শোনা কথা
আমাদের পাড়ায় একটি ছোট পার্ক আছে, চার ধারে একবার ঘুরে আসতে পাঁচ মিনিট লাগে। সকাল বেলায় অনেকগুলি বুড়ো ও আধবুড়ো ভদ্রলোক সেখানে চক্কর দেন। এঁদের ভিন্ন ভিন্ন দল, এক এক দলে তিন—চারজন থাকেন। প্রত্যেক দলের আলাপের বিষয়ও আলাদা, যেমন রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব, অমুক সাধুবাবার মহিমা, শেয়ার বাজারের দূরবস্থা, আজকালকার ছেলেমেয়ে ইত্যাদি।
আশ্বিন মাস। একটি দলের কিছু পিছনে বেড়াচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ বৃষ্টি এল; পার্কে টালি দিয়ে ছাওয়া একটি ছোট আশ্রয় আছে, দলের চারজন তাতে ঢুকে পড়লেন। পূর্বে সেখানে দুটো বেঞ্চ ছিল, এখন একটা আছে, আর একটা চুরি গেছে। আমি ইতস্তত করছি দেখে একজন বললেন, ভিতরে আসুন না, ভিজছেন কেন, বেঞ্চে পাঁচজন কুলিয়ে যাবে এখন, একটু না হয় ঘেঁষাঘেঁষি হবে। বাংলায় থ্যাংক ইউ মানায় না, আমি কৃতজ্ঞতা সূচক দন্তবিকাশ করে বেঞ্চের এক ধারে বসে পড়লুম।
অনেক দিন থেকে এঁদের দেখে আসছি, কিন্তু কাকেও চিনি না। অগত্যা কাল্পনিক পরিচয় দিয়ে এঁদের বিচিত্র আলাপ বিবৃত করছি। প্রথম ভদ্রলোকটি–যিনি আমাকে ডেকে নিলেন–শ্যামবর্ণ, রোগা, মাথায় টাক, গোঁফ—কামানো, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি; চোখে পুরু কাচের চশমা, হাতে খবরের কাগজ। এঁকে দেখলেই মনে হয় মাস্টার মশায়। দ্বিতীয় ভদ্রলোকটিকে বহুকাল থেকে আমাদের পাড়ায় দেখে আসছি। এঁর বয়স এখন পঁয়ষট্টি, ফরসা রং, স্থূলকায়, একটু বেশী বেঁটে। পনর বৎসর আগে এঁর কালো গোঁফ দেখেছি, তার পর পাকতে আরম্ভ করতেই বার্ধক্যের লক্ষণ ঢাকবার জন্য কামিয়ে ফেলেন। সম্প্রতি এঁর চুল প্রায় সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু চামড়া খুব উর্বর, টাক পড়েনি। এই সুযোগে ইনি এখন আবক্ষ দাড়ি—গোঁফ এবং আকণ্ঠ বাবরি চুল উৎপাদন করেছেন, তাতে চেহারাটি বেশ ঋষি ঋষি দেখাচ্ছে। বোধহয় ইনি যোগশাস্ত্র, থিয়সফি, ফলিত জ্যোতিষ, ইলেকট্রোহোমিওপ্যাথি প্রভৃতি গূঢ় তত্ত্বের চর্চা করেন। এঁকে ভরদ্বাজবাবু বলব। তৃতীয় ভদ্রলোকটি দোহারা, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, বয়স প্রায় ষাট; কাঁচা—পাকা কাইজারি গোঁফ; চেহারা সম্ভ্রান্ত রকমের, পরনে ইজের ও হাতকাটা কামিজ, মুখে একটি বড় চুরুট। সর্বদাই ভ্রূ একটু কুঁচকে আছেন, যেন কিছুই পছন্দ হচ্ছে না। ইনি নিশ্চয় একজন উঁচুদরের রাজকর্মচারী ছিলেন। এঁকে বাবু বললে হয়তো ছোট করা হবে, অতএব চৌধুরী সাহেব বলব। চতুর্থ লোকটির বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ, লম্বা মজবুত গড়ন, কালো রং, গায়ে আধময়লা খাদি পাঞ্জাবি। গোঁফটি হিটলারি ধরনে ছাঁটা হলেও দেখতে ভালমানুষ, সবিনয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে সঙ্গীদের কথা শোনেন, মাঝে মাঝে আনাড়ীর মতন মন্তব্য করেন। ইনি কেরানী কি গানের মাস্টার, কি ভোটের দালাল, তা বোঝা যায় না। এঁকে ভজহরিবাবু বলব।
