তিন-তিনটে দিন কেটে গেছে। তদন্ত কীভাবে এগোচ্ছে, আদৌ এগোচ্ছে কি না, কিছুই বুঝতে পারছিল না টুপুর। মিতিনমাসি হয় ঘণ্টার পর-ঘণ্টা কম্পিউটারে বসে থাকে, নয়তো মোবাইলে বকবক করে এর-ওর-তার সঙ্গে। হুটহাট বেরিয়েও যাচ্ছে যখন-তখন। কখনও তিন ঘণ্টা, কখনও পাঁচ ঘণ্টা। জিজ্ঞেস করলেও সদুত্তর মেলে না। মুচকি হেসে বলে, এখন চলছে ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজ। বাসমতী চাল ঘেঁটে দেখছি কাঁকর মেলে কিনা। এরকম হেঁয়ালিভরা জবাব শুনলে আর প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়?
বৃহস্পতিবার সকালে মিতিনের কিঞ্চিৎ ভাবান্তর দেখা গেল। জলখাবারের টেবিলে টোস্ট চিবোতে চিবোতে বলল, এবার তো রণক্ষেত্রে নেমে পড়তে হয় রে টুপুর।
মাসির কাছে ক’দিন পাত্তা না পেয়ে টুপুর মনে মনে বেশ আহত ছিল। অভিমানী সুরে বলল, কেন? পাঁজিতে বুঝি এবার শুভক্ষণ বেরিয়েছে?
অনেকটা তাই, মিতিন ঠোঁট টিপে হাসল, সাইমনের যাওয়ার প্রতীক্ষায় ছিলাম। কাল সন্ধেবেলার ফ্লাইটে তিনি সপরিবার ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়েছেন।
তোমার এনকোয়ারির সঙ্গে সাইমনের কী সম্পর্ক?
কিছুই না। তবে মিস্টার যোশুয়া নিষেধ করেছিলেন কিনা। তাঁর ছেলে চাইছিলেন না শোকের সময়ে এসব তদন্ত টদন্ত হোক, মিতিন ডিমসেদ্ধ ভেঙে মুখে পুরল, একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে।
কীরকম?
আমিও খানিকটা গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করে নিলাম।
যেমন?
যতীনের সম্পর্কে খানিকটা খোঁজখবর নিলাম।
কী জানলে?
ও চাকরি করছে এক বছরেরও কম। ডেভিড আর র্যাচেল ছেলের কাছ থেকে ফেরার পর যতীন মার্কুইস স্ট্রিটের বাড়িতে এসেছে।
তো?
তিনটে মৃত্যুর সময়েই যতীন মার্কুইস স্ট্রিটের বাড়িতে মজুত। সুতরাং ফাউল প্লে যদি কিছু ঘটে থাকে, সে তার সাক্ষীও বটে, সাসপেক্টও বটে। তারপর ধর প্রোফেসর, ডাক্তার, শ্যামচাঁদ সকলের সম্পর্কেই কিছু কিছু ইনফরমেশন পেয়েছি।
কীরকম? কীরকম?
ছটফট করছিস কেন। সময় হলেই জানতে পারবি। শুধু শুনে রাখ তিনজনের কেউই নিখাদ ভালমানুষ নন।
পার্থ নীরবে খাচ্ছিল। খেতে খেতেই খবরের কাগজের শব্দজব্দে ব্যস্ত। পুটুস করে বলে উঠল, ওরকম ভাসা ভাসা কিছু ইনফরমেশন আমিও দিতে পারি।
তাই বুঝি?
ইয়েস ম্যাডাম টিকটিকি। যেমন ধরো, কলকাতার ইহুদি সমাজে একটা চালু গুজব আছে। মাটুকদের যে কী ধনরত্ন আছে, তা নাকি মাটুকরা নিজেরাই জানে না।
কে বলল তোমায়? কোনও ইহুদির সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছ নাকি?
সরি। কলকাতার কোনও ইহুদিরই আমার বন্ধু হওয়ার বয়স নেই। সকলেই সত্তরের ওপারে। মাত্র এক পিসেরই বয়সটা কম। নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছ সে কে?
নাথান? টুপুর প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, যে কবরখানাটা পাহারা দেয়?
ওকে খুব সামান্য ভাবিস না। ও কলকাতার সমস্ত ইহুদি পরিবারেরই কেয়ারটেকার। তাদের বিপদে আপদে ডাক পেলে অমনি ছুটে যায়। আর কেউ মারা গেলে সমাধি দেওয়া পর্যন্ত সব দায়িত্ব ওর কাঁধে। নাথানের বাবা মা মারা গিয়েছেন, দাদা-দিদিরা সব চলে গিয়েছে ইজরায়েলে, ও একা কলকাতার ইহুদিদের জন্য পড়ে আছে। সব ইহুদি পরিবারই ওকে কিছু কিছু মাসোহারা দেয়, তাতেই ওর চলে কোনওমতে। পার্থ হাতের কাগজখানা সরিয়ে রাখল। মুখে একটা ভারিক্কি ভাব ফুটিয়ে বলল, কাল বিকেলে গিয়েছিলাম নারকেলডাঙায়। নাথানের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেছি। দেখলাম, ও এখানকার সব ইহুদি পরিবারেরই হাঁড়ির খবর রাখে। নাথানই আমায় বলল, আব্রাহাম মাটুকের ওই বাড়িতে গুপ্তধন থাকা মোটেই আশ্চর্যের নয়।
তুমিও তা হলে এখন ব্যাপারটা বিশ্বাস করছ?
