বাড়িটা আজ অদ্ভুত রকমের নিঝুম। আগের দিনও যে খুব সাড়াশব্দ ছিল তা নয়, কিন্তু আজ যেন কেমন ছমছম করছে। নাকি টুপুরেরই মনে হল এমনটা? র্যাচেল যোশুয়ার মৃত্যুসংবাদ পেয়েছে বলে? হবেও বা।
গাড়ি থেকে নেমে সিঁড়িতে পা রাখতেই যতীনের মুখোমুখি। মলিন মুখে দাঁড়িয়ে ছিল দরজায়। নীরবে দেখিয়ে দিল দোতলায় ওঠার রাস্তা।
উপরে এসে মিতিন আর টুপুর থমকাল ক্ষণেক। ডান দিকের প্রথম ঘরটায় চার-পাঁচজন মানুষ। প্রত্যেকেই বয়স্ক এবং পোশাক চিনিয়ে দিচ্ছে তাঁরা সকলেই ইহুদি।
সম্ভ্রান্ত চেহারার একজন বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। অতি নিম্ন স্বরে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের তো ঠিক চিনতে পারলাম না?
আমি প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায়। আর এ আমার বোনঝি ঐন্দ্রিলা। আমরা মিস্টার যোশুয়ার ডাক পেয়ে এসেছি।
ও। আপনিই বুঝি ডিটেকটিভ? ডেভিড আমাকে আপনার কথা বলছিল বটে। ভদ্রলোক সামান্য মাথা নোওয়ালেন, অধীনের নাম এফ্রাহিম নাহুম।
আমি আপনাকে চিনি। নিউ মার্কেটের দোকানে অনেকবার দেখেছি।
আমি ধন্য। আবার এ কী মিসহ্যাপ হল বলুন তো? একই পরিবারে এক বছরে তিন তিনজনের মৃত্যু, এফ্রাহিম ব্যথিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন, এখন তো মনে হচ্ছে, ডেভিড যা বলে সেটাই ঠিক। সত্যিই অশুভ কিছু একটা ঘটছে এ বাড়িতে।
হ্যাঁ। ঘটনাটা খুব উদ্বেগজনক।
আমরাও কয়েকজন মিলে সেটাই বলাবলি করছিলাম। কিছুতেই মানতে পারছি না, কাল সন্ধেবেলা যাঁকে সুস্থ হাসিখুশি দেখলাম, রাতেই কিনা শুনতে হল সে আর নেই?
কাল সন্ধেবেলা মিসেস যোশুয়ার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল বুঝি?
হ্যাঁ। শুধু র্যাচেল কেন, আমরা সমস্ত ইহুদিরাই তো মিলিত হয়েছিলাম আমাদের মঘেন ডেভিড সিনাগগে। কাল-পরশু দু’দিনই।
কোনও বিশেষ পরব ছিল বুঝি?
হ্যাঁ। শাভুয়ত। তেত্রিশশো বছর আগে এই দিনই আমরা সিনাই পর্বতে দৈববাণী শুনেছিলাম। এখন তো কলকাতায় আমাদের কোনও পুরোহিত নেই, সমাজের মাথা হিসেবে আমাকেই এই দু’দিন প্রার্থনা পরিচালনা করতে হয়েছে। কাল তো প্রার্থনা শেষ হওয়ার পর র্যাচেলের সঙ্গে আমার দু’ একটা কথাবার্তা হল, তারপর র্যাচেল আর ডেভিড চলে এল বাড়িতে। তারপর রাত বারোটায় হঠাৎ ডেভিডের ফোন। খবরটা শুনে আমি স্তম্ভিত। সারারাত ঘুমোতে পারিনি। ভোর হতে না-হতে ছুটে এসেছি, এফ্রাহিমের গলার স্বর সামান্য দুলে গেল, র্যাচেলকে আমি সেই ছেলেবেলা থেকে চিনি। খুবই ধর্মপ্রাণ ভাল মেয়ে ছিল। ডেভিড আর র্যাচেলের জুড়িটাও ছিল খুব মজবুত। একে অন্যকে চোখে হারাত। এখন যে বেচারা ডেভিডের কী হবে? কী করে যে ওর দিন কাটবে?
মিস্টার যোশুয়া এখন কোথায়?
এই ঘরেই আছে।
আমরা কি ভিতরে যেতে পারি?
