ্টা করল। আপনমনে বলল, স্ট্রাকচারগুলো সলিড।
আগেকার দিনের নির্মাণ ম্যাডাম… তখন তো খুব পাকা কাজই হত।
ঠিক। চলুন, এবার ফেরা যাক।
আবার লোহার সিঁড়ি। তৃতীয় ঘরের মধ্যে দিয়ে ফের প্যাসেজ। বেসমেন্টের বাইরে এসে বড়সড় শ্বাস নিল পাৰ্থ। উদাস স্বরে বলল, কেন যে এমন গৰ্ভগৃহ বানানো? শেষ পর্যন্ত তো আবর্জনা জড়ো করার জায়গা!
সেটাও এক ধরনের ইউটিলিটি। মিতিন হাসল সামান্য। সন্দীপনকে জিজ্ঞেস করল, নীচে কি একদমই আসা হয় না?
বেসমেন্টের দরজা বন্ধ করছিল সন্দীপন। তালাটা টেনে পরখ করে নিয়ে বলল, খুব কম। একেবারেই খোলাখুলি না করলে চামচিকে-টামচিকে বাসা বাঁধবে, তাই মাসে এক-আধবার…।
চাবি কি আপনার জিন্মাতেই থাকে?
কাকাবাবু আসার আগে কাছেই রাখতাম। এখন উপরেই থাকে, দরকারমতো নিয়ে খুলি।
আপনারা তো আগে এ বাড়িতেই বাস করতেন?
হ্যাঁ, আগে সব্বাই ছিলাম। বছর কুড়ি আগে বাবা ডায়মন্ডহারবার রোডে নিজস্ব বাড়ি বানালেন। তখনই আমি, মা আর দিদি সেখানে চলে যাই। বাবা ওখানেও থাকতেন, এখানেও থাকতেন। আমি অবশ্য এ বাড়ির দায়িত্ব নেওয়ার পর টানা এখানেই থেকেছি।
শুনলাম আপনার একটা টিউটোরিয়ালও আছে? কী পড়ান?
কমার্স। এম কম পাশ করেও চাকরিবারি জুটল না। তিন বন্ধু মিলে তাই কোচিং ক্লাসটা খুলেছি। বাড়ির কাছেই। তিনখানা ঘর ভাড়া নিয়ে।
কদ্দিন?
বছর দুয়েক।
কখন চলে কোচিং?
দুপুর থেকে সন্ধে আটটা।
আপনার আর দুই বন্ধুও কি নুরপুরের?
একজন আমতলার। অন্যজন থাকে ডায়মন্ডহারবারে। কলেজে আমরা একসঙ্গে পড়তাম। চাকরি না পেয়ে আমাদের এমন জেদ চেপে গেল…!
কাজের কাজ করেছেন। আচ্ছা সন্দীপনবাবু, অনঙ্গমোহন চক্রবর্তী মানুষটি কেমন?
একটু সময় নিয়ে সন্দীপন বলল, ভালই তো! দোষের মধ্যে দোষ, একটু বানিয়ে-বানিয়ে গল্প করতে ভালবাসেন। আর একটু নেশাটেশা করেন। তবে লোক খারাপ বলা যাবে না।
কিন্তু উনিই তো অশান্তির মূল? গুপ্তধনের গুজবটা তো উনিই ছড়িয়েছেন?
ওটা পাকেচক্রে ঘটে গিয়েছে। ঠাকুরমশাইয়ের মুখে গুপ্তধনের গল্প তো আমরা ছেলেবেলা থেকেই শুনছি। হাসাহাসি করতাম সকলেই।
কিন্তু এরকম রটিয়ে উনি কী সুখ পান?