ইয়েস। তবে আর একটা কথাও বলল নাথান। শুধু আব্রাহাম নন, তাঁর বাপ-ঠাকুরদারাও কোনও কালে গুপ্তধন খোঁজার চেষ্টা করেননি। ইহুদিদের ধর্মে নাকি বলে, পরিশ্রম করে যেটা পাবে, সেটুকুই তোমার প্রাপ্য। পূর্বপুরুষরা লোকচক্ষুর আড়ালে যদি কিছু রেখে গিয়ে থাকেন, তবে ধরে নিতে হবে জিহোভা চান না ওটা কেউ পাক।
এবার আমি তোমাকে কিছু জানাই? মিতিন মিটিমিটি হাসছে, যাঁর সুবাদে মাটুকদের আর্থিক প্রতিপত্তি, সেই শ্যালোম কোহেন শুধু বাণিজ্যই করতেন না। আর পাঁচটা ইহুদির মতো তাঁর সুদের ব্যবসাও ছিল। কারবারটা শুধু এ দেশে নয়, বিদেশেও চলত। এক আফগান তাঁর কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিল। সেই আফগান ছিল অনেক খনির মালিক। এখন যেখানে আফগানিস্তান-তাজিকিস্তানের বর্ডার, সেখানেই বদখশান প্রদেশে ছিল খনিগুলো। দামি দামি পাথর মিলত বদখশানের খনিতে। সেই আফগানটি ধার শোধ করার সময় কোহেনকে সুদের বদলে দিয়েছিল এক বিশাল সাইজের চুনি। অতএব কোহেনের ছোট জামাইয়ের পরিবারে ওই চুনিটি থাকাও মোটেই আশ্চর্যের নয়।
টুপুরের চোখ চকচক করে উঠল, তা হলে কি আমরা সেই চুনি উদ্ধারে নামব এবার?
ওটা পরে ভাবব। আপাতত আমাদের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য, তিনটে মৃত্যুর কারণ খোঁজা। চা রেখে গিয়েছে আরতি। মিতিন কাপে চুমুক দিল, এখন ফের সেই কাজই শুরু হবে।
মৃত্যুগুলো যে স্বাভাবিক নয়, সে ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত?
আগে খরগোশগুলোকে তো সংগ্রহ করি। তারপর জুড়ে দেখা যাক ঘোড়া হয়, না গাধা।
অর্থাৎ এখন চলবে ডেটা কালেকশন, তাই তো? টুপুর উৎসুক চোখে তাকাল, তা হলে আজ আবার আমরা ডেভিডসাহেবের বাড়ি যাচ্ছি?
তার আগে একবার শ্যামচাঁদ অগ্রবালের সঙ্গে মোলাকাত হওয়া দরকার।
কেন?
ধর, ভদ্রলোকের সঙ্গে ভালভাবে আলাপ জমানো। সেদিন কবরখানায় তো দুটো একটার বেশি কথা হয়নি।
মিতিনমাসির কিছু যে একটা উদ্দেশ্য আছে, বুঝতে অসুবিধে হয় না। টুপুর আর খোঁচাল না। শুধু জিজ্ঞেস করল, কখন বেরোচ্ছি আমরা?
দুপুরে। খাওয়া দাওয়ার পরে সরাসরি ওঁর বাড়িতেই যাব।
শ্যামচাঁদ অগ্রবালের নিবাসটি একেবারে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের উপরে। পুরনো এক পাঁচতলা বাড়ির গোটা দোতলাটা জুড়ে থাকেন শ্যামচাঁদ। গিয়ে বেল বাজাতেই দরজা খুললেন এক বয়স্কা মহিলা। মিতিন ফোন করে দিয়েছিল, মহিলা পরিচয় জেনে নিয়ে সামনের ঘরখানাতেই মাসি-বোনঝিকে বসিয়ে চলে গেলেন অন্দরে।
ঘরখানা মোটেই দেখার মতো নয়। ক্যাটকেটে সবুজ দেওয়াল, দামি দামি আসবাব, কিন্তু সেগুলো রাখার কোনও ছিরিছাঁদ নেই, মাথার উপর পুরনো ফ্যানখানার যথেষ্ট বিবর্ণ দশা। একদম বড় রাস্তার উপর হওয়া সত্ত্বেও এই ভরদুপুরেও কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার। শ্যামচাঁদ যে এক ধনী মানুষ, ঘরখানা দেখে আন্দাজ করা কঠিন।
মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর দর্শন মিলল বছর সত্তরের মানুষটির। পরনে ধুতি-ফতুয়া। হাতে চৌকো মতো স্টিলের পানের ডিবে।
সোফায় বসতে বসতে শ্যামচাঁদ বললেন, হঠাৎ আমাকে কেন জরুরত পড়ল ম্যাডাম?
মিতিন হেসে বলল, জানেন নিশ্চয়ই, ডেভিডসাহেব আমাকে কী কাজে লাগিয়েছেন?
শুনেছি। লেকিন আমি কীভাবে আপনাকে মদত করতে পারি?
আমি যা জিজ্ঞেস করব, তার জবাব দিলেই চলবে। তার বেশি আর কিছু দরকার নেই।
বহোত আচ্ছা। বলুন কী জানতে চান?
