উলট-পুরাণ

উলট-পুরাণ

রিচমণ্ড বঙ্গ-ইঙ্গীয় পাঠশালা। মিস্টার ক্র্যাম (পণ্ডিত মহাশয়)

এবং ডিক টম হ্যারি প্রভৃতি বালকগণ

ক্র্যাম। চটপট নাও, চারটে বাজে। ডিক, ইতিহাসের শেষটুকু প’ড়ে ফেল।

ডিক। ‘ইওরোপের দুঃখের দিন অবসান হইয়াছে। জাতিতে জাতিতে দ্বেষ হিংসা বিবাদ দূর হইয়াছে। প্রবলপরাক্রান্ত ভারত—সরকারের দোর্দণ্ডশাসনের সুশীতল ছায়ায়’—দোর্দণ্ড মানে কি পণ্ডিত মশায়?

ক্র্যাম। দোর্দণ্ড জান না? The big rod. under the soothing influence of the big rod.

ডিক। ‘সুশীতল ছায়ায় আশ্রয়লাভ করিয়া সমস্ত ইওরোপ ধন্য হইয়াছে। আয়ারল্যাণ্ড হইতে রাশিয়া, ল্যাপল্যাণ্ড হইতে সিসিলি, সর্বত্র শান্তি বিরাজ করিতেছে। ফ্রান্স এখন আর জার্মানির গলা কাটিতে চায় না, ইংলণ্ড আর জাতিতে জাতিতে বিবাদ বাধাইতে পারে না, অস্ট্রিয়া ও ইটালিতে আর মেতিপুকুরের দখল লইয়া মারামারি করে না।’ মেতিপুকুর কোনটা পণ্ডিতমশায়?

ক্র্যাম। ঐ সামনে মানচিত্র রয়েছে দেখ না। ইটালির কাছে যে সমুদ্র সেইটে। সেকালে নাম ছিল মেডিটেরেনিয়ান। ইণ্ডিয়ানরা উচ্চারণ ক’রতে পারে না ব’লে নাম দিয়েছে মেতিপুকুর। সেইরকম আলস্টারকে বলে বেলেস্তারা, সুইটসারল্যাণ্ডকে বলে ছছুরাবাদ, বোর্দোকে বলে ভাঁটিখানা, ম্যাঞ্চেস্টারকে বলে নিমতে। তারপর প’ড়ে যাও।

ডিক। ‘ইওরোপীয়গণের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হইতেছে। তাহাদের লোভ কমিয়াছে, অসভ্য বিলাসিতা দূর হইতেছে, ইহকালের উপর আস্থা কমিয়া গিয়াছে, পরকালের উপর নির্ভরতা বাড়িতেছে। ভারত—সন্তানগণ সাত—সমুদ্র তের নদী পার হইয়া এই পাণ্ডববর্জিত দেশে আসিয়া নিঃস্বার্থভাবে শান্তি শৃঙ্খলা ও সভ্যতার প্রতিষ্ঠা করিতেছেন।’ আচ্ছা পণ্ডিতমশায়, এসব কি সত্যি?

ক্র্যাম। ছাপার অক্ষরে যখন লিখেছে আর সরকারের হুকুমে যখন পড়তে হচ্ছে তখন সত্যি বইকি।

ডিক। কিন্তু বাবা বলেন সব bosh।

ক্র্যাম। তোমার বাবার আর বলতে বাধা কি। তিনি হলেন উকিল, আমার মতন তো আর সরকারের মাইনেয় নির্ভর করতে হয় না।

ডিক। ‘হে সুবোধ ইংরেজশিশুগণ, তোমরা সর্বদা মনে রাখিও যে ভারত সরকার তোমাদের দেশের অশেষ উপকার করিয়াছেন। তোমরা বড় হইয়া যাহাতে শান্ত বাধ্য রাজভক্ত প্রজা হইতে পার তাহার জন্য এখন হইতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া যাও।’

টম। বু—হু—হু—হু—

ক্র্যাম। ও কি রে, শীত করছে বুঝি? আবার তুই ধুতি—পাঞ্জাবি প’রে এসেছিস! বাঙালীর নকল করতে গিয়ে শেষে দেখছি নিউমোনিয়ায় মরবি।

টম। বাবার হুকুম পণ্ডিতমশায়। আজ পাঠশালের ফেরত খাঁসাহেবের গবসন টোডির পার্টিতে যেতে হবে। তিনি নতুন খেতাব পেয়েছেন কিনা। সেখানে বিস্তর ইণ্ডিয়ান ভদ্রলোক আসবেন, তাই বাবা বললেন, দেশী পোশাক পরা চলবে না।

ক্র্যাম। তা বাঙালী সাজতে গেলি কেন? ইজের—চাপকান পরলেই তো পারতিস।

টম। আজ্ঞে, বাবা বললেন, বাঙালীই সবচেয়ে সভ্য তাই—ব্রর র র—

ক্র্যাম। যা যা শীগগির বাড়ি যা, অন্তত একটা শাল মুড়ি দিগে যা। ও কি, হোঁচট খেলি নাকি?

হ্যারি। দেখুন দেখুন, টম কি রকম কাছা দিয়েছে, যেন স্কিপিং রোপ!