সামান্য ইতস্তত করে এফ্রাহিম বললেন, আসুন। তবে অনুগ্রহ করে জুতোটা খুলে…। আর দয়া করে ওখানে কোথাও বসবেন না। আমরা ইহুদিরা এগুলো খুব মানি তো।
মিতিনের পিছু পিছু ঘরে ঢুকে টুপুর দেখল প্রকাণ্ড একটি খাটে শুয়ে আছেন র্যাচেল৷ দেখে বোঝাই যায় না দেহে প্রাণ নেই, যেন ঘুমিয়ে আছেন। পাতলা একটা চাদরে গলা পর্যন্ত ঢাকা। খাটের পাশে একখানা বেঁটে টুলে ডেভিড। খাটের অন্য প্রান্তে আর একটি নিচু আসনে এক প্রবীণা ইহুদি। ঘরের বাকিরা মেঝের কার্পেটে আসীন। র্যাচেলের মাথার দিকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে একটি মোমবাতি। সকালের আবছা আবছা আলোমাখা ঘরে ওই দীপশিখা যেন শোকের আবহকে আরও গভীর করেছে।
খাটের কাছে গিয়ে একদৃষ্টে র্যাচেলের শায়িত দেহখানা দেখছিল মিতিন। ডেভিড যোশুয়া মৃদু স্বরে বললেন, আমি আপনারই প্রতীক্ষা করছিলাম। চলুন, নীচে যাই।
বেরোনোর আগে ঝটিতি একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল টুপুর। ড্রয়িংরুমের মতো না হলেও এ ঘরখানাও বিশাল। দু-দু’খানা জাঁদরেল কাঠের আলমারি, চারখানা চেয়ার সমেত একদিকে গোল টেবিল, চেস্ট অফ ড্রয়ার, পুরনো ওয়ালপেপারে মোড়া দেওয়ালে লোহার সিন্দুক, ডেভিড আর র্যাচেলের যুগল ছবি….। অল্পবয়সি সুন্দরী র্যাচেলের ছবিও আছে একখানা। এক কিশোরের সঙ্গে। সম্ভবত কিশোরটি র্যাচেলের ছেলে। আছে আরও বেশ কয়েকটি পারিবারিক ফোটোগ্রাফ। ঘরের একধারে একটা মানুষপ্রমাণ আয়না। সাদা কাপড়ে ঢাকা। কেন ঢেকেছে? ইহুদিদের নিয়ম কি?
একতলার ড্রয়িংরুমে এসে সোফা নয়, সরাসরি কার্পেটে বসে পড়লেন ডেভিড। আজও তাঁর পরনে কালো কোট। তবে বুকের কাছে ডান দিকটা ছেঁড়া। ইহুদিদের শোকের চিহ্ন। ডেভিডের দেখাদেখি মিতিন আর টুপুরও বসল কার্পেটে।
ডেভিড নরম গলায় বললেন, কিছু মনে করবেন না। শোকের সময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের উচ্চাসনে বসার নিয়ম নেই।
মিতিন বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমাদের একটুও অসুবিধে হচ্ছে না। মিসেস যোশুয়ার মৃত্যুতে আমি মর্মাহত। এই মুহূর্তে আপনাকে সান্ত্বনা জানানোর কোনও ভাষা নেই।
ডেভিড নিশ্চুপ।
মিতিন আবার বলল, আপনার ছেলে নিশ্চয়ই খবর পেয়ে গিয়েছে?
হ্যাঁ। রাতেই তাকে জানিয়েছি। সম্ভবত আজ লন্ডন থেকে ফ্লাইট ধরবে। আশা করছি, কাল পৌঁছে যাবে, বলতে বলতে স্বরটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল ডেভিডের, দেখলেন তো আবার মৃত্যু এসে কেমন হানা দিল এ বাড়িতে?
ঠিক আবার সেই পরবের দিন। যাওয়ার কথা ছিল আমার, ভুলক্রমে র্যাচেল চলে গেল।
মিস্টার নাহুম বলছিলেন, আপনারা কাল সন্ধেবেলা সিনাগগে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। এফ্রাহিমই তো টেন কম্যান্ডমেন্টস পাঠ করল। তারপর বাড়ি ফিরে বেশ আমোদ-আহ্লাদ হচ্ছিল। গানবাজনা, হাসি-রঙ্গ। তারপর কী যে হয়ে গেল!
কে কে এসেছিল কাল?
যারা সাধারণত আসেন। আমাদের বন্ধুরা। ইহুদি সমাজের ছিল মাত্র দু’জন। বেঞ্জামিন আর সারা। আপনারা তো সারাকে দেখলেন। উপরে আমার স্ত্রীর পাশে বসে আছেন।
উনি বুঝি আপনার মিসেসের খুব বন্ধু ছিলেন?
হ্যাঁ। ওরা দুজনে মিলেই তো খাবার টাবার সার্ভ করছিল। তখনও র্যাচেল রীতিমতো হেইল অ্যান্ড হার্টি।
অসুস্থ হলেন কখন?
শরীর খারাপ তো দেখিনি। অন্তত আমার নজরে পড়েনি।
তা হলে কী করে মারা গেলেন? কখন মারা গেলেন?
সময় সঠিক বলতে পারব না। সম্ভবত তখন এগারোটা বাজে। কাল তো খুব গরম ছিল, সকলকে বিদায় জানিয়ে আমি একটু বাইরেটায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ যতীন এসে বলল, ম্যাডামের গতিক ভাল ঠেকছে না, আপনি এক্ষুনি একবার উপরে যান। দোতলায় উঠে দেখি র্যাচেল যেন কেমন অদ্ভুত ভাবে বসে আছে চেয়ারে। মুখ ঝুঁকে পড়েছে টেবিলে। দু’হাত ঝুলছে দু’দিকে। ভীষণ ভয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করলাম। সে বেচারা তখনও বাড়ি পৌঁছোয়নি, কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্যাক করে এল। র্যাচেলের নাড়ি দেখেই বলল সব শেষ।
তক্ষুনি আমাকে ফোন করলেন না কেন?
