মহাবিদ্যা

মহাবিদ্যা

বক্তৃতা—গৃহ। উচ্চ বেদীর উপর আচার্যের আসন। বেদীর নীচে ছাত্রদের জন্য চেয়ার ও বেঞ্চ।

প্রথম শ্রেণীতে আছেন—

প্রথম শ্রেণীর কথা

মিস্টার গ্র্যাব। হ্যাল্লো মহারাজা, আপিনও দেখছি ক্লাসে জয়েন করেছেন।

হোমরাও সিং। হাঁ, ব্যাপারটা জানবার জন্য বড়ই কৌতূহল হয়েছে। আচ্ছা এই জগদগুরু লোকটি কে?

গ্র্যাব। কিছুই জানি না। কেউ বলে, এ’র নাম ভ্যাণ্ডারলুট, আমেরিকা থেকে এসেছেন; আবার কেউ বলে, ইনিই প্রফেসার ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। ফাদার ওব্রায়েন সেদিন বলছিলেন, লোকটি devil himself— শয়তান স্বয়ং। অথচ রেভারেণ্ড ফিগস বলেন, ইনি পৃথিবীর বিজ্ঞতম ব্যক্তি, একজন সুপারম্যান। একটা কমপ্লিমেণ্টারি টিকিট পেয়েছি, তাই মজা দেখতে এলুম।

মিস্টার হাউলার। আমিও একখানা পেয়েছি।

হোমরাও। বটে? আমরা তো টাকা দিয়ে কিনেছি, তাও অতি কষ্টে। হয়তো জগদগুরু জানেন যে আপনাদের শেখবার কিছু নেই, তাই কমপ্লিমেণ্টারি টিকিট দিয়েছেন।

খুদীন্দ্রনারায়ণ। শুনেছি লোকটি নাকি বাঙালি, বিলাত থেকে ভোল ফিরিয়ে এসেছে। আচ্ছা, বলশেভিক নয় তো?

চোমরাও আলি। না না, তা হলে গভর্নমেন্ট এ লেকচার বন্ধ ক’রে দিতেন। আমার মনে হয়, জগদগুরু তুর্কি থেকে এসেছেন।

হাউলার। দেখাই যাবে লোকটি কে!

দ্বিতীয় শ্রেণীর কথা

নিতাইবাবু । জগদগুরু কোথায় উঠেছেন জানেন কি? একবার ইন্টারভিউ করতে যাব।

মিস্টার গুহা। শুনেছি বেঙ্গল ক্লাবে আছেন।

রুপচাঁদ। না—না, আমি জানি, পগেয়াপটিতে বাসা নিয়েছেন।

লুটবেহারী। আচ্ছা উনি যে মহাবিদ্যার ক্লাস খুলেছেন, সেটা কি? ছেলেবেলায় তো পড়েছিলুম—কালী, তারা, মহাবিদ্যা—

প্রফেসার গুঁই। আরে, সে বিদ্যা নয়। মহাবিদ্যা— কিনা সকল বিদ্যার সেরা বিদ্যা, যা আয়ত্ত হলে মানুষের অসীম ক্ষমতা হয়। সকলের উপর প্রভুত্ব লাভ হয়।

রূপচাঁদ। এখানে তো দেখছি হাজারো লোক লেকচার শুনতে এসেছে। সকলেরই যদি প্রভুত্ব লাভ হয় তবে ফরমাশ খাটবে কে?

গাঁট্টালাল। এই জন্যে ভাবছেন? আপনি হুকুম দিন, আমি আর তেওয়ারী দুই দোস্ত মিলে সবাইকে হাঁকিয়ে দিচ্ছি। কিছু পান খেতে দেবেন—

তেওয়ারী। না—না, এখন গন্ডগোল বাধিও না, —সাহেবরা রয়েছেন।

তৃতীয় শ্রেণীর কথা

সরেশ। আপনিও বুঝি এই বৎসর পাস করেছেন? কোন লাইনে যাবেন, ঠিক করলেন?

নিরেশ। তা কিছুই ঠিক করিনি। সেইজন্যই তো মহাবিদ্যার ক্লাসে ভর্তি হয়েছি,— যদি একটা রাস্তা পাওয়া যায়। আচ্ছা এই কোর্স অভ লেকচার্স আয়োজন করলে কে?

