৫-৬. মাসির বাড়ির খাওয়া

দুপুরে মাসির বাড়ির খাওয়াটা মোটেই জমল না টুপুরের। আয়োজন অবশ্য মন্দ ছিল না। ঢাকুরিয়া বাজার থেকে একটা সোয়া কিলো ইলিশ মাছ এনেছিল মেসো৷ মাসির হাতে ট্রেনিং পাওয়া আরতিদি ভাপা ইলিশটা রেঁধেও ছিল আজ দারুণ। মাছের ডিম আর তেলের স্বাদটাও ছিল মনোহরণ! কিন্তু টুপুরের মুখে রুচলে তো! এমনকী, শেষপাতে সুরেশের অতি সুমধুর রাবড়ি পর্যন্ত জিভে পানসে ঠেকল। মন ভাল না থাকলে যা হয় আর কী! ফুচকাও তো তখন উচ্ছে। শালিনীর বাড়িতে বেইজ্জত হওয়াটা টুপুর কিছুতেই ভুলতে পারছে না যে!

হ্যাঁ, বেইজ্জতই তো। আকাশচাঁদ যাই বলুন, শালিনীর সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়াটা অপমান হিসেবেই দেখছে টুপুর। মাসি সেই অপমানটা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনল না! গোদের উপর বিষফোঁড়া, শালিনীর বাবার সঙ্গে কেন যে অতক্ষণ ধরে হাবিজাবি বকল, সেটা পর্যন্ত টুপুরের কাছে ঝেড়ে কাশছে না! তা হলে মাসির বাড়িতে টুপুরের আর পড়ে থাকার দরকার আছে কি? বরং মেসোকে বললেই হয়, আজ বিকেলেই তাকে হাতিবাগানে পৌঁছে দিয়ে আসুক। বুধবার ম্যাথসের ক্লাসটেস্ট, কাল জন্মাষ্টমীর দিনটা না হয় পাটিগণিত-বীজগণিত কষেই কাটাবে।

কথাটা বলতেই ঘুমন্ত বুমবুমকে ডিঙিয়ে বিছানা থেকে নামল টুপুর। দরজা পর্যন্তও যায়নি, মেসোর গলা শুনে পা আটকে গেল।

পার্থমেসো বলছে, তুমি তা হলে শিয়োর, আকাশচাঁদ জগৎশেঠদের বংশধর?

মিতিনমাসির স্বর উড়ে এল, টু হানড্রেড পারসেন্ট।

 কিন্তু পরিচয় গোপন রাখতে চায় কেন?

রাখেনি তো। ভদ্রলোকের ফেসবুক প্রোফাইল তো বলেই দিচ্ছে উনি কে?

হাউ?

নাগৌর-পটনা-রাজমহল-মুর্শিদাবাদ-মহিমাপুর-ওংগঙ্গা…হিরা-মানিক ফতে-আনন্দ-মহতাব-স্বরূপ-ওংগঙ্গা। এটাই তো যথেষ্ট।

হাউ?

হাউহাউ কোরো না। যা বলছি, মন দিয়ে শোনো। রাজস্থানের এক মরূদ্যান শহর নাগৌর। সেখান থেকে জৈন বণিক হীরানন্দ শাহ এসেছিলেন পটনায়। বাদশাহ শাহজাহানের আমলে। হীরানন্দের ছেলে মানিকচন্দ পটনা থেকে এলেন বাংলার তখনকার রাজধানী ঢাকা রাজমহলে। মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার নবাব হয়ে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গেলেন মুর্শিদাবাদে, মানিকচাঁদও তার পিছু পিছু সেখানে হাজির। ঝানু ব্যবসায়ী মানিকচাঁদের কারবার ছড়িয়ে পড়ল দূরদূরান্তরে। বেনারস, ইলাহাবাদ, কোরা, জাহানাবাদ, আগ্রা ছাড়িয়ে সেই দিল্লি পর্যন্ত। বাদশাহ ফারুকশিয়ার তাকে দেন শেঠ খেতাব।

পরে সেটাই হয়ে যায় জগৎশেঠ, তাই তো?

আজ্ঞে না স্যার। দিল্লিতে একটা বড় আকাল হয়েছিল। তখন বাদশাহর হয়ে অজস্র লোককে হুন্ডিতে টাকা ধার দিয়েছিলেন শেঠ মানিকচাঁদের দত্তকপুত্র ফতেচাঁদ। খুশি হয়ে বাদশাহ তাঁকে দিলেন জগৎশেঠ উপাধি। বংশটার নামই হয়ে গেল জগৎশেঠ। এঁদের মতো টাকা তখন গোটা ভারতে একজন বণিকেরও ছিল না। ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ কোম্পানিগুলোও তখন ধারের জন্য জগৎশেঠের গদিতে এসে হাত কচলাত। মুর্শিদাবাদের কাছে মহিমাপুরে প্রকাণ্ড এক প্রাসাদে বাস করতেন জগৎশেঠরা, ধনদৌলত তখন ও বাড়িতে উপচে পড়ত।

অ। সেইজন্য মহিমাপুর। কিন্তু ওংগঙ্গা কেন?

