৫-৬. ভাঙাচোরা রাস্তা

অতি ধীরে চলছিল গাড়ি। ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে। ভাঙাচোরা বলাটা ভুল, রাস্তা প্রায় নেই বললেই চলে। গহিন অরণ্য চিরে প্রায় মাটির পথ, মেরেকেটে সাত-আট হাত চওড়া। কোনও এককালে হয়তো ইট-টিট পড়েছিল, এখন তার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া কঠিন।

মুখে কুলুপ এঁটে পথের দু’পাশটা দেখছিল টুপুর। কী গাঢ় নিস্তব্ধতা। এমন নৈঃশব্দ্যের মাঝে কথা বলা বুঝি মানায়ও না। জনপ্রাণীর আওয়াজ তো দূরস্থান, শোনা যাচ্ছে না কোনও পাখির ডাকও। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দটা পর্যন্ত কানে লাগছে। জঙ্গল ক্রমশ এতই গভীর, স্পষ্টভাবে কিছু দেখার উপায় নেই। এই ঘোর দুপুরেও বনের মাঝে চাপ চাপ অন্ধকার। হঠাৎ হঠাৎ ঝোপঝাড় সামান্য নড়ে উঠলেই ছ্যাঁত করে ওঠে বুক। মনে হয়, এই বুঝি হানা দিল কোনও বুনো জন্তু। মাঝে মাঝেই পথের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি ঝোরা। সন্তর্পণে সেই জল মাড়িয়ে এগোচ্ছে টুপুরদের জিপ। একবার যেন হরিণের ডাকও শোনা গেল। কিন্তু চোখে এসে ধরা দিল না কেউ।

স্তব্ধতার চাপ কমাতেই বুঝি কথা বলে উঠলেন বিভূতি, কেমন লাগছে স্যার?

দুর্দান্ত, পার্থ পাশের সিট থেকে বলল, ভেবেছিলাম হালকাপুলকা ফরেস্ট। কিন্তু এ তো দেখছি সিমলিপাল, সারান্ডাকেও হার মানায়। লবঙ্গি আর কদ্দূর?

আরও সাত-আট কিলোমিটার তো বটেই।

আগাগোড়াই এরকম? মাঝে কোনও ফাঁকা জায়গা নেই? গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফোটো তুলতাম।

হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে বই কী। একটু অপেক্ষা করুন।

 বলতে বলতে মিনিট কয়েকের মধ্যে জঙ্গল একটু পাতলা হয়েছে। মিলেছে একফালি খোলা প্রান্তর। শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া ছাড়াও আরও কত লাল লাল ফুল ফুটে আছে। গাছের পাতাগুলোও যেন লালচে লাগে ফুলের আভায়।

গাড়ি থামতেই টুপুর নেমে হাত-পা ছাড়িয়ে নিল। চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে মিতিনের ঘাড় ঘুরছে এদিক-সেদিক। পার্থর শাটার টেপার বিরাম নেই। বুমবুম ঘাড় উঁচিয়ে দেখছে ফুলের মেলা।

হঠাৎ টুপুর চেঁচিয়ে উঠল, ওই দ্যাখো, দূরে একটা হরিণ।

বুমবুম পলকে সচকিত, কই রে টুপুরদিদি?

ওই তো, বড় শাল গাছটার নীচে। ও মা! একটা তো নয়, অনেক!

 টুপুরদের শো দেওয়ার জন্যই যেন হাজির হয়েছে চিতল হরিণের পাল। একটুও ভয় পাচ্ছে না মানুষকে। দিব্যি অসংকোচে দাঁড়িয়ে। হালকা বাদামির উপর সাদা সাদা ছোপ। সুন্দর জীবগুলো কী সরল চোখে তাকাচ্ছে! আচমকা কোথায় যেন মৃদু শব্দ হল, অমনি দুদ্দাড়িয়ে পালাল হরিণের দল, লাফ মেরে মেরে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।

টুপুর অবাক হয়ে বলল, একটা আওয়াজ শুনেই ওরা হাওয়া মারল যে বড়?

মিতিন বলল, ওরা এমনিতেই ভিতু। তা ছাড়া, জঙ্গলের প্রাণীরা আগাম বিপদের গন্ধ পায়। হয়তো কাছেপিঠে নেকড়ে কিংবা প্যান্থার গোছের কিছু এসেছে।

পার্থ সামান্য বিচলিত হয়েছে। বলল, আর দেরি নয়। চলো, তা হলে আমরা জিপে উঠে পড়ি।

মিতিন হেসে বলল, ভয় পেয়ে গেলে?

তা কেন, সঙ্গে আমাদের বাচ্চাকাচ্চা আছে, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা মোটেই সেফ নয়।

জন্তুটাকে দেখতে পেলে একটা দুরন্ত স্ন্যাপ নিতে পারতে।

চলো, গাড়িতে গিয়ে বসি তো। ওখান থেকেও কিছু মন্দ হবে না।

বসে অপেক্ষা করাই সার। কোনও চারপেয়েই দর্শন দিল না। তবু টেলিলেন্স লাগিয়ে বেশ কয়েকবার শাটার মারল পার্থ।

বিভূতি ফের স্টার্ট দিয়েছেন গাড়িতে। আবার নিঝুম জঙ্গল। আবার এবড়োখেবড়ো পথ। পার্থ ঘাড় ঘুরিয়ে মিতিনকে জিজ্ঞেস করল, সঙ্গে বিস্কুটটিস্কুট কিছু এনেছ?