কী জানি। আসলে একজন বিফল মানুষ তো, জীবনে কিছুই করে উঠতে পারেননি। পুরুতগিরি করে ক পয়সাই বা আসে? একটা চাকরি জোগাড় করেছিলেন কোনওরকমে, পিয়নের। কারওর কাছ থেকেই তেমন শ্ৰদ্ধাসম্মান পাননি কখনও। তিন ছেলের একটাও মানুষ হয়নি। তারা সব এখন উঞ্ছবৃত্তি করে বেড়ায়। বড়টা তো চিটিংবাজির কেসে একবার হাজতবাসও করে এসেছে। বেচারা ঠাকুরমশাইকে রিটায়ারমেন্টের পর, সংসার প্রতিপালনের জন্য এখন জমি-বাড়ির দালালি করতে হয়। তাই হয়তো দুর্ভাগা লোকটা নিজেকে একটু ওজনদার প্রতিপন্ন করতে ওইসব গল্প এখনও চালিয়ে যান। তা বলে গুপ্তধনের খোঁজে কেউ যে সত্যিসত্যি শাবল-গাঁইতি নিয়ে হাজির হবে, এতটা বোধ হয় উনিও ভাবেননি।
ঠাকুরমশাই কিন্তু আমাদের আর-একটা কথাও বলেছেন আজ।
কী?
এ বাড়ির নীচে শুধু গুপ্তধন নয়, অনেক পাপও নাকি জমে আছে?
পাপ? সন্দীপন ক্ষণিক নিশ্চুপ। তারপর বিড়বিড় করে বলল, এটা তো নতুন শুনছি। কিন্তু এ বাড়িতে পাপ জমা হবে কোত্থেকে? আমি যতটুকু জানি, কাকাবাবুর পূর্বপুরুষরা কেউই তো তেমন খারাপ লোক ছিলেন না। হয়তো সেভাবে কেউ রোজগারপাতি করেননি। বংশের পয়সায় বসে-বসে খেয়েছেন। উত্তর কলকাতায় তো অনেক বাড়ি ছিল, একে-একে প্রায় সবই গিয়েছে। সেও তো ওই আলস্যের কারণে। কিন্তু কারও উপর এঁরা অত্যাচার করেছেন, কিংবা কাউকে ঠকিয়ে তার সম্পত্তি গ্রাস করেছেন, এমন অভিযোগ কস্মিনকালেও শুনিনি। ঠাকুরমশাইকে জিজ্ঞেস করলেন না কেন, কী পাপ? কে করেছে?
হু, প্রশ্নটা করা হয়নি। আচ্ছা, অনঙ্গবাবুরা কি এ বাড়িতে থাকতেন কখনও?
ভুজঙ্গমোহন নাকি অল্প কিছুদিন ছিলেন। তারপর কাকাবাবুর ঠাকুরদার বাবা তাকে খানিকটা জমি কিনে দেন, সেখানেই বাড়িঘর বানিয়ে…।
টুপুর বলল, সে কী? ঠাকুরমশাই যে বললেন এখানে আড়াইশো বছর ধরে আছেন? ওঁদের নাকি বিশাল অবস্থা ছিল…?
তুমি বুঝি বিশ্বাস করেছ? সন্দীপন হেসে ফেলল, ওটা নিয়েও তো ঠাকুরমশাইয়ের গল্প আছে। গঙ্গা নাকি ওঁদের প্রাসাদের মত অট্টালিকাটি গ্রাস করে নিয়েছে…!
রং চড়ানোটা বোধ হয় ওঁর নেশা। মিতিন না হেসেই বলল, আর-একটা কথাও আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে সন্দীপনবাবু। গুপ্তধনের গল্প তো আপনার শৈশব থেকেই শোনা। তারপর বেশ কিছুদিন এ বাড়িতে একাই ছিলেন। তখনও কি কখনও রটনাটা সত্যি কি না যাচাই করার কৌতূহল আপনার জাগেনি?
ওই খুঁড়েটুড়ে দেখা? সন্দীপন এবার বেশ শব্দ করেই হেসে উঠল। পরক্ষণেই মুখখানা গ্রাম্ভারি করে বলল, দেখুন ম্যাডাম, আমার বাবা একটা কথা প্রায়ই বলেন। আমরা নাকি গুপ্তধনের চেয়েও অনেক বেশি কিছু পেয়ে গিয়েছি। কাকাবাবুর বাবা প্রায় রাস্তা থেকে তুলে এনে আমার ঠাকুরদাকে এ বাড়িতে ঠাঁই দেন। তারপর আর কোনও দিন আমাদের অন্নবস্ত্রের চিন্তা করতে হয়নি। দিদির বিয়ে, আমার পড়াশোনা…এমনকী, বাবা যে বাড়িটা বানিয়েছেন, তার পিছনেও কি কাকাবাবুদের অর্থসাহায্য কম ছিল? এ বাড়িতে মাটির উপরেই যখন এত পেয়ে গিয়েছি, মাটির তলায় আর কেন ঘড়া-ঘড়া মোহর খুঁজতে যাব বলুন?