ওর পরেই সব ফুড়ুৎ হয়ে গেল কিনা। হয়তো সেটা বোঝাতেই… মিতিন একটু থেমে আচমকা গলা ওঠাল, দরজার ওপারে কেন, এখানেই চলে আয়।

টুপুর পলক থতমত, তারপর পরদা সরিয়ে মাসির ড্রয়িংরুমে ঢুকেছে। গোমড়া গলায় বলল, ভাবলাম তোমাদের জ্ঞানচর্চায় বিঘ্ন ঘটবে, তাই…

আড়াল থেকে তোমাদের কথা গিলছিলাম, তাই তো? মিতিনের ঠোঁটে মুচকি হাসি, তোকে একটা বেসিক টিপস দিই। আড়ি পেতে যখন কিছু শুনবি, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকবি। পরদার ওপারে দাঁড়িয়ে আছিস, অথচ পা দুখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এমনটা যেন আর না হয়।

টুপুর মনে মনে জিভ কাটল। মুখে অবশ্য বলল, ওসব শিখে আমার কী হবে? তুমি তো আমায় অ্যাসিস্ট্যান্ট করছ না?

কী যুক্তিতে এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলি?

তোমার অ্যাটিটিউডেই বোঝা যায়। তুমি আমার সঙ্গে কিছু আলোচনাই করতে চাইছ না।

খুব চটেছিস, অ্যাঁ, মিতিন শব্দ করে হেসে উঠল, ওরে বোকা, আমি তোকে নিজের মতো করে ভাবনাচিন্তা করার সময় দিলাম। যাতে তোর মনে রহস্যটা নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠে আসে। ঘটনাপ্রবাহের অস্বাভাবিক অংশগুলো তোর নজরে পড়ে।

আমি তো তেমন কিছু দেখছি না। একমাত্র শালিনীকে লুকিয়ে রাখা ছাড়া।

কেন লুকিয়ে রাখলেন বলে তোর মনে হয়?

যাতে ওই উদ্ভট স্বপ্নটা নিয়ে কোনও কথা না ওঠে।

এমনটা আকাশচাঁদ ভাববেন কেন? আমি তো গিয়েছি অন্য প্রয়োজনে।

হয়তো শালিনী আগেই টুপুরের নামটা বাবাকে বলেছিল। কিংবা তোমরা যাবে শুনে জেরা করে শালিনীর মুখ থেকে জেনে গিয়েছেন, ঐন্দ্রিলা নামের মেয়েটা ওই ব্যাড ড্রিমটি সম্পর্কে অবহিত৷ টুপুরের বদলে পার্থই যুক্তি খাড়া করল, হয়তো উনি ভেবেছেন, শালিনী সামনে এলে ঐন্দ্রিলা, আই মিন টুপুর, হয়তো প্রসঙ্গটা তুলে বসতে পারে।

তো?

তাই টু বি অন দ্য সেফ সাইড, উনি শালিনীকে আড়ালে…

দাঁড়াও দাঁড়াও, স্বপ্নটার একটা বিপদ ঘটার মতো সাইডও আছে তা হলে?

থাকতেও পারে। অন্তত শালিনীর বাবা তাই মনে করেন। শালিনীর দাদুটিও।

 আমি তো সেই সাইডটাই খুঁজছি মশাই। আর সে ব্যাপারে ওই দাদুটির কী ভূমিকা, সেটাও আমাকে জানতে হবে।

কিন্তু কেন? টুপুর অসহিষ্ণু হয়ে বলল, এখানে তো কোনও ক্রাইমটাইমের ব্যাপার নেই মাসি।

শুধু অপরাধ আর ক্রিমিনালের সন্ধান করাই কি আমার থার্ড আইয়ের কাজ? যে-কোনও রহস্যের জট খোলাই তো তৃতীয় নয়নের লক্ষ্য, মিতিনের হাসিহাসি মুখে পলকা ছায়া, তা ছাড়া শিগগিরি একটা অপরাধ ঘটবে কিনা, সে সম্পর্কেও তো নিশ্চিত হতে চাই। কারণ, বিপদে যে পড়তে পারে, সে এক অতি নিরীহ বালিকা।

টুপুর আশঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কি শালিনীর কথা বলছ?

অবশ্যই। স্বপ্নটা সে দেখেছে এবং এখনও দেখছে। নিশ্চয়ই অকারণে নয়।

মিতিন ভুরু কুঁচকোল। দেওয়াল ঘড়িটা দেখল এক ঝলক। আঙুল তুলে টুপুরকে বলল, এই সময়টায় শালিনী সম্ভবত একা আছে। ওকে একটা মেসেজ কর তো৷

কী লিখব?

বেশি কিছু নয়। লুকিয়ে ফোন কর, ভেরি আর্জেন্ট।

যদি উত্তর না আসে?

 আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে, আসবে।

 ধরো এল, কী বলব?

 সেটা তুই আমার উপর ছেড়ে দে। কথা তো বলব আমি।

সন্দিগ্ধ চোখে মাসিকে দেখতে দেখতে ঘর থেকে মোবাইলটা নিয়ে এল টুপুর। টুকটুক বোতাম টিপে রাখল পাশে। হৃৎপিণ্ডে লাবডুব। এই বুঝি বেজে উঠল।

মিতিন হাসছে, অত টেনশন করিস না। ওর একটু সময় লাগবে, বলেই পার্থর দিকে ফিরেছে। সহজ গলায় বলল, আমাদের যেন কী নিয়ে কথা হচ্ছিল?

