চাঙ্গায়নী সুধা
ক্যালকাটা টি ক্যাবিনের নাম নিশ্চয় আপনাদের জানা আছে, নূতন দিল্লির গোল মার্কেটের পিছনের গলিতে কালীবাবুর সেই বিখ্যাত চায়ের দোকান।
বিজয়াদশমী, সন্ধ্যা সাতটা। পেনশনভোগী বৃদ্ধ রামতারণ মুখুজ্যে, স্কুল মাস্টার কপিল গুপ্ত, ব্যাংকের কেরানী বীরেশ্বর সিংগি, কাগজের রিপোর্টার অতুল হালদার প্রভৃতি নিয়মিত আড্ডাধারীরা সকলেই সমবেত হয়েছেন। বিজয়ার নমস্কার আর আলিঙ্গন যথারীতি সম্পন্ন হয়েছে, এখন জলযোগ চলছে। কালীবাবু আজ বিশেষ ব্যবস্থা করেছেন—চায়ের সঙ্গে চিঁড়ে ভাজা ফুলুরি নিমকি আর গজা।
অতুল হালদার বললেন, আজকের ব্যবস্থা তো কালীবাবু ভালই করেছেন, কিন্তু একটি যে ত্রুটি রয়ে গেছে, কিঞ্চিৎ সিদ্ধির শরবত থাকলেই বিজয়ার অনুষ্ঠানটি সর্বাঙ্গসুন্দর হত।
রামতারণ মুখুজ্যে বললেন, তোমাদের যত সব বেয়াড়া আবদার। চায়ের দোকানে সিদ্ধির শরবত কি রকম? সিদ্ধি হল একটি পবিত্র বস্তু, যার শাস্ত্রীয় নাম ভঙ্গা বা বিজয়া। কালীবাবুর এই দোকান তো পাঁচ ভূতের হাট এখানে সিদ্ধি চলবে না। দেবীর বিসর্জনের পর মঙ্গলঘট আর গুরুজনদের প্রণাম করে শুদ্ধচিত্তে সিদ্ধি খেতে হয়। আমি তো বাড়িতেই একটু খেয়ে নিয়ম রক্ষা করে তবে এখানে এসেছি।
একজন সাধুবাবা টি ক্যাবিনে প্রবেশ করলেন। ছ ফুট লম্বা মজবুত গড়ন, কাঁধ পর্যন্ত ঝোলা চুল, মোটা—গোঁফ, কোদালের মতন কাঁচা—পাকা দাড়ি, কপালে ভস্মের ত্রিপুণ্ড্রক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মাথায় কান—ঢাকা গেরুয়া টুপি, গায়ে গেরুয়া আলখাল্লা, পায়ে গেরুয়া ক্যামবিসের জুতো, হাতে একটি অ্যালুমিনিয়মের প্রকাণ্ড কমণ্ডলু বা হাতলযুক্ত বদনা। আগন্তুক ঘরে এসেই বাজখাঁই গলায় বললেন, নমস্তে মশাইরা, খবর সব ভাল তো?
কপিল গুপ্ত বললেন, আরে বকশী মশাই যে, আসতে আজ্ঞা হ’ক।* দু বছর দেখা নেই, এতদিন ছিলেন কোথায়? ভোল ফিরিয়েছেন দেখছি, সাধু মহারাজ হলেন কবে থেকে? বাঃ, দাড়িটিতে দিব্বি পার্মানেণ্ট ওয়েভ করিয়েছেন। কত খরচ পড়ল?
