দশকরণের বাণপ্রস্থ
দর্ভাবতীর রাজা দশকরণ একদিন রাজসভায় পদার্পণ ক’রেই বললেন, ‘আমার পঞ্চাশ বৎসর বয়স পূর্ণ হয়েছে, কালই আমি বানপ্রস্থে যাব।’
বৃদ্ধমন্ত্রী আকাশ থেকে পড়ে বললেন, ‘সে কি মহারাজ, আপনি এখনও যুবা, চুল পাকে নি, দাঁত পড়ে নি, শরীর অজর, বাহু সবল, বুদ্ধি তীক্ষ্ন, কি দুঃখে কালই বনে যাবেন? এখন বিশ বৎসর ওকথা তুলবেন না।’
রাজা ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘না, আমার যাওয়াই স্থির। কুমারের অভিষেক আজই হ’য়ে যাক। উৎসবটা পরে করলেই চলবে।’
মন্ত্রী বললেন, ‘হাঁ, কি দুর্দৈব! মহারাজ, হঠাৎ এমন মত কেন আপনার হ’ল? দর্ভাবতী রাজ্যের অবস্থাটা ভেবে দেখুন। রাজপুত্র এখনও বালক, সবে বাইশ বৎসরে পড়েছেন, আমিও জরাগ্রস্ত। রাজ্য চালনা কি আমাদের কাজ? কুমার, তুমি মহারাজকে বুঝিয়ে বল না।’
কুমার নতমস্তকে উত্তর দিলেন, ‘আমি আর কি বলব। পিতা যদি ধর্মার্থে তৃতীয় আশ্রম গ্রহণ করেন তবে আমি তাতে বাধা দিয়ে পাপের ভাগী কেন হব। তাঁর পদানুসরণ করে অগত্যা আমিই রাজ্য চালাব।’
যুবমন্ত্রী বললেন, ‘আর আমরাও তো আছি, ভয় কি।’
বৃদ্ধমন্ত্রী তখন হতাশ হয়ে স্থবির রাজপুরোহিতকে বললেন, ‘ধর্মজ্ঞ মাণ্ডুক, এই সংকটে একমাত্র আপনিই মহারাজ দশকরণকে সদবুদ্ধি দিতে পারেন।’
মাণ্ডুক বললেন, ‘মহারাজ, পঞ্চাশোর্ধ্বে বনপ্রস্থান নৃপতির পক্ষে অবশ্যকৃত নয়। দশরথ অতি বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেছিলেন। দু—বার জরাগ্রস্ত হয়েও সিংহাসন ছাড়েন নি। যদি পরমার্থই আপনার অভিপ্রেত হয়, তবে রাজর্ষি জনকের তুল্য নির্লিপ্তচিত্তে প্রজাপালনে নিযুক্ত থেকে মোক্ষানুসন্ধান করুন।’
দশকরণ কিছুতেই সম্মত হলেন না। এদিকে তাঁর বনগমনের সংবাদ কিঞ্চিৎ রঞ্জিত হয়ে অন্তঃপুরে পৌঁছে গেছে। ছোটরানী মহা উৎসাহে সভায় এসে বললেন, ‘আর্যপুত্র, আমি প্রস্তুত, দ্বিপ্রহরের মধ্যেই সমস্ত গুছিয়ে ফেলব। সঙ্গে বেশী কিছু নেব না, শুধু আমার অলংকার তিন মঞ্জুষা, বসন দশ পেটিকা, এটা—সেটা বিশ পেটিকা। আর তিনজন সখী, আর দশজন দাসী, আর শুকসারী, আর আমার প্রিয় মার্জারী দধিমুখী। আপনি গোটাদশেক বড় বড় স্কন্ধাবার পাঠাবার ব্যবস্থা করুন, তাতেই আমদের কুলিয়ে যাবে। উঃ ভারী মজা হবে, দিনকতক ঝামেলা থেকে বাঁচা যাবে। সঙ্গে আবার ভেজাল জোটাবেন না যেন।’
রাজা বললেন, ‘ওসব কিছুই যাবে না। যুবরাজ কাল তোমাকে পিত্রালয়ে পাঠিয়ে দেবেন।’
ছোটরানী রাগে দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন। বড়রানী দেবপূজায় ব্যস্ত ছিলেন, এখন সংবাদ পেয়ে এসে বললেন, ‘মহারাজ, একি শুনছি! আমি সহধর্মিনী পট্টমহিষী, আমাকে ফেলে যাবেন না তো?’