জিব দিয়ে একটা নৈরাশ্যের শব্দ করে ভজহরিবাবু বললেন, দিন দিন কি হচ্ছে বলুন তো! যা রোজগার করি তাতে খেতেই কুলায় না, ট্রামে বাসে দাঁড়াবার জায়গা নেই, আবার নতুন উপদ্রব জুটেছে বোমা। বড় ছেলেটা বিগড়ে যাচ্ছে, ধমকাবার জো নেই, তার বন্ধুদের লেলিয়ে দিয়ে কোনদিন আমাকে ঘায়েল করবে।
মাস্টার মশায় বললেন, আট শ বৎসর দাসত্বের পরে দেশ স্বাধীন হয়েছে, এখন অনেকে একটু বেচাল আর অসামাল হবেই। অবাধ্যতা বোমা চুরি—ডাকাতি কালোবাজার ঘুষ সবই কিছুকাল সইতে হবে, অবশ্য প্রতিকারের চেষ্টাও করতে হবে। এই সমস্তই স্বাধীনতাযুগের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম, অন্য দেশেও এমন হয়েছে।
চৌধুরী সাহেব ধমকের সুরে বললেন, তা বলে বেপরোয়া যাকে তাকে বোমা মারবে?
মাস্টার। এ সমস্তই আমাদের কর্মফল–
ভরদ্বাজবাবু তর্জনী নেড়ে বললেন, যা বলেছ দাদা। সবই প্রারব্ধ, পূর্বজন্মের পাপের ফল।
মাস্টার। আজ্ঞে না, ইহজন্মেরই কর্মফল। আমাদের ব্যক্তিগত কর্মের নয়, জাতিগত কর্মের। অত্যাচারী ইংরেজ আর তাদের এদেশী তাঁবেদারদের মারবার জন্য স্বদেশী যুগের বিপ্লবীরা বোমা ছুড়ত। আমরা তখন আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে বৈঠকখানায় বসে তাদের প্রশংসা করতাম। এখন আর ইংরেজের ভয় নেই, প্রকাশ্যে বলছি–মিউটিনিই প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ, খুদিরামই আদি শহীদ, সেই দেখিয়ে দিলে–দেব আরাধনে ভারত উদ্ধার, হবে না হবে না খোল তরবার।
ভরদ্বাজ। এই মতিগতির জন্যই দেশ উৎসন্নে যাচ্ছে। খুদিরাম আমাদের ধর্মবুদ্ধি নষ্ট করেছে, ছেলেদের খুন করতে শিখিয়েছে।
ভজহরি। বলেন কি মশায়! এই সেদিন মহাসমারোহে তাঁর মূর্তিপ্রতিষ্ঠা হয়ে গেল, দেশের বড় বড় লোক উপস্থিত হয়ে সেই মহাপ্রাণ বালকের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন।
মাস্টার। গান্ধীজী বেঁচে থাকলে এতে খুশী হতেন না। জওহরলালও যেতে চান নি। পূর্বে তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে নেতাজী ভারত আক্রমণ করলে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে লড়বেন। স্বদেশের মুক্তিকামী হলেই সকলের আদর্শ আর কর্তব্যবুদ্ধি সমান হয় না।
চৌধুরী। খুদিরাম তো ইংরেজকে মেরেছিল, কিন্তু এখন যে আমাদের গায়েই বোমা ফেলছে। একেও কর্তব্যবুদ্ধি বলতে চান নাকি?