আপনার কী মনে হয়, পরপর তিনটে মৃত্যু হওয়াটা খুব স্বাভাবিক? না ডালমে কুছ কালা আছে?
ফালতু ফালতু ওইস্যা ভাবব কেন? আমি তো কোনও কারণ দেখি না।
একটা কারণ কিন্তু এক্ষুনি বলতে পারি মিস্টার অগ্রবাল। বাড়ির লোকেরা পরপর এভাবে মারা গেলে ডেভিড সাহেব এ দেশ থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হবেন। তখন সস্তায় জমি-বাড়িটা হাতিয়ে সেখানে পেল্লাই কিছু তৈরি করা এবং বিপুল মুনাফা অর্জন।
কী যে বলেন ম্যাডাম? এই কারণে কেউ কারও প্রাণ নিতে পারে?
পারে বই কী মিস্টার অগ্রবাল। আমিই তো একটা ঘটনা জানি। কলকাতারই এক নামী ডেভেলপার আলিপুরে একটা জমির দখল নিতে চাইছিল। সেখানে আদ্যিকালের এক বাড়িতে বাস করতেন একজন বৃদ্ধা। তিনি কিছুতেই বিক্রি করতে রাজি হচ্ছিলেন না। হঠাৎই তাঁকে একদিন বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সেই ডেভেলপারের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করে বৃদ্ধার নাতি। অনেক কায়দাকানুন করে ডেভেলপার কেসটিকে ধামাচাপা দেয়। তবে সে আর প্রত্যক্ষ ভাবে ব্যবসায় থাকেনি। ছেলেদের হাতে বিজনেস ছেড়ে দিয়ে সে এখন শুধু উপদেষ্টার ভূমিকায় আছে, মিতিন ঝুঁকল একটু। চোখ সরু করে বলল, আপনি তো ওই লাইনেই ছিলেন। চেনেন নাকি ডেভেলপারটিকে?
অলস মেজাজে সোফায় উপবিষ্ট শ্যামচাঁদের মুখ কালো হয়ে গিয়েছে সহসা। নার্ভাস গলায় বললেন, তার সঙ্গে এই মৃত্যুগুলোর কী সম্পর্ক?
আছে কিনা কে বলতে পারে?
ওটা ফলস কেস ছিল। আমাকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আবার জড়িয়ে যাবেন। কারণ, আপনি একাধিকবার মার্কুইস স্ট্রিটের জমি-বাড়ি কিনতে চেয়েছেন?
বিশ্বাস করুন, সিরিয়াসলি কিছু বলিনি। ওটা স্রেফ কথার কথা। আব্রাহাম আমার পুরনো বন্ধু, তাই জাস্ট আলগাভাবে প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম।
সেটা তো প্রমাণসাপেক্ষ। আপনি কিনতে আগ্রহী ছিলেন, তারপর একজন-একজন করে মারা যাচ্ছেন। অতএব সন্দেহের একটা তির আপনার দিকে যায় বই কী মিস্টার অগ্রবাল।
শ্যামচাঁদের মুখখানা চুপসে মুপসে এতটুকু। গলা দিয়ে আর স্বর ফুটছে না।
মিতিন ঠান্ডা গলায় বলল, তা হলে মিস্টার অগ্রবাল, এবার যে প্রশ্নগুলো করব তার ঠিক ঠিক উত্তর আমায় দেবেন তো?
বলুন না কী জানতে চান, শ্যামচাঁদের গলা মাখনের মতো নরম, আমি তো আপনাকে কো-অপারেটই করতে চাই।
ডেভিড যোশুয়ার সঙ্গে আপনার কদ্দিনের পরিচয়?
আব্রাহামের সূত্রে অনেক বছর ধরেই চেনাজানা ছিল। অন্তত বছর পনেরো। তবে ডেভিড মার্কুইস স্ট্রিটে পাকাপাকি চলে আসার পর থেকে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। তাও ধরুন, প্রায় তিন বছর হল।
পুরোপুরি সত্যি কিন্তু বললেন না। ডেভিডসাহেবের সঙ্গে তিন বছরের বেশি সময় ধরেই আপনার ঘনিষ্ঠতা। কারণ, তাঁর এজরা স্ট্রিটের বাড়ি আপনার অগ্রবাল কনস্ট্রাকশনই কিনেছে এবং সেখানে একটি শপিং কমপ্লেক্স তৈরি করছে।
শ্যামচাঁদের মুখ পলকে রক্তশূন্য। আমতা আমতা করে বললেন, ওই আর কী, তিন বছরের বেশি, মোটামুটি চার বছর।
কী দামে কিনেছিলেন?
দু’কোটি।
মাত্র?
ওঁর বাড়িতে অনেক টেনেন্ট ছিল। তাঁদেরও বহুত রুপিয়া দিতে হয়েছে।
ভয় দেখিয়ে তাঁদের তোলেননি নিশ্চয়ই? মস্তান টস্তান লাগাননি?
ছি ছি, কী যে বলেন ম্যাডাম! আমি ওরকম আদমি নই। আমি বহুত শান্তিপ্রিয় আছি। এখন তো কারবার থেকেও মন উঠিয়ে নিয়েছি। সচ বাত।
সত্যি হলেই ভাল। তা মিস্টার আব্রাহামের সঙ্গে তো আপনার কারবারের সূত্রেই যোগাযোগ হয়েছিল, তাই না?