ধর্মযাজকগণের মুখপত্র ‘দি কিংডম কাম’

হইতে উদ্ধৃত।

সর্বনাশের আয়োজন হইতেছে। ভারতসরকার আমাদের ধনপ্রাণ হস্তগত করিয়াছেন—আমরা নিরীহ ধর্মযাজক—সম্প্রদায় তাহাতে কোনও উচ্চবাচ্য করি নাই, কারণ ইহলোকের পাঁউরুটি ও মাছের উপর আমাদের লোভ নাই এবং সীজারের প্রাপ্য সীজারকে দেওয়াই শাস্ত্রসম্মত। কিন্তু আজ এ কি শুনিতেছি? আমাদের ধর্মের উপর হস্তারোপ! ঘোড়দৌড় বন্ধ করার জন্য আইন হইতেছে। অ্যাসকট, এপসম প্রভৃতি মহাতীর্থ কি শেষে শ্মশানে পরিণত হইবে? বিশপ স্টোনিব্রোক নাকি গর্ভনমেণ্টকে জানাইয়াছেন যে ধর্মশাস্ত্রে ঘোড়দৌডের উল্লেখ নাই, অতএব রেস বন্ধ করিলে খ্রীষ্ট্রিয় ধর্মের হানি হইবে না। হা, একজন ধর্মযাজকের মুখে এই কথা শুনিতে হইল! বিশপ কি জানেন না যে, রেস খেলা ব্রিটিশ জাতির সনাতন ধর্ম এবং লোকাচার বাইবেলেরও উপর? আরও ভয়ানক সংবাদ—শীঘ্রই নাকি মদ্যপান রোধ করার উদ্দেশ্যে আইন হইবে। আমাদের শাস্ত্রসম্মত সনাতন পানীয় বন্ধ করিয়া ভারত সরকার কি ভারতীয় চায়ের কাটতি বাড়াতে চান?

‘রাষ্ট্রবিৎ’—যাহার সঙ্গে সংযুক্ত আছে ‘ইঙ্গবন্ধু’

হইতে উদ্ধৃত।

আমরা খাঁসাহেব গবসন টোডিকে সাদরে অভিনন্দন করিতেছি। তিনি অতি উপযুক্ত ব্যক্তি, তাহাকে উচ্চ সম্মানে ভূষিত দেখিয়া আমরা প্রকৃতই আনন্দিত হইয়াছি। দেশী লোকের ভাগ্যে এত বড় উপাধি এই প্রথম মিলিল। আমরা কিন্তু সরকারকে সাবধান করিতেছি—এই সকল উচ্চ উপাধি যেন বেশী সস্তা করা না হয়, তাহা হইলে ভারতীয় রায়সাহেব খাঁবাহাদুর প্রভৃতি ক্ষুণ্ণ হইবেন এবং তাহাতে ইওরোপের উন্নতি পিছাইয়া যাইবে। নাইট, ব্যারন, মার্কুইস, ডিউক প্রভৃতি দেশী উপাধিই সাহেবদের পক্ষে যথেষ্ট। যাহা হউক, মিস্টার টোডি যখন নিতান্তই খাঁসাহেব টোডি হইয়া গিয়াছেন, তখন তাঁহার অতি সন্তর্পণে সম্ভ্রম বজায় রাখিয়া চলা উচিত। আশা করি, তিনি রাজদ্রোহী লিবার্টি—লীগের ছায়া মাড়াইবেন না।

গবসন টোডির অন্দরমহল। মিসেস টোডি, তাঁহার দুই কন্যা

ফ্লফি ও ফ্ল্যাপি এবং তাহাদের শিক্ষয়িত্রী জোছনা—দি

জোছনা। ফ্ল্যাপি, তোমায় নিয়ে আর পেরে উঠি নে বাছা। ওই রকম ক’রে বুঝি চুল বাঁধে? আহা কি ছিরিই হয়েছে! কান দুটো যে সবটাই বেরিয়ে রয়েছে। এতখানি বয়স হ’ল কিছুই শিখলে না। দেখ দিকি, তোমার দিদি কি সুন্দর খোঁপা বেঁধেছে!

ফ্ল্যাপি। Let her। কানের ওপর চুল পড়লে আমি কিচ্ছু শুনতে পাই না। আমি ঘাড় ছাঁটবো, ও—বাড়ির মিস ল্যাংকি গসলিং—এর মতন।

জোছনা। হ্যাঁ ঘাড় ছাঁটবে, নাড়া হবে, ভুরু কামাবে, রূপ একেবারে উথলে উঠবে। দেখাবে যেন হাড়গিলেটি। পড়তে শাশুড়ীর পাল্লায়—

ফ্ল্যাপি।

Little pussy Friskers

Shaved off her whiskers;

And sharpening her paw

Scratched her mum-in-law.

জোছনা। কি বেহায়া মেয়ে। মিসেস টোডি, আপনার ছোট মেয়েকে দুরস্ত করা আমার সাধ্য নয়।

মিসেস টোডি। ছি ফ্ল্যাপি, তুমি দিন দিন ভারী বেয়াড়া হচ্ছ। জোছনা—দি তোমাদের শিক্ষার জন্য কত মেহনত করেন তা বোঝ?

ফ্ল্যাপি। আমি শিখতে চাই না। উনি ফ্লফিকে শেখান না।

জোছনা। আবার ‘ফ্লফি’! দিদি বলতে কি হয়? অ্যাঁ ও কি—ফের তুমি পেনসিল চুষছ! ছি ছি, কি নোংরা! আচ্ছা, এখন তুমি ও ঘরে গিয়ে সেই উর্দু গজলটা অভ্যাস কর।

মিসেস টোডি। জোছনা—দি, আপনার ডিবে থেকে একটা পান নেব? থ্যাংক ইউ।

জোছনা। দেখুন মিসেস টোডি, কথায় কথায় থ্যাংক ইউ—প্লীজ—সরি এগুলো বলবেন না। ভারী বদ অভ্যাস এর জন্যেই আপনাদের জাতের উন্নতি হচ্ছে না। ওরকম তুচ্ছ কারণে কৃতজ্ঞতা বা দুঃখ জানানো আমরা ভন্ডামি ব’লে মনে করি। নিন একটু দোক্তা খান।

মিসেস টোডি। নো, থ্যাংকস,—থুড়ি। দোক্তা খেলেই আমার মাথা ঘোরে। বরং একটা সিগারেট খাই।

জোছনা। মেয়েদের সিগারেট খাওয়া অত্যন্ত খারাপ। আপনি একটু চেষ্টা ক’রে দোক্তা ধরুন।

মিসেস টোডি। কিন্তু দু—ই তো হল তামাক?