ভজহরি। মাস্টার মশায়, আপনি কি খুদিরামের কাজ গর্হিত মনে করেন?
মাস্টার। আমি অতি সামান্য লোক, ধর্মাধর্ম বিচার আমার সাধ্য নয়। কর্মের ফল যা দেখতে পাই তাই বলতে পারি। খুদিরাম যখন বোমা ফেলেছিল তখন বড় বড় মডারেটরা ধিককার দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে এই ভয়ঙ্কর পন্থায় তাঁদের আস্থা নেই। খুদিরামের দল নিজের স্বার্থ দেখেনি, প্রাণের মায়া করেনি, ধর্মাধর্ম ভাবেনি, বিনা দ্বিধায় সরকারের সঙ্গে লড়েছিল। তারা শুধু ইংরেজকে বোমা মারেনি, মডারেট বুদ্ধিতেও ফাট ধরিয়েছিল। অনেক মডারেট আড়ালে বলতেন, বাহবা ছোকরা!
চৌধুরী সাহেব অধীর হয়ে বললেন, আপনি কেবল অবান্তর কথা বলছেন, আদালতে এ রকম বললে জজের ধমক খেতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে এই—ইংরেজ চলে গেছে, দেশনেতাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে, এখন আবার বোমা কেন?
মাস্টার মশায় সবিনয়ে বললেন, আদালতে কখনও যাইনি সার। আপনার প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দিতে পারি এমন বুদ্ধি আমার নেই। যা মনে আসছে ক্রমে ক্রমে বলে যাচ্ছি, দয়া করে শুনুন। যদি তাড়া দেন তবে সব গুলিয়ে ফেলব।
চৌধুরী। বেশ, বেশ, বলে যান।
মাস্টার। স্বদেশী যুগের সন্ত্রাসকদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ তাড়ানো, বিদেশী শাসকরা চলে যাবার পর কি করতে হবে তা তারা ভাবে নি। উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য যে—কোনও উপায়ে মানুষ মারা তারা পাপ মনে করত না। শ্রীকৃষ্ণ গীতায়, অর্জুনকে ধর্মযুদ্ধের উপদেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু মহাভারতে অন্যত্র আড়াল থেকে বোমা মারতেও বলেছেন।
ভরদ্বাজ। কোথায় আবার বললেন? যত সব বাজে কথা।
মাস্টার। দ্রোণবধের জন্য মিথ্যা বলা এবং দুর্যোধনের কোমরের নীচে গদাঘাত বোমারই শামিল। সাধারণ ধর্ম আর আপদধর্ম এক নয়, অপৎকালে অনেকেই অল্পাধিক অধর্মাচরণ করে থাকেন। সন্ত্রাসকরা তাই করেছিল। পরে মহাত্মা গান্ধী যখন যুদ্ধের নূতন উপায় আবিষ্কার করলেন এবং তাতে সিদ্ধিলাভের সম্ভাবনাও দেখা গেল তখন সন্ত্রাসকরা নিরস্ত হল। কিন্তু তারা হিংস্রতার জমি তৈরি করে গেল, বহু লোকের ধারণা হল যে রাজনীতিক উদ্দেশ্যে হিংস্র কর্মে দোষ হয় না, বরং তাতে বাহাদুরিও আছে। সাতচল্লিশ সালে দাঙ্গায় অনেক শান্তশিষ্ট হিন্দুসন্তান অসংকোচে খুন করতে শিখল। তার পর মহাত্মাজীও নিহত হলেন। অনেক গণ্যমান্য লোক চুপি চুপি বললেন, ভগবান যা করেন ভালর জন্যই করেন। এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে, মুক্তিকামীদের আদি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু অন্য উদ্দেশ্য দেখা দিয়েছে এবং তার জন্য হিংস্র—অহিংস্র নানা পন্থার উদ্ভব হয়েছে।