আমার মাথা কাজ করছিল না ম্যাডাম। তা ছাড়া আমাদের ইহুদিদের অনেক নিয়মকানুন আছে। নিজেদের সমাজের লোকজনদের খবর দিতে হয়, পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের ব্যবস্থার জন্য জানাতে হয়। প্রথমে সারা বেঞ্জামিনকে ফোন করেছিলাম, তারপর একে একে… মৃতদেহ তো একা ছাড়ার নিয়ম নেই, তাই রাতভর আমরা ওখানেই আছি।
ডাক্তারবাবু কি ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে গিয়েছেন?
না। বললে হয়তো লিখে দিত। আমি নিইনি, ডেভিড একটু চুপ থেকে বললেন, তখনই ডাক্তারকে বলে দিয়েছি এবার আমি কারও আপত্তি শুনব না। র্যাচেলের বডির পোস্টমর্টেম আমি করাবই। ওর মৃত্যুর সঠিক কারণ আমি জানতে চাই। ডাক্তারও বলল, রাত্তিরটা ভাবুন। যদি সিদ্ধান্ত বদলান, তো সকালে এসে সার্টিফিকেট দিয়ে যাব। নইলে পোস্টমর্টেমের জন্য রেফার করব।
ও। তা এখন কী ভাবছেন?
আমি সিদ্ধান্তে অটল। ডাক্তারও এক্ষুনি এসে পড়বে। তারপর পুলিশকে…, ডেভিডের গলাটা করুণ হয়ে গেল, ম্যাডাম, আপনার তো অনেক চেনাজানা, দেখুন না যদি বলে-কয়ে আজকের মধ্যে পোস্টমর্টেমটা করিয়ে দিতে পারেন, তা হলে বড় উপকার হয়।
কালই কবর দিতে চান, তাই তো?
না। আগামী কাল শনিবার। স্যাবাথ। ওই দিন আমাদের কবর দিতে নেই। আগামী কালটা র্যাচেল পিস হ্যাভেনের বরফের বিছানায় ঘুমোক। আশা করছি, তার মধ্যেই সাইমনও পৌঁছে যাবে। তারপর রোববারই…। আমি সেভাবেই সব কিছু রেডি করতে বলেছি নাথানকে।
কে নাথান?
যে আমাদের কবর দেওয়ার ব্যাপার স্যাপারগুলো দেখভাল করে। খুব ভাল ছেলে। এই তো, খবর পেয়ে সকালেই এসেছিল…।
কথার মাঝেই দরজায় এক গাঁট্টাগোট্টা মাঝবয়সি। এক হাতে ব্রিফকেস, অন্য হাতে হেলমেট। মিতিনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সসম্ভ্রমে বললেন, আপনিই তো সেই বিখ্যাত মহিলা ডিটেকটিভ?
মিতিনের ঠোঁটে সৌজন্যের হাসি, আপনি আমায় চেনেন?
টিভিতে দেখেছি। অপরাধীদের মানসিকতা নিয়ে আপনি একটা টক শো-তে ছিলেন। আমি তো নানা ধরনের রোগী চরিয়ে খাই। তার মধ্যে খুনি-বদমাশও থাকে। আপনার বক্তব্যটা শুনতে তাই বেশ লাগছিল।
ও। আপনিই তা হলে মিস্টার যোশুয়াদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান?
ওই পরিচয়টা এখন গৌণ হয়ে গিয়েছে। হেলমেট পাশে রেখে ডাক্তারবাবু বসে পড়েছেন কার্পেটে, আমি রণেন সামন্ত। এঁদের পরিবারেরই একজন। তাই না ডেভিড?
বটেই তো। বন্ধুও বটে। ছোট ভাইও বটে। তুমি পাশে পাশে থাকো বলে কত ভরসা পেতাম। কিন্তু তুমি এবারও শেষরক্ষা করতে পারলে না।
আমার কপাল ডেভিড। কেন যে সুস্থ লোকগুলো এভাবে চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়! রণেন সামন্তর মুখ ম্রিয়মাণ। অনুচ্চ স্বরে বললেন, কী ঠিক করলেন? পোস্টমর্টেমই তো?
সেটাই তো উচিত। মনে যখন খটকা আছে, মীমাংসা একটা হয়ে যাওয়াই ভাল।
পাশে রাখা ব্রিফকেসখানা খুললেন রণেন। ডেভিডের ইচ্ছেমাফিক খসখস কলম চালাচ্ছেন। মিতিন একটু দূরে উঠে গিয়ে ফোন করল অনিশ্চয় মজুমদারকে। সংক্ষেপে জানাল ঘটনাটা এবং ময়নাতদন্তের জরুরি প্রয়োজনটুকুও। ফিরে এসে ডেভিডকে বলল, চিন্তা করবেন না। আধঘণ্টার মধ্যে পুলিশ এসে যাবে।
থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। যদি ময়নাতদন্তে কিছু পাওয়া যায়…। আমি নিশ্চিত কিছু একটা পাওয়া যাবেই। আপনি কেসটার তদন্ত করবেন তো?
আমি আপনার পাশে আছি মিস্টার যোশুয়া, শোকার্ত বৃদ্ধকে আশ্বস্ত করে রণেনের দিকে ফিরল মিতিন, আপনাকে কি একটা-দুটো প্রশ্ন করতে পারি ডক্টর সামন্ত?