হাঁ। বহুত সাল পহেলে। বিশ-বাইশ বরস তো হবেই। আগে একটা পার্টনারশিপ ফার্ম ছিল, তখন সবে নিজের কোম্পানি খুলেছি। আব্রাহাম তখন বহুতবার আমাকে লোন দিয়েছেন। ইন্টারেস্ট বেশি নিতেন, লেকিন তুরন্ত টাকা মিলত ওঁর কাছ থেকে। যে-কোনও অ্যামাউন্ট। বিশ লাখ, পঞ্চাশ লাখ, এক ক্রোড়, যা আমি চাইতাম।
তা সেই সুদের কারবারির সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব হয়ে গেল?
একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে হল। বহুত সাচ্চা ইনসান ছিল তো৷ হকের পাওনা ছাড়ত না, তবে আমাকে বিজনেসে বুদ্ধি টুদ্ধি দিত। অনেক পড়াশোনা ছিল, আচ্ছা পিয়ানো বাজাত। ওর মউত-এ আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম।
মিস্টার আব্রাহামের মৃত্যুর রাতটা আপনার মনে আছে?
জরুর। মাসটা ছিল সেপ্টেম্বর। সেদিন ওদের বাড়িতে নিউ ইয়ার্সের পার্টি চলছিল।
টুপুর বলে উঠল, সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়ার্সের পার্টি?
ইহুদিদের ক্যালেন্ডার একেবারে আলাদা রে টুপুর, মিতিন ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, শুরু হয়েছে খ্রিস্টাব্দের তিন হাজার সাতশো ষাট বছর আগে থেকে। মাসগুলোর নামও অন্যরকম। ইংরেজি বা রোমান প্যাটার্নের নয়। আরবি ধাঁচের।
ঠিক বলেছেন ম্যাডাম। নিউ ইয়ারকে ওরা বলে ‘রোস হাসান্না’। দু’ দিন ধরে চলে উৎসব। তা সেটা ছিল শেষ দিন। ক্যাথলিন আর র্যাচেল দুই মেমসাহেব আচ্ছা আচ্ছা খানা বানিয়েছিল। কেক আইসক্রিম…। আমার জন্য স্পেশ্যাল নিরামিষও ছিল। তো হল কী, ওদের ভাষায় গানটান হল, আব্রাহাম বড়িয়া পিয়ানো বাজাল, আঙুর আর বেদানার শরবত খেলাম সবাই। শেষে আইসক্রিম খেতে গিয়ে আব্রাহামের গায়ে খানিকটা পড়ে গেল। নয়া ড্রেস খারাপ হয়ে গেল বলে আব্রাহামের কী মনখারাপ, আমরা তাই নিয়ে একটু হাসাহাসি করলাম। তারপর যাওয়ার সময় মিসেস আব্রাহাম আমাদের সবাইকে একটা করে গিফ্ট দিলেন। আমি পেয়েছিলাম একটা কাঠের উট। ডাক্তার পেল চকোলেটের বাক্স। সেনসাহেবকে বোধহয় কিতাব টিতাব…।
তারপর?
পার্টি খতম হল রাত দশটায়।
মিস্টার আব্রাহামের মৃত্যুর খবরটা পেলেন কখন?
সেই রাতেই। বারোটা, সাড়ে বারোটায়।
কে জানিয়েছিলেন? মিস্টার যোশুয়া?
না। ডাক্তার। ডক্টর সামন্ত।
তখনই কি পোস্টমর্টেমের সিদ্ধান্ত হয়েছিল?
তেমন তো কিছু বলেনি ডাক্তার। পরদিন ভোরবেলা গিয়ে শুনলাম বডি পোস্টমর্টেমে পাঠানো হচ্ছে। ক্যাথলিন মেমসাহেবের বুঝি আপত্তি ছিল, তবু ডেভিডের জোরাজুরিতে…। ডাক্তারও তো ডেভিডের ইচ্ছেয় সায় দিয়ে রিপোর্ট লিখল।
হুম, মিতিন ঘাড় দোলাল, মিসেস আব্রাহামও তো এক পরবের দিন মারা গেলেন?
হাঁ। সেদিনও ওদের কী একটা যেন ছিল। ওই রাত্তিরে ওরা এক আজব কিসিমের কেক বানায়। পোস্ত টোস্ত দিয়ে।
এটা কোন মাসে হয়েছিল?
জানুয়ারিতে। মাত্র ক’মাস আগে আব্রাহাম মারা গেছে তো, তাই খুব একটা আমোদ আহ্লাদ হয়নি। আব্রাহামের উদ্দেশে প্রার্থনাও করলাম সেদিন। আমি অবশ্য সেদিন বেশিক্ষণ ছিলাম না, তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলাম। সকালে ডেভিডের ফোন পেয়ে মিসেস আব্রাহামের খবরটা জানলাম।
মিসেস আব্রাহামের তো পোস্টমর্টেম হয়নি?
না ম্যাডাম। তবে সেবারও ডেভিডের খুব ইচ্ছে ছিল পোস্টমর্টেম করানোর। কেউ রাজি হয়নি বলে নাকি চেপে গিয়েছিল।
মিস্টার আব্রাহামের সময়ে কেউ ময়নাতদন্তে আপত্তি করেনি?