সরেশ। কি জানি মশায়। কেউ বলে, বিলাতের কোনও দয়ালু ক্রোরপতি জগদগুরুকে পাঠিয়েছেন। আবার শুনতে পাই, ইউনিভার্সিটিই নাকি লুকিয়ে এই লেকচারের খরচ যোগাচ্ছে।

মিস্টার গুপ্টা। ইউনিভার্সিটির টাকা কোথা? যেই টাকা দিক, মিথ্যে অপব্যয় হচ্ছে। এ রকম লেকচারে দেশের উন্নতি হবে না। ক্যাপিট্যাল চাই, ব্যবসা চাই।

দীনেশ। তবে আপনি এখানে এলেন কেন? এইসব রাজা—মহারাজাই বা কি জন্য ক্লাস অ্যাটেণ্ড করছেন? নিশ্চয়ই একটা লাভের প্রত্যাশা আছে। এই দেখুন না, আমি সামান্য মাইনে পাই, তবু ধার করে লেকচারের ফী জমা দিয়েছি—যদি কিছু অবস্থার উন্নতি করতে পারি।

সরেশ । জগদগুরু আসবেন কখন? ঘণ্টা যে কাবার হয়ে এল।

চতুর্থ শ্রেণীর কথা

গবেশ্বর। কিহে পাঁচুমিয়া এখানে কি মনে করে?

পাঁচুমিয়া। বাবুজী, এক টাকা রোজে আর দিন চলে না। তাই থালিয়া—লোটা বেচে একটা টিকিট কিনেছি, যদি কিছু হদিস পাই। তা আপনারা এত পিছে বসেছেন কেন হুজুর? সামনে গিয়ে বাবুদের সাথ বসুন না!

কাঙালীচরণ। ভয় করে।

গবেশ্বর। আমরা বেশ নিরিবিলিতে আছি। দেখ, পাঁচু, তুমি যদি বক্তৃতার কোনও জায়গা বুঝতে না পার তো আমাকে জিজ্ঞাসা ক’রো।

ঘণ্টাধ্বনি। জগদগুরুর প্রবেশ। মাথায় সেনার মুকুট, মুখে মুখোশ, গায়ে গেরুয়া আলখাল্লা। তিনি আসিয়া বহির্বাস খুলিয়া ফেলিলেন। মাথা কামানো, গায়ে তেল, পরনে লেংটি, ডান—হাতে বরাভয়, বাঁ—হাতে সিঁধকাটি। পট পট হাততালি।

হোমরাও। লোকটির চেহারা কি বীভৎস! চেনেন নাকি মিস্টার গ্র্যাব?

গ্র্যাব। চেনা চেনা বোধ হচ্ছে।

জগদগুরু। হে ছাত্রগণ, তোমাদের আশীর্বাদ করছি জগজ্জয়ী হও। আমি যে—বিদ্যা শেখাতে এসেছি তার জন্য অনেক সাধনা দরকার—তোমরা একদিনে বুঝতে পারবে না। আজ আমি কেবল ভূমিকামাত্র বলব। হে বালকগণ, তোমরা মন দিয়ে শোন—যেখানে খটকা ঠেকবে, আমাকে নির্ভয়ে জিজ্ঞাসা করবে।

প্রফেসার গুঁই। আমি স্ট্রংলি আপত্তি করছি—জগদগুরু কেন আমাদের ‘বালকগণ— তোমরা’ বলবেন? আমরা কি স্কুলের ছোকরা? এটা একটা রেস্পেকটেবল গ্যাদারিং। এই মহারাজা হোমরাও সিং, নবাব চোমরাও আলি রয়েছেন। পদমর্যাদা যদি না ধরেন, বয়সের একটা সম্মান তো আছে। আমাদের মধ্যে অনেকের বয়স ষাট পেরিয়েছে।

হাউলার—আপনাদের বাংলা ভাষার দোষ। জগদগুরু বিদেশী লোক, ‘আপনি’ ‘তুমি’ গুলিয়ে ফেলেছেন। আর ‘বালক’ কথাটা কিছু নয়, ইংরেজীর ওল্ড বয়।

খুদীন্দ্র। বাংলা ভাল না জানেন তো ইংরেজীতে বলুন না।

গুঁই। যাই হ’ক আমি আপত্তি করছি।

মিস্টার গুহা। আমি আপত্তির সমর্থন করছি।

জগদগুরু (সহাস্যে)। বৎস উতলা হয়ো না। আমি বাংলা ভালই জানি। বাংলা, ইংরেজী, ফরাসী, জাপানী, সবই আমার মাতৃভাষা। আমি প্রবীণ লোক, দশ—বিশ হাজার বৎসর ধ’রে এই মহাবিদ্যা শেখাচ্ছি। তোমরা আমার স্নেহের পাত্র, ‘তুমি’ বলবার অধিকার আমার আছে।