পার্থর চোখ পিটপিট। একটু মাথা চুলকে বলল, জগৎশেঠ?

হ্যাঁ, জগৎ শেঠ। ওঁদের ধনরত্ন নিয়ে তো গল্পগাছা কম নেই। ব্যবসা শুরু নিয়েও উপাখ্যান আছে। হীরানন্দ শাহ নাকি পটনা এসেছিলেন প্রায় শূন্যহাতে। একদিন ঘুরতে ঘুরতে পটনার কাছে এক জঙ্গলে ঢুকে দুপুরবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন হীরানন্দ, হঠাৎ ঘুম ভাঙে এক আর্তনাদ শুনে। শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে দ্যাখেন, কাছেই এক ভাঙাচোরা প্রাসাদ, তার অন্দরে এক অসুস্থ বুড়ো লোক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। হীরানন্দ সেই বৃদ্ধের খুব সেবাশুশ্রূষা করেন। কিন্তু বুড়ো লোকটি বাঁচেননি। তাঁর সৎকার করার পর হীরানন্দ আবিষ্কার করেন, বিপুল টাকাপয়সা রেখে গিয়েছেন ভদ্রলোক।

বুঝেছি। সেই টাকা খাঁটিয়েই জগৎশেদের রমরমা, পার্থ ঘাড় দোলাল। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, আমাদের কপালে যে কেন এমন জোটে না?

সরি, তুমি ওই টাকা পেলে দু’মাসে উড়িয়ে দিতে। স্রেফ খেয়ে খেয়ে, মিতিন মুখ বেঁকাল, হীরানন্দ কী করেছিলেন জানো? গোটা টাকাটা একবারে নেননি। যতটুকুনি দরকার, শুধু ততটুকুনই নিয়ে যেতেন। খেপে খেপে এসে।

যাই হোক, পরের টাকায় শেঠ বনায় কৃতিত্ব নেই।

অন্যের টাকার জোরে ওঁরা শেঠ হননি। ব্যবসাবুদ্ধির জোরে ওঁরা ধনী হয়েছিলেন। তখন মুর্শিদাবাদে টাকশাল ছিল, সেখানে নিজস্ব মুদ্রা তৈরি করা হত নবাবের। ওঁরা ছিলেন তার কর্তা। নবাবের গোটা টাকাপয়সার জগৎটাই ছিল ওঁদের মুঠোয়। কত ধনসম্পদ ছিল ওঁদের বাড়িতে জানো?

দশ লাখ? বিশ লাখ? পঞ্চাশ লাখ?

ওভাবে হিসেব হবেই না। চার সিন্দুক বোঝাই রৌপ্যমুদ্রা মজুত থাকত সর্বদা। এ ছাড়া ছিল দু’সিন্দুক সোনার মোহর। আরও চার সিন্দুক সোনা, রুপোর বাট, সিন্দুকভরতি হিরে-জহরত৷ প্লাস, রাশি রাশি মুক্তো। প্লাস চুনি দিয়ে তৈরি একটা লক্ষ্মীমূর্তি, জৈনগুরু ভগবান পার্শ্বনাথের একখানা স্ট্যাচু, পান্না দিয়ে তৈরি।

যাঃ মাসি। তুমি কিন্তু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছ, টুপুর না বলে পারল না। অবিশ্বাসী সুরে বলল, এত কিছু কারও থাকে নাকি?

সত্যিই ছিল রে। শুধু তাই নয়, মাত্র দু’পুরুষেই এই সম্পত্তি তৈরি করে ছিলেন জগৎশেঠরা। নবাব, বিদেশি বণিক, দেশি জমিদার সকলে ছিল ওঁদের কৃপাপ্রার্থী। তবে বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি। ফতেচাঁদের নাতি মহতাপচাঁদ পর্যন্ত জলুস ছিল, তারপর থেকেই পতন, শুধু পতন।

ঠিক হয়েছে, টুপুর চোখ ঘোরাল, ওই জগৎশেঠই না সিরাজদৌল্লার বিরুদ্ধে চক্রান্তের মূল পাণ্ডা।

হুম, অর্থবল ওঁরই সবচেয়ে বেশি ছিল কিনা। ইংরেজরা যে সিরাজকে হটিয়ে একদিন দেশটার রাজা হয়ে বসবে, আর সেই সঙ্গে তাঁদেরও কপাল পুড়বে, এতটা ওঁরা অনুমান করতে পারেননি। মিরকাশিম তো ওঁদের দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না। মহতাপ আর তাঁর ভাই স্বরূপ, দু’জনকেই উনি মাঝগঙ্গায় ডুবিয়ে মারেন।

ইজ ইট? পার্থর গলা দিয়ে বিস্ময় ঠিকরে এল, জান খতম! ওই জন্যই ওংগঙ্গা!