চৌধুরী। এখন একমাত্র উদ্দেশ্য শান্তি ও শৃঙ্খলা, তার পন্থা একই—জবরদস্ত গভর্নমেণ্ট।
মাস্টার। আজ্ঞে না। নানা লোকের নানা উদ্দেশ্য, কেউ চান রামরাজ্য, কেউ চান সমাজতন্ত্র, কেউ কিষাণ—মজদুরের রাজা হতে চান, কেউ চান সমভোগতন্ত্র বা কমিউনিজম। এঁরা কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেন না যে ঠিক কি চান, এঁদের পন্থাও সমান নয়, কেউ আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে চান, কেউ তাড়াতাড়ি। কেউ মনে করেন বা মুখে বলেন যে যথাসম্ভব সত্য ও অহিংসাই শ্রেষ্ঠ উপায়, কেউ মনে করেন শঠে শাঠ্যং না হলে চলবে না, কেউ মনে করেন হিংস্র উপায়েই চটপট কার্যসিদ্ধি হবে। দেখতেই পাচ্ছেন, আজকাল কতগুলি দল হয়েছে –কংগ্রেস, তার মধ্যেও দলাদলি, সমাজতন্ত্রী, হিন্দু—মহাসভা কমিউনিস্ট, আরও কত কি। এদের মধ্যে ভাল মন্দ হিংস্র অহিংস্র সব রকম লোক আছে।
ভজহরি। কংগ্রেসে হিংস্র লোক নেই?
মাস্টার। তা বলতে পারি না। দলের নীতি বা ক্রীড যাই হোক সকলেই তা অন্তরের সঙ্গে মানে না। সব দলেই এমন লোক আছে যাদের নীতি–মারি অরি পারি যে কৌশলে। অগস্ট বিপ্লবে অনেক কংগ্রেসী হিংস্র কাজ করেছিল। এখনও কংগ্রেসের মধ্যে এমন লোক আছে যারা প্রতিপক্ষকে যে—কোনও উপায়ে জব্দ করতে প্রস্তুত।
ভজহরি। কিন্তু কংগ্রেসের ওপর মহাত্মার প্রভাব এখনও রয়েছে। তারা যতই অন্যায় করুক কমিউনিস্টদের মতন বোমা ছোড়ে না।
মাস্টার। হিংস্র কমিউনিস্টদের তুলনায় হিংস্র কংগ্রেসী অনেক কম আছে তা মানি, কিন্তু সব কংগ্রেসী মনে প্রাণে অহিংস নয়, সব কমিউনিস্টও হিংস্র নয়। বিলাতে লাস্কি হালডেন বার্নাল প্রভৃতি মনীষীরা কমিউনিস্ট, কিন্তু তাঁরা অসৎ বা হিংস্র প্রকৃতির লোক নন, রাশিয়ার অন্ধ ভক্তও নন। এদেশেও যোশী—প্রমুখ কয়েকজন বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা হিংসার বিরোধী বলে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন।
চৌধুরী। মাস্টার মশায়, আপনার মতলবটা কি খোলসা করে বলুন তো। বোধ হচ্ছে আপনি কমিউনিস্ট দলের ভক্ত।
মাস্টার। কোনও দলেরই ভক্ত নই, মানুষকেই ভক্তি করি। কোন মানুষের সব কাজেরও সমর্থন করি না। দলের লেবেল দেখে বিচার করব কেন, মানুষ কেমন তাই দেখব। কমিউনিস্টদের কথাই ধরুন। অনেক লোক আছে যারা মার্কস প্রভৃতির মতে অল্পাধিক বিশ্বাস করে, সেজন্য নিজেদের কমিউনিস্ট বলে। এদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রীদের বেশী প্রভেদ নেই। আবার অনেক কমিউনিস্ট গুপ্ত সমিতির সদস্য, তারা স্বদেশী যুগের