রাজভোগ

রাজভোগ

পৌষ মাস, সন্ধ্যাবেলা। একটি প্রকাণ্ড মোটর ধর্মতলার অ্যাংলোমোগলাই হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। মোটরটি সেকেলে কিন্তু দামী। চালকের পাশ থেকে একজন চোপদার জাতীয় লোক নেমে পড়ল। তার হাতে আসাসোঁটা নেই বটে কিন্তু মাথায় একটি জরি দেওয়া জাঁকালো পাগড়ি আছে, তাতে রুপোর তকমা আঁটা ; পরনে ইজের—চাপকান, কোমরে লাল মখমলের পেটি, তাতেও একটি চাপরাস আছে। লোকটি তার প্রকাণ্ড গোঁফে তা দিতে দিতে সগর্বে হোটেলে ঢুকে ম্যানেজারকে বললে, পাতিপুরকা রাজাবাহাদুর আয়ে হেঁ।

ম্যানেজার রাইচরণ চক্রবর্তী শশব্যস্তে বেরিয়ে এল এবং মোটরের দরজার সামনে হাত জোড় করে নতশিরে বলল, মহারাজ, আজ কার মুখ দেখে উঠেছি। দয়া করে নেমে এই গরিবের কুটিরে পায়ের ধুলো দিতে আজ্ঞা হ’ক।

পাতিপুরের রাজাবাহাদুর ধীরে ধীরে মোটর থেকে নামলেন। তাঁর বয়স সত্তর পেরিয়েছে, দেহ আর পাকা গোঁফ—জোড়াটি খুব শীর্ণ, মাথায় যেটুকু চুল বাকী আছে তাই দিয়ে টাক ঢেকে সিঁথি কাটবার চেষ্টা করেছেন। পরনে জরিপাড় সূক্ষ্ম ধুতি আর রেশমী পাঞ্জাবি, তার উপর দামী শাল, পায়ে শুঁড়ওয়ালা লাল লপেটা। তিনি গাড়ি থেকে নেমে ভিতরের মহিলাটিকে বললেন, নেমে এস। মহিলা বললেন, আমি আর নেমে কি করব, গাড়িতেই থাকি। তুমি যা খাবে খেয়ে এস, দেরি ক’রো না যেন। রাজা বললেন, তা কি হয় তুমিও এস। রাইচরণ কৃতাঞ্জলি হয়ে বললে, নামতে আজ্ঞা হ’ক রানী—মা, আপনার শ্রীচরণের ধুলো পড়লে হোটেলের বরাত ফিরে যাবে।

মহিলাটি বোধ হয় সুন্দরী ও যুবতী, কিন্তু ঠিক বলা যায় না, তাঁর সজ্জা আর প্রসাধন এমন পরিপাটি যে রূপযৌবনের কতটা আসল আর কতটা নকল তা বোঝবার উপায় নেই। তিনি গাড়ি থেকে নামলেন। রাইচরণ বিনয়ে কুঁজো হয়ে সামনের দিকে জোড় হাত নাড়তে নাড়তে পথ দেখিয়ে রাজাবাহাদুর ও তাঁর সঙ্গিনীকে ভিতরে নিয়ে গেল এবং হেঁকে বললে, এই শীগগির রয়েল সেলুনের দরজা খুলে দে। হোটেলের সামনের বড় ঘরটিতে বসে যারা খাচ্ছিল তারা উদগ্রীব হয়ে মহিলাটিকে দেখে ফিসফিস করে জল্পনা করতে লাগল।

একজন চাকর তাড়াতাড়ি একটা কামরা খুলে দিল। ছোট খোপ, রং—করা কাঠের দেওয়াল,…মাঝে একটি টেবিল এবং দুটি গদি—আঁটা চেয়ার। টেবিলটি সাদা চাদরে ঢাকা, দিনের বেলায় তাতে হলুদের দাগ দেখা যায়। এই কামরার পাশেই পর্দার আড়ালে আর একটি কামরা, তাতে এক সেট পুরনো কৌচ ও সেটি এবং একটি ছোট টেবিল, তার উপর তিন—চারটি গত সালের মাসিক পত্রিকা। দেওয়ালে কয়েকটি সিনেমা—তারার ছবি খবরের কাগজ থেকে কেটে এঁটে দেওয়া হয়েছে।

দুই মহামান্য অতিথিকে বসিয়ে ম্যানেজার রাইচরণ বললে, হুজুর, আজ্ঞা করুন কি এনে দেব। রাজাবাহাদুর সাগ্রহে বললেন, তোমার কি কি তৈরি আছে শুনি? রাইচরণ বললে, আজ্ঞে, তিন রকম পোলাও আছে—ভেটকি মাছের, মটনের আর পাঁঠার। কালিয়া আছে, কোর্মা আছে, কোপ্তা আছে ; মটন—চপ, চিংড়ি—কাটলেট ; ফাউল—রোস্ট, ছানার পুডিং….হুজুরের আশীর্বাদে আরও কত কি আছে।

রাজাবাহাদুর খুশী হয়ে বললেন, বেশ বেশ, অতি উত্তম। আচ্ছা ম্যানেজার, তোমার এখানে বিরিয়ানি পোলাও হয়?

—হয় বই কি হুজুর, ঘণ্টা খানিক আগে অর্ডার পেলেই করে দিতে পারি। আমি তিন বচ্ছর দুম্বাগড়ের নবাব সাহেবের রসুইঘরের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট ছিলুম কিনা, সেখানেই সব শিখেছি। খুব খাইয়ে লোক ছিলেন নবাব সাহেব, এ বেলা এক দুম্বা, ও বেলা এক দুম্বা। বাবুর্চীদের রান্না তাঁর পছন্দ হত না, আমি তাদের কায়দার অনেক উন্নতি করেছি, তাই জন্যেই তো নবাব বাহাদুর খুশী হয়ে নিজের হাতে ফারসীতে আমাকে সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছেন। দেখবেন হুজুর?

—থাক থাক। আচ্ছা, তোমার কায়দাটা কি রকম শুনি।

—বিরিয়ানি রান্নার? এক নম্বর বাঁশমতী চাল—এখন তার দাম পাঁচ টাকা সের, খাঁটি গাওয়া ঘি, ডুমো ডুমো মাংস, বাদাম পেস্তা কিশমিশ এবং হরেক রকম মসলা, গোলাপ জলে গোলা খোয়া ক্ষীর, মৃগনাভি সিকি রতি, দশ ফোঁটা ও—ডি—কলোন, আলু একদম বাদ। চাল আর মাংস প্রায় সিদ্ধ হয়ে এলে তার ওপর দু—মুঠো পেঁয়াজ—কুচি মুচমুচে করে ভেজে ছড়িয়ে দিই, তারপর দমে বসাই। খেতে যা হয় সে আর কি বলব!

রাজাবাহাদুরের জিবে জল এসে গেল, সুৎ করে টেনে নিয়ে বললেন, চমৎকার! আচ্ছা সামি কাবাব জান?

—হেঁ হেঁ, হুজুরের আশীর্বাদে মোগলাই ইংলিশ ফ্রেঞ্চ হেন রান্না নেই যা এই রাইচরণ চক্কত্তি জানে না। মাংস পিষে তার সঙ্গে ছোলার ডাল বাটা আর পেস্তা বাদাম মেশাতে হয়, তাতে আদা হিং পেঁয়াজ রসুন গরম মসলা ইত্যাদি পড়ে, তারপর চ্যাপটা লেচি গড়ে চাটুতে ভাজতে হয়। এই হল সামি কাবাব। ওঃ, খেতে যা হয় হুজুর তা বলবার কথা নয়।

রাজাবাহাদুর আবার সুৎ করে জিভের জল টেনে নিলেন, তার পর বললেন, আচ্ছা রাইচরণ, রোগন—জুশ জান?

মহিলাটি অধীর হয়ে বললেন, আঃ, ওসব জিজ্ঞেস করে কি হবে, যা খাবে তাই আনতে বল না।

রাজাবাহাদুর বললেন, আ হা হা ব্যস্ত হও কেন, খাওয়া তো আছেই, আগে একবার রাইচরণকে বাজিয়ে নিচ্ছি।

রাইচরণ বললে, বাজাবেন বই কি হুজুর, নিশ্চয় বাজাবেন। রোগন—জুশ হচ্ছে—

মহিলাটি আস্তে আস্তে উঠে পাশের কামরায় গিয়ে মাসিক পত্রিকার পাতা ওলটাতে লাগলেন।

—রোগন—জুশ হচ্ছে খাসি বা দুম্বার মাংস, শুধু ঘি—এ সিদ্ধ, জল একদম বাদ। ভারী পোষ্টাই হুজুর, সাত দিন খেলে লিকলিকে রোগা লোকেরও গায়ে গত্তি লেগে ভুঁড়ি গজায়।

—তুমি তো অনেক রকম জান দেখছি হে। আচ্ছা মুর্গ মুসল্লম তৈরী করতে পার?

—নিশ্চয় পারি হুজুর, ঘণ্টা তিনেক আগে অর্ডার দিতে হয়, অনেক লটঘটি কিনা। বাবুর্চীদের চাইতে আমি ঢের ভাল বানাতে পারি, আমি নতুন কায়দা আবিষ্কার করেছি। একটি বড় আস্ত মুরগি, তার পেটের মধ্যে মাছের কোপ্তা, ডিম আর কুচো—চিংড়ি দেওয়া কচুর শাগের ঘণ্ট, অভাবে লাউ—চিংড়ি, আর দই—

—কচুর শাগ? আরে রাম রাম।

—না হুজুর, মুরগির পেটে সমস্ত জিনিস ভরে দিয়ে সেলাই করে হাঁড়ি—কাবাবের মতন পাক করতে হয়, সুসিদ্ধ হয়ে গেলে মুরগি কুচো—চিংড়ি কচুর শাগ দই আর সমস্ত মশলা মিশে গিয়ে এক হয়ে যায়। খেতে যা হয় সে আর কি বলব হুজুর।

রাজাবাহাদুর এবারে আর সামলাতে পারলেন না, খানিকটা নাল টেবিলে পড়ে গেল। একটু লজ্জিত হয়ে রুমাল দিয়ে মুছে ফেলে বললেন, ওহে রাইচরণ, উত্তম সর—ভাজা খাওয়াতে পার?

হুজুরের আশীর্বাদে কি না পারি? সর—ভাজার রাজা হল গোলাপী গাই—দুধের সর—ভাজা, নবাব সিরাজদ্দৌলা যা খেতেন। কিন্তু দশ দিন সময় চাই মহারাজ, আর শ—খানিক টাকা খরচ মঞ্জুর করতে হবে।

—গোলাপী রঙের গরু হয় নাকি?

—না হুজুর। একটি ভাল গরুকে সাত দিন ধরে সেরেফ গোলাপ ফুল, গোলাব জল আর মিছরি খাওয়াতে হবে, খড় ভুষি জল একদম বারণ। তারপর সে যা দুধ দেবে তার রং হবে গোলাপী আর খোশবায় ভুর ভুর করবে। সেই দুধ ঘন করে তার সর নিতে হবে, আর সেই দুধ থেকে তৈরি ঘি দিয়েই ভাজতে হবে। রসে ফেলবার দরকার নেই আপনিই মিষ্টি হবে—গরু মিছরি খেয়েছে কিনা। সে যা জিনিস, অমৃত কোথায় লাগে। কেষ্টনগরের কারিগররা তা দেখলে হুতোশে গলায় দড়ি দেবে।

—কিন্তু অত গোলাপ ফুল খেলে গরুর পেট ছেড়ে দেবে না?

রাইচরণ গলার স্বর নীচু করে বললে, কথাটা কি জানেন মহারাজ? গোলাপ ফুলের সঙ্গে খানিকটা সিদ্ধি—বাটাও খাওয়াতে হয়, তাতে গরুর পেট ঠিক থাকে আর সর—ভাজাটিও বেশ মজাদার হয়।

—চমৎকার, চমৎকার!

—এইবার হুজুর আজ্ঞা করুন কি কি খাবার আনব। আমি নিবেদন করছি কি—আজ আমার যা তৈরি আছে সবই কিছু কিছু খেয়ে দেখুন, ভাল জিনিস, নিশ্চয় আপনি খুশী হবেন। এর পরে একদিন অর্ডার মতন পছন্দসই জিনিস তৈরি করে হুজুরকে খাওয়াব।

—আচ্ছা রাইচরণ, তোমার এখানে পাতি নেবু আছে?

—আছে বই কি, নেবু হল পোলাও খাবার অঙ্গ। একটি আরজি আছে মহারাজ—আজ ভোজনের পর হুজুরকে একটি শরবত খাওয়াব, হুজুর তর হয়ে যাবেন।

—কিসের শরবত!

—তবে বলি শুনুন মহারাজ। আমার একটি দূর সম্পর্কের ভাগনে আছে, তার নাম কানাই। সে বিস্তর পাস করেছে, নানা রকম দ্রব্যগুণ তার জানা আছে। শরবতটি সেই কানাই ছোকরারই পেটেণ্ট, সে তার নাম দিয়েছে—চাঙ্গায়নী সুধা। বছর—দুই আগে কানাই হুণ্ডাগড় রাজসরকারে চাকরি করত, কুমার সায়েব তাকে খুব ভালবাসতেন। কুমারের খুব শিকারের শখ, একদিন তাঁর হাতিকে বাঘে ঘায়েল করলে। হাতির ঘা দিন—কুড়ির মধ্যে সেরে গেল, কিন্তু তার ভয় গেল না। হাতি নড়ে না, ডাঙশ মারলেও ওঠে না। কুমার সায়েবের হুকুম নিয়ে কানাই হাতিকে সের—টাক চাঙ্গায়নী খাওয়ালে। পরদিন ভোরবেলা হাতি চাঙ্গা হয়ে পিলখানা থেকে গটগট করে হেঁটে চলল, জঙ্গল থেকে একটা শালগাছের রলা উপড়ে নিলে, পাতাগুলো খেয়ে ফেলে ডাণ্ডা বানালে, তার পর পাহাড়ের ধারে গিয়ে শুঁড় দিয়ে সেই ডাণ্ডা ধরে বাঘটাকে দমাদম পিটিয়ে মেরে ফেলল। কুমার সাহেব খুশী হয়ে কানাইকে পাঁচ—শ টাকা বকশিশ দিলেন।

—শরবতে হুইস্কি টুইস্কি আছে নাকি? ওসব আমার আর চলে না।

—কি যে বলেন হুজুর! কানাই ওসব ছোঁয় না, অতি ভাল ছেলে, সিগারেটটি পর্যন্ত খায় না। চাঙ্গায়নী সুধায় কি কি আছে শুনবেন? কুড়িটা কবরেজী গাছ—গাছড়া, কুড়ি রকম ডাক্তারী আরক, কুড়িদফা হেকিমী দাবাই, হীরেভস্ম, সোনাভস্ম, মুক্তোভস্ম, রাজ্যের ভিটামিন, আর পোয়াটাক ইলেকটিরি—এইসব মিশিয়ে চোলাই করে তৈরী হয়। খুব দামী জিনিস, কানাই আমাকে হাফ প্রাইস পঞ্চাশ টাকায় এক বোতল দিয়েছে, মামা বলে ভক্তি করে কিনা! দোহাই হুজুর, আজ একটু খেয়ে দেখবেন।

—সে হবে এখন। আচ্ছা রাইচরণ, তুমি বার্লি রাখ?

—রাখি হুজুর। ছানার পুডিং—এ দিতে হয়, নইলে আঁট হয় না। এইবার তবে হুজুরের জন্য খাবার আনতে বলি? হুকুম করুন কি কি আনব।

—এক কাজ কর—এক কাপ জলে এক চামচ বার্লি সিদ্ধ ক’রে নেবু আর একটু নুন দিয়ে নিয়ে এস।

রাইচরণ আকাশ থেকে পড়ে বললে, সেকি মহারাজ! ভেটকি মাছের পোলাও, মটনকারি, ফাউল—রোস্ট—

রাজাবাহাদুর হঠাৎ অত্যন্ত খাপপা হয়ে বললেন, তুমি তো সাংঘাতিক লোক হ্যা! আমাকে মেরে ফেলতে চাও নাকি, অ্যাঁ? আমি বলে গিয়ে তিনটি বচ্ছর ডিসপেপসিয়ায় ভুগছি, কিচ্ছু হজম হয় না, সব বারণ, দিনে শুধু গলা ভাত আর শিঙি মাছের ঝোল, রাত্তিরে বার্লি—আর তুমি আমাকে পোলাও কালিয়ার লোভ দেখাচ্ছ! কি ভয়ানক খুনে লোক!

রাইচরণ মর্মাহত হয়ে চলে গেল এবং একটু পরে এক ‘বাটি বার্লি’ এনে রাজাবাহাদুরের সামনে ঠক করে রেখে বললে, এই নিন।

তারপর রাইচরণ পর্দা ঠেলে পাশের কামরায় গিয়ে মহিলাটিকে বললে, রানী—মা, আপনার জন্য একটু ভেটকি মাছের পোলাও, মটন—কারি আর ফাউল—রোস্ট আনি?

—খেপেছেন? আমি খাব আর ওই হ্যাংলা বুড়ো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে দেখবে! গলা দিয়ে নামবে কেন?

—তবে একটু চা আর খানকতক চিংড়ি কাটলেট? এনে দিই রানী—মা?

—রানী—ফানি নই, আমি নক্ষত্র দেবী। আর একদিন আসব এখন, স্টুডিওর ফেরত। ডিরেক্টার হাঁদুবাবুকেও নিয়ে আসব।

১৩৫৫ (১৯৪৮)