প্ৰশ্নোত্তরের মাঝেই মীনধ্বজ বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। উদগ্রীব মুখে জিজ্ঞেস করলেন, কী ম্যাডাম, পরিদর্শন কমপ্লিট?
মিতিন হাসল, হল এক রাউন্ড।
কিছু হদিশ পেলেন?
এত তাড়াতাড়ি? মিতিনের হাসি চওড়া হল, আমি কি ম্যাজিক জানি?
.
০৬.
এবার আর পার্থ নয়, স্টিয়ারিংয়ে মিতিন। যাওয়ার সময় গাড়ি চালিয়ে যা পরিশ্রম হয়েছিল, ফেরার পথে ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে তার ডবল উশুল করে নিল পার্থ। গোটা রাস্তা মিতিনও স্পিকটি নট। কোনও তদন্ত শুরু করলে এটাই মিতিনের দস্তুর। টুপুরেরও মুখে কুলুপ। এখনও তার চোখে ভাসছে অপরূপ এক নদী, এক নয়নাভিরাম সূর্যাস্ত, নদীতে ছড়িয়েছিটিয়ে ভেসে থাকা নৌকো, ওপারের ছায়াছায়া গাছপালা, বাড়িঘর… গঙ্গা রূপনারায়ণের সঙ্গমটাও দেখা হল। দামোদরটাই যা বাকি রয়ে গেল, ইস!
বাড়িতে ঢুকেই অবশ্য নীরবতার ইতি। বুমবুম কেন এখনও খাওয়া না সেরে কম্পিউটারে, তাই নিয়ে বকাবকি জুড়ল মিতিন। টুপুর টুক করে টিভিতে একটা রিয়েলিটি শো দেখতে বসে গেল। ঢাউস এক কাপ চা খেয়ে পার্থও দিব্যি টগবগে। মিতিনের উদ্দেশে টিপ্পনী ভাসিয়ে দিল, তোমার ভেল্টুদাদা তোমাকে কিন্তু একটা ফালতু কেসে ফাঁসিয়ে দিলেন।
আরতি টেবিলে খাবারদাবার রেখে চলে যাচ্ছে। দরজাটা বন্ধ করে এসে বুমবুমকে আহারে বসাল মিতিন। আলগোছে পার্থকে বলল, কেন, কেসটার কি মেরিট নেই?
একেবারেই না। পাৰ্থ চেয়ার টেনে গুছিয়ে বসল। হাতের ইশারায় ডাকল টুপুরকে। টেবিলে আরও তিনখানা প্লেট সাজিয়ে টুপুরকেই সাক্ষী মানল, তুইই বল, তোর মাসি এমন একটা জিনিস খুঁজতে গিয়েছে, যেটা আছে কি না সে সম্পর্কেই কেউ নিশ্চিত নয়। কস্মিনকালে তার অস্তিত্ব ছিল কি না তাও কেউ জানে না। শুধুমাত্র এক গুলবাজ বুড়ো ছাড়া।
প্রিয় অনুষ্ঠান ছেড়ে উঠতে হয়েছে বলে টুপুর যেন খানিক আনমনা! ঢক করে ঘাড় নেড়ে বলল, তা অবশ্য ঠিক।
ক্যাসারোল খুলে প্লেটে রুটি নিল পাৰ্থ। টুপুরকেও দিল। হাতায় মাটনকারি তুলতে-তুলতে বলল, তারপর ধর, এমন একটা ক্রাইম হয়েছে, যা অপরাধ পদবাচ্যই নয়। দুটো বুদ্ধু খামোখা মাটি খুঁড়ে পুলিশের রুলের গুঁতো খেয়েছে। ঠিক, কি না?
