কৃষ্ণকলি
সকাল বেলা বেড়াতে বেরিয়েছি। রাস্তার ধারে একটা ফুলুরির দোকানের দাওয়ায় তিন—চার বছরের দুটি মেয়ে বসে আছে। একটি মেয়ে কুচকুচে কালো, কিন্তু সুশ্রী। আর একটি শ্যামবর্ণ, মুখশ্রী মাঝারি রকম। দুজনে আমসত্ত্ব চুষছে।
আমি তাকাচ্ছি দেখে তারা মুখ থেকে আমসত্ত্ব বার করে আমার দিকে এগিয়ে ধরলো। বোধ হয় লোভ দেখাবার জন্য। বললুম, কি চুষছ খুকী?
কালো মেয়েটি উত্তর দিলো, বল দিকি নি কি?
—চটি জুতোর সুকতলা।
—হি হি হি, এ বাবুটা কিছু জানে না, আমসত্ত্বকে বলছে সুকতলা!
অন্য মেয়েটি বললে, হি হি হি, বোকা বাবু রে!
তার পর প্রায় চার বৎসর কেটে গেছে। সকাল বেলা বাড়ি থেকে বেরুবার উপক্রম করছি, একটি মেয়ে এসে বললে, একটু দুব্বো দেবে গা দাদু? বিশ্বকম্মা পুজো হবে।
দেখেই চিনেছি এ সেই আমসত্ত্ব—চোষা কালো মেয়ে, এখন এর বয়স বোধ হয় আট বছর। বললুম, যত খুশি দুব্বো নাও না।
মেয়েটির সাজ দেখবার মতন। সদ্য স্নান করে এসেছে, এলো চুল পিঠের ওপর ছড়ানো। একটি ফরসা লালপেড়ে শাড়ি কোমরে জড়িয়েছে। গা খোলা, কিন্তু আঁচলের এক দিক মাথায় দেবার চেষ্টা করছে আর বার বার তা খসে পড়ছে। গোল গোল দুই হাত যেন কষ্টি পাথরে কোঁদা, তাতে ঝকঝকে রুপোর চুড়ি আর অনন্ত, কোমরে রুপোর গোট, গলায় লাল পলার মালা, পায়ে আলতা, হাতে আলতা, সিঁথিতে সিঁদুর। জিজ্ঞাসা করলুম একি খুকী, বিয়ে করলে কবে?
মাথার ওপর কাপড় টেনে খুকী বললে, খুকী ব’লো নি বাবু, এখন আমি বড় হইছি। আমার নাম কেলিন্দী।
আমি বললুম, কেলিন্দী নয়, কালিন্দী। কিন্তু তোমার আরও ভাল নাম আছে, কৃষ্ণকলি। রবি ঠাকুর তোমাকে দেখে লিখেছেন—কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।…কালো? তা সে যতই কালো হ’ক, দেখেছি তার কালো হরিণ—চোখ। কৃষ্ণকলি নাম তোমার পছন্দ হয়?
কালিন্দী ঘাড় দুলিয়ে জানালে যে খুব পছন্দ হয়।
—তোমার বিয়ে হল কবে?
—সেই অঘ্রান মাসে।
—শ্বশুরবাড়ি কোথায়? বরের নাম কি?
—ধেৎ, বরের নাম বুঝি বলতে আছে! শ্বশুরঘর হুই হোথাকে, ছুতোর বউ মুড়িউলীর দোকানে। দাদু ওই রাঙা ফুল দুটো দাও না, মা পুজো করবে।
চাকরকে বললুম, নিতাই গোটাকতক রঙ্গন ফুল পেড়ে দাও।
মুখ বেঁকিয়ে সাদা দাঁত বার করে কৃষ্ণকলি বললে, এ ম্যা গে, ও তো নোংরা পেণ্টু পরে আছে, সাত জন্ম কাচে নি। তুমি ফুল পেড়ে দাও।
—আমিও তো নোংরা, এখনও স্নান করি নি, কাপড় ছাড়ি নি। আচ্ছা এক কাজ করা যাক, নিতাই তোমাকে আলগোছে তুলে ধরুক, ও ফুল ছোঁবে না, তুমি নিজের হাতে পেড়ে নাও।
—কি বলচ গা দাদু, আমার যে বে হয়ে গেছে।
বুঝলুম, পরপুরুষের স্পর্শে কৃষ্ণকলির আপত্তি আছে। বললুম, তবে তোমার বরকে ডেকে আন, সেই তোমাকে তুলে ধরুক।
—সে তুলতে লারবেক। তুমিই আমাকে তুলে ধর না, আমি ফুল পেড়ে নেব।
—সেকি কৃষ্ণকলি, তোমার যে বিয়ে হয়ে গেছে। আমি তোমাকে তুলে ধরব কি করে?
—তুমি তো বুড়ো থুবড়ো।
ঠিক কথা, এতক্ষণ আমার হুঁশ ছিল না যে আমি বুড়ো থুবড়ো, সমস্ত অবলা জাতি আমার কাছে অভয় পেয়েছে। বললুম, আমার হাতে যে বাতের ব্যথা, তোমাকে তোলবার তো শক্তি নেই।
—বাড়িতে আঁকশি নেই?
আমার লাঠির ডগায় একটা ছুরি বেঁধে আঁকশি করা হল। নিতাই তাই দিয়ে গোটাকতক ফুল পাড়লে, কৃষ্ণকলি মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলে।
ফুল—দুব্বো নিয়ে সে চলে যাবার উপক্রম করছে, আমি তাকে বললুম, কৃষ্ণকলি, বিস্কুট খাবে?
—উঁহু।
—মাখন দেওয়া পাঁউরুটি আর মিষ্টি কুলের আচার?
কৃষ্ণকলির মুখ দেখে মনে হল তার রুচি আছে, কিন্তু সংস্কারে বাধছে। বললে, আজ খেতে নেই, বিশ্বকম্মা পূজো। সোঁসা আছে?
—আছে বোধ হয়। নিতাই, দেখ তো বাড়িতে শসা আছে কিনা।
শসা পবিত্র ফল, তাতে কৃষ্ণকলির আপত্তি নেই। নিতাই দুটো শসা এনে আলগোছে তার আঁচলে দিলে। আমি বললুম, কৃষ্ণকলি, তুমি এই অল্প বয়সে বিয়ে করে ফেলেছ, টের পেলে পুলিসে যে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে।
—ইশ, নিয়ে গেলেই হল কিনা! আমি তো বে করি নি, বে করেছে রেমো। সেই তো মন্তর পড়লে, আমি চুপটি করে বসেছিনু। রেমোর বাবার গায়ে খুব জোর, বলেছে পুলিস এলে ভোমর ঘুরিয়ে তাদের পেট ছেঁদা করে দেবে।
—রেমো বুঝি তোমার বর?
কৃষ্ণকলি ওপর নীচে মাথা নাড়লে।
—এই যাঃ, কৃষ্ণকলি, বরের নাম করে ফেললে!
কৃষ্ণকলি লজ্জায় মা—কালীর মতন জিব বার করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, বলে ফেলেছ তা হয়েছে কি, আজকাল সব্বাই বরকে নাম ধরে ডাকে।
—সক্কলের সামনে ডাকে?
—আড়ালে ডাকে! নির্মলচন্দ্রের বউ ডাকে—ওরে নিমে, জগদানন্দর বউ ডাকে— এই জগা। দিন কতক পরে মেমদের মতন সক্কলের সামনেই ডাকবে।
—আমি যে তোমার সামনে বলে ফেলনু!
—তাতে দোষ হয় নি, আমি বুড়ো লোক কিনা।
এমন সময় একটি ফ্রক—পরা মেয়ে এসে বললে, এই কেলিন্দী, কি করছিস এখেনে, এক্ষুনি আয়, মামী ডাকছে।
এই মেয়েটিই বোধ হয় সেই চার বছর আগে দেখা আমসত্ত্ব—চোষা দ্বিতীয় মেয়ে। কৃষ্ণকলি তাকে বললে, খবদ্দার বিমলি আর কেলিন্দী কইবি নি, রবি ঠাকুর আমার ভাল নাম দিয়েছে কেষ্টকলি। এই দাদু বললে।
মুখভঙ্গী করে দু—হাত নেড়ে বিমলি বললে, মরি মরি, কেলেকিষ্টি কেলিন্দীর নাম আবার কেষ্টকলি! রূপ দেখে আর বাঁচ্চি নে!
কৃষ্ণকলি বললে, দেখ না দাদু, বিমলি আমায় ভেংচি কাটছে।
প্রশ্ন করলুম, বিমলি তোমার কে হয়, বোন নাকি?
—বোন না ঢেঁকি, ও তো আমার পিসতুতো ননদ। বিমলি, তুই যা, আমি একটু পরে যাব।
চলে যেতে যেতে বিমলি বললে, দেখিস এখন, আজ মামী তোকে ছেঁচবে। ওরে আমার কেষ্টকলি, শ্যাওড়া গাছের পেতনী!
কৃষ্ণকলি বললে, দাদু, ও আমায় পেতনী বলবে কেন?
—বলুক গে, ননদরা অমন বলে থাকে, শ্রীরাধার ননদও বলত। এক মেয়ের রূপ আর এক মেয়ে দেখতে পারে না। তোমার বর রেমো তো তোমাকে পেতনী বলে না?
—সেও বলে।
—তুমি রাগ কর না?
—উঁহু, সে হাসতে হাসতে বলে কিনা। আমি তাকে বলি ভূত পিচেশ হনুমান।
—তোমরা ঝগড়া কর নাকি?
—আমি খুব ঝগড়া করি, চিমটিও কাটি, কিন্তু রেমো রাগে না, শুধু মুখ ভেংচায় আর হাসে।
এমন সময় রামের মা এল। সে অনেকদিন থেকে এ বাড়িতে মুড়ি চিঁড়েভাজা দিয়ে আসছে। তার স্বামী মুরারী ছুতোর মিস্ত্রী, ভাল কারিগর, কাঠের ওপর নকসা তোলে। রামের মা কৃষ্ণকলিকে দেখে বললে, ওমা, তুই এখেনে রইছিস, বিমলি যে বললে কেলিন্দী ধিঙ্গী হয়ে হেথা হোথা সেথা চান্দিক ঘুরে বেড়াচ্ছে!
কৃষ্ণকলি বললে, সব মিছে কথা। জান গা মা, এই দাদু বললে রবি ঠাকুর আমার নাম দিয়েছে কেষ্টকলি।
আমি রামের মাকে জিজ্ঞাসা করলুম, এ মেয়েটি তোমার বউ নাকি?
—হেঁ গা বাবা, গেল অঘ্রানে রেমোর সঙ্গে বে দিয়েছি। রেমোর বয়স দশ আর এর আট।
—এত কম বয়সে বিয়ে দিলে? কাজটা যে বেআইনী হয়েছে।
—আইন ফাইন জানি নে বাবা। মেয়েটা হতভাগী, এর মা পাঁচ বছর রোগে ভুগে গেল সন জষ্টি মাসে ম’ল। বাপটা নক্ষীছাড়া, গাজা ভাং খেয়ে গেরুয়া পরে কোথা তারকেশ্বর কোথা ভদ্রেশ্বর টোটো করে ঘুরে বেড়ায়। তাই অনাথা মেয়েটাকে নিজের ঘরে এনে ছেলের সঙ্গে বে দিনু। ওদের ফুলুরির দোকানটাও আমি চালাচ্ছি। আমার তিন মেয়েই তো শ্বশুরঘর করছে, একটা বউ না আনলে কি আমার চলে বাবা? তা কেলিন্দী এখেনে এসে আপনাকে জ্বালাতন করছে বুঝি?
—না না, জ্বালাতন করে নি, একটু গল্প করছিল। তুমি আর একে কেলিন্দী ব’লো না রামের মা, এখন থেকে কৃষ্ণকলি ব’লো।
—হা রে কপাল, আমার খুড়শাশুড়ীর নাম যে ফেষ্টদাসী। ঠাকুর দেবতার নাম কি মুখে আনবার জো আছে বাবা, শ্বশুরবাড়ির গুষ্টি সব নাম দখল করে বসে আছে। দাদাশ্বশুর ছিলেন ফরিদাস, শ্বশুরের নাম ফালিদাস, খুড়শ্বশুর ফ্রীধর, শ্বাশুড়ী ফরস্বতী।
কৃষ্ণকলি বললে, আর তোমার নামটা বলে দিই মা? হি হি হি, ফুগগা ফুগগতিনাশিনী!
আমি বললুম, রামের মা, আদর দিয়ে তুমি বউটির মাথা খেয়েছ, মুখের ওপর তোমাকে ঠাট্টা করে।
রামের মা হেসে বললে, কি করি বাবা, ওর ধরনই ওইরকম। নিজের মায়ের যত্ন আর ক দিন পেয়েছে, জন্ম ইস্তক আমাকেই দেখছে কিনা। যে নতুন নামটি বললেন তার পুরোটি তো বলতে পারব নি, এখন থেকে একে কলি বলব। দেখুন বাবা, এর বন্নটা কালো বটে, কিন্তু খুব ছিরি আছে, ছাঁদটি পরিষ্কার যেন বাটালি দিয়ে গড়া, আর ভারী সতীনক্ষী মেয়ে। বিমলিটা হচ্ছে কুঁদুলি। এখন আসি বাবা। ঘরকে চলরে কলি।
আমি বললুম, কৃষ্ণকলি, তোমার বরকে নিয়ে এক দিন এখানে এসো।
রামের মা বললে, হা আমার কপাল, রেমোর যে বড্ড নজ্জা, বউ—এর সঙ্গে কোথাও যেতে চায় না। আজকালকার ছোঁড়াদের মতন তো নয় যে সোমত্ত বউকে নিয়ে চাদ্দিকে ধেই ধেই নেত্য করে বেড়াবে। রেমোর পরীক্ষেটা চুকে যাক, আমিই একদিন দুটিকে নিয়ে আসব।
কৃষ্ণকলি হাত নেড়ে বললে, সে তোমাকে কিছু করতে হবে নি মা, আমি একাই একাই তাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসব।
আমি বললুম, রামের মা, তোমার ছেলে তো সেকেলে, কিন্তু বউটি যে অত্যন্ত একেলে।
—ওটুকু সেরে যাবে বাবা, একটু বড় হলেই নজ্জা শরম আসবে।
রামের মা তার পুত্রবধূকে নিয়ে চলে গেল। কৃষ্ণকলির কপাল ভাল, আট বছর বয়সেই সে শাশুড়ীর থেকে সতীলক্ষ্মী সার্টিফিকেট আদায় করেছে, এক মা হারিয়ে আর এক মা পেয়েছে, এমন বর পেয়েছে যাকে নির্বিবাদে চিমটি কাটা চলে আর হিড়হিড় করে টেনে আনা যায়।
১৩৫৯ (১৯৫২)