করেছিল বই কী। ওদের সমাজের কেউই চায়নি আব্রাহামের কাটাছেঁড়া হোক।
তা হলে মিসেস আব্রাহামের বেলায় কেন সেভাবে জোর করলেন না মিস্টার ডেভিড?
আমি কী করে বলব? ওর মনে কী ছিল আমি কী করে জানব?
হুম, অনেকক্ষণ ঝুঁকে বসে ছিল মিতিন, এবার সোফায় হেলান দিয়ে বলল, আচ্ছা শ্যামচাঁদজি, প্রোফেসর আর ডাক্তারকে আপনার কেমন লোক বলে মনে হয়?
ডাক্তার বিলকুল সিধাসাদা। তবে প্রোফেসর একটু নাকউঁচু আছে। আমার পড়ালিখা কম বলে আমায় নিয়ে কভি কভি ঠাট্টা ভি করেন। আমি অবশ্য গায়ে মাখি না।
আপনি কি জানেন, মার্কুইস স্ট্রিটের বাড়িতে গুপ্তধন আছে?
সিডিতে ডেভিডের ইন্টারভিউটা শুনে জেনেছি।
সেটা কোন মাসে?
ডেভিড যেন কবে লন্ডন থেকে ফিরল? হাঁ, আগের বছর জুলাই-অগস্ট হবে।
মিস্টার আব্রাহামকে তো আপনি জমি-বাড়ি বিক্রির কথা বলেছিলেন। মিস্টার ডেভিড যোশুয়াকে ওরকম কোনও প্রস্তাব দিয়েছিলেন নাকি?
কভি নেহি। তবে বহুত প্রোমোটারের ওই মকানের উপর লোভ আছে। আমি জানি, বলেই শ্যামচাঁদ একটু গলা নামালেন, দেখুন ম্যাডাম, ওই তিনজনের মউত নিয়ে আমি কিছু বলছি না। কিন্তু একটা বাত আমার মনে খচখচ করছে।
কী?
প্রোফেসরসাব যে লড়কাটাকে কাজের জন্য আব্রাহামকে দিয়েছিলেন, সে আসার পর থেকেই কিন্তু এক-এক করে তিনজন মারা গেল। জানি না, এ কোইনসিডেন্ট ভি হতে পারে!
অর্থাৎ আপনি বলছেন প্রোফেসরসাহেবই হয়তো কিছু…।
আমি কুছু বলছি না। যা মনে হল তাই বলে দিলাম। এখন আপনি ভাবুন এতে কোনও গড়বড় আছে কিনা।
শ্যামচাঁদের ঠোঁটের কোণে ধূর্ত হাসি৷ মিতিন আর টুপুর চোখ চাওয়াচাওয়ি করল।
.
০৮.
বেলা চারটে বাজে। জ্যৈষ্ঠের সূর্য এখনও দারুণ প্রখর। শ্যামচাঁদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির এসিটা চালিয়ে দিয়েছিল মিতিন, তাপটা তাই সেভাবে টের পায়নি টুপুর। মাকুইস স্ট্রিটে পৌঁছে দরজা খুলে নামতেই গায়ে যেন আগুনের হষ্কা। ঝটিতি গাড়িবারান্দার নীচে এসে তবে শান্তি। আদ্যিকালের কাঠামো তো, ছায়াতে শরীর যেন জুড়িয়ে যায়।
বেল বাজাতেই যতীন। খানিকটা যেন অবাক মুখেই বলল, এখন আপনারা?
মিতিন কেজো গলায় বলল, এলাম। দরকার আছে।
ও। আসলে সাহেবের তো এখন শোকের সময় চলছে, বাইরের লোক তো বড় একটা আসছে না।
তাই বুঝি? তা সাহেব কোথায়?
উপরে।
তা হলে তো তাঁকে একবার ডাকতে হবে।
বসুন। খবর দিচ্ছি।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই নীচে নেমেছেন ডেভিড। তবে একা নন, সঙ্গে সারা আর বেঞ্জামিন।
দাড়ি-গোঁফ ছাঁটা প্রবীণ বেঞ্জামিনের পরনে ইহুদি পোশাক। সারার অঙ্গে কালো গাউন। আজও কার্পেটে আসন গ্রহণ করলেন তিনজনে। দেখাদেখি টুপুর-মিতিনও। ডেভিডের মুখখানা আষাঢ়ের মেঘের মতো থমথমে। বোঝাই যায়, এখনও র্যাচেলের মৃত্যুশোকটা সামলে উঠতে পারেননি।
কাতর স্বরে ডেভিড জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি তদন্ত শুরু করেছেন?