মিতিন ভ্রূভঙ্গি করল, এরই মধ্যে খিদে পেয়ে গেল?

যা ঝাঁকুনি, বাপ রে! ভাত, মাছের ঝোল হজম হয়ে গিয়েছে।

বুমবুমের চিপস আছে, চলবে?

দাও দু-চারটে। ক্ষুন্নিবৃত্তি হোক।

অমনি বুমবুমের বায়না, আমাকেও দাও, আমাকেও দাও।

অগত্যা টুপুরই বা আর বাকি থাকে কেন! সেও চলেছে টকঝাল কচুভাজা চিবোতে চিবোতে।

খানিকটা গিয়ে টুপুর জিজ্ঞেস করল, লবঙ্গি থেকে ফিরে আমরা কি আর বেরোব?

পার্থ কাঁধ ঝাঁকাল, কোথায় আর যাব?

বা রে, তুমিই তো বললে জঙ্গলে একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে। গভীর রাতে সেখান থেকে নাকি অনেক জন্তু দেখা যায়।

উত্তম প্রস্তাব, যাওয়া যেতেই পারে, পার্থ পাশে তাকাল, কী বলেন বিভূতিবাবু?

কোনটায় যাবেন? বিভূতির পালটা প্রশ্ন।

 মানে? বিট অফিসার যে বললেন, একটাই ওয়াচ টাওয়ার? হাতিবাড়ি কোথায় যেন?

না তো, আরও দুটো আছে। কদলিখোলা আর করদাপাড়া। অবশ্য হাতিবাড়ি যাওয়াই ভাল। বাকি দুটোর দশা সুবিধের নয়।

ওখানে বাঘ-ভল্লুক কিছু দেখা যাবে?

এখন সম্ভাবনা কম। জলাশয় মতো বানানো আছে, আর আছে নুনের গর্ত। গরম আরও বাড়লে ঝরনা টরনাগুলো একেবারে শুকিয়ে যায়, তখন জানোয়াররা ওখানে জল খেতে আসে। তবে নুন চাটতে আসা দু’-একটা ভালুক কিংবা বুনো শূকর দেখতে পাবেন, এটুকু বলতে পারি। আর কপাল খুব ভাল থাকলে হাতি। বাঘ টাঘ এখন আশাই করবেন না।

পার্থ বুঝি একটু দমে গিয়েছে। তবু বলল, হাতি তো বোধহয় আজই পেয়ে যাব, লবঙ্গিতে।

তা হলে আর বিভূতিবাবুকে মিছিমিছি কষ্ট দেওয়া কেন? মিতিন বলে উঠল, রাত্তিরটা উনি শান্তিতে ঘুমোন। কাল-পরশু তো হাতে থাকছে। তার মধ্যেই একদিন না হয়…

জো আপকা মর্জি ম্যাডাম।

লবঙ্গির বনবাংলো এসে গিয়েছে। জিপ থামতেই দৌড়ে এল চৌকিদার। বুড়ো মানুষ, হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, খালি গা, কাঁধে গামছা, গায়ের রং মিশমিশে কালো। মুখে আদিবাসী আদিবাসী ছাপ অতি স্পষ্ট।

চৌকিদার বিভূতির চেনা। পার্থর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এ হল সুরজ মুন্ডা। সাতকোশিয়ার সব কটা বনবাংলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো কর্মচারী।

সুরজ ঘাড় নাড়লেন। ওড়িয়া ভাষায় বললেন, হাঁ স্যার, পঁয়ত্রিশ বৎসর চাকরি করছি।

বটে? তা হলে তো আপনার কাছে জঙ্গলের অনেক গল্প শোনা যাবে, পার্থ সোৎসাহে বলল, তার আগে একটু চা পাওয়া যাবে কি?

এইনে করি আনুছি।

বলেই দৌড়। টুপুররা ঘুরে ঘুরে দেখল বাংলোটা। তিনটে ঘর, মাঝে ডাইনিং হল, সবই অবশ্য বন্ধ। সামনে খানিকটা খোলা জমি। সেখানে অনেক গাছ। শাল, সেগুন, শিশু, কাঁঠাল। একটু দূরে লম্বা দেবদারুও চোখে পড়ল। একখানা পাহাড়ও দৃশ্যমান। পাহাড়ের নীচে খেত, যেন পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বেশ লাগে দেখতে।

পার্থ বিভূতিকে জিজ্ঞেস করল, বাংলোটা বন্ধ কেন? কেউ আসে না এখানে?

বুকিং দিচ্ছে না। জলের খুব সমস্যা তো এখানে।

 টুলকায় নিশ্চয়ই পাওয়া যায়?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওখানে তো টুরিস্ট যাচ্ছে। বাঘমুন্ডাতেও।

কিন্তু পুরানাকোট? ওখানে তো রেঞ্জ অফিস, লোকবসতি আছে, তবু বাংলোটা তো শুনশান মনে হল।

তার কারণ অন্য স্যার। পুরানাকোটের বাড়িটায় ভূত আছে।

হোয়াট?

হ্যাঁ স্যার। আপনাআপনি দরজা খুলে যায়, খাওয়ার প্লেট থেকে খানা উবে যায়, নানারকমের গলা কানে আসে। বনদফতর এখন পারতপক্ষে কাউকে ওখানে পাঠায় না।

সুরজ চা এনেছেন। হাতে হাতে কাপ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনা মানুকু তো খুব অসুবিধা হইছি।

পার্থ যেন ঠিক বুঝতে পারল না। বলল, কেন? কীসের অসুবিধে?

