ইসাবেলের ঘর থেকে বেরিয়ে আরাকিয়েলদের দোতলাটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল মিতিন। ভিতরবারান্দা, রান্নাঘর, বাথটব শোভিত স্নানাগার, নির্মলার থাকার জায়গা, জেসমিনের ডেরা… জেসমিন থাকে ইসাবেলের শয়নকক্ষের একেবারে উলটো প্ৰান্তে। ঘরটা ওরকমই বড়, তবে আসবাবপত্র দিব্যি আধুনিক কম্পিউটার, টিভি আর মিউজিক সিস্টেম মজুত। এ ঘর থেকেও টেরেসে যাওয়ার একটা দরজা আছে।
টেরেসে দাঁড়িয়ে মিতিন বলল, আপনাদের গাড়িবারান্দার এই ছাদটাই বাড়ির সেরা জায়গা। কী হাওয়া এখানে।
মিতিন-টুপুরের সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরছিল জেসমিন। হেসে বলল, এই জায়গাটা আমারও খুব প্রিয়। কত সময় আমি এখানে বসে গান শুনি, বই পড়ি…
টুপুর বলল, আমি হলে তো রাতে মাদুর পেতে এখানেই শুয়ে থাকতাম।
পারতে না। বড্ড মশা। জেসমিন হাসিটাকে ছড়িয়ে দিল। মিতিনকে জিজ্ঞেস করল, এবার এককাপ কফি হবে নাকি?
চলতে পারে। তবে তার আগে একবার নির্মলার সঙ্গে বসব।
জেসমিনের হাসি নিবল, আপনার কি নির্মলাকে সন্দেহ হয় ম্যাডাম?
নট এগজ্যাক্টলি। সেদিন রাতের ডিটেলটা আমি প্রত্যেকের মুখ থেকেই আলাদা-আলাদাভাবে শুনতে চাই। নীচে ভাড়াটেদের কাছেও যাব।
বেশ। নির্মলাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
নিজের ঘরের মধ্যে দিয়ে অন্দরে গেল জেসমিন। মিনিট দুয়েকের মধ্যে নির্মলা হাজির। কোমরে জড়ানো ন্যাপকিনে হাত মুছতে-মুছতে বলল, আমায় ডাকছেন?
কোনও ঘোরপ্যাঁচ নয়, মিতিন সরাসরি প্রশ্ন হানল, হিরেটা কে সরিয়েছে বলো তো?
নির্মলা পলকের জন্য থতমত। পরক্ষণে অবাক স্বরে বলল, আমি কী করে বলব?
তুমিই তো বলবে। চুরিটা হয়েছে মিস্টার আরাকিয়েলের মৃত্যুর রাতে। এবং একমাত্ৰ তুমিই গোটা রাত ওই ঘরে ছিলে।
কে বলেছে?
তা জানার তো দরকার নেই। যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দাও।
নির্মলা একটুক্ষণ চুপ। আস্তে আস্তে ঠোঁটে একটা ফ্যাকাশে হাসি ফুটেছে। কেটে-কেটে বলল, খবরটা যে-ই দিয়ে থাক, ভুল বলেছে। আমি মোটেই সারারাত ওই ঘরে ছিলাম না। দু-দুবার তো কিচেনে যেতে হল। কফি বানাতে।
কখন? কত রাতে? মিসেস আরাকিয়েল জেসমিনের ঘরে শুতে যাওয়ার পর?
হ্যাঁ। জেসমিন আন্টিকে নিয়ে গেল। একতলার পিটার আঙ্কল তো আগেই নেমে গিয়েছিলেন নীচে। মিস্টার হ্যারি আর অ্যালবার্ট গিয়ে বসলেন লাইব্রেরিরুমে। আঙ্কলের ফিউনারেল নিয়ে উঁরা আলোচনা করছিলেন। তখনই মিস্টার হ্যারি আমায় ডেকে কফি বানাতে বলেন।
তার মানে আঙ্কলের ঘরে তখন আর কেউ নেই?
না, মিস্টার কুরিয়েন ছিলেন। উনি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ, আঙ্কলের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে প্রেয়ার করছিলেন। আমি ওঁকেও এককাপ কফি দিই।
মিস্টার কুরিয়েন ছিলেন কতক্ষণ?
কফি শেষ করেই তো চলে গেলেন। ফের সেই সকালে এসেছিলেন।
তুমিই শুধু রয়ে গেলে মিস্টার আরাকিয়েলের ঘরে?
একা ছিলাম না। কাপগুলো রাখতে এসে জেসমিনের রুমে গিয়েছিলাম। আন্টিকে দেখতে। ফিরে দেখি, মিস্টার হ্যারি আর অ্যালবার্ট বসে আছেন আঙ্কলের পাশে।
তারপর?
ওঁরা আমায় বললেন একটু রেস্ট নিতে। আমার একদম ইচ্ছে করছিল না। আঙ্কল আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, নিজের মেয়ের মতো মনে করতেন…
নির্মলার গলা আবেগে বুজে এল। ঘনঘন চোখ মুছছে। মিতিন যেন দেখেও দেখল না। কাঠখোট্টাভাবে বলল, আর দ্বিতীয়বার কফি করতে গেলে কখন?
সাড়ে তিনটে নাগাদ। মিস্টার হ্যারির ঢুলুনি আসছিল, ঘুম তাড়াতে…।
তুমি ছাড়া তখন কি মিস্টার হ্যারিই শুধু আঙ্কলের কাছে…?
অ্যালবার্টও ছিল। ওদের কফি দিয়ে এর পর আমি নিজের রুমে যাই।
শুতে?