শিয়োর। ডেভিডের পরিবারের স্বার্থে আপনি আমায় হাজারটা কোয়েশ্চেন করতে পারেন।
কাল রাত্তিরে আপনি যখন ফিরে এলেন, তার কতক্ষণ আগে মিসেস যোশুয়া মারা গিয়েছেন বলে আপনার ধারণা?
লেখা শেষ করে কাগজখানা প্যাড থেকে ছিঁড়ছিলেন রণেন। একটা ভাঁজ করে ডেভিডকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার ডাক্তারি জ্ঞান বলছে বড়জোর মিনিট পনেরো-কুড়ি। কারণ, তখনও ম্যাডামের বডি ওয়াজ নট দ্যাট কোল্ড।
তা হলে মিসেস যোশুয়ার মৃত্যুর সময়টা কীরকম দাঁড়াচ্ছে?
ডেভিডের ডাক পেয়ে আমি এ বাড়ি এসেছিলাম এগারোটা পাঁচে। অতএব ম্যাডামের ডেথটা কোনও ভাবেই দশটা পঞ্চাশের আগে নয়।
আচ্ছা, মিস্টার আব্রাহাম, মিসেস আব্রাহাম এবং মিসেস যোশুয়া, তিনটে মৃতদেহই তো আপনি দেখেছেন? তিনটে মৃত্যুই কি অবিকল একরকম বলে আপনার মনে হয়েছে?
হ্যাঁ। মোটামুটি সিমিলার। তিনজনেরই আকস্মিক ভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু।
ব্যাপারটা কি খুব স্বাভাবিক?
অস্বাভাবিকই বা বলি কী করে। তেমন কোনও প্রমাণ তো পাইনি। তবে…।
কী তবে?
কিছু কিছু আনন্যাচারাল ডেথেও হার্ট অ্যাটাকই ঘটে। কিন্তু আদতে সেটা খুন।
যেমন?
যেমন ধরুন যদি ব্লাডে এয়ার বাবল ইনজেক্ট করে দেওয়া হয়। তারপর ধরুন, এমন কিছু বিষ আছে যা অতি সূক্ষ্ম পরিমাণে রক্তে মিশলে হার্ট চিরতরে থেমে যাবে। পোস্টমর্টেমে তা ধরা পড়া কঠিন। অনেক সময়ে ভিসেরা পরীক্ষাতেও তা পাওয়া যায় না।
কী বিষ?
আছে নানান রকম। আফ্রিকানরা গাছগাছালি থেকে তৈরি করে। তিরের ফলায় মাখানোর জন্য। ওই তির সামান্য ক্ষত তৈরি করলেও মৃত্যু এবং সেই মৃত্যু সিম্পল হার্ট অ্যাটাকই দেখাবে।
হুম, মিতিন কী যেন ভেবে নিয়ে ডেভিডকে বলল, মিস্টার যোশুয়া, আপনি যে ভয় দেখানো কলগুলো পেয়েছিলেন, সেই নম্বর তিনটে আমায় দিতে পারেন?
এক্ষুনি? আমাকে তো উপরে গিয়ে নোটবুক দেখে…
নো প্রবলেম। আমায় ফোনে জানিয়ে দেবেন। মিতিন ব্যাগ খুলে নিজের কার্ডটা বাড়িয়ে দিল, এখানে ল্যান্ডলাইন ছাড়া আমার মোবাইল নম্বরও আছে। আমরা তবে আপাতত চলি?
ডেভিড আর রণেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের গাড়ি পর্যন্তও পৌঁছোয়নি মাসি-বোনঝি, পুলিশের গাড়ি এসে হাজির। লাফিয়ে নামলেন এক অফিসার, দুই কনস্টেবলকে নিয়ে তিনি ঢুকে পড়লেন বাড়ির অন্দরে।
মিতিন স্টার্ট দিল গাড়িতে। গেটের মুখে থামতে হল। প্রবেশ করছে আর একখানা প্রাইভেট কার। পিছনের সিটে এক বয়স্ক অবাঙালি ভদ্রলোক। ফরসা গোলগাল মুখ, মাথাজোড়া টাক, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি।
মিতিন ফিসফিস করে বলল, সম্ভবত শ্যামচাঁদ অগ্রবাল।
দাঁড়িয়ে গেলে হত না? টুপুরের চোখ চকচক, ভদ্রলোককে একটু বাজিয়ে দেখতে।
এক্ষুনি কী দরকার। দেখা তো হবেই। আজ নয়তো কাল, গাড়িটাকে কাটিয়ে বেরিয়ে এল মিতিন। ঈষৎ আনমনা মুখে বলল, কিছু পুরনো কেস মনে পড়ছে, বুঝলি।
কীরকম?
