সরলাক্ষ হোম
বরুণ বিশ্বাস একজন বড় অফিসার, যদিও বয়স ত্রিশের কম। ছেলেবেলায় মা বাপ মারা যাবার পর তাঁর পিতৃবন্ধু গদাধর ঘোষ তাকে পালন করেন। তিনি খুব ধনী লোক, বিস্তর খরচ করে বরুণকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। বরুণ ছেলেটিও ভাল, ছ মাস হল আমেরিকা থেকে গোটাকতক ডিগ্রী নিয়ে ফিরে এসেছে। গদাধরের মেয়ে মাণ্ডবীর সঙ্গে তার বিয়ে আগে থেকেই ঠিক করা আছে, তিন মাস পরে বিয়ে হবে।
গদাধর ঘোষ প্রতিপত্তিশালী লোক, মুরুব্বীর জোর খুব আছে। তাঁর চেষ্টায় বরুণ একটা বড় চাকরি পেয়ে গেছে—বানর—নির্বাসন—অধিকর্তা, অর্থাৎ ডিরেক্টর অভ মংকি ডিপোর্টেশন। এই সরকারি বিভাগটির উদ্দেশ্য মহৎ। এদেশে মানুষ যা খায় বাঁদরও তাই খায়, তার ফলে মানুষের ভাগে কম পড়ে। সরকার স্থির করেছেন দেশের সমস্ত বাঁদর ক্রমে ক্রমে আমেরিকায় চালান দেবেন, সেখানে চিকিৎসা আর শারীরবিদ্যার গবেষণার জন্য মুখপোড়া রূপী মর্কট প্রভৃতি সব রকম শাখা মৃগের চাহিদা আছে। বানরনির্বাসনের ফলে দেশের খাদ্যাভাব কমবে, আমেরিকান ডলারও ঘরে আসবে। কিন্তু শ্রেয়স্কর কর্মে বহু বিঘ্ন। যাঁরা জীবহিংসার বিরোধী তাঁরা প্রবল আপত্তি তুললেন। বিদেশে গিয়ে বাঁদররা প্রাণ বিসর্জন দেবে এ হতেই পারে না। তাঁরা শ্রী হনুমানের আত্মীয়, ভারতীয় রামরাজ্যের প্রজা, মানুষের মতন তাঁদের বাঁচবার অধিকার আছে। ভারতবাসী যেমন গরুকে মাতৃবৎ দেখে তেমনি বাঁদরকে ভ্রাতৃবৎ দেখে। সরকার যদি নিতান্তই বানরনির্বাসন চান তবে এদেশেরই কোনও স্বাস্থ্যকর স্থানে তাদের জন্য উপনিবেশ নির্মাণ করুন, প্রচুর আম কাঁঠাল কলা ইত্যাদির গাছ পুঁতুন, ছোলা মটর বেগুন ফুটি কাঁকুড় ইত্যাদির খেত করুন, তদারকের ভাল ব্যবস্থা করুন। উদবাস্তুদের পুনর্বাসনে যে বেবন্দোবস্ত হয়েছে বাঁদরের বেলা তা হলে চলবে না। এই রকম আন্দোলনের ফলে বানরনির্বাসন আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে, বরুণ বিশ্বাসের উপর হুকুম এসেছে এখন শুধু গনতি করে যাও, পরিসংখ্যান তৈরি কর। বরুণের অধীনে বিশ জন পরিদর্শক আছে, তারা জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়ায় আর রিপোর্ট পাঠায়—বাঁদর এত, বাঁদরী এত, বাঁদরছানা এত। কলকাতার অফিসে এইসব রিপোর্ট ফাইল করা হয় এবং মোটা মোটা খাতায় তার খতিয়ান ওঠে।
আজ বরুণের হাতে কাজ কিছু নেই, মনেও সুখ নেই। সে তার অফিসঘরে ঘূর্ণিচেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে দিয়ে সিগারেট টানছে আর আকাশ পাতাল ভাবছে, এমন সময় সামনের বাংলা কাগজে এই বিজ্ঞাপনটি তার চোখে পড়ল—
যদি মনে করেন সময়টা ভাল যাচ্ছে না, মুশকিলে পড়েছেন, তবে আমার কাছে আসতে পারেন। যদি অবস্থা এমন হয় যে, উকিল ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার পুলিস জ্যোতিষী বা গুরুমহারাজ কিছুই করতে পারবেন না, তবে বৃথা দেরি না করে আমাকে জানান। এই ধরুন, আপনার সম্বন্ধী সপরিবারে আপনার বাড়িতে উঠেছেন, ছ মাস হয়ে গেল তবু চলে যাবার নামটি নেই। অথবা আপনার পিসেমশাই তাঁর মেয়ের বিয়ের গহনা কেনবার জন্য আপনাকে তিন হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু রেস খেলতে গিয়ে আপনি তা উড়িয়ে দিয়েছেন। অথবা পাশের বাড়ির ভবানী