না। মা মেরির কাছে প্রার্থনা করছিলাম, আঙ্কলের আত্মা যেন শান্তি পায়।
ফের আঙ্কলের ঘরে এলে কখন?
ভোর হওয়ার মুখে-মুখে।
তখন ঘরে কে কে ছিল?
কেউ না। অ্যালবার্ট নীচে চলে গিয়েছিল। মিস্টার হ্যারি ঘুমোচ্ছিলেন। ড্রয়িংরুমে। আমি গিয়ে বসার পরই অবশ্য মিস্টার হ্যারি জেগে যান। তারপর সকাল হওয়া পর্যন্ত তো আমি আর মিস্টার হ্যারি…। নিৰ্মলা মিতিনের চোখে চোখ রাখল, পুলিশকেও আমি একই কথা বলেছি। মিলিয়ে দেখবেন।
ঠিক আছে, তুমি যাও জেসমিনকে বলল, আমরা ড্রয়িংরুমে আসছি। ওখানেই কফি খাব।
নিৰ্মলা চোখের আড়াল হতেই টুপুর কলকলিয়ে উঠল, নির্মলাকে পুরো বিশ্বাস কোরো না মিতিনমাসি। ওর চোখ দুটো মোটেই সুবিধের নয়।
দুনিয়ায় কজনই বা পুরো সত্যি বলে রে টুপুর! ঘেঁটে-ঘেঁটে সত্যিটাকে বের করতে হয়।
কিছু কি ধরতে পারলে?
সবে তো কলির সন্ধে। মিতিন মৃদু হাসল, চল, কফিতে চুমুক দিয়ে একতলার কাজটাও আজ চুকিয়ে ফেলি।
শুধু কফি নয়, সঙ্গে এবার প্লেটভর্তি কাজু-চানাচুর। জেসমিন জোর করে একখানা খামও ধরিয়ে দিল মিতিনকে। অগ্রিম বাবদ চেক। না নিলে আন্টির নাকি অস্বস্তি হবে।
ইসাবেলের সঙ্গে অবশ্য আর দেখা হল না মিতিনদের। তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন ঘরে। জেসমিনকে বিদায় জানিয়ে মিতিন-টুপুর এসেছে ডিসুজাদের দরজায়।
একবার নয়, বারতিনেক বেল বাজানোর পর পাল্লা খুলেছেন দশাসই চেহারার এক প্রবীণ। বছর সত্তরের মানুষটির গায়ের রং ঈষৎ তামাটে, মাথাজোড়া টাক, চোখের পাতা ফোলা-ফোলা। পরনে গ্যালিস দেওয়া প্যান্ট আর হাফহাতা গেঞ্জি।
হাসি হাসি মুখে বৃদ্ধ বললেন, ইয়েস?
ইংরেজিতেই কথা শুরু করল মিতিন। হেসে বলল, আমি দোতলার হিরে চুরির ব্যাপারে তদন্ত করতে এসেছি।
কী চুরি?
হিরে। মিস্টার জোসেফ আরাকিয়েলের।
না না, আমি মিস্টার ডিসুজা। আরাকিয়েলরা উপরে থাকে। ওই যে সিঁড়ি।
টুপুর আর মিতিন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ভদ্ৰলোক বোধ হয় কানে ভাল শোনেন না। এর সঙ্গে কীভাবে কথা চালানো যায়?
তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে মিতিন নিজের কার্ডটা বের করে দিল। চোখ থেকে অনেকটা তফাতে ধরে পড়লেন পিটার। তারপর একবার মিতিনকে দেখছেন, একবার টুপুরকে।
গলা সামান্য চড়িয়ে মিতিন বিনীতভাবেই বলল, আমরা কি ভিতরে যেতে পারি?।
ও শিওর। কাম ইন।
বড়সড় ড্রয়িংরুমখানা রীতিমতো অবিন্যস্ত। সোফাগুলো দামি, কিন্তু এখন বেশ তেড়াবেঁকা দশা। কাগজ, জলের বোতল, আর সিগারেটের প্যাকেট ছড়িয়ে আছে যত্রতত্র। সেন্টার টেবিলে তাস। ঘরটা বোধ হয় পরিষ্কারও হয় না নিয়মিত। আসবাব-কার্পেট মেঝেতে ধুল্লের আস্তরণ।
মিতিন-টুপুর অন্দরে আসতেই পিটার যেন খানিক ব্যস্ত হয়েছেন। বিছানো তাস প্যাকেটে ভরতে-ভরতে বললেন, বোসো। বিপত্নীকের ফ্ল্যাট তো, একটু অযত্নেই থাকে।
না না, ঠিক আছে। মিতিন আর টুপুর বসেছে পাশাপাশি। মিতিন ফের গলা তুলে বলল, আপনি নিশ্চয়ই হিরে চুরির সংবাদটা জানেন?
জানব না? এত থানা-পুলিশ হয়ে গেল! পিটারের ঘড়ঘড়ে গলা বেজে উঠল, ওফ, পুলিশ আমাদের যা নাস্তানাবুদ করেছে। অ্যালবার্ট, মানে আমার ছেলে তো বাড়িতে থাকতেই চাইছে না। এমনিই মা মারা যেতে কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেল…
এখনও বুঝি উনি বাড়ি নেই?
আজ একটা কাজে বেরিয়েছে। দুজন ফরাসি টুরিস্টকে কলকাতা দেখাচ্ছে।
গাইডের কাজ করেন বুঝি?