বছর কুড়ি আগে ভাগলপুরে এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসীর আবির্ভাব হয়েছিল। ওখানে রইস বাঙালি পরিবারগুলোয় গুরু সেজে বসেছিল সাধুটা। তখনই বেশ কয়েকটি পরিবারের কর্তার আকস্মিক মৃত্যু হয়। সাধুটাই কিছু একটা করছে ভেবেছিল পুলিশ। কিন্তু ধরতে পারেনি। পরে দেখা গিয়েছিল, ওই পরিবারগুলোর অনেক ধনরত্নই ওই সাধুবাবার মতো নিপাত্তা। বছর চারেক আগে গোয়াতেও সিমিলার ইন্সিডেন্ট ঘটেছিল। তিন-চারটে পর্তুগিজ পরিবারে পরপর কয়েকটা মৃত্যু। সেখানেও একজন সাসপেক্ট ছিল, ধরা পড়েনি।
সেই সাধু কি এবার কলকাতায় হানা দিয়েছে? অস্বাভাবিক মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে চালাচ্ছে?
মিতিন জবাব দিল না। আদৌ টুপুরের প্রশ্নটা শুনল কি? বুঝতে পারল না টুপুর।
.
০৬.
জ্যৈষ্ঠ মাসের বিকেল এখনও ফুরোয়নি। নারকেলডাঙার ইহুদিদের কবরখানা থেকে ফিরছিল টুপুররা। দুপুর আড়াইটে নাগাদ মেগন ডেভিড সিনাগগ ঘুরিয়ে গোরস্থানে আনা হয়েছিল সাদামাটা কাঠের কফিনে ভরা র্যাচেলের দেহ। একটু আগে প্রার্থনা টার্থনা সেরে তাঁকে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। ছোট্ট একটা জমায়েত মতো হয়েছিল, চলে গিয়েছেন সকলে। শুধু টুপুররাই রইল আরও খানিকক্ষণ। ঘুরে ঘুরে দেখছিল ভিতরটা। ঝোপঝাড় জঙ্গল মতো হয়ে গিয়েছে, তারই মাঝে মাঝে কত অজস্র কবর। কোনওটার উপরে উঁচু উঁচু সৌধ, আবার কোনওটায় বা ছোট ছোট ফলক। প্রতিটি সমাধিতেই দুর্বোধ্য হিব্রু ভাষায় কিছু লেখা। তার নীচে ইংরেজিতে নাম-ধাম-জন্ম-মৃত্যুর তারিখ। নামগুলো দেখতে দেখতে, পড়তে পড়তে মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়, পুরনো কলকাতার একটা ছবি ভেসে ওঠে চোখের পরদায়। পার্থ তো দিব্যি গল্প জুড়ে দিয়েছিল গোরস্থানের পাহারাদারটির সঙ্গে। মিতিন না তাড়া লাগালে তাকে হয়তো সন্ধের আগে বেরই করা যেত না।
আজ স্টিয়ারিং-এ পার্থ। শিয়ালদহ ফ্লাইওভার পেরিয়ে আলগা প্রশ্ন ছুড়ল, এখন কি সোজা গৃহে প্রত্যাবর্তন?
পিছনের সিট থেকে মিতিন বলল, উঁহু। একবার মার্কুইস স্ট্রিটে যাব।
কী হবে গিয়ে? শোকের বাড়ি… ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনিরা ভিড় করে আছে।
তা হোক। অনেকেই থাকবে… সম্ভব হলে আজই একটু কথাবার্তা বলব।
প্রয়োজন আছে কোনও? পোস্টমর্টেমে তো কিছুই মেলেনি।
সত্যিই তাই। এবারও ময়নাতদন্তে কোনও অস্বাভাবিকতা পাওয়া যায়নি। সাধারণ হার্ট অ্যাটাক বলেই রায় দিয়েছেন মর্গের ডাক্তার। গতকাল খবরটা পেয়ে গুম হয়ে গিয়েছিলেন ডেভিড। পরে অবশ্য তিনি মিতিনকে জানিয়েছেন, তিনি তাঁর বিশ্বাস থেকে একচুল নড়তে রাজি নন, নিজের মতো করে তদন্ত চালাক মিতিন। টুপুরও অবশ্য ভেবে পাচ্ছিল না এর পর মিতিনমাসির কী-ই বা করার থাকতে পারে।
পার্থকে জবাব দিতে গিয়ে মিতিনের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল সামান্য। ভারী গলায় বলল, পোস্টমর্টেমের রিপোর্টই ধ্রুব সত্য নয়। তার চোখেও তো ধুলো দেওয়া যায়।
পার্থর পাশ থেকে টুপুর বলে উঠল, তুমি কি ওই ডক্টর সামন্তর কথা ধরে বসে আছ? মিসেস যোশুয়ার বডিতে এয়ার বাবল ঢোকানো হয়েছে? কিংবা কোনও জটিল বিষটিস?
অসম্ভব তো নয়?
কিন্তু তা হলে তো বডিতে ইঞ্জেকশনের চিহ্ন থাকবে। তেমন কিছুও তো মেলেনি।
পার্থ বলল, একদম ঠিক। যত ছোট ক্ষত হোক, মৃত্যুর পর সেখানে একটা কালো স্পট হবেই।
সরি। এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তা ছাড়া মিসেস যোশুয়ার যা বয়স, তাতে এমনিতেই চামড়ায় নানা স্পট থাকতে পারে। সুতরাং একটা কালচে ফুটকি খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব, মিতিন সিটে হেলান দিল। দৃষ্টি গাড়ির বাইরে মেলে দিয়ে বলল, তবে ডেডবডির একটা-দুটো অস্বাভাবিকতা কিন্তু আমার নজর এড়ায়নি।
যেমন?
প্রথমত, মিসেস যোশুয়ার মৃত্যু যদি এগারোটায় ঘটে থাকে, আমি তাঁকে দেখেছি তার প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা পরে। এই সময়ের মধ্যে মৃতদেহ শক্ত হতে শুরু করে ঠিকই, কিন্তু অতটা বিবর্ণ হওয়ার তো কথা নয়। তা ছাড়া ওঁর হাতের একটা অংশ চাদরের বাইরে ছিল। সেখানে কবজির কাছের জায়গাটা একটু যেন বেশি কালচে দেখাচ্ছিল।
ঘরে তো তেমন আলো ছিল না। তুমি তার মধ্যেই বুঝতে পারলে?
একেবারে নিশ্চিত নই। তবু মনে হল…, মিতিন বাইরে থেকে মুখ ফেরাল, এবার সকলকে একটু নাড়াচাড়া করে দেখি। সারকামস্টেনশিয়াল এভিডেন্স থেকে তো কোনও সূত্র পাওয়া যেতে পারে। এমনকী, প্রমাণও।
পার্থ ঠাট্টা ছুড়ল, একেই বলে নেই কাজ তো খই ভাজ!
ভুলে যেয়ো না, খই ভেজেও অনেকের পেট চলে মশাই। হালকা হাসিঠাট্টায় কেটে গেল বাকি পথটুকু। মিস্টার যোশুয়ার ফটকে যতীন দাঁড়িয়ে। মিতিন অবাক মুখে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখানে কেন?
স্যার আমায় থাকতে বলেছেন। যদি চেনাজানা কেউ আসে, ভিতরে নিয়ে যেতে।
পার্থকে ভিতরে গাড়ি রাখতে বলে মিতিন গেটেই নেমে পড়ল। দেখাদেখি টুপুরও। যতীনের সামনে এসে মিতিন বলল, তোমার মুখটুখ তো খুব শুকনো হয়ে আছে। ম্যাডামের মৃত্যুতে তুমিও দেখছি খুব শক পেয়েছ?
যতীন অল্প মাথা নাড়ল। বিড়বিড় করে বলল, ম্যাডাম আমায় বড় স্নেহ করতেন। প্রায় ছেলের মতো দেখতেন। আমার আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
বুঝতে পারছি। তা তুমিই তো বৃহস্পতিবার রাতে স্যারকে গিয়ে প্রথম দুঃসংবাদটা দিয়েছিলে?
হ্যাঁ। নীচ থেকে গ্লাস-প্লেট জড়ো করে উপরের রান্নাঘরে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখনই নজরে এল ম্যাডাম যেন কেমন করছেন।
ঠিক কী করছিলেন উনি?
বুক চেপে ধরে জোরে জোরে শ্বাস টানছেন। আর মাথা ঝাঁকাচ্ছেন। তারপর আচমকাই ঘাড়টা কেমন ঝুলে গেল, উনি নেতিয়ে পড়লেন।
অর্থাৎ তখনও উনি জীবিত?
হ্যাঁ। তবে স্যার আসার পরে আর বোধহয় প্রাণ ছিল না।
সময়টা মনে আছে?
তখনও এগারোটা বাজেনি। স্যার ডাক্তারবাবুকে ফোন করার পর বড় ঘড়িতে ঢং ঢং ঘণ্টা বাজল।
তখন তো বাড়িতে আর কোনও অতিথি নেই?
না। দশটার পর থেকেই তো একে-একে চলে গেলেন। সাড়ে দশটার পর বাড়ি ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল।
মোট ক’জন ছিলেন সেদিন?
স্যার আর ম্যাডামকে বাদ দিয়ে পাঁচজন। বেঞ্জামিন সাহেবরা স্বামী-স্ত্রী, প্রোফেসর স্যার, শ্যামবাবু, আর ডাক্তারবাবু।
কে কার পর বেরিয়েছিলেন, তোমার মনে আছে?
দাঁড়ান, একটু চিন্তা করে বলি, যতীনের চোখ সরু হল। ঠোঁটখানা ছুঁচলো করে বলল, প্রথমে গেলেন প্রোফেসর স্যার, তারপর স্যার ম্যাডামরা, তারপরে শ্যামবাবু আর ডাক্তারবাবু তো একসঙ্গে গল্প করতে করতে…।
তা কী করে হয়? ডাক্তারবাবুর তো স্কুটার, শ্যামবাবুর তো মোটরগাড়ি?
ঠিক কথা ম্যাডাম। তবে যে-যার গাড়িতে ওঠার আগে অনেকক্ষণ কথা বলছিলেন, আমি দেখেছি। স্যারও ছিলেন সঙ্গে। ওঁরা চলে যাওয়ার পরও স্যার দাঁড়িয়ে রইলেন।
হুম, সেদিন সন্ধে থেকে কী কী ঘটেছিল একটু বলবে?
স্যার আর ম্যাডাম বেঞ্জামিনসাহেবের গাড়িতে ওঁদের ধর্মস্থানে গিয়েছিলেন। ফিরলেন প্রায় আটটায়। বাকিরাও তার পরপরই এলেন। দুপুরে আমি আর মেমসাহেব কিছু খাবার তৈরি করে রেখেছিলাম। সেগুলো পরিবেশন করা হল। বেঞ্জামিনসাহেব বাড়িতে তৈরি করা রেড ওয়াইন এনেছিলেন, আমি সেটা গ্লাসে গ্লাসে ঢেলে দিলাম। উৎসবের রাতে নাকি ওটা খেতে হয়। তারপর গানবাজনা, গল্পটল্প হচ্ছিল। তখন আমি ওঘরে ছিলাম না। পরে পার্টি শেষ হওয়ার মুখে মুখে ডেভিডস্যার আমায় একবার ডেকেছিলেন। র্যাচেল ম্যাডামের হাতের গ্লাসটা কী করে যেন পড়ে ভেঙে গিয়েছিল, অনেকটা পানীয় পড়েছিল ওঁর গায়ে। আমাকে বললেন কাচ টাচগুলো পরিষ্কার করতে। ম্যাডামকে একটা তোয়ালেও এনে দিলাম হাত আর ড্রেস মোছার জন্যে।
তারপর?
আর তো তেমন কিছু ঘটেনি। বেঞ্জামিন সাহেবরা চলে যেতে ম্যাডাম উঠে গেলেন উপরে। তারপর তো পার্টিও শেষ হয়ে গেল।
এর পর ম্যাডামকে ফের দেখলে একেবারে শেষ সময়ে? তাই তো?
জবাব দেওয়ার আগে যতীন সহসা শশব্যস্ত। একটা পুরনো মারুতি ঢুকছে। চাপা স্বরে বলে উঠল, প্রোফেসরস্যার এসে গিয়েছেন।
ফটকের মুখ থেকে সরে দাঁড়াল মিতিন৷ যতীনকে বলল, ওঁর সঙ্গে আমাদের একটু পরিচয় করিয়ে দাও।
আলাপের পালা সাঙ্গ হতেই যতীন ফের গেটে গিয়ে দাঁড়াল। মিতিনদের দেখে হিরন্ময় যেন তেমন খুশি নন। কাঠ কাঠ গলায় বললেন, ডেভিড কিন্তু তিলকে তাল করছে। পুলিশ-ডিটেকটিভের ঝামেলায় না জড়ালেই ভাল করত।
সাদামাটা চেহারার চশমাধারী বছর সত্তরের হিরন্ময়কে একবার জরিপ করে নিল মিতিন। শান্ত স্বরেই বলল, মিস্টার যোশুয়াকে আপনার মতামতটা জানিয়েছিলেন কি?
বহুবার। শুধু ডাক্তারই ওর তালে তাল দিয়ে যাচ্ছে, হিরন্ময় আস্তে আস্তে এগোচ্ছেন গাড়িবারান্দার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে বললেন, তা সন্দেহের কিছু পেলেন?
খুঁজছি।
বেশ। চালিয়ে যান অনুসন্ধান।
আপনার দেওয়া যতীন ছেলেটি কিন্তু বেশ স্মার্ট।
হিরন্ময় যেন চমকে তাকালেন। পরক্ষণে গলা ঝেড়ে বললেন, একটু চালাক-চতুর না হলে কি বুড়োবুড়িদের সামলেসুমলে রাখতে পারে?
ঠিক, মিতিন মৃদু হাসল, তা আপনিও কি ডাক্তারবাবুর মতো কাছাকাছিই থাকেন?
খুব দূরে নয়। আমার বাড়ি ভবানীপুর। সাত নম্বর নন্দন রোডে।
নিজেদের বাড়ি?
জেরা করছেন নাকি? হিরন্ময় খর চোখে তাকালেন, আমার কিন্তু এসব একদম পছন্দ নয়। আর এ বাড়ির বর্তমান পরিবেশ আপনার কৌতূহলের পক্ষে একেবারেই বেমানান।
কথাগুলো বলেই বাড়ির অন্দরে সেঁধিয়ে গেলেন হিরন্ময়। দু’-এক সেকেন্ড থমকে থেকে মিতিনরাও প্রবেশ করল একে-একে। ডেভিড আর সাইমন ড্রয়িংরুমের কার্পেটে বসে। হিরন্ময়ও স্থান নিয়েছেন তাঁদের পাশে।
মিতিন নিচু স্বরে ডেভিডকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কতক্ষণ আগে ফিরলেন?
সময়ের আর হিসেব নেই ম্যাডাম। আধ ঘণ্টাটাক হবে।
আমরা এসে আপনার বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটালাম না তো?
না-না। আপনারা শবানুগমন করেছেন। আজ আপনারা এই পরিবারের সম্মাননীয় অতিথি। রেবেকা, মানে আমার ছেলে সাইমনের বউ, ডিমসেদ্ধ করছে। অনুগ্রহ করে খেয়ে যাবেন। এটা আমাদের রীতি।
হিরন্ময় সামান্য অপ্রস্তুত স্বরে বললেন, সরি ডেভিড। আমারও আজ সিমেট্রিতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। বাড়িতে লোক এসে গেল বলে বেরোতে পারলাম না।
তো কী আছে? মনে মনে তো তুমি পাশেই ছিলে। নিশ্চয়ই র্যাচেলের আত্মার সদগতির জন্য প্রার্থনা করেছ?