রান্ধুতি কি এ? টিকরপদার চৌকিদার তো ছুটিতে যাইছি।

যাহ, সে তো নিখোঁজ। তার তো পাত্তাই মিলছে না।

রাজু তো পরশু ঘরকো যাইছি। পনেরো দিনের আগে আসিবুনি।

পার্থ আর মিতিন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। পার্থ জিজ্ঞেস করল, আপনাকে এত খবর কে দিল?

সুরজবুড়ার কান বড় লম্বা। জঙ্গলের সব কথা ভাসি আসে।

এ তো বেশ গোলমেলে ব্যাপার! পার্থর চোখ পিটপিট, তা আর কী কথা আপনার কানে ভেসে এসেছে?

নুকিচুরি করে কেত্তে কেত্তে সব জন্তু মারে। এনে কেই দেখি পারিনি।

তাই নাকি? শুনছিলাম বটে গত বছর দু’খানা চিতা খুন হয়েছে। পার্থ মাথা নাড়ল, আর কী-কী জন্তুকে টার্গেট করে?

এত্তেদিনি হরি মার খেলা। এনে ঘড়িয়া মারুছি।

ঘড়িয়া? মানে ঘড়িয়াল?

হ্যাঁ স্যার।

বলেন কী? এমন নিরীহ মেছো কুমিরদেরও?

 মিতিন মন দিয়ে কথোপকথন শুনছিল। চায়ে চুমুক দিয়ে শান্ত গলায় বলল, অবাক হওয়ার কিছু নেই পার্থ। ঘড়িয়ালের চামড়া যে কত মহার্ঘ, তা টুপুরও জানে।

তা বটে। কিন্তু…।

পার্থর তবু যেন মন খুঁতখুঁত। এদিকে চার-চারজন শ্রোতা পেয়ে সুরজ উজাড় করে দিচ্ছেন তাঁর গল্পের ঝাঁপি। সেই অনেক অনেক বছর আগে রইস লোকজন কীভাবে কাঁধে বন্দুক চাপিয়ে বাঘ, ভালুক শিকারে আসত। তারপর একসময় জন্তু-জানোয়ার মারার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল সরকার। রায়গড়া, পদ্মাতোলা আর মহানদীর জঙ্গল মিলিয়ে হয়ে গেল একটাই বন। ভাল লোক তো আর আসেই না, এখন শুধু দুষ্ট ছেলে-ছোকরার উপদ্রব। তারা যেখানে-সেখানে পিকনিক করে, গাঁকগাঁক করে গান চালায়, ভয়ে জন্তুরা আর তেমন বেরোয়ই না।

নিজের ভাষায় চলছে সুরজের বকবকানি। প্রথমটা মন্দ লাগছিল না, কিন্তু ক্রমেই যেন পার্থর বোধগম্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। কেটে পড়ার জন্য ঘনঘন ইশারা করছে বিভূতিকে। কোনওক্রমে ছাড়া পেয়ে বিভূতিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন যেন।

গাড়ি চলতেই টুপুরের গলায় আফশোস, এ মা, আমাদের তো লবঙ্গিতে হাতি দেখা হল না!

বিভূতি বললেন, হাতিরা বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকে না। অনবরত স্থান বদলায়। টিকড়পাড়া ফেরার আর একটা রাস্তা আছে। খুব খারাপ পথ। আরও ঘন জঙ্গল। ওই দিক দিয়ে গেলে হয়তো কিছু জানোয়ার চোখে পড়বে। যদি বলেন তো…

কোনও দরকার নেই, মিতিন সরাসরি নাকচ করে দিল, জঙ্গলে তো আসা বুনো বুনো ভাবটা এনজয় করতে। সেটা তো পুরোমাত্রায় হচ্ছে। জন্তুজানোয়ার দেখার জন্য কলকাতার চিড়িয়াখানাই কি যথেষ্ট নয়?

পার্থ ক্ষীণ স্বরে বলল, তবু ন্যাচারাল পরিবেশে বন্যপ্রাণী দেখার মজাটাই তো আলাদা।

বুমবুম বলল, ঠিক বলেছ, ঠিক বলেছ।

মিতিন বলল, না, এখন সোজা বাংলো। রাতে যদি জাগতে পারো, ওয়াচ টাওয়ারে বসে দেখো।

অগত্যা আগের পথেই প্রত্যাবর্তন। রুমে এসে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি খেল পার্থ। তারপর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে চলল বিভূতিকে জপাতে। বিকেলে গরম গরম পকোড়া চাই কিনা!

লনে চেয়ার নিয়ে বসে ছিল মিতিন। টুপুরও একটা চেয়ার টেনে বসল পাশে। দেখছে নদীর ওপারের পাহাড়, বাঁক খাওয়া রুপোলি নদী। শেষ সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে জলটা। কাছেই একটা গাছে তিনটে মিশকালো পাখি এ ডাল ও ডাল করছে। ভীমরাজ নাকি? একটা টিয়ার ঝাঁক মহানদীর ওপার থেকে ফিরছে। ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের আড়ালে।

টুপুর আত্মগতভাবে বলল, বিকেলটা এখানে দারুণ, তাই না মিতিনমাসি?