টুপুর স্যালাড টানল, সেরকমই দাঁড়াচ্ছে বটে!
বেজায় উৎসাহ পেল পার্থ। মুখে আরও বিজ্ঞ ভাব ফুটিয়ে বলল, তারপর দ্যাখ, বাড়িতে এমনই ভৌতিক ঘটনা ঘটছে, যাতে কেউই তেমন ভীত নয়।
হুঁ। টুপুর রুটি ছিঁড়ল, মীনধ্বজবাবুকে তো মোটেই আতঙ্কিত দেখাল না।
ওই মীনধ্বজ মর্মরবক্ষ বাগচী একটি ট্যাবলেট, বুঝলি? যখনই দেখেছি গেটে দরোয়ান নেই, তখনই বুঝেছি, ইনি একটি হাড়কেপ্পন। এত দূর গেলাম, অতক্ষণ রইলাম…স্টমাকে কী জুটল বল? নাম মীনধ্বজ, অথচ কটা ফিশফ্ৰাইও খাওয়াতে পারলেন না।
টুপুর হেসে বলল, বুঝেছি, তুমি খুব ক্ষুধার্ত। তাড়াতাড়ি হাত চালাও।
উঁহু, খিদেটা বড় কথা নয়। এটা আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। অমন লম্বাচওড়া একটি নাম বয়ে বেড়াচ্ছেন, থাকেন পেল্লাই এক প্রাসাদে…শোনালেন রাজশাহির জমিদার ছিলেন। অথচ বুকের খাঁচাটা এইটুকু। আঙুলের মুদ্রায় মীনধ্বজের হৃদয়ের মাপখানা দেখাল পার্থ। রুটির টুকরো ঝোলে ড়ুবিয়ে বলল, খুব তো তোর মাসিকে বারফট্টাই দেখালেন, এনি অ্যামাউন্ট দিতে পারেন। কিন্তু একটা পয়সাও তো অ্যাডভান্স ঠেকালেন না।
আহা, মাসিও তো বলল, আজ কিছু লাগবে না।
অমনি উনি হাত গুটিয়ে নেবেন? এ কী ধরনের ভদ্রতা? পার্থ আবার মিতিনকে খোঁচাল, তোর মাসিটাও হয়েছে সেরকম! যা আসছে, ঝটাকসে ব্যাগে পুরে ফ্যালো…। তা নয়, উনি ভবিষ্যতের আশায় তাকিয়ে আছেন। আরে বাবা, পরে তো লবডঙ্কা জুটবে!
কেন?
কারণ, কেসটায় কিসসু নেই। নো রহস্য, নো ক্রাইম, না কোনও অলৌকিক কাণ্ডকারখানা। সারমর্ম বুঝে গেলে মীনধ্বজ মৰ্মরবক্ষ তোর মাসিকে টা টা করে দেবে। এবং তার মাসির ভেল্টুদা আড়ালে তখন খ্যাকখ্যাক হাসবে।
পর্বতাকৃতি অনিশ্চয় মজুমদারের ভেল্টু নামটা শুনলেই টুপুরের পেট গুলিয়ে হাসি আসছে। এখনও কোনওক্রমে হাসিটা চেপে জুলজুল চোখে মিতিনমাসিকে দেখল টুপুর। আশ্চর্য, কোনও প্রতিক্রিয়াই নেই? এত শ্লেষ-বিদ্রুপের পরেও? একমনে রুটি-মাংস খাচ্ছে আর মাঝেমধ্যে বাঁ হাতের চাপড়ে তাড়া লাগাচ্ছে বুমবুমকে।
অগত্যা, টুপুরকেই হাল ধরতে হয়। ভুরুতে একটা ভাঁজ এনে টুপুর বলল, আমার কিন্তু ব্যাপারটা একদম সিধেসাদা লাগছে না মেসো। কেমন একটা আঁশটে গন্ধ পাচ্ছি।
ওটা তোর ঘ্রাণশক্তির দোষ। মাসির সঙ্গে থেকে-থেকে হয়েছে।
উঁহু। ঠাকুরমশাই মানুষটি ধরো পঞ্চাশ বছর ধরেই এক গল্প করছেন। কিন্তু মীনধ্বজবাবু পাকাপাকিভাবে ফিরে আসার পরই গুপ্তধনের সন্ধানে কেউ হানা দিল। এটা কি খুব স্বাভাবিক?
