দ্বান্দ্বিক কবিতা

দ্বান্দ্বিক কবিতা

ভূপতি মুখুজ্যে এই আড্ডার নিয়মিত সদস্য নয়, মাঝে মাঝে আসে। সে কোন্নগরে থাকে কিন্তু কলকাতার সব খবর রাখে। আমুদে লোক, বয়স চল্লিশ হলেও ভাঁড়ামি করতে তার বাধে না।

আজ সন্ধ্যায় যতীশ মিত্রের আড্ডাঘরে ঢুকেই ভূপতি সেকেলে বিদ্যাসুন্দর যাত্রার ভঙ্গীতে সুর করে হাত নেড়ে বলল,

শুন—ন—গ—র—বা—আ—সি—গণ

আশ্চর্য খবর মহা সেনসে—শন

শুন ন—গ—র—

বৃদ্ধ পিনাকি সর্বজ্ঞ এখানে রোজ চা খেতে আসেন। বললেন, ফাজলামি রাখ, যা বলবার সোজা ভাষায় বল।

ভূপতি আবার সুর করে বলল,

আমাদের কবি ধূর্জটিচরণ

ছিরু ঘোষকে করেছে গুরু বরণ,

মার্কসীয় বৈষ্ণব মঠে নিয়েছে শরণ,

সব সম্পত্তি নাকি করিবে অর্পণ।

পিনাকী সর্বজ্ঞ বলিলেন, গাঁজা টেনে এসেছ নাকি? ছিরু ঘোষ লোকটা কে?

ভূপতি বলল, জানেন না? কমরেড শ্রীদাম ঘোষ, সম্প্রতি মঠস্বামী শ্রীদাম মহারাজ হয়েছেন?

—ওকে চিনি না, তবে তোমাদের কবি ধূর্জটিচরণকে বার কতক দেখেছি বটে, বছর দুই আগে যতীশের কাছে মাঝে মাঝে আসত। মার্কসীয় বৈষ্ণব মঠ আবার কি? জান নাকি যতীশ?

যতীশ মিত্র বলল,একটু আধটু জানি, কমরেড ছিরুর সঙ্গে এককালে আলাপ ছিল। আর ধূর্জটির সঙ্গে তো এক ক্লাসে পড়েছি, কিন্তু সে যে ছিরুর শিষ্য হয়েছে তা জানতুম না।

পিনাকী সর্বজ্ঞ বললেন, মার্কসীয় বৈষ্ণব মঠ নামটা যেন সোনার পাথরবাটি, কাঁঠালের আমসত্ত্ব। মার্কসের শিষ্যরা তো ঘোর নাস্তিক, তারা আবার বৈষ্ণব হল কবে?

যতীশ বলল, কালক্রমে সবাই বদলে যায়। ডবলু সি ব্যানার্জির সময় কংগ্রেস যা ছিল এখনও কি তাই আছে? লেনিন আর ট্রটস্কির পলিসি কি এখনও বজায় আছে? বেঁচে থাকলে আরও কত কি দেখবেন সর্বজ্ঞ মশাই। তান্ত্রিক ফাসিজম, মার্কিন অদ্বৈতবাদ, ভারতীয় সর্বাস্তিবাদ—

উপেন দত্ত বলল, হেঁয়ালি রাখ যতীশ—দা, মার্কসীয় বৈষ্ণব মঠ ব্যাপারটা কি বুঝিয়ে দাও।

