একগুঁয়ে বার্থা
মোগলসরাই—এর দু স্টেশন আগে সাকলদিহা। সকাল আটটায় পঞ্জাব মেল সেখানে এসে থামল। একটা সেকেণ্ডক্লাস কামরায় দশ জন বাঙালী আর অবাঙালী যাত্রী আছেন, গাড়ি চলতে দেরি হচ্ছে দেখে তাঁরা অধীর হয়ে উঠলেন। প্ল্যাটফর্মে কলরব হতে লাগল।
ক্যা হুআ গার্ডসাহেব? গার্ড জানালেন, এঞ্জিন বিগড়ে গেছে, ট্রেন এখন সাইডিং—এ ফেলে রাখা হবে, মোগলসরাই থেকে অন্য এঞ্জিন এলে গাড়ি চলবে। অন্তত দেড় ঘণ্টা দেরি হবে।
অতুল রক্ষিত বিরক্ত হয়ে বললেন, বিগড়ে যাবার আর সময় পেলেন না ইঞ্জিন, সেরেফ বজ্জাতি। ই.আই.আর নাম বদলে গিয়েই এইসব যাচ্ছেতাই কাণ্ড শুরু হয়েছে। কাশী পৌঁছুতে দুপুর পেরিয়ে যাবে দেখছি। ওহে নরেশ, তোমাদের প্লে যদি ভাল না ওতরায় তো আমি দায়ী হব না তা বলে দিচ্ছি। আনাড়ী অ্যাক্টরদের তামিল দিতে অন্ততঃ দশ ঘণ্টা লাগবে। সিরাজুদ্দৌলা নাটকটি সোজা নয়।
নরেশ মুখুজ্যে বললেন, আপনি ভাববেন না রক্ষিত মশায়। ওরা অনেক দিন ধরে রিহার্সাল দিয়ে তৈরী হয়ে আছে, আপনি শুধু একটু পালিশ চড়িয়ে দেবেন। তিন—চার ঘণ্টার বেশী লাগবে না।
অতুল রক্ষিত বললেন, তাতে কিছুই হবে না, তোমাদের খোট্টাই উচ্চারণ দুরস্ত করতেই দিন কেটে যাবে। দেখ নরেশ, আমার মনে হচ্ছে আমরা অশ্লেষা কি মঘায় যাত্রা করেছি, সকলেই আমাদের পিছনে লেগেছে। হাওড়া আসতে ট্যাকসির টায়ার ফাটল, সিগারেটের দুটো টিন বাড়িতেই পড়ে রইল, ট্রেনে উঠতে হোঁচট খেলুম, এই দেখ গোড়ালি জখম হয়েছে। এখন আবার ইঞ্জিন নড়বেন না বলে গোঁ ধরেছেন।
অধ্যাপক ধীরেন দত্তর শ্বশুরবাড়ি কাশীতে, পূজোর বন্ধে সেখানে চলেছেন। সহাস্যে বললেন, অচেতন পদার্থের একগুঁয়েমি সম্বন্ধে একটা ইংরাজী প্রবাদ আছে বটে।
দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ কৈলাস গাঙুলী বললেন, জগদীশ বোস তো বলেই দিয়েছেন যে এক টুকরো লোহাও সাড়া দেয়। তার মানে, লোহার চেতনা আছে। রেলের ইঞ্জিন আর মোটর গাড়ি আরও সচেতন।
ধীরেন দত্ত বললেন, তাদের চাইতে একটা পিঁপড়ে ঢের বেশী সচেতন। এঞ্জিন বা মোটর গাড়ির জীবন নেই।
কৈলাস গাঙুলী বললেন, নেই কেন? ইঞ্জিন কয়লা খায়, জল খায়, ধোঁয়া ছাড়ে, ছাই ফেলে, অর্থাৎ কোষ্ঠ সাফ করে। মোটর গাড়িও পেট্রল খায়, তেল খায়, ধোঁয়া ছাড়ে, চার পায়ে দাপিয়ে বেড়ায়। জীবনের সব লক্ষণই তো বর্তমান, গোঁ ধরবে তা আর বিচিত্র কি!
—হল না গাঙুলী মশায়! মোটর গাড়ি যদি লোহা—পেতল—চুর খেয়ে দেহের ক্ষয় মেরামত করতে পারত, আর মাঝে মাঝে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পিছনের খোপ থেকে একটি বাচ্চা মোটর প্রসব করত তবেই জীবিত বলা চলত। জীবনের লক্ষণ হচ্ছে—আহার গ্রহণ, শরীর পোষণ, মল বর্জন, আর বংশবৃদ্ধি।
—ওহে প্রফেসার, নিজের ফাঁদে নিজে পড়ে গেছ। তুমি যে সব লক্ষণ বললে তাতে আগুনকেও সজীব পদার্থ বলা চলে। আশপাশ থেকে দাহ্য উপাদান আত্মসাৎ করে পুষ্ট হয়, ধোঁয়া আর ছাই ত্যাগ করে সুবিধে পেলেই ব্যাপ্ত হয়ে বংশবৃদ্ধি করে।
ধীরেন দত্ত হেসে বললেন, হার মানলুম, গাঙুলী মশায়! কিন্তু এঞ্জিনের বা আগুনের গোঁ আছে এ কথা মানি না।
—জোর করে কিছুই বলা যায় না, জগৎটাই যে প্রাণময়।
একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক এক কোণে হেলান দিয়ে চোখ বুজে সব কথা শুনছিলেন। মাথায় টাক, বড় গোঁফ, কপালে একটা কাটা দাগ, চোখে পুরু চশমা। ইনি খাড়া হয়ে বসে বললেন, মশায়রা যদি অনুমতি দেন তো একটা কথা নিবেদন করি। আমি একটা মোটর গাড়ি জানি যার অতি ভয়ানক গোঁ ছিল। আমার নিজেরই গাড়ি, জার্মন বার্থা কার।
অতুল রক্ষিত বললেন, ব্যাপারটা খুলে বলুন সার।
দু হাতের আস্তিন গুটিয়ে ভদ্রলোক বললেন, এই দেখুন কি রকম চোট লেগেছিল। কপালের কাটা দাগতো দেখতেই পাচ্ছেন শুধু জখম হইনি মশায়, বিনা অপরাধে কোর্টে হাজারটি টাকা জরিমানা দিয়েছি। সবই সেই বার্থা গাড়ির একগুঁয়েমির ফল।
নরেশ মুখুজ্যে বললেন, আপনারই তো গাড়ি, তবে আপনার ওপর তার অত আক্রোশ হল কেন? বেদম চাবুক লাগিয়েছিলেন বুঝি?
—তামাশা করবেন না মশায়। আক্রোশ আমার ওপর নয়, মকদুমপুরের কুমার সাহেবের উপর। তিনি খুন হলেন, আমি জখম হলুম, আর অসাবধানে গাড়ি চালিয়ে মানুষ মেরেছি এই মিথ্যে অপবাদে মোটা টাকা দণ্ড দিলুম। আমি হচ্ছি মাখনলাল মল্লিক, আমার কেসটা কাগজে পড়ে থাকবেন।
কৈলাস গাঙুলী বললেন, মনে পড়ছে না কি হয়েছিল। ঘটনাটা সবিস্তারে বলুন মল্লিক মশাই। ইঞ্জিন এসে পৌঁছুতে তো ঢের দেরি, ততক্ষণ আপনার আশ্চর্য কাহিনীটি শোনা যাক।
মাখন মল্লিক বলতে লাগলেন।—
আমি শেয়ারের দালালি করি, শহরে হরদম ঘুরে বেড়াতে হয়। পনর বছর আগেকার কথা। জগুমল সেথিয়া পুরনো মোটর গাড়ির ব্যবসা করে। একদিন আমাকে বললে, বাবুজী, একটা ভাল গাড়ি নেবেন? জার্মন বার্থা কার, রোলস রয়েস তার কাছে লাগে না, সস্তায় দেব। গাড়িটি দেখে আমার খুব পছন্দ হল। বেশী দিন ব্যবহার হয় নি, কিন্তু দেখেই বোঝা যায় যে, বেশ জখম হয়েছিল, সর্বাঙ্গে চোট লাগার চিহ্ন আছে। তা হলেও গাড়িটি অতি চমৎকার, মেরামতও ভাল করে হয়েছে। জগুমল খুব কম দামেই বেচলে, সাড়ে তিন হাজারে পেয়ে গেলুম।
একদিন স্টক এক্সচেঞ্জে যাচ্ছি, ড্রাইভার নেই, নিজেই চালাচ্ছি। যাব দক্ষিণ দিকে, কিন্তু স্টিয়ারিং এর ওপর হাতটা যেন কেউ জোর করে ঘুরিয়ে দিলে, গাড়ি উত্তর দিকে চলল। সামনে একটা প্রকাণ্ড গাড়ি আস্তে আস্তে চলছিল, আমার বার্থা গাড়ি পিছন থেকে তাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিলে, প্রাণপণে ব্রেক কষেও সামলাতে পারলুম না।
যখন জ্ঞান হল, দেখলুম আমি রক্ত মেখে শুয়ে আছি, মাথা আর হাতে যন্ত্রণা, চারিদিকে পুলিস। আমাকে মেডিক্যাল কলেজে ড্রেস করিয়ে থানায় নিয়ে গেল। শুনলাম ব্যাপারটা এই।—আমার গাড়ি যাকে ধাক্কা মেরেছিল সেটা হচ্ছে মকদুমপুরের কুমার সাহেবের গাড়ি। গাড়িখানা একেবারে চুরমার হয়েছে, একটা গ্যাস পোস্টে ঠুকে গিয়ে কুমার সাহেবের মাথা ফেটে গেছে, বাঁচবার কোনও আশা নেই। আমি বেহুঁশ হয়ে গাড়ি চালিয়ে মানুষ খুন করেছি এই অপরাধে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করেছে। অনেক কষ্টে বেল দিয়ে খালাস পেলুম।
তার পর তিন মাস ধরে মকদ্দমা চলল। সরকারী উকিল বললেন, আসামী মদ খেয়ে চুর হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। আমার ব্যারিস্টার বললে, মাখন মল্লিক অতি সচ্চরিত্র লোক, মোটেই নেশা করে না, হঠাৎ মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়ে অসামাল হয়েছিল।
কৈলাস গাঙুলী প্রশ্ন করলেন, আপনার মৃগীর ব্যারাম আছে নাকি?
—না মশায়, মৃগী কস্মিন কালে হয় নি, মদ গাঁজা গুলিও খাই নি। আমাকে ফাঁসাবার জন্য সরকারী উকিল আর বাঁচাবার জন্যে আমার ব্যারিস্টার দুজনেই ডাহা মিথ্যে কথা বলেছিল। প্রকৃত ব্যাপার— বার্থা গাড়ি নিজেই চড়াও হয়েছিল, আমার তাতে কিছুমাত্র হাত ছিল না। কিন্তু সে কথা কে বিশ্বাস করবে? আমি নিস্তার পেলুম না, হাজার টাকা জরিমানা হল, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সও বাতিল হয়ে গেল।
নরেশ মুখুজ্যে বললেন, কুমার সাহেবের গাড়িটা কোন মেক ছিল?
—খুব দামী ব্রিটিশ গাড়ি, সোআংক—টুটলার।
—তাই বলুন। আপনার জার্মন গাড়ি তো ব্রিটিশ গাড়িকে ঢুঁ মারবেই, শত্রুর তৈরি যে। মজা মন্দ নয়, দুই চ্যাম্পিয়ান গাড়ির লড়াই হল, মাঝে থেকে বেচারা কুমার বাহাদুর মরলেন, আপনি জখম হলেন, আবার জরিমানাও দিলেন।
মাখন মল্লিক বললেন, যা ভাবছেন তা নয় মশায়, এতে ইণ্টারন্যাশনাল ক্ল্যাশের নাম গন্ধ নেই। আসল কথা, বার্থা গাড়ি প্রতিশোধ নিয়েছে, কুমার সাহেবকে ডেলিবারেটলি খুন করেছে।
কৈলাস গাঙুলী বললেন, বড় অলৌকিক কথা, কলিযুগেও কি এমন হয়? অবশ্য জগতে অসম্ভব কিছু নেই। আপনার এই বিশ্বাসের কারণ কি?
এই সময় কামরায় একটা ধাক্কা লাগল, তারপরেই হেঁচকা টান। অতুল রক্ষিত বললেন, যাক বাঁচা গেল, ইঞ্জিন খুব চটপট এসে গেছে, সাড়ে দশটার মধ্যে কাশী পৌঁছে যাব।
নরেশ মুখুজ্যে বললেন, কাশী বিশ্বনাথ এখন মাথায় থাকুন। মল্লিক মশায়, আপনার গল্পটি শেষ করে ফেলুন, নইলে গাড়ি থেকে নামতে পারব না।
মাখন মল্লিক বললেন, তারপর শুনুন। আমার মাথার আর হাতের ঘা সেরে গেল, মকদ্দমাও চুকে গেল। তখন আমার মনে একটা জেদ চাপল। বার্থা গাড়ির আচরণটি বড়ই অদ্ভুত, তার রহস্য ভেদ না করলে স্বস্তি পাব না। প্রথমেই খোঁজ নিলুম জগুমল সেথিয়ার কাছে। সে বললে, এই গাড়ির মালিক ছিলেন সলিসিটার জলদ রায়, রায় অ্যান্ড দস্তিদার ফার্মের পার্টনার। রাঁচি যেতে চাণ্ডিলের কাছে তাঁর গাড়ি উলটে যায়। তাঁর বন্ধু কুমার বাহাদুর নিজের গাড়িতে আগে আগে যাচ্ছিলেন। তিনিই অতি কষ্টে জলদ রায় আর তাঁর স্ত্রীকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনেন। জলদ রায় সাত দিন পরে মারা গেলেন, তাঁর স্ত্রী ভাঙা বার্থা গাড়ি জগুমলকে বেচলেন। মেরামতের পর সে আবার আমাকে বেচলে।
কৈলাস গাঙুলী বললেন, মানুষ মারাই দেখছি বার্থা গাড়িটার স্বভাব।
না মশায়, জলদ রায়কে বার্থা মারে নি। জগুমল আর কোনও খবর দিতে পারলেন না, তখন আমি জলদ রায়ের স্ত্রীর কাছে গেলুম। তিনি বাপের বাড়িতে ছিলেন, একেবারে উন্মাদ হয়ে গেছেন, তার সঙ্গে দেখা করা বৃথা। তার পর গেলুম জলদের পার্টনার রমেশ দস্তিদারের কাছে। শেয়ার কেনা বেচা উপলক্ষ্যে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। প্রথমটা তিনি কিছুই বলতে চাইলেন না। যখন শুনলেন বার্থা গাড়িই কুমার সাহেবকে মেরেছে তখন অবাক হয়ে গেলেন এবং নিজে যা জানতেন তা প্রকাশ করলেন। মারা যাবার আগে জলদ রায় তাঁকে সবই জানিয়েছেন। সংক্ষেপে বলছি। শুনুন।
জলদ রায় বিস্তর পৈতৃক সম্পত্তি পেয়েছিলেন। সলিসিটার ফার্মের কাজ দস্তিদারই দেখতেন, জলদ রায় ফুর্তি করে বেড়াতেন আর নিয়মরক্ষার জন্য মাঝে মাঝে অফিসে যেতেন। তাঁর স্ত্রী হেলেনা রায় ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী আর বিখ্যাত সোসাইটি লেডি।
কৈলাস গাঙুলী বললেন, ও, তাই বলুন, এর মধ্যে একজন সুন্দরী নারী আছেন, নইলে অনর্থ ঘটবে কেন।
—জলদ রায়ের সঙ্গে মকদুমপুরের কুমার ইন্দ্রপ্রতাপ সিং—এর খুব বন্ধুত্ব ছিল। ইন্দ্রপ্রতাপ বিলিতী সোআংক টুটলার গাড়ি কিনলেন দেখে জলদ রায় বললেন, আমি লেটেস্ট মডেল জার্মান বার্থা কার কিনেছি। তোমার গাড়ি বড়, কিন্তু স্পীডে বার্থার কাছে হেরে যাবে।
কুমার সাহেব বললেন, তবে এস, একদিন রেস লাগানো যাক, পাঁচ হাজার টাকা বাজি। জলদ রায় বললেন, রাজী আছি। আমার বাড়ী থেকে স্টার্ট করা যাবে। বেলা একটার সময় তুমি রওনা হবে, তার ঠিক পনর মিনিট পরে আমি হেলেনাকে নিয়ে বেরুব। চাণ্ডিলের আগেই তোমাকে ধরে ফেলব। কুমার সাহেব বললেন, খুব ভাল কথা। চাণ্ডিল ডাকবাংলায় আমরা রাত কাটাব, পরদিন সকালে একসঙ্গে রাঁচি যাব, সেখানে আমার বাড়িতে পিকনিক করা যাবে।
নির্দিষ্ট দিনে, জলদ রায় তাঁর অফিস থেকে বেলা পৌনে একটায় ফিরে এলেন। স্ত্রীকে দেখতে পেলেন না, দারোয়ান বললেন, বাহাদুর এসেছিলেন, তাঁর গাড়িতে মেমসাহেবকে তুলে নিয়ে এইমাত্র রওনা হয়েছেন। এই চিঠি রেখে গেছেন।
চিঠিটা জলদ রায়ের স্ত্রী লিখেছিলেন। তার মর্ম এই।—কুমারের সঙ্গে চললুম, জীবনটা পরিপূর্ণ করতে চাই। লক্ষ্মীটি, তুমি আর শুধু শুধু পিছনে ধাওয়া করো না। ডিভোর্সের দরখাস্ত কর, ইন্দ্রপ্রতাপ কৃপণ নয়, উপযুক্ত খেসারত দেবে। হেলেনা।
জলদ রায়ের মাথায় খুন চাপল। স্ত্রীর জন্যে একটা চাবুক, কুমারের জন্যে একটা মাউজার পিস্তল, নিজের জন্য এক বোতল ব্রাণ্ডি, আর বার্থার জন্যে তিন বোতল সাজাহানপুর রম নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়লেন। গাড়ি কেনার পরেই তিনি পরীক্ষা করে দেখেছিলেন যে, বার্থাকে রম খাওয়ালে (অর্থাৎ পেট্রল ট্যাংকে ঢাললে) তার বেশ ফুর্তি হয়, হর্সপাওয়ার বেড়ে যায়।
প্রচণ্ড বেগে গাড়ি চালিয়ে জলদ রায় যখন চাণ্ডিলের কাছে পৌঁছুলেন তখন দেখতে পেলেন প্রায় দেড় মাইল দূরে কুমারের গাড়ি চলেছে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে কিন্তু দূর থেকে সোআংক—টুটলারের রূপলী রং স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
ওদিকে কুমার ইন্দ্রপ্রতাপও দেখলেন পিছনে একটা গাড়ি ছুটে আসছে। তিনটে হেড লাইট দেখেই বুঝলেন যে জলদ রায়ের বার্থা কার। কুমারের সামনেই একটা পাহাড়, রাস্তা তার পাশ দিয়ে বেঁকে গেছে। তিনি জোরে গাড়ি চালিয়ে পাহাড়ের আড়ালে এলেন, এবং গাড়ি থেকে নেমে তাড়াতাড়ি গোটাকতক বড় বড় পাথরের চাঙড় রাস্তায় রাখলেন। তারপর আবার গাড়িতে উঠে চললেন।
সঙ্গে সঙ্গে বার্থা গাড়ি এসে পড়ল। জলদ রায় বিস্তর মদ খেয়েছিলেন, বার্থাকেও খাইয়েছিলেন, তার ফলে দুজনেই একটু টলছিলেন। রাস্তার বাধা জলদ দেখতে পেলেন না, পাথরের ওপর দিয়েই পুরো জোরে চালালেন। ধাক্কা খেয়ে বার্থা গাড়ি কাত হয়ে পড়ে গেল। ইন্দ্রপ্রতাপের ইচ্ছে ছিল তাড়াতাড়ি অকুস্থল থেকে দূরে সরে পড়বেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গিনী হেলেনা চিৎকার করতে লাগলেন, দৈবক্রমে একটা মোটর গাড়িও বিপরীত দিক থেকে এসে পড়ল। তাতে ছিলেন ফরেস্ট অফিসার বনবিহারী দুবে আর তাঁর চাপরাসী।
অগত্যা ইন্দ্রপ্রতাপকে থামতে হল; তিনি দুবের সাহায্যে জলদ রায়কে তুলে নিয়ে চাণ্ডিল হাসপাতালে এলেন। ডাক্তার বললেন, সাংঘাতিক জখম, আমি মরফীন ইঞ্জেকশন দিচ্ছি, এখনই কলকাতায় নিয়ে যান। দুবেজী বললেন, কুমার সাহেব, আপনি আর দেরি করবেন না, এঁদের নিয়ে এখনই বেরিয়ে পড়ুন। আপনার বন্ধুর গাড়িটা আমি পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। চেক বই সঙ্গে আছে তো? একখানা সাড়ে সাত হাজার টাকার বেয়ারার চেক লিখে দিন, পুলিসকে ঠাণ্ডা করতে হবে।
কলকাতায় ফেরবার সাত দিন পরেই জলদ রায় মারা পড়লেন, তাঁর স্ত্রী হেলেনা উন্মাদ অবস্থায় বাপের বাড়ি চলে গেলেন। তোবড়ানো বার্থা গাড়িটা জগুমল কিনে নিলে।
এখন ব্যাপারটা আপনাদের পরিষ্কার হল তো? ইন্দ্রপ্রতাপ বার্থাকে জখম করেছে, তার প্রিয় মনিবকে খুন করেছে, বার্থা এরই প্রতিশোধ খুঁজছিল। অবশেষে আমার হাতে এসে মনষ্কামনা পূর্ণ হল, স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে সোআংক—টুটলারকে ধাক্কা দিয়ে চুরমার করে দিলে, ইন্দ্রপ্রতাপকেও মারলে।
নরেন দত্ত বলিলেন, বার্থা খুব পতিব্রতা গাড়ি, তার আগেকার মনিবের হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে, কিন্তু আপনার ওপর তার টান ছিল না, দেখছি। শত্রু মারতে গিয়ে আপনাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বার্থার গতি কি হল?
—জগুমলকেই বেচে দিয়েছি, চার শ টাকায়।
নরেশ মুখুজ্যে বললেন, খাসা গল্পটি মাখনবাবু, কিন্তু বড্ড তড়বড় করে বলেছেন। যদি বেশ ফেনিয়ে আর রসিয়ে পাঁচ শ পাতার একটি উপন্যাস লিখতে পারেন তবে আপনার রবীন্দ্র পুরস্কার মারে কে। যাই হোক, বেশ আনন্দে সময়টা কাটল।
—আনন্দে কাটল কি রকম? দুজন নামজাদা লোক খুন হল, এক জন মহিলা উন্মাদ হয়ে গেল, দুটো দামী গাড়ি ভেঙে গেল, আমি জখম হলুম আবার জরিমানাও দিলুম, এতে আনন্দের কি পেলেন?
—রাগ করবেন না মাখনবাবু। আপনি জখম হয়েছেন, জরিমানা দিয়েছেন, তার জন্যে আমরা সকলেই খুব দুঃখিত— কি বলেন গাঙুলী মশায়? কুমার সাহেবকে বধ করে আপনি ভালই করেছেন, কিন্তু জলদ রায়কে মরতে দিলেন কেন? সে কলকাতায় ফিরে এল, হেলেনা আহার নিদ্রা ত্যাগ করে সেবা করলে, জলদ সেরে উঠল, তার পর ক্ষমাঘেন্না করে দুজনে মিলে মিশে সুখে ঘরকান্না করতে লাগল—এইরকম হলে আরও ভাল হত না কি?
—আপনি কি বলতে চান আমি একটা গল্প বানিয়ে বলেছি? আপনারা দেখছি অতি নিষ্ঠুর বেদরদী লোক।
মোগলসরাই এসে পড়ল। মাখন মল্লিক তাঁর বিছানার বাণ্ডিলটা ধপ করে প্লাটফর্মে ফেললেন এবং সুটকেসটি হাতে নিয়ে নেমে পড়ে বললেন, অন্য কামরায় যাচ্ছি, নমস্কার।
কৈলাস গাঙুলী বললেন, ভদ্রলোককে তোমরা শুধু শুধু চটিয়ে দিলে। আহা, চোট খেয়ে বেচারার মাথা গুলিয়ে গেছে।
১৩৬০ (১৯৫৩)