ওই আর কী। ও যে কখন কী করে…।
টুপুর কানে কানে মিতিনকে বলল, তা হলে আর এখানে বসে কী লাভ? চলো, উঠে পড়ি।
মিতিন যেন শুনেও শুনল না। সামান্য ঝুঁকে পিটারকে বলল, আপনাকে কি কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি? জেরা নয়, কৌতূহল।
বলো কী জানতে চাও? পিটার টানটান হলেন, তবে আমি কিন্তু ওই চুরির ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না।
হিরেটার ব্যাপারে তো জানেন?
জোসেফের মুখে শুনেছি। ওর ঠাকুরদার ঠাকুরদা ছিলেন সুরাটের নামী ডাক্তার। গুজরাতের কোনও এক স্থানীয় রাজাকে কঠিন অসুখ থেকে বাঁচিয়ে ওই হিরে উপহার পেয়েছিলেন। জোসেফ বড় সাবধানে রাখত রত্নটিকে।
আপনি কখনও হিরেটা দেখেছেন?
না। অনাত্মীয় কাউকে দেখানোর নাকি রেওয়াজ ছিল না।
আরাকিয়েল পরিবার সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
আমি ওদের খুব সম্মান করি। অর্থবান আর্মেনিয়ান হিসেবে জোসেফের একটা অহংকার ছিল বটে, তবে আচার-ব্যবহারে কখনও সৌজন্যের অভাব দেখিনি। সত্যি বলতে কী, দীর্ঘদিন রেলে চাকরি করেছি, রিটায়ারমেন্টের আগে ডিজিএম হয়েছিলাম, কিন্তু জোসেফের তুলনায় আমি তো নেহাতই চুনোপঁটি। অথচ জোসেফ আমাকে বন্ধুর মতোই দেখত। ইদানীং জোসেফ দানধ্যানও করছিল খুব। কলকাতার আর্মেনিয়ান কলেজ অ্যান্ড ফিলানথ্রপিক অ্যাকাডেমিতে মোটা ডোনেশন দিত। প্রায়ই বলত, বউটউ না থাকলে গোটা সম্পত্তিটাই নাকি লিখে দিত অ্যাকাডেমিকে, কোনও হোমটোম করার জন্যে। আর্মেনিয়া থেকে অনেক গরিব-দুঃখী ছেলে এখানে এসে পড়াশুনো করছে তো, তারা যেন এখানে একটা আস্তানা পায়। মিতিনের ভুরুতে পলকা ভাঁজ পড়েই মিলিয়ে গেল, আর মিসেস আরাকিয়েল কেমন? যথেষ্ট সহৃদয় মহিলা। আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর মিসেস আরাকিয়েল যেভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তা বলার নয়। তাই তো সেদিন দুঃসংবাদটা পেয়েই অ্যালবার্টকে নিয়ে উপরে ছুটলাম। অ্যালবার্ট এমনই অবশ্য দোতলায় বেশি যেতে চায় না…।
কেন?
জেসমিন ওকে তেমন পছন্দ করে না যে। মেয়েটা একটু নাকউঁচু ধরনের। ওর মামারা ছিল গালফুন ফ্যামিলির, সেই দেমাকেই যেন ফুটছে।
টুপুর জিজ্ঞেস করল, গালনরা খুব বড়লোক ছিলেন বুঝি?
শুধু বড়লোক কী বলছ, টাকার কুমির। জোহানেস গালস্টুন তো এক সময় সাড়ে তিনশোখানা বাড়ি বানিয়েছিলেন কলকাতায়। দক্ষিণ কলকাতার কুইন্স পার্ক, সানি পার্ক, ওঁরই হাতে তৈরি। এখন যেখানে নিজাম প্যালেস দ্যাখো, ওই জায়গাটাও ছিল গালনদের। বিশাল একটা পার্ক ছিল ওখানে। গালস্টুনদেরই নামে। তারপর তো হায়দরাবাদের নিজাম জায়গাটা কিনে…।
পিটার বকবক করেই চলেছেন। মিতিন থামাল বৃদ্ধকে। গল্পের মাঝেই প্রশ্ন জুড়ল, আপনার সঙ্গে জেসমিনের সম্পর্ক কী রকম?
আমিও ওই মেয়ের সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলি না। এমন অসভ্য… আমার ফ্ল্যাটের পাশেই বাহারি মোমবাতি বানাচ্ছে… ভুলেও একটা উপহার দিল না কোনও দিন!
সত্যি, এ ভারী অন্যায়। মিতিন ভ্রুভঙ্গি করল, আচ্ছা, হ্যারির সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?
অল্পস্বল্প। দেখা হলে হাসে, কেমন আছি জিজ্ঞেস করে…. তবে অ্যালবার্টের সঙ্গে ওর খাতিরটা আর-একটু বেশি।
কী করে হল?
শুনেছি হ্যারির হোটেল শিলটনকে ও টুরিস্ট জোগাড় করে দেয়।
বুঝলাম। মিতিন কবজি উলটে ঘড়ি দেখল। দুম করে প্রশ্ন থামিয়ে বলল, অনেক ধন্যবাদ মিস্টার ডিসুজা। আজ তা হলে উঠি। পরে একদিন অ্যালবার্টের সঙ্গে নয় মোলাকাত হবে।
ওই হতচ্ছাড়াকে কি সহজে বাড়িতে পাবে? পিটার মাথা নাড়লেন, বরং অ্যালবার্টের মোবাইল নম্বরটা রাখো। তবে হিরের ব্যাপারে ও কিছু বলতে পারবে বলে মনে হয় না।
মিতিন আর কথা বাড়াল না। নম্বরটা চুপচাপ তুলে নিল নিজের মোবাইলে।
পিটারের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে টুপুর ফিক করে হাসল, চেঁচিয়েচেঁচিয়ে কথা চালাতে গিয়ে তোমার গলা চিরে যায়নি মিতিনমাসি?