যতীশ বলল, সব বৃত্তান্ত আমার জানা নেই, যতটুকু জানি তাই বলছি। ছেলেবেলা থেকেই ছিরুর একটু কমরেডী মতিগতি ছিল। কলেজ ছাড়ার পর সে একজন উগ্র সাম্যবাদী হয়ে উঠল, প্রতিপত্তিও খুব হল। শুনেছি শেষকালে সে ওদের দলের একজন কর্তা ব্যক্তি হয়েছিল। কিন্তু ছিরুর সঙ্গে পার্টির লোকদের মতের মিল হল না। তাদের গুরু রাশিয়া, কিন্তু ছিরু বলল, সব দেশে একই ব্যবস্থা চলতে পারে না। ভারতের লোক হচ্ছে ধর্মপ্রাণ, ধর্ম বাদ দিয়ে কোনও রাজনীতি এখানে দাঁড়াতেই পারে না। এই দেখ, বঙ্কিমচন্দ্র দেশকে মা—দুর্গা বানিয়েছিলেন। আমাদের অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের এক হাতে থাকত বোমা, আর এক হাতে গীতা। দেশবন্ধু কৃষ্ণপ্রেমী হয়ে পড়লেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র তান্ত্রিক সাধনা করতেন। শ্রী অরবিন্দ লাইফ ডিভাইন নিয়ে মেতে রইলেন। গান্ধীজী রঘুপতি রাঘবের নাম কীর্তন করতেন। গুরুজী গোলবালকরও রামভক্ত, যদিও তাঁর ভক্তি একটু দুসরী কিসিম কী। কমিউনিজম এদেশে জুত করতে পারছেন না তার কারণ এর কোনও ঐশ্বরিক অবলম্বন নেই। মহান স্তালিন, মহান মাও—সে—তুং বলে যতই চেঁচাও তাতে প্রাণ সাড়া দেবে না। ভক্তি চাই, অবতার চাই। সাম্যবাদকে ঢেলে সাজাতে হবে। ছিরু ঘোষ বিগড়ে গেছে দেখে পার্টির কর্তারা তাকে দল থেকে দূর করে দিল। কিন্তু ছিরু দমবার পাত্র নয়, অনেক বড়লোক ভক্ত জুটিয়েছে, তাদের টাকায় মার্কসীয় বৈষ্ণব মঠ প্রতিষ্ঠা করে নিজে মঠাধীশ শ্রীদাম মহারাজ হয়েছে। বড় বড় ব্যবসায়ীরা তাঁর পৃষ্ঠপোষক, শীঘ্রই সে অবতার হয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের ধূর্জটি কবির তো কোনও দিন ধর্মে বা পলিটিকসে মতি ছিল না, সে কি করে ছিরুর কবলে পড়ল বুঝতে পারছি না।

ভূপতি বলল, ছিরুর সব খবর আমি রাখি, ধূর্জটিরও নাড়ী নক্ষত্র জানি, সে দূর সম্পর্কে আমার শালা হয়। ছেলেবেলা থেকেই ধূর্জটি কবিতা লিখত, তার কবিখ্যাতি আছে, গোটাকতক বইও আছে। অনেক কবি যেমন করে থাকে সেই রকম ধূর্জটিও একটি মানসী প্রিয়া খাড়া করে তার উদ্দেশ্যে কবিতা লিখত।

উপেন দত্ত বলল, এর মানে আমি মোটেই বুঝতে পারি না। আমাদের ছোট বড় বিবাহিত অবিবাহিত যত কবি আছেন তাঁদের অনেকে একটি মনগড়া মেয়ের উদ্দেশ্যে কবিতা লেখেন? এতে তাঁদের কি লাভ হয়?

যতীশ বলল, শাস্ত্রে আছে, সাধকদের হিতের জন্য ব্রহ্মের রূপকল্পনা। কবিরা তেমনি প্রেমাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করবার জন্য একটি পরমা প্রেয়সীর কল্পনা করেন। এ একরকম তান্ত্রিক নায়িকাসাধনা।

পিনাকী বললেন, বাজে কথা। একে বলে মনে মনে ব্যভিচার। যাদের স্ত্রী নেই কিংবা স্ত্রী পছন্দ হয় না সেই সব কবিই মনগড়া নারীর সঙ্গে প্রেম করে।

উপেন বলল, সর্বজ্ঞ মশাই যা বললেন তা হয়তো ঠিক, যতীশ—দার কথাও ঠিক। কিন্তু কবিদের এইরকম প্রেমলীলার জন্য তাদের স্ত্রীরা চটে না কেন? মেয়ে কবিও তো ঢের আছে, তারা তো মনগড়া প্রেমিকের উদ্দেশ্যে কবিতা লেখে না।