ঘোষাল আপনাকে যাচ্ছেতাই অপমান করেছে, কিন্তু সে হচ্ছে ষণ্ডামার্কা গুণ্ডা আর আপনি রোগা—পটকা। কিংবা ধরুন আপনার স্ত্রীর মাথায় ঢুকেছে যে তাঁর মতন সুন্দরী ভূভারতে নেই, তিনি সিনেমা অ্যাকট্রেস হবার জন্য খেপে উঠেছেন, আপনি কিছুতেই তাঁকে রুখতে পারছেন না। কিংবা মনে করুন আপনি একটি মেয়েকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দেবার পর অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে ঘোরতর প্রেমে পড়েছেন, আগেরটিকে খারিজ করবার উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। ইত্যাদি প্রকার সংকটে যদি পড়ে থাকেন তো সোজা আমার কাছে চলে আসুন। শ্রীসরলাক্ষ হোম, তিন নম্বর বেচু কর স্ট্রীট, বাগবাজার, কলিকাতা। সকাল আটটা থেকে দশটা, বিকেল চারটে থেকে রাত নটা।
বিজ্ঞাপনটি পড়ে বরুণ কিড়িং করে ঘণ্টা বাজালে। লাল চাপকান পরা একজন আরদালী ঘরে এল, বরুণ তাকে বললে, মিস দাস। একটু পরে ঘরে ঢুকল খঞ্জনা দাস, বরুণের অ্যাসিস্টাণ্ট, রোগা লম্বা কাঁধ পর্যন্ত ঝোলা ঢেউ তোলা রুক্ষ ফাঁপানো চুল, চাঁচা ভুরু, গোলাপী গাল, লাল ঠোঁট, লাল নখ, নখের ডগাটিকে দেখায় লানসেটের মতন সরু। সস্তা সিন্থেটিক ভায়োলেটের গন্ধে ঘর ভরে গেল।
বরুণ কাগজটা হাতে দিয়ে বললে, এই বিজ্ঞাপনটা পড়ে দেখ।
বিজ্ঞাপন পড়ে খঞ্জনা বললে, যাবে নাকি লোকটার কাছে? নিশ্চয় হামবগ জোচ্চোর, কিছুই করতে পারবে না, শুধু ঠকিয়ে পয়সা নেবে। আমার কথা শোন, দু নৌকোয় পা রেখো না, মাণ্ডবী আর তার বাপকে সোজা জানিয়ে দাও যে তুমি অন্য মেয়ে বিয়ে করবে।
—তার ফল কি হবে জান তো? আমার আড়াই হাজার টাকা মাইনের চাকরিটি যাবে। আমাদের চলবে কি করে? মাণ্ডবীর বাপ গদাধর ঘোষকে তুমি জান না, অত্যন্ত রাগী লোক।
—অত ভয় কিসের? তোমার সরকারী চাকরি, গদাই ঘোষ তোমার মনিব নয়, ইচ্ছে করলেই তোমাকে সরাতে পারে না। আর যদিই চাকরি যায়, অন্য জায়গায় একটা জুটিয়ে নিতে পারবে না?
বরুণ বললে, আজ বিকেলে এই সরলাক্ষ হোমের কাছে গিয়ে দেখি। যদি কোনও উপায় বাতলাতে না পারে তবে তুমি যা বলছ তাই করব।
এখন সরলাক্ষ হোমের পরিচয় জানা দরকার। লোকটির আসল নাম সরলচন্দ্র সোম। বি.এ পাস করে সে স্থির করলে আর পড়বে না, চাকরিও করবে না, বুদ্ধি খাটিয়ে স্বাধীনভাবে রোজগার করবে। প্রথমে সে রাজজ্যোতিষীর ব্যবসা শুরু করলে। কিন্তু তাতে কিছু হল না। কারণ সামুদ্রিক আর ফলিত জ্যোতিষের বুলি তার তেমন রপ্ত নেই, মক্কেলরা তার বক্তৃতায় মুগ্ধ হল না। তার পর সে সরলাক্ষ হোম নাম নিয়ে ডিটেকটিভ সেজে বসল, কিন্তু তাতেও সুবিধা হল না। সম্প্রতি সে একেবারে নতুন ধরনের ব্যবসা ফেঁদেছে, মক্কেলও অল্পস্বল্প আসছে।
সরলাক্ষ হোমের বাড়িতে ঢুকতেই যে ঘর, সেখানে একটা ছোট টেবিল আর তিনটে চেয়ার আছে, মক্কেলরা সেখানে অপেক্ষা করে। তারপরের ঘরটি কনসল্টিং রুম, সেখানে সরলাক্ষ আর তার বন্ধু বটুক সেন গল্প করছে। বটুক সরলাক্ষর চাইতে বয়সে কিছু বড়, সম্প্রতি পাস করে ডাক্তার হয়েছে, কিন্তু এখনও কেউ তাকে ডাকে না। ঘরের ঘড়িতে পৌনে চারটে বেজেছে।
বটুক সেন বলছিল, খুব খরচ করে ব্যবসা তো ফাঁদলে। ঘর সাজিয়েছ, দামী পর্দা টাঙিয়েছ, উর্দি পরা বয় রেখেছ, কাগজে বিজ্ঞাপনও দিচ্ছ। মক্কেল কেমন আসছে?