জোছনা। তা বললে কি হয়। একটা হ’ল ধোঁয়া আর একটা হ’ল ছিবড়ে। ধোঁয়া পুরুষের জন্য, আর ছিবড়ে মেয়েদের জন্য। ফ্লফি, তোমার সেই বাংলা উপন্যাসখানা শেষ হয়েছে?

ফ্লফি। বড় শক্ত, মোটেই বুঝতে পারছি না।

জোছনা। বোঝবার বিশেষ দরকার নেই, কেবল বাছা বাছা জায়গা মুখস্থ ক’রে ফেলবে। লোককে জানানো চাই যে বাংলা ভাল ভাল বইয়ের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে। কিন্তু তোমার উচ্চারণটা বড় খারাপ। সভ্যসমাজে মিশতে গেলে চোস্ত বাংলা উচ্চারণ আগে দরকার, আর গোটাকতক উর্দু গান। আচ্ছা, তুমি বাংলায় এক দুই তিন চার ব’লে যাও দিকি।

ফ্লফি। এক দুই তিন শাড়—

জোছনা। শাড় নয়, চার।

ফ্লফি। চার পাইচ—

জোছনা। পাইচ নয়, পাঁচ।

ফ্লফি। পাঁইশ—

জোছনা। পাঁ—চ।

ফ্লফি। ফ্যাঁচ—

জোছনা। মাটি করলে। মিসেস টোডি, ফ্লফিকে বেশী চকোলেট খেতে দেবেন না, ছোলাভাজার ব্যবস্থা করুন, নইলে জিবের জড়তা ভাঙবে না। দেখ ফ্লফি, আর এক কাজ কর। বার বার আওড়াও দিকি—রিশড়ের আড়পার খড়দার ডান ধার—ছাঁদনাতলায় হোঁতকা হোঁদল।

নেপথ্যে গবসন টোডি। ডিয়ারি—

মিসেস টোডি। কূ! কোথায় তুমি?

গবসন টোডি। বাথরুমে। আরও গোটাকতক আম দিয়ে যাও।

জোছনা। বাথরুমে আম?

মিসেস টোডি। তা ভিন্ন আর উপায় কি। গবি বলে, আম যদি খেতে হয় তবে ভারতীয় পদ্ধতিতেই খাওয়া উচিত। অথচ আপনাদের মতন হাত দুরস্ত নয়,—পোশাক কার্পেট টেবিল—ক্লথে রস ফেলে একাকার করে। তাই গবিকে বলেছি বাথরুমে গিয়ে আম খাওয়া অভ্যাস করতে। সেখানে দু—হাতে আঁটি ধ’রে চুষছে আর চোয়াল ব’য়ে রস গড়াচ্ছে। Horrid!

জোছনা। ঠিক ব্যবস্থাই করেছেন। দেখুন মিসেস টোডি, আপনি যে স্বামীকে ‘গবি’ বলছেন, ওটা সভ্যতার বিরুদ্ধে। আড়ালে গবি হাবি যা খুশি বলুন, কিন্তু অপরের কাছে নাম করবেন না। দরকার হ’লে বলবেন—’উনি’। আর যদি অতটা খাতির না করতে চান তবে বলবেন—’ও’।

মিসেস টোডি। তাই নাকি? আচ্ছা, আপনি বসুন একটু। আমি ওকে আম দিয়ে আসছি।

‘রাষ্ট্রবিৎ’—এর বিজ্ঞাপনস্তম্ভ হইতে।

বিশুদ্ধ আনন্দনাড়ু। চর্বিমিশ্রিত ইংরেজী বিস্কুট খাইয়া স্বাস্থ্য নষ্ট করিবেন না। আমাদের আনন্দনাড়ু খান। দাঁত শক্ত হইবে। কেবল চালের গুঁড়ো ও গুড়। যন্ত্রদ্বারা স্পর্শিত নহে। বাঙালী মেয়ের নিজ হাতে গড়া। এক ঠোঙা পাঁচ শিলিং। সর্বত্র পাওয়া যায়। নির্মাতা—রসময় দাস, টিকটিকি বাজার, কলিকাতা।

অম্বুরী বরুণ। মেমগণের দুঃখ এইবার দূর হইল। এই আশ্চর্য গুঁড়া মুখে মাখিলে ফ্যাকাশে রং দুর হইয়া ঠিক বাঙালী মেয়ের মতন রং হইবে। যদি আর একটু বেশী ঘোর করিতে চান, তবে ইহার সঙ্গে একটি বের্দিগ্রীন মিশাইয়া লইবেন। রামচন্দ্রজী উহা মাখিতেন। দাম প্রতি পুরিয়া পাঁচ শিলিং। বিক্রেতা—শেখ অজহর লেডেনহল স্ট্রীট, ইন্ডিয়া হাউস, লণ্ডন।

‘দি লণ্ডন ফগ’ হইতে উদ্ধৃত

আগামী আশ্বিন মাসে এই লণ্ডন নগরে বিরাট রাজসূয় যজ্ঞ বসিবে। স্বয়ং মহাক্ষত্রপ ভারত সরকারের প্রতিনিধিরূপে এই যজ্ঞের যজমান হইবেন। হোতা, ঋত্বিক মোল্লা, মওলানা প্রভৃতি ভারত হইতে আসিবেন। দুই মাস ব্যাপিয়া দীয়তাং ভূজ্যত্যাং চলিবে, খরচ জোগাইবে অবশ্য এই গরীব ইওরোপবাসী।