রামতারণ মুখুজ্যে বললেন, শোন হে জটাধর বকশী, দু’দুবার ঠকিয়ে গেছ, এবার আর তোমার নিস্তার নেই, পুলিশে দেব।
অতুল হালদার বললেন, হুঁ হুঁ বাবা দু—দুবার ঘুঘু তুমি খেয়ে গেছ ধান, এই বার ফাঁদে ফেলে বধিব পরান।
কপিল গুপ্ত বললেন, আহা ভদ্রলোককে একটু হাঁফ ছেড়ে জিরুতে দিন, এঁর সমাচার সব শুনুন, তারপর পুলিস ডাকবেন। ও কালীবাবু, বকশী মশাইকে চা আর খাবার দাও, আমার অ্যাকাউণ্টে।
রবি বর্মার ছবিতে যেমন আছে—মেনকার কোলে শিশু শকুন্তলাকে দেখে বিশ্বামিত্র মুখ ফিরিয়ে হাত নাড়ছেন—সেই রকম ভঙ্গী করে জটাধর বললেন, না না, আর লজ্জা দেবেন না। আপনাদের ঢের খেয়েছি, এখন আমাকেই সেই ঋণ শোধ করতে হবে।
রামতারণ বললেন, তোমার অচলার কি খবর, সেই যাকে বিধবা বিবাহ করেছিলে?
ফোঁস করে একটি সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে জটাধর বললেন, তার কথা আর বলবেন না মুখুজ্যে মশাই, মনে বড় ব্যথা পাই। অচলা তার আগের স্বামী বলহরির সঙ্গেই চলে গেছে। বলহরি তাকে জোর করে নিয়ে গেছে, আমার পঞ্চাশটা টাকাও ছিনিয়ে নিয়েছে, অচলার জন্যে এখান থেকে যে খানকতক চপ নিয়ে গিয়েছিলুম তাও সেই রাক্ষসটা কেড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে।
কপিল গুপ্ত বললেন, যাক, গতস্য অনুশোচনা নাস্তি, এখন আপনার সন্ন্যাসের ইতিহাস বলুন। আহা, লজ্জা করছেন কেন, চা আর খাবার খেতে খেতেই বলুন, আমরা শোনবার জন্যে সবাই উদগ্রীব হয়ে আছি। ওহে কালীবাবু বকশী মশাইকে আরও এক পেয়ালা চা আর এক প্লেট খাবার দাও, গোটা দুই বর্মা চুরুটও দাও, সব আমার খরচায়।
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে জটাধর বললেন, নেহাতই যদি শুনতে চান তো বলছি শুনুন। অচলা চলে যাবার পর মনে একটা দারুণ বৈরাগ্য এল, সংসারে ঘেন্না ধরে গেল। দুত্তোর বলে একটি তীর্থযাত্রী দলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লুম। ঘুরতে ঘুরতে মানস সরোবর কৈলাস পর্বতে এসে পৌঁছুলুম। সেখানে হঠাৎ কানহাইয়া বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাঁর পূর্বনাম কানাই বটব্যাল, খুব বড় সায়েণ্টিস্ট ছিলেন, অনেক রকম কারবারও একাকালে করেছেন। শেষ বয়সে বিবাগী হয়ে হিমালয়ের একটি গুহায় পাঁচটি বৎসর তপস্যা করে সিদ্ধ হয়েছেন। আমার সঙ্গে পূর্বে একটু পরিচয় ছিল, দেখা মাত্র চিনে ফেললেন। তাঁর পা ধরে আমার দুঃখের সব কথা তাঁকে নিবেদন করলুম। কানু ঠাকুর বললেন, ভেবো না জটাধর, নিষ্কাম হয়ে কর্মযোগ অবলম্বন কর, আমার শিষ্য হও। আমি সংকল্প করেছি এই মানস সরোবরের তীরে একটি বড় মঠ প্রতিষ্ঠা করব, তাতে যাত্রীরা আশ্রয় পাবে। তিব্বত সরকারের পারমিশন পেয়েছি, দালাই লামা তাসী লামা পঞ্চেন লামা সবাই শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আমি চাঁদা সংগ্রহের জন্য পর্যটন করব, তুমি সঙ্গে থেকে আমাকে সাহায্য করবে। কানু মহারাজের কথায় আমি তখনই রাজী হলুম। তার পর প্রায় বছর খানিক তাঁর সঙ্গে ভ্রমণ করেছি, হিমালয় থেকে কুমারিকা পর্যন্ত। মঠের জন্য গরিব বড়লোক সবাই চাঁদা দিয়েছে, যার যেমন সামর্থ্য, এক আনা থেকে এক লাখ পর্যন্ত। তা টাকা মন্দ ওঠে নি, প্রায় পৌনে চার লাখ, সবই ইণ্ডো—টিবেটান যক্ষ ব্যাংকে জমা আছে। কানু মহারাজ সম্প্রতি দিল্লিতেই অবস্থান করছেন দরিয়াগঞ্জে শেঠ গজাননজীর কুঠীতে। তাঁর অনুমতি নিয়ে একবার আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে এলুম।
রামতরণ বললেন আমরা কেউ এক পয়সা চাঁদা দেব না তা আগেই বলে রাখছি। তোমাকে থোড়াই বিশ্বাস করি।
জটাধর বকশী প্রসন্ন বদনে বললেন, মুখুজ্যে মশাইএর কথাটি হুঁশিয়ার জ্ঞানযোগীরই উপযুক্ত। বিশ্বাস করবেন কেন, আমার ভালোর দিকটা তো দেখেন নি। অদৃষ্টের দোষে বিপাকে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছি, আপনাদের কাছে অপরাধী হয়ে পড়েছি, সে কথা আমিই কি ভুলতে পারি? সৎকার্যের জন্যে চাঁদা, বিশেষ করে মঠ নির্মাণের জন্যে চাঁদা শ্রদ্ধার সঙ্গে দিতে হয়। শ্রদ্ধয়া দেয়ম—এই হল শাস্ত্রবচন। শ্রদ্ধা না হলে দেবেন কেন, আমিই বা চাইব কেন!
অতুল হালদার বললেন, থ্যাংক ইউ জটাই মহারাজ, আপনার বাক্যে আশ্বস্ত হলুম। মঠ প্রতিষ্ঠার কথা শুনেই আতঙ্ক হয়েছিল এখনই বুঝি চাঁদা চেয়ে বসবেন, না দিলে কানহাইয়া বাবার শাপের ভয় দেখাবেন। যাক, শ্রদ্ধা যখন নাস্তি তখন চাঁদাও নবডঙ্কা। আপনার ওই বিরাট বদনাটায় কি আছে?
জটাধর বললেন, বদনা বলবেন না। এর নাম রুদ্র কমণ্ডলু, কানু মহারাজের ফরমাশে গজানন শেঠজী বানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর অ্যালুমিনিয়মের কারখানা আছে কিনা।
রামতারণ প্রশ্ন করলেন, কি আছে ওটাতে? চলবল করছে যেন।
—আজ্ঞে এতে আছে চাঙ্গায়নী সুধা, আপনাদের জন্যেই এনেছি।
রামতারণ বললেন, মৃতসঞ্জীবনী সুধা জানি; চাঙ্গায়নী আবার কি?
—এ এক অপূর্ব বস্তু মুখুজ্যে মশাই, কানু মহারাজের মহৎ আবিষ্কার। খেলে মন প্রাণ চাঙ্গা হয় তাই চাঙ্গায়নী সুধা নাম।
—মদ নাকি?