সন্ত্রাসকদের মতন লুকিয়ে কাজ করে এবং দলের নেতাদের আদেশে চলে। এদের অনেকে রাশিয়ার তাঁবেদার বা অন্ধ ভক্ত। যেমন কংগ্রেসের মধ্যে তেমন কমিউনিস্ট দলের মধ্যে স্বার্থসর্বস্ব লোক আছে। অনেক কংগ্রেসী যেমন মন্ত্রীত্বকেই পরম কাম্য মনে করে, সেই রকম অনেক কমিউনিস্ট আশা করে যে ডিকটেটরী রাষ্ট্র স্থাপিত হলে সে একটা কেষ্টবিষ্টুর পদ পাবে। আবার অনেকে, বিশেষত ছেলেমেয়ে, শখের জন্যই কমিউনিস্ট নাম নেয়। এরা কিছুই বোঝে না, শুধু কতকগুলি মুখস্থ বুলি আওড়ায়। আবার এক দল বিশেষ কিছু না বুঝলেও তাদের নেতাদের আদেশে নানা রকম হিংস্র কর্ম করে এবং ভাবে যে দেশের মঙ্গলের জন্যই করছি। এমন দুর্বৃত্তও আছে যাদের কোনও রাজনীতিক মত নেই, কিন্তু সুবিধা পেলেই শুধু নষ্টামির জন্য ট্রাম বাস পোড়ায়, বোমাও ফেলে। ভর্তৃহরি বলছেন, ‘তে বৈ মানুষরাক্ষসাঃ পরহিতং স্বার্থায় নিঘ্নান্তি যে, যে তু ঘ্নান্তি নিরর্থকং পরহিতং তে কে ন না জানীমহে’—যারা স্বার্থের জন্য পরের ইষ্টনাশ করে তারা নররাক্ষস, কিন্তু যারা অনর্থক পরের অহিত করে তারা কি তা জানি না।
ভরদ্বাজ। মাস্টার, তোমার কথায় এই বুঝলুম যে অনেক লোক দেশের ভাল করছি ভেবেই হিংস্র কর্ম করে, যেমন স্বদেশী যুগের সন্ত্রাসকরা করত; অনেকে হুজুক বা বজ্জাতির জন্য করে, অনেকে স্বার্থসিদ্ধির জন্যই করে। কিন্তু দেশের জনসাধারণ হিংস্রতার বিরোধী, তারা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না, শুধু চায় অন্ন বস্ত্র স্বাচ্ছন্দ্য শান্তি আর সুশাসন। তোমাদের পলিটিক্সে তা হবে না। এই ধর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষে প্রজাতন্ত্র সমাজতন্ত্র সমভোগতন্ত্র সমস্তই অচল ও অনাবশ্যক। দিল্লীতে যে ভারতশাসনতন্ত্র রচিত হয়েছে তাতে কিছুই হবে না।
মাস্টার। কি রকম শাসনতন্ত্র চান আপনিই বলুন।
ভরদ্বাজ। ধর্মরাজ্য চাই। প্রথমেই রাজার আশ্রয় নিতে হবে। প্রত্যেক প্রদেশে একজন উচ্চবংশীয় ক্ষত্রিয় রাজা থাকবেন, তাঁদের সকলের ওপরে একজন সার্বভৌম রাজচক্রবর্তী সম্রাট থাকবেন। প্রদেশে ও কেন্দ্রে কেবল বিদ্বান সদব্রাহ্মণরা মন্ত্রী হবেন, তাঁরাই আইন করবেন রাজ্য চালাবেন। প্রজাদের কোনও সভা থাকবে না, রাম শ্যাম যদুর খেয়াল অনুসারে রাজ্য চলতে পারে না, তাতে কেবল ঝগড়া হবে। রাজারা সনাতন বর্ণাশ্রম ধর্মের প্রতিষ্ঠা করবেন, মাঝে মাঝে যজ্ঞ করে প্রজাদের ধর্মকর্মে উৎসাহ দেবেন। মন্দিরে মন্দিরে দেবতার পূজা হবে, শঙ্খ ঘণ্টা বাজবে, ধূপের ধূম উঠবে। রাষ্ট্রের লাঞ্ছনা হবে গরু, বাঘ—সিংগি চলবে না। জাতীয় সংগীত হবে মোহমুদগর। ফাঁসি উঠে যাবে, পাপীদের শূলে দেওয়া হবে। অনাচারী নাস্তিক আর বিধর্মীরা রাজকার্য করবে না, তারা নগরের বাইরে বাস করবে।