সমস্ত ইওরোপের শোষণকার্য অবিরাম গতিতে চলিতেছে, কিন্তু তাহাতেও তৃপ্তি নাই। ভারতমাতা তাঁহার খরজিহ্বা লকলক করিয়া বলিতেছেন—হে সপত্নীপুত্রগণ, আনন্দ কর, আর একবার ভাল করিয়া তোমাদের হাড় চাটিব।

ঠিক ঐ সময়েই হাগ—নগরে প্যান—ইওরোপিয়ান লিবার্টি—লীগের অধিবেশন হইবে। হে ব্রিটন, জন—অ—গ্রোটস হইতে ল্যাণ্ডস—এণ্ড পর্যন্ত যে যেখানে আছ, দলে দলে সর্বরাষ্ট্রীয় মহাসম্মেলনে যোগ দাও। যদি তোমার বিন্দুমাত্র আত্মসম্মান থাকে তবে রাজসূয় যজ্ঞের ত্রিসীমায় যাইও না। একবার ভাবিয়া দেখ তোমার এই মেরি ইংল্যাণ্ড—যেখানে একদা দুগ্ধ ও মধুর স্রোত বহিত—তাহার কি দশা হইয়াছে। অন্ন নাই, বস্ত্র নাই, বীফ নাই, মাখন নাই, পনির নাই—এইবার বিয়ারও বন্ধ হইবে। বিদেশ হইতে গম আসে তবে তোমার রুটি প্রস্তুত হয়। তোমার ভেড়ার লোম ছাঁটামাত্রই পাঞ্জাবে যাইতেছে এবং তথা হইতে বনাত কম্বলরূপে ফিরিয়া আসিয়া তোমার অঙ্গে উঠিতেছে। ভারতের কার্পাসবস্ত্র তোমার বিখ্যাত লিনেন শিল্প নষ্ট করিয়াছে। হায়, তুমি কাহার বসন পরিয়াছ? তোমার নগ্নতা ঘুচিয়াছে কিন্তু লজ্জা ঢাকে নাই, শীত নিবারিত হইয়াছে কিন্তু তুমি অন্তরে অন্তরে কাঁপিতেছ। তোমার ভাল ভাল গো—বংশ ভারতে নির্বাসিত হইয়াছে, সেখানকার হিন্দু—মুসলমান ক্ষীর—ছানা ঘি খাইয়া নির্দ্বন্ধে মোটা হইতেছে। বিয়ার হুইস্কির আস্বাদ তুমি ভুলিয়া যাইতেছ, ভারতের গাঁজা আফিম তোমার মস্তিষ্কে শনৈঃ শনৈঃ প্রভাব বিস্তার করিতেছে। তোমার সর্বনাশের উপরে ভারত তাহার ভোগবিলাসের বিরাট মন্দির খাড়া করিয়াছে। তুমি ডিসেম্বরের শীতে পর্যাপ্ত কয়লার অভাবে হিহি করিয়া শিহরিতেছ, ওদিকে তোমারই অর্থে শেভিয়ট হিলে লক্ষ লক্ষ টন কয়লা পুড়াইয়া কৃত্রিম আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি করা হইয়াছে; কারণ, ভারতীয় আমলাগণ শীতকালে সেখানে অপিস করবেন —লণ্ডনের শীত তাঁহাদের বরদাস্ত হয় না।

হে বহুধাবিভক্ত আত্মকলহপরায়ণ ইওরোপীয়গণ, এখনও কি তোমরা তুচ্ছ সাম্প্রদায়িক স্বার্থ ত্যাগ করিবে না? এখনও কি অ্যাংলো—সেল্টিক দ্বন্দ্ব, ফ্রাঙ্কো জার্মান দ্বন্দ্ব, ধনিক—শ্রমিকের দ্বন্দ্ব, স্ত্রী—পুরুষের দ্বন্দ্ব বন্ধ হইবে না?

হাইড পার্ক। বক্তা—সার ট্রিকসি টার্নকোট।

শ্রোতা—তিন চার হাজার লোক।

টার্নকোট। মাই কান্ট্রিমেন, তোমরা আজ আমাকে যে দু—চার কথা বলবার সুযোগ দিয়েছ তার জন্য বহু ধন্যবাদ। তোমাদের কি বলে সম্বোধন করব খুঁজে পাচ্ছি না, কারণ আমার হৃদয় পূর্ণ হয়েছে। হে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠদেশবাসী ভগবানের নির্বাচিত মানবগণ, হে ব্রিটন—সাকসন—ডেন—নর্মান বংশোদ্ভব ইংরেজ জাতি—।

ম্যাকডুডল। ইংরেজ নয়, বলুন ব্রিটিশ জাতি। স্কচরা কি ভেসে এসেছে নাকি?

টার্নকোট। আচ্ছা, আচ্ছা। হে ব্রিটিশ জাতি, একবার তোমাদের সেই প্রাচীন ইতিহাস স্মরণ কর। হে হেস্টিংস—ক্রেসি—এজিনকোর্টের বীরগণ, যাদের বিজয়পতাকা একদিন ইংল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড, আয়ারল্যাণ্ড, ফ্রান্সে—

ম্যাকডুডল। মিথ্যে কথা। স্কটল্যাণ্ডে তোমাদের বিজয়পতাকা কোনও কালে ওড়ে নি।

টার্নকোট। আচ্ছা, আচ্ছা, স্কটলাণ্ড বাদ দিলুম। যাদের বিজয়পতাকা একদিন আয়ারলাণ্ড ফ্রান্সে—

ও’ হুলিগান। Oirsland! Say it again!

টার্নকোট। আচ্ছা, আচ্ছা। বিজয়পতাকা কোথাও ওড়ে নি। হে ইংলিশ—স্কচ— আইরিশ—মিশ্রিত—ব্রিটিশ জাতি—

ও’ হুলিগান। Begorrah! আমরা ব্রিটিশ নই, — সেলটিক। টার্নকোট। আচ্ছা, আচ্ছা। হে ব্রিটিশ ও সেলটিক ভাইসকল আজ তোমরা কেন সমবেত হয়েছ?

ও’ হুলিগান। Sure, Oi don’t know।

টার্নকোট। কেন এখানে সমবেত হয়েছ তাও কি ব’লে দিতে হবে? হে হতভাগ্যগণ, তোমাদের এই পৈতৃক দেশের বুকের ওপর কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে তার খবর রাখ? রাজসুয় যজ্ঞ। ভারত সরকার মহা আড়ম্বর ক’রে তাঁর ঐশ্বর্য এবং পরাক্রমের পসরা খুলে বসবেন, আর সমস্ত ইওরোপের গণ্যমান্য ব্যক্তি এসে মহাক্ষত্রপকে কুর্নিশ করে বলবেন— ভারতসরকার কি জয়! এই আউট লাণ্ডিশ কাণ্ড এই স্যাক্রিলেজ—

(লর্ড ব্লার্নির বেগে প্রবেশ)

লর্ড ব্লার্নি জনান্তিকে। আরে তুমি কি বলছ সার ট্রিকসি। নিজের সর্বনাশ করছ? আমি কত ক’রে ক্ষত্রপকে ব’লে ক’য়ে এসেছি যেন Chiltren Hundreds-এর দেওয়ানিটা তোমাকেই দেওয়া হয়। কি আরামের চাকরি, একেবারে sine cure। ক্ষত্রপের ইচ্ছে চাকরিটা টোডিকে দেন, কিন্তু আমার একান্ত মিনতি শুনে বলেছেন বিবেচনা করে দেখবেন। এখনই খবর আসবে, আর এদিকে তুমি রাজদ্রোহ প্রচার করছ!

টার্নকোট। বটে বটে? আচ্ছা, আমি সামলে নিচ্ছি।

জনতা হইতে। Go on Tricksy, go on।

টার্নকোট। হ্যাঁ, তারপর কি বলছিলুম—হে আমার দেশবাসিগণ, এই ঘোর দুর্দিনে তোমাদের কর্তব্য কি? তোমরা কি এই যজ্ঞে এই বিরাট তামাশায় যোগ দেবে?

জনতা হইতে। Never, never।

বিল স্নুকস। Say guv’nor will they stand treat? মদ ক পিপে আসবে?

টার্নকোট। এক ফোঁটাও নয়। কেবল বাতাসা বিলি হবে। হে বন্ধুগণ! এই মহাযজ্ঞে তোমাদের স্থান কোথায়?

লর্ড ব্লার্নি। আঃ, কি বলছ টার্নকোট।

টার্নকোট। ঘাবড়ান কেন, শুনুন না। হে বন্ধুগণ! এই বিরাট যজ্ঞে কি তোমরা যাবে?

জনতা হইতে। বরং শয়তানের কাছে যাব।

টার্নকোট। না না, সেটা ভালো দেখাবে না। তোমাদের যেতেই হবে— না গিয়ে উপায় নেই, কারণ ভারত সরকার স্বয়ং তোমাদের আহ্বান করেছেন।

লর্ড ব্লার্নি। হিয়ার, হিয়ার।

জনতা হইতে। মিয়াও, মিয়াও।

টার্নকোট। দোহাই তোমরা আমাকে ভুল বুঝো না। মনে রেখো ভারতের সহানুভুতি না পেলে আমাদের গতি নেই—আমাদের ভবিষৎ নির্ভর করছে সরকারের দয়ার উপর—(পচা ডিম) —এঃ, চোখটা খুব বেঁচে গেছে। হে বন্ধুগণ! আমি কর্তব্য পালনে ভয় খাই না, যা সত্য ব’লে বিশ্বাস করি তাই অকপটে বলব।

লর্ড ব্লার্নি। বাঃ, ঠিক হচ্ছে। ঐ যে টেলিগ্রাম নিয়ে আসছে। ব্রেভো সার ট্রিকসি, নিশ্চয় ক্ষত্রপ তোমাকেই মনোনীত করেছেন। আমি পড়ে দেখছি, তুমি থেমো না, বক্তৃতা চলুক।

টার্নকোট। হে ভাই—সকল! আমি যা বলছি তা তোমাদেরই মঙ্গলের জন্য। এতে আমার নিজের কোনো স্বার্থ নেই। ব্লার্নি খবর কি হে? হে প্রিয় বন্ধুগণ, দেশের মঙ্গলের জন্য আমি সকল রকম লাঞ্ছনা ভোগ করতে প্রস্তুত। তোমাদের ঐ বেড়ালডাক আমারই জয়ধ্বনি। তোমাদের এই পচা ডিম আমি মাথা পেতে নিলুম। যদি তোমাদের তুণীরে আরও কিছু নিগ্রহের অস্ত্র থাকে —(বাঁধাকপি) —নাঃ, আর পারা যায় না। ব্লার্নি বল না হে, কি লিখেছে?

ব্লার্নি। পুওর ট্রিকসি! শেষটায় টোডি ব্যাটাই চাকরি পেলে। নেভার মাইন্ড, তুমি হতাশ হয়ো না। আবার একটা সুবিধা পেলেই তোমার জন্য চেষ্টা করব। ক্ষত্রপটা অতি গাধা। এটা বুঝলে না যে টোডি তো পোষ মেনেই আছে। আর তুমি হ’লে এত বড় একটা ডিমাগ—তোমাকে হাত করবার এমন সুযোগটা ছেড়ে দিলে! ছি ছি!

টার্নকোট। ড্যাম টোডি অ্যান্ড ড্যাম ক্ষত্রপ। হে আমার স্বদেশবাসীগণ—

জনতা হইতে। Shut up! Kick him—lynch the traitor!

টার্নকোট। না, না, আগে আমাকে বলতেই দাও। এই রাজসূয় যজ্ঞে তোমাদের যেতেই হবে। কেন যেতে হবে? বাতাসা খেতে? সেলাম করতে? ভারতসরকারের জয়জয়কার করতে? নেভার। সেখানে যাবে যজ্ঞ পন্ড করতে, লন্ডভন্ড করতে—ভারতসরকার যেন বুঝতে পারে যে তামাশা দেখিয়ে আর বাতাসা খাইয়ে তোমাদের আর ভুলিয়ে রাখা যাবে না।

জনতা হইতে। Long live Tricksy! Turncoat for ever!

নারীজাতির মুখপত্র ‘দি শিম্যান’ হইতে উদ্ধৃত।

কাল বৈকালে ঠিক তিনটার সময় নিখিল—ব্রিটিশ—নারী—বাহিনীর শোভাযাত্রা বাহির হইবে। রিজেণ্ট পার্ক হইতে আরম্ভ করিয়া পোর্টল্যাণ্ড প্লেস, রিজেন্ট স্ট্রীট, পিকাডিলি সার্কাস, ট্রাফালগার স্কোয়ার হইয়া এই বিরাট প্রসেশন পার্লিমেণ্ট হাউসে পৌঁছিবে।

হাজার হাজার বৎসর হইতে পুরুষজাতি নারীর উপর কর্তৃত্ব করিয়া আসিতেছে, কিন্তু আর তাহাদের চালাকি চলিবে না। আমরা সবলে নিজের প্রাপ্য আদায় করিয়া লইব। আমরা ভোটের অধিকার যাহা পাইয়াছি তাহা একেবারে ভুয়া। জুয়াচোর পুরুষগণ ছলে বলে কৌশলে ভোট যোগাড় করিয়া রাষ্ট্রীয়—পরিষদ প্রায় একচেটে করিয়াছে। এ ব্যবস্থা চলিবে না। ব্রিটেনের লোকসংখ্যার শতকরা ষাটজন নারী। আমরা এই অনুপাতেই নারীসদস্য চাই। সরকারী চাকরিতেও আমরা শতকরা ষাটজন নারী চাই। পুরুষের চেয়ে কিসে আমরা কম? আমরা ডিভাইডেড স্কার্ট পরি, ঘাড় ছাঁটি, সিগারেট খাই, ককটেল টানি। এর পর দরকার হয় তো মুখে কবিরাজি কেশ—তৈল মাখিয়া গোঁফ—দাড়ি গজাইব। পুরুষের সহিত কোনও কারবার রাখিব না, কারণ ওরূপ কুটিল স্বার্থপর জাতি পৃথিবীতে আর নাই। তারা মনে করে এই জগতটা পুরুষের জন্যই সৃষ্টি হইয়াছে। তাদের ভগবান পর্যন্ত পুংলিঙ্গ। আমরা হি—গড মানিব না। আইসিস, ডায়না, কালী অথবা শূর্পণখা—এঁদের দ্বারাই আমাদের কাজ চলিবে।

হে নারী, তুমি আর অবলা সরলা miminy piminy গৃহিণী নও। তুমি দাঁত নখ শানাইয়া এস, ভয়ংকর মূর্তিতে এই মহাবাহিনীতে যোগ দিয়া পার্লামেণ্ট আক্রমণ কর। অকর্মণ্য পুরুষদের তাড়াইয়া দিয়া সরকারের নিকট হইতে আপন অধিকার আদায় করিয়া লও।

পুরুষজাতির মুখপাত্র ‘দি মিয়্যার ম্যান’ হইতে উদ্ধৃত।

সরকার কি নাকে সরিষার তেল দিয়া ঘুমাইতেছেন? কাল এই লণ্ডন শহরের উপর যে পৈশাচিক কাণ্ড হইয়া গেল তাহাতে বোধ হয় যেন দেশে অরাজকতা উপস্থিত। দুর্বৃত্তা নারীগণ প্রকাশ্য দিবালোকে বিষম অত্যাচার করিয়াছে, দোকান—পাট ভাঙিয়া তছনছ করিয়াছে, নিরীহ পুরুষগণকে খামচাইয়া কামড়াইয়া জর্জরিত করিয়াছে, কিন্তু সরকারের পেয়ারের উড়িয়া—পুলিস তখন কি করিতেছিল? তারা একগাল পান মুখে পুরিয়া দন্ত বিকাশ করিয়া হাসিতেছিল এবং নারীগুন্ডাগণকে, অধিকতর ক্ষিপ্ত করিবার জন্য হাততালি দিয়া বলিতেছিল—’হী—হ—হ—হ—হ—হ—।’ খাঁসাহেব গবসন টোডি, সার ট্রিকসি টার্নকোট প্রভৃতি মাননীয় দেশনেতৃগণ দাঙ্গানিবারণের উদ্দেশ্যে গিয়াছিলেন, কিন্তু উড়িয়া সার্জেণ্টরা তাদের অপমান করিয়া, বলিয়াছে—’এ সাহেবঅ, ওপাকে যিব তো ডণ্ডা খিব।’

সরকার নিশ্চয় এই ব্যাপারে মনে মনে খুশী হইয়াছেন, কারণ দেশে আত্মকলহ যত হয় ততই সরকারের বলিবার ছুতা হয় যে আমরা স্বায়ত্তশাসনের অযোগ্য।