এই তো…সবেমাত্র…।
আর কি তার প্রয়োজন আছে? বেঞ্জামিন বলছিল…।
শুধু আমি নই, বেঞ্জামিনের ঘড়ঘড়ে স্বর বেজে উঠল, আমি আর সারা দুজনেই বোঝাচ্ছিলাম ডেভিডকে। এভাবে আপনজনদের চলে যাওয়াটা খুবই দুঃখের। কিন্তু মৃত্যুগুলো নিয়ে অনর্থক শোরগোল তুলেই বা কী লাভ? বরং জিহোভার কাছে প্রার্থনা করো তিনি যেন শোক সইবার শক্তি দেন।
সারা নরম গলায় বললেন, সেই সঙ্গে র্যাচেলের আত্মাও শান্তি পায়।
আমি আর একটা পরামর্শও দিচ্ছিলাম ম্যাডাম, বেঞ্জামিন বললেন, র্যাচেল যতদিন ছিল, ততদিন কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু ডেভিডের পক্ষে এখন তো আর কলকাতায় একা-একা থাকা সম্ভব নয়। এখন ওর শোকের প্রথম পর্ব চলছে। আমরাও রোজ আসছি। এখন তো বাড়িতে রান্নাবান্নার নিয়ম নেই, সারা খাবার দাবারও তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরাও তো বুড়োবুড়ি, আমাদের পক্ষে এভাবে চালিয়ে যাওয়া মুশকিল। এর পর হয়তো নিয়মিত আসতেই পারব না। তখন কে ওর দেখাশোনা করবে? শুধুমাত্র যতীনের ভরসায় এখানে পড়ে থাকা কি ওর পক্ষে সম্ভব? আপনিই বলুন?
সারা বলে উঠলেন, তাই বেঞ্জামিন বলছিল, আর কোনও ওজরআপত্তি নয়। ডেভিডের এখনই পাকাপাকি ভাবে লন্ডন চলে যাওয়াটাই সমীচীন।
মিতিনের ভুরুতে পলকা ভাঁজ, আর এই জমি-বাড়ির কী হবে?
সে ব্যাপারটাও ভেবেছি। বাড়ি-জমি বিক্রি নিয়ে এখন টেনশন করার কোনও প্রয়োজন নেই, বেঞ্জামিন বললেন, আপাতত আমিই দেখাশোনা করব। যদি ডেভিড পারমিশন দেয়, তা হলে এদিকে কোনও প্রোমোটার টোমোটারের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারি। তারা না হয় ই-মেলে সাইমনের সঙ্গে দরদাম স্থির করবে। তারপর একবার বাপ-ছেলে একসঙ্গে এসে ব্যাপারটা চূড়ান্ত করে চলে যাক।
ভালই তো প্রস্তাবটা, মিতিন আড়চোখে দেখল ডেভিডকে, তা মিস্টার যোশুয়া কি রাজি?
নিমরাজি মতো হয়েছে।
ও। তা কবে চলে যাবেন ঠিক করেছেন কিছু?
আগামী রোববার শোকের প্রথম পর্বটা চুকবে। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তিরিশ দিন বা এক বছরের রীতিনিয়ম নয় লন্ডনেই পালন করবে।
অতি উত্তম, মিতিনের ঠোঁটে চিলতে হাসি, তবে যতদিন উনি আছেন, ততদিন একটু ব্যাপারটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখি।
সারা বা বেঞ্জামিন কেউই যেন বিশেষ প্রীত হলেন না। গোমড়া মুখে সারা বললেন, কী তদন্ত করবেন? করার আছেটা কী?
তেমন কিছু নয়। জাস্ট কিছু খোঁজখবর আর ক’টা প্রশ্নটশ্ন। মিতিন গলা ঝাড়ল, যেমন ধরুন, তিনটে মৃত্যুর দিনই তো আপনারা ছিলেন, কোথাও কোনও অস্বাভাবিকতা নজরে পড়েছিল কি?
একেবারেই না। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনটেই হার্ট অ্যাটাকের কেস।
ব্যস, ওইটুকুই? শুনলাম, মিস্টার আব্রাহামের মৃত্যুর দিন তার গায়ে হঠাৎ আইসক্রিম পড়ে গিয়েছিল? র্যাচেল ম্যাডামের গায়ে পড়েছিল লাল পানীয়ের গ্লাস? ভেঙে চুরচুর হয়ে গিয়েছিল?
পার্টিতে তো ওরকম হরবখতই ঘটে। ক্যাথলিনের গায়েও তো ফলের রস পড়েছিল। তারপর দিব্যি গটগটিয়ে উপরে গেল, ড্রেস বদলাল। যখন ফের সিঁড়ি দিয়ে নেমেছে, তখনই দুম করে…।
ঘটনাটা কতক্ষণ পর ঘটেছিল স্মরণে আছে কি? আই মিন, গায়ে ফলের রস পড়ার কতক্ষণ পর হার্ট অ্যাটাকটা হয়েছিল?
পনেরো-বিশ মিনিট তো হবেই। কিংবা আরও বেশি। ধরুন প্রায় আধ ঘণ্টা, বেঞ্জামিন বিরক্ত স্বরে বললেন, তাতে কী হয়েছে? আর জেনেই বা কী হবে আপনার?
জবাব না দিয়ে মিতিন বলল, উনি কি গায়ে ফলের রস মাখা অবস্থাতেই ড্রেস বদলাতে চলে গিয়েছিলেন?
আজব প্রশ্ন! এবার সারা যেন একটু ঝেঁঝে উঠলেন, এমনটা হয় নাকি? আমি মুছে দিয়েছিলাম।
আপনার রুমালে?
না। কে একজন যেন দিল।
কে?
সে কি আর মনে আছে? থাকা সম্ভব?
একটু স্মরণ করার চেষ্টা করুন।
সরি, সারার কণ্ঠে এবার বিদ্রূপ, চার মাস পরে আপনাকে বলতে হবে জানলে নিশ্চয়ই মনে গেঁথে রাখতাম। কিন্তু এখন তো সেটা আর পারব না।
মিতিন চটল না। শান্ত ভাবেই বলল, তবু একবার ভেবে দেখুন। প্রোফেসরসাহেব? ডাক্তারবাবু? মিস্টার অগ্রবাল? কিংবা যতীন?