লুটবেহারী। নিশ্চয় আছে। আপনি আমাদের ‘তুমি, তুই’—যা খুশি বলুন। আমি ও সব গ্রাহ্য করি না। মোদ্দা, শেষকালে ফাঁকি দেবেন না।

জগদগুরু। বাপু, আমি কোনও জিনিস দিই না, শুধু শেখাই মাত্র। যা হ’ক, তোমাদের দেখে আমি বড়ই প্রীত হয়েছি। এমন—সব সোনার চাঁদ ছেলে—কেবল শিক্ষার অভাবে উন্নতি করতে পারছ না!

মিস্টার গুপ্টা। ভণিতা ছেড়ে কাজের কথা বলুন।

জগদগুরু। হে ছাত্রগণ, মহাবিদ্যা না জানলে মানুষ সুসভ্য ধনী মানী হ’তে পারে না, তাকে চিরকাল কাঠ কাটতে আর জল তুলতে হয়। কিন্তু এটা মনে রেখো যে, সাধারণ বিদ্যা আর মহাবিদ্যা এক জিনিস নয়। তোমরা পদ্যপাঠে পড়েছ—

এই ধন কেহ নাহি নিতে পারে কেড়ে,

যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে।

এই কথা সাধারণ বিদ্যা সম্বন্ধে খাটে, কিন্তু মহাবিদ্যার বেলায় নয়। মহাবিদ্যা কেবল নিতান্ত অন্তরঙ্গ জনকে অতি সন্তর্পণে শেখাতে হয়। বেশী প্রচার হ’লে সমূহ ক্ষতি। বিদ্বানে বিদ্বানে সংঘর্ষ হ’লে একটু বাক্যব্যয় হয় মাত্র, কিন্তু মহাবিদ্বানদের ভিতর ঠোঁকাঠুঁকি বাধলে সব চুরমার। তার সাক্ষী এই ইওরোপের যুদ্ধ। অতএব মহাবিদ্বানদের একজোট হয়েই কাজ করতে হবে।

হাউলার। আমি এই লেকচারে আপত্তি করছি। এদেশের লোকে এখনও মহাবিদ্যালাভের উপযুক্ত হয় নি। আর আমাদের মহাবিদ্বানরা দেশী মহাবিদ্বানদের সঙ্গে বনিয়ে চলতে পারবে না। মিথ্যা একটা অশান্তির সৃষ্টি হবে।

গ্র্যাব। চুপ কর হাউলার। মহাবিদ্যা শেখা কি এ দেশের লোকের কর্ম? লেকচার শুনে হুজুকে প’ড়ে যদি মহাবিদ্যা নিয়ে লোকে একটু ছেলেখেলা আরম্ভ করে, মন্দ কি? একটু অন্যদিকে ডিসট্র্যাকশন হওয়া দেশের পক্ষে এখন দরকার হয়েছে।

হাউলার। সাধারণ বিদ্যা যখন এদেশে প্রথম চালানো হয় তখনও আমরা ব্যাপারটাকে ছেলেখেলা মনে করেছিলুম। এখন দেখছ তো ঠেলা? জোর করে টেক্সট বুক থেকে এটা—সেটা বাদ দিয়ে কি আর সামলানো যাচ্ছে?

খুদীন্দ্র। মিস্টার হাউলার ঠিক বলেছেন। আমারও ভাল ঠেকছে না।

চোমরাও আলি। ভাল—মন্দ গভর্নমেণ্ট বিচার করবেন। তবে মহাবিদ্যা যদি শেখাতেই হয়, মুসলমানদের জন্য একটা আলাদা ব্যবস্থা করা দরকার।

হোমরাও। অর্ডার, অর্ডার।

জগদগুরু। সাধারণ বিদ্যা মোটামুটি জানা না থাকলে মহাবিদ্যার ভাল রকম ব্যুৎপত্তি লাভ হয় না। পাশ্চাত্য দেশে দুই বিদ্যার মণিকাঞ্চন যোগ হয়েছে। এ—দেশেও যে মহাবিদ্বান নেই, তা নয়—

গাঁট্টালাল। হুঁ হুঁ গুরুজী আমাকে মালুম করছেন।

রূপচাঁদ। দূর, তোকে কে চেনে? আমার দিকে চাইছেন।

জগদগুরু। তবে মূর্খ লোকে মহাবিদ্যার প্রয়োগটা আত্মসম্ভ্রম বাঁচিয়ে করতে পারে না। পাশ্চাত্য দেশ এ বিষয়ে অত্যন্ত উন্নত। জরির খাপের ভিতর যেমন তলোয়ার ঢাকা থাকে, মহাবিদ্যাকেও তেমনি সাধারণ বিদ্যা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। মহাবিদ্যার মূলসূত্রই হচ্ছে—যদি না পড়ে ধরা।

প্রফেসার গুঁই। আপনি কী সব খারাপ কথা বলছেন!