মিতিনের কোনও সাড়াশব্দ নেই। টুপুরের হঠাৎই মনে হল, মাসি যেন বড্ড চুপচাপ। ফেরার পথে গাড়িতেও বিশেষ কথাবার্তা বলছিল না। কী যেন ভাবছে সারাক্ষণ।

টুপুর জিজ্ঞেসই করে ফেলল, কী এত চিন্তা করছ গো?

সামান্য মাথা ঝাঁকাল মিতিন। তারপর বলল, একটা সংশয় মনে উঁকি দিচ্ছে, বুঝলি।

কীরকম?

যেমন ধর, রাজু নামের চৌকিদারটির হঠাৎ প্রস্থান। বিট অফিসার কিছুই জানেন না, অথচ সুরজ বলছেন, সে নাকি ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছে।

হয়তো সুরজ ভুল জানেন। কিংবা রাজু হয়তো বাড়ি থেকে কোনও খারাপ খবরটবর পেয়েছে।

কিন্তু বিট অফিসার তো পাশেই থাকেন। তাঁকে বলে যাবে না?

উনি তো বলছিলেন, রাজুর নাকি এরকম অভ্যেস আছে।

হুম। তারপর ধর, কর্মবীর আর শক্তিধরই শুধু তাঁবুর বুকিং পেলেন।

 টুপুর উৎসুক মুখে বলল, তুমি কি কোনও রহস্যের গন্ধ পাচ্ছ?

উঁহু, তার চেয়েও বেশি। মনে হচ্ছে, কোথাও একটা নোংরা খেলা চলছে। আর সেই খেলাটা খুবই ভয়ংকর।

তুমি কী বলছ, কিছুই বুঝতে পারছি না।  

আমি নিজেও পরিষ্কার বুঝতে পারছি না যে। আবছা আবছা ক’টা সুতো দেখতে পাচ্ছি শুধু। যতক্ষণ না ওগুলো স্পষ্ট হচ্ছে, জোড়াও যাবে না।

এক-এক সময়ে কী যেন হেঁয়ালি করে মিতিনমাসি, মাথামুন্ডু ঠাহর করাই দায়। তবে যাই হোক, টুপুরকে এড়িয়ে তো কিছু করবে না মাসি৷

ভাবনার মধ্যেই রাশি রাশি তেলেভাজা হাজির। পাহাড়প্রমাণ বেগুনি, পেঁয়াজি, আলুর চপ, কিছুই বাদ নেই। বড় প্লেটে সাজিয়ে এনেছেন বিভূতি। পাশে উল্লসিত মুখে পার্থ আর বুমবুম। কচর কচর মুখ চলছে বাপ ছেলের।

পার্থ আহ্লাদিত স্বরে বলল, খেয়ে দ্যাখো, তোমার কালকের রাতের বেগুনির চেয়ে ঢের ভাল হয়েছে।

মিতিন একটা বেগুনি তুলে নিল। কামড় দিয়ে বলল, মন্দ নয়, তবে নুন একটু কম।

পার্থ বলল, ওফ, কিছুতেই প্রাণ খুলে প্রশংসা করতে পারো না। একদম নিখুঁত হলে কি প্রেসের ব্যবসায় পড়ে থাকতাম? জমিয়ে তেলেভাজার দোকান দিতাম একখানা।

আর নিজেই খেয়ে সাফ করতে, টুপুরও মজা জুড়ল, আর দিনের শেষে ক্যাশবক্সে পড়ে থাকত লবডঙ্কা।

মোটেই না। তোর মাসি টিকটিকিগিরি করে যা কামায়, তার তুলনায় ঢের বেশি পয়সা আসত, পার্থ আর একটা চেয়ার টেনে বসল। তির্যক সুরে বলল, কত কেসে যে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়, হিসেব করে দেখেছিস কখনও?

এমন একটা অপবাদ মিতিনমাসির আছে বটে। অনেক সময়েই সরকারি কেসে বিনা পয়সায় খেটে দেয় আই জি অনিশ্চয় মজুমদারের অনুরোধে। এই জঙ্গলেও যদি কোনও রহস্যের সন্ধান পায়, সেটাও কি বেগার খাটা হবে? হয়তো বা!

বিভূতি হাসি হাসি মুখে পাশের বাংলোটা দেখছিলেন। হঠাৎই বলে উঠলেন, মাস্টারমশাই আর ছাত্র খুব জঙ্গলে ঘুরছেন দেখি! এখনও ফিরলেন না!

রাতে খাওয়ার সময়ে ঠিক গুটিগুটি পায়ে হাজির হবেন, বলেই পার্থ তর্জনী তুলে মিতিনকে বলল, আজ কিন্তু ওঁদের আর নেমন্তন্ন নয়। নিজেরা যা পারে, রেঁধে খান।

নিমন্ত্রণ করা, না করার অবশ্য প্রয়োজন হল না। সুবাহু ভিড়লই না রান্নাঘরের দিকে। পুরানাকোট থেকে সম্ভবত কিছু শুকনো খাবার কিনে এনেছে, তাই দিয়েই সারবে নৈশাহার।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর পার্থ মন দিয়ে আজকের তোলা ফোটোগুলো দেখছিল। তাকে ঘিরে মিতিন, টুপুর আর বুমবুম। নিজের তোলা ফোটোতে নিজেই ভারী মুগ্ধ পার্থ। বাহ, বাহ, ধ্বনি ঠিকরোচ্ছে গলা থেকে। তার আত্মতারিফের ঘটায় টুপুর তো হেসে খুন। উজ্জ্বল মুখে ক্যামেরাটা মিতিনকে বাড়িয়ে দিয়েছে পার্থ। বলল, দ্যাখো, ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফি কাকে বলে একটু বোঝার চেষ্টা করো।