যতীশ বলল, কেউ কেউ লেখে বই কি! তবে খুব কম, কারণ কায়মনোবাক্যে সতীধর্ম পালন করার সংস্কার এদেশের বেশীরভাগ মেয়ের এখনও আছে। পুরুষদের সে বালাই নেই। কবিদের স্ত্রীরা মনে করে, ছাগলে কি না খায়, কবিরা কি না লেখে, তাতে দোষ ধরলে চলে না।

ভূপতি বলল, কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে গণ্ডগোল বাঁধে, স্বামী—স্ত্রীর জীবন যাত্রায় ওলটপালট ঘটে, যেমন ধূর্জটিদের হয়েছে। ওদের সব খবরই আমি রাখি, বলছি শোন—

ধূর্জটি যখন ছোট তখনই তার বাপ—মা মারা যান, এক মামা তাকে নিজের কাছে রেখে পালন করেন। শিক্ষা শেষ করে ধূর্জটি তার মামার কারবারে যোগ দিল, দেদার কবিতাও লিখতে লাগল। তার পর তার বিয়ে হল। দ্বিজেন্দ্রলাল যেমন লিখেছেন ধূর্জটির ঠিক সেই রকম মনে হল— ভাবলাম বাহা! বাহা রে, কি রকম যে হয়ে গেলাম বলব তাহা কাহারে। এতদিন সে কাল্পনিক প্রিয়ার উদ্দেশ্যে কবিতা লিখত, এখন জীবন্ত প্রিয়ার ওপর লিখতে লাগল। বউয়ের শংকরী নামটা সেকেলে বলে ধূর্জটি বদলাতে চেয়েছিল, কিন্তু বউ রাজী হল না, বলল ও আমার জেঠামশায়ের দেওয়া নাম, বদলানো চলবে না; তোমার নামটাই বা কি এমন মধুর? অগত্যা সেকেলে শংকরীকেই সম্বোধন করে ধুর্জটি লিখতে লাগল—নন্দনের উর্বশী, পাতালপুরীর রাজকন্যা, সাগর থেকে ওঠা ভিনস, আমার হৃদয় যা চায় তুমি ঠিক তাই গো, এই সব।

কিছু কাল এই রকমে চলল, তার পর ক্রমশ ধূর্জটির হুঁশ হল মানসী প্রিয়ার সঙ্গে তার বিবাহিত প্রিয়ার মিল নেই। শংকরী কাব্যরস বোঝে না, তার মনে রোমান্স নেই। বিয়ের সময় সে আত্মীয় আর বন্ধুদের কাছ থেকে বিস্তর সস্তা উপহার পেয়েছিল। তার উদ্দেশ্যে লেখা ধূর্জটির কবিতাগুলোও যেন তার কাছে মামুলী উপহারের শামিল। সে সংসারের কাজ আর তার নবজাত খোকাকে নিয়েই ব্যস্ত। ধূর্জটি বেচারা আবার তার কাল্পনিক প্রিয়ার উদ্দেশ্যে চুটিয়ে কবিতা লিখতে লাগল আর শংকরী সাংসারিক কাজে ডুবে রইল।

তার পর হাঙ্গামা বাধাল বিশাখা। সে আমার খুড়তুতো শালী, অত্যন্ত ফন্দিবাজ মেয়ে, ধূর্জটির বউ শংকরীর সঙ্গে এক কলেজে পড়ছিল। তার স্বামী নরেশ ইঞ্জিনিয়ার, আগে কাঁচরাপাড়ায় কাজ করত, তারপর বদলী হয়ে কলকাতায় এল, ধূর্জটির বাড়ির পাশেই বাসা করল। বিশাখাকে কাছে পেয়ে শংকরী খুব খুশী হল।

একদিন বিশাখা বলল, তোমার বর তো একজন বিখ্যাত কবি। আজকাল কবিতার বই কেউ কেনে না, কিন্তু ধূর্জটিবাবুর বই বেশ বিক্রি হয় শুনেছি। আচ্ছা, উনি কার উদ্দেশ্যে অত প্রেমের করিতা লেখেন? তোমার জন্যে নিশ্চয় নয়, তা হলে ‘স্বপ্নে দেখা অচিন প্রিয়া’ এই সব লিখতেন না।

শংকরী বলল, কারও উদ্দেশ্যে লেখে না। কবিরা খেয়ালী লোক, মনগড়া একটা কিছু খাড়া করে তার উদ্দেশ্যে লেখে।

—সত্যি বা মনগড়া যাই হক, তোমার রাগ হয় না?