রাজা উত্তর দিলেন, ‘তুমি এখানেই তোমার পুত্রের কাছে থাকবে। আর ইচ্ছা হয় তো বারাণসীতে বাস করতে পার।’
যুক্তি, ধর্মোপদেশ, অনুনয়, ক্রন্দন কিছুতেই কিছু হ’ল না। রাজা দশকরণ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সভা ভঙ্গ হ’ল।
দ্বিপ্রহরে দশকরণের নিভৃত কক্ষে গিয়ে রাজবয়স্য প্রগলভক বললেন, ‘মহারাজ, এতকাল আমার কাছে কিছুই গোপন করেন নি। আজ একবার মনের কথাটি খুলে বলতে আজ্ঞা হ’ক। ধর্মে আপনার বেশী মতি আছে, তা তো বোধ হয় না, পরকালের চিন্তাও করতে দেখি নি। পুত্রকলত্রের উপদ্রব সইতে না পেরে বনে পালাচ্ছেন না তো?’
রাজা বললেন, ‘খেপেছ, তাহলে পুত্রকলত্রকেই বনে পাঠাতাম।’
‘তবে কি জন্য যাচ্ছেন?’
দশকরণ একটু হেসে বললেন, ‘ফুর্তি করবার জন্য।’
‘অবাক করলেন মহারাজ। রাজপদে থেকে ফুর্তি হবে না আর বনে গিয়ে হবে! ফুর্তি চান তো এখানেই তার বাধা কি? আরও গুটিদশেক মহিষী গৃহে আনুন, নৃত্যগীতনিপুণা ভাল ভাল বারাঙ্গনা বাহাল করুন, কাকাক্ষীনদীতটে সুবিশাল প্রমোদ—কানন রচনা করুন, তাতে মনোরম সৌধ তুলুন। উৎকলিঙ্গ থেকে নিপুণ সুপকার, গান্ধার থেকে পলান্নপাচক, গৌড়ভূমি থেকে লডডুকলাবিৎ আনান। আর ময়লাদ্রির গন্ধসম্ভার, সিংহলের রত্নাভরণ, বাহ্ণিকজাত বিচিত্র আস্তরণ, যবন—দেশের আসব—’
‘থাম থাম, ওসব আমার খুব জানা আছে। শুধু বিলাস সামগ্রীতে কিছু হয় না, ভোগের শক্তি চাই।’
‘আপনার শক্তি কম কি? আর বনে গেলেই কি শক্তি বাড়বে?’
‘মূর্খ, তুমি বুঝবে না। যদি আবার কখনও দেখা হয় তখন বুঝিয়ে দেব। যাও এখন বিরক্ত ক’রো না।’
রাজাকে উন্মাদ ভেবে, প্রগলভক বিষণ্ণ মনে চলে গেলেন।
পরদিন ভোরবেলা, দশকরণ রথারূঢ় হ’য়ে রাজ্য ত্যাগ করলেন। সঙ্গে নিলেন শুধু একটি নাতিবৃহৎ থলি। বহুদূরে এসে রথ আর সারথিকে ফিরিয়ে দিলেন, তার পর থলিটি কাঁধে নিয়ে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন।
দশকরণ একটি গাছের তলায় ব’সে একান্তঃকরণে ব্রহ্মার আরাধনা করতে লাগলেন। তিন দিন তিন রাত অতিক্রান্ত হ’ল, অবশেষে ব্রহ্মা দর্শন দিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি চাও?’
দশকরণ সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতান্তে বললেন, ‘প্রভু, আমার পিতৃদত্ত নামটি সার্থক করুন।’
‘তার মানে?’
‘আমার প্রত্যেক ইন্দ্রিয় দশগুণ ক’রে দিন। অর্থাৎ চক্ষু, বিংশতি কর্ণ, দশ নাশা, দশ জিহ্বা, দশগুণ বিস্তৃত ত্বক।’
‘আর বাক—পাণি—পাদাদি কর্মেন্দ্রিয়? হৃৎ—ক্লোম—জঠরাদি যন্ত্র?’
‘তাও দশ—দশগুণ।’
বিধাতা সবিস্ময়ে বললেন, অর্থাৎ তুমি একাই দশজন হ’তে চাও। তোমার মতলবটা কি?