স্রেফ কাকতালীয়।
আর অনঙ্গমোহনবাবুর আড়িপাতাটা?
ওটা অনেকের নেচার থাকে। কেউ কথা বললে লুকিয়েলুকিয়ে শোনার।
অনঙ্গমোহনবাবু সম্পর্কে আর-একটু কিন্তু ভাবার আছে। করুণা একদমই অনঙ্গমোহনকে পছন্দ করে না। মীনধ্বজবাবুও বাড়ির ঠাকুরমশাইটির উপর প্রীত নন। লক্ষ করছিলে, মাসি যেই অনঙ্গমোহনবাবুর কথা তুলল, অমনি মীনধ্বজবাবুর চোয়াল পলকের জন্য হলেও কেমন কঠিন হয়ে গেল?
আমি অত খেয়াল করিনি। বলেই পার্থ পালটা তৰ্ক জুড়ল, অবশ্য অনঙ্গমোহনের মতো একটি চিড়িয়াকে পছন্দ করারও তো কোনও কারণ দেখি না। এক সন্দীপন ছাড়া সকলেই ওঁর নিন্দামন্দই করবে।
তাই?
ইয়েস। সন্দীপন ছেলেটার মনটা ভাল বলে, যথাসম্ভব রেখেঢেকে কমেন্ট করছিল।
আমি শুধু অনঙ্গমোহনবাবুর কথাই বলছি না। টুপুর তাড়াতাড়ি বলল, করুণাই বা জানল কী করে, মাসি ডিটেকটিভ? সেও নিশ্চয়ই আড়ি পাতে। তারপর..আমরা যেটা প্রায় ধরছিই না…দ্বিতীয় আর-একদিন চোর এসেছিল। কী উদ্দেশ্যে?
সেম ধান্দা। কাল্পনিক গুপ্তধন।
কিন্তু তারা তো খোঁড়াখুঁড়ি করেনি? জায়গাটা তো প্রথম ঘটনার পরেই মাটি ফেলে দুরমুশ করে দেওয়া হয়েছে। এবং এখনও ইনট্যাক্টই আছে জায়গাটা?
দ্বিতীয়বার গাঁইতি মারার সুযোগই তো পায়নি। মীনধ্বজবাবু এমন হল্লা জুড়েছিলেন…!
আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না, গুপ্তধনের জন্য প্রথমবার খোঁজাখুঁড়ির পর করুণা তো স্পটটা জেনেই গেল! তারপর হয়তো সেকেন্ড টাইম ও কাউকে পাঠিয়েছিল? হয়তো ওর বর, সঙ্গে আর কেউ…? পাছে তার ওই ষড়যন্ত্র মিতিনমাসি ধরে ফেলে, কথা বলার সময় তাই অত আড়ষ্ট ছিল?
ওটা অবশ্য তুই জানিস। করুণাকে জেরার সময় আমি তো ছিলাম না। তবে, করুণার বর যদি খুঁড়তে এসেও থাকে, তা হলেও কি গুপ্তধন আছে প্রমাণ হয়?
যাই বলো, মীনধ্বজবাবুরই কিন্তু জায়গাটা খুঁড়ে দেখা উচিত এখন।
উচিত তো বটেই। আমি হলে তো ডিটেকটিভ না ডেকে নিজে আগে দেখতাম।
সন্দীপনই বা দেখল না কেন?
এটাই তো প্রমাণ করে, গুপ্তধনের ব্যাপারটাই ফক্কিকারি। নইলে সন্দীপন যতই ডায়ালগ ঝাড়ুক, ট্রাই একটা নিতই। মীনধ্বজবাবুরা উপকার করেছেন বলে কি সন্দীপনের লোভলালসা সব উবে গিয়েছে? মুখে বললেই মানতে হবে? মীনধ্বজবাবুরই তো গুপ্তধন থাকতে পারে এই আশায় চোখ চকচক করছিল!