—ও সব আমি গ্রাহ্য করি না।

—এ তোমার ভারী অন্যায়, এরপর পস্তাতে হবে। আর দেরি নয়, এখন থেকে স্টেপ নাও।

—কি করতে বল তুমি?

—একটা মনগড়া পুরুষের উদ্দেশে তুমিও কবিতা লিখতে শুরু কর।

—রাম বল। কবিতা লেখা আমার আসে না, আর লিখলেই বা ছাপবে কে?

—সে তুমি ভেবো না। ‘নিস্যন্দিনী’ পত্রিকা দেখেছ তো? তার সম্পাদক তরণী সেন আমার দেওর রমেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তোমার লেখা ছাপাবার ব্যবস্থা আমি করে দেব। আর কবিতা লেখা খুব সোজা, দেদার চুরি করবে, ওখান থেকে এক লাইন এখান থেকে এক লাইন নেবে, তার সঙ্গে নিজের কিছু জুড়ে দেবে। এখন গদ্য কবিতার যুগ, মিলের ঝঞ্ঝাট নেই, যা খুশি এলোমেলো করে সাজিয়ে দিলেই গদ্য কবিতা হয়ে যায়।

বিশাখার জেদের ফলে শংকরী রাজী হল। দুজনে মিলে একটি কবিতা খাড়া করল, বিশাখার দেওর রমেশ সেটা তরণী সেনের কাছে নিয়ে গেল।

তরণী বলল, আরে ছ্যা, একে কি কবিতা বলে। ‘ওগো আমার বধূ, তুমি ডুমুর ফুলের মধু!’এ রকম সেকেলে কাঁচা লেখা ছাপলে আমার পত্রিকা কেউ পড়বে না।

রমেশ তার বউদিদির সঙ্গে পরামর্শ করে তৈরি হয়েই গিয়েছিল। বলল, আচ্ছা তরণী, তোমার পত্রিকার লাভ কত হয়?

—লাভ কোথায়, এখনও ঘর থেকে গচ্চা দিতে হয়।

—তবে বলি শোন। প্রতি মাসে আমি পাঁচ—ছটা কবিতা আনব, প্রত্যেকটি ছাপবার জন্যে পাঁচ টাকা হিসেবে দেব। তাতে পঁচিশ—তিরিশ টাকা পাবে। রাজী আছ?

তরণী সেন বলল, তা মন্দ কি, কাগজের খরচটা তো উঠবে। টাকা পেলে প্রতি সংখ্যায় দশটা কবিতা ছাপতে রাজী আছি। কিন্তু দেখো ভাই, নিতান্ত রাবিশ না হয়।

—আরে না না। শংকরী দেবীর নামে ছাপা হবে বটে, কিন্তু বেশীর ভাগ আমার বউদিই লিখবেন। তাঁর হাত খুব পাকা।

নিস্যন্দিনী পত্রিকায় শংকরী দেবীর নামে কবিতা ছাপা হতে লাগল। তা দেখে ধূর্জটির মনে কিঞ্চিত কৌতূক আর করুণার উদয় হল। সে তার স্ত্রীকে বলল, বেশ তো, শখ যখন হয়েছে লিখতে থাক। এখন বড্ড কাঁচা, লিখতে লিখতে হাত পাকতে পারে। চাও তো আমি সংশোধন করে দিতে পারি। শংকরী বলল, না, না, তোমায় কিছু করতে হবে না, যা পারি আমিই লিখব। বদনাম হয় তো আমারই হবে, তোমার ক্ষতি হবে না।