অনেক। শেম, শেম।

জগদগুরু। বৎস, লজ্জিত হয়ো না। তোমাদেরই এক পণ্ডিত বলেন—একাং লজ্জাং পরিত্যজ্য ত্রিভুবনবিজয়ী ভব। যদি মহাবিদ্যা শিখতে চাও তবে সত্যের উলঙ্গ মূর্তি দেখে ডরালে চলবে না। যা বলছিলুম শোন।—এই মহাবিদ্যা যখন মানুষ প্রথমে শেখে তখন সে আনাড়ী শিকারীর মত বিদ্যার অপপ্রয়োগ করে। যেখানে ফাঁদ পেতে কার্যসিদ্ধি হ’তে পারে সেখানে সে কুস্তি ল’ড়ে বাঘ মারতে যায়। দু—চারটে বাঘ হয়তো মরে কিন্তু শিকারীও শেষে ঘায়েল হয়। বিদ্যাগুপ্তির অভাবেই এই বিপদ হয়। মানুষ যখন আর একটু চালাক হয়, তখন সে ফাঁদ পাততে আরম্ভ করে, নিজে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু গোটাকতক বাঘ ফাঁদে পড়লেই আর সব বাঘ ফাঁদ চিনে ফেলে, আর সেদিকে আসে না, আড়াল থেকে টিটকারি দেয়, শিকারীরও ব্যবসা বন্ধ হয়। ফাঁদটা এমন হওয়া চাই যেন কেউ ধ’রে না ফেলে। মহাবিদ্যাও সেই রকম গোপন রাখা দরকার। তোমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো নিজের অজ্ঞাতসারে কেবল সংস্কারবশে মহাবিদ্যার প্রয়োগ কর। এতে কখনও উন্নতি হবে না। পরের কাছে প্রকাশ করা নিষেধ; কিন্তু নিজের কাছে লুকোলে মহাবিদ্যায় মরচে পড়বে। সজ্ঞানে ফলাফল বুঝে মহাবিদ্যা চালাতে হয়।

গুঁই। বড়ই গোলমেলে কথা।

লুটবেহারী। কিছু না, কিছু না। জগদগুরু নূতন কথা আর কি বলছেন। প্র্যাকটিস আমার সবই জানা আছে, তবে থিওরিটা শেখবার তেমন সময় পাইনি।

গুহা। এতদিন ছিলে কোথা হে?

লুটবেহারী। শ্বশুরবাড়ি। সেদিন খালাস পেয়েছি।

গুহা। নাঃ, তোমার দ্বারা কিছু হবে না। এই তো ধরা দিয়ে ফেললে।

লুটবেহারী। আপনাকে বলতে আর দোষ কি! দু—জনেই মহাবিদ্বান, মাসতুতো ভাই।

হোমরাও। অর্ডার, অর্ডার।

গুহা। আচ্ছা গুরুদেব, মহাবিদ্যা শিখলে কি আমাদের দেশের সকলেরই উন্নতি হবে?

জগদগুরু। দেখ বাপু, পৃথিবীর ধনসম্পদ যা দেখছ, তার একটা সীমা আছে, বেশী বাড়ানো যায় না। সকলেই যদি সমান ভাগে পায়, তবে কারও পেট ভরে না। যে জিনিস সকলেই অবাধে ভোগ করতে পারে, সেটা আর সম্পত্তি ব’লে গণ্য হয় না। কাজেই জগতের ব্যবস্থা এই হয়েছে যে জনকতক ভোগদখল করবে, বাকি সবাই যুগিয়ে দেবে। চাই গুটিকতক মহাবিদ্বান আর একগাদা মহামূর্খ।

খুদীন্দ্র। শুনছেন মহারাজা? এই কথাই তো আমরা বরাবর ব’লে আসছি। আরিস্টোক্রাসি না হ’লে সমাজ টিকবে কিসে? লোকে আবার আমাদের বলে মূর্খ—অযোগ্য। হুঁঃ!