সরলাক্ষ বললে, দুটি একটি করে আসছে। বেশীর ভাগই স্কুলের ছেলে, ষোল টাকা ফী দেবার সাধ্য নেই, টাকাটা সিকেটা যা দেয় তাই নিই। একজন প্রেমে পড়েছে, কিন্তু সে অত্যন্ত বেঁটে বলে প্রণয়িনী তাকে গ্রাহ্য করছে না। আমি অ্যাডভাইস দিয়েছি—সকালে দু পায়ে দুখানা ইট বেঁধে দু হাতে গাছের ডাল ধরে আধ ঘণ্টা দোল খাবে, বিকেলে মাঠে মনুমেণ্টের মাথার দিকে তাকিয়ে এক ঘণ্টা ধ্যান করবে, ছ মাসের মধ্যে ছ ইঞ্চি বেড়ে যাবে। আর একটি ছেলে কাশী থেকে পালিয়ে এখানে ফুর্তি করতে এসেছে, টাকা সব ফুরিয়ে গেছে, বাপকে জানাতে লজ্জা হচ্ছে। আমি বলেছি—লিখে দাও, ছেলেধরা ক্লোরোফর্ম করে নিয়ে এসেছে, মিস্টার সরলাক্ষ হোম আমাকে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন, পত্রপাঠ এক শ টাকা পাঠাবেন। আর এই দেখ বটুক—দা—শ্রীগদাধর ঘোষ চিঠি লিখেছেন, আজ সন্ধ্যা সাতটায় আসবেন।
বটুক বললে, বল কি হে! গদাধর তো মস্ত বড় লোক, তার আবার মুশকিল কি হল? তাকে যদি খুশী করতে পার তো তোমার বরাত ফিরে যাবে।
সরলাক্ষর প্রতিহাররক্ষী ছোকরা সোনালাল একটি স্লিপ নিয়ে এল। সরলাক্ষ পড়ে বললে, এ যে দেখছি একজন মহিলা, মাণ্ডবী ঘোষ। পাঠিয়ে দে এখানে।
কুড়ি—বাইশ বছরের একটি মেয়ে ঘরে এল। দুজন লোক দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললে, মিস্টার হোমের সঙ্গে কিছু প্রাইভেট কথা বলতে চাই।
সরলাক্ষ বললে, আমিই হোম, ইনি আমার সহকর্মী ডাক্তার বটুক সেন। আপনি এঁর সামনে সব কথা বলতে পারেন, কোনও দ্বিধা করবেন না। বসুন আপনি।
মাণ্ডবী কিছুক্ষণ ঘাড় নীচু করে বসে রইল। তার পর আস্তে আস্তে বললে, আমার বাবার নাম শুনে থাকবেন, শ্রীগদাধর ঘোষ।
সরলাক্ষ বললে, ও, তাঁরই কন্যা আপনি?
—হাঁ। বরুণ—দার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা অনেক কাল থেকে ঠিক করা আছে—বানর—নির্বাসন—অধিকর্তা বরুণ বিশ্বাস।
হাঁ হাঁ এই নতুন পোস্টের কথা কাগজে পড়েছি বটে। খুব ভাল সম্বন্ধ, কংগ্রাটস মিস ঘোষ।
মাণ্ডবী বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বললে, একটা বিশ্রী গুজব শুনছি, বরুণ—দা তার অ্যাসিস্টাণ্ট খঞ্জনা দাসের প্রেমে পড়েছে।
—আপনার বাবা জানেন?
—জানেন, কিন্তু তিনি তেমন গা করছেন না। বলছেন, ইয়ংম্যানরা অমন একটু—আধটু বেচাল হয়ে থাকে, বিয়ে হলেই সেরে যাবে।
—কথাটা ঠিক, চটপট বিয়ে হয়ে যাওয়াই ভাল।
—এক জ্যোতিষী বলেছেন আমার একটা ফাঁড়া আছে, তিন মাস পরে কেটে যাবে। তার পর বিয়ে হবে। কিন্তু তার মধ্যে বরুণ—দা কি করে বসবে কে জানে।
—দেখি আপনার হাত।
মাণ্ডবীর করতল দেখে সরলাক্ষ বললে, হুঁ, ফাঁড়া একটা আছে বটে, কিন্তু তিন মাস নয়, মাস খানিকের মধ্যেই আমি কাটিয়ে দেব। খঞ্জনা দাসের খপ্পর থেকে আপনি শ্রীবিশ্বাসকে উদ্ধার করতে চান তো?
—হাঁ। আপনি দু জনের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দিন, ভীষণ ঝগড়া, যাতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়। খরচ যা লাগে আমি দেব, এখন এই একশ টাকা আগাম দিচ্ছি।
সরলাক্ষ সাহাস্যে বললে, ব্যস্ত হবেন না, আমার প্রথম ফী ষোল টাকা মাত্র। কাজ উদ্ধার হলে আর যা ইচ্ছে দেবেন।
বটুক বললে, মিস ঘোষ, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, সরলাক্ষর অসাধ্য কিছু নেই, ঠিক ঝগড়া বাধিয়ে দেবে।
মাণ্ডবী মাথা নেড়ে বললে, উঁহু, অত সহজ ভাববেন না। খঞ্জনাকে আপনারা চেনেন না, ভীষণ বদমাশ মেয়ে, দারুণ ছিনে জোঁক, সহজে ছাড়বে না। আর বরুণ—দাও ভীষণ বোকা।
সরলাক্ষ প্রশ্ন করলে, বরুণ—দাকে আপনি কত দিন থেকে জানেন?
—সেই ছেলেবেলা থেকে। আমার বাবাই ওকে মানুষ করেছেন, চাকরিও জুটিয়ে দিয়েছেন।
সোনালাল আবার ঘরে এসে একটা কার্ড দিলে। সরলাক্ষ দেখে বললে, আরে স্বয়ং বরুণ বিশ্বাস দেখা করতে এসেছেন!
মাণ্ডবী চমকে উঠে বললে, সর্বনাশ, আমাকে তো দেখে ফেলবে! কি করি বলুন তো?
সরলাক্ষ বললে, কোনও চিন্তা নেই, আপনি ওই পিছনের ঘরে যান, মোটা পর্দা আছে, কিছু দেখা যাবে না। শ্রীবিশ্বাস চলে গেলে আপনি আবার এ ঘরে আসবেন।
মাণ্ডবী তাড়াতাড়ি পিছনের ঘরে গেল এবং পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আড়ি পাততে লাগল।
বরুণ বিশ্বাস ঘরে ঢুকে বললেন, মিস্টার হোমের সঙ্গে আমার কথা আছে, অত্যন্ত প্রাইভেট।
সরলাক্ষ বললে, আমিই সরলাক্ষ হোম, ইনি আমার কোলীগ ডাক্তার বটুক সেন। এঁর সামনে আপনি স্বচ্ছন্দে সব কথা বলতে পারেন।
বরুণ তবু ইতস্তত করছে দেখে বটুক বললে, মিস্টার বিশ্বাস, আপনি সংকোচ করবেন না। শার্লক হোমসের জুড়িদার যেমন ডাক্তার ওআটসন, সরলাক্ষ হোমের তেমনি ডাক্তার বটুক সেন—এই আমি। তবে আমি ওআটসনের মতন হাঁদা নই। আপনিই বাঁদর দপ্তরের কর্তা তো?
বরুণ বললে, আমি হচ্ছি ডিরেক্টর অভ মংকি ডিপোর্টেশন। সরলাক্ষবাবু, আমি একটি অত্যন্ত ডেলিকেট ব্যাপারের জন্য আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছি।
সরলাক্ষ বললে, কিছু ভাববেন না, আপনি খোলসা করে সব কথা বলুন।
—শ্রীগদাধর ঘোষের নাম শুনেছেন তো? তাঁর মেয়ে মাণ্ডবীর সঙ্গে আমার বিবাহ বহু কাল থেকে স্থির হয়ে আছে।
—চমৎকার সম্বন্ধ, কংগ্রাটস মিস্টার বিশ্বাস।
—কিন্তু আমি অন্য একটি মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছি।
—বেশ তো, তাঁকেই বিবাহ করুন না।
—তাতে বিস্তর বাধা। শ্রীগদাধর আমার পিতৃবন্ধু, ছেলেবেলার অভিভাবক, এখনও মুরুব্বী। তিনিই আমার চাকরিটি করে দিয়েছেন, চটে গেলে তিনিই আমাকে তাড়াতে পারেন। অথচ তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে আমি বিস্তর সম্পত্তি পাব, চাকরিও বজায় থাকবে।
—তবে তাঁর মেয়েকেই বিয়ে করুন না।
—দেখুন, মাণ্ডবীকে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, তাকে ছোট বোন মনে করতে পারি, কিন্তু তার সঙ্গে প্রেম হওয়া অসম্ভব।
—দেখতে বিশ্রী বুঝি?
—ঠিক বিশ্রী হয়তো নয়, কিন্তু আমার পছন্দর সঙ্গে একদম মেলে না। মোটাসোটা গড়ন, ডলিপুতুলের মতন টেবো টেবো গাল। ফোর্থইয়ারে পড়ছে বটে, কিন্তু চালচলন সেকেলে, স্মার্ট নয়, ভুল ইংরিজী বলে। এখনও জরির ফিতে দিয়ে খোঁপা বাঁধে, এক গাদা গহনা পরে জুজুবুড়ী সাজে।
—যাঁকে ভালবেসে ফেলেছেন তিনি কেমন?
—খঞ্জনা? ওঃ, সুপর্ব, চমৎকার। মেমের মতন ইংরিজী বলে, তার সঙ্গে মাণ্ডবীর তুলনাই হয় না।
সরলাক্ষ বললে, দেখুন মিস্টার বরুণ বিশ্বাস, আপনার ইচ্ছেটা বুঝেছি। আপনি চাকরি বজায় রাখতে চান, গদাধরবাবুর সম্পত্তিও চান, অথচ তাঁর কন্যাকে চান না। এই তো?
বরুণ মাথা নীচু করে বললে, সমস্যাটা সেইরকমই দাঁড়িয়েছে বটে। কোন উপায় বলতে পারেন?
সরলাক্ষ বললে, একটা খুব সোজা উপায় বাতলাতে পারি। আপনি হিন্দু তো? এখনও বহু—বিবাহ—নিষেধের আইন পাস হয় নি। শ্রীগদাধরের কন্যাকে বিবাহ করে ফেলুন, যত পারেন সম্পত্তি আদায় করেন নিন। ছ মাস পরে মিস খঞ্জনাকেও বিবাহ করবেন, তাঁকেই সুয়োরানীর পোস্ট দেবেন?
বরুণ বললে, আপনি গদাধর ঘোষকে জানেন না, ধড়িবাজ দুর্দান্ত লোক। সম্পত্তি যা দেবার তিনি মেয়েকেই দেবেন। খঞ্জনাকে বিয়ে করলে তৎক্ষণাৎ আমার চাকরিটি খাবেন আর মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন।
বটুক সেন বললে, আমি একটি ডাক্তারী উপায় বলছি শুনুন। মিস মাণ্ডবীকে বিয়ে করে ফেলুন। আপনাকে দু পুরিয়া আর্সেনিক দেব, একটা শ্বশুরকে আর একটা শ্বশুর—কন্যাকে চায়ের সঙ্গে খাওয়াবেন। দুজনেই পঞ্চত্ব পেলে সম্পত্তি আপনার হাতে আসবে, চাকরিও থাকবে, তখন মিস খঞ্জনাকে দ্বিতীয় পক্ষে বিয়ে করবেন।
—বিষ দিতে বলছেন?
আর্সেনিকে আপত্তি থাকলে কলেরা জার্ম দিতে পারি, কাজ সমানই হবে।
বরুণ রেগে গিয়ে বললে, আপনাদের সঙ্গে ইয়ারকি দিতে এখানে আসি নি, আমার সময়ের মূল্য আছে।
সরলাক্ষ বললে, না না রাগ করবেন না, আপনার প্রবলেমটি বড় শক্ত কিনা তাই বটুক—দা একটু ঠাট্টা করেছেন। আমি বলি শুনুন—আপনার আকাঙ্ক্ষাটি বড্ড বেশী নয় কি? কিছু কমিয়ে ফেলুন, দুধও খাবেন তামাকও খাবেন তা তো হয় না।
—আচ্ছা, সম্পত্তির আশা না হয় ছেড়ে দিচ্ছি। আপনি এমন উপায় বলতে পারেন যাতে মাণ্ডবীর সঙ্গে আমার বিয়ে ভেস্তে যায় অথচ চাকরির ক্ষতি না হয়, অর্থাৎ গদাধর ঘোষ রাগ না করেন?
—আমাকে একটু সময় দিন, ভেবে চিন্তে উপায় বার করতে হবে। আপনি সাত দিন পরে আসবেন। ফী জানতে চান? আজ ষোল টাকা দিন, তার পর কাজ উদ্ধার হলে তার গুরুত্ব বুঝে আরও টাকা দেবেন।
বরুণ টাকা দিয়ে চলে গেল।
মাণ্ডবী পর্দা ঠেলে ঘরে এল। তার গা কাঁপছে, মুখ লাল, চোখ ফুলো ফুলো, দেখেই বোঝা যায় যে জোর করে কান্না চেপে রেখেছে।
বটুক সেন বললে, একি মিস ঘোষ, আপনি বড্ড আপসেট হয়ে পড়েছেন দেখছি। স্থির হয়ে বসুন, দু মিনিটের মধ্যে একটা ওষুধ নিয়ে আসছি।
মাণ্ডবী বললে, ওষুধ চাই না, একটু জল।
সরলাক্ষ তাড়াতাড়ি এক গ্লাস জল এনে দিলে। মাণ্ডবী চোখে মুখে জল দিয়ে ভাঙা গলায় বললে, সরলাক্ষবাবু, আর কিচ্ছু করবার দরকার নেই, বরুণদাকে আমি বিয়ে করব না।
সরলাক্ষ বললে, না না, ঝোঁকের মাথায় কোনও প্রতিজ্ঞা করবেন না। অপনার বাবা খুব খাঁটী কথা বলেছেন, বিয়ে হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি—খঞ্জনার খপ্পর থেকে আপনার বরুণদাকে উদ্ধার করবই। যদি তিনি অনুতপ্ত হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চান তবে তাঁকে বিয়ে করবেন না কেন?
সজোরে মাথা নেড়ে মাণ্ডবী বললে, না না না। আমি মুটকী ধুমসী, আমি সেকালে মুখখু জুজ বুড়ী, আর খঞ্জনা হচ্ছে বিদ্যাধরী—
—ও, আপনি বুঝি আড়ি পাতছিলেন। ভেরি ব্যাড। ওসব কথায় কান দেবেন না, বাঁদরের কর্তা হয়ে আপনার বরুণদা বাঁদুরে বুদ্ধি পেয়েছেন, খঞ্জনার মোহে পড়ে যা তা বলছেন। মোহ কেটে গেলেই আপনার কদর তিনি বুঝবেন। আপনি হচ্ছেন সেই কালিদাস যা বলেছেন—পর্যাপ্ত— পুষ্পস্তবকাবনম্রা সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতা, আপনি হচ্ছেন—শ্রোণীভারাদলসগমনা, স্তোকনম্রা—
—চুপ করুন, অসভ্যতা করবেন না। এই নিন আপনার ষোল টাকা, আমি চললুম।
সরলাক্ষ হাতজোড় করে বললেন, মাণ্ডবী দেবী, মন শান্ত করুন, ধৈর্য্য ধরুন। যত শীঘ্র পারি খঞ্জনাকে তাড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করব, দোহাই আপনার, তত দিন কিছু করে বসবেন না।
মাণ্ডবী নমস্কার করে চলে গেল। বটুক বললেন, নাও, ঠেলা সামলাও এখন। সবাই দেখছি ভীষণ, খঞ্জনা ভীষণ বদমাশ, বরুণ—দা ভীষণ বোকা আর মাণ্ডবী ভীষণ ছেলেমানুষ। পাত্রী একদিকে যাচ্ছেন, পাত্র আর একদিকে যাচ্ছেন, কার মন রাখবে? আবার পাত্রীর বাপ আসছেন, তিনি কি চান কে জানে।
সন্ধ্যা সাতটায় শ্রী গদাধর ঘোষ প্রকাণ্ড মোটরে চড়ে উপস্থিত হলেন। সরলাক্ষ খুব খাতির করে তাঁকে নিজের খাস কামরায় নিয়ে গিয়ে বসালে এবং বটুকের পরিচয় দিলে।
পকেট থেকে বিজ্ঞাপনটা বার করে শ্রীগদাধর একটু হেসে বললেন, খাসা ব্যবসা খুলেছেন সরলাক্ষবাবু। ডেলিকেট ব্যাপারে মতলব দিতে পারে এমন একজন তুখড় চৌকশ লোকের বড়ই অভাব ছিল। আপনি বিজ্ঞাপনে ঠিকই লিখেছেন, ডাক্তার উকিল পুলিস জ্যোতিষী গুরু—এদের কি সব কথা বলা চলে, নাকি এরা সব সমস্যার সমাধান করতে পারে? আপনার তো বয়স বেশী নয়, ব্যবসাটি শিখলেন কোথায়? ডিগ্রী কিছু আছে?