—মহাভারত! কানু মহারাজ মাদক দ্রব্য স্পর্শ করেন না, চা পর্যন্ত খান না। চাঙ্গায়নীতে কি আছে শুনবেন? আপনাদের আর জানাতে বাধা কি, কিন্তু দয়া করে ফরমুলাটি গোপন রাখবেন।
কপিল গুপ্ত বললেন, ভয় নেই বকশী মশাই, আমরা এই ক—জন ছাড়া আর কেউ টের পাবে না।
—তবে শুনুন। এতে আছে কুড়িটি কবরেজী গাছ—গাছড়া, কুড়ি রকম ডাক্তারী আরক, কুড়ি রকম হোমিও গ্লোবিউল, কুড়ি দফা হেকিমী দাবাই, তা ছাড়া তান্ত্রিক স্বর্ণভস্ম হীরকভস্ম বায়ুভস্ম ব্যোমভস্ম রাজ্যের ভিটামিন, আর পোয়াটাক ইলেকট্রিসিটি। আর আছে হিমালয়জাত সামলাতো, যাকে আপনারা সিদ্ধি বলেন, আর কাশ্মীরী মকরকন্দ। এই সব মিশিয়ে বকযন্ত্রে চোলাই করে প্রস্তুত হয়েছে। কানু ঠাকুর বলেন, এই চাঙ্গায়নী সুধাই হচ্ছে প্রাচীন ঋষিদের সোমরস, উনি শুধু ফরমুলাটি যুগোপযোগী করেছেন।
অতুল হালদার ঊরুতে চাপড় মেরে বললেন, আরে মশাই, এইরকম জিনিসই তো আজ দরকার। একটু আগেই বলছিলুম কিঞ্চিৎ সিদ্ধির শরবত হলেই আমাদের এই বিজয়া সম্মিলনীটি নিখুঁত হয়।
রামতারণ বললেন, অত ব্যস্ত হয়ো না হে অতুল, জটাধরের চাঙ্গায়নী যে নেশার জিনিস নয় তা জানলে কি করে?
জটাধর বকশী তাঁর প্রকাণ্ড জিহ্বাটি দংশন করে বললেন, কি যে বলেন মুখুজ্যে মশাই! নেশার জিনিস কি আপনাদের জন্যে আনতে পারি, আমার কি ধর্মজ্ঞান নেই? এতে সিদ্ধি আছে বটে, কিন্তু তা মামুলী ভাঙ নয়, বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় শোধন করে তার মাদকত্য একেবারে নিউট্রালাইজ করা হয়েছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে যাকে বলে হৃদ্য বৃষ্য বল্য মেধ্য, এই চাঙ্গায়নী হল তাই। খেলে শরীর চাঙ্গা হবে, ইন্দ্রিয় আর বুদ্ধি তীক্ষ্ন হবে, চিত্তে পুলক আসবে, সব গ্লানি আর অশান্তি দূর হবে। কপিলবাবু, একটু ট্রাই করে দেখুন না। চায়ের বাটিটা আগে ধুয়ে নিন, জিনিসটা খুব শুদ্ধভাবে খেতে হয়।
কপিল গুপ্ত তাঁর চায়ের বাটি ধুয়ে এগিয়ে ধরে বললেন, খুব একটুখানি দেবেন কিন্তু। এই সিকিটি দয়া করে গ্রহণ করুন, আপনার কানহাইয়া মঠের জন্যে যৎকিঞ্চিৎ সাহায্য।
সিকিটি নিয়ে জটাধর তাঁর দশসেরী রুদ্র কমণ্ডলুর ঢাকনি খুললেন। ভিতর থেকে একটি ছোট হাতা বার করে তারই এক হাতা কপিল গুপ্তর বাটিতে ঢেলে দিয়ে বললেন, শ্রদ্ধয়া পেয়ম।
অতুল হালদার বললেন, আমাকেও একটু দাও হে জটাধর মহারাজ। এই নাও দুটো দোয়ানি।
বীরেশ্বর সিংগিও চার আনা দক্ষিণা দিয়ে এক হাতা নিলেন। চেখে বললেন, চমৎকার বানিয়েছেন জটাধরজী, অনেকটা কোকা কোলার মতন।
অতুল হালদার বললেন, দূর মুখখু, কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা! সেদিন হংগেরিয়ান এমবাসির পার্টিতে মিল্কপঞ্চ খেয়েছিলুম, তার আগে ফ্রেঞ্চ কনসলের ডিনারে শ্যাম্পেনও খেয়েছি, কিন্তু এই চাঙ্গায়নী সুধার কাছে সে সব লাগে না। ওঃ, কি চীজই বানিয়েছ জটাই বাবা! মিষ্টি টক নোনতা ঝাল, ঈষৎ তেতো, ঈষৎ কষা, সব রসই আছে, কিন্তু প্রত্যেকটি একেবারে লাগসই। ঝাঁজও বেশ, বোধ হয় ইলেকট্রিzসটির জন্যে, পেটে গিয়ে চিনচিন করে শক দিচ্ছে। দাও হে আর এক হাতা।
রামতারণ মুখুজ্যে বললেন, আমার আবার বাতের ব্যামো, ডায়াবিটিসও একটু আছে। চাঙ্গায়নী একটু খেলে বেড়ে যাবে না তো হে জটাধর?