জগদগুরু। ভুল বুঝলে বৎস। তোমার পূর্বপুরুষরাই মহাবিদ্বান ছিলেন, তুমি নও। তুমি কেবল অতীতে অর্জিত বিদ্যার রোমন্থন করছ। তোমার আশে—পাশে মহাবিদ্বানরা ওত পেতে বসে আছেন। যদি তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিতে না শেখ তবে শীঘ্রই গাদায় গিয়ে পড়বে।

প্রফেসর গুঁই। পরিষ্কার করেই বলুন না মহাবিদ্যাটা কি।

তৃতীয় শ্রেণী হতে। ব’লে ফেলুন স্যার, ব’লে ফেলুন। ঘণ্টা বাজতে বেশী দেরি নেই।

জগদগুরু। তবে বলছি শোন। মহাবিদ্যায় মানুষের জন্মগত অধিকার; কিন্তু একে ঘ’ষে মেজে পালিশ ক’রে সভ্যসমাজের উপযুক্ত ক’রে নিতে হয়। ক্রমোন্নতির নিয়মে মহাবিদ্যা এক স্তর হ’তে উচ্চতর স্তরে পৌঁছেছে। জানিয়ে শুনিয়ে সোজাসুজি কেড়ে নেওয়ার নাম ডাকাতি—

ছাত্রগণ। সেটা মহাপাপ—চাই না, চাই না।

জগদগুরু। দেশের জন্য যে ডাকাতি, তার নাম বীরত্ব—

ছাত্রগণ। তা আমাদের দিয়ে হবে না, হবে না!

হাউলার। Bally rot।

জগদগুরু। নিজে লুকিয়ে থেকে কেড়ে নেওয়ার নাম চুরি—

ছাত্রগণ। ছ্যা—ছ্যা, আমরা তাতে নেই, তাতে নেই।

লুটবেহারী। কিহে গাঁট্টালাল, চুপ ক’রে কেন? সায় দাও না।

জগদগুরু। ভালমানুষ সেজে কেড়ে নিয়ে শেষে ধরা পড়ার নাম জুয়াচুরি—

ছাত্রগণ। রাম কহ, তোবা, থুঃ।

গুহা। কি লুটবেহারী, চোখ বুঁজে কেন?

জগদগুরু। আর যাতে ঢাক পিটিয়ে কেড়ে নেওয়া যায়, অথচ শেষ পর্যন্ত নিজের মানসম্ভ্রম বজায় থাকে লোকে জয়—জয়কার করে— সেটা মহাবিদ্যা।

ছাত্রগণ। জগদগুরু কি জয়! আমরা তাই চাই, তাই চাই।

গুঁই। কিন্তু ঐ কেড়ে নেওয়া কথাটা একটু আপত্তিজনক।

লুটবেহারী। আপনার মনে পাপ আছে। তাই খটকা বাধছে। কেড়ে নেওয়া পছন্দ না হয়, বলুন ভোগা দেওয়া।

গুঁই। কে হে বেহায়া তুমি? তোমার কমনশেন্স নেই?

জগদগুরু। বৎস, কেড়ে নেওয়াটা রূপক মাত্র। সাদা কথায় এর মানে হচ্ছে —সংসারের মঙ্গলের জন্য লোককে বুঝিয়ে—সুঝিয়ে কিছু আদায় করা।

লুটবেহারী। আমার তো সবে একটি সংসার। কিছু আদায় করতে পারলেই ছছল—বছল নবাবসাহেবের বরঞ্চ—

হোমরাও। অর্ডার, অর্ডার।

গুঁই। দেখুন জগদগুরু, আমার দ্বারা বিবেক—বিরুদ্ধ কাজ হবে না। কিন্তু ঐ যে আপনি বললেন—সংসারের মঙ্গলের জন্যে, সেটা খুব মনে লেগেছে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি—

লুটবেহারী। মশায়, ভগবান বেচারাকে নিয়ে যখন—তখন টানাটানি করবেন না, চটে উঠবেন।

নিতাই। আচ্ছা, সকলেই যদি মহাবিদ্যা শিখে ফেলে তা হলে কি হবে?