ওফ, তাও আবার ইংরেজিতে। মিতিনও হাসছে, একটা অভিজ্ঞতাও হল। ভাবছি এবার থেকে জেরা করতে বেরোলে ব্যাগে লবঙ্গ রেখে দেব।
কুরিয়েনের ফ্ল্যাটে অবশ্য চিৎকারের প্রয়োজন হল না। ফটরফটর ইংরেজি বলারও নয়। বছর ষাটেকের কেরালাইট ক্রিস্টানটি ভালই বাংলা জানেন। সম্ভবত ব্যবসার সুবাদেই। শীর্ণকায় মিসেস কুরিয়েনও বোঝন মোটামুটি। তবে মিতিনের ভিজিটিং কার্ড দেখে এবং আগমনের উদ্দেশ্য শুনে দুজনের কেউই প্রীত হলেন না।
মিতিনরা বসতে না-বসতেই কুরিয়েন গজগজ করে উঠলেন, এভাবে আমাকে বারবার জ্বালাতন করার কী অর্থ?
বিরক্তিটাকে বিশেষ আমল দিল না মিতিন। ঠান্ডা গলায় বলল, উপায় নেই বলেই তো আসা। মিস্টার আরাকিয়েলের মৃত্যুর রাতে আপনার হোয়্যার অ্যাবাউটস্টা জানাটা খুব ভাইটাল।
পুলিশকে তো বলেছি।
আমাকেও বলুন।
আপনি কে, অ্যাঁ? লুঙ্গি-শার্ট পরা কুরিয়েন তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, মিসেস আরাকিয়েল আপনাকে অ্যাপয়েন্ট করেছেন বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন? আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।
বলবেন কি না বলবেন সে আপনার ইচ্ছে। মিতিনের স্বর আচমকাই কঠিন, মনে রাখবেন, লজিক্যালি আপনিই কিন্তু মেন সাসপেক্ট।
মোটা-মোটা সাদা গোঁফের ফাঁক থেকে প্রশ্ন ঠিকরে এল, কোন হিসেবে?
কারণ তো অনেক। প্রথমত, আপনার চিটফান্ডের অবস্থা এখন খুব ভাল নয়। যারা টাকা রেখেছিল, তুলে নিতে চাইছে। আর আপনিও টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, আপনার আগের কোম্পানিগুলো… মানে এখনকার বিজনেস আগে যেসব নামে ছিল…।
দাঁড়ান-দাঁড়ান। আমার ব্যবসার খবর আপনি কোথা থেকে পেলেন?
বাজারে আপনার রেকর্ড তো ভাল নয় স্যার। খবর তো বাতাসে উড়ছে। মিতিন বেতের চেয়ারে হেলান দিল, তারপর ধরুন, চটজলদি লাভের আশায় যেসব শেয়ার কিনেছিলেন, সেগুলোও তো ডুবুড়ুবু। হালে পানি পেতে এখন আপনার অনেক টাকার দরকার। পুলিশ তো বলছে, আপনি সম্ভবত ডায়মন্ডটা বেচে…।
বেচার প্রমাণ পুলিশের হাতে আছে নাকি?
প্ৰমাণ পুলিশ ঠিক বের করে নেবে। একবার হাতে দড়ি পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছেন, এবার আপনাকে গারদে পোরা এমন কিছু শক্ত হবে না।
আপনি কিন্তু বাড়ি বয়ে এসে আমায় ইনসাল্ট করছেন ম্যাডাম।
ইনসাল্ট কি সতৰ্কবাণী সেটা পরে টের পাবেন। শুধু শুনে রাখুন, আপনি যে সেদিন সিন্দুক খুলেছিলেন তার কিন্তু একজন প্রত্যক্ষদর্শী আছে।
মিথ্যে। ডাহা মিথ্যে। কুরিয়েন প্রায় লাফিয়ে উঠেছেন, আমি সিন্দুক স্পর্শও করিনি।
নির্মলা যখন কফি বানাতে গেল, তখন কি একা ঘরে শুধুই ধ্যান করছিলেন? ভুলে যাবেন না, ও ঘরের চারটে দরজাই তখন খোলা।
মোটেই না। ভিতরবারান্দার দরজা তখন ভেজানো ছিল।
প্রেয়ার করতে করতে সেটাও লক্ষ করেছেন তা হলে?
হ্যাঁ…না…মানে…আগেই চোখে পড়েছিল।
বটে?
মিতিনের ধারাল দৃষ্টির সামনে এবার যেন বেশ মিইয়ে গেলেন কুরিয়েন। স্বর নরম করে বললেন, আপনি কিন্তু মিছিমিছি আমাকে জড়াচ্ছেন ম্যাডাম। মা মেরির নামে শপথ করে বলছি, হিরে আমি নিইনি।
এতক্ষণে মিসেস কুরিয়েনেরও বাক্য ফুটেছে। ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, আমার স্বামী আর যাই হোন, চোর-বাটপাড় নন। নেহাতই সংসারী মানুষ আমরা। দু-দুটো মেয়ে আছে, তাদের ভাল ঘরে বিয়ে দিয়েছি… সমাজে আমাদের প্রতিষ্ঠাও কম নয়। এক সময় ব্যবসায় একটু এদিক-ওদিক হয়েছিল ঠিকই, তা বলে উনি অন্যের বাড়ি থেকে হিরে হাতিয়ে নেবেন? এ আমি মরে গেলেও বিশ্বাস করব না। ঢের হয়েছে, এখন আপনারা আসতে পারেন।
মিস্টার কুরিয়েনের পাংশু হয়ে থাকা মুখখানা দু-চার সেকেন্ড দেখল মিতিন। তারপর মিসেস কুরিয়েনকে বলল, বেশ তো, চলে যাচ্ছি। আপনিই বরং আপনার হাজব্যান্ডকে একটা প্রশ্ন করবেন।
কী?