‘প্রভু, তবে খুলে বলি শুনুন! আমার দেহটা তো মোটে সাড়ে তিন হাত বানিয়েছেন, আর ইন্দ্রিয়াদি যা দিয়েছেন তাও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র। কতই বা দেখব, কতই শুনব, কতই খাব, কতটুকুই বা ভোগ করব? আমি মহালোভী পুরুষ, আমার ইন্দ্রিয় বর্ধন করে ভোগশক্তি দশগুণ বাড়িয়ে দিন।’
‘বটে! কিন্তু দশ—দশটা আলাদা দরকার কি, একটা প্রকাণ্ডদেহ যদি দিই, তাতে সব অঙ্গই, তো বড় বড় হবে।’
‘আজ্ঞে, আমি ভেবে দেখেছি, লাভ হবে না। হাতির দেহ প্রকাণ্ড, তার সুখভোগের মাত্রা তো ইঁদুরের চেয়ে বেশী নয়। সংখ্যা না বাড়লে ভোগ বাড়বে না।’
‘তুমি খুব হিসাবী দেখছি। আচ্ছা, মন নামে একটা অন্তরিন্দ্রিয় আছে, তা কটা চাও?’
‘সে কথা তো ভাবি নি প্রভু। আচ্ছা মন একটাই থাকুক।’
‘উত্তম প্রস্তাব। এরূপ জীবনকল্পনা আমার মাথাতেও আসে নি, তোমার উপরই পরীক্ষা হ’ক। কিন্তু সামলাতে পারবে তো? যদি সর্দি হয় তো দশটা নাক হাঁচবে, যদি জ্বর হয় তবে বিশটা পা কামড়াবে। আরও অসুবিধা আছে—লোকে যদি রাক্ষস ভেবে তোমাকে আক্রমণ করে?’
‘প্রভু, আপনি সুখ দুঃখ দুই—ই দিয়েছেন, তবু তো লোকে জীবন ধারণ করতে চায়। আমি দশটা জীবন একসঙ্গে ভোগ করতে চাই, দুঃখ যদি বাড়ে সুখও তো বাড়বে। আমার এই বর্তমান দেহ খুব শক্তিমান, আর আপনার প্রদত্ত অঙ্গগুলির জন্য বলবীর্য দশগুণ বাড়বে। তবে যা দেবেন মজবুত দেখেই দেবেন। আমার সঙ্গে প্রচুর ধনরত্নও আছে, সেই অর্থবলে আর বাহুবলে সকলকেই বশে এনে নবরাজ্য স্থাপন করব।’
বিধাতা বললেন, ‘তবে তাই হ’ক, তথাস্তু। সার্থকনামা দশকরণ, উত্তিষ্ঠ, ঐ ডোবার জলে তোমার নবকলেবরের প্রতিবিম্ব দেখে নাও, তারপর যথেচ্ছা ভোগের আয়োজন কর।’
এক বৎসর হয়ে গেছে। ব্রহ্মা বেদের পুঁথি নিয়ে কাটাকুটি করছেন এমন সময় তাঁর চতুর্মুণ্ডের চতুঃশিখা থরথর ক’রে কেঁপে উঠল, যাকে বলে টনক নড়া। ধ্যানস্থ হয়ে বুঝলেন দশকরণ তাঁকে আবার ডাকছেন। অদ্ভুতদেহধারীর পরিণাম জানবার জন্য তাঁর কৌতূহল হ’ল, আহ্বান পাবামাত্র ভূলোকে অবতরণ করলেন।
দশকরণ সেই গাছটির তলার বিষণ্ণ হয়ে বসে আছেন। বিধাতাকে দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে দণ্ডবৎ হলেন—কিছু কষ্টে, কারণ তাঁর নূতন যৌগিক দেহটি লম্বায় না বাড়লেও বেষ্টনে অনেকখানি।
ব্রহ্মা বললেন, ‘ভাল তো সব?’
‘কিছুই ভাল নয় প্রভু। বর তো দিলেন, কিন্তু সুখ পাচ্ছি না। আগে দুই চোখে একই দৃশ্য দেখতাম, এখন কুড়ি চোখে নানাদিকের দৃশ্য মিশে গিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে—গাছের উপর জল, জলের মধ্যে উড়ন্ত পাখি। ভেবেছিলাম দশ রসনায় বিভিন্ন রসের আস্বাদ নিয়ে একসঙ্গে বিচিত্র অনুভূতি পাব, এখন দেখছি কটুতিক্তমধুর মিশে গিয়ে এক উৎকট উপলব্ধি হচ্ছে। দশটি উদর বোঝাই ক’রেও তৃপ্তি বাড়ছে না। দশ জোড়া পা থাকলেও দশগুণ পথ চলতে পারি না। সব অঙ্গেরই এক দশা! আচ্ছা, আপনিও তো চতুরানন চতুর্ভুজ, কিরকম বোধ করেন?’