মাস্টার। চমৎকার, যেন সত্যযুগের স্বপ্ন। আপনার এই ধর্মরাজ্যের সঙ্গে হিটলার— মুসোলিনির রাষ্ট্রের কিছু কিছু মিল আছে। শরিয়তী রাজ্য এবং গোঁড়া রোমান ক্যাথলিকদের আদর্শ খ্রীস্টীয় রাজ্যও অনেকটা এই রকম। কিন্তু পৃথিবীতে বহু কোটি সনাতনী থাকলেও আপনার আদর্শ ধর্মরাজ্য বা শরিয়তী—খিলাফতী রাজ্য বা হোলি রোমান এম্পায়ার আর হবার নয়।
ভরদ্বাজ। আচ্ছা বাপু, তুমিই বল কোন উপায়ে দেশে শান্তি আর সুশাসনের প্রতিষ্ঠা হবে।
মাস্টার। এমন উপায় জানি না যাতে রাতারাতি আমাদের দুঃখ ঘুচবে। মুষ্টিমেয় বিপ্লবী আর গুণ্ডা ছাড়া দেশের সকলে শান্তি আর শৃঙ্খলা চায় তা ঠিক, কিন্তু এই মুষ্টিমেয় লোক উদযোগী বেপরোয়া, জনসাধারণ অলস নিরুদ্যম কাপুরুষ। একটা দশ বছরের ছেলে ট্রামে উঠে যদি বলে—নেমে যান আপনারা, গাড়ি পোড়ানো হবে—অমনি ভেড়ার পালের মতন যাত্রীরা সুড়সুড় করে নেমে যাবে। অত প্রাণের মায়া করলে প্রাণরক্ষা হয় না। জড়পিণ্ড হয়ে শান্তি আর সুশাসন চাইলে তা মেলে না, শুধু সরকারের ওপর নির্ভর করলেও মেলে না, চেষ্টা করে অর্জন করতে হয়। বিপ্লবীদের যেমন দল আছে শান্তিকামী লোকেও যদি সেই রকম আত্মরক্ষা আর দুষ্টদমনের জন্য দল তৈরি করে তবেই দেশে শান্তি আসবে। তা না হলে মুষ্টিমেয় লোকেরই আধিপত্য হবে।
ভরদ্বাজ। কেন, পুলিশ আর মিলিটারি কি করতে আছে?
মাস্টার। জনসাধারণ যদি সাহায্য না করে তবে তারাও হাল ছেড়ে দেবে।
চৌধুরী সাহেব প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বললেন, হবে না, হবে না, আপনারা যে সব উপায় বলছেন তাতে কিছুই হবে না। আপনাদের এই স্বাধীন রাষ্ট্রে গোড়া থেকেই ঘূণ ধরেছে। গাছে না উঠতেই এক কাঁদি—কেন রে বাপু? জমিদার উচ্ছেদ করবার কি দরকার ছিল? তারাই তো দেশের স্তম্ভস্বরূপ, চিরকাল গভর্নমেণ্টকে সাহায্য করে এসেছে। নুনের শুল্ক আর মদ বন্ধ না করলে কি চলত না? ভাবুন দেখি, কতটা রাজস্ব খামকা নষ্ট করা হয়েছে! কিষাণ—মজদুরের উপর তো দরদের সীমা নেই, অথচ পেনশনভোগীদের কথা কারও মনে আসে না। তাদের কি সংসার খরচ বাড়েনি? রাজা মহারাজ সার রায়বাহাদূর প্রভৃতি খেতাব তুলে দিয়ে কি লাভ হল? এসব থাকলে বিনা খরচে সরকারের সহায়কদের খুশী করা যেত। রাজভক্ত প্রজাদের বঞ্চিত করা হয়েছে, অথচ মন্ত্রীরা তো দিব্যি ডি এস—সি, এল—এল ডি খেতাব নিচ্ছেন! আরে তোদের বিদ্যে কতটুকু? দেশনেতারা সবাই মন্ত্রী হতে চান। তাঁরা কেবল ভাবছেন কিসে ভোট বজায় থাকবে আর প্রতিদ্বন্দ্বী ঘোষ বোস সেনদের জব্দ করা যাবে। আমি বলছি আপনাদের এই গভর্নমেণ্ট কিছুই করতে পারবে না, দেশশাসন এদের কাজ নয়।
মাস্টার। চৌধুরী সাহেব, আপনিও কমিউনিস্ট শাসন চান নাকি?