একা ঘরে মিস্টার আরাকিয়েলের মৃতদেহের উপর ঝুঁকে উনি কী করছিলেন।
বলেই আর বসল না মিতিন। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসেছে টুপুরকে নিয়ে।
টুপুরের পেট কৌতূহলে ফুলছিল। গাড়িবারান্দায় এসে জিজ্ঞেস করল, এটা কেমন হল মিতিনমাসি? জানলে কী করে মিস্টার কুরিয়েনই সিন্দুক খুলেছিলেন?
মিতিন মুচকি হাসল, ধরে নে, মনশ্চক্ষে দেখেছি।
তুমি শিওর, হিরে মিস্টার কুরিয়েনই নিয়েছেন?
ক্রমশ প্রকাশ্য। সবে তো পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানো শুরু হল। এবার দ্যাখ না, একটু-একটু করে কেমন ঝাঁঝ ছড়ায়।
আশ্চর্য! মিস্টার কুরিয়েনের ব্যবসার হালহকিকতই বা এত জেনে ফেললে কীভাবে?
দুয়ে-দুয়ে চার করে। মিতিন আলগা টোকা দিল টুপুরের মাথায়, বুদ্ধিটাকে খেলা, তা হলেই বুঝে যাবি।
.
০৬.
টুপুর বাংলা খবরের কাগজটা ওলটাচ্ছিল। পার্থমেসো যতক্ষণ থাকে, কাগজ তো হাতে পাওয়ার উপায় নেই। বাথরুমেও নিয়ে যায় আজকাল, কমোডে বসে খবর মুখস্থ করে। এ ছাড়া শব্দজব্দ তো আছেই। চায়ে চুমুক দিতে-দিতে শব্দজব্দ, ভাতের গরাস মুখে তুলতে-তুলতে শব্দজব্দ, এমনকী বেরনোর আগে জুতো পরতে পরতেও শব্দ মাথায় এলে টুক করে বসিয়ে দিচ্ছে ছকে। ভাগ্যিস আজ তাড়াতাড়ি প্রেসে ছুটল, নইলে থোড়াই এই সাড়ে নটায় কাগজ হাতে পেত টুপুর।
কিন্তু খবরের কী ছিরি। হাওড়ায় গুমখুন। পেরুতে ভূমিকম্প। ইরাকে বোমা বিস্ফোরণ। শ্যামনগরে রেল অবরোধ। উফ, একটাও কি সুসংবাদ থাকতে নেই? বেজার মুখে খেলার পাতায় গেল টুপুর। আছে, আছে। সানিয়া মির্জা জিতেছে কাল। সিনসিনাটি ওপেনে সানিয়া থার্ড রাউন্ডে উঠল। এক চেক প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে।
টুপুর ঝুঁকে পড়তে শুরু করল খবরটা। তিন সেটের লড়াই হয়েছে। প্রথম সেটে হেরে গিয়েছেন সানিয়া, পরের দুটো সেটে…।
আচমকাই মনঃসংযোগে ব্যাঘাত। মিতিনমাসি কথা বলছে মোবাইলে, অ্যাম আই টকিং টু মিস্টার অ্যালবার্ট ডিসুজা?
ব্যস, সানিয়া মির্জা মাথায়। টুপুর প্রায় চেঁচিয়ে বলতে যাচ্ছিল, তুমি অ্যালবার্টকে ফোন করছ… তার আগেই মিতিনমাসির আঙুল উঠে এসেছে ঠোঁটে। চুপ। এবং সঙ্গে সঙ্গে অন করে দিয়েছে লাউড স্পিকার। টুপুর শুনতে পেল একটা তড়বড়ে গলা ইংরেজিতে বলছে, ও আপনিই তা হলে কাল আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন?
হ্যাঁ স্যার। মিতিনের গলায় মধু ঝরছে, আপনার বাবার সঙ্গে আলাপ হল। কী চমৎকার মানুষ…।
তো? আমাকে ফোন করছেন কেন?
একটা খবর দেওয়ার ছিল। মিতিন ঝটিতি বলল, হিরের সন্ধান পেয়ে গিয়েছি।
এক সেকেন্ড বুঝি থমকে রইল গলাটা। তারপরই উচ্ছাস উড়ছে, পেয়ে গেলেন? এত তাড়াতাড়ি? কে নিয়েছিল?
নামটা বলা এখনই ঠিক হবে না। হিরে এখনও হাতে আসেনি। জাস্ট একটা স্টেপ বাকি।
ওহ?
আপনার কাছ থেকে শুধু একটা ইনফরমেশন চাই। তা হলেই হিরেটা লোকেট করে ফেলব।
কী বলুন তো?
ফোনে বলা যাবে না। আপনার সঙ্গে যদি একবার দেখা করা যায়…।
কখন?
যদি আজ দুপুরে সময় দেন…।
কিন্তু আমি যে আজ হোল-ডে বিজি।
মাঝে কি একটু টাইম বের করা যায় না?
এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কেন বলুন তো? খুব ফিশি মনে হচ্ছে।
গোটা ব্যাপারটাই তো ফিশি মিস্টার ডিসুজা। আমার মনে হয়, আপনিও চান হিরেটা এখনই উদ্ধার হোক। আফটার অল আপনাকেও তো কম হ্যারাসড হতে হয়নি।
তা ঠিক। জেসমিনকেও একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। মহারানির স্পৰ্ধা কত, অ্যালবার্ট ডিসুজাকে কিনা চোর ভাবে! গলাটা একটু থেমে আবার বেজে উঠেছে, একটা কথা বলুন তো। জেসমিনই কি হিরেটা হাতিয়েছে?
দেখা হলে সব জানতে পারবেন। তা হলে কখন আমরা মিট করছি?
এক কাজ করুন। দেড়টা… না না, দুটো নাগাদ চলে আসুন।
কোথায়?
ভিক্টোরিয়ার সাউথ গেটে।
ফাইন। আমি পৌঁছে যাব।
মোবাইল অফ করে মিতিন বলল, তা হলে আমরা দেড়টায় রওনা দিই, কী বল?
টুপুর ভুরু কুঁচকে বলল, সে নয় যাওয়া যাবে। কিন্তু তুমি এত কায়দা করে ডাকলে কেন?
জাস্ট একটু ভাঁজ মেরে নিলাম। নইলে থোড়াই রাজি হত।
তাও… তোমাকে গিয়ে তো হিরের ব্যাপারে কিছু একটা বলতে হবে।
তখনকার কথা তখন ভাববখন। যা, সকাল সকাল স্নানটা সেরে নে।
তক্ষুনি-তক্ষুনি অবশ্য উঠল না টুপুর। হাতে এখনও অনেক সময়, খেলার পাতাটা পড়ল খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে। তারপর গিয়ে উঁকি দিয়েছে রান্নাঘরে। আজ চিতল মাছের গাদা এনেছে পার্থমেসো। সাবধানে কাঁটা ছাড়াচ্ছে আরতিদিদি, মুইঠা বানাবে। ওয়াও! তাক থেকে বয়াম পেড়ে টুপুর কুলের আচার বের করল খানিকটা। চাখতে-চাখতে বুমবুমের সঙ্গে খুনসুটি চালাল কিছুক্ষণ। খুব টিনটিন পড়ার নেশা হয়েছে বুমবুমের, ছোঁ মেরে বইটা কেড়ে নিতেই সে কী চিলচিৎকার! ইতিমধ্যে হাতিবাগান থেকে মার ফোন এসে গেল। মিতিনমাসির কাছে টুপুরের সারাদিনের রুটিন জানতে চাইছেন মা। এর পরই তার ডাক পড়বে টের পেয়ে টুপুর সটান বাথরুমে।
স্নান করতে করতে হঠাৎই মাথায় ফিরে এল হিরে চুরির ঘটনাটা। কুরিয়েনকেই যদি সন্দেহ মিতিনমাসির, তা হলে আবার অ্যালবার্টকে ডাকাডাকি কেন? মিস্টার আরাকিয়েলের কাছে একা থাকাই যদি বিচার্য হয়, নিৰ্মলা মেরি বিশ্বাস তবে ছাড় পায় কোন হিসেবে? হিরে সরিয়ে অন্যত্র লুকিয়ে রাখা নির্মলার পক্ষে কী এমন কঠিন কাজ। হিরের তো লয়ক্ষয় নেই, কম্পাউন্ডেই কোথাও মাটিতে পুঁতে রাখলে কে খোঁজ পাবে? রান্নাঘরের কৌটোবাটায় থাকলেই বা দেখছে কে? আটা-ময়দার লেচিতেও তো হিরেটা পুরে রাখা যায়। তারপর কোনও একদিন মওকা বুঝে কেটে পড়লেই ব্যস, দু কোটি টাকার মালকিন। উহুঁ, নির্মলাকেই ভাল করে চেপে ধরা উচিত।… বাহাদুরকেই বা ধর্তব্যের মধ্যে আছে না কেন মিতিনমাসি? সেদিন রাত দুটোর পর বাহাদুর কি একবারও দোতলায় ওঠেনি? সারারাত দরজা খোলা… কেউ এ ঘরে নিদ্রায়, কেউ ও ঘরে… তখন যদি বাহাদুর…? নাহ, মাথা খারাপ করে লাভ নেই। দেখাই যাক না, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।
পাক্কা দুপুর দুটোয় টুপুররা পৌছে গেল ভিক্টোরিয়ায়। চড়া রোদে পুড়ছে পৃথিবী। ট্যাক্সি থেকে নেমেই মাসি-বোনঝি দেখতে পেল, ভিতরের নুড়ি ছড়ানো পথ ধরে বাইরে আসছে এক বিচিত্রদর্শন মানুষ। চেহারায় নয়, সাজপোশাকে। টাইট জিনসে অজস্র তাপ্পি, ঢোল্লা টি-শার্টে রামধনু রং ঝিকমিক। বয়স তিরিশপঁয়ত্রিশ। থুতনিতে ছাগলদাড়ি। চোখে সবজেটে সানগ্লাস। চুল সজারু-কাঁটার মতো খাড়া-খাড়া।
টুপুর অস্ফুটে বলল, অ্যালবার্ট নাকি?