ইয়েস, মিতিন মাথা নাড়ল, মহতাপচাঁদের ছেলে খুশলচাঁদ জগৎ শেঠ হয়েছিলেন বটে, কিন্তু কোমরের জোর ভেঙে গিয়েছিল। আর দু-তিন পুরুষ পর থেকেই তো ইংরেজের হাততোলা হয়ে জীবনধারণ। মাসোহারা মিলত যৎসামান্য, সেই টাকায়।

তুমি এত জানলে কোত্থেকে মাসি? টুপুর কৌতূহলী, ইন্টারনেট ঘেঁটে?

নো মাদমোয়াজেল। তার চেয়েও নির্ভরযোগ্য সোর্স।

সেটা কী?

 কী নয়? কে, মিতিন ঠোঁট টিপে হাসছে, সোর্সটা অবশ্য ডিক্লেয়ার করব না।

কেন? পার্থ মুখ বেঁকাল, সোর্স গোপন রাখাই বুঝি টিকটিকি সমাজের আইন?

টুপুরও একটু ফুট কাটতে যাচ্ছিল, হঠাৎ পাশে রাখা মোবাইল সরব। মনিটরে শালিনীর নাম। বাটন টিপতে গিয়েও থমকাল টুপুর। নার্ভাস মুখে বলল, ও মাসি, তুমি ধরবে না, আমি?

আমাকেই দে, মিতিন মোবাইলটা নিয়ে কানে চাপল। ফোনের মাইক্রোফোন চালু করে বলল, হ্যালো, আমি শালিনীর সঙ্গে কথা বলছি তো?

ওপারে ক্ষীণকণ্ঠ, শোনাই যাচ্ছে না প্রায়, হ্যাঁ রে। আমি খুব সরি রে।

আমি ঐন্দ্রিলা নই শালিনী। আমি ঐন্দ্রিলার মাসি। মিতিনের গলা ভারী নরম, সকালে আমিই তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম।

সাড়াশব্দ নেই, মিতিন প্রায় ফিসফিস করে বলল, তুমি এখন কোথায়?

এবার অস্পষ্ট গলা শোনা গেল, আমাদের ফ্লোরের করিডরে।

বাবা বাড়ি নেই?

জাস্ট নাও বেরিয়ে গেলেন। বড়ে তাউজি, মানে আলোকচাঁদ আঙ্কেলের সঙ্গে।

উনি আজ এসেছিলেন বুঝি?

 হ্যাঁ। অনেকদিন পর, শালিনীর অস্ফুট স্বর, কিন্তু আপনি কেন ফোন করছেন?

আমি যা বলছি মন দিয়ে শোনো, মিতিনের স্বর সামান্য উঠছে, আমি ইতিহাসের গবেষক নই, মনের গলিঘুঁজি ঘাঁটি। তোমার স্বপ্নটার মানে খুঁজছি।

ওপ্রান্ত আবার চুপ। মিতিন একটু সময় নিয়ে বলল, ভয় পেয়ো না শালিনী। তুমি কি সত্যিই জানতে চাও, কেন দেখছ স্বপ্নটা?

চাই তো। কিন্তু…

এতে কোনও কিন্তু নেই শালিনী। ভয়টা পাচ্ছ তুমি, কষ্টটাও তো তোমারই হচ্ছে, মিতিনের গলায় স্নেহ, দ্যাখো মেয়ে, তুমিও নিশ্চয়ই মন থেকে ভয়টাকে উপড়ে ফেলতে চাও, নয় কি?

হ্যাঁ চাই তো, একটু যেন সপ্রতিভ হয়েছে শালিনী।

তা হলে যা-যা প্রশ্ন করব, মনে করে জবাব দাও তো। স্বপ্নটা প্রথম কবে দেখলে?

লাস্ট মানডে। না-না লাস্ট সানডে।

 সেদিন কোনও স্পেশাল ইভেন্ট? তোমার ছোড়দাদু কি… হ্যাঁ

, সানডে সন্ধেবেলাতেই উনি আমাদের বাড়ি এলেন।

তুমি কি আগে কখনও ওঁকে দেখেছিলে?

 না। তবে অনেক গল্প শুনেছি।

কীরকম? একটা-দুটো গল্প কি শুনতে পারি?

উনি নাকি লেখাপড়ায় খুব ব্রাইট ছিলেন। একবার যা পড়তেন তাই নাকি ওঁর মেমারিতে রয়ে যেত। অনেক ভাষা জানতেন। ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি ছাড়া সংস্কৃত, ফারসি, উর্দু, জার্মান… উনি নাকি পাস্ট, প্রেজেন্ট সব দেখতে পান।

কে বলেছেন এসব?

বাবা। উনি ছোটা দাদাজিকে খুব রেসপেক্ট করেন।

ওঁর সঙ্গে তোমার বাবার যোগাযোগ আছে বুঝি?

আছে তো৷ এভরি ইয়ার বাবা একবার ওঁর আশ্রমে যান। রাজস্থানে।

তুমি কখনও সেখানে যাওনি? আই মিন, তোমার বাবা নিয়ে যাননি তোমাকে?

না। উনি নাকি ফ্যামিলির লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে চান না।

 টুপুরের অবাক লাগছিল। কোনও জড়তা নেই, বেশ টকটক কথা বলছে শালিনী। মিতিনমাসি কি ভোজবাজিতে শালিনীর জড়তা কাটিয়ে দিল?

মিতিনমাসি জিজ্ঞেস করছে, তা হঠাৎ উনি কলকাতায় চলে এলেন যে বড়?