যে কেউই হতে পারে। বেঞ্জামিন বা ডেভিড হতেই বা আপত্তি কী! সারার বলিরেখা ভরা কপালে আরও ভাঁজ বাড়ল, ওই রুমালটা কি খুবই রহস্যময়?
মিতিন কোনও উত্তর দিল না। বেঞ্জামিনের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, মিস্টার আব্রাহাম আর মিস্টার যোশুয়ার লোকাল বন্ধুদের আপনারা তো বহুকাল চেনেন, তাই না?
প্রোফেসরসাহেব আর মিস্টার অগ্রবালের সঙ্গে অনেক বছরেরই আলাপ। ডাক্তার তো এ বাড়িতে হালে আসছে। অবশ্য তার আগেই ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।
কীভাবে?
আমাদেরই সমাজের আর একজনের বাড়িতে। এলিয়াস আসের। তার বোধহয় মাসখানেক পর ওকে এই বাড়িতে দেখলাম।
ও। তা এঁরা লোক কেমন?
কেউই খারাপ নয়। দুনিয়ার সকলেই ভাল। শুধু মিস্টার অগ্রবাল একটু ধান্দাবাজ টাইপ। শুনেছি নিজের স্বার্থে খারাপ কাজ করতে পারেন। তবে…, বেঞ্জামিন সামান্য দম নিলেন, আব্রাহাম বা ডেভিডের সঙ্গে ওঁর সম্পর্কটা তেমন নয়। এখানে তো খোলা মনেই মেলামেশা করেন। অন্তত দেখে তো তাই মনে হয়।
ডেভিড অনেকক্ষণ নিশ্চুপ বসে। সামনে যে এত কথা হচ্ছে, কিছুই যেন তাঁর কানে যাচ্ছে না। হঠাৎ ক্লান্ত স্বরে বললেন, এসব প্রসঙ্গ আজ থাক না ম্যাডাম। আমার আর ভাল লাগছে না।
বেশ। থাক তবে, মিতিন অল্প কাঁধ ঝাঁকাল। মৃদু স্বরে বলল, আপনার কাছে অন্য একটা রিকোয়েস্ট ছিল মিস্টার যোশুয়া।
বলুন?
আপনাদের এই বাড়িটা প্রথম দিন থেকে আমায় খুব টানছে। যদি অনুগ্রহ করে একটু ঘুরে দেখার অনুমতি দেন। বিশেষ করে দোতলার ঘরগুলো।
ডেভিড ভাবলেন ক্ষণেক। তারপর বললেন, চলুন সঙ্গে।
পায়ে পায়ে দোতলায় উঠল মিতিন আর টুপুর। ডেভিড-সারা-বেঞ্জামিনের পিছু পিছু। প্রথমেই সেই ঘর, যেখানে মারা গিয়েছিলেন র্যাচেল। চেয়ার, টেবিল, টিভি, আলমারি, খাট, ড্রেসিংটেবিল সর্বত্রই চোখ বোলাল মিতিন। তারপর এসেছে পাশের ঘরে। এই কামরাখানা তেমন বড় নয়। তবে পুরনো আসবাবে মোটামুটি সুসজ্জিত। এ ঘরেই এখন বাস করছেন ডেভিড। আরও দু’খানা ঘর আছে দোতলায়। তালাবন্ধ অবস্থায়।
মিতিন জিজ্ঞেস করল, ঘর দুটো কি বন্ধই থাকে?
ডেভিড বললেন, হ্যাঁ। ওগুলো আব্রাহাম আর ক্যাথলিনের ঘর। ক্যাথলিনের মৃত্যুর পর আমি দুটোতেই তালা মেরে দিয়েছি।
আর একদমই খোলা হয় না?
র্যাচেল খুলত। প্রতি সপ্তাহে একদিন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সাফসুতরো করাত যতীনকে দিয়ে। ঘর দুটো কি দেখতে চান?
যদি আপনার অসুবিধে না হয়…
কোমর থেকে চাবির ভারী গোছা বের করলেন ডেভিড। খুলছেন বাঁ দিকের প্যাসেজের তৃতীয় ঘরখানা। মোটামুটি বড়ই। সাজানো-গোছানো। যত্নআত্তির ছাপ বেশ স্পষ্ট। মাথার উপর ছোট একটা ঝাড়লণ্ঠন। দেওয়ালে অজস্র বিবর্ণ হয়ে আসা বাঁধানো ফোটোগ্রাফ। বিশাল পালঙ্ক, আলমারি, পাথর বসানো ড্রেসিংটেবিল, ফ্রেমে বসানো দোলআয়না, সবেতেই কেমন মনকেমন করা প্রাচীন প্রাচীন গন্ধ।
প্যাসেজের শেষ প্রান্তের ঘরটিতে ঢুকে টুপুরের চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। কী পেল্লাই সাইজ রে বাবা! নীচের ড্রয়িংহলটার চেয়েও বড়।
আরও আশ্চর্য, অত বড় ঘরে আসবাব প্রায় নেই বললেই চলে। ঘরের প্রায় মধ্যিখান দিয়ে তিন-তিনখানা সরু থাম উঠে গিয়েছে সিলিং পর্যন্ত। তাদের গায়ে বিচিত্র কারুকাজ। থামের ওপারে দু’খানা ভারী আরামকেদারা, একটা শ্বেতপাথরের টেবিল, দেওয়ালে গাঁথা কাচের আলমারিতে বই, বই, রাশি রাশি বই।
টুপুর ফস করে বলে উঠল, এত বই? এটা লাইব্রেরি নাকি?