আমার আর-একটা কথাও মনে হচ্ছে, বুঝলে মেসো। গুপ্তধনের গুজবটার সূত্র ধরে, একটা হাঙ্গাম-হুজ্জোত বাধিয়ে এবং তার সঙ্গে ভৌতিক ব্যাপারট্যাপার জড়িয়ে কেউ হয়তো মীনধ্বজবাবুর উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে!
কেন?
মীনধ্বজবাবুকে উৎখাত করার জন্যে।
বুমবুমের খাওয়া শেষ। চেয়ার থেকে লাফিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘুরে বলল, উৎখাত মানে কী?
উৎখাত হল গিয়ে…। পাৰ্থ নাক কুঁচকে বলল, ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাউকে স্থানান্তরীকরণ।
বুমবুম চোখ পিটপিট করল, বাংলায় বলো না।
বেশ, সরলভাবে বোঝাচ্ছি। ধর, তুই কম্পিউটারে গেম খেলছিস। তোর টুপুরদিদি গিয়ে তোকে ঘেঁটি ধরে তুলে দিল…এটাকেই বলে উৎখাত। ক্লিয়ার?
বুমবুম মাথা দোলাতে-দোলাতে চলে গেল বেসিনের দিকে।
পার্থ আবার প্রসঙ্গে ফিরল। টুপুরকে বলল, উৎখাত কেন করবে শুনি?
বাড়িটার দখল পাওয়ার জন্যে। কিংবা উনি যাতে বিরক্ত হয়ে বাড়িটা বেচে দিয়ে চলে যান? অনঙ্গমোহন তো জমিবাড়ির দালালি করেন, তাঁরই ইন্টারেস্ট থাকতে পারে। হয়তো কেনার লোক আছে, বিক্রি হলে অনঙ্গমোহন মোটা কমিশন পাবেন।
পাৰ্থ চোখ বুজে ভাবল একটুক্ষণ। তারপর দুদিকে ঘাড় নাড়ল, না রে, গুপ্তধনের গপ্পো রটিয়ে কাউকে বাড়ি থেকে ভাগানো যায় না। একমাত্র ভূতের ভয়টাই…! তবে সেটাও তো তেমন কাজের নয়। আই মিন, ওতে মীনধ্বজবাবু চট করে ঘায়েল হবেন না। প্লাস, অঙ্কের টিচার তো, তেমন জুতসই ভুতুড়ে ছাত্র পেলে অঙ্ক কষানো আরম্ভ করবেন।
টুপুরের খেই হারিয়ে গেল, আর তো কোনও পয়েন্ট মাথায় আসছে না মেসো। করুণা, অনঙ্গমোহন, সন্দীপন, যাকেই সন্দেহ করি না কেন, একটা লাগসই মোটিভ তো চাই।
পাবি না। পাৰ্থ খিকখিক হাসল, বললাম তো, কেসটা পুরো ফাঁপা। তোর মাসিকে লাট খাইয়ে ভেল্টুবাবু এবার ড্যাং-ড্যাং কাঁসর বাজাবেন।
মিতিন একভাবে খেয়ে যাচ্ছে। একটিবার ঘাড় তোলারও নাম নেই। টুপুর করুণ মুখে বলল, ও মাসি, কিছু একটা বলো না।
বহুক্ষণ পর মিতিনের সুর ভেসে উঠল, দাঁড়া, আগে তোর মেসোর বোলচাল খতম হোক।
বেশ, আমি চুপ করলাম। পাৰ্থ যেন উসকাল, এবার তুমি চালু হও।
না, তেমন বলার কিছু নেই। আমি শুধু দু-একটা ব্যাপার ভাবছি।
কীরকম?
খুঁড়ে মাটি মেলে, বোজাতেও মাটি লাগে।
মানে?
মিতিন মুখ তুলল এবার। চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল, পাপ কাকে বলে?
অন্যায় কাজকে। অমানবিক কাজকে।
রাইট। এখন বলো, উচ্চতা কি মিলছে? কিংবা দৈর্ঘ্য?
কীসের?
ক্রমশ প্রকাশ্য। মিতিন গলাখাঁকারি দিল, কাল আমাদের দ্বিতীয় অভিযান। প্রস্তুত হও টুপুর!