বাবাই বোধহয় কী এক জরুরি কারণে ওঁকে ডেকেছেন।

হুম। তো ছোটা দাদাজিকে দেখার জন্য, তুমি খুব এক্সসাইটেড ছিলে নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ, ছিলাম তো। অত স্টোরি শুনেছি, তিনি নিজে আমাদের ফ্ল্যাটে আসবেন…

সেদিন দাদাজি আসার পর কী-কী হল, একটু গুছিয়ে বলো তো।

 দাদাজিকে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এলেন বাবা। আমি, মা, সবাই ওঁকে প্রণাম করলাম। মা কত কী বানিয়েছিলেন, উনি কিছু খেলেন না। একটা পুরনো বই ছিল ওঁর কাছে। বাবা আর উনি ওইটা খুলে কী সব কথা বলতে লাগলেন।

তোমার সঙ্গে কথা বলেননি?

হ্যাঁ। আমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে গল্প বললেন। আমি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতে খাওয়ার জন্য মা যখন ডাকল, আহিরচাঁদজি চলে গিয়েছেন।

আর আসেননি উনি?

 রোজ আসছেন। কাল রাতেও…

আচমকা কুট করে কেটে গেল লাইনটা। টুপুর হাঁ। পার্থর ভুরু জড়ো।

মোবাইলটা নাড়াচাড়া করছে মিতিন। দৃষ্টি জানলার ওপারে। কী ভাবছে মাসি!

.

০৬.

সন্ধে নেমেছে কলকাতায়। দুপুর থেকেই আকাশে আজ মেঘেদের ঘনঘটা, কিন্তু বৃষ্টি নামছে না। হাওয়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। বিচ্ছিরি গুমোটে, প্যাঁচপ্যাঁচে গরমে, মানুষজনের প্রাণ যায় যায় দশা।

টুপুরও ছটফট করছিল। শুধু গরমে নয়, টেনশনেও। আবার ফোনটা তুলে রিং করল শালিনীকে। উহ, আবার সেই সুইচড অফ ঘোষণা! নাহ, ব্যাপারটা খুব খারাপ। মেয়েটাকে নতুন করে কেন যে জড়িয়ে দিল মাসি? ধরা তো পড়েছেই, ফ্ল্যাটের বাইরে এসে ফোন করার জন্য জোর বকুনিও খেয়েছে নির্ঘাত! স্বপ্নটা নিয়ে কেন যে এত কুস্তি লড়ছে মাসি?

টুপুর ঘরে ফের উঁকি দিল। এখনও বুমবুমকে হোমটাস্ক করাচ্ছে মাসি। ওদিকে পার্থমেসো একমনে একটা আদ্যিকালের পুরনো ফুটবল ম্যাচ দেখছে টিভিতে। আশ্চর্য, কারও কোনও তাপউত্তাপ নেই। ওই ঘটনার পরেও দিব্যি নাচতে নাচতে মাটন রোল নিয়ে এল মেসো, টুপুরকে গপগপ করে তা খেতে হল। এদিকে টুপুর যে বন্ধুর চিন্তায় কত কাতর, তা কেউ বুঝতেই পারছে না!

মেসোর পাশে গিয়ে ধপাস করে বসল টুপুর। গুমগুমে গলায় বলল, আমার বন্ধুটার যে কী হল, কে জানে!

কী আবার হবে? পার্থ তেমন একটা আমল দিল না। হালকা ভাবে বলল, বরং পেটের কথা বেশ খানিকটা উগরে দিতে পেরে সে হয়তো অনেকটা নিশ্চিন্ত এখন। তোর মাসি তাকে কত ভরসা দিল।

কিন্তু যেভাবে ফোনটা কেটে গেল…

তার একাধিক কারণ থাকতে পারে। হয়তো তক্ষুনি ওর ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গিয়েছিল কিংবা সার্ভিস-প্রোভাইডার কোম্পানিটির হয়তো ঠিক ওই মুহূর্তে সার্ভার বসে গেল।

কিন্তু তারপর থেকেই ফোন সুইচড অফ থাকবে কেন?

প্লেন অ্যান্ড সিম্পল। ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়ে সে বাবার আদেশমতো ফোনটি বন্ধ করে রেখেছে, পার্থ ঝুঁকল সামান্য, এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, হ্যাঁরে, তোর মাসির মাথাটা একেবারে গিয়েছে, তাই না?

টুপুর সতর্ক স্বরে বলল, হুঁ, মাসিকে স্বপ্নের কথাটা বলাই গোক্ষুরি হয়েছে।

হাতে এখন কেসটেস নেই তো, তাই জোর করে কেস বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, পার্থ চোখ টিপল, ভাব তুই, একটা স্বপ্নকে ধরে তার মধ্যে জগৎ শেঠ পরিবারকে এনে খানিক উত্তেজনার আগুন পোহানো ছাড়া আর কোনও লাভ আছে? কাল রাত্রে আমিও তো স্বপ্ন দেখেছি, আমি একটা নদীতে ডুবে যাচ্ছি, সেখানে গ্লেসিয়ারের মতো রাবড়ির মোটা মোটা সর ভাসছে…

যাঃ, তুমি বানিয়ে বলছ…।

না রে, সত্যি। আমি একটা সরের উপর উঠেছি, অমনি সরটা ডুবতে শুরু করল, আমি প্রাণপণে চেঁচাচ্ছি, কিন্তু গলায় আওয়াজ নেই…

তারপর উঠে বসে ঢকঢক করে জল খেলে, বিছানা থেকে নেমে ডাইনিং-এ গিয়ে ফ্রিজ খুললে, মিতিন দরজায়, সেখান থেকেই টুপুরকে বলল, তোর মেসোকে জিজ্ঞেস কর তো, ফ্রিজের রাবড়ির ভাঁড়টা তখনই অর্ধেক করেছিল কিনা?

