৯-১১. কেসটা নিয়ে কথা

রাত্তিরে আর কেসটা নিয়ে মাসির সঙ্গে কথা হল না টুপুরের। বাড়ি ফিরে সন্ধেবেলা পার্থমেসোকে আজকের অভিযানের আনুপূর্বিক বিবরণ শোনাল। সগর্বে নিজস্ব নানান মতামত জাহির করল পার্থমেসো। কিন্তু মিতিন সেদিকে ঘেঁষলই না। সে হঠাৎই কম্পিউটারে বেজায় ব্যস্ত। নৈশাহারের সময়টুকু ছাড়া নিজের খুপরি থেকে বেরোলই না। কত রাতে যে শুয়েছে মাসি, তাও জানে না টুপুর।

সকালে এক বিচিত্র কাণ্ড। পার্থ সবে খেয়েদেয়ে নিজের প্রেসে গিয়েছে, ক’দিন বইখাতা নিয়ে বসা হচ্ছে না বলে টুপুর তখন হোমটাস্ক নিয়ে খানিকটা ব্যস্ত, হঠাৎই ল্যান্ডফোন ঝনঝন।

মিতিন আজও সকাল থেকে কম্পিউটারে। টুপুর গিয়ে রিসিভার তুলেছে। ও প্রান্তে ডেভিডের গলা থরথর, ম্যাডাম মুখার্জি আছেন?

উদ্বেগজনক কিছু ঘটেছে আঁচ করে টুপুর বলল, কেন? কী হয়েছে?

ওঁকে এক্ষুনি একটা খবর দেওয়া দরকার। আবার সেই ভূতুড়ে ফোনটা…।

কী বলেছে আপনাকে?

না না, আমাকে নয়। আমাদের প্রোফেসরসাহেবকে। আর কী আশ্চর্য, ফোনটা আমার ফোন থেকেই গিয়েছে!

তাই?

হ্যাঁ। এইমাত্র প্রোফেসরসাহেব আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনিও তো মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছেন না, ডেভিডের গলা কাঁপছে, আমার খুব নার্ভাস লাগছে। তুমি এক্ষুনি মাসিকে জানিয়ে দাও।

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।

ফোনটা রেখেই টুপুর দেখল মিতিনমাসি বেরিয়ে এসেছে গলতা ছেড়ে। উত্তেজিত মুখে তাকে ডেভিডের কথাগুলো জানাল টুপুর। কিন্তু শুনেও মিতিনের কোনও হেলদোল নেই। অলস মেজাজে বসেছে সোফায়।

টুপুর অবাক হয়ে বলল, কী গো, তুমি কি কলটাকে পাত্তা দিচ্ছ না?

দিচ্ছি তো।

তা হলে বসে পড়লে যে বড়? প্রোফেসর সেনের নম্বর তো আছে তোমার কাছে। জিজ্ঞেস করো ব্যাপারটা।

হুটোপাটির কী আছে? প্রোফেসর তো পালাচ্ছে না। বরং ফোনটা নিয়ে একটু ভাবি, কেমন? বলেই মিতিন হেলান দিয়ে চোখ বুজেছে। হতবুদ্ধির মতো মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে রইল টুপুর। ঠোঁট উলটে ঘরেই চলে যাচ্ছিল, ফের ফোনের ঝংকার। এবার ল্যান্ডলাইন নয়, মিতিনের হাতের মোবাইল। চোখ না খুলেই বোতাম চাপল মিতিন, হ্যাঁ প্রোফেসর সেন, বলুন। বাহা রে বা, ফোনের ওপারে প্রোফেসর সেন স্বয়ং! খুবই হাউমাউ করছেন ভদ্রলোক। কথা বোঝা না গেলেও কণ্ঠস্বরটি শোনা যায়। মিতিন অবশ্য হুঁ, হ্যাঁ, তাই নাকি, বটে, ছাড়া বলছে না কিছু। তবে মাসির শেষ বাক্যে এইটুকু বোধগম্য হল, ভদ্রলোক এখনই আসছেন বাড়িতে।

টুপুর কিছু শুধোবার আগেই মিতিন বলে উঠল, জানার জন্যে পেট ফুলছে তো?

বলার হলে বলো।

শোন, ভদ্রলোকের কাছে ফোন গেছে খানিকক্ষণ আগে। দশটা পনেরো নাগাদ। মেয়েলি গলায় কেউ একজন বলেছে, সেভ ডেভিড। টেল হিম টু লিভ কলকাতা।

মিস্টার যোশুয়ার নম্বর থেকে? মেয়েলি গলায়?

ইয়েস।

স্ট্রেঞ্জ! কী করে হয়?

অনেক কিছুই হয় রে টুপুর। চুপচাপ খেলা দেখে যা, বলেই তড়াং করে লাফিয়ে উঠে সোজা হয়েছে। ফোন লাগাচ্ছে ডেভিড যোশুয়াকে।

ওপারে সাড়া পেতেই গম্ভীর স্বরে বলল, ফোন কলের নিউজটা পেয়েছি। দেখছি। এবার আমি আপনাকে ক’টা কথা বলছি, খুব মন দিয়ে শুনুন। আমি জানি, ইহুদিরা শোকের প্রথম সাত দিন কোনও জামাকাপড় কাচাকুচি করে না। সুতরাং র‍্যাচেল ম্যাডাম মৃত্যুর দিন পার্টিতে যে পোশাকটি পরেছিলেন, এখনও নিশ্চয়ই সেটা ধোওয়া হয়নি? আপনি পোশাকটি আলাদা করে রাখুন, আমি আজই গিয়ে নিয়ে আসব। কারণটা আপনি পরে শুনবেন। মনে থাকবে নিশ্চয়ই?

মিতিন ফোন অফ করতেই টুপুর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল, তুমি র‍্যাচেল ম্যাডামের ড্রেস দিয়ে কী করবে?

মাথা খাটা, মিতিন হালকা হাসল, বুঝতে পারবি। আর মগজে ঘিলু না থাকলে গিয়ে অঙ্ক কর।

টুপুর আরও বেজার। গোমড়া মুখে ঘরে গিয়ে বীজগণিত নিয়ে বসেছে। কিন্তু মন দেবে কী করে? বাইরের ঘর টানছে না?

আধঘণ্টার মধ্যে বেলের আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এল টুপুর। হ্যাঁ, প্রোফেসর হিরন্ময় সেনই বটে। বয়স্ক লোকটিকে যেন বেশ উদভ্রান্ত দেখাচ্ছে আজ। মিতিন আপ্যায়ন জানাতেই ধপ করে বসে পড়লেন সোফায়। চশমা খুলে কাচ মুছছেন।

মিতিন জিজ্ঞেস করল, বাড়ি চিনতে অসুবিধে হয়নি তো?

না না। আপনি তো বলেই দিলেন স্কুলের উলটো দিকের বাড়ি।

চা-শরবত কিছু চলবে?

 না। শুধু এক গ্লাস জল।

 টুপুর জল এনে দিয়েছে। গ্লাসটুকু নিঃশেষ করে একটু বুঝি থিতু হলেন হিরন্ময়। রুমালে মুখ মুছছেন।

মিতিন বসেছে মুখোমুখি। ঠোঁটে শুকনো হাসি টেনে বলল, এবার নিশ্চয়ই বিশ্বাস হয়েছে মিস্টার যোশুয়া অকারণে ভয় পাননি?

তাই তো দেখছি, হিরন্ময় ঢোঁক গিললেন, কিন্তু আমাকে ফোন করা কেন?

বোধহয় দুষ্টু লোকটার ডেভিডের উপর করুণা হয়েছে প্রোফেসর সেন। এই শোকের সময় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দিতে চায় না। তাই হয়তো বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে মিস্টার যোশুয়াকে শাসানোর পন্থা নিয়েছে, মিতিনের স্বর ক্রমশ কঠিন, এবার নিশ্চয়ই এও বুঝতে পারছেন, মিস্টার আব্রাহাম, ম্যাডাম ক্যাথলিন, ম্যাডাম র‍্যাচেলের মৃত্যু সম্ভবত অস্বাভাবিক?

আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না।

এত নার্ভাস হচ্ছেন কেন? আপনি তো মোটেই নরম ধাতের মানুষ নন প্রোফেসর সেন।

আচ্ছা, এমন নয় তো, ডেভিডের ফোন থেকে কোনও মহিলা আমায় ফোনটা করেছেন? ডেভিডের অজান্তে?

কে করতে পারে?

 মিসেস বেঞ্জামিন তো ও বাড়িতে সর্বদাই যাওয়া-আসা করেন।

সরি প্রোফেসর সেন। সারা ম্যাডাম ফোনটা করেনি।

কী করে জানলেন?

কারণ, মিসেস বেঞ্জামিন আজ ও বাড়িতে যাননি। মিস্টার যোশুয়াকে আমি জিজ্ঞেস করে জেনেছি।

তা হলে?

এমন নয় তো, মিস্টার যোশুয়ার ল্যান্ডলাইন থেকে আপনার কাছে কোনও ফোনই যায়নি? আপনি বানিয়ে বলছেন? মিতিন গলার স্বর আরও দৃঢ় করেছে, আপনার মোবাইলে নম্বরটা আছে?

না মানে…ফোনটা তো এসেছিল আমার ল্যান্ড লাইনে… হয়তো কলার আইডি ঘাঁটলে পাওয়া যাবে।

অর্থাৎ পরিষ্কার প্রমাণ নেই।

কিন্তু আমি মিথ্যে কেন বলব?

কারণ, আপনি মানুষটি যে একটু গোলমেলে। মাটুক পরিবারের সঙ্গে যে আপনার এতদিনের মেলামেশা তা তো অকারণে নয়।

মানে?

নিজের অতীত ইতিহাসটা একটু ভাবুন। আজ থেকে বারো বছর আগে আপনি একটা অভিযানে গিয়েছিলেন। বেশি দূরে নয়, মালদায়। গৌড়ে। আপনার ঐতিহাসিক গবেষণার কাজে। ওখানে তখন অনেক খোঁড়াখুঁড়ি চলছিল। মাটির নীচ থেকে সুলতানি আমলের বেশ কিছু প্রাচীন মুদ্রাও মিলেছিল। বহুমূল্য সেই মুদ্রাগুলো হঠাৎ খোওয়া যায়। অভিযোগটা আপনার ঘাড়ে চেপেছিল কিন্তু। কিছুই হয়তো প্রমাণ হয়নি, কিন্তু আপনার টিম মেম্বারদের বিশ্বাস, আপনিই সেগুলো সরিয়েছিলেন।

বাজে কথা। মিথ্যে অপবাদ।

আপনি তা বলতেই পারেন। তবে কিনা আপনার মতো সন্দেহজনক অতীতের একজন মানুষ যখন যেচে একটি ইহুদি পরিবারের সঙ্গে আলাপ জমায়, আর সেই ইহুদি পরিবারটায় যদি গুপ্তধন টুপ্তধন থাকে, তখন ব্যাপারটা একটু কেমন কেমন লাগে না?

কী বলছেন আপনি? আব্রাহামের সঙ্গে আমার কত বছরের বন্ধুত্ব, ও আমাকে আরবি ভাষা শিখিয়েছে, ওর লাইব্রেরিতে বসে আমরা পড়াশোনা করতাম…।

বটে? নিছক জ্ঞানচর্চার কারণেই কি তবে যতীনকে ও বাড়িতে নিয়োগ করিয়েছিলেন? তাও আবার কিনা মিস্টার যোশুয়া গুপ্তধনের কাহিনিটা বিদেশেও শুনিয়ে এলেন, তার পর? সেই যতীনও অষ্টপ্রহর সকলের উপর নজর রাখছে। লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যদের কথা গিলছে এবং আপনার কাছে সেটা পৌঁছে দিচ্ছে, মিতিনের স্বরে মৃদু ধমক, একটি বর্ণও আপনি অস্বীকার করতে পারেন?

হিরন্ময় রীতিমতো মিইয়ে গেছেন। আমতা আমতা করে বললেন, বিশ্বাস করুন, আমার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না।

সে আপনি পুলিশকে বলবেন। কারণ, আপনার দেওয়া লোকটি কাজে যোগ দেওয়ার পরই তিন-তিনজন মানুষ মারা গেলেন তো। ব্যাপারটা কতটা কাকতালীয় পুলিশ তো সেটা জানতে চাইবেই।

সর্বনাশ, হিরন্ময়ের কপালে হাত, পুলিশ কেস হয়ে গিয়েছে নাকি?

না হওয়াটাই তো আশ্চর্যের, মিতিন চোখ তেরচা করল, যাক গে, যদি মনে পাপ নাই থাকে, সাফ সাফ আমার প্রশ্নের জবাব দিন দেখি। কিছু গোপন করবেন না কিন্তু।

প্রশ্নই আসে না। বলুন কী জানতে চান?

মৃত্যুর দিন মিস্টার আব্রাহামের গায়ে অনেকটা আইসক্রিম পড়ে গিয়েছিল। কীভাবে?

আচমকা এ হেন জিজ্ঞাসায় হিরন্ময় থতমত। তারপর অপ্রতিভ স্বরে বললেন, সত্যি বলতে কী, দোষটা আমারই ছিল।

কীরকম?

কার্পেটে না কীসে যেন হোঁচট খেয়ে এমনভাবে আব্রাহামের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম, ওঁর পুরো আইসক্রিমটাই…, হিরন্ময় অপরাধী অপরাধী মুখ করে বললেন, অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে মুছেও দিয়েছিলাম।

আপনার রুমাল দিয়ে?

 বের করতে যাচ্ছিলাম। তার আগে কে যেন এগিয়ে দিল।

কে? ডেভিড? বেঞ্জামিন? র‍্যাচেল? ডাক্তার? ক্যাথলিন? শ্যামচাঁদ? যতীন?

বোধহয় ডাক্তার। না না, বোধহয় ডেভিড। নাকি র‍্যাচেলই বোধহয়…। আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।

আর এবার র‍্যাচেল ম্যাডামের বেলায়? কে রুমাল দিলেন?

যতীন তো তোয়ালে এনেছিল। তার আগে অবশ্য দু’-তিনজন মিলে হাত-টাতগুলো মুছে দিচ্ছিল।

তাঁরা কারা?

ওই তো, সারা, ডাক্তার। তারপর আমিও রুমালটা দিলাম। যতীন তখন ভাঙা কাচগুলো সরাচ্ছিল।

মিস্টার অগ্রবাল হাত লাগাননি?

দূর দূর, শ্যামচাঁদের ওসব সেন্স আছে নাকি? অফিস বাড়ি টাড়ি বানিয়ে অনেক পয়সা কামিয়েছে বটে, তবে সভ্যভব্য প্রোমোটার হওয়ারও ওর যোগ্যতা নেই।

আপনি কি অনেক প্রোমোটারকে চেনেন?

দু’-চারজনকে। আমার এক ভাইপোই তো…, কথাটা গপ করে গিলে নিলেন হিরন্ময়। সতর্কভাবে বললেন, তারা কেউই শ্যামচাঁদের মতো হাঙর-কুমির নয়। কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ আর্কিটেক্ট, প্রত্যেকেই শিক্ষিত ব্যবসাদার।

হুম, ব্যাপারগুলো মোটামুটি বোঝা গেল, মিতিন ঠোঁট চাপল, এবার আপনি আসতে পারেন।

তা হলে ফোনটার ব্যাপারটা কী হল? হিরন্ময়ের স্বরে ইতস্তত ভাব, ডেভিডের কি তা হলে সত্যিই বিপদ?

এক্ষুনি বলা কঠিন। চারপাশে যা চাঁদের হাট নিয়ে বিচরণ করছেন ভদ্রলোক! মিতিনের স্বরে চোরা হুল, দেখছি কদ্দূর কী করতে পারি।

ক্ষুব্ধ মুখে উঠে দাঁড়ালেন হিরন্ময়। এক পা, এক পা করে দরজার দিকে এগোচ্ছেন। পিছন থেকে মিতিন ডাকল, এক সেকেন্ড। যতীনের মোবাইল নম্বরটা দিয়ে যান তো।

হিরন্ময়ের নিষ্প্রভ মণি পলকের জন্য জ্বলে উঠল। পরক্ষণে স্বাভাবিক। ফোন নম্বরটা আউড়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

দরজা বন্ধ করে এসে টুপুর বলল, ভদ্রলোকের উপর তুমি কিন্তু খুব অত্যাচার করলে।

মিতিন নির্বিকার মুখে বলল, প্রয়োজন ছিল।

যদি কোনও অপরাধ ঘটেও থাকে, এঁকে কি সন্দেহের তালিকায় রাখলে?

ফালতু কথা ছাড়, মিতিন উঠে দাঁড়াল, খেয়ে উঠেবেরোতে হবে।

.

১০.

বাড়িটা গলির ভিতরে। ছোট্ট, কিন্তু দোতলা। বাইরে থেকে জানলা দরজা আর দোতলার বারান্দার টানা রেলিং দেখে বোঝা যায় তালতলা অঞ্চলের আর পাঁচটা বাড়ির মতো পুরনোও বটে। তবে সম্প্রতি কলি ফেরানো হয়েছে। নতুন রঙের ছোঁয়া পেয়ে বাইরেটা এখন রীতিমতো চকচকে। সদর দরজা খোলা। ঢুকতেই বাঁয়ে একটা সাইবার কাফে। ডান দিকে ডাক্তারের চেম্বার। সেখানে কাঠের নেমপ্লেটে জ্বলজ্বল করছে রণেন সামন্তর নাম।

মিতিন পরদা সরিয়ে উঁকি দিল। অন্দরে একটি মাত্র ছোকরা বসে। মোবাইল নিয়ে কী যেন খুটখাট করছে।

মিতিন গলাখাঁকারি দিল, ডাক্তারবাবু নেই?

ছোকরা মুখ তুলেছে। স্বরে বাড়তি ওজন এনে বলল, বিশ্রাম নিচ্ছেন। ঠিক ছটায় নামবেন। দেখাতে হলে নাম লিখিয়ে যান।

একটা অন্য কাজ ছিল, মিতিন নিজের ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে দিল, এটা ডাক্তারবাবুকে গিয়ে দিন। উনি বুঝতে পারবেন।

মোবাইল চর্চায় ব্যাঘাত ঘটায় ছোকরা বেশ বিরক্ত। কার্ডটায় চোখ বুলিয়ে কেমন সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে মিতিন-টুপুরকে জরিপ করল একবার। তারপর অন্য একটা দরজা দিয়ে গিয়েছে অন্দরে।

রোগীদের জন্য পাতা বেঞ্চিতে বসল মিতিন আর টুপুর। সামনেই খোলা জানলা। গরাদের ওপারে বাড়ির চৌহদ্দির ভিতরে অল্প একটু ফাঁকা জায়গা। বেশ কিছু লতানে গাছ গজিয়েছে সেখানে। হালকা বেগুনি ফুলে ছেয়ে আছে গাছগুলো। দেখতে বেশ লাগছে।

ছোকরার প্রায় পিছন পিছন হন্তদন্ত পায়ে রণেন সামন্ত উপস্থিত। অপ্রস্তুত স্বরে মিতিনকে বললেন, একটা ফোন করে আসবেন তো! তা হলে দোতলায় নিয়ে গিয়ে বসানো যেত। একা মানুষ বাস করি, উপরটা বড্ড অগোছালো হয়ে থাকে।

নো প্রবলেম। এখানেই বসছি।

না না, আমার চেম্বারে আসুন।

 পাশেই একখানা পুঁচকে ঘর। একদিকে রোগী পরীক্ষার লম্বাটে বেড, অন্য দিকে টেবিল-চেয়ার। ডাক্তারের চেয়ারটি গদি-মোড়া। ঘরের কোণে একটি ছোট বেসিনও দৃশ্যমান।

মিতিনরা বসতেই ডাক্তার হাসিহাসি মুখে বললেন, হঠাৎ এই অভাজনকে কী দরকার পড়ল ম্যাডাম?

মিতিন হাসল, এদিকে এসেছিলাম। ভাবলাম আপনাকে একটা খবর জানিয়ে যাই।

কী?

মনে হচ্ছে মিস্টার যোশুয়াদের কেসটায় এবার ইতি টানতে হবে।

কেন, তদন্ত শেষ?

মোটামুটি।

কী বুঝলেন?

আমার কয়েকটা দিন বৃথাই নষ্ট হল।

তিনটে মৃত্যুর কোনওটাতেই কোনও রহস্য খুঁজে পেলেন না?

সেরকমই তো দাঁড়াচ্ছে, মিতিন ঈষৎ ভুরু কুঁচকে বলল, শুধু একটা ব্যাপারই কেমন খচখচ করছে।

কী বলুন তো?

তিনটে মৃত্যুর আগে একটা করে মাইনর ইনসিডেন্ট ঘটেছে এবং সেগুলো প্রায় সিমিলার।

আপনি কোন ঘটনার কথা বলছেন?

মনে করে দেখুন। তিনজনেরই গায়ে মৃত্যুর আগে কোনও না-কোনও খাবার বা ড্রিঙ্কস পড়েছিল। সেই খাদ্য বা পানীয় থেকে যদি এমন কোনও বিষক্রিয়া ঘটে থাকে, যার এফেক্ট সাধারণ পোস্টমর্টেমে ধরা পড়বে না। কমন হার্ট ফেলিওরই দেখাবে।

আমি তো আপনাকে বলেইছিলাম, এরকম একটা আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, ডাক্তার মিতিনের কথায় সায় দিলেন, তো এখন আর সে ব্যাপারে তো কিছু করা যাবে না। একমাত্র বডিগুলোকে গোর থেকে তুলে যদি ফের টেস্ট করা যায়, তবে হয়তো…।

না না, ওসব হাঙ্গামা করা আর সম্ভব নয়। তা ছাড়া মিস্টার যোশুয়াও এখন আর কেসটা নিয়ে প্রসিড করতে তেমন আগ্রহী নন।

ওমা, তাই নাকি?

হ্যাঁ। কাল তো বলছিলেন এবার পাকাপাকি লন্ডনে চলে যাবেন।

পুয়োর সোল। ডেভিড কলকাতাকে খুব ভালবাসত, ডাক্তার ঝুঁকলেন সামান্য, তা উনি বাড়িটা বিক্রির বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন?

করবেন নিশ্চয়ই। আপনার চেনাজানা আছে কেউ?

আমি তো একেবারেই অন্য লাইনের লোক। তবে ডেভিড বললে একটু খোঁজখবর করে দেখতে পারি।

করাই তো উচিত। আপনি বন্ধুলোক। মিস্টার যোশুয়ার আপনার উপর অগাধ আস্থা, বলতে বলতে মিতিন থামল একটু। তারপর সিরিয়াস গলায় বলল, সত্যি বলতে কী, সেই কারণে আপনি আমারও খুব ভরসার পাত্র। তাই আপনার একটু গাইডেন্স চাই।

কী ব্যাপারে?

তদন্ত তো এবার থেমেই যাবে। তবু একটা সম্ভাবনা আমার মাথায় ঘুরছে, মিতিনের চোখ সরু, আচ্ছা, আইসক্রিম কিংবা শরবত যা-ই গায়ে পড়ুক না কেন, তার ট্রেস নিশ্চয়ই মৃত ব্যক্তির পোশাকে থাকবে?

ডাক্তার ঘাড় নাড়লেন, হ্যাঁ। থাকা উচিত।

তা হলে তো… মিস্টার আব্রাহাম আর ম্যাডাম ক্যাথলিনের পোশাক এখন আর অবিকৃত অবস্থায় মিলবে না, কিন্তু র‍্যাচেল ম্যাডামের ড্রেস তো মজুত। এখনও ধোওয়া-কাচা হয়নি। তাই ভাবছি পোশাকটাকে ফরেনসিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করি, মিতিন কৌতূহলী চোখে ডাক্তারের দিকে তাকাল, আইডিয়াটা কেমন?

ভাল। ভালই তো। আপনার বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়। তা কবে পাঠাচ্ছেন ফরেনসিকে?

শুভস্য শীঘ্রম। এক্ষুনি বন্দোবস্তটা করে ফেলি, বলেই মোবাইল বের করে মিতিন টকটক নম্বর টিপল। টুপুরকে হতবাক করে অবিকল সকালের বয়ানে মিস্টার যোশুয়াকে পোশাকটি সংরক্ষণের নির্দেশ দিল আবার। বাড়তি শুধু যোগ করল, পোশাকের প্যাকেটটি যেন নিচতলার ড্রয়িংরুমে রাখা থাকে, পুলিশ কাল সকালে গিয়ে নিয়ে আসবে। তারপর ফোন অফ করে স্মিত মুখে বলল, যাক, নিশ্চিন্ত। যদি কিছু না পাওয়া যায় আমাদের সকলের মনের ধন্দটা কেটে যাবে, ঠিক কিনা?

একদম ঠিক। ডেভিডের মনেও স্বস্তি আসবে। তা উনি অ্যারেঞ্জ করে রাখছেন তো?

এক্ষুনি করবেন বললেন। যতীন নাকি আজ ছুটি নিয়ে তার সোনারপুরের বাড়িতে গিয়েছে। রাত দশটার আগে ফিরবে না। তাই উনি নিজের হাতেই…।

ও, ডাক্তার হাসলেন, তা আপনারা এখন যাবেন কোথায়? বাড়ি?

হু, ক’জন গেস্ট আসার কথা, মিতিন কবজি উলটে ঘড়ি দেখল, ছ’টা তো বাজে। আপনারও তো রোগী দেখার সময় হয়ে এল।

আমার প্র্যাকটিসে তেমন আগ্রহ নেই। সকালে ঘণ্টা দুয়েক বসলাম, বিকেলে এক ঘণ্টা। একা মানুষ তো, এতেই চলে যায়।

মিস্টার যোশুয়ার বাড়িতে আপনার প্যাডটা দেখছিলাম। আপনি তো একসময় মিলিটারির ডক্টর ছিলেন, তাই না?

প্রায় কুড়ি বছর। গোটা ইন্ডিয়া চষে বেড়িয়েছি। এই তো বছর দুয়েক হল কলকাতায় ফিরেছি।

বাড়িটা কি আপনার নিজের?

ওই আর কী। হাতে তো কিছু পয়সাকড়ি পেয়েছিলাম, সস্তায় বাড়িটা কিনে নিয়েছি।

সাইবার কাফেটা কি ভাড়া দিয়েছেন?

দিলাম। যা আসে সেটুকুই লাভ।

শেষ একটা কৌতূহল। মিস্টার আব্রাহামের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছিল কীভাবে?

নাহুমসাহেবের দোকানে যেতাম। সেখানেই আলাপ থেকে বন্ধুত্ব।

ও। চলি তা হলে আজ? ফরেনসিক রিপোর্টটা পেলে অবশ্যই আপনাকে জানাব। হোপফুলি কিছু মিলবে না।

আমিও সেই আশাই করি।

বাড়ির দরজা পর্যন্ত মিতিনদের এগিয়ে দিয়ে গেলেন ডাক্তার। গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে গাড়িতে চাপল মিতিন আর টুপুর। মাসির আজকের কাজকর্ম, কথাবার্তা, সবই কেমন ধোঁয়াশার মতো লাগছিল টুপুরের। দুপুরে বেরিয়ে আজ সোজা গেল মিস্টার যোশুয়ার বাড়ি। তাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে একটা প্যাকেট নিয়ে এল। সেটা নিয়ে জমাও করে এল লালবাজারে অনিশ্চয় মজুমদারের কাছে। প্যাকেটটাতে কি তা হলে র‍্যাচেল ম্যাডামের ড্রেস ছিল না? অন্য আর কিছু টেস্ট করতে দিয়ে এসেছে? তুৎ, সব জায়গায় টুপুরকে গাড়িতে বসিয়ে রাখলে টুপুর রহস্যখানা ভেদ করবে কী করে?

মিতিন গাড়ি স্টার্ট দিতেই টুপুর প্রশ্ন ছুড়ল, তোমার উদ্দেশ্যটা কী বলো তো? তুমি তো নিজেই ফরেনসিক টেস্টের প্ল্যান করেছ। আবার ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করতে গেলে কেন?

মুচকি হেসে মিতিন বলল, আমি তো আনাড়ি ডিটেকটিভ। একবার ডাক্তারের পরামর্শ নেব না?

কিন্তু দুপুরে লালবাজারে ওই প্যাকেটটা?

আহ, এত বকবক করিস কেন? সকালে যে বললাম, চুপচাপ খেলা দেখে যা!

অগত্যা মুখে কুলুপ আঁটতেই হয় টুপুরকে। মনে যদিও অজস্র প্রশ্ন বুড়বুড়ি কাটছে। মাসি যখন বাড়ি না গিয়ে মিউজিয়ামের পাশের রাস্তায় গাড়ি পার্ক করল, তখনও যেন খানিকটা অভিমানেই রা কাড়ল না টুপুর। মার্কুইস স্ট্রিটের দিকে যখন হনহনিয়ে হাঁটা শুরু করল মিতিন, তখনও না।

মিস্টার যোশুয়ার গেট দিয়ে ঢুকেই হঠাৎ যেন মিতিনের ভোল বদলে গিয়েছে। টুপুরের হাত ধরে টানল, দাঁড়া, আমরা এখন বাড়ির ভিতরে যাব না।

টুপুর ভার গলায় বলল, কেন? আমি সঙ্গে আছি বলে?

দূর বোকা। আয় আমার সঙ্গে।

 টুপুরকে টানতে টানতে ঝোপঝাড়ের আড়ালে নিয়ে এল মিতিন। বলল, একটু ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়।

কী করব বসে বসে?

 আস্তে আস্তে এক থেকে দু’হাজার গোন। মনে মনে।

মাসির এ কী আজব খেলা? তবে তার নির্দেশ তো অমান্য করার জো নেই, নিঃশব্দে আওড়াচ্ছি সংখ্যা। বিকেলও পড়ে আসছে ক্রমশ।

দেড় হাজার পর্যন্ত গোনা হল না, তার আগেই জোর চমক। ডাক্তারের স্কুটার ঢুকছে! টুপুর বিস্মিত মুখে বলে উঠতে যাচ্ছিল, এ কী! মিতিন হাতের ইশারায় তাকে বলল, চুপ।

গাড়িবারান্দার নীচে স্কুটার রেখে ডাক্তার বেল বাজালেন। মিস্টার যোশুয়া এসে দরজা খুললেন। ভিতরে ঢুকে গেলেন ডাক্তার।

আরও মিনিট পাঁচেক পর গাড়িবারান্দার নীচে এসে দাঁড়াল মিতিন। নিঃসাড়ে। পিছু পিছু টুপুর।

তখনই কী আজব কাণ্ড! একখানা প্যাকেট হাতে সুড়ুৎ করে বেরিয়ে এসেছেন ডাক্তার! মিতিনকে দেখামাত্র তাঁর মুখখানা ফ্যাকাশে মেরে গিয়েছে, আ আ আপনারা?

আপনারই প্রতীক্ষায়, মিতিন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, এত সহজে আপনি ফাঁদে পা দেবেন ভাবতে পারিনি।

কী ফাঁদ? কীসের ফাঁদ?

ওই প্যাকেটে ম্যাডাম র‍্যাচেলের ড্রেস নেই মিস্টার সামন্ত। এতক্ষণে সেটি ফরেনসিক ল্যাবে পৌঁছে গিয়েছে। তখন আপনার চেম্বার থেকে যে ফোনটা করেছিলাম, সেটা একেবারেই ফলস। অন্য প্রান্তে কেউ ছিল না।

ও। তাতে আমার কী?

কিছুই যদি না থাকে, প্যাকেটটা চুরি করতে ছুটে এসেছেন কেন? এক পা, এক পা করে এগিয়ে গেল মিতিন। তীব্র স্বরে বলল, সরি রণেন সামন্ত, ওরফে ভাগলপুরের জয় মহারাজ, ওরফে পানাজির রবার্ট ডিকস্টা… আপনার জারিজুরি খতম।

কী সব আলতু ফালতু নাম বলে যাচ্ছেন? তারা কে?

পুলিশের গুঁতো খেলে সব স্মরণে এসে যাবে, দু’জনের চড়া গলার আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এসেছেন ডেভিড যোশুয়া। গোল্লা গোল্লা চোখে বোঝার চেষ্টা করছেন ব্যাপারটা। মিতিন ঘুরে তাঁকে বলল, আপনার সন্দেহটা অভ্রান্ত মিস্টার যোশুয়া। আপনার বোন, ভগ্নিপতি এবং স্ত্রী, তিনজনকেই হত্যা করা হয়েছে। এবং সেই নৃশংস খুনিটি হলেন আপনার এই পরম বিশ্বাসভাজন বন্ধুবর।

যত সব আজেবাজে কথা। আমার ওসব বুকনি শোনার সময় নেই, বলেই ঝটিতি স্কুটারে চেপেছেন রণেন সামন্ত।

অমনি মিতিন পথ রোধ করে দাঁড়াল। কঠোর স্বরে বলল, ভুলেও পালাবার চেষ্টা করবেন না। তালতলা থানার পুলিশ এ বাড়ি ঘিরে রেখেছে।

রণেন মরিয়া হয়ে বললেন, আপনি আমাকে এভাবে হ্যারাস করতে পারেন না। আমি একজন রেসপেক্টেবল ডাক্তার। আপনি আমায় অপমান করছেন।

চুপ করুন। আপনার রেজিস্ট্রেশন নম্বরটা যে ভুয়ো, সেটাও আর জানতে বাকি নেই।

ডেভিড যোশুয়া বিড়বিড় করে বললেন, ও ডাক্তারই নয়?

মোটেই না। জন্মে কোনওদিন মিলিটারিতে চাকরিও করেননি, মিতিন তর্জনী তুলে রণেনকে দেখাল, আদতে ইনি একজন সিরিয়াল কিলার। অল্প কয়েকজন ধনী বৃদ্ধকে বেছে নিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে তাঁদের খুন করেন। তারপর সেই এলাকা ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ভাগলপুরে উনি চারজন বাঙালি বৃদ্ধকে মেরেছেন, পানাজিতে তিন পর্তুগিজ বৃদ্ধাকে। কলকাতায় টার্গেট ছিলেন আপনারা৷ ইহুদিরা। আপনার খুব কপাল ভাল, আপনি অন্তত বেঁচে গেলেন। যেভাবে উনি বিষপ্রয়োগে একের পর এক হত্যালীলা চালিয়েছেন।

আমি বিষ দিয়েছি? যা খুশি বললেই হল? রণেন সামন্ত এখনও ফোঁস ফোঁস করছেন, প্রমাণ কী?

প্রমাণ আপনার বাড়িতেই আছে সামন্তমশাই, মিতিনের ঠোঁট বেঁকে গেল, আপনার ওই জংলা ফুলের গাছগুলোকে আমি কি চিনতে পারিনি ভেবেছেন? ওগুলো তো স্ট্রোফানথাস। লতানে গাছগুলো মূলত আফ্রিকার জঙ্গলে পাওয়া যায়। ভারতেও মেলে অল্পস্বল্প। দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে। ওই ফুলেরই বীজ থেকে তৈরি করা যায় প্রাণঘাতী বিষ আওয়াবেন। যার এক মিলিগ্রামও শরীরের কোষে প্রবেশ করলে এক ঘণ্টারও কম সময়ে হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, ওই বিষ মগজে সোডিয়াম, পটাশিয়াম ঢুকতে দেয় না। বিষটা ভারী অদ্ভুত। পাঁচ-ছ’ ঘণ্টা পরে পোস্টমর্টেম হলে বিষের আর কোনও চিহ্নই মেলে না শরীরে। তখন সাধারণ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু বলে রায় দেন মর্গের ডাক্তার। কিন্তু ম্যাডাম র‍্যাচেলের পোশাকে তো আওয়াবেনের চিহ্ন মিলবেই। নয় কি মিস্টার সামন্ত?

এখনও বলছি, আপনি কিন্তু আমায় মিথ্যে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন।

দেখা যাক, আপনার বাড়ি তল্লাশি করলে ওই বিষের সন্ধান মেলে কিনা, বলতে বলতে মোবাইল তুলে একটা ফোন। অবিলম্বে পুলিশ অফিসার ঢুকছেন গেট দিয়ে।

রণেনের ঘাড় ঝুলে গেল।

.

১১.

রবিবারের সন্ধে। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়েছে ইহুদি প্রথামাফিক যোশুয়া পরিবারের প্রথম সাতদিনের শোক পালন। মার্কুইস স্ট্রিটের বাড়িটায় আজ ছোট্ট একটা জমায়েতের আয়োজন করেছেন ডেভিড। পার্থ আর টুপুরকে নিয়ে এসেছে মিতিন। সারা আর বেঞ্জামিনও হাজির। ডেভিডের বিশেষ আমন্ত্রণে পুলিশকর্তা অনিশ্চয় মজুমদারও উপস্থিত। নীচের ড্রয়িংরুমেই সকলে জড়ো হয়েছিলেন, মিতিনের পীড়াপীড়িতে সবাই মিলে উঠে এসেছেন দোতলায়। আব্রাহাম মাটুকের লাইব্রেরিতে। বেঁটে বেঁটে টুল আনা হয়েছে এ ঘরে, গোল হয়ে বসেছেন সাতজন।

ডেভিডের মুখ-চোখ এখনও মোটেই স্বাভাবিক নয়। রীতিমতো মুষড়ে আছেন প্রবীণ মানুষটি। মাত্র ক’দিনে তাঁর কপালের বলিরেখা বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ। বিমর্ষ স্বরে বললেন, ডাক্তারই যে অপকর্মগুলো করছে, এ আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি ম্যাডাম। যাই হোক, রহস্য ভেদ করে অপরাধীকে ধরার জন্যে আপনাকে আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

ধন্যবাদ তো আমাদের তরফ থেকেও প্রাপ্য, অনিশ্চয় মজুমদারের গমগমে গলা বেজে উঠল, আপনার দৌলতে কী জাঁদরেল একখানা ক্রিমিনাল পাকড়ানো গেল, বাপস! যা যা আপনি বলেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে। তালতলার বাড়িখানা রেড করে আমরা তো স্তম্ভিত। দোতলায় আস্ত একখানা ল্যাবরেটরি বানিয়ে রেখেছিল ওই রণেন সামন্ত! স্ট্রোফানথাস গাছের এক কাঁড়ি শুকনো ফল, তার বীজের গুঁড়ো থেকে বানানো বিষ, ব্যুরেট, পিপেট, টেস্টটিউব, নানান কেমিক্যাল, সব এখন আমাদের জিম্মায়। ওর আর নড়নচড়নের রাস্তা নেই। ফরেনসিক রিপোর্টটা এলেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাবে। তবে…।

মিতিন ভুরু কুঁচকোল,কী তবে?

লোকটা আমাকে অবাক করে দিয়েছে ম্যাডাম। রুম সার্চ করে ওর লেখাপড়ার সার্টিফিকেটগুলোও মিলেছে। দুর্ধর্ষ স্টুডেন্ট ছিল এককালে। হায়ার সেকেন্ডারিতে লেটার মার্কস, গ্র্যাজুয়েশনে কেমিস্ট্রি অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস!

প্রতিভাবান বলেই তো অমন তুখোড় মগজ। শুধু শর্টকাটে টাকা রোজগারের ফন্দি এঁটে জীবনটাকে নষ্ট করে ফেলল, মিতিনের ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি, ভাবুন, কেমন মানুষ! বইপত্র ঘেঁটেঘুঁটে এমন একটা বিষ খুঁজে বের করল, রুটিন ময়নাতদন্তে যার সন্ধানই মিলবে না। তারপর একটা একটা লোককে টার্গেট করছে। বিষ দেওয়ার আইডিয়াটাও কী নিপুণ। গায়ে কোনও পানীয় বা আইসক্রিম গোছের কিছু কায়দা করে ঢেলে দাও, তারপর হইচই জটলার মাঝে নিজের বিষ মাখানো রুমালখানা ধরিয়ে দাও কারও হাতে। মোছার সঙ্গে সঙ্গে বিষ ঢুকে যাবে শরীরে, তার ঘন্টাখানেকের মধ্যে জীবন শেষ। পানীয় কিংবা আইসক্রিম পরীক্ষা করে কোনও লাভ নেই, তাতে কোনও বিষ মিলবে না। শুধু রুমালটাকে হাপিস করে ফেললেই কেল্লা ফতে, আর কোনও প্রমাণ নেই।

অনিশ্চয় বললেন, ভাগ্যিস ড্রেসটা ফরেনসিকে পাঠানোর কথা আপনার মাথায় এসেছিল। অন্য দু’বার তো নর্মাল মৃত্যু ভেবে…

এবারও সেভাবেই চলে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু অপরাধের চিহ্ন তো। কোথাও না কোথাও থেকেই যায়, তাই না মজুমদারসাহেব?

হুম, ড্রেসটা সরিয়ে ফেলতে পারলে সামন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেত। বুদ্ধিটা সামন্তর মাথায় আসেনি। ভেবেছিল আর দু’বারের মতো এবারও ঘুঘু ধান খেয়ে পালিয়ে যাবে।

বেঞ্জামিন ধন্দ মাখা মুখে শুনছিলেন কথাগুলো। হঠাৎ মিতিনের দিকে ফিরে বললেন, ম্যাডাম, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আপনি কি গোড়াতেই বুঝেছিলেন মৃত্যুগুলো অস্বাভাবিক?

না, মিতিন ঘাড় নাড়ল, সন্দেহটা আমার দানা বাঁধে র‍্যাচেল ম্যাডামের মৃতদেহখানা দেখে। ওঁর হাতে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে নীলচে ছোপ ছিল। তা ছাড়া, যত সামান্যই হোক, বডিতে পচন ধরতে শুরু করেছিল। বিষের প্রভাব না থাকলে মৃত্যুর মাত্র আট ঘণ্টার মধ্যে যা হওয়ার কথা নয়। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট দেখে তাই খুব হতাশ হইনি। শুধু নেচার অফ পয়জনটা আমায় ভাবাচ্ছিল। সেটাও তো ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে গেল।

কীভাবে?

এই যে তিন ভিকটিমের গায়ে পানীয় কিংবা আইসক্রিম পড়ার সমাচারটি। বুঝলাম একটি দুর্ঘটনাও কাকতালীয় নয়। পিছনে কোনও ঝানু মাথার প্ল্যান আছে। তখনই আমার নিজস্ব পুরনো ক্রাইম রেকর্ডগুলো ঘাঁটতে লাগলাম। দেখলাম, ভাগলপুর আর গোয়াতেও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের একই ধরনের অপমৃত্যু ঘটেছিল। সেখান থেকেই দুয়ে-দুয়ে চার করে করে এগিয়েছি।

পার্থ তেরচা চোখে বলল, তখন অনেকে নিশ্চয়ই তোমার সন্দেহের তালিকায় ছিলেন? শ্যামচাঁদ অগ্রবাল, প্রোফেসার সেন, হয়তো বা মিস্টার অ্যান্ড মিসেস বেঞ্জামিনও?।

আজ্ঞে না স্যার। যখনই জানলাম রণেন সামন্ত এ বাড়ির লেটেস্ট আগন্তুক এবং কলকাতার ইহুদি সমাজে তার যথেষ্ট মেলামেশা আছে, তখন থেকে সামন্তই আমার একমাত্র টার্গেট।

এবার টুপুর আপত্তি জানিয়েছে। বলল, তা হলে তুমি শ্যামচাঁদ অগ্রবাল আর প্রোফেসার সেনকে অত জেরা করলে কেন? কড়া কড়া কথা শোনালেই বা কেন?

ওরে বোকা, ওঁদের অতীত দুষ্কর্মের কথা বলে হ্যামার না করলে ওঁরা সুড়সুড়িয়ে কি সত্যি কথাগুলো আওড়াতেন? কোন পার্টিতে কী ঘটেছিল নিখুঁত ভাবে স্মরণ করতেন কি? সামন্ত যে সর্বদাই খানিকটা নেপথ্যে থাকছে তাও কি জানা যেত? মিতিন মিটিমিটি হাসছে, তা ছাড়া দু’জনকে একটু সমঝানোর দরকারও ছিল। মিস্টার যোশুয়া আর মিস্টার আব্রাহাম মাটুকের বন্ধু হিসেবে ওঁরা আসতেন বটে, কিন্তু কেউই তো খুব সুবিধের লোক নন। শ্যামচাঁদবাবু ছটফট করছিলেন সস্তায় জমি-বাড়িটা কেনার জন্যে। আর প্রোফেসর সেনের লোভ ছিল গুপ্তধনে। যতীনকে এ বাড়িতে ঢোকানোর সেটাই কারণ। যাতে সে সর্বদা এই বাড়ির লোকজনের উপর নজরদারি চালাতে পারে।

আর ভূতুড়ে ফোনের ব্যাপারটা? ওটাও কি যতীনকে দিয়ে…?

আরে না। যতীন অত সব জটিল কায়দা জানবে কোত্থেকে? মিতিন ঠোঁট চাপল, ওটাও রণেন সামন্তর প্যাঁচ।

কীরকম?

ইন্টারনেট ঘাঁটলে দেখতে পাবি, স্পুফ কার্ড বলে একটা সিস্টেম আছে। ওতে নিজের নম্বর গোপন রেখে যে-কোনও একটা নম্বর লাগিয়ে যত্রতত্র ফোন করা যায়। পুলিশ তো বটেই, আমরা গোয়েন্দারাও অনেক সময় ওই পদ্ধতির আশ্রয় নিই। তাই না অনিশ্চয়দা?

ইয়েস, অনিশ্চয় মাথা দোলাচ্ছেন, মিস্টার যোশুয়া যখন প্রথম কমপ্লেনটা করেছিলেন, তখনই আমার খেয়াল করা উচিত ছিল। কেসটায় তখন তেমন গুরুত্ব দিইনি তো।

আমি কিন্তু প্রথমেই ধরেছিলাম, মিতিন হাসছে, ইন ফ্যাক্ট, আমার ল্যাপটপ থেকে ওই প্রসেসেই তো একটা ফোন করলাম প্রোফেসর সেনকে। মস্ত একটা লাভও হল। প্রোফেসর সেনের ছুটে আসা দেখে পাকাপাকিভাবে সন্দেহ থেকে ওঁকে বাতিল করা গেল।

পার্থ চোখ সরু করে বলল, তা রণেন সামন্তকেও একটা ফোন লাগালে না কেন?

খেপেছ? নির্ঘাত বুঝে যেত ওকে ট্যাপ করা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হয়ে উড়ে পালাত। ভাগলপুর বা গোয়ার মতো।

ডেভিড পাথরের মতো মুখ করে বসে। মিতিনকে ধন্যবাদ জানানোর পর আর একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। দীর্ঘক্ষণ পর ফের তাঁর স্বর শোনা গেল। মৃদু কণ্ঠে বললেন, এই শহরে প্রায় না থাকার মতো করে আমরা কয়েক ঘর মাত্র ইহুদি টিকে আছি। তাদের মধ্যে তিন-তিনজন অকারণে প্রাণ হারাল। স্রেফ আমার দোষে। স্রেফ আমার দোষে।

কী যা তা বলছ? বেঞ্জামিন সান্ত্বনা দিচ্ছেন,তোমার কী দোষ?

ওই যে গুপ্তধনের গল্প ফাঁদা। ভেবে দ্যাখো তারপর থেকেই একজন একজন করে…। ডেভিড ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললেন, অথচ আদৌ হয়তো ওই গুপ্তধনের কোনও অস্তিত্বই নেই!

আমার কিন্তু তা মনে হয় না মিস্টার যোশুয়া, মিতিনের স্বর যথেষ্ট দৃঢ়, যা রটে, তার সবটাই কিন্তু মিথ্যে নয়। মিস্টার আব্রাহাম মাটুকের এই বাড়িতে গুপ্তধন থাকার কিন্তু সমূহ সম্ভাবনা।

আপনি কি ঠাট্টা করছেন ম্যাডাম? কোথায় আছে সেই মণিমাণিক্য?

জবাব না দিয়ে টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মিতিন। পায়ে পায়ে গিয়েছে ঘরের মধ্যিখানে। সরু সরু থাম তিনটের সামনে। মাঝের থামখানা একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করতে করতে বলল, এর গায়েই তো আপনাদের আদি ধর্মগ্রন্থ তালমুদ খোদাই করা আছে, তাই না?

হ্যাঁ। আমাদের পবিত্র হিব্রু ভাষায়।

আস্তে আস্তে থামটাকে আলগা ভাবে ঠুকল মিতিন। এক জায়গায় থেমেছে আঙুল। সেখানে সামান্য চাড় দিতেই, কী আশ্চর্য, খুলে গিয়েছে। থামের ঢাকনা। হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স বের করে আনল মিতিন। গম্ভীর গলায় বলল, আগের দিনই পরখ করে গিয়েছিলাম, থামের ওই অংশটুকু ফাঁপা। এবার আপনি দেখুন তো মিস্টার যোশুয়া, কাঠের বাক্সখানাও ফাঁপা কিনা।

কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্সখানা নিলেন ডেভিড। খুলছেন সন্তর্পণে। ছোট্ট ডালাখানা উন্মোচিত হতেই সাত জোড়া চোখ বিস্ময়ে শিহরিত। পায়রার ডিমের সাইজের অপরূপ এক পাথর শোভা পাচ্ছে আধারে। কী তার দ্যুতি!

গা দিয়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে গোলাপি আভা, ধাঁধিয়ে দিচ্ছে চোখ।

ডেভিড অফুটে বলে উঠলেন, এ তো সেই চুনি!

 হ্যাঁ। বদখশানি চুনি। কম সে কম দেড়শো ক্যারেট তো হবেই। এর জুড়ি দুনিয়ায় দ্বিতীয় মিলবে কিনা সন্দেহ।

ডেভিডের দু’হাতের আঁজলায় ঝকমক করছে চুনিটা। নির্নিমেষে দেখছেন ডেভিড। তাঁর দু’চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে অঝোরে।

টুপুরের মনটা ভারী হয়ে এল।

.

ফেরার পথে স্টিয়ারিং-এ পার্থ। গাড়ি চালাতে চালাতে হেঁড়ে গলায় গান ধরেছে। তার বেসুরো সংগীতে টুপুরের মনখারাপ উধাও, সেও হেসে উঠছে খিলখিল।

মিন্টো পার্কের মুখটায় এসে মিতিন বলল, প্রাণে খুব পুলক জেগেছে? মিস্টার যোশুয়ার চেকখানা দেখে খুশিতে একেবারে আত্মহারা?

মোটেই না, পার্থ ঠাট্টা ছুড়ল, আমার মজা লাগছে তোমার ব্যাখ্যান শুনে। যা গুলগাপ্পি মেরে তুমি কেসটা সলভ করলে।

মানে?

ওই যে বললে, পুরনো ক্রাইম রেকর্ড দেখেই নাকি তুমি বুঝে গেলে জয় মহারাজ, রবার্ট ডিকস্টা আর রণেন সামন্ত তিনজনই একই ব্যক্তি! এ তো স্রেফ গোঁজামিল। তোমার কাছে তাদের ছবি নেই, তাদের গতিবিধি সম্পর্কে কোনও ইনফরমেশন নেই। শুধু মৃত্যুর ধরনে মিল আছে বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়াটা কি যুক্তিতে মানায়?

কোনও তথ্যই হাতে ছিল না ভাবলে কী করে? মিতিনও পালটা আক্রমণ জুড়েছে, অত কাঁচা কাজ প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি করে না মশাই। তিন ওস্তাদের মধ্যে একটা কমন ফ্যাক্টর আছে বই কী। আর সেটাই রণেন সামন্তকে চিনিয়ে দেওয়ার মূল সূত্র।

কী?

জয় মহারাজ উত্তম বংশীবাদক ছিল। রবার্ট ডিকস্টাও তাই। ওই গুণটা তাদের অ্যাসেট, আবার ওই গুণটাই বাঁশি বাজিয়ে রণেনকে চিনিয়ে দেওয়ার একটা বড় ক্লু। বুঝেছ মশাই?

অ। তা হলে তো তোমার প্রশংসা করতেই হয়, পার্থ ঠোঁট ছুঁচলো করল, সেদিক দিয়ে দেখলে তো বলতেই হবে তোমার মগজের পূর্ণ মর্যাদা তুমি পেলে না। মিস্টার যোশুয়া তোমায় ঠকিয়েছেন।

যাহ, কী যে বলো? পঞ্চাশ হাজার টাকা কম নাকি?

মিস্টার যোশুয়ার কাছে তো নস্যি। ফোকটে দিদি-জামাইবাবুর বিশাল সম্পত্তি পেয়ে গেলেন। খুনি ছাড়াও তুমি তাকে একটা পঞ্চাশ লাখি চুনি খুঁজে দিলে। বিনিময়ে এক লাখও তো মিলল না। সাধে কি প্রবাদ আছে, ইহুদিরা হাড়কিপটে হয়! পার্থ হ্যা হ্যা হেসে উঠল। রগুড়ে সুরে বলল, সামন্তই ওর যোগ্য ওষুধ। টেলিফোনে ভয় দেখাত, বেশ করত।

পার্থর কথায় হঠাৎই একটা প্রশ্ন জেগেছে টুপুরের মনে। জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মিতিনমাসি, রণেন সামন্ত ভয় দেখানো ফোনটা করত কেন? চুপিসাড়ে সকলকে একের পর এক নিকেশ করে দেওয়াই তো যথেষ্ট ছিল।

লোকটা ওভার কনফিডেন্ট এবং ওস্তাদ খেলুড়ে। এক ঢিলে দুটো পাখি মারতে চেয়েছিল।

কীরকম? কীরকম?

 প্রথমত, মিস্টার যোশুয়া ফোনটা পেয়ে সকলকে জানাবেন, কিন্তু ফোনের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে না পারার দরুন তাঁর কথাকে কেউ আর আমলই দেবে না। মৃত্যুগুলোকে খুন খুন বলে চেঁচালেও না। ভাববে বুড়ো মানুষটা ভুলভাল বকছে। জানত, সাধারণ পোস্টমর্টেমে বিষটা ধরা পড়বে না, তাই আব্রাহামের ময়নাতদন্তটা করিয়ে দিয়েছিল। অতএব ক্যাথলিনের ক্ষেত্রে তেমন আর জোরাজুরিও করতে পারেননি মিস্টার যোশুয়া। আমি পিকচারে না এলে র‍্যাচেল ম্যাডামের মৃত্যুটাও নির্ঘাত চাপা পড়ে যেত। সেকেন্ড কারণ, মৃত্যু আর ফোন, ফোন আর মৃত্যু, এতেই ভয়ে আধমরা হয়ে যাবেন ডেভিডসাহেব। সেই সুযোগে রণেন সামন্ত ইহুদি বৃদ্ধটির আরও কাছের লোক হয়ে উঠবে। সময় বুঝে তাঁকে মারার আগে জমি-বাড়ি বিক্রির জন্য মোক্ষম চাপ দেবে। আমার স্থির বিশ্বাস, প্রোমোটার ওর ফিট করাই ছিল। তার কাছ থেকেও সম্ভবত টাকা খেয়েছে। পুলিশের জেরায় এবার সেটাও প্রকাশ হবে।

তৃতীয় একটা উদ্দেশ্যও ছিল, পার্থ শিস দিচ্ছে। চোখ নাচিয়ে টুপুরকে জিজ্ঞেস করল, বল তো কী?

বুঝতে পারছি না।

তোর মাসিকে পঞ্চাশ হাজার পাইয়ে দেওয়া। যাতে আমরা এই চিটপিটে গরমে এক্ষুনি হুস করে একবার দার্জিলিং বেড়িয়ে আসতে পারি, পার্থ চোখ টিপল, কী রে, যাবি তো?

টুপুর খুশিতে বাক্যহারা। নিস্তরঙ্গ গ্রীষ্মের ছুটিটা যে শেষমেশ এভাবে জমে উঠবে, কে জানত!