জগদগুরু। সে ভয় নেই তোমরা প্রত্যেকে যদি প্রাণপণে চেষ্টা কর, তা হলেও কেবল দু—চারজন ওতরাতে পার।

সরেশ। সার, একবার টেস্ট ক’রে নিন না।

জগদগুরু। এখন পরীক্ষা করলে বিশেষ ভাল ফল পাওয়া যাবে না। অনেক সাধনা দরকার।

নিরেশ। কিছু—মার্কও কি পাব না?

জগদগুরু। কিছু—কিছু পাবে বই কি। কিন্তু তাতে এখন ক’রে—খেতে পারবে না।

নিরেশ। তবে না হয় আমাদের কিছু হোম—একসারসাইজ দিন।

জগদগুরু। বাড়িতে তো সুবিধা হবে না বাছা। এখন তোমরা নিতান্ত অপোগণ্ড। দিনকতক দল বেঁধে মহাবিদ্যার চর্চা কর।

খুদীন্দ্র। ঠিক বলেছেন। আসুন মহারাজ, আপনি আমি আর নবাবসাহেব মিলে একটা অ্যাসোসিয়েশন করা যাক।

প্রফেসর গুঁই। আমাকেও নেবেন। আমি স্পীচ লিখে দেব।

মিস্টার গুহ। নিতাইবাবু, আমি ভাই তোমার সঙ্গে আছি।

লুটবেহারী। আমি একাই এক শ। তবে রুপচাঁদবাবু যদি দয়া ক’রে সঙ্গে নেন।

রূপচাঁদ। খবরদার, তুমি তফাত থাক।

লুটবেহারী। বটে? তোমার মত ঢের—ঢের বড়লোক দেখেছি।

গাঁট্টালাল। আমরা কারও তোয়াক্কা রাখি না—কি বল তেওয়ারীজী?

মিস্টার গুপ্টা। ভাবনা কি সরেশবাবু, নিরেশবাবু। আমি টেকনিক্যাল ক্লাস খুলছি, ভর্তি হ’ন। তরল আলতা, গোলাবী বিড়ি, ঘড়ি—মেরামত, ঘুড়ি—মেরামত, দাঁত—বাঁধানো, ধামা—বাঁধানো সব শিখিয়ে দেব।

দীনেশ। গুরুদেব, চুপি—চুপি একটা নিবেদন করতে পারি কি?

জগদগুরু। বল বৎস।

দীনেশ। দেখুন, আমি নিতান্তই মুরুব্বীহীন। মহাবিদ্যার একটা সোজা তুকতাক—বেশী নয়, যাতে লাখ—খানেক টাকা আসে—যদি দয়া ক’রে গরিবকে শিখিয়ে দেন।

জগদগুরু। বাপু, তোমার গতিক ভাল বোধ হচ্ছে না। মহাবিদ্বান অপরকেই তুকতাক শেখায়—নিজে ও সবে বিশ্বাস করে না।

দীনেশ। টিকিটের টাকাটাই নষ্ট। তার চেয়ে ডার্বির টিকিট কিনলে বরং কিছুদিন আশায় আশায় কাটাতে পারতুম।

গবেশ্বর। আমার কি হবে প্রভু? কেউ যে দলে নিচ্ছে না।

জগদগুরু। তুমি ছেলে তৈরি কর। তাদের শেখাও—মহাবিদ্যা শেখে যে, গাড়ি—ঘোড়া চড়ে সে।

পাঁচু মিয়া। আমার কি করলেন ধর্মাবতার?

জগদগুরু। তুমি এখানে এসে ভাল করনি বাপু। তোমার গুরু রুশিয়া থেকে আসবেন, এখন ধৈর্য ধ’রে থাক।

গুহা। দশহাজার টাকা চাঁদা তুলতে পারিস? ইউনিয়ন খুলে এমন হুড়ো লাগাব যে এখনি তোদের মজুরি পাঁচগুণ হয়ে যাবে।

মিস্টার গ্র্যাব। সাবধান, আমার চটকলের ত্রিসীমানার মধ্যে যেন এস না।

গুহা। (চুপি চুপি) তবে আপনার বাড়ি গিয়ে দেখা করব কি?

কাঙালীচরণ। দেবতা আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি?

জগদগুরু। তোমার আবার কি চাই? ব’লে ফেল।

কাঙালী। যদি কখনও মহাবিদ্যা ধরা পড়ে যায়, তখন অবস্থাটা কি রকম হবে?

জগদগুরু। (ঈষৎ হাসিয়া বেদী হইতে নামিয়া পড়িলেন)।

ঘণ্টা ও কোলাহল

ভারতবর্ষ, ফাল্গুন ১৩২৯ (১৯২২)