‘রাষ্ট্রবিৎ’ হইতে উদ্ধৃত।

ইংরেজগণের মধ্যে যদি কেহ বুদ্ধিমান থাকেন তবে এইবার বুঝিবেন যে তাঁহাদের স্বাধীনতার আশা সুদূরপরাহত। লিবার্টি লীগ, অ্যাংলো—সেল্টিক ইউনিয়ন, হেটোরো—সেক্সুয়াল প্যাক্ট—এ সব শুনিতে বেশ। কিন্তু এই ঠাণ্ডা দেশের রক্ত যখন দ্বেষ—হিংসায় গরম হইয়া উঠে তখন আর তত্ত্বকথায় চলে না। যখন দাঙ্গা বাধে তখন একমাত্র ভরসা ভারত সরকারের দণ্ডনীতি আর দুর্দান্ত উড়িয়া—পুলিস।

কেবলই শুনিতে পাই—স্বায়ত্তশাসনে ব্রিটিশ জাতির জন্মগত অধিকার। কিন্তু হে ব্রিটন, তোমাদের ইতিহাসে কি সাক্ষ্য দেয়? স্বাধীনতা কাকে বলে তোমরা কখনই জানিতে না। প্রথমে রোমানগণের, তারপর অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, ডেন, নরম্যান প্রভৃতি দস্যুজাতির অধীনতায় তোমাদের দিন কাটিয়াছে। যাহারা বিজেতারূপে তোমাদের দেশে আসিয়াছে, পরে তাহারাই আবার অন্য জাতি কর্তৃক বিজিত হইয়াছে। আজ কে বিজেতা কে বিজিত বুঝিবার উপায় নাই—তোমরা কেহই নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিতে পার নাই। তোমাদের জাতির স্থিরতা নাই, দেশ নিজের নয়, ধর্ম পর্যন্ত নিজের নয়। একতা তোমাদের মধ্যে কোনও কালেই নাই। সামাজিক আর্থিক কতরকম দলাদলি তোমাদের আছে তার ইয়ত্তা নাই। ক্ষুদ্র ব্রিটেনের যখন এই অবস্থা, তখন সমস্ত ইউরোপের কথা না তোলাই ভাল! নানা জাতি, নানা ভাষা, নানা ধর্ম ইওরোপকে চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়াছে। একমাত্র ভারতসরকারের শাসনেই এই মহাদেশ ঠাণ্ডা হইয়াছে। তোমরা আগে একটু সভ্য হও, তার পর স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিও। তোমরা মদে ও জুয়ায় ডুবিয়া আছ, বর্বরের মত তোমরা এখনও নাচিয়া থাক, স্নান করিতে ভয় খাও, আহারের পর কুলকুচা কর না। এখন কিছুকাল শান্ত শিষ্ট হইয়া সর্ব বিষয়ে ভারতের অনুগত হইয়া চল, তারপর যথাসময়ে তোমাদের অধিকার দেওয়া—না—দেওয়া সম্বন্ধে বিবেচনা করা হইবে।

ভোমস্টাট প্রাসাদ। প্রিন্স ভোম, চৈনিক পর্যটক ল্যাং প্যাং

এবং প্রিন্সের খানসামা কোবল্ট

প্রিন্স ভোম। আচ্ছা হের প্যাং, আপনি তো নানা দেশ বেড়িয়েছেন— আমাদের এই রাজ্যটা আপনার কেমন লাগছে?

ল্যাং প্যাং। মন্দ নয়। মাঠ আছে, জল আছে, রুটি আছে, ঘাস আছে, শুওর—ভেড়া আছে। কিন্তু দেশের লোক যেন সব ঝিমিয়ে রয়েছে। কেন বলুন তো?

প্রিন্স। ঐ তো মজা। সমস্ত ইওরোপে যে অসন্তাোষ আর চাঞ্চল্য দেখেছেন, এখানে তার কিছুই পাবেন না। ভারত সরকার বলেন—আমাদের খাস রাজ্যে আমরা ইচ্ছামত প্রজাদের একটু আশকারা দেব, আবার রাশ টেনে ধরব। কিন্তু তুমি নাবালক, ওরকম করতে যেও না, মারা যাবে। তোমার রাজ্যে গোলযোগ দেখলেই তোমায় কান ধরে বার ক’রে দেব। তাই রাজ্যসুদ্ধ মৌতাতের ব্যবস্থা ক’রে দিয়েছি—সব ভোম হয়ে আছে। কোবল্ট, এক গুলি দে বাবা, তিনটে বাজে, হাই উঠছে। আহা, কি জিনিসই আপনাদের পূর্বপুরুষেরা আবিষ্কার করেছিলেন হের প্যাং!

ল্যাং প্যাং। কিন্তু এখন আর আমাদের দেশে জন্মায় না। যা খাচ্ছেন তা ভারতের, আপনাদের জন্যই উৎপন্ন হয়।

(প্রিন্সের মন্ত্রী ব্যারন ফন বিবলারের প্রবেশ)

বিবলার। মহারাজ, ইংল্যাণ্ড থেকে সার ট্রিকসি টার্নকোট দেখা করতে এসেছেন।

প্রিন্স। আঃ জ্বালালে! একটু যে শুয়ে শুয়ে আরাম করব তার জো নেই। নিয়ে এসো ডেকে। বাবা কোবল্ট, আমায় বাঁ পাশে ফিরিয়ে দে তো।

ল্যাং প্যাং। আমি তা হ’লে এখন উঠি—

প্রিন্স। না, না, বসুন। আমি ভারতীয় কায়দায় লোকজনের সঙ্গে মোলাকাত করি, একে একে অডিয়েন্স দেওয়া আমার পোষায় না, একসঙ্গেই পাঁচ—সাত জনের দরবার শুনি। তাতে মেহনত কম হয়, গল্প—গুজবও ভাল জমে।

(টার্নকোটের প্রবেশ)

প্রিন্স। হা—ডু—ডু সার ট্রিকসি?—বসুন ঐ চেয়ারটায়। তারপর খবর কি বলুন।

টার্নকোট। প্রিন্স, আপনাকে হাগ যেতে হবে, প্যান ইওরোপিয়ান লিবার্টি লীগের সভাপতিরূপে।

প্রিন্স। মাইন গট! এ বলে কি? কোবল্ট, আর এক গুলি দে বাবা।

টার্নকোট। আচ্ছা সভাপতি হ’তে আপত্তি থাকে, না হয় অমনিই যবেন। না গেলে আমরা ছাড়ছি না।

প্রিন্স। হাগ যাব? খেপেছেন নাকি?

টার্নকোট। কেন, তাতে বাধা কি? এই তো ভাইকাডণ্ট প্যাফ, কাউণ্টেস গ্রিমালকিন, গ্র্যাণ্ডডিউক প্যাঞ্জানড্রাম—এঁরা সব যাবেন।

প্রিন্স। আরে তাদের সঙ্গে আমার তুলনা! তারা হ’ল নগণ্য ভারতীয় প্রজা, ইচ্ছা করলে জাহান্নামে যেতে পারে। আর আমি হলুম একজন স্বাধীন সামন্ত নরপতি, যাব বললেই কি যাওয়া যায়? যদি মহাক্ষত্রপের হুকুম নিতে যাই তো বলবেন—ব্যাটা এক্ষুনি রাজ্য ছেড়ে বনবাসে যাও।

টার্নকোট। তবে কথা দিন রাজসূয় যজ্ঞেও যাবেন না।

প্রিন্স। গট ইন হিম্মেল! আপনার দেখছি মাথা বিগড়ে গেছে। রাজসূয় যজ্ঞে যাবার জন্যে ছ—মাস ধ’রে আয়োজন করছি, কোটিখানেক টাকা খরচ হবে—আর আপনাদের আবদার শুনে সব এখন ভেস্তে দিই! হাঁ—ভাল কথা—ব্যারন, জগঝম্প সব কটা ঠিক আছে তো? সতরটা গুণে দেখেছ?

বিবলার। আজ্ঞে হাঁ। আমি সব—কটা রদ্দুরে দিয়ে টনটনে ক’রে রেখেছি।

প্রিন্স। ঠিক সতরটা?

বিবলার। ঠিক সতর।

ল্যাং প্যাং। জগঝম্প কি হবে প্রিন্স?

প্রিন্স। বাজবে। যখন আমি যাত্রা করব, সঙ্গে সঙ্গে সতরটা জগঝম্পই বাজবে। প্রিন্স ড্রুংকেনডর্ফের মোটে তেরটা। আমার সতর।

ল্যাং প্যাং। আপনার অভাব কি, আপনি মনে করলে তো সতরর জায়গায় সাত—শ জগঝম্প, জয়ঢাক, চড়বড়ে, কাঁসি, ভেঁপু, রামশিঙে যা খুশী বাজাতে পারেন।

প্রিন্স। হেঁ হেঁ, জগঝম্প হ’লেই হয় না। সরকার যে—কটি বরাদ্দ ক’রে দিয়েছেন ঠিক সেই কটি বাজানো চাই। বেশী যদি বাজাই তবে বিলকুল বাতিল হবে। বাবা কোবল্ট, আমার নাকের ডগায় একটু সুড়সুড়ি দিয়ে দে তো।

টার্নকোট। তা হ’লে আপনি আমার কোনও অনুরোধই রাখলেন না?

প্রিন্স। অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু আপনাদের উদ্যমে আমার সম্পূর্ণ সহানুভুতি আছে জানবেন। ব্যারন বিবলার, আপনি একটু ও—ঘরে যান তো। হ্যাঁ— দেখুন সার ট্রিকসি, আপনাদের সঙ্গে দেশ উদ্ধার করতে গিয়ে আমার এই পৈতৃক রাজ্য আর পৈতৃক প্রাণটি খোয়াতে পারব না। তবে যদি বেঁচে থাকি, আর আপনাদের কার্যসিদ্ধি হয়, আর ইওরোপের জন্য একজন জবরদস্ত এম্পারার কি কাইজার কি ডিকটেটার দরকার হয়, তখন আমার কাছে আসবেন। ঐ কাজটা আমাদের বংশগত কিনা, বেশ সড়গড় আছে। তার পর সার ট্রিকসি, এগুলি খেয়ে দেখবেন নাকি? মাথা ঠাণ্ডা হবে। অভ্যাস নেই? আচ্ছা, তবে এক গ্লাস শ্ন্যাপ্স খান।

‘দি লণ্ডন ফগ’ হইতে উদ্ধৃত

দুইমাসব্যাপী হরতালের মধ্যে রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হইল। ইওরোপের জনসাধারণ এই অনুষ্ঠান বর্জন করিয়া আত্মসম্মান রক্ষা করিয়াছে—অবশ্য জনকতক ধামা—ধরা ছাড়া। আমরা যজ্ঞক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলাম না, সুতরাং আর কোনও খবর জানি না।

‘রাষ্ট্রবিৎ’ হইতে উদ্ধৃত

রাজসূয় যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হইল। তথাকথিত দেশনায়কগণকে রম্ভা প্রদর্শন করিয়া ইওরোপের জনসাধারণ এই বিরাট উৎসবে যোগ দিয়া অশেষ আনন্দ লাভ করিয়াছে।

যজ্ঞ উপলক্ষে যাঁহারা সরকারকে নানাপ্রকার সাহায্য করিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে সার ট্রিকসি টার্নকোর্টের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। শুনিতেছি ব্রিটিশ মেষবংশের উৎকর্ষ সাধনের জন্য সরকার যে কমিশন বসাইয়াছেন, সার ট্রিকসি তার প্রেসিডেণ্টরূপে শীঘ্রই কামরূপ যাত্রা করিবেন।