ঠিক ধরেছ, ডেভিড বললেন, এ বাড়ি যিনি তৈরি করেছিলেন, এটা ছিল তাঁরই লাইব্রেরি।
কে তিনি? কী নাম?
শ্যালোম কোহেনের নাতি। স্যামুয়েল এজরা মাটুক। আব্রাহামের ঠাকুরদার বাবা। আব্রাহাম তার প্রপিতামহের ধারাটা বজায় রেখেছিল, এ ঘরেই কাটাত দিনের বেশির ভাগ সময়টা। প্রোফেসর এলে তো রীতিমতো লেখাপড়ার আড্ডা জমে যেত এ ঘরে।
মিতিন কাছে গিয়ে থামগুলো দেখছিল। ঘুরে জিজ্ঞেস করল, থামের গায়ে ভারী সুন্দর ডিজাইন তো?
না না, ওগুলো ডিজাইন নয়, ডেভিড প্রায় হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ওগুলো আমাদের ধর্মীয় লিপি। বাঁ দিকের থামে লেখা আছে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট। মধ্যিখানে আমাদের আদি ধর্মগ্রন্থ তালমুদ। আর একেবারে ডান দিকেরটায় রয়েছে আমাদের ধর্মীয় অনুশাসন ‘টোরা’। সবই আমাদের পবিত্র হিব্রু ভাষায় লেখা।
বেঞ্জামিন বললেন, স্যামুয়েল খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন তো, তাই ঘরেই ধর্মগ্রন্থ পাঠের বন্দোবস্ত করেছিলেন।
ডেভিড বললেন, শুনেছি সিরিয়া থেকে একজন লিপিকার আনিয়েছিলেন। ঘরের মাঝখানে থাম তিনখানা তুলে তাকে দিয়ে ধর্মগ্রন্থ খোদাই করিয়েছিলেন।
তার মানে এটা শুধু লাইব্রেরিই নয়, প্রার্থনার ঘরও বলা যায়, বলতে বলতে হঠাৎ মিতিন ত্বরিত পায়ে ঘরের দরজায়। বিরস গলায় বলে উঠল, তুমি এখানে কী করছ যতীন? কিছু বলবে?
চৌকাঠের ওপারে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা যতীন বেজায় থতমত। মিনমিন করে বলল, না মানে… জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম আপনারা শরবত টরবত খাবেন কিনা?
ধন্যবাদ। কিছু লাগবে না। তুমি যেতে পারো।
প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগিয়েছে যতীন। সেদিকে দু’-এক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে মিতিন আবার ফিরেছে, এ বাড়িটার বয়স কত হল?
দেড়শোর চেয়ে কিছু কম। একশো ছেচল্লিশ।
আর একবার থাম তিনটে নিরীক্ষণ করে দেওয়ালের বইগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল মিতিন। আলতো হেসে বলল, সমস্ত বই-ই কি স্যামুয়েলসাহেবের সংগ্রহ?
সে তো বলতে পারব না ম্যাডাম। তবে আব্রাহামও খুব বইটই কিনত। সেগুলোও এখানে আছে কিনা ওটা প্রোফেসরসাহেবই বলতে পারবেন। আমি তো খুব একটা পুস্তকপ্রেমী নই। অ্যাকাউন্টস লাইনের লোক, হোটেলের জমাখরচের হিসেব করে করেই জীবন কেটে গিয়েছে।
ও হ্যাঁ, তাও তো বটে, মিতিন আলগাভাবে বলল, ঘরখানা দেখে বেশ আনন্দ পেলাম। চলুন, এবার যাওয়া যাক।
দোতলার রান্নাঘরখানায় একবার উঁকি মেরে নীচে নামল সকলে। হালকা পায়ে একটু ঘুরল একতলাটা। তারপর ডেভিডদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে মিতিন আর টুপুর।
বিকেল ফুরিয়ে এসেছে। পথে অফিসযাত্রীদের থিকথিকে ভিড়। ধীর গতিতে নীরবে গাড়ি চালাচ্ছিল মিতিন। টুপুর আড়ে আড়ে দেখছিল মাসিকে। ধুরন্ধর শ্যামচাঁদ আর খিটখিটে বেঞ্জামিনের সঙ্গে কথা বলে লাভ হল কি কিছু? নাকি দিনটা বেকার গেল আজ? মাসির মুখ দেখে তো কিছুই ঠাহর করার জো নেই।
টুপুর সতর্কভাবে জিজ্ঞেস করল, কী গো, কী বুঝছ? মিস্টার যোশুয়া তো বোধহয় আর কেস নিয়ে এগোতে চাইছেন না?
অতই সোজা? আর কি পিছোনোর জো আছে?
কেন নেই?
হাউ মাউ খাঁউ রহস্যের গন্ধ পাঁউ। কী বুঝলি?
টুপুর দু’দিকে মাথা নাড়ল। হেঁয়ালি করে কী যে সুখ পাচ্ছে মিতিনমাসি!