সরু চোখে প্রত্যেকটি ফোটো নিরীক্ষণ করছিল মিতিন। পাহাড়, নদী, শাল, সেগুন, আসান, কুসুম, শিরীষ, মহুল গাছে ভরা বন। লাল লাল ফুল, হরিণ, চকিতে হরিণের পালিয়ে যাওয়া।

হঠাৎ মিতিনের দৃষ্টি স্থির। একটা ফোটো দেখছে জুম করে। পার্থকে বলল, এটা একটু ডিপলি ওয়াচ করো তো। গাছের ওপাশে ওটা কী? মানুষ না?

হ্যাঁ, তাই তো, পার্থ ঝুঁকল, দু’জন লোককে দেখা যাচ্ছে যেন!

মিতিন আরও জুম করল ফোটোটাকে। বিড়বিড় করে বলল, ওদের হাতে…

রিভলভার! পার্থ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, রিভলভারই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু ওরা কারা?

মিতিন বলল, চিনতে পারলে না? কর্মবীর আর শক্তিধর।

.

০৬.

সকালে নৌকো চড়তে চড়তে বেলা দশটা বেজে গেল। চওড়া পাটাতনে বসেছে টুপুর আর পার্থ। মাঝে বুমবুম। উলটো দিকে সালোয়ার কামিজে মিতিন, গলায় তার বাইনোকুলার। আকাশে আজ বেশ মেঘ, দমকা বাতাস উঠছে হঠাৎ হঠাৎ। স্রোতের অভিমুখে চলা নৌকো দুলে দুলে উঠছে। অমনি ছটফটে বুমবুম ভয়ে জড়সড়।

টুপুরেরও যে বুক ঢিপঢিপ করছিল না, তা নয়। তবে অন্য একটা চিন্তা তাকে আরও বেশি ভাবাচ্ছে যে। ধরেই রেখেছিল আজ আবার ঘাটের পথে দেখা হবে শক্তিধর আর কর্মবীরের সঙ্গে। কিন্তু কী কাণ্ড, তাঁবু বেবাক ফাঁকা! তাদের গতিবিধি নিয়ে সন্দেহ জেগেছে বলেই কি পালাল লোক দু’জন? শূন্য তাঁবুটা তন্নতন্ন করে খুঁজল মিতিনমাসি৷ মিলল শুধু একটা ছেঁড়াখোঁড়া কার্বন পেপার। মূল্যবান হিরেজহরতের মতো সেটাই ব্যাগে পুরল মিতিনমাসি৷ কী কম্মে লাগবে কে জানে!

ওই লোক দু’জন যে কোনও খারাপ উদ্দেশ্যে জঙ্গলে ঢুকেছেন, তাতে আর টুপুরের কোনও সন্দেহ নেই। পার্থমেসোরও না। ক্যামেরার মনিটরে দুই মূর্তিমানকে আবিষ্কার করেই ভারী উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল পার্থমেসো। তর্জনী উঁচিয়ে বলল, ওঁরা নির্ঘাত চোরাশিকারি। জঙ্গলে জন্তু মারতে এসেছেন।

আমারও তাই মনে হয়, টুপুর বলেছিল, হরিণগুলোকে বোধহয় তাক করছেন। হরিণের চামড়ার যা দাম!

হতেই পারে। হয়তো এক-আধটাকে মেরেও ফেলেছেন। আমাদের এখন তা হলে কী করা উচিত?

বিট অফিসারকে জানাবে? নাকি পুলিশকে?

 সরাসরি ওঁদের তাঁবুতে গিয়ে হানাও দিতে পারি।

থাক। রাত্তিরবেলা এখন আর শোরগোল তুলে লাভ নেই। অত বীরত্বও দেখাতে হবে না, মিতিনমাসি সরাসরি উৎসাহে জল ঢেলে দিল, যাও, এখন সবাই শুয়ে পড়ো তো।

তুমি ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছ না?

নিয়েছি বলেই তো ঘুমোতে বলছি। সকালে তা হলে শরীর-মন তাজা থাকবে। তখন নয় অভিযানে নামব।

মিতিনমাসিকে আর ঘাঁটায়নি বটে, কিন্তু প্রস্তাবটা মোটেই মনঃপূত হয়নি পার্থমেসোর। আর এখন খাঁ খাঁ তাঁবুটি দেখা ইস্তক তার মুখ রীতিমতো গোমড়া। নদীর দু’পাশে সবুজের বাহার, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অরণ্য ক্রমশ উঠে গিয়েছে উপরপানে। গাছে গাছে কত রঙের যে ফুল! এমন অপরূপ দৃশ্য পার্থমেসো যেন দেখেও দেখছে না। শুধুই যান্ত্রিক ভাবে এলোমেলো শাটার টিপে চলেছে ক্যামেরায়। নদীর ওপারেও নাকি চিতল, শম্বর, নীলগাই, চৌশিঙ্গার দর্শন মেলে। আছে ভালুক, আছে হাতির পাল। বনপথ ধরে নাকি প্রায় কটক পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যায়। দাঁড় বাইতে বাইতে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে ধারাভাষ্য দিয়ে চলেছেন বৃদ্ধ মাঝি। পার্থমেসো যেন শুনেও শুনছে না। সাতকোশিয়া সম্পর্কে তার যেন আর আগ্রহই নেই।

তার মাঝেই হঠাৎ মাঝিকে মিতিনের প্রশ্ন, কাল ওই বাবুদের কতক্ষণ নৌকো চড়ালেন?