পার্থ ঘাড় চুলকোচ্ছে, তখন তুমি জেগে ছিলে বুঝি?

আজ্ঞে না। তোমার অভ্যেস আর কার্যকারণ সম্পর্ক দিয়ে মেলালাম, মিতিন সোফায় এসে বসল, মোলায়েম সুরে বলল, শালিনীর স্বপ্নটাও আমি ওভাবেই স্টাডি করছি মশাই।

টাইমপাস হিসেবে মন্দ কী! পার্থর স্বরে বিদ্রূপ। রাতদুপুরে চুরি ধরা পড়ে যাওয়ার ঝাল মেটাতে টকটক গলায় বলল, শেষে কিন্তু অশ্বডিম্ব মিলবেই।

মিতিন একটুও চটল না। হাসিমুখেই বলল, আমাকে কয়েকটা জিনিস বুঝিয়ে দেবে?

পার্থ টিভি অফ করে সিধে হয়ে বসল। কাধ ঝাঁকিয়ে বলল, লেট মি ট্রাই।

যে সংসারত্যাগী মানুষটা আত্মীয়স্বজনদের দেখতে চান না, তিনি হঠাৎ উড়ে এলেন কলকাতায়। হ্যাঁ, উড়ে। ট্রেনে চেপে নয়। খরচের কথা এক্ষুনি ধরছি না। কিন্তু এত তাড়া কীসের?

শালিনী তো বলল, আকাশচাঁদ ওঁকে ডেকে এনেছেন।

ডাকতেই উনি চলে এলেন? যিনি বিশ বছর কলকাতার ছায়া মাড়ান না? এসেই একখানা কিতাব খুলে জরুরি আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন দুই জৈন? যাঁদের একজন প্রবীণ সন্ন্যাসী? তারপরই নাতনিকে গল্প শোনাতে এগিয়ে এলেন, যে নাতনির সঙ্গে তার পরিচয়ই নেই? গল্পটা কী নিয়ে তা জানি না। কিন্তু সেই গল্প শুনে সন্ধেবেলাতেই ঘুমিয়ে পড়ল শালিনী। আর সেই রাত থেকেই শুরু হল মেয়েটার দুঃস্বপ্ন।

ওটা কাকতালীয়। অন্য ঘটনাগুলোর সঙ্গে মেলাচ্ছ কেন?

মানতাম। যদি স্বপ্নটা গোপন রাখার জন্য আকাশচাঁদ আর আহিরচাঁদ মরিয়া হয়ে না উঠতেন। এমন স্বপ্ন যা রোজ রিপিট হয়। ঘটনাটা কি খুব স্বাভাবিক?

পার্থ আর টুপুর চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। ঢোক গিলে পার্থ বলল, দুনিয়ায় রোজ অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। তার মানে এই নয় যে, পিছনে সর্বদাই একটা ক্রাইম হচ্ছে, বা হতে চলেছে।

এখানে কিছু একটা ঘটবেই। ইন ফ্যাক্ট হয়তো অলরেডি ঘটে গিয়েছে।

কী করে বলছ? পার্থর স্বরে ফের ব্যঙ্গ, তুমি কি জ্যোতিষচর্চা শুরু করেছ?

নো। জগৎশেঠদের ইতিহাস যা বলছে…

অ্যাই বেশি বোকো না তো, পার্থর গলা সামান্য চড়ে গেল, জগৎ শেঠদের হিস্ট্রি আমারও ঘাঁটা হয়ে গিয়েছে। আকাশচাঁদ, শালিনীরা আদৌ জগৎশেঠই নয়।

বটে, মুচকি হাসল মিতিন। বুমবুম ঘর থেকে বেরিয়ে জুলজুল চোখে বন্ধ টিভির দিকে তাকাচ্ছিল, তাকে কার্টুন চ্যানেল চালিয়ে দিয়ে সোফায় বাবু হয়ে বসে বলল, তা কী জেনেছ একটু শেয়ার করা যাক।

তুমি তখন যে খুশলচাঁদের কথা বলছিলে, তিনি ছিলেন বেজায় খরুচে। জৈন মন্দির বানিয়ে আর দানধ্যান করেই জগৎশেদের সম্পত্তি প্রায় লাটে তুলে দিয়েছিলেন। এমন হাল হয়েছিল, ইংরেজদের কাছে মাসখরচ চাইতে শুরু করেন। বছরে তিন লাখ টাকা বরাদ্দ করেছিল ইংরেজ, নেননি খুশলচাঁদ। কারণ, তার মাসিক খরচই ছিল একলাখ টাকা।

বলো কী? টুপুরের চোখ কপালে, তখনকার একলাখ মানে তো এখনকার কোটি টাকার সমান!