মনে হচ্ছে। মিতিন মোবাইলের বোতাম টিপল, দাঁড়া, ভেরিফাই করে নিই।
মোক্ষম কৌশল। বিচিত্ৰদর্শন এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল, হঠাৎই পকেট থেকে সেলফোন বের করে নম্বর দেখতে লাগল।
সঙ্গে-সঙ্গে মিতিন হাত তুলল, হাই। আমি এখানে।
কাঁধ দোলাতে-দোলাতে এগিয়ে এল অ্যালবার্ট। সানগ্লাস খুলে টুপুরকে একবার দেখে নিয়ে মিতিনকে বলল, আপনিই মিসেস ডিটেকটিভ?
ইয়েস। …চলুন না, ছায়ায় গিয়ে কথা বলি।
আপত্তি করল না অ্যালবার্ট। তবে শিরীষগাছের নীচে সরে এসে বলল, আমার কিন্তু হাতে সময় নেই। ভিতরে টুরিস্ট আছে।
জাস্ট দু-চার মিনিট। মিতিন অল্প হাসল, একটা-দুটো পয়েন্ট মিলিয়ে নিয়েই আপনাকে ছেড়ে দেব।
কী পয়েন্ট?
জেসমিন সেদিন সারারাত কী করছিল?
আগেই ধরেছিলাম, সরষের মধ্যে ভূত! অ্যালবার্ট খসকুটে মার্কা দাড়িতে হাত বোলাল, নইলে আমার পিছনে ও পুলিশ লেলায়।
বলুন,বলুন। মনে করে-করে বলুন। আপনার উপরেই কিন্তু সব নির্ভর করছে। কিছু মিস করবেন না।
আমার নিখুঁত স্মরণে আছে। নির্মলা এসে ডেথ-নিউজটা দিতেই বাবা হাউমাউ করে উঠলেন। তাঁকে নিয়ে গেলাম দোতলায়। জেসমিন তখন.. অ্যালবার্ট নাক-চোখ-মুখ একসঙ্গে কুঁচকোল, ইয়েস, জেসমিন তখন জোসেফ আঙ্কলের মাথার পাশে। ফোঁচফোঁচ করে ন্যাকাকান্না কাঁদছে। দৃশ্যটা সহ্য হচ্ছিল না, বাবাকে নীচে পৌঁছে দিয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসেছিলাম। হ্যারি আসার পর আবার ঢুকলাম আঙ্কলের ঘরে।
মিস্টার হ্যারি এলেন কখন?
অ্যারাউন্ড টুয়েল্ভ। জেসমিন তখন আন্টিকে সান্ত্বনাবাক্য শোনাচ্ছে।
তারপর জেসমিন কী করল?
অনেকক্ষণ তো বসেই ছিল ওখানে। তারপর তো আন্টিকে নিজের রুমে নিয়ে গেল।
তখন কটা বাজে?
রাত পৌনে দুটো… দুটো…।
আর তো রাতে জেসমিনকে দেখেননি?
উহুঁ, একবার যেন দেখেছিলাম। কখন যেন… কখন যেন…?
ভাল করে মনে করুন। স্টেপ বাই স্টেপ।
ওয়েট, ওয়েট। ওরা যাওয়ার পর তো আমি আর হ্যারি এলাম লাইব্রেরিরুমে। আঙ্কলের সৎকার নিয়ে হ্যারির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। হ্যারির মাথা ধরেছিল খুব, নির্মলাকে কফি বানাতে বলল। নির্মলাও গেল কিচেনে।
তখন নিশ্চয়ই মিস্টার আরাকিয়েলের বডির পাশে কেউ নেই?
নো, নো। কুরিয়েন আঙ্কল ছিলেন তো। উনি তো কফি খেয়ে নীচে গেলেন।
আর আপনারা? লাইব্রেরিরুমে রইলেন?
উহুঁ, আমরা তো তখন ড্রয়িংরুমে। ইনফ্যাক্ট, কফিটাও তো খেলাম ড্রয়িংরুমে বসে। হ্যারি স্যান্ডলাইন থেকে পরপর ফোন করছিল যে। রিলেটিভদের।
অত রাতে আত্মীয়দের ফোন?
নট ইন দি কান্ট্রি ম্যাম। অস্ট্রেলিয়ায়, স্টেটসে, আর্মেনিয়ায়…। গোটা বিশ্বেই তো ওদের আত্মীয় ছড়ানো। অ্যালবার্ট ডিঙি মেরে ভিক্টোরিয়ার গেটের ওপাশটা দেখে নিল। ফের ড়ুব দিয়েছে স্মরণে। দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, নাহ, ওই সময় জেসমিন আসেনি।
তা হলে?
ফোনটোন সেরে কিছুক্ষণ পর আবার আমরা জোসেফ আঙ্কলের কাছে গেলাম। হ্যারি ছেলেবেলার গল্প বলছিল। রিগার্ডিং জোসেফ আঙ্কল। শুনছিলাম। রেসের মাঠে যাওয়ার আগে জোসেফ আঙ্কল নাকি একবার হ্যারিদের বাড়ি যেতেনই। হ্যারি নাকি আঙ্কলের গুডলাক ছিল…।
হ্যারিরা বরাবরই আলাদা থাকতেন নাকি?
শুনেছি বিয়ের পরই হ্যারির বাবা কারনানি ম্যানশনে চলে যান।
কেন?
দ্যাট আই কান্ট সে। আমার অন্যের ব্যাপারে জানার অত কিউরিওসিটি নেই।
বেশ। তারপর কী হল?
নির্মলাও শুনছিল গল্প। আমরা ওকে নিজের রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে বলেছিলাম…। যায়নি। দেন, হ্যারি আবার একবার কফি চাইল। সেকেন্ড টাইম কফি দিয়ে নির্মলা অবশ্য আর বসেনি, রুমে চলে যায়।
তখন বুঝি জেসমিনকে দেখলেন?