বেশি নয়, জোর এক ঘণ্টা।

মাত্র? তারপর ওঁরা ফিরে এলেন?

না তো। ওঁরা এক জায়গায় নৌকো দাঁড় করিয়ে পাড়ে নেমে গেলেন।

ওসব জেনে আর কোনও লাভ আছে? পার্থর বিদ্রূপ উড়ে এল, সময়কালে কোনও ব্যবস্থা নিলে না, পাখি তো ফুড়ুৎ।

অত সোজা নয় স্যার। জঙ্গল ছেড়ে যাবেন কোথায়?

যেখানে খুশি। গোয়েন্দা ম্যাডাম নিশ্চয়ই দেখেছেন, বাংলোর কাছ থেকেই আঙুলের বাস ছাড়ে। ভোরবেলা যদি সেই বাসে চেপে থাকেন, এতক্ষণে তাঁরা…।

এক সেকেন্ড। তারা যদি শিকারই করে থাকেন, তা হলে সেই মরা জন্তুটন্তু নিয়েই গিয়েছেন নিশ্চয়ই?

তা কেন। চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন।

রাতারাতি ওই কাজটি সম্ভব নয় পার্থ। জন্তুজানোয়ারের ছাল ছাড়ানোর নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। মেরেই অমনি কাঁধে চামড়া নিয়ে পালানো যায় না। চামড়াটাকে শুকোতে হয়। সময় লাগে। অন্তত তিন-চারদিন।

তা হলে হয়তো আছেন কোথাও ঘাপটি মেরে। এখন গোটা জঙ্গল ঢুঁড়ে দেখা কি সম্ভব? কাল রাতেই যদি পাকড়াও করতে পারতাম…

কাল রাতে ওঁরা তাঁবুতে ফেরেননি। সোলার ব্যাটারির আলোও জ্বলেনি। আমি দেখেছি।

পার্থ চুপসে গেল। মিতিন ফের প্রশ্ন ছুঁড়েছে মাঝিকে, তা ওঁরা দুজন কাল নামলেন কোথায়?

এই তো, একটু সামনে। মহানদী যেখানে চওড়া হয়েছে, তার শুরুতেই৷

ও।

আর কিছু না বলে আইফোনখানা ব্যাগ থেকে বের করল মিতিন। কী যেন দেখছে মনিটরে, আর বারবার তাকাচ্ছে পারের দিকে। বুঝতে না পেরে টুপুর চোখ সরাল বাঁয়ে, সাতকোশিয়ার পাহাড়ে। এখন নদী থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছে কেন জায়গাটাকে সাতকোশিয়া গর্জ বলে। খাড়া পাহাড়ের গা ঘেঁষে নদী যেন এক সরু গিরিখাত ধরেই বইছে। এমন একটা নদীতে সে এখন নৌকোয়, ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়।

ঠিক তখনই বুমবুমের চিৎকার, অ্যাই টুপুরদিদি, দ্যাখ দ্যাখ, কুমির!

হ্যাঁ, তাই তো! টুপুরের চোখ বড় বড়। পাড়ের কাছে একটা পাথরের উপর দিব্যি শুয়ে আছে ঘড়িয়ালটা। গায়ের রং পাথরের সঙ্গে প্রায় মিশে গিয়েছে, হঠাৎ দেখলে ঠাহর করা কঠিন। বেশ পেল্লাই সাইজ। কম করে পনেরো-ষোলো ফুট তো হবেই।

হঠাৎ টুপুরদের চমকে দিয়ে নড়ে উঠল ঘড়িয়ালটা। পাথর ছেড়ে ধীর পায়ে নেমে পড়েছে জলে। অমনি কী তার গতি! জলে গা ভাসিয়ে শাঁই শাঁই ছুটছে।

বুমবুম টুপুরের হাত চেপে ধরল, অ্যাই দিদি, ও তো নৌকোর দিকেই আসছে! কী হবে এখন?

বৃদ্ধ মাঝি বলে উঠলেন, ভয় পেয়ো না খোকা। ওরা মানুষের কোনও ক্ষতি করে না। দ্যাখো, কেমন নৌকোর সঙ্গে সঙ্গে যাবে।

মাঝির কথা মেনেই যেন নৌকোর কাছাকাছি এসে সুড়ুৎ করে ঘুরে গেল ঘড়িয়াল। তারপর চলেছে পাশে পাশে নৌকোর পাহারাদার হয়ে। যেতে যেতেই মাঝে মাঝে ঘাড় ঘোরাচ্ছে ঘড়িয়াল। কখনও ডাইনে, কখনও বাঁয়ে। ম্প্রিং-এর মতো।

বুমবুম বলল, ও ওরকম করছে কেন?

 মাঝির ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি, মছলি খাচ্ছে বেটা।

কোথায় মাছ? দেখতে পাচ্ছি না তো?