তার চেয়েও ঢের ঢের বেশি। ওই টাকা উড়িয়েই তো ফৌত হয়েছিলেন, পার্থর ঠোঁটে তেরচা হাসি, খুশলচাঁদের পর এলেন হারাকচাঁদ, তারপর ইন্দ্ৰচাঁদ, দেন গোবিন্দচাঁদ। তিনিও ছিলেন টাকা ওড়ানোর মাস্টার। জগৎ শেঠদের যেখানে যা সম্পত্তি ছিল, সব বেচেবুচে দিয়ে তার প্রায় নাঙ্গা ফকিরের দশা। মাত্র বারোশো টাকা ভিক্ষে দিত ইংরেজরা, শেষে সংসার চালাতে তাই নিতেন হাত পেতে। তিনি মারা যেতে মাসোহারা গেল তার খুড়তুতো ভাই কিষনাদের হাতে, টাকার পরিমাণ তখন আটশো। তার আবার এক ভাগীদার জুটল গোপালচাঁদ, ওই টাকা থেকে তিনশো চলে গেল তার গব্বায়। ভাব তুই?

হুঁ, টুপুর মাথা দোলাল, খুবই করুণ।

আরও আছে। গোপালের পর নামকাওয়াস্তে জগৎশেঠ হলেন গোলাপচাঁদ, আঠারোশো সাতানব্বইয়ের ভূমিকম্পে তাদের মহিমাপুরের বাড়ি, মন্দির সব ধূলিসাৎ। ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে আবার বাড়িটাড়ি হল বটে, কিন্তু তখন জগৎ শেঠ পরিচয় দিলে লোকজন হাসে।

যেমন কর্ম তেমনি ফল। সিরাজদৌল্লার সঙ্গে বেইমানি করে ইংরেজকে রাজা বানানোর উচিত শাস্তি।

সবাই তাই বলে। নিয়তিই নাকি সাজা দিয়েছে বংশটাকে। …যাই হোক গোলাপচাঁদের ছেলে দ্বিতীয় ফতোদেরও মৃত্যু ঘটেছে বছরপঞ্চাশ আগে, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে, পার্থ ঘাড় বেঁকিয়ে মিতিনের দিকে তাকাল, আমার ফান্ডায় কিছু ভুল আছে?

নাঃ, মোটামুটি কারেক্ট।

ভাঙবে, তবু মচকাবে না। এবার এটুকু তো মানবে, দেড়শো বছর আগে বদ্রিদাস টেম্পল স্ট্রিটে যাঁরা বাড়ি বানিয়েছিলেন, তাঁরা কোনও ভাবেই জগৎ শেঠ নন।

সরি। মানা গেল না।

 কেন কেন কেন?

কারণ, এত খেটেখুটে তুমি শুধু ইতিহাসের অর্ধেকটা জেনেছ। আকাশচাঁদ শেঠদের পরিবারটা আছে ইতিহাসের বাকি অর্ধেকটায়। বলতে পারো চাঁদের উলটো পিঠে।

বুঝলাম না, পার্থর চোখ পিটপিট। সন্দিগ্ধ স্বরে বলল, কোনও আষাঢ়ে গল্প ফাঁদবে না তো?

উঁহু, মিতিন হাসতে হাসতে বলল, জানো কি, খুশলচাঁদের এক ভাই ছিল। উদয়চাঁদ। তার বংশধররা জগৎশেঠ উপাধি পাননি ঠিকই, কিন্তু তাঁরাও তো ওই পরিবারের অংশ। জগৎ শেঠ বলে তারা পরিচয় দেন না, কিন্তু ওই বংশের সৌভাগ্যের ভাগ তারাও পেয়েছেন। এমনকী, জগৎ শেঠদের কিছু কিছু বিশেষ সম্পদ এঁদের কাছে গচ্ছিত রয়ে গিয়েছে।

তোমায় কে বলল এটা? পার্থ শ্লেষের সুরে বলল, তোমার সেই সোর্স?

ধরো তাই। অনেক দলিলদস্তাবেজ ঘেঁটে তিনি জানাচ্ছেন, মূল জগৎ শেঠ পরিবার যখন ক্রমশ ডুবছে, এঁদের রমরমা তখন হু হু করে বেড়েছে। মূলধন কোথা থেকে পেয়েছিলেন সেটাই রহস্য। সেই বিষয়ে অবশ্য নানান জনশ্রুতি আছে। কোথাও বলা হচ্ছে, জগৎশেঠদের অনেক লুকোনো সোনাদানা এঁদের হাতে এসে গিয়েছিল, কোথাও বা বলা হয়েছে…।

তোমার গল্পে আমি নট ইন্টারেস্টেড। যদি কোনও বিশ্বাসযোগ্য ডকুমেন্ট থাকে তো বলো, নয়তো মুখে কুলুপ আঁটো।

গোমড়া গলায় কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে পার্থ কার্টুনে মন দিয়েছে। মিতিন ভুরু কুঁচকে নখ খুঁটছে। একবার মোবাইলটা হাতে নিয়েও রেখে দিল। উঠে জানলায় গিয়ে দাঁড়াল একটু, আবার এসে বসল সোফায়। বোঝাই যায়, মনের মধ্যে চিন্তার ঘূর্ণিপাক চলছে। কিন্তু কী নিয়ে? পার্থমেসোর জন্য লাগসই উত্তর খুঁজছে মিতিনমাসি? নাকি শালিনীকে নিয়ে এতক্ষণে ভাবিত হয়েছে মাসি?

