অগস্ত্যদ্বার
পঞ্চাশ—ষাট বছর আগে পাটনায় ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়ি ছিল। পুরনো শহরের গুলজারবাগ মহল্লা থেকে বাঁকিপুরের জজ—আদালত পর্যন্ত সিংগল লাইনে গাড়ি চলত। দুদিক থেকে যাতায়াতের বাধা যাতে না হয় তার জন্য এক মাইল অন্তর লুপ ছিল, অর্থাৎ লাইন থেকে একটা শাখা বেরিয়ে বিশ—পঁচিশ গজ দূরে আবার লাইনের সঙ্গে মিশত। প্রত্যেক গাড়ি লুপের কাছে এসে থামত এবং উলটো দিকের গাড়ি এলে লুপে গিয়ে পথ ছেড়ে দিত। কিন্তু সব সময় এই ব্যবস্থায় কাজ হত না। একটা গাড়ি লুপের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে, আধ ঘণ্টা হয়ে গেল তবু ও দিকের গাড়ির দেখা নেই। যাত্রীরা অধীর হয়ে বললে, চালাও গাড়ি, আর আমরা সবুর করতে পারি না। গাড়ি অগ্রসর হল, কিন্তু আধ মাইল যেতে না যেতে ও দিকের গাড়ি এসে পথরোধ করলে। তখন দুই তরফের গালাগালি শুরু হল। আরে গাধা তুই লুপে সবুর করিস নি কেন? আরে উল্লু তুই এত দেরি করলি কেন? যাত্রীরাও ঝগড়ায় যোগ দিলে, দুই গাড়ির চারটে ঘোড়াও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পা তুলে চিঁহিহি করতে লাগল। তামাশা দেখবার জন্য রাস্তায় লোক জমে গেল, ছোকরার দল হাততালি দিয়ে চেঁচাতে লাগল— হী লব লব লব। অবশেষে একজন যাত্রী বললে, ঝগড়া এখন থাক, গাড়ি চালাবার ব্যবস্থা কর। তখন দুই গাড়ির ঘোড়া খুলে পিছনে জোতা হল, এই গাড়ির যাত্রীরা ও গাড়িতে উঠল দুই গাড়িই যেখান থেকে এসেছিল সেখানে ফিরে চলল। গাড়ি বদলের ফলে যাত্রীরাও তাদের গন্তব্য স্থানে পৌঁছে গেল।
এই ধরনের কিন্তু অতি গুরুতর একটা বিভ্রাট পুরাকালে ঘটেছিল। তারই ইতিহাস এখন বলছি।
একদা সত্যযুগে বিন্ধ্য গিরির অহংকার হয়েছিল, চন্দ্র—সূর্যের পথরোধ করবার জন্য সে ক্রমশ উঁচু হতে লাগল। তখন অগস্ত্য মুনি এসে তাকে বললেন, আমি দক্ষিণে যাত্রা করব, আমাকে পথ দাও। বিন্ধ্য বিদীর্ণ হয়ে একটি সংকীর্ণ পথ করে দিলে, যার নাম অগস্ত্যদ্বার। সেই গিরিসংকটের ওপারে গিয়ে বিন্ধ্যের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে অগস্ত্য বললেন, বৎস বিন্ধ্য, এ হচ্ছে কি, তুমি যে বাঁকা হয়ে বাড়ছ, ওলন ঠিক নেই, কোন দিন হুড়মুড় করে পড়ে যাবে। আমি ফিরে এসে শিখিয়ে দেব কি করে খাড়া হয়ে বাড়তে হয়, ততদিন তুমি উঁচু হয়ো না। বিন্ধ্য বললে, যে আজ্ঞে। তারপর অনেক কাল কেটে গেল কিন্তু অগস্ত্য ফিরলেন না। তখন বিন্ধ্য রেগে গিয়ে শাপ দিলে, এই অগস্ত্যদ্বারে যারা দু দিক থেকে মুখোমুখি প্রবেশ করবে তাদের বুদ্ধিভ্রংশ হবে। শাপের কথা একজন শিষ্যের মুখে শুনে অগস্ত্য বললেন, ভয় নেই, কিছুদিন পরেই বুদ্ধি ফিরে আসবে।
উক্ত পৌরাণিক ঘটনার বহু কাল পরের কথা বলছি। তখনও বিন্ধ্য পর্বতের নিকটবর্তী স্থান নিবিড় অরণ্যে আচ্ছন্ন, সেখানে লোকালয় ছিল না, কোনও রাজার শাসনও ছিল না। এই বিশাল নো ম্যানস ল্যাণ্ডের উত্তরে কলিঞ্জর রাজ্য। কলিঞ্জরের দক্ষিণে অরণ্য, তারপর দুর্লঙ্ঘ বিন্ধ্য গিরি, তারপর আবার অরণ্য, তারপর বিদর্ভ রাজ্য। কলিঞ্জরের রাজা কনকবর্মা আর বিদর্ভের রাজা বিশাখসেন দুজনেই তেজস্বী যুবক। তাঁদের মহিষীরা মামাতো—পিসতুতো ভগ্নী।
কলিঞ্জরপতি কনকবর্মা তাঁর রাজ্যের দক্ষিণস্থ বনে মাঝে মাঝে মৃগয়া করতে যেতেন। একদিন তাঁর ইচ্ছা হল বিন্ধ্য গিরি অতিক্রম করে আরও দক্ষিণে গিয়ে শম্বর হরিণ শিকার করবেন। তিনি তাঁর প্রিয় বয়স্য কহোড়ভট্টের সঙ্গে রথে চড়ে যাত্রা করলেন, পিছনে রথী পদাতিক গজারোহী অশ্বারোহী সৈন্যদল চলল।
দৈবক্রমে ঠিক এই সময়ে বিদর্ভরাজ বিশাখসেনেরও ইচ্ছা হল বিন্ধ্য পর্বত্যের উত্তরবর্তী অরণ্যে গিয়ে ব্যাঘ্রভল্লুকাদি বধ করবেন। তিনি তাঁর প্রিয় বয়স্য বিড়ঙ্গদেবের সঙ্গে রথারূঢ় হয়ে যাত্রা করলেন, চতুরঙ্গসেনা পিছনে পিছনে গেল।
বিন্ধ্যপর্বতমালা ভেদ করে একটি পথ উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে গেছে। এই পথটি বেশ প্রশস্ত, কিন্তু মাঝামাঝি এক স্থানে পূর্বোক্ত অগস্ত্যদ্বার নামক গিরিসংকট আছে, তা এত সংকীর্ণ যে দুটি রথ পাশাপাশি যেতে পারে না।
কলিঞ্জরপতি কনকবর্মা অগস্ত্যদ্বারের উত্তর প্রান্তে এসে দেখলেন রাজা বিশাখসেন সদলবলে দক্ষিণ প্রান্তে উপস্থিত হয়েছেন। দুই রাজরথ নিকটবর্তী হলে কনকবর্মা বললেন নমস্কার সখা বিশাখসেন, স্বাগতম। বিদর্ভ রাজ্যের সর্বত্র কুশল তো? চতুর্বর্গের প্রজা ও গবাদি পশু বৃদ্ধি পাচ্ছে তো? ধনধান্যের ভাণ্ডার পূর্ণ আছে তো? তোমার মহিষী আমার শ্যালিকা বিংশতিকলা ভাল আছেন তো?
প্রতিনমস্কার করে বিশাখসেন বললেন, অহো কি সৌভাগ্য যে এই দুর্গম পথে প্রিয়সখার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! মহারাজ, তোমার শুভেচ্ছার প্রভাবে আমার রাজ্যের সর্বত্র কুশল। কলিঞ্জর রাজ্যের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল তো? তোমার মহিষী আমার শ্যালিকা কম্বুকঙ্কণা ভাল আছেন? সখা, এখন দয়া করে পথ ছেড়ে দাও, তোমার রথটি এই গিরিসংকটের একটু উত্তরে সরিয়ে রাখ। আমি সসৈন্যে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যাই, তারপর তুমি তোমার সেনা নিয়ে অভীষ্ট স্থানে যাত্রা ক’রো।
কনকবর্মা মাথা নেড়ে বললেন, তা হতেই পারে না, আমি তোমার চাইতে বয়সে বড়, আমার অশ্ব—রথ—গজাদিও বেশী, অতএব পথের অগ্রাধিকার আমারই। তুমিই একটু দক্ষিণে হটে গিয়ে আমাকে পথ ছেড়ে দাও।
বিশাখসেন বললেন, অন্যায় বলছ সখা। তুমি বয়সে একটু বড় হতে পার, তোমার অশ্ব—গজাদিও প্রচুর থাকতে পারে, কিন্তু আমার বিদর্ভ রাজ্য অতি সমৃদ্ধ ও বিশাল, তার মধ্যে চারটে কলিঞ্জরের স্থান হয়। অতএব তুমিই আমাকে পথ দাও।
অনেকক্ষণ এই রকম তর্কবিতর্ক চলল। তারপর কনকবর্মা বললেন, ওহে বিশাখসেন তোমার বড়ই স্পর্ধা হয়েছে। এই শরাসন স্পর্শ করে শপথ করছি, কিছুতেই তোমাকে আগে যেতে দেব না, তোমার পূর্বেই আমি দক্ষিণে অগ্রসর হব। যখন মিষ্টবাক্যে বিবাদের মীমাংসা হল না তখন যুদ্ধই করা যাক। এই বলে তিনি তাঁর ধনুতে শরসন্ধান করলেন।
বিশাখসেন বললেন, ওহে কনকবর্মা, আমিও শপথ করছি, বাহুবলে আমার পথ করে নেব, তোমার পূর্বেই আমি উত্তর দিকে যাত্রা করব। এই বলে তিনি ধনুতে শরযোজনা করে জ্যাকর্ষণ করলেন।
তখন দুই রাজবয়স্য কহোড়ভট্ট আর বিড়ঙ্গদেব একযোগে হাত তুলে উচ্চ কণ্ঠে বললেন, ভো নৃপতিযুগল, থামুন থামুন। মনে নেই, গত বৎসর মকরসংক্রান্তির দিনে আপনারা নর্মদায় স্নানের পর অগ্নিসাক্ষী করে মৈত্রীবন্ধন করেছিলেন? অপি চ, তখন উষ্ণীষ বিনিময় করে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে কিছুতেই আপনাদের সৌহার্দ ক্ষুণ্ণ হতে দেবেন না।
কনকবর্মা গালে হাত দিয়ে বললেন, হুঁ, ওই রকম একটা প্রতিজ্ঞা করা গিয়েছিল বটে!
বিশাখসেন বললেন, হুঁ, আমারও সে কথা মনে পড়েছে। তাই তো! এখন কি করা যায়? এক দিকে সৌহার্দরক্ষার প্রতিজ্ঞা, আর এক দিকে অগ্রযাত্রার শপথ। দুটোই বজায় থাকে কি করে? মহারাজ কনকবর্মা, তোমার মুখ্যমন্ত্রীকে সংবাদ পাঠাও, তিনি এখনই এখানে চলে আসুন। আমিও আমার মহামন্ত্রীকে আনাচ্ছি। দুই মন্ত্রী যুক্তি করে এমন একটা উপায় স্থির করুন যাতে আমাদের প্রতিজ্ঞা আর শপথ রক্ষিত হয়, মর্যাদারও হানি না হয়।
কনকবর্মা তাঁর এক অশ্বারোহী অনুচরকে বললে, খেটকসিংহ, তুমি এখনই দ্রুতবেগে গিয়ে আমার মুখ্যমন্ত্রীকে ডেকে নিয়ে এস। বিশাখসেন, তুমিও লোক পাঠাও।
কহোড়ভট্ট বললেন, তার কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই, অনর্থক বিলম্ব হবে। আমার পরম বন্ধু মহাপণ্ডিত বিড়ঙ্গদেব এখানে রয়েছেন, আমারও বিদ্যাবুদ্ধির প্রচুর খ্যাতি আছে। আমরা দুজনেই রাজবয়স্য। ঠিক মন্ত্রী না হই, উপমন্ত্রী তো বটেই। পত্নীর স্থান অন্তঃপুরে, পথে তিনি বিবর্জিতা, উপপত্নীই প্রবাসসঙ্গিনী হয়ে থাকে। তদ্রূপ মন্ত্রীর স্থান রাজধানীতে, কিন্তু পর্যটনে ও ব্যসনে উপমন্ত্রীই সহায়। আমরাই মন্ত্রণা করে কিংকর্তব্য স্থির করতে পারব।
দুই রাজা বললেন, উত্তম কথা, তাই কর। কিন্তু বিলম্ব না হয়, বেলা পড়ে আসছে।
কহোড় আর বিড়ঙ্গ রথ থেকে নেমে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন, তার পর একটি শিলাপট্টে বসে মন্ত্রণা করতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পরে কহোড় বললেন, হে নরপতিদ্বয়, শুনতে আজ্ঞা হোক। আমরা দুই বন্ধুতে মিলে আপনাদের সমস্যার একটি উত্তম সমাধান স্থির করেছি, তাতে সৌহার্দের প্রতিজ্ঞা, অগ্রযাত্রার শপথ, এবং উভয়ের মর্যাদা সমস্তই রক্ষা পাবে।
উদগ্রীব হয়ে দুই রাজা বললেন, কি প্রকার সমাধান?
কহোড় বললেন, মহারাজ কনকবর্মা! আপনি রাজধানী থেকে এক দল নিপুণ খনক আনান, তারা অগস্ত্যদ্বারের তলা দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ খনন করুক। সেই সুড়ঙ্গপথে আপনি দক্ষিণ দিকে এবং উপরের পথে বিদর্ভরাজ বিশাখসেন উত্তরদিকে একই মুহূর্তে যাত্রা করবেন।
বিশাখসেন বললেন, যুক্তি মন্দ নয়। কিন্তু পবর্তের নীচে সুড়ঙ্গ করতে অন্তত এক বৎসর লাগবে। তত দিন আমরা কি করব? রথ থেকে আমি কিছুতেই নামব না তা বলে দিচ্ছি।
কহোড় বললেন, নামবেন কেন। রথে আরূঢ় থেকেই একটু কষ্ট করে এক বৎসর কাটিয়ে দেবেন, ওখানেই শৌচ—স্নানাদি পান—ভোজনাদি অক্ষক্রীড়াদি করবেন, ওখানেই নিদ্রা যাবেন। রাজধানী থেকে নর্তকীদের আনিয়ে নিন, তারা নৃত্যগীত করে আপনাদের চিত্তবিনোদন করবে।
কনকবর্মা বললেন, সুড়ঙ্গ টুড়ঙ্গ চলবে না। বিশাখসেন উপর দিয়ে যাবেন আর আমি মূষিকের ন্যায় তাঁর নীচে দিয়ে যাব এ হতে পারে না।
বিড়ঙ্গ বললেন, মহারাজ কনকবর্মা, আর এক উপায় আছে। আপনি কুবেরের আরাধনা করুন যাতে তিনি তুষ্ট হয়ে কিছুক্ষণের জন্য তার পুষ্পক বিমানটি পাঠিয়ে দেন। সেই বিমানে আপনি আকাশমার্গে দক্ষিণ দিকে যাবেন এবং বিদর্ভরাজ গিরিসংকট দিয়ে উত্তর দিকে যাবেন।
বিশাখসেন বললেন, উনি আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাবেন তা হতেই পারে না। তোমরা দুজনেই অত্যন্ত মূর্খ, সমস্যার সামাধান তোমাদের কর্ম নয়।
বিড়ঙ্গ বললেন, মহারাজ, ধৈর্য ধরুন আমরা আর এক বার মন্ত্রণা করছি।
দুই রাজবয়স্য আবার মন্ত্রণায় নিবিষ্ট হলেন, দুই রাজা অধীর হয়ে রথের উপর তাঁদের ধনুক ঠুকতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে কহোড় বললেন, হে নৃপতিযুগল, এবারে আমরা একটি অতি সাধু বিচিত্র ও যশস্কর সমাধান আবিষ্কার করেছি।
কনকবর্মা বললেন, বলে ফেল।
কহোড় বললেন, প্রথমে আপনাদের দুই রথের ঘোড়া খুলে ফেলা হবে, তা হলে সংকীর্ণ স্থানেও অনায়াসে রথ ঘোরানো যাবে। ঘোরাবার পর আবার ঘোড়া জোতা হবে, তখন দুই রথের মুখ বিপরীত দিকে থাকবে।
বিশাখসেন সক্রোধে বললেন, আমরা পরাঙমুখ হয়ে নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে যাব এই তুমি বলতে চাও?
—না না মহারাজ, ফিরবেন কেন? ঘোরাবার পর দুই রথ একটু পশ্চাতে সরে আসবে যাতে ঠেকাঠেকি হয়। তার পর মহারাজ কনকবর্মা পিছন দিক থেকে পা বাড়িয়ে টুপ করে বিদর্ভরাজের রথে উঠবেন এবং বিদর্ভরাজ কলিঞ্জরপতির রথে উঠবেন।
দুই রাজা সমস্বরে বললেন, তার পর, তার পর?
—রথ বদলের পর আর কোনও ভাবনা নেই। আপনারা যুগপৎ বিপরীত দিকে অর্থাৎ আপনাদের অভীষ্ট মার্গে যাত্রা করবেন।
কনকবর্মা প্রশ্ন করলেন, কিন্তু আমাদের চতুরঙ্গ সৈন্যদলের কি হবে?
—তাদেরও বদল হবে। আপনার আগে আগে বিদর্ভসেনা এবং মহারাজ বিশাখসেনের আগে আগে কলিঞ্জরসেনা যাবে। তারা মুখ ঘুরিয়ে নেবে।
কনকবর্মা বললেন, সখা, সম্মত আছ?
বিশাখসেন বললেন, আমার সেনা তোমার হবে এবং তোমার সেনা আমার হবে এতে আপত্তি করবার কিছু নেই। কিন্তু বেলা যে শেষ হয়ে এল, মৃগয়া কখন করব?
কহোড় বললেন, আজ মৃগয়া নাই করলেন মহারাজ। আজ আপনাদের প্রতিজ্ঞা আর শপথ রক্ষিত হক, মৃগয়া এর পরে এক দিন করবেন।
বিশাখসেন বললেন, কিন্তু আজ যেতে যেতেই তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে, আমাদের অভিযানের শেষ হবে কোথায়? ফিরব কখন?
কহোড় বললেন, ফিরবেন কেন? কিচ্ছু ভাববেন না, সবই আমরা স্থির করে ফেলেছি। আপনাদের রাজ্যেরও বিনিময় হবে। মহারাজ কনকবর্মা বিদর্ভসেনার সঙ্গে যাত্রা করে বিদর্ভরাজ্যে অধিষ্ঠিত হবেন, এবং মহারাজ বিশাখসেন কলিঞ্জরসেনার সঙ্গে গিয়ে কলিঞ্জর সিংহাসন অধিকার করবেন।
কিছু কাল স্তব্ধ হয়ে থাকার পর কনকবর্মা বললেন, অতি জটিল ব্যবস্থা। আমাদের পিতৃপিতামহের রাজ্য হস্তান্তরিত হবে এ যে বড় বিশ্রী কথা।
কহোড় বললেন, মহারাজ, ক্ষত্রিয় নৃপতির প্রধান কর্তব্য প্রতিজ্ঞা, শপথ আর আত্মমর্যাদা রক্ষা, তার জন্য যদি রাজ্য বা প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় তাও শ্রেয়। কিন্তু আমাদের ব্যবস্থায় আপনাদের রাজ্যনাশ বা প্রাণনাশ কিছুই হচ্ছে না, এক রাজ্যের পরিবর্তে আর এক রাজ্য পাচ্ছেন।
কনকবর্মা বললেন, এই বারে বুঝেছি, সখা, তুমি সম্মত আছ?