 পার্থর মেজাজ সমে ফিরেছে। হেসে বলল, দেখতে পেলে আমরাই ঘড়িয়াল বনে যেতাম রে! সাঁতার কাটতে কাটতেই দু’ পাশটায় ওদের দৃষ্টি চলে, আর সুড়ুৎ সুড়ুৎ মৎস্য গেলে।

কথার মাঝেই কখন যেন দিক পরিবর্তন করেছে ঘড়িয়াল। ক্রমশ সরে যাচ্ছে তীরের পানে। হেলেদুলে উঠে পড়ল পারে। আবার যেন ঘুমিয়ে পড়ল তক্ষুনি।

প্রতিটি দৃশ্যই সযত্নে লেন্সবন্দি করেছে পার্থ। খুশি খুশি মুখে বলল, ঘড়িয়ালটা বড় লক্ষ্মী রে! না চাইতেই দিব্যি কেমন একটা শো দিয়ে গেল।

মুখখানাও ভারী খাসা, টুপুর টিপ্পনী জুড়ল, ঠিক যেন হিন্দি ফিল্মের ভিলেন।

যাহ, মোটেই ভিলেন নয়। কী চমৎকার শান্ত ব্যবহার। কুমির-ঘড়িয়াল সম্পর্কে আমার ধারণাটাই বদলে গেল।

বদলানোই তো উচিত, অনেকক্ষণ পর কথা বলল মিতিন। ঘড়িয়ালের দৃশ্যটি উপভোগ করার পর আবার তার দৃষ্টি মোবাইলের মনিটরে। অল্প মাথা দুলিয়ে বলল, হাঙর, কুমির, সাপ, বাঘ, ভল্লুক, কেউই তেমন খারাপ জীব নয়। এদের চেয়ে বরং মানুষ অনেক বেশি হিংস্র প্রাণী। ওরা আক্রমণ করে পেটের দায়ে। আর মানুষ খেয়ালখুশি মতো জন্তুজানোয়ার হত্যা করে।

টুপুর উৎসাহী মুখে মাসির কথায় সায় দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই জোর দুলে উঠেছে নৌকো। একটা বাঁকের পর হঠাৎই যেন মুখটা খুলে গেল নদীর। অনেকটা চওড়া হয়ে গিয়েছে। প্রায় তিন গুণ। এখন আর পাহাড়ি নদী বলে মনে হচ্ছে না, থইথই করছে জল।

বাঁদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে মিতিন জিজ্ঞেস করল, কালকের বাবুরা এখানেই নেমেছিলেন?

মাঝির ঘাড় নড়ল, হাঁ দিদি। নেমেই লাফাতে লাফাতে পাহাড়ে উঠে গেলেন।

মোবাইলের মনিটরে চোখ রেখে মিতিন পার্থকে বলল, আমার জি পি এস যা বলছে, এখান থেকে লবঙ্গির জঙ্গল পঁচিশ কিলোমিটার দূর। মানে, কর্মবীর আর শক্তিধরকে যেখানে দেখা গিয়েছে।

পার্থ ভুরু কুঁচকে বলল, তো?

কাল ওঁদের ফোটোটা তুলেছিলে অ্যারাউন্ড সাড়ে তিনটেয়। আর ওঁরা এখানে ল্যান্ড করেছিলেন মোটামুটি সাড়ে দশটায়। অর্থাৎ, জঙ্গলের পথে মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় পঁচিশ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছেন।

হুম। বোঝাই যাচ্ছে দু’জনেই দারুণ এক্সপার্ট।

একটু বেশি মাত্রায় এক্সপার্ট। হিসেবটা আমার মিলছে।

কী হিসেব?

উত্তর না দিয়ে মিতিন চোখ রাখল বাইনোকুলারে। মন দিয়ে দেখছে কী যেন। পার্থ আর টুপুর চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। মিতিনের মাথায় কিছু যে একটা পাক খাচ্ছে, টের পাচ্ছে দু’জনেই। তবে এখন যে মিতিন আর মুখ খুলবে না, সেটা তারা দুজনেই জানে।

অগত্যা মাঝির সঙ্গে কথোপকথন চালু করল পার্থ। জিজ্ঞেস করল, এই নদীই তো কটকে যাচ্ছে, তাই না?

হাঁ স্যার। কটক পেরিয়ে সেই পারাদ্বীপে গিয়ে সমুদ্রে পড়ছে।

 ও। তা কটক এখান থেকে কদ্দূর? মানে এই নদীপথে?

তা তিরিশ-চল্লিশ মাইল হবে। দাঁড় টানটে টানতে মাঝি একবার আকাশের দিকে তাকালেন। বলিরেখা ভরা কপালে আরও কিছু ভাঁজ পড়ল যেন। পার্থকে বললেন, বাবু, চলুন, এবার ফেরা যাক।

এত তাড়াতাড়ি? কেন?

