প্রেমচক্র

প্রেমচক্র

‘এখনও বল হাবলা।’

‘হাঁ হাঁ হাঁ, আমি বলছি তুমি ফেলে দাও মামা।’

‘কিন্তু লোকে কি বলবে?’

‘ভালই বলবে।’

‘তোর মামী?’

‘মামী খুশী হবে, তুমি দেখো।’

‘তুই না—হয় একবার ওপরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয়।’

‘তা আসছি! তুমি ততক্ষণ বেশ ভিজিয়ে নরম ক’রে রাখ।’

হাবলা ওপরে গেল। আমি বুরুশ ঘষতে লাগলুম। হুকুম এলেই জয়—মা—কালী ব’লে চোপ বসাব।

কিন্তু শুভকর্মে অনেক বাধা। হাবলার ছোট ভাই বঙ্কা ঝড়ের মতন ঘরে ঢুকে বললেন—’ওকি হচ্ছে মামা?’

‘কি আবার হবে, গোঁপটা ফেলে দেব।’

বঙ্কা বললে—’গোঁপ এখন থাকুক। দাও ধাঁ করে একটা গল্প লিখে। একটা মাসিক পত্রিকা বার করেছি—চিরন্তনী।’

‘ক—মাস বার হবে?’

‘চিরকাল। এ পত্রিকা মরবে না, তুমি দেখে নিও। দস্তুরমত এস্টিমেট ক’রে আটঘাট বেঁধে নামা হচ্ছে। পঁচিশজন নামজাদা লেখকের সঙ্গে কনট্রাক্ট করেছি। প্রতি সংখ্যায় উনিশটা গল্প—পাঁচটা সোজা প্রেম, দশটা বাঁকা প্রেম, চারটে লোমহর্ষণ। প্রথম সংখ্যা প্রায় ছাপা হয়ে এল, কেবল শেষ ফর্মার লেখাটা যোগাড় হয়ে ওঠেনি। তাই তোমার শরণাপন্ন হয়েছি। দাও চটপট একটা লিখে।’

‘কেন তোর কনট্রাক্টরদের কাছে যা না।’

‘তাদের খোশামোদ করবার আর সময় নেই, তুমিই একটা লিখে দাও, আজই চাই কিন্তু।’

এমন সময় হাবলা ফিরে এল। মুখখানা হাঁড়ির মতন ক’রে বললে—র্’মামী রাজী নয়।’

‘কি বললে?’

‘বললেন—খবরদার, ঐ তো মুখের ছিরি, গোঁপ ফেললে দেখাবে যা, মরি মরি! মামা, অমন মুষড়ে গেলে চলবে না কিন্তু। প্রতিশোধ নিতে হবে, ভীষণ প্রতিশোধ। আমি বলছি তুমি দাড়ি রাখ, দিব্যি মুখ—ভরা কোমর পর্যন্ত, নিরঞ্জন সিংএর মতন।’

বঙ্কা অস্থির হয়ে বললে—’আঃ কেবল গোঁপ আর দাড়ি। তার চেয়ে ঢের বড় জিনিস সৃষ্টি করবার আছে। মামা, তুমি অন্য চিন্তা ত্যাগ করে গল্প লেখ।’

হাবলা বললে—’তোদের সেই পত্রিকাটার জন্যে বুঝি?’

বঙ্কা জবাব দিল না। সে তার দাদাকে গ্রাহ্য করে না, কারণ হাবলা একটু সেকেলে গোছের, আর বঙ্কা হচ্ছে খাজা—তরুণ।

আমি বললুম—’বঙ্কার পত্রিকায় এক ফর্মা খালি রয়েছে, তুই একটা লিখে দে না হাবলা।’

হাবলা বললে—’কবিতা চায় তো দিতে পারি। পুঁটুর বিয়ের জন্যে একটা লিখেছি, তাই একটু অদলবদল ক’রে দিলে চলবে।’

বিয়ের পদ্যে হাবলার হাত খুব পাকা। তার বন্ধুরা বলে, এ লাইনে ও—ই এখন সম্রাট। হাবলাদের রাবণের বংশ, জেটতুতো খুড়তুতো পিসতুতো মাসতুতো। মামাতোর অন্ত নেই, তার সমস্ত তাল সামলায় শ্রীমান হাবুলচন্দ্র। বছরের মধ্যে গোটা—পাঁচেক হৃদয়বাণী, গণ্ডা দুই মর্মোচ্ছ্বাস, ছ—সাতটা প্রীতি—উপহার তাকে লিখতেই হয়। ভাষা ছন্দ ভাব তিনটেই বেশ স্ট্যাণ্ডারডাইজ ক’রে ফেলেছে। আজি কি সুন্দর প্রভাত, নীল নভে পূর্ণচন্দ্র উঠিছে, মলয় মৃদু হিল্লোলে বহিছে, কুসুম থরে থরে ফুটিছে, হৃদয়ে সাহানা রাগিণী বাজিছে। কেন এ সব হচ্ছে? কারণ, আমাদের স্নেহের পুঁটুরানীর সঙ্গে শ্রীমান চামেলিরঞ্জন বি. এস—সির শুভপরিণয়। অতএব হে বিভু, তুমি প্রচুর মধুলেপন ক’রে এই দুটি তরুণ হিয়া জুড়ে দাও।

কিন্তু বঙ্কার তা পছন্দ নয়। বললে—’রাবিশ। ওসব সেকেলে ছড়া একদম চলবে না।’