‘কিছুই বোধ করি না, ওসব মাথমুণ্ডু আমার নিজের নয়। মানুষ সৃষ্টি করবার পর হঠাৎ একদিন দেখি আমার চারটে মাথা চারটে হাত গজিয়েছে। এ হচ্ছে মানুষের কাজ, তারা আমার সৃষ্টির শোধ তুলেছে আমারই স্কন্ধে। তা এখন কি চাও বল।’
‘আপনি বলুন কি করলে আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।’
‘বাপু, পরামর্শ দেওয়া আমার কাজ নয়। আর তোমার উদ্দেশ্য যে কি তারও স্পষ্ট ধারণা তোমার নেই। যা চাও নিজেই স্থির ক’রে বল।’
‘আমার একটা মনই গোলযোগের কারণ। এখন কৃপা ক’রে দশটি মন দিন, তাতে প্রত্যক্ষগুলো আর জট পাকাবে না, আলাদা মনের খোপে খোপে থাকবে।’
ব্রহ্মা তথাস্তু ব’লে প্রস্থান করলেন।
আর এক বৎসর কেটে গেছে। ব্রহ্মার আবার টনক নড়ল, দশকরণ ডাকছেন। বিরক্ত হ’য়ে বললেন, ‘আঃ লোকটা জ্বালিয়ে মারলে। যাই হ’ক, শেষ অবধি দেখতে হবে।’
ব্রহ্মা এসে দশকরণকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিহে, এবার সুবিধে হল?’
দশকরণ কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘কই আর হ’ল প্রভু, দশটা মনে আরও গোলযোগ বেড়েছে। যতই চেষ্টা করি মনে হয় ভিন্ন ভিন্ন লোক ভোগ করছে। একবার বোধ হয় আমি দেবদত্ত—মিষ্টান্ন খাচ্ছি, আবার ভাবি আমি গঙ্গা দত্ত—সংগীত শুনছি। তখনই আবার দেখি আমি অনঙ্গদত্ত—প্রেমালাপে মগ্ন, পুনশ্চ আমি ত্রিভঙ্গদত্ত—গেঁটেবাতে কাতর। সমস্ত অনুভূতি কেন্দ্রস্থ করতে পারছি না, কেবলই বিক্ষেপ হয়। আমার মনগুলোও দিয়েছেন হরেক রকমের—চালাক, বোকা, শান্ত, সহিষ্ণু, রাগী, উদার, হিংসুটে, নিষ্ঠুর, দয়ালু। এই দেখুন না, আপনার কাছে যে মনের কথা জানাব তাতেও বাধা। প্রত্যেক মন চায়—আমি বলব, আমি বলব। কোনও গতিকে রফা ক’রে একটি মন এখন মুখপাত্র হয়েছে!’
‘হুঁ, এ রকম যে হবে তা আগেই অনুমান করেছিলাম। এখন কি চাও?’
‘প্রভু, কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনিও তো উপায় বলবেন না। এখন বরং পূর্বদেহ পূর্বমন ফিরিয়ে দিন, দিনকতক প্রকৃতিস্থ হ’য়ে ভেবে চিন্তে দেখি, তারপর আবার আপনার শরণাপন্ন হব।’
ব্রহ্মা বললেন, ‘তথাস্তু।’
তার পর আরও পাঁচ বৎসর কেটে গেছে। ব্রহ্মা দশকরণের কথা ভুলে গেছেন, তাঁর কাছে কোন ডাকও আর আসেনি। একদিন তিনি সৃষ্টি চিন্তা করছেন, ভাবছেন—বেঁটে শরীরের সঙ্গে পীতচর্ম আর খাঁদা নাক দিলে কেমন হয়, এমন সময় তাঁর তৃতীয় মূণ্ডের দ্বিতীয় কর্ণ সুড়সুড় করে উঠল। হাত দিয়ে পেলেন—একটি ষটপদ সহস্রাক্ষ বিচিত্রপক্ষ পতঙ্গ, যার নাম প্রজাপতি। দেখেই দশকরণকে মন পড়ে গেল।
লোকটার হ’ল কি, আর তো সাড়াশব্দ নেই, মারা গেল নাকি? বোধ হয় হতাশ হ’য়ে নিজের রাজ্যে ফিরে গেছে। কিন্তু গিয়েই বা কি করবে, এই সাত বৎসর পরে তার ছেলে তো আর দখল দেবে না। ধ্যানস্থ হ’য়ে দেখলেন, দশকরণ বেঁচে আছেন, দর্ভাবতীর নিকটেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিধাতা বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের মূর্তিতে তখনই সেখানে নেমে এলেন।
গোপপল্লী। একটা মেটে ঘরের মটকায় চ’ড়ে দশকরণ খড় দিয়ে চাল ছাইছেন, ঘরের সামনে একটি গোপনারী শিশুকে খাওয়াচ্ছে আর হাত নেড়ে দশকরণকে কাজ বাতলাচ্ছে।
ব্রহ্মা ডাকলেন, ‘ওহে দশকরণ, হচ্ছে কি?’
দশকরণ নেমে এসে অপরিচিত ব্রাহ্মণকে প্রণাম ক’রে বললেন, ‘কে আপনি দ্বিজবর?’
‘আরে আমি ব্রহ্মা, তোমার খোঁজ নিতে এসেছি। তারপর তোমার গবেষণা কতদূর এগল? চেহারাটা চাষাড়ে হয়ে গেছে দেখছি। এখন করা হয় কি, আছ কেমন?’
‘খুব ভাল আছি প্রভু। এই গৃহের স্বামী অসুস্থ, অন্য পুরুষ নেই, বর্ষাও আসন্ন, তাই আমিই ঘরের চালটা মেরামত করে দিচ্ছি।’
‘সুখ হচ্ছে?’
‘পরিশ্রম হচ্ছে, অভ্যাস নেই কিনা! সুখী হবে এই গোপ—দম্পতি।’
‘এখানেই থাকা হয় বুঝি?’
‘না, গ্রামের প্রান্তে থাকি, তবে কাজের জন্য নানা স্থানে ঘুরে বেড়াতে হয়।’
‘দর্ভাবতী রাজ্যের সংবাদ কি, তোমার সেই ধনরত্নের থলিটার কি হ’ল?’
‘রাজ্য পুত্রের হাতে, আর ধন যা এনেছিলাম তার কিছু খরচ হয়ে গেছে, অবশিষ্ট রাজকোষে ফেরত দিয়েছি। রাজ্যের লোক এখন আমাকে চিনতে পারে না, আর দুরভিসন্ধি নেই জেনে কেউ অনিষ্টও করে না।’
‘রাজমহিষীরা কোথায়?’
‘জ্যেষ্ঠা পত্নী আমার কাছেই আছেন। কনিষ্ঠা আসতে চান না।’
‘তা হ’লে আবার সংসারধর্ম করছ। আমি ভেবেছিলাম বুঝি বানপ্রস্থের অন্তে সন্ন্যাস নিয়েছ। তোমার সেই উৎকট খেয়ালের কি হল—সেই মহাভোগায়তন দশদেহসংঘাত?’
দশকরণ সহাস্যে বললেন, ‘সে সমস্যার সমাধান হ’য়ে গেছে প্রভু। এখন আমি দশকরণ নই, কোটিকরণ; তারও একীকরণ হয়ে গেছে। গোছাবাঁধা দশটা দেহমনের দরকার কি, দেখছি যত জীব আছে সব মিলে আমি, এখন ভোগের ইয়ত্তা নেই। ভারী সুবিধা হয়েছে, সকলের সুখদুঃখ পৃথক ক’রেও বুঝতে পারি, একত্রও বুঝতে পারি।’
‘কি রকম?’
‘সেদিন বাঘে একটা গরু মারলে। অবলা গরুর মৃত্যুযন্ত্রণা আর ক্ষুধার্ত বাঘের ভোজনসুখ দুই—ই বুঝলাম। গ্রামের লোকে মিলে কুঠারাঘাতে বাঘটা মারলে। অসহায় বাঘের আর্তনাদ আর দলবদ্ধ গ্রামবাসীর উল্লাস তাও বুঝলাম।’
‘ভাল মন্দ সবই নির্বিকার সাক্ষী হয়ে দেখ?’
‘তা কেন দেখব। বাঘটাকে প্রথম মার আমিই দিয়েছিলুম, মৃগয়া অভ্যাস ছিল কিনা। আপনি অপক্ষপাতে ভাল মন্দ মিশিয়ে জগৎ সৃষ্টি করেছেন, আবার প্রবল স্বার্থবোধও দিয়েছেন। তাই বাঘে গরু মানুষ মারে, মানুষে বাঘ মারে, মানুষকেও মারে। যখন রাজা ছিলাম, তখন নিজের সুখটাই অগ্রগণ্য ছিল। তার পর সুখবৃদ্ধির নূতন উপায় মাথায় এল, আপনার বরে দশমনা হলাম। নিজের দশটা অংশের স্বার্থসিদ্ধি তো সব সময় করা যায় না, তাই রফা করতে হল। যথাসম্ভব সবকটাকে সুখে রাখবার চেষ্টা করতাম, না পারলে গোটাকতককে নিগৃহীত করতাম। তার পর স্বার্থবুদ্ধি আরও ব্যাপক হ’ল, বুঝলাম দশটা দেহমন যথেষ্ট নয়, একসঙ্গে জড়িয়ে থাকাও অনর্থকর, পৃথক থেকেও একত্ব—বোধ হয়। এখন কোটিকরণ হয়েছি, বিস্তর ইন্দ্রিয় বিস্তর দেহমন। তাই মধ্যম পন্থা আরও বেশী শিখেছি। সর্ব অবয়বের লাভালাভ বুঝে চলতে হয় প্রভু আপনার মতন নির্মম সাক্ষী হয়ে থাকতে পারি না।’
‘লাভালাভ বিচারে ভুল ক’র না?’
‘করি বই কি। সেটা আপনার দোষ—যেমন বুদ্ধি দিয়েছেন তেমনই তো হবে, ঘ’ষে মেজে ঠেকে শিখে আর কতই বাড়বে।’
‘আচ্ছা দশকরণ, বুঝলাম তোমার অনেক দেহ, অনেক মন। কিন্তু তোমার আত্মা কটা?’
‘সমস্যায় ফেললেন প্রভু। বৃদ্ধ মান্ডুক বলতেন বটে—জীবাত্মা, পরমাত্মা, প্রত্যাগাত্মা, সর্বাভূতান্তরাত্মা—এইসব কটমটে কথা। আমার কটা আছে তা তো জানি না।’
‘হয়তো এককালে জানবে। না জানলেও তোমার কাজ আটকাবে না।’
এমন সময় একটি লোক এসে ডাকলে, ‘ওহে এককড়ি, আজ যে বুড়ো জরৎখরের কুলত্যাগিনী বউটার একটা গতি করবার কথা, তার পর গ্রামের ছেলেদের ধনুর্বিদ্যা শেখাবে, তার পর সন্ধ্যায় ভরতরাজার উপাখ্যান শোনাবে বলেছিলে। তোমার আর কত দেরি?’
ব্রহ্মা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এককড়ি কে?’
দশকরণ বললেন, ‘আজ্ঞে আমি। ওরা কোটিকরণ একীকরণ বোঝে না, সংক্ষেপে এককড়ি বলে। তুমি এগোও হে, আমি হাতের কাজটা শেষ ক’রেই যাচ্ছি। প্রভু, আমার একটি শেষ প্রার্থনা আছে। বয়স তো অনেক হ’ল গবেষণাও ঢের ক’রে দেখলাম। এইবার মুক্তির সন্ধান দিন।’
ব্রহ্মা হেসে বললেন, ‘বল কি হে, তোমার এতগুলো সত্তাকে ফাঁকি দিয়ে তুমি একাই মুক্তি চাও?’
‘ঠিক বলেছেন। থাক গে, মুক্তির দরকার নেই।’
‘দরকার না থাকলেও তুমি পেয়ে গেছ।’
‘দোহাই পিতামহ, পরিহাস করবেন না।’
‘আরে মুক্তির পথ কি একটা? তোমার রাজবুদ্ধি তোমাকে মুক্তির রাজমার্গ দেখিয়েছে।’
বিধাতা অন্তর্হিত হলেন। দশকরণ আবার মটকায় চ’ড়ে ভাবতে লাগলেন—এ কি রকম মুক্তি, লোকে ছাড়তেই চায় না, নাইবার খাবার অবসর নেই।
১৩৪৯ (১৯৪২)