সরলাক্ষ বললে, আমি হচ্ছি সাউথ আমেরিকার মায়া—আজটেক—ইংকা ইউনিভার্সিটির পিএচ.ডি, আমার রিসার্চের জন্য সেখানকার অনারারী ডিগ্রী পেয়েছি। বাগবাজার বিবুধ সভাও আমাকে বুদ্ধিবারিধি উপাধি দিয়েছেন।
—বেশ বেশ। এখন আমার মুশকিলটা শুনুন।
শ্রীগদাধর তাঁর মুশকিলটা সবিস্তারে বিবৃত করে অবশেষে বললেন, আপনি ওই খঞ্জনা মাগীর কবল থেকে বরুণকে চটপট উদ্ধার করে দিন, আমার মেয়েটা বড়ই মনমরা হয়ে আছে।
সরলাক্ষ বললে, আপনার তো শুনেছি খুব প্রতিপত্তি, মন্ত্রীরা আপনার কথায় ওঠেন বসেন। আপনি মনে করলেই খঞ্জনাকে আণ্ডামানে বদলী করতে পারেন।
—সেটি হবার জো নেই। খঞ্জনা হচ্ছে চতুর্ভুজ খাবলদারের তৃতীয় পক্ষের শালী। চতুর্ভুজকে চটানো আমার পলিসি নয়, আমার ছেলে দিল্লিতে তারই কম্পানিতে কাজ করে।
—বরুণকে দূরে বদলী করিয়ে দিন।
—সে কথা আমি যে ভাবিনি এমন নয়। কিন্তু বিচ্ছেদের ফলে প্রেম যে আরও চাগিয়ে উঠবে, চিঠিতে লম্বা লম্বা প্রেমালাপ চলবে, তার কি করবেন?
—তারও উপায় আছে। অন্য কারও সঙ্গে চটপট খঞ্জনার বিয়ে দিতে হবে।
—খেপেছেন? খঞ্জনা আমাদের ফরমাশ মত বিয়ে করবে কেন?
—জুতসই পাত্র পেলেই করবে। শুনুন সার—বরুণকে দূরে বদলী করান, তার জায়গায় এমন একজন বহাল করুন যে খঞ্জনাকে বিয়ে করতে রাজী আছে।
—কোথায় পাব এমন লোক?
বটুককে ঠেলা দিয়ে সরলাক্ষ বললে, কি বল বটুক—দা?
বটুক প্রশ্ন করলে, মাইনে কত?
শ্রীগদাধর বললেন, তা ভালই, আড়াই হাজার।
সরলাক্ষ বললে, রাজী আছ বটুক—দা? এমন চাকরি পেলে খঞ্জনাকে আত্মসাৎ করতে পারবে না?
—খুব পারব, খঞ্জনা গঞ্জনা ঝঞ্জনা কিছুতেই আমার আপত্তি নেই।
শ্রীগদাধর বললেন, বরুণকে ছেড়ে খঞ্জনাকে বিয়ে করতে চাইবে কেন? চাকরি বদল যত সহজে হয় প্রেমের বদল তত সহজে হয় না।
বটুক বললেন, সেজন্য আপনি ভাববেন না স্যর, আমি খঞ্জনাকে ঠিক পটিয়ে নেব।
—কিন্তু জন্তুর সায়েন্স না জানলে তো বানর—নির্বাসন—অধিকর্তা হতে পারবে না। তুমি তো নাড়ী—টেপা ডাক্তার?
সরলাক্ষ বললেন, শুনুন স্যার। এমন বিদ্যে নেই যা ডাক্তাররা শেখে না, ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বটানি জোঅলজি আরও কত কি। নয় বটুক—দা?
বটুক বললে, নিশ্চয়। জোঅলজি, বিশেষ করে মংকিলজি, আমার খুব ভাল রকম জানা আছে।
গদাধর একটু ভেবে বললেন, বেশ, কালই আমি মিনিস্টার ইন চার্জকে বলব। কিন্তু প্রথমটা টেম্পোরারি হবে, যদি দুমাসের মধ্যে খঞ্জনাকে বিয়ে করতে পার তবেই চাকরি পাকা হবে, নয়তো ডিসমিস।
বটুক বলে, দু মাস লাগবে না, এক মাসের মধ্যেই আমি তাকে বাগিয়ে নেব।
গদাধর বললে, বেশ। বড় আনন্দ হল তোমাদের সঙ্গে আলাপ করে। কাল আমাকে একবার দিল্লি যেতে হবে, গিন্নীকে ছেলের কাছে রেখে আসব, পাঁচ দিন পরে ফিরব। তার পরের রবিবারে বিকেল চারটার সময় তোমরা আমার বাড়িতে চা খাবে, কেমন? আমার মেয়ে মাণ্ডবীর সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেব।
সরলাক্ষ আর বটুক সবিনয়ে বললেন, যে আজ্ঞে!
শ্রীগদাধরের সুপারিশের ফলে তিন দিনের মধ্যে বরুণের জায়গায় বটুক সেন বাহাল হল এবং বরুণ দহরমগঞ্জে বদলী হয়ে গেল। তার নতুন পদের নাম— কুক্কুটাণ্ড—বিবর্ধন—পরীক্ষা—সংস্থা—আযুক্তক, অর্থাৎ অফিসার ইন চার্জ হেনস এগ এনলার্জমেণ্ট এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশন।
নির্দিষ্ট দিনে সরলাক্ষ আর বটুক গদাধরবাবুর বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেল। গদাধর বললেন, এই যে, এস এস। ওরে মাণ্ডবী, এদিকে আয়। এই ইনি হচ্ছেন শ্রীসরলাক্ষ হোম, মুশকিল আসান এক্সপার্ট। আর ইনি ডাক্তার বটুক সেন, আমাদের নতুন বানর—নির্বাসন—অধিকর্তা। খাসা লোক এঁরা।
নমস্কার বিনিময়ের পর বটুক বললে, সার, একটি অপরাধ হয়ে গেছে, আপনাকে আগে খবর দেওয়া উচিত ছিল, বড্ড তাড়াতাড়ি হল কিনা তাই পারি নি, মাপ করবেন। শ্রীমতী খঞ্জনার সঙ্গে কাল আমার শুভ পরিণয় হয়ে গেছে।
বটুকের পিঠ চাপড়ে, শ্রীগদাধর বললেন, জিতা রহো, বাহবা, বাহবা, বলিহারি, শাবাশ! আমরা ভারী খুশী হলুম শুনে, কি বলিস মাণ্ডবী? খেতে শুরু কর তোমরা, আমি চট করে গিন্নীকে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিয়ে আসছি।
মাণ্ডবী বটুককে বললেন, ধন্য রুচি আপনার, বাবার কাছে ঘুষ খেয়ে সেই শূর্পনখাটাকে বিয়ে করে ফেললেন! খঞ্জনাই বা কি রকম মেয়ে, দু দিনের মধ্যে বরুণ—দাকে ভুলে গিয়ে আপনার গলায় মালা দিলে?
সরলাক্ষ বললেন, তিনি অতি সুবুদ্ধি মহিলা, বরুণ—দার চাকরিটি মারেন নি, বটুক—দার চাকরি পাকা করে দিয়েছে, আমারও মুখরক্ষা করেছেন।
মাণ্ডবী বললেন, আপনারা আবার কি করলেন?
—আপনাকে কথা দিয়েছিলুম দুজনের মধ্যে ভীষণ ঝগড়া বাধিয়ে দেব, মনে নেই? আপনি শুনে খুশী হবেন খঞ্জনা বউ—দি মিস্টার বরুণকে ভীষণ গালাগালি দিয়ে একটি চিঠি লিখেছেন, আমিই সেটা ড্রাফট করে দিয়েছি। এখন আপনার লাইন ক্লিয়ার। যদি বরুণ—দাকে আপনি একটি মোলায়েম চিঠি লেখেন তবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ফী—এর বাকী টাকাটা আপনাকে আর দিতে হবে না, আপনার বাবাই তো শোধ করবেন।
—উঃ, আপনাদের কি কোনও প্রিনসিপল নেই, সেন্টিমেণ্ট নেই, হৃদয় নেই, শোভন অশোভন জ্ঞান নেই? কি ভীষণ মানুষ আপনারা! মাপ করবেন, আপনাদের কাণ্ড দেখে হতভম্ব হয়ে যা তা বলে ফেলেছি।
গদাধরবাবু তার পাঠিয়ে ফিরে এলেন। অনেকক্ষণ নানা রকম আলাপ চলল, তার পর সরলাক্ষ আর বটুক চলে গেল।
পরদিন বরুণের কাছ থেকে মাণ্ডবী একটা আট পাতা চিঠি পেলে।
এখানেই থামা যেতে পারে, কারণ এর পরে যা হল তা আপনারা নিশ্চয় আন্দাজ করতে পেরেছেন। কিন্তু এমন পাঠক অনেক আছেন যাঁরা নায়ক নায়িকার একটা হেস্তনেস্ত না দেখলে নিশ্চিত হতে পারেন না। তাঁদের অবগতির জন্য বাকীটা বলতে হল।
সন্ধ্যার সময় শ্রী গদাধর সরলাক্ষর কাছে এলেন। সে একাই আছে, বটুক সস্ত্রীক সিনেমায় গেছে। গদাধর বললেন, ওহে সরলাক্ষ, এ তো মহা মুশকিলে পড়া গেল! মাণ্ডবীকে বরুণ মস্ত একটা চিঠি লিখেছে, বেশ ভাল চিঠি, খুব অনুতাপ জানিয়ে অনেক কাকুতি মিনতি করে ক্ষমা চেয়েছে। আমিও অনেক বোঝালুম, কিন্তু মাণ্ডবী গোঁ ধরে বসে আছে—বাঙালে গোঁ, তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। চিঠিখানা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বললে, ছুঁচোকে আমি বিয়ে করতে পারব না। বাবা সরলাক্ষ, তুমি কালই তার সঙ্গে দেখা করে বুঝিয়ে ব’লো। বরুণের মতন পাত্র লাখে একটা মেলে না। তোমার অসাধ্য কাজ নেই, মাণ্ডবীকে রাজী করাতে যদি পার তো তোমাকে খুশী করে দেব।
সরলাক্ষ বললে, যে আজ্ঞে, আমি তার সঙ্গে দেখা করে সাধ্য মত চেষ্টা করব।
পরদিন শ্রীগদাধর সরলাক্ষকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল হে, রাজী করাতে পারলে?
—উঁহু, বরুণের উপর ভীষণ চটে গেছেন, শুধু ছুঁচো নয়, মীন মাইণ্ডেড মংকিও বলেছেন। আমার মতে চটপট তাঁর অন্যত্র বিবাহ হওয়া দরকার, নয়তো মনের শান্তি ফিরে পাবেন না। দারুণ একটা শক পেয়েছেন কিনা। তাঁর হৃদয়ে যে ভ্যাকুয়ম হয়েছে সেটা ভরতি করাতে হবে।
—কিন্তু এত তাড়াতাড়ি অন্য লোককে বিয়ে করতে রাজী হবে কেন? ভাল পাত্রই বা পাই কোথা?
—যদি অভয় দেন তো নিবেদন করি। অনুমতি পেলে নিজের জন্যে একটু চেষ্টা করে দেখতে পারি।
—তুমি! তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে কেন? ধর মাণ্ডবী রাজী হল, কিন্তু আমার হোমরা চোমরা আত্মীয় স্বজনের কাছে জামাইয়ের পরিচয় কি দেব? মুশকিল আসান অধিকর্তা বললে তো চলবে না, লোকে হাসবে।
—আপনার কৃপা হলেই আমি একটা বড় পোস্ট পেয়ে যেতে পারি, আপনার জামাইএর উপযুক্ত।
কোন কাজ পারবে তুমি?
সরকার তো হরেক রকম পরিকল্পনা করছেন, মাটির তলায় রেল, শহরের চারদিক ঘিরে চক্রবেড়ে রেল, সমুদ্র থেকে মাছ, ড্রেনের ময়লা থেকে গ্যাস, আরও কত কি। আমিও ভাল স্কীম বাতলাতে পারি।
—বল না একটা।
—এই ধরুন, উপকণ্ঠ—গির্যাশ্রম।
—সে আবার কি, গির্জে বানাতে চাও নাকি?
—আজ্ঞে না। গিরি—আশ্রম হল গির্যাশ্রম, উপকণ্ঠ—গির্যাশ্রম মানে সাবর্বান হিল স্টেশন। সহজেই হতে পারবে। কলকাতার কাছে লম্বা চওড়ায় এক শ মাইল একটা জমি চাই, তাতে প্রকাণ্ড একটা লেক কাটা হবে, তার মাটি স্তূপাকার করে লেকের মধ্যিখানে দশ—বারো হাজার ফুট উঁচু একটা পিরামিড বা কৃত্রিম পাহাড় তৈরি হবে। দার্জিলিং যাবার দরকার হবে না, পাহাড়ের গায়ে আর মাথায় একটি চমৎকার শহর গড়ে উঠবে, বিস্তর সেলামী দিয়ে লোকে জমি লীজ নেবে। আঙুর আপেল পীচ আখরোট বাদাম কমলালেবু ফলবে, নীচের লেকে অজস্র মাছ জন্মাবে। পাহাড়ের মাথা থেকে বিনা পয়সায় বরফ পাবেন, ঢালু গা দিয়ে আপনিই হড়াক করে নেমে আসবে—
—চমৎকার, চমৎকার, আর বলতে হবে না। কালই আমি মিনিস্টার ইন চার্জ অভ ল্যাণ্ড আপলিফটের সঙ্গে কথা বলব। কিন্তু তোমার পোস্টের নামটা কি হবে?
—পরিকল্পন—মহোপদেষ্টা, অর্থাৎ অ্যাডভাইজার—জেনারেল অভ স্কীমস। সাড়ে তিন হাজার টাকা মাইনে দিলেই চলবে।
—নিশ্চিত থাক বাবাজী, চার—পাঁচ দিনের মধ্যেই আমি সব পাকা করে ফেলব। তুমি দেরি করো না, লেগে যাও, এখন থেকেই মাণ্ডবীকে বাগাবার চেষ্টা কর।
মাণ্ডবী অতি লক্ষ্মী মেয়ে, আর সরলাক্ষর প্রেমের প্যাঁচ অর্থাৎ টেকনিকও খুব উঁচুদরের। পাঁচ দিনের মধ্যেই সে মাণ্ডবীকে বাগিয়ে ফেললেন।
কিন্তু বরুণ বিশ্বাসের কি হল? তার কথা আর জিজ্ঞাসা করবেন না। তাকে বিয়ে করবার জন্যে একটা মাদ্রাজী, দুটো পাঞ্জাবী আর তিনটে ফিরিঙ্গী মেয়ে ছেঁকে ধরেছে, তা ছাড়া ওখানকার জজ—গিন্নী, ডেপুটি—গিন্নী আর উকিল—গিন্নীও নিজের নিজের আইবড় মেয়েদের বরুণের পিছনে লেলিয়ে দিয়েছেন। বেচারা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
১৩৬০ (১৯৫৩)