শংকরী দেবীর কবিতা ক্রমশ কাঁচা থেকে পাকা, ঠাণ্ডা থেকে গরম এবং গরম থেকে গরমতর হতে লাগল। পাঠকরা বলল, কি চমৎকার! একজন আধুনিক সমালোচক লিখলেন—এক অনাস্বাদিতপূর্ব রসঘন কাব্যমধুরিমা, নারীর অন্তর্নিহিত ফলগুধারার স্বতঃউৎসারিত উৎস, এর তুলনা নেই। নিস্যন্দিনী পত্রিকার কাটতি হু হু করে বেড়ে গেল। তরণী সেনকে রমেশ বলল, আর টাকা দিচ্ছি না, এখন থেকে তুমিই দেবে, প্রতি কবিতায় দশ টাকা। ‘প্রগামিনী’র সম্পাদক অনুকূল চৌধুরী তাই দেবেন বলেছেন। তরণী বলল, আচ্ছা, আচ্ছা, শংকরী দেবী টাকা না হয় নাই দেবেন। কিন্তু দক্ষিণা দেবার সার্মথ্য এখনও আমাদের হয় নি, আরও কিছু দিন সবুর করতে হবে।

উপেন দত্ত বলল, শংকরী দেবীর কবিতা পড়েছি বলে মনে হয় না। আপিসের যা খাটুনি, সাহিত্য চর্চার ফুরসতই নেই। এই আড্ডায় এসে পাঁচ জনের মুখে যা একটু শুনতে পাই। আচ্ছা যতীশ—দা, তোমার কাছে নিস্যন্দিনী নেই?

যতীশ বলল, আমি পয়সা দিয়ে রাবিশ কিনি না।

ভূপতি বলল, শংকরী দেবীর কবিতা শুনতে চাও? কিছু কিছু আমার মনে আছে, বলছি শোন। একটা হচ্ছে এই রকম—

আমি চিনি গো চিনি তোমারে,

তুমি থাক মহাপ্রাচীরের এপারে।

কি মিষ্টি তোমার আধো আধো বুলি,

রুশকে বল লুশ, দু টাকাকে তু লুপি।

ওগো লাল চীনের জঙ্গী জওয়ান,

তোমার নয়ন বাঁকা, বর্ণ স্বর্ণচাঁপা,

সিল্কমসৃণ শ্যাময় লেদার তোমার চামড়া,

ওই নির্লোম বুকে ঠাঁই চাই ঠাঁই চাই।

আর একটা বলি শোন—

ও বিদেশী পাখতুনিস্তানবাসী,

তাগড়া জাক্কাখেল, আমি তোমায় ভালবাসি।

নর্ডিক নীল তোমার সূর্মা পরা চোখ,

সেমেটিক নাকের নীচে মোটা ছাঁটা গোঁফ।

তোমার লোমজঙ্গল বুকে টেনে নাও আমাকে,

ক্র্যাংক—শাফটের মতন দুই হাতে জাপটে ধর,

মড়মড়িয়ে ভেঙে দাও আমার পাঁজরা,

পিষে ফেল, পিষে ফেল।

এই সব কবিতা নিস্যন্দিনী পত্রিকায় দেদার ছাপা হতে লাগল। ‘কাঙ্ক্ষার ঝংকার’ নাম দিয়ে শংকরীর একটা কবিতাসংগ্রহ প্রকাশিত হল, তিন মাসের মধ্যেই তিনটে সংস্করণ ফুরিয়ে গেল। ধূর্জটি নিজের রচনা নিয়েই মেতে থাকত, তার বউ কি লিখছে, তা পড়ে লোকে কি বলছে, এ সব খবর রাখত না। একদিন তার এক সাহিত্যিক বন্ধু একখানা কাঙ্ক্ষার ঝংকার দেখিয়ে বলল, ওহে ধূর্জটি, এই শংকরী দেবী তোমারই গৃহিণী তো? ওঃ, ভদ্রমহিলা কি সব অদ্ভুত কবিতা লিখছেন, রেগুলার হট স্টফ। পড়ে তোমার মনে একটু ইয়ে হয় না? আমাদের সাইকোলজিস্ট প্রফেসার ভড় বলেছিলেন, এ হচ্ছে উদ্দাম লিবিডো।

ধূর্জটির ভাবনা হল। স্ত্রীর কাছ থেকে তার কবিতার বই চেয়ে নিয়ে খুব মন দিয়ে পড়ল। তার মেজাজ বিগড়ে গেল। শংকরীকে বলল, এ সব কি ছাই ভস্ম লেখা হচ্ছে? লোকে যে ছি ছি করছে।

শংকরী বলল, করুক গে ছি ছি, খুব বিক্রি তো হচ্ছে। আরও একখানা বই ছাপবার জন্যে প্রেসে দিয়েছি।

মাথা নেড়ে ধূর্জটি বলল, ওসব চলবে না বলছি।

—বা রে মজা! তুমি লিখলে দোষ হয় না, আর আমার বেলা দোষ! ওগো সর্বনাশী, আমি ভালবাসি তোমার ঠোঁটের ওই মোনালিসা হাসি’—তুমি এই সব ছাই ভস্ম লেখ কেন?