আকাশের মতিগতি ভাল ঠেকছে না। এখানে নদীর স্রোতটাও খুব খারাপ। ঝড় উঠলে নৌকো উলটে যেতে পারে।

যাহ, কিচ্ছু হবে না। আপনি চলুন তো।

না পার্থ, ওঁকে জোর কোরো না, মিতিনের স্বর বেজে উঠল, নদীতে মাঝির কথা অমান্য করতে নেই। উনি যখন আর এগোতে চাইছেন না, তখন ফিরে যাওয়াটাই সংগত।

পার্থ হতাশ মুখে বলল, তবে আর কী। হাইকমান্ড যখন নির্দেশ দিয়েছে, চলো এবার উজান পথে।

তা যেতে এক ঘণ্টা সময় লেগেছিল। স্রোতের বিপরীতে ফিরতে দেড় ঘণ্টা পার হয়ে গেল। ঘাটে যখন টুপুররা নামল, আকাশ মেঘে ছাওয়া। হাওয়ার ঝাপটায় দুলছে জঙ্গলের গাছপালা। ফাঁকা তাঁবুটা একবার আলগা নিরীক্ষণ করে এক দৌড়ে বাংলোয় পৌঁছে গেল বুমবুম আর টুপুর।

বনবাংলোর পিছনের জঙ্গল থেকে নেমে আসছিল সুবাহু। কাঁধে গিটারের বাক্স। টুপুরদের দেখে একগাল হাসি, তোমাদের সকালের বোটিং প্রোগ্রাম ওভার?

হ্যাঁ, বুমবুম ঘাড় দোলাল, আজ একটা বিরাট ঘড়িয়াল দেখেছি। জ্যান্ত।

হা হা হা। জ্যান্ত ঘড়িয়াল তো এখানেও দেখেছ, খাঁচায়।

ওগুলো যেন কেমন কেমন, বুমবুম মুখে বেঁকাল, মেশিনের মতো হাঁ করে, মেশিনের মতো মুখ বোজে।

মিতিন-পাৰ্থও এসে গিয়েছে। পার্থ স্মিত মুখে সুবাহুকে জিজ্ঞেস করল, আপনি একা যে? স্যার আজ বেরোননি?

স্যারের একটু জ্বর জ্বর মতো হয়েছে।

মশাটশা কামড়ায়নি তো? জঙ্গল মসকিউটো কিন্তু হাইলি ডেঞ্জারাস। ফরেস্ট ম্যালেরিয়া হয়ে যায়।

তাই তো ভাবছি। এখনও স্পেসিমেন কালেকশান চলছে, আরও দিন পাঁচেক থাকতে হবে।

জঙ্গলে পদে পদে বিপদ, পার্থ চোখ ঘোরাল, তার উপর আবার উটকো দু’খানা বিপদ এসে ঢুকে পড়েছে জঙ্গলে।

মানে?

ওই যে দুটো লোক তাঁবু খাঁটিয়ে রয়েছেন, ঘোরতর সন্দেহজনক। এবং বিপজ্জনক।

কেন? ওঁরা আবার কী করলেন?

জঙ্গলের মধ্যে খোলা রিভলভার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

তাই নাকি? সুবাহু থতমত, আপনারা দেখলেন রিভলভার নিয়ে ঘুরতে?

উঁহু। আমার ক্যামেরা দেখেছে, পার্থ গলা নামাল। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মিতিনকে দেখিয়ে বলল, আমার মিসেস তো ডিটেকটিভ, উনি জঙ্গলে তোলা ফোটোগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ বের করলেন, দু’জনেরই হাতে আর্মস।

চোখের কোণ দিয়ে একবার মিতিনকে দেখে নিয়ে সুবাহু বলল, খুব অ্যালার্মিং ব্যাপার তো!

অবশ্যই। কিছু একটা গড়বড়ে ঘটনা চলছে জঙ্গলে। আমার মিসেস তার স্মেল পেয়েছেন।

তাই বুঝি উনি গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিয়েছেন? সুবাহু হাসছে, আপনাদের বেড়ানো তো তা হলে ডকে।

আরে না, এই তো খেয়ে উঠেই আবার বেরোব, বলেই পার্থর হাঁক, বিভূতিবাবু, আপনার রান্না কদ্দূর?

খানা রেডি, বিভূতির জবাব উড়ে এল, আপনারা ঘরে গিয়ে বসুন, আমি নিয়ে আসছি।

পার্থ আর মিতিন ঢুকে গেল রুমে। বুমবুম টানছে টুপুরকে, অ্যাই, চল একবার খাঁচার ঘড়িয়ালগুলোকে দেখে আসি।

কেন রে?

এমনি। ইচ্ছে করছে।

আজব বাসনা! খিধেয় পেট চুঁইচুঁই, এখন বাবুর ঘড়িয়াল দেখার শখ জেগেছে!

পায়ে পায়ে দুই মূর্তি খাঁচার সামনে হাজির। ছোট ছোট ঘড়িয়ালগুলো নড়াচড়া করছে বটে, কিন্তু বড় দুই ঘড়িয়াল শুয়ে আছে স্থির।

বুমবুম চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই, অ্যাই, তোরা জাগ না।

ঘড়িয়াল-যুগল নিথর।

বুমবুম খাঁচা ধরে ঝাঁকাচ্ছে, অ্যাই, ওঠ না, ওঠ না।

টুপুর হেসে বলল, কী পাগলামি করছিস? ওরা তোর ভাষা বুঝতে পারবে নাকি?

পারতেও তো পারে, পিছনে হঠাৎ সুবাহুর গলা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, আবার ডাকো। আর-একবার ডাকো।

কিমাশ্চর্যম! বুমবুম তৃতীয়বার গলা চড়াতেই চোয়াল ফাঁক হতে শুরু করেছে ঘড়িয়ালের। ক্রমশ বড় হচ্ছে হাঁ। আবার আস্তে আস্তে বুজেও গেল।

বুমবুম আহ্লাদে আটখানা। হাততালি দিচ্ছে। টুপুরও খুশি। তবু কেমন একটা যেন খটকা লাগছিল টুপুরের। হঠাৎই।