টুপুর বুঝতে পারছিল না। মাসিকে প্রশ্ন করতেও মন থেকে সাড়া পাচ্ছে না। অগত্যা টিভিতেই চোখ রাখল। কার্টুনের প্রোগ্রামটা শেষ হল, বিজ্ঞাপন স্টার্ট। রিমোটে খেলার চ্যানেলে গেল মেসো। সেখানে এখন গলফ। পাশের চ্যানেলে বাস্কেটবল। পছন্দের খেলা না হলে আঙুল স্থির থাকে না মেসোর। ঘুরে এবার খবরের চ্যানেল। কোথায় যেন কী একটা চুরি হয়েছে, শুভ্রবসন সৌম্যদর্শন এক প্রবীণ অভিযোগ জানাচ্ছেন বুমধারী সাংবাদিককে। পার্থমেসো ফের চ্যানেল ঘোরাতে যাচ্ছিল, হঠাৎ হাঁ হাঁ করে উঠল মাসি, আহ, থামো না। খবরটা একটু দেখি।

থমকেছে পার্থ। কয়েক সেকেন্ড পরে তারও চোখ গোলগোল এবং টুপুরেরও। চেনা চেনা লাগছে চেহারাটা! অভিযোগকারী ভদ্রলোকের নাম আহিরচাঁদ। শালিনীর ছোড়দাদুর নামও তো তাই। তিনিই নন তো!

হ্যাঁ তিনিই। চুরিটা হয়েছে বড়বাজারের জৈন ধর্মশালায়। আহিরচাঁদের কক্ষে। বিকেলে বেরিয়ে কাছেই একটা জৈন মন্দিরে গিয়েছিলেন আহিরচাঁদ, ফিরে দেখেন দরজা খোলা। ঘরে একটি বহুমূল্য ভগবান পার্শ্বনাথের মূর্তি ছিল। সেটি গায়েব। মূর্তিটি নাকি হাজার বছরের পুরনো, চোখের মণিদুটো পান্নার। পুলিশ এসে অকুস্থল পরিদর্শন করে গিয়েছে একটু আগে। জোরকদমে নেমে পড়েছে তদন্তে। কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

কয়েক সেকেন্ড ঘরে অখণ্ড নীরবতা। তারপরই পার্থর গলাই বেজে উঠল সবার আগে, কী হল ব্যাপারটা? হঠাৎ একটা মূর্তি চুরি হয়ে গেল?

টুপুর বলল, অত দামি মূর্তি ওঁর কাছে এল কীভাবে?

পার্থ বলল, ওই জৈন ধর্মশালা আমি চিনি। যথেষ্ট ভদ্রসভ্য জায়গা। উটকো লোক তো ওখানে এন্ট্রি পায় না।

টুপুর বলল, আমার মনে হচ্ছে, ওই ধর্মশালার কোনও স্টাফ জড়িত। আগেই দেখে রেখেছিল, তক্কে তক্কে ছিল। আজ সুযোগ মিলতেই হাপিস করে দিয়েছে।

পার্থ বলল, হু, ওদের কাছে তো রুম-কি থাকেই।

 টুপুর বলল, কী গেরো বলো তো, সেই কোন রনকপুর থেকে এসে কলকাতায় মূর্তিটা খোয়ালেন। কলকাতার বদনাম হয়ে গেল!

চুপচাপ শুনছিল মিতিন, হঠাৎ ঝেঁজে উঠল, তোদের বোকা বোকা গবেষণাগুলো থামাবি? বুঝতে পারছিস না কমপ্লেন্টটায় গড়বড় আছে?

টুপুর ফ্যালফ্যাল করে তাকাল, কেন?

আহিরচাঁদ একজন সন্ন্যাসী। তাঁর কাছে পার্শ্বনাথের বিগ্রহ হারানোটাই মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট ফ্যাক্টর হওয়া উচিত। উনি কিন্তু বারবার সাংবাদিককে মূর্তির দামটা বোঝানোর চেষ্টা করছেন।

হয়তো পুলিশের উপর চাপ তৈরি করতে চাইছেন, পার্থ বলল, দামি জিনিস হলে তবেই না পুলিশের টনক নড়ে।

উঁহু, আমি আঁশটে গন্ধ পাচ্ছি। মিতিন মোবাইল ফোন হাতে নিল। একটা নম্বর টিপে চাপল কানে, অনিশ্চয়দা, জৈন ধর্মশালার মূর্তিচুরির কেসটা দেখছিলাম। খুব সিম্পল নয়। আমি আপনাদের সঙ্গে…হ্যাঁ, আমি পারসোনালি আগ্রহী… কী কাণ্ড! খোদ ডি সি ডি ডি অনিশ্চয় মজুমদারকে ফোন! স্বপ্ন আর চুরি…কোনও সম্পর্ক আছে নাকি!