—আমার সঙ্গে তোমার তুলনা। কাল্পনিক রমণীর ওপর কবিতা লিখলে পুরুষের দোষ হয় না, কিন্তু মেয়েদের সে রকম লেখা অতি গর্হিত।

—বেশ, তুমি কবিতা লেখা বন্ধ কর, তোমার সব বই পুড়িয়ে ফেল, আমিও তাই করব।

ধূর্জটি রেগে আগুন হয়ে বেরিয়ে গেল।

উপেন দত্ত বলল, যত নষ্টের গোড়া আপনার শালী বিশাখা। খামকা এই ঝগড়া বাঁধিয়ে তার কি লাভ হল?

ভূপতি বলল, হুঁ, বিশাখার স্বামী নরেশও তাই বলেছে, খুব ধমকও দিয়েছে। তার পর শোন। শংকরীর কাছে সব কথা শুনে বিশাখা তার সখীর হয়ে লড়তে গেল। ধূর্জটিকে বলল, আপনার বুদ্ধি—সুদ্ধি লোপ পেয়েছে নাকি? ঘরে অমন সুন্দরী বউ থাকতে কোথাকার কে অচিন প্রিয়ার উদ্দেশ্যে আপনি কবিতা লেখেন কোন আক্কেলে? তাতে শংকরীর রাগ হবে না? শোধ তোলবার জন্যে সেও যদি ওই রকম লেখে তাতে অন্যায়টা কি মশাই?

ধূর্জটি বলল, তা বলে চীনেম্যান আর কাবলীওয়ালার উদ্দেশ্যে প্রেমের কবিতা লিখবে?

—আচ্ছা, আচ্ছা, এখন থেকে না হয় বাঙালী তরুণদের উদ্দেশ্যেই লিখবে। কিন্তু তার চাইতে ভাল—আপনি আজ থেকে নিজের গিন্নীর নামে কবিতা লিখুন, যেমন প্রথম প্রথম লিখতেন। আর সেও আপনার নামে লিখুক। এক বাড়িতে যখন বাস করছেন, দুইজনেই যখন কবি, তখন রেসিপ্রোসিটি না হলে চলবে কেন?

ধূর্জটি কিন্তু বুঝল না, তার মন অস্থির হয়ে উঠল। ভাল করে খায় না, ঘুমোয় না, আপিসের কাজেও মন দেয় না। এই অবস্থায় একদিন ছিরু ঘোষের সঙ্গে তার দেখা হল। ছিরু তখন মঠাধীশ মণ্ডলেশ্বর হাজার—আট—শ্রী হিজ হোলিনেস শ্রীদাম মহারাজ। দশ আঙুলে দশটা হীরের আংটি, বাসন্তী রঙের সিল্ক ভিন্ন পরে না। সে মিষ্টি মিষ্টি করে অনেক তত্ত্বকথা শোনাল, ধূর্জটি মুগ্ধ হল। ছিরু বলল, কোনও চিন্তা নাই, তোমার সমস্ত ক্ষোভ আমি দূর করে দেব, তোমরা স্বামী—স্ত্রীতে যাতে পরম শান্তি পাও তার ব্যবস্থা করব।

তারপর ছিরু ধূর্জটিকে যে লেকচারটি দিল তার সারমর্ম এই।—তোমাদের এই দাম্পত্যকলহ মার্কস—কথিত দ্বান্দ্বিক নিয়মেই হয়েছে। তুমি কাল্পনিক প্রিয়ার উদ্দেশে কবিতা লেখ, তাতে তোমার স্ত্রী চটে উঠল—এ হল থিসিস। তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ তোমার স্ত্রী কাল্পনিক পুরুