উপেক্ষিত
শহর ফতেহাবাদ, সময় অপরাহ্ন। শাহজাদী জবরউন্নিসা দিলতোড়বাগ উদ্যানে একাকিনী বসিয়া আছেন। সমান্তরাল তরুশ্রেণীর শীর্ষে অস্তরাগ ঝিকমিক করিতেছে, ডালে ডালে হাজার বুলবুলের কাকলি, গোলাবের ফোয়ারায় রামধনুর রংবাহার, ফুলে ফুলে চারিদিক ছয়লাপ। শাহজাদীর হাতে রবাব, তাহাতে তিনি কোমল গুঞ্জন তুলিয়া আপন মনে মৃদুস্বরে গাহিতেছেন। তাঁহার প্রিয় ব্যাঘ্র হেমকান্তি ফারুকশিয়র পদ—প্রান্তে বসিয়া থাবা দিয়া তাল দিতেছে এবং মাঝে মাঝে স্বামিনীর বিজাপুরী জরিদার লাল চটিজুতা চাটিতেছে।
সহসা একটি পুরুষ মূর্তির আবির্ভাব। গৌরবর্ণ বলিষ্ঠ দেহ, বক্রাগ্র দাড়ি, বহুমূল্য পরিচ্ছদ, কটিবন্ধে রত্নখচিত পিধানে নিহিত দামস্কসীয় তলবার। ইনিই সুবিখ্যাত কোফতা খাঁ, বাদশাহের সেনাপতি ও দক্ষিণহস্ত।
জবরউন্নিসা চমকিত হইয়া বলিলেন—’একি, কোফতা খাঁ, তুমি এখানে?’
সেনাপতি কহিলেন—’হাঁ সুন্দরী। আজ আমি একটা হেস্ত—নেস্ত করিতে চাই। তুমি বহুকাল আমাকে ছলনা করিয়াছ, আজ জবান খুলিয়া বল আমাকে বিবাহ করিবে কি না।’
জবরউন্নিসা কন্দর্পচাপতুল্য তাঁহার ভ্রূযুগল কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন—’বেওকুফ, তুমি কাহার সঙ্গে কথা কহিতেছ? ছিলে নগণ্য কিজিলবশ ক্রীতদাস, আজ বাদশাহের দয়ায় সেনাপতি হইয়াছ। বস, ঐখানেই ক্ষান্ত হও, অধিক ঊর্ধ্বে নজর দিও না।’
কোফতা খাঁ যথোচিত ভীষণতা সহকারে একটি অট্টহাস্য হাসিলেন। বলিলেন,—’শাহজাদী, কে তোমার পিতাকে তখতে চড়াইয়াছে? মারহাট্টার আক্রমণ কে বার বার রোধ করিয়াছে? কাহার অনুগ্রহে তোমার এই ভোগৈশ্বর্য, এই হীরাজহরৎ, এই লীলা—উদ্যান, এই হাজার—বুলবুল—মুখরিত বুস্তাঁ? ঈনশাল্লাহ! জান, একটি অঙ্গুলির হেলনে সমস্ত ভূমিসাৎ করিতে পারি? আজ হিন্দুস্তানের প্রকৃত মালিক কে? তোমার অক্ষম পিতা, না এই মহাবীর রুস্তম—ই—হিন্দ কোফতা খান ফতে জঙ্গ?’
জবরউন্নিসা বলিলেন—’কুত্তার গর্দানে লোম গজাইলেই সে সিংহ হয় না।’
সেনাপতি কহিলেন—’বিসমিল্লাহ! এই কথা আর কেহ বলিলে এই মুহূর্তে তাহাকে কোতল করিতাম। কিন্তু তুমি আমার দিল গিরিফতার করিয়াছ, এবারকার মত মাফ করিলাম। যাহা হউক, এখনও বল তুমি আমার হৃদয়েশ্বরী হইবে কি না।’
জবরউন্নিসা মধুর হাস্য করিয়া বলিলেন—’কোফতা খাঁ, তুমি কি কবি হাফেজের সেই বয়েতটি জান না?—কুকুর বার বার ঘেউ ঘেউ করে, কিন্তু সিংহী একবারই গর্জায়।’
ইহার পর কোনও পুরুষই স্থির থাকিতে পারে না, বিশেষত সেই দারুণ মুঘল যুগে। কোফতা খাঁ হুংকার করিয়া কহিলেন—’ইলহমদলিল্লাহ! শাহজাদী, তবে আল্লার নাম স্মরণ করিয়া মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।’ কোষ হইতে সড়াক করিয়া অসি নির্গত হইল।
‘কোফতা খাঁ তুমি আমাকে নিতান্তই হাসাইলে!’ এই বলিয়া শাহজাদী অন্যমনস্কভাবে গুনগুন করিয়া গহিতে লাগিলেন—’চল চল চম্বেলীবাগ পর মেরা বাঘকো খিলাউংগি।’
অসহ্য। কোফতা খাঁর নিষ্ঠুর হস্তে তলবার ঝলকিয়া উঠিল। সহসা শূন্যে যেন সৌদামিনী খেলিল, একটি হিল্লোলিত কাঞ্চনাকায়া নিমেষের তরে উৎক্ষিপ্ত হইয়া আবার ভূতলে পড়িল। একটু অস্ফুট আর্তনাদ, একটু ছটফটানি, তাহার পর সব শেষ।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হইতেছে। জবরউন্নিসা তখন যন্ত্রে ঝংকার তুলিয়া গাহিতেছেন—’আয়সে বেদরদীকে পালে পড়ী হু।’ তাঁহার পোষা বাঘটি ভোজন সমাপ্ত করিয়া পরম তৃপ্তির সহিত সৃক্কণী পরিলেহন করিতেছে। তাহার বাঁয়ে কোফতা খাঁর পাগড়ি, ডাহিনে ছিন্ন ইজার কাবা জোব্বা, সম্মুখে কিঞ্চিৎ হাড়।
১৩৩৬ (১৯২৯)