আমি বললুম—’খুব চলবে। এই কবিতাই কিছু অদলবদল করে দিলে আধুনিক হয়ে দাঁড়াবে। দু—চারটে ভূমা, গোটা—তিন অবদান, একটু রুদ্র শিহরণ একটু রিনকি—ঝিনি—’

বঙ্কা তিড়বিড় ক’রে হাত—পা নেড়ে বললেন—’না না না। ওসব পচা কবিতা একদম চলবে না। মামা, তুমি গল্প লেখ, বেশ ঘোরালো প্লট চাই, শিগগির দিতে হবে কিন্তু।’

বললুম—’আচ্ছা তাই হবে।’

‘ছবিও চাই কিন্তু।’

‘বলিস কি রে! আমার চোদ্দপুরুষ কখনও ছবি আঁকে নি।’

‘বাঃ সেই যে তুমি ঘোষ কোম্পানির আপিসে ছবি আঁকতে?’

কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। চার বার বি.এ. ফেল হবার পর বাবার উপরোধে দিন—কতক এঞ্জিনিয়ার ঘোষ কোম্পানির আপিসে প্ল্যান আঁকা শিখি। কত রকম যন্ত্র, কত রকম রং। আমি মনের সুখে সেট—স্কোয়ার দিয়ে পুকুর আঁকতুম আর কম্পাস দিয়ে চাঁদামাছ আঁকতুম। ঘোষ সাহেব দেখেও দেখতেন না, পিতৃবন্ধু কিনা! বঙ্কা সেই থেকে ঠাউরেছে আমি একজন আর্টিস্ট। তা হোক, একটু চেষ্টা করলে যদি একাধারে লিখিয়ে আর আঁকিয়ে হতে পারি তো মন্দ কি। বঙ্কাকে বললুম—’কাল সন্ধ্যাবেলা আসিস, দেখি কি করতে পারি।’

পরদিন সন্ধ্যা হ’তে না হ’তে বঙ্কা এসে হাজির। সঙ্গে আবার তার ছোটবোন চিংড়িকে এনেছে। সে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, গল্প আর ছবির একজন মস্ত সমঝদার। জিজ্ঞাসা করলুম,—’হাবলা এল না?’

বঙ্কা বললে—’দাদা ভীষণ চটেছে। বললে, দেখি আমাকে বাদ দিয়ে তোদের পত্রিকা কদিন চলে। দাদা ম্যালেরিয়া—বধ কাব্য শুরু করেছে, শ্যাওড়াপুলি—হিতৈষীতে ক্রমশ প্রকাশ্য। যাক, তুমি চটপট পড়ে ফেল মামা। লেখাটা এখনি ছাপাখানায় দিতে হবে, ছবির ব্লক করতে হবে। নাও, আরম্ভ কর।’

আরম্ভ করলুম।—

‘স্থান—নৈমিষারণ্যের ঋষিপাড়া। কাল—সত্যযুগ। পাত্র—তিন ঋষিকুমার, হারিত জারিত আর লারিত। পাত্রী—তিন ঋষিকন্যা, সমিতা জমিতা আর তমিতা।’

বঙ্কা বললে—সত্যযুগে গেলে কেন? আধুনিক হলেই বেশ হত, প্রেমের পথে কোন বাধা পেতে না। যদি বর্তমান যুগধারার সঙ্গে তোমার পরিচয় না থাকে তবে বৌদ্ধ মুঘল আমল চালাতে পারতে।’

বললুম—’তুই কতটুকু খবর রাখিস? যদি হৃদয়ের অবাধ প্রসার আর কল্পনার উদ্দাম প্রবাহ দেখাতে হয় তবে সত্যযুগের প্লট ফাঁদতেই হবে।’

চিংড়ি বললে—’যেমন কচ ও দেবযানী।’

‘ঠিক। চিংড়ি, তুই জানিস দেখছি।’

চিংড়ি খুশী হয়ে উত্তর দিলে—’মামা, তুমি কারও কথা শুনো না, চালাও সত্যযুগ।’

‘চালাবই তো। তারপর শোন।—হারিত ভালবাসে সমিতাকে, কিন্তু সমিতা চায় জারিতকে। আবার জারিত চায় জমিতাকে, অথচ জমিতার টান লারিতের ওপর। আবার লারিত ভালবাসে তমিতাকে, কিন্তু তমিতার হৃদয় হারিতের প্রতি ধাবমান।’

বঙ্কা বললে—’ভয়ংকর গোলমেলে প্লট, মনে রাখা শক্ত।’

‘মোটেই না। এক নম্বর চিত্র দেখ।’

চিংড়ি বললে—’উঃ করেছ কি মামা! এ যে ইটার্নাল ট্র্যাংগলের বাবা, হোপলেস হেক্সাগন! আচ্ছা মামা, মধ্যিখানে এটা কি এঁকেছ, চামচিকে?’