জটাধর বললেন, বাড়বে কি মশাই, একেবারে নির্মূল হবে, শরীরের সমস্ত ব্যাধি, মনের সমস্ত গ্লানি, হৃদয়ের যাবতীয় জ্বালা বেমালুম ভ্যানিশ করবে। মুখ হাঁ করুন তো, এক হাতা ঢেলে দিচ্ছি, ভক্তিভরে সেবন করুন। শ্রদ্ধয়া পেয়ং, শ্রদ্ধয়া দেয়ম।
—নাঃ, তুমি দেখছি বেজায় নাছোড়বান্দা, কিছু আদায় না করে ছাড়বে না। নাও, পুরোপুরি একটা টাকাই নাও।
বৃদ্ধ রামতারণ মুখুজ্যের সদদৃষ্টান্তে সকলেই উৎসাহিত হয়ে চাঙ্গায়নী সেবন করলেন। তিন হাতা খাবার পর বীরেশ্বর সিংগি কাঁদোকাঁদো হয়ে বললেন, জটাধরজী, আমার মনে সুখ নেই, বড় কষ্ট, বড় অপমান, বউটা হরদম বলে, বোকারাম হাঁদারাম ভ্যাবাগঙ্গারাম।
জটাধর বললেন, আর একটু চাঙ্গায়নী খান বীরেশ্বরবাবু, সব দুঃখ ঘুচে যাবে। আপনি হলেন বীরপুংগব পুরুষসিংহ কার সাধ্য আপনায় অপমান করে! বোকারাম বললেই হল! দেখবেন আজ থেকে আর বলবে না, সবাই আপনাকে ভয় করবে।
রামতারণ বললেন, ওহে জটায়ু পক্ষী, তোমার চাঙ্গায়নী সত্যিই খাসা জিনিস। এই নাও দু টাকা, একটু বেশী করে দাও তো। গিন্নী কেবলই বলে বাহাত্তুরে বেআক্কেলে বুড়ো, ভীমরতি ধরেছে। মাগী আমাকে ভালমানুষ পেয়ে গ্রাহ্যির মধ্যে আনে না, বড়লোকের বেটী বলে ভারী দেমাক। আরে বাপের কত টাকা আমার ঘরে এনেছিস? আজ বাড়ি গিয়ে দেখে নেব, বেশ একটু তেজ পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে।
জটাধর বললেন, এই চাঙ্গায়নীতে সৌরতেজ রুদ্রতেজ ব্রহ্মতেজ সব আছে মুখুজ্যে মশাই। আপনি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, ঋষিদের বংশধর, আপনার পূর্বপুরুষরা সোমযাগ করতেন, কলসী কলসী সোমরস খেতেন। আপনার আবার তেজের ভাবনা! নিন, চায়ের পেয়ালা ভরতি করে দিলাম, চোঁ করে গলাধঃকরণ করে ফেলুন। পাঁচ টাকা দক্ষিণা—শ্রদ্ধয়া দেয়ং, শ্রদ্ধয়া পেয়ম।
কালীবাবুর টি ক্যাবিনে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা সকলেই অল্পাধিক চাঙ্গায়নী সুধা পান করলেন। কিন্তু জিনিসটির প্রভাব সকলের উপর সমান হল না। কপিল গুপ্ত গম্ভীর হয়ে বিড়বিড় করে ম্যাকবেথ আবৃত্তি করতে লাগলেন। বীরেশ্বর সিংগি এবং আর দুজন কচি ছেলের মতন খুঁতখুঁত করে কাঁদতে লাগলেন। দু তিন জন মেজেতে শুয়ে পড়ে নিদ্রামগ্ন হলেন। অতুল হালদার দাঁড়িয়ে উঠে হাত নেড়ে থিয়েটারী সুরে বলতে লাগলেন, শাহজাদী সম্রাটনন্দিনী, মৃত্যুভয় দেখাও কাহারে? রামতারণ মুখুজ্যে বেঞ্চের উপর উবু হয়ে বসে তুড়ি দিয়ে রামপ্রসাদী গাইতে লাগলেন—
কালী, একবার খাঁড়াটা নেব;
তোমার লকলকে জিব কেটে নিয়ে মা,
ভক্তিভরে কেটে নিয়ে মা,
বাবা শিবের শ্রীচরণে দেব।
কালীবাবু তাঁর টেবিলের পিছনে বসে সমস্ত নিরীক্ষণ করছিলেন। এখন এগিয়ে এসে জটাধরকে প্রশ্ন করলেন,আজ কত টাকা হাতালে জটাধরবাবু?
জটাধর বললেন? চাঁদার কথা বলছেন? অতি সামান্য বড়জোর পঞ্চাশ টাকা। আপনার মক্কেলরা তো কেউ টাকার আণ্ডিল নয়, সকলেরই দেখছি অদ্যভক্ষ্য ধনুর্গুণ।
—আমার দোকানে ব্যবসা করলে আমাকে কমিশন দিতে হয় তা বোঝ তো?
—বিলক্ষণ বুঝি। এই নিন পাঁচটাকা, টেন পারসেণ্টের কিছু বেশী পোষাবে।
—তোমার ওই বদনাটায় আর কিছু আছে না কি?
—আছে বই কি, চায়ের কাপের দু কাপ হবে। খাবেন?
—দাম কিন্তু দেব না।
—আপনার কাছে আবার দাম কি। এই নিন, সবটাই খেয়ে ফেলুন।
কালীবাবু দু পেয়ালা চাঙ্গায়নী পান করলেন, একটু পরেই তাঁর চোখ ঢুলুঢুলু হল।
জটাধর বললেন, টেবিলের ওপর শুয়ে পড়ে একটু বিশ্রাম করুন কালীবাবু। ভাববেন না, দশ মিনিটের মধ্যেই আপনারা সবাই চাঙ্গা হয়ে উঠবেন। হাঁ, ভাল কথা—আমার টাকা একটু কম পড়েছে, কিছু হাওলাত চাই, শৃঙ্গেরী মঠে যাবার রাহাখরচ, টাকা পঁচিশ হলেই চলবে। আপনার ক্যাশ থেকে নিলুম। আপত্তি নেই তো? একটা হ্যাণ্ডনোট লিখে দিই?… তাও নয়? থ্যাঙ্ক ইউ কালীবাবু, আপনি মহাশয় ব্যক্তি, বন্ধুকে একটু সাহায্য করতে আপত্তি করবেন কেন। টাকাটা আমার নামে আপনার খাতায় ডেবিট করবেন, আবার যেদিন আসব সুদ সুদ্ধ শোধ করব।
শিবনেত্র হয়ে জড়িত কণ্ঠে কালীবাবু বললেন, আবার কবে দেখা পাব?
—সবই ঠাকুরের ইচ্ছে কালীবাবু। কানহাইয়া বাবা যখনই এখানে টানবেন তখনই এসে পড়ব। আচ্ছা, এখন আসি, দরজাটা ভেজিয়ে দিচ্ছি। একটু সজাগ থাকবেন, বড় চোরের উপদ্রব। নমস্কার।
১৮৭৮ শক (১৯৫৬)