চৌধুরী। টু হেল উইথ কমিউনিস্ট কংগ্রেস হিন্দুসভা অ্যান্ড সোশ্যালিস্ট!
মাস্টার। তবে বলুন কি চান?
চৌধুরী। শুনবেন? উঁহু, শেষকালে আমার পেনশনটি বন্ধ না হয়। কোথায় গোয়েন্দা আছে তা তো বলা যায় না।
ভরদ্বাজ। চৌধুরী সাহেব, আমরা আপনার পুরানো বন্ধু, আমাদের বিশ্বাস করেন না?
চৌধুরী আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন দেখে আমি বললাম, আমি অতি নিরীহ লোক আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন।
চৌধুরী সাহেব কিছুক্ষণ আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। ভরসা পেয়ে বললেন, সুশাসনের একমাত্র উপায় বলছি শুনুন—রাজেন্দ্রজী পণ্ডিতজী আর সর্দারজী বিলেত চলে যান। সেখানে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় গিয়ে গলবস্ত্র হয়ে বলুন, প্রভু, ঢের হয়েছে, আমাদের শখ মিটে গেছে, আর স্বাধীনতায় কাজ নেই, আপনারা আবার এসে দেশ শাসন করুন। দু—শ বৎসর এখানে রাজত্ব করেছিলেন, আরও দু—শ বৎসর করুন, পিতার ন্যায় আমাদের জ্ঞানশিক্ষা দিন। তারপর যদি আমাদের লায়েক মনে করেন তবে নিজের দেশে ফিরে আসবেন।
মাস্টার। রোমানরা যখন ব্রিটেন থেকে চলে যাচ্ছিল তখন সেখানকার লোকেও এইরকম প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু তাতে ফল হয়নি, বর্বর জার্মানদের আক্রমণ থেকে নিজের দেশ রক্ষার জন্যই রোমানদের চলে যেতে হয়েছিল। এদেশের কোনও নেতা ইংরেজকে ফিরে আসতে বলবেন না, বললেও ইংরেজ আর আসতে পারবে না।
চৌধুরী সাহেব ঊরুতে চাপড় মেরে বললেন, তবে রইল আপনাদের ভারত, এদেশে আমি থাকব না, বিলেতেই বাস করব।
জিরাফের মতন গলা বাড়িয়ে ভজহরিবাবু মৃদুস্বরে বললেন, সার, আপনার আইভি রোডের বাড়িটা? বেচেন তো বলুন ভাল খদ্দের আমার হাতে আছে।
বৃষ্টি থেমে গেছে দেখে আমি উঠে পড়লাম। ভরদ্বাজবাবু আমাকে বললেন, কই মশায়, আপনি তো কিছুই বললেন না!
আমি হাত জোড় করে উত্তর দিলাম, মাপ করবেন, কানে তালা লেগে আছে, গলা ভেঙে গেছে! এখন যেতে হবে রণজিৎ ভটচাজ ডাক্তারের কাছে। বসুন আপনারা নমস্কার।
১৩৫৬ (১৯৪৯)