বিশাখসেন বললেন, অন্য উপায় তো দেখছি না। বেশ, তাই হোক।
সেকালের রথ কতকটা একালের এক্কার মতন। দুটি মাত্র চাকা, হালকা গড়ন, বেশী জায়গা নিত না। সারথি সামনে বসত, তার পাশে বা পিছনে রথী বসতেন। দুই রাজার আদেশে রথের ঘোড়া খুলে ফেলা হল। বোম খাড়া করে তুলে সেই সংকীর্ণ স্থানে সহজেই রথ ঘোরানো গেল। তারপর আবার ঘোড়া জোতা হল। একটু পিছনে হটাতেই দুই রথের পিছন দিক ঠেকে গেল, তখন রাজারা না থেমেই এক রথ থেকে অন্য রথে উঠলেন। দুই রাজবয়স্যও নিজ নিজ প্রভুর পশ্চাতে বসলেন।
অনন্তর কনকবর্মা পিছনে ফিরে বললেন, হে কলিঞ্জর সৈন্যগণ, ব্যাবর্তধ্বম (অর্থাৎ right about turn)। এখন থেকে তোমরা মহারাজ বিশাখসেনের অধীন, উনি তোমাদের সঙ্গে গিয়ে কলিঞ্জর রাজ্য অধিকার করবেন। আমিও বিদর্ভসেনার সঙ্গে গিয়ে বিদর্ভ রাজ্য অধিকার করব।
বিশাখসেনও অনুরূপ ঘোষণা করলেন।
সৈন্যরা অতি সুবোধ, সমস্বরে বললে, রাজাদেশ শিরোধার্য। তারপর কনকবর্মা আর বিশাখসেন একযোগে আজ্ঞা দিলেন, গম্যতাম (অর্থাৎ march)। বিদর্ভসেনা বিদর্ভের দিকে চলল, কনকবর্মার রথ তাদের পিছনে গেল। কলিঞ্জরসেনা কলিঞ্জরে ফিরে চলল, বিশাখসেনের রথ তাদের পিছনে গেল।
যেতে যেতে কনকবর্মা তাঁর বয়স্যকে বললেন, কাজটা কি ভাল হল? রাজ্য বদলের ফলে বিশাখসেনের লাভ আর আমার ক্ষতি হবে। আমার মহিষী তার মহিষীর চাইতে ঢের বেশী সুন্দরী।
কহোড় বললেন, মহারাজ, আপনি যে লোকবাহ্য কথা বলছেন, পরস্ত্রীকেই লোকে বেশী সুন্দরী মনে করে। সর্ব বিষয়ে আপনারই লাভ অধিক হবে। বিদর্ভমহিষী পুত্রবতী, কিন্তু আপনার মহিষী এখনও অনপত্যা। বিদর্ভরাজ্যের ধনভাণ্ডারও অতি বিশাল। ওখানকার অধিপতি হয়ে আপনি ধনে পুত্রে লক্ষ্মীলাভ করবেন।
কনকবর্মা যখন বিদর্ভরাজ্যে পৌঁছলেন তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাঁর আদেশে কয়েক জন অশ্বারোহী আগেই রাজধানীতে গিয়ে সংবাদ দিয়েছিল যে রাজ্য বদল হয়ে গেছে, নূতন রাজা আসছেন। কনকবর্মা দেখলেন, তাঁর সংবর্ধনার কোনও আয়োজন হয় নি, পথে আলোকসজ্জা নেই, শাঁখ বাজছে না, হুলুধ্বনি হচ্ছে না, কেউ লাজবর্ষণও করছে না। তিনি অপ্রসন্ন মনে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে রথ থেকে নামলেন। কয়েকজন রাজপুরুষ নীরবে নমস্কার করে তাঁকে সভাগৃহে নিয়ে গেল, কহোড়ভট্টও সঙ্গে সঙ্গে গেলেন।
বিদর্ভরাজমহিষী বিংশতিকলা গম্ভীরমুখে সিংহাসনে বসে আছেন। তাঁকে অভিবাদন করে কনকবর্মা বললেন, পট্টমহিষী, ভাল আছেন তো? পাঁচ বৎসর পূর্বে আপনার বিবাহসভায় আপনাকে তন্বী দেখেছিলাম। এখন আপনি একটু স্থূলাঙ্গী হয়ে পড়েছেন, তাতে আপনার রূপ ষোল কলা পেরিয়ে কুড়ি কলায় পৌঁছে গেছে। সকল সমাচার শুনেছেন বোধ হয়। এখন আমিই এই বিদর্ভরাজ্যের অধিপতি, অভিষেকের ব্যবস্থা কাল হবে। আমি আর আমার বয়স্য এই কহোড়ভট্ট অত্যন্ত শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়েছি, আজ ক্ষমা করুন, কাল আপনার সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপ করব। এখন আমাদের বিশ্রামাগার দেখিয়ে দিন এবং সত্বর আহারের ব্যবস্থা করুন।
একজন সশস্ত্র রাজপুরুষকে সম্বোধন করে মহিষী বিংশতিকলা বললেন, ওহে কোষ্ঠপাল, এই ধৃষ্ট নির্বোধ রাজা আর তার সহচরকে কারাগারে নিক্ষেপ কর। এদের শয়নের জন্য কিছু খড় আর ভোজনের জন্য প্রত্যেককে এক সরা ছাতু আর এক ভাঁড় জল দিও।
কহোড়ভট্ট করজোড়ে বললেন, সে কি রানী—মা, আমাদের এই পরমভট্টারক শ্রীশ্রীমহারাজ আপনার ভগ্নীপতি তো বটেনই, এখন বিদর্ভপতি হয়ে অধিকন্তু আপনার পতিও হয়েছেন। একে ছাতু খাওয়াবেন কি করে? ইনি নিত্য নানা প্রকার চর্ব্য চূষ্য লেহ্য পেয় আহার করে থাকেন।
বিংশতিকলা বললেন, তাই হবে। ওহে কোষ্ঠপাল, এই রাজমূর্খকে দু মুটো ছোলা, এক ছড়া তেঁতুল, একটু গুড়, আর এক ভাঁড় ঘোল দিও। ছোলা চিবুবে, তেঁতুল চুষবে, গুড় চাটবে, আর ঘোলের ভাঁড়ে চুমুক দেবে।
কোষ্ঠপাল বললেন, যথা আজ্ঞা মহাদেবী। আরক্ষিগণ, এদের কারাগারে নিয়ে চল।
কনকবর্মা হতভম্ব হয়ে নীরবে কারাগৃহে গেলেন এবং ক্লান্তদেহে বিষণ্ণ মনে রাত্রিযাপন করলেন। পরদিন প্রাতঃকালে তিনি বললেন, ওহে পণ্ডিতমূর্খ কহোড়, তোমাদের মন্ত্রণা শুনেই আমার এই দুর্দশা হল। এই শত্রুপুরী থেকে উদ্ধার পাব কি করে?
কহোড় বললেন, মহারাজ, ভাববেন না। আমি সারা রাত চিন্তা করে উপায় নির্ধারণ করেছি।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কনকবর্মা বললেন, তোমার উপর আর ভরসা নেই। বিশাখসেন কেমন আছেন কে জানে, তিনি হয়তো কলিঞ্জর রাজ্যে খুব সুখে আছেন।
কহোড় বললেন, মনেও ভাববেন না তা। আমাদের মহাদেবী কম্বুকঙ্গণাও বড় কম যান না।
এই সময় একজন প্রহরী কারাকক্ষে এসে বললেন, আপনারা শৌচস্থানাদির জন্য ওই প্রাচীরবেষ্টিত উপবনে যেতে পারেন।
কহোড় বললেন, বৎস প্রহরী, শৌচাদি এখন মাথায় থাকুক, একবার রানীমার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দাও, মহারাজ তোমাকে পুরস্কার দেবেন।
প্রহরী বললে, আসুন আমার সঙ্গে।
রাজমহিষী বিংশতিকলার কাছে এসে কহোড় কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, মহাদেবী, ঢের হয়েছে, আমাদের মুক্তি দিন, ফিরে গিয়েই বিদর্ভরাজ বিশাখসেনকে পাঠিয়ে দেব।
মহিষী বললেন, আগে তিনি আসুন, তার পর তোমাদের মুক্তির বিষয় বিবেচনা করা যাবে।
—তবে কেবল আমাকে মুক্তি দিন, আমি কলিঞ্জরে গিয়ে বদলা—বদলির ব্যবস্থা করব।
বেশ, তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, যাতায়াতের জন্য একটা রথও দিচ্ছি। কিন্তু যদি সাত দিনের মধ্যে ফিরে না এস তবে তোমার প্রভুকে শূলে দেব।
কহোড়ভট্ট রথে চড়ে যাত্রা করলেন। এই সময় বিড়ঙ্গদেবও বিশাখসেনের দূত হয়ে বিদর্ভরাজ্যে আসছিলেন। মধ্যপথে দুই বন্ধুতে দেখা হয়ে গেল। কুশলপ্রশ্নের পর দুজনে অনেকক্ষণ মন্ত্রণা করলেন, তার পর যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানে ফিরে গেলেন।
বিদর্ভরাজমহিষী বিংশতিকলাকে কহোড় বললেন, মহাদেবী, আমার প্রিয়বন্ধু বিড়ঙ্গদেবের সঙ্গে মন্ত্রণা করে এই ব্যবস্থা করেছি যে কাল প্রাতঃকালে মহারাজ বিশাখসেন কলিঞ্জর থেকে বিদর্ভ রাজ্যে যাত্রা করবেন, এবং এখান থেকে মহারাজ কনকবর্মাও কলিঞ্জরে যাত্রা করবেন। যত ইচ্ছা রক্ষী সৈন্য আমাদের সঙ্গে দেবেন। অগস্ত্যদ্বারে উপস্থিত হয়ে যদি তারা দেখে যে মহারাজ আসেন নি, তবে আমাদের ফিরিয়ে আনবে।
মহিষী বললেন, ফিরিয়ে এনেই তোমাদের শূলে চড়াবে। বেশ, তোমার প্রস্তবে সম্মত আছি, কাল প্রভাতে যাত্রা ক’রো।
পরদিন প্রাতঃকালে কনকবর্মা ও কহোড়ভট্ট রথে চড়ে যাত্রা করলেন, এক দল অশ্বারোহী সৈন্য তাঁদের সঙ্গে গেল। অগস্ত্যদ্বারের দক্ষিণ মুখে এসে কনকবর্মা দেখলেন, বিশাখসেন ও বিড়ঙ্গদেবও উত্তর মুখে উপস্থিত হয়েছেন।
উল্লসিত হয়ে বিশাখসেন বললেন, সখা কনকবর্মা, আমার বিদর্ভ রাজ্যে সুখে ছিলে তো?
এত রোগা হয়ে গেছ কেন? তোমার সেবার ত্রুটি হয় নি তো?
কনকবর্মা বললেন, কোনও ত্রুটি হয় নি, তোমার মহিষী বিংশতিকলা যেমন রসিকা তেমনি গুণবতী। উঃ, কি যত্নই করেছেন! কিন্তু তোমাকেও তো বায়ুভুক তপস্বীর মতন দেখাচ্ছে। আমার কলিঞ্জর রাজ্যে তোমার যথোচিত সৎকার হয়েছিল তো?
অট্টহাস্য করে বিশাখসেন বললেন, সখা, আশ্বস্ত হও, সৎকারের কোনও ত্রুটি হয় নি। তোমার মহিষী কম্বুকঙ্কণাও কম রসিকা আর গুণবতী নন, তিনি আমাকে বিচিত্র চর্ব্য চুষ্য লেহ্য পেয় খাইয়েছেন। কিছুতেই ছাড়বেন না, তাঁকে অনেক সান্ত্বনা দিয়ে তবে চলে আসতে পেরেছি। যাক সে কথা। আমরা এই অগস্ত্যদ্বারে আবার মুখোমুখি হয়েছি। কে আগে যাত্রা করবে?
কহোড়ভট্ট আর বিড়ঙ্গদেব বললেন, দোহাই মহারাজ, আর বিবাদ করবেন না, আপনাদের যাত্রার ব্যবস্থা আমরাই করে দিচ্ছি। ওহে সারথিদ্বয়, তোমরা ঠিক গত বারের মতন রথ ঘুরিয়ে ফেল।…হয়েছে তো?…মহারাজ কনকবর্মা, এখন আপনি এ রথ থেকে ও রথে উঠুন। মহারাজ বিশাখসেন, আপনিও ও রথ থেকে এ রথে আসুন। মহামুনি অগস্ত্যের প্রসাদে এবং এই কহোড়—বিড়ঙ্গের বুদ্ধিবলে আপনারা সংকটমুক্ত হয়েছেন, আপনাদের প্রতিজ্ঞা শপথ মর্যাদা রাজ্য প্রাণ আর ভার্যা সবই রক্ষা পেয়েছে। এখন আর বিলম্ব নয়, দুই রথ যুগপৎ দুই দিকে শুভযাত্রা করুক।
১৩৫৯(১৯৫২)