ইয়েস, ইয়েস। তখনই তো…। আমরা ড্রয়িংরুমে গেলাম সিগারেট খেতে। সেই সময়েই জেসমিন ড্রয়িংরুমে একবার উঁকি দিয়েছিল। আমি আছি দেখেই বোধ হয় আর ভিড়ল না, চলে গেল।
তখন টাইম কত?
জোসেফ আঙ্কলের রুমে বসে কফি খেলাম অ্যারাউন্ড পৌনে চারটে। কফি শেষ করে হ্যারি আমার কাছে সিগারেট চাইল। আমি প্যাকেট নিয়ে যাইনি… নীচে গেলাম আনতে। ফিরেছিলাম বোধ হয় মিনিট পনেরো পর।
অতক্ষণ লাগল কেন?
পেটটা একটু আপসেট লাগছিল। টয়লেটে গিয়েছিলাম। লজ্জা-লজ্জা মুখে হাসল অ্যালবার্ট, ফিরে ড্রয়িংরুমে বসি। উইথ হ্যারি। অর্থাৎ ধরুন… তখন চারটে বেজেছে। তারপর তো হ্যারি সোফায় হেলান দিল, আমিও নীচে এসে শুয়ে পড়লাম।
আবার কখন গেলেন দোতলায়?
বেশ লেটেই। তখন উপরে বাড়িভর্তি লোক। আঙ্কলকে পিস হ্যাভেনে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় চলছে। বলেই অ্যালবার্টের চটজলদি প্রশ্ন, কী বুঝলেন? জেসমিনই হিরেটা সরিয়েছে তো?
পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া গেল না। মিতিনের স্বর সহসা বদলে গিয়েছে। ঈষৎ রুক্ষভাবে বলল, আপনি কিন্তু কিছু একটা বাদ দিয়ে গেলেন অ্যালবার্ট।
কখনও না। নেভার। অ্যালবার্ট জোরে-জোরে ঘাড় নাড়ছে, সব তো বললাম, ইন ডিটেল।
উহুঁ। একটা খিঁচ রয়েই যাচ্ছে। মিতিনের চোখ সরু, ওয়ান অফ ইওর অ্যাকশনস ইজ মিসিং।
বিলিভ মি, দ্যাট নাইট যা যা করেছি, সব বলেছি। আপ অন গড। মিথ্যে বললে আমার জিভ খসে পড়বে।
মিতিন একটুও গলল না। একই সুরে বলল, কী খসবে দেখতেই পাবেন। একটা কথা ভুলবেন না, সাসপেক্ট লিস্টে আপনার নামটা কিন্তু একেবারে উপরের দিকে।
কী অন্যায় কথা! কেন?
কারণ, হিরে হাতানোর সুযোগ আপনি পেয়েছিলেন। এবং সেটি পাচার করা আপনার পক্ষেই সবচেয়ে সহজ।
ও গড, কেস যে পুরো উলটে গেল! অ্যালবার্ট কটমট তাকল, আমাকে ফাঁসানোর জন্যই ডেকেছেন নাকি?
ফাঁসার মতো কাজ করে থাকলে তো ফাঁসবেনই। মিতিনের স্বর আরও কঠিন, শেষরাত্তিরে সিন্দুকটা খুলেছিলেন কেন, অ্যাঁ?
আ-আ-আ-আ-আমি?
হ্যাঁ। আপনিই। অবাক হওয়ার ভান করবেন না। মিতিন চাপা গলায় ধমক দিল, শুনুন, যেসব বিদেশিকে নিয়ে আপনি ঘোরেন, তাদের কাউকে হিরেটা পাচার করেছেন কিনা সেটা কিন্তু আপনাকেই প্রমাণ করতে হবে। অবশ্য এক্ষুনি নয়। পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করার পর।
পুলিশ আমায় অ্যারেস্ট করবে?
জবাব না দিয়ে টুপুরকে টানল মিতিন, চল।
অ্যালবার্ট কাতর স্বরে বলল, বিশ্বাস করুন, হিরে আমি নিইনি। আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব ছিল না।
মিতিন ঘুরে তাকাল, কেন?
অ্যালবার্টের মুখে আর বাক্য নেই। মাথা ঝাঁকাচ্ছে, দু হাত নাড়ছে, কিন্তু আর স্বর ফুটছে না। ছিলেছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে দূরে চলে গেল, পরক্ষণে ভিক্টোরিয়ার গেট পেরিয়ে অন্দরে। হনহনিয়ে হাঁটছে, আর তাকাচ্ছে ঘুরে ঘুরে।
টুপুর ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখে মিতিনকে দেখছিল। বিড়বিড় করে বলল, তুমি তা হলে মিষ্ট্রি সলভ করে ফেলেছ? কুরিয়েন নয়, এই অ্যালবার্টই..?
ধীরে বালিকা, ধীরে। মিতিনের দৃষ্টিতে রহস্যের ঝিলিক, কলি সবে সন্ধে পেরিয়ে রাত্তিরে পা রাখল। ভোর হতে এখনও ঢের বাকি।
সত্যি করে বলো তো, তুমি কাকে সন্দেহ করছ?
প্রায় সবাইকেই। মিতিন হাসল, আমিও এখন মইসাহেবের দলে।
ও বলবে না? টুপুর ঈষৎ আহত, এখন তবে কী কর্তব্য। গৃহে প্রত্যাবর্তন?
উহুঁ। এবার হোটেল শিলটন। মিশন হ্যারি।