অবশ্যই। তবে নিজের হাতে কবরে মাটি দিতে পারলাম না, এ আক্ষেপ আমার রয়েই গেল, হিরন্ময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নরম গলায় বললেন, তোমাদের তো আরও সাতদিন শোক পালন করতে হবে, তাই না?
সূর্যাস্তের আগে ফিরেছি। সুতরাং আরও ছ’দিনই যথেষ্ট। তবে এখন তো ধাপে ধাপে অ্যাভেলিউট চলবে। সাত দিন, তিরিশ দিন, এক বছর। সাইমনরা অবশ্য তিন দিন পরে ফিরে যাচ্ছে। ওর ব্যাবসা, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, রেবেকার অফিস।
হ্যাঁ প্রোফেসর। আমার কোনও উপায় নেই, বছর পঞ্চাশের সাইমনের স্বর শোনা গেল। ডেভিডের মতোই তাঁর পরনে এখনও কবরখানার পোশাক। ফুলহাতা কালো কোটের বাঁ দিকে বোতামঘর লম্বা করে কাটা৷ মুখমণ্ডলে দু-তিন দিনের না কামানো দাড়ি। চুল উসকোখুসকো। চোখে উদভ্রান্ত ভাব। নিচু গলায় বললেন, বাবাকে কতবার বলছি, এবার ঘরদোরে তালা মেরে দাও। বেঞ্জামিন আঙ্কলকে চাবি দিয়ে পাকাপাকি চলে এসো লন্ডনে। শুনছেনই না।
এক্ষুনি এক্ষুনি তা হয় নাকি? র্যাচেল এই শহরে শেষ নিশ্বাস ফেলল। তার প্রথম বছরের ক্রিয়াকর্ম না হলে কি আমি নড়তে পারি?
এ সবই তোমার বাহানা। আমি কি আজ প্রথম তোমায় চলে আসতে বলছি? এই শহরের আর আছেটা কী? ডেভেলপার আর ধান্দাবাজ প্রোমোটারে চারদিক ছেয়ে গিয়েছে। শহরের মধ্যিখানে এই জমিবাড়ি নিয়ে তুমি প্রতিদিন তাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠছ।
আমিও তো ডেভিডকে তাই বলি, হিরন্ময় বলে উঠলেন, মোটামুটি ভাল দাম পেলে বেচে দিয়ে ছেলের কাছে চলে যাও।
মাঝখান থেকে আমি মাকে হারালাম, সাইমন ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললেন, এখন বলছ মাকে নাকি কেউ মেরে দিয়েছে। লন্ডনে থাকলে এমনটা কখনও ঘটত না।
ডেভিড অসহায় স্বরে বললেন, রাগ করছিস কেন? জিহোভা তার কপালে মৃত্যু লিখে রেখেছিলেন।
ভাগ্যের দোহাই পেড়ো না ডেভিড, হিরন্ময় ঈষৎ বিরক্ত মুখে বললেন, অত যদি জিহোভার উপর বিশ্বাস, তা হলে ডিটেকটিভ লাগিয়েছ কেন?
বা রে, আমাকে প্রাণের ভয় দেখানো ফোন আসছে, তারপর বাড়িতে একের পর এক মৃত্যু…। আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকব?
ওটাও তোমার আর একটা ওজর, সাইমন গজগজ করছে, ওরকম ফোন কি আমিও পাইনি? …সেভ ইয়োর পপ! রিমুভ হিম ফ্রম ক্যালকাটা…!
তোমার কাছেও ফোন গিয়েছে? ডেভিডের চোখে বিস্ময়, কই, বলোনি তো?
তুমি আরও নার্ভাস হতে পারো ভেবে জানাইনি। তবে ইহুদিরা তো তাদের জন্মলগ্ন থেকে এই ধরনের শাসানি শুনে আসছে, তাই আমলও দিইনি খুব একটা।
কোত্থেকে গিয়েছিল ফোনটা? নিশ্চয়ই কলকাতা?
না। একটা স্ট্রেঞ্জ নম্বর। সম্ভবত আমেরিকার।
মিতিন বহুক্ষণ ধরে শুনছিল তিনজনের কথোপকথন। হঠাৎ বলে উঠল, কবে পেয়েছিলেন ফোনটা স্মরণে আছে কি?
সাইমন সামান্য চিন্তা করে বললেন, তা বেশ কয়েক মাস আগে হবে।
নিশ্চয়ই মিস্টার আব্রাহামের মৃত্যুর আগে নয়?
না না। আঙ্কল তো গেলেন রোশ হাসান্নার সময়ে। তখন আমাদের ইহুদিদের পরব চলছিল। ইন ফ্যাক্ট ফোনটা পেয়েছি সম্ভবত ক্যাথলিন আন্টির মৃত্যুর পর। এ বছর জানুয়ারির শেষে।
আপনিও তো মোটামুটি ওই সময় থেকেই…? মিতিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল, তাই না মিস্টার যোশুয়া?
বৃদ্ধ মানুষটি অস্ফুটে বললেন, হু। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে…।
মিতিনের ঠোঁটে চিলতে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল। চোখ ঘুরিয়ে দেখছে ঘরের সকলকে। ক্রমশ শক্ত হচ্ছে তার চোয়াল।