‘চামচিকে নয়, ইনি হচ্ছেন খোদ কন্দর্প। অতনু কিনা, তাই অঙ্গপ্রতঙ্গ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। লেন্স দিয়ে দেখলে টের পাবি ওঁর দুই হাতে দুই ধনুক, তার ছিলের একপ্রান্ত খোলা, তাই দিয়ে ডাইনে বাঁয়ে ওপর নীচে সপাসপ চাবুক লাগাচ্ছেন, আর প্রেমচক্র বন বন ক’রে ঘুরছে।’

চিংড়ি বললে—’বনবন সেকেলে ভাষা। বাঁইবাঁই লেখ, অথবা পাঁইপাঁই।’

‘ঠিক। প্রেমচক্র বাঁইবাঁই অথবা পাঁইপাঁই ক’রে ঘুরছে। এই চক্রের বাইরে আর একটি মূর্তি আছেন, তিনি হলেন ভুণ্ডিল মুনি। ব্রহ্মচর্য শেষ করার পর গৃহী হবার জন্য কিছুদিন চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনও ঋষিকন্যাই একে বিয়ে করতে রাজী হয় নি, কারণ ভুণ্ডিল মুনি যেমন মোটা তেমন গম্ভীর, আর তাঁর বয়স প্রায় চার হাজার বৎসর, অর্থাৎ এই কলিযুগের হিসেবে চল্লিশ। অবশেষে তিনি বুঝলেন যে দৃশ্যমান জগৎটা নিছক মায়া, আর নারী সেই মায়াসমুদ্রের ভুড়ভুড়ি, তাদের আকার আছে, কিন্তু বস্তু নেই। তখন তিনি আশ্রম ত্যাগ ক’রে নিবিড় অরণ্যে গিয়ে নাসিকাগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। দু—নম্বর চিত্র দেখ।’

চিংড়ি বললে ‘মামা, এবার আমাদের বার্ষিক উৎসবে তোমার গল্পটা অভিনয় করব। সরসী—দি যদি ভুণ্ডিল মুনি সাজেন, ওঃ কি চমৎকার মানাবে! গোঁফ লাগবে না, শুধু চাট্টি দাড়ি আনলেই চলবে। তারপর প’ড়ে যাও মামা।’

‘একদা বসন্ত সমাগমে যখন বনভূমি রমণীয় হয়ে উঠেছে, অশোক কিংশুক কুরুবক পুন্নাগ প্রভৃতি তরুরাজি পুষ্পভারে নমিত হয়েছে, ভ্রমরের গুঞ্জন আর কোকিলের কূজন বুড়ো বুড়ো তপস্বীদের পর্যন্ত উদব্যস্ত করে তুলেছে, তখন এক মধুর অপরাহ্নে সমিতা জমিতা আর তমিতা তিন সখীতে মিলে গোমতী তীরে বায়ু সেবন করতে করতে মনের কথা আলোচনা করছিল। ঠিক সেই সময়ে হাত তিরিশ পিছনে একটি আম্রকাননের অন্তরালে হারিত জারিত আর লারিত ঘাসের ওপর বসে আড্ডা দিচ্ছিল।’

চিংড়ি বললে—’ঋষিকন্যাদের সাজ কি রকম তা লিখলে না?’

‘হচ্ছে, হচ্ছে। সত্যযুগে বস্ত্র বড়ই দুর্মূল্য ছিল। ঋষিকন্যারা একখানি সাদাসিদে খাপী বল্কল পরিধান করতেন, আর একখানি শৌখিন মিহি বল্কল গায়ে তেড়চা ক’রে বাঁধতেন।’

চিংড়ি বললেন—’খুব আর্টিস্টিক সাজ। আচ্ছা মামা, স্টেজে ব্রাউন রঙের জর্জেট প’রলে ঠিক বল্কলের মতন দেখাবে না?’

‘নিশ্চয়। তার পর শোন।—ঋষিপত্নীদের সাজও ঐরকম। মাথায় কাপড় টানবার উপায় ছিল না, লজ্জা প্রকাশ করবার দরকার হ’লে কিঞ্চিৎ জিহ্বা প্রদর্শন করতেন। উঁচুদরের মুনিঋষিরা, যাঁরা রাগ—দ্বেষ—শীতোষ্ণাদি দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠতেন, তাঁদের কিছুই দরকার হ’ত না; তবে তাঁরা লোকালয়ে যেতে পারতেন না, কুকুর ঘেউ ঘেউ করত। সাধারণ ঋষির বল্কলই ধারণ করতেন, কিন্তু ছেলে—ছোকরাদের ব্যবস্থা ছিল বেল—কাঠের কৌপীন।’

বঙ্কা বললে—’বেল—কাঠের?’

হাঁ। কর্তারা বলতেন—তোদের এখন ব্রহ্মচর্যের সময়, বেশী বিলাসিতা ভাল নয়। তোরা বেদ পড়বি, ধেনু চরাবি, কাঠ কাটবি, বনে—বাদাড়ে ঘুরে হরদম বল্কল ছিঁড়বি। কাঁহাতক যোগাব? তার চেয়ে কাঠের কৌপীন পরিধান কর, তোদের পুত্রপৌত্রাদিক্রমে টিকবে।’

বঙ্কা বললে—’কিন্তু কাছা দেবে কি ক’রে?’

‘কেন দেবে না? তিন নম্বর চিত্র দেখ।’

চিংড়ি বললে—’ও! রোল—টপ টেবিলের মতন।’

‘ঠিক বুঝেছিস। চিংড়ি, তোর মাথা একদম ক্লিয়ার।’

চিংড়ি বললে—’কিন্তু মামা, তোমার এ গল্প অভিনয় করা চলবে না।’

বঙ্কা বললে—’বেল—কাঠের জন্য ভাবছিস। কিচ্ছু দরকার নেই, জারুল—কাঠ হ’লেও চলবে, ফুট—লাইটে ঠিক বেল—কাঠ ব’লে মনে হবে।’

চিংড়ি বললে—’পড়ে যাও মামা।’

‘জারিত বলছিল—সখা, প্রাণ যে যায়!’

লারিত বললে—তাই তো দেখছি। কি একগুঁয়ে মেয়ে সব! আরে, আমাদের ভালই যদি বাসিস তবে অমন গুলিয়ে ফেললি কেন? কিন্তু একটা কথা না ব’লে থাকতে পারছি না। তমিতার জন্য ম’রে আছি দাদা, কিন্তু জমিতা যে আমাকে চায় তাতে আনন্দও হয়। আহা, যদি দুটিকেই পেতুম।

হারিত ঘাড় নেড়ে বললে—ঠিক, ঠিক! পঞ্চশরের কি বিচিত্র লীলা!

লারিত বললে—আচ্ছা হারিত—দা, ওদের জোর ক’রে ধ’রে নিয়ে গিয়ে রাক্ষস বিবাহ করলে কেমন হয়?

হারিত বললে—দূর বোকা, আমরা যে ঋষির সন্তান। হয় ব্রাহ্মবিবাহ না হয় গান্ধর্ববিবাহ, এ ছাড়া অন্য বিধি নেই। চল, আর একবার ওদের বুঝিয়ে দেখি।

ওদিকে নদীর ধারে পায়চারি করতে করতে জমিতা বলছিল—সখী, যৌবন যে যায়!

তমিতা উত্তর দিলে—যায় যাক গে, তা ব’লে তো দ্বিচারিণী হ’তে পারি না। হৃদয় যাকে চায় না তাকে মাল্যদান ক’রব কি ক’রে? কিন্তু লারিত বেচারার জন্য সত্যি আমার দুঃখ হয়, কেনই বা আমাকে চায় সে!

জমিতা বললে—অতই যদি দরদ তবে গলায় মালা দিলেই পারিস। আমারও এক জ্বালা হয়েছে—কেনই বা মরতে সেদিন বেনারসী বল্কলটা পরেছিলুম, জারিত বেচারার তো দেখে আশ মেটে না। কিন্তু লারিত—দার কোনও পছন্দ নেই, কেমন যেন একরকম।

তমিতা বললে—আহা চটো কেন জমিতা—দি, লারিতকে তো আর কেড়ে নিচ্ছি না। তাকে আজীবন ভাই বলতে পারি, দাদা বলতে পারি, ঠাকুরপো বলতে পারি, কিন্তু প্রাণনাথ বলতে শুধু হারিত—দা।

একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে সমিতা বললে—কিন্তু সে যে আমাকেই চায়। আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেছে।

এমন সময় তিন বন্ধু এসে উপস্থিত। হারিত সম্ভাষণ করলে—কিগো বরবর্ণিনীরা, কি হচ্ছে?

তমিতা একটু জিহ্বাবিলাস ক’রে বললে—এই যে আসুন, নমস্কার।

হারিত বললে—আর কত কাল আমাদের কষ্ট দেবে, দয়া কি হয় না? সমিতে, একবারটি হাঁ বল।

জারিত জড়িত স্বরে বললে—জমিতে, সাড়া দাও।

লারিত হাঁকলে—তমিতে, আমি যে তোমার তরে ম’রে আছি প্রিয়ে।

তমিতা স’রে গিয়ে বললে—ও হারিত—দা, দেখ না কি বলছে!

হারিত বললে—অন্যায় কিছু বলে নি। তুমি লারিতকে ধন্য কর, জমিতা জারিতকে করুক আর সমিতা আমাকে।

সমিতা বললে—সে হ’তেই পারে না। আমরা হৃদয় বিলি ক’রে ফেলেছি, তার আর নড়চড় নেই।

হারিত বললে—একটা রফা করা যায় না? ভগবান কন্দর্পকে না—হয় মধ্যস্থ মানা যাক।

জমিতা আর তমিতা প্রথমটা এ প্রস্তাবে রাজী হ’ল না। কিন্তু সমিতা তাদের বুঝিয়ে দিলে—দেখাই যাক না কন্দর্প কি করেন, আমরা তো নিজেদের মত বদলাচ্ছি না।

কন্দর্প নিকটেই ছিলেন, পাঁচ মিনিট আবাহন করতেই দেখা দিলেন। সব শুনে বললেন—দেখ, এ বিসংবাদ তোমরা নিজেরাই মিটিয়ে ফেল। আমার কি বা ক্ষমতা, শুধু প্রজাপতির আদেশে পঞ্চবাণ মোচন করি। তার আঘাত যদি তোমাদের পছন্দসই না হয় তো আমি নাচার।

লারিত বললে—আপনি প্রেমচক্রে একটা উলটো পাক লাগিয়ে দিন না!

হারিত বললে—দূর গর্দভ, তাতে শুধু উলটো বিপত্তি হবে, প্রেমচক্র দক্ষিণাবর্তে না ঘুরে বামাবর্তে ঘুরবে, আমি চাইব তমিতাকে, তমিতা চাইবে লারিতকে—এই রকম বিপরীত অবস্থা দাঁড়াবে, তাতে কোন পক্ষের মনস্কামনা পূর্ণ হবে না।

সমিতা কন্দর্পকে বললে—আপনি অতি বেয়াড়া লোক, ছটি নিরীহ তরুণ—তরুণীকে খামকা চরকি ঘোরাচ্ছেন। কি সুখ পাচ্ছেন এতে?

জমিতা ঘাড় বেঁকিয়ে বললে—আমরা অভিশাপ দেব কিন্তু, তখন মজা টের পাবেন।

তমিতা কিল তুলে বললেন—লাগাও না দু—চার ঘা লারিত—দা।

বেগতিক দেখে কন্দর্প চট ক’রে স’রে পড়লেন।

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছে, হারিত বললে,—আজ আমরা বিদায় নি, রাত্রে আবার বৃহদারণ্যক আগাগোড়া মুখস্থ করতে হবে। কাল বিকেলে এসে ফের আমাদের আবেদন জানাব।

ঋষিকুমাররা চলে গেলে সমিতা অনেকক্ষণ ভেবে বললে—দেখ, কন্দর্প বেঁচে থাকতে এই প্রেমচক্রের ঘুরপাক থামবে না। চল, আমরা মহাদেবকে গিয়ে ধরি, তিনি আর একবার মদনভস্ম করুন।

জমিতা খুব হিসেবী। বললে—উঁহু। পঞ্চশরের ভস্ম যদি ভুবন—মাঝে ছড়িয়ে পড়ে তবেই চিত্তির, যেখানে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতন প্রেম গজিয়ে উঠবে। একেবারে সাবাড় না করলে নিস্তার নেই!

তমিতার উপস্থিত বুদ্ধি সব চেয়ে বেশী। সে বললে—ভগবান রাহুকে ধর, তিনি কপ করে গিলে ফেলুন।

সমিতা আর জমিতা লাফিয়ে উঠে বললে—সেই খাসা হবে। চল এক্ষুনি রাহুর কাছে যাই।

বঙ্কা বললে—’ছাই গল্প হচ্ছে। শাস্ত্রের কথা না—হয় মেনে নিলুম যে রাহু একটা গ্রহ, আকাশে থাকে। কিন্তু মেয়েরা তার কাছে যাবে কি ক’রে? যত সব গাঁজাখুরি।’

চিংড়ি ধমক দিয়ে বললে—’তুমি থাম ছোড়দা। এটা যে সত্যযুগ সে খেয়াল আছে? প’ড়ে যাও মামা।’

রাহু, তখন আকাশে নিরিবিলিতে বসে পাঁজি দেখছিলেন। মেয়েদের দেখে জিজ্ঞাসা করলেন—’কি চাই? চট ক’রে বলে ফেল, আমার সময় বড্ড কম।’

সমিতা হাতজোড় করে বললে—প্রভু, আমরা প্রেমে পড়েছি।

রাহু ফিক করে হেসে বললেন—মাইরি? তা আমাকে কেন। আমি শূন্য পথে ধাই,চাঁদ—সূয্যি খাই, প্রেমের আমি কিবা জানি। দেখছ তো, আমার শুধুই মুণ্ডু, তাতে প্রেম হয় না। প্রেম চাও তো ইন্দ্রাদি দেবতার কাছে যাও, তাঁদের ওই ব্যবসা।

সমিতা নিবেদন করলে—প্রভু, আপনাকে হৃদয় দেব এমন ভাগ্য আমরা করি নি। আমরা মানুষকেই ভালবেসেছি, কিন্তু কন্দর্প সমস্তই ওলটপালট করে দিচ্ছেন। তিনি ধ্বংস না হ’লে আমাদের স্বস্তি নেই। আপনি কৃপা করে তাঁকে গ্রাস করুন।

রাহু মাথা নেড়ে বললেন—সইবে না, সইবে না। চাঁদ পর্যন্ত আমার হজম হয় না, গিলতে না গিলতে বেরিয়ে যায়। কন্দর্প খেলে পেট ফাঁপবে।

তমিতা বললে—পেট তো আপনার দেখছি না।

রাহু ধমকে বললে—’হাঁ, তুই সব জানিস। আধ্যাত্মিক উদর শুনেছিস? আমার তাই।’

জমিতা বললে—প্রভু, তবে আমাদের তিনটিকে ভক্ষণ করুন, বেঁচে আর সুখ নেই।

রাহু একটু বিষণ্ণ হাসি হেসে বললেন—হজমের কি আর শক্তি আছে রে! শুধু লঘুপথ্য খেয়ে বেঁচে আছি, হ’ল একটু চাঁদের কুচি, হ’ল বা গরম গরম এক কামড় সূয্যি। আচ্ছা, কাছে আয়, দেখি একটু তোদের গাল চেটে।

তমিতা বললে—কি যে বলেন!

তবে এলি কি করতে? যা এখন পালা, আমার খাবার লগ্ন হ’ল।

রাহু তাঁর লকলকে গোঁপ দিয়ে খপ করে পূর্ণচন্দ্র ধরলেন, তার পর তাতে একটু মাখন মাখিয়ে কামড় দিলেন। চার নম্বর চিত্র দেখ। মেয়েরা সে করুণ দৃশ্য সইতে পারলে না, ছুটে পালাল।

মহামুনি ঔড়ব হচ্ছেন নৈমিষারণ্যের বড় আশ্রমের কুলপতি। তাঁর দশ হাজার শিষ্য, বিশ হাজার ধেনু। যজ্ঞশালায় রোজ আড়াই—শ মণ নীবার ধানের চাল রান্না হয়, আর তিন—শ ঝুড়ি উড়ুম্বরের তরকারি। ঔড়ব অত্যন্ত রাশভারী ঋষি। আশ্রমবাসীরা তাঁর ভয়ে তটস্থ।

সকালবেলা হারিত জারিত আর লারিত বেদাধ্যয়ন করতে এসেছে। ঔড়ব জলদগম্ভীর স্বরে ডাকলেন—হারিত!

আজ্ঞে।

এসব কি শুনছি? তোমরা নাকি আশ্রমকন্যাদের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াও? জান, এটা হচ্ছে তপোবন, ইয়ারকির জায়গা নয়? এখন তোমাদের ব্রহ্মচর্যের সময়, সে খেয়াল আছে?

সত্যযুগে মিথ্যে কথা লোকে বড় একটা কইত না। হারিত হাতজোড় ক’রে স্বীকার করলে—প্রভু, আমরা অপরাধ করেছি।

তবে প্রায়শ্চিত্ত কর। তিনজনে গোমুখী তীর্থে চলে যাও, নিরন্তর গোসেবা, সদ্যোজাত গোময় আহার, কবোষ্ণ গোমূত্র পান, এই ব্যবস্থা। তাতে চিত্তশুদ্ধি পিত্তশুদ্ধি পাপমোচন একযোগে হবে। একটি বৎসর নৈমিষারণ্যের ত্রিসীমানায় এসো না।

হারিত জারিত আর লারিত গুরুদেবের চরণবন্দনা ক’রে বিষণ্ণ মনে বিদায় হ’ল।

একদিন প্রাতঃকালে কন্দর্প হিমালয়ের পাদদেশে কিন্নরমিথুন শিকার করতে গেছেন। ইতস্তত বিচরণ করতে করতে হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল একটা মস্ত উই ঢিবি উঁচু হয়ে রয়েছে, তার উপর পোকা বিজবিজ করছে। কেমন সন্দেহ হ’ল। গোটা দুই বাণের খোঁচা দিতেই পনর ইঞ্চি উই—মাটির স্তর খ’সে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে মানুষের ক্ষীণ কণ্ঠরব শোনা গেল—অহো, কুসুমশর কি দুঃসহ!

কন্দর্প বললে—ভুণ্ডিল মুনির গলা শুনছি না?

বল্মীকের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ভুণ্ডিল বললেন—আমার তপস্যা ভঙ্গ করলে কেন হে? ভস্ম ক’রে ফেলব।

কন্দর্প বললেন—আরে দাঁড়াও ঠাকুর, এখন গোসা রাখ। বেজায় কাহিল হয়ে গেছ যে! নাও, এই দিব্য মকরন্দটুকু খেয়ে ফেল। গায়ে বল পাচ্ছ? বেশ বেশ, আর একটু খাও! তারপর, কিসের জন্য তপস্যা হচ্ছিল?

ভুণ্ডিল উত্তর দিলেন—তপস্যা আবার কিসের জন্য করে? মোক্ষলাভের জন্য।

মোক্ষ এখন থাকুক। দিব্যকান্তি চাও? তপ্তকাঞ্চনবর্ণ চাও? রমণীর মন হরণ করতে চাও?

ভুণ্ডিল একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললেন—কিন্তু তপস্যার কি হবে?

তপস্যা এখন থাক না। দিন—কতক ছুটি নাও, ফুর্তি কর।

ভুণ্ডিল ভেবে দেখলেন, এরকম তো অনেক মহামুনিই ক’রে থাকেন, পরাশর বিশ্বামিত্র ব্যাসদেব। তাতে আর দোষ কি। বললেন—আচ্ছা, রাজী আছি, কিন্তু এক বৎসরের বেশী নয়।

কন্দর্প বললেন—মোটে? বেশ তাই হবে। আমি বর দিচ্ছি, ভুবনমোহন রূপ ধারণ কর। বৎসরান্তে আবার স্বমূর্তি ফিরে পাবে, তখন যত খুশি তপস্যা ক’রো, কেউ বাধা দেবে না।

ভুণ্ডিলের আপাদমস্তকে একটা তারুণ্যের প্লাবন ব’য়ে গেল। কাঁচা—পাকা জটাজুট উড়ে গিয়ে মাথায় ভ্রমরবিনিন্দিত কৃষ্ণ কেশ ঝাঁকড়া—ঝাঁকড়া গজিয়ে উঠল। একটা অদৃশ্য ক্ষুর চরর ক’রে মুখমণ্ডল নির্লোম করে দিলে, রইল শুধু দু’পাশে দুটি কচি কচি জুলপি। ছাতাপড়া নড়া দাঁত খটাখট উপড়ে গিয়ে দু—পাটি দন্তরুচিকৌমুদী ফুটে উঠল। কটিতটে শুভ্র পট্টবাস জড়িয়ে গেল, কাঁধে চড়ল আপীত উত্তরীয়, গলায় মল্লিকার মালা, হাতে মোহন মুরলী, সর্বাঙ্গে দিব্যকান্তির পলেস্তারা। ভুণ্ডিল একটি লম্ফ দিয়ে হুংকার ছেড়ে বললেন—ভো বিশ্বচরাচর শৃন্বন্তু, আমি আছি, তোমরাও আছ, এইবার দেখে নেব।

কন্দর্প বললেন—অতি পাকা কথা। আচ্ছা, এইবার ওই সুদূর নৈমিষারণ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ কর।

ভুণ্ডিল তাই করলেন। আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন—আহা, কি দেখলুম!

কি দেখলে?

তিনটি পরমাসুন্দরী তরুণী গোমতীসলিলে স্নান করছে।

প্রাণে পুলক জাগছে?

জাগছে।

হিয়ায় হিল্লোল উঠছে?

উঠছে।

চিত্ত চুলবুল করছে?

করছে।

চিংড়ি বললে—’মামা, এইখানটা ভারী গ্র্যাণ্ড লিখেছ কিন্তু।’

‘হুঁ হুঁ, এখনই হয়েছে কি। পরে দেখবি আরও মধুর, আরও মর্মস্পর্শী। তারপর শোন।—

কন্দর্প বললেন—ভুণ্ডিল।

আজ্ঞে।

কোনটিকে পছন্দ হয়।

ঠিক করতে পারছি না যে।

আচ্ছা, ওই যেটি তন্বী, দীর্ঘকায়, পদ্মকোরকবর্ণা, রাজহংসীর মতন যার গলা?

অতি সুন্দর।

আর যেটি সুমধ্যমা, চম্পকগৌরী, মদমুকুলিতাক্ষী, দোহারা গড়ন, টুকটুকে ঠোঁট?

চমৎকার।

আর ওই বেঁটেটি, শ্যামাঙ্গী, চঞ্চলা, চকিতমৃগনয়না, বেশ মোটা—সোটা, টেবো টেবো গাল?

ওটিও খাসা।

ব’লে ফেল কোনটিকে চাও।

আজ্ঞে তিনটিকেই।

কন্দর্প ভুণ্ডিলের পিঠ চাপড়ে বললেন—সাধু ভুণ্ডিল—সাধু। তবে আর দেরি ক’রো না, সোজা নৈমিষারণ্যে চ’লে যাও, গোমতীর তীরে বসে তোমার ওই বাঁশিটি বাজাও গে।

সমিতা জমিতা আর তমিতা বিকেলবেলা গোমতীর ধারে ব’সে নৈমিষারণ্যের বিখ্যাত চিঁড়েভাজা খাচ্ছে। হঠাৎ একটা করুণ বেসুরো বাঁশির আওয়াজ কানে এল। সমিতা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেল একটি লোক কশ্যপ—ঘাটে ব’সে তাদের দিকে চেয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে।

সমিতা বললে—কে ওই তরুণ? আগে তো দেখি নি কখনও।

জমিতা বললে—কেন বাঁশি বাজাচ্ছে কে জানে। কেমন যেন উদাস সুর।

তমিতা বললে—সুন্দর চেহারাটি কিন্তু।

সমিতা বললে—তোর হারিত—দার চেয়েও সুন্দর?

তমিতা ভ্রূভঙ্গী করে বললে—কি যে বলিস! হারিত—দা জারিত—দা লারিত দার চাইতে বুঝি কারও সুন্দর হ’তে নেই!

মেয়েরা অন্যমনস্ক হয়ে আড়চোখে দেখতে লাগল। —’আচ্ছা চিংড়ি, আড়চোখে চাওয়া কি রকম করে আঁকতে হয় জানিস?’

চিংড়ি বললে—’খুব সোজা। একটা আন্ডার মতন আঁক। মাথায় ইচ্ছেমত চুল বসাও। কপালে নিরেনব্বই লেখ, তার নীচে একটা কাত—করা বিসর্গ, তার নীচে একটা পাঁচ। যদি দাঁত দেখাতে চাও তবে চুয়াল্লিশ বসাও। আর যদি মোনা—লিসার ধরনের নিগূঢ় হাসি ফোটাতে চাও তবে আট লেখ।’

‘বাঃ ঠিক হয়েছে। পাঁচ নম্বর চিত্র দেখ। তার পর শোন।’

একটি বৎসর দেখতে দেখতে কেটে গেল। হারিত জারিত আর লারিত প্রায়শ্চিত্ত শেষ করে তীব্র আশা আর দারুণ উৎকন্ঠা নিয়ে নৈমিষারণ্যে ফিরে এল। মেয়েদের সংবাদ কি? তারা কি এখনও নিজেদের গোঁ বজায় রেখেছে? এই বৎসরব্যাপী বিচ্ছেদের ফলে তারা কি প্রেমের সোজা পথটি খুঁজে পায় নি, মনে একটুও প্রতিদানস্পৃহা জাগে নি? হবেও বা।

কিন্তু খবর যা শুনলে তা মর্মান্তিক। সমিতা জমিতা তমিতা তিনজনেই ভুণ্ডিলকে মাল্যদান করেছে। হা রে কন্দর্প, এই কি তোর মনে ছিল? প্রেম—চক্রে বৃথাই এতদিন ঘুরপাক খাওয়ালি? হায় হায়, কেন তারা মেয়েদের মতেই সায় দেয়নি, সে তো মন্দের ভাল ছিল। আর মেয়ে তিনটেরও ধন্য রুচি, শেষে কিনা ভুণ্ডিল!

হারিত মাথা চাপড়ে বললে—ওঃ, স্ত্রীচরিত্র কি কুটিল! ওদের কিসসু বিশ্বাস নেই।

জারিত হাত নেড়ে বললে—একেবারে যাসসেতাই।

লারিত দাড়ি ছিঁড়ে বললে—তিনটি বসসর নাহক ভুগিয়েছে মশাই।

তিন উদ্দাম প্রেমিক উর্ধ্বশ্বাসে ছুটল ভুন্ডিলের বাড়ি। ব্যাটাকে ঠেঙিয়ে মনের জ্বালা দূর ক’রতে হবে, তাতে মহামুনি ঔড়ব ভস্মই করুন আর তির্যগযোনিতেই পাঠান।

ভুণ্ডিলের কুটীরে কেউ নেই, শুধু প্রাঙ্গণে একটি আশ্রম—ব্যাঘ্রী তৃণভোজন করছে আর তিনটি হরিণশিশু তার স্তন্য পান করছে। এই স্নিগ্ধ শান্ত আশ্রম—সুলভ দৃশ্য দেখে ঋষিকুমারদের হুঁশ হল, অহিংসার কাছে কিছু নেই। হারিত ব্যঘ্রীটিকে একটু আদর ক’রে সঙ্গীদের বললে—যা হবার তা তো হয়ে গেছে, দৈবই সর্বত্র বলবান। কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ। মিথ্যা ঋষিহত্যা ক’রে কি হবে, চল আমরা গোমুখী তীর্থে ফিরে গিয়ে পরমাত্মাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করি।

সংসারে বীতরাগ হয়ে তারা আবার উত্তর মুখে চলল। কিন্তু দৈবের মতলব অন্য রকম। একটু যেতে না যেতে তারা দেখতে পেলে বটগাছের তলায় একটি বল্মীকস্তূপ, সমিতা জমিতা আর তমিতা তার উপরে ঝাঁটা চালাচ্ছে।

একটি সলজ্জ ম্লান হাসি হেসে তমিতা বললে—এই যে, আসুন নমস্কার। ভাল আছেন তো? কবে এলেন?

হারিত বললে—ভদ্রে, এ কি?

অবনতমস্তকে সমিতা উত্তর দিলেন—এই উই—ঢিপির মধ্যে আছেন। কাল বিকেল পর্যন্ত বেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন, কত গল্প কত হাসি কত গান। যেমন সূর্যাস্ত হ’ল, অমনি হঠাৎ কেমন একটা কাঁপুনি ধরল, আর চেহারাটাও এক মুহূর্তে বিকট কাল মোটা হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় এক রাশ জটা আর মুখভরা বিশ্রী দাঁড়ি—গোঁপ। আমরা তো ভয়ে পালিয়ে গেলুম। তার পর খুঁজে খুঁজে পেলুম এই বটতলায় বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে তপস্যা করছেন। অনেক ডাকাডাকি করতে একবার চোখ মেলে চাইলেন, ধমকে বললেন—খবরদার, ভস্ম ক’রে ফেলব। দেখতে দেখতে সর্বাঙ্গে উই লেগে মাটির প্রলেপ জমে গেল, দেখুন না, একদিনেই আগা—পাস্তলা চাপা পড়ে গেছে। আমরা কি আর করি, তিন জনে ঝাঁটা বুলিয়ে উই তাড়াচ্ছি।

হারিত বললে—না না না, অমন কাজও ক’রো না, তাতে ওঁর তপস্যার হানি হবে। উই অত্যন্ত উপকারী প্রাণী, তপশ্চর্যার একটি প্রধান অঙ্গ, বাহ্য বিষয় বোধ ক’রে মনকে অন্তর্মুখ করতে অমন আর দুটি নেই।

জারিত বললে—তা ছাড়া, উই—মাটি ভেঙে গিয়ে যদি ভিতরে হাওয়া ঢোকে, তবে চ’টে গিয়ে বিলকুল ভস্ম ক’রে ফেলবেন।

লারিত বললে—ওঃ, কি জোচ্চোর হৃদয়হীন তপস্বী, তিন—তিন তরুণীকে ভাসিয়ে দিলে!

তমিতা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললে—ওগো সেই বাঁশিতেই সর্বনাশ করেছে।

জমিতা গদগদ কণ্ঠে ডাকলে—ও হারিদ্দা জারিদ্দা লারিদ্দা!

হারিত বললে—ভয় কি, আমরা তিন জনেই আছি। ওঁকে আর ঘাঁটিয়ে কাজ নেই, কল্পান্ত পর্যন্ত সমাধিস্থ হয়েই থাকুন। তোমরা আমাদের সঙ্গে হিমালয়ে চল, সেইখানেই আশ্রম নির্মাণ করা যাবে।

কিন্তু আমরা যে সতী, হারিত দা।

আমরাই কোন অসৎ। চল চল, বেলা ব’য়ে যায়।’

বঙ্কা বললে—’থামলে কেন মামা, তার পর?’

‘তার পর আর নেই; তোর মামী আর লিখতে দেয় নি।’

‘আঃ, মামীর যদি কিছু আক্কেল থাকে!’

চিংড়ি বললে—’এ মামীর ভারী অন্যায় কিন্তু। সত্যযুগে কী না হ’তে পারে। আচ্ছা, তোমার তো মনে আছে, শেষটা মুখে মুখেই বল না, আমি লিখে নিচ্ছি।’

‘উঁহু একদম গুলিয়ে গেছে, যে তোর মামীর ধমক।’

বঙ্কা বললে—’তোমার মরাল কারেজ কিচ্ছু নেই! দাও আমাকে, আমিই শেষ ক’রব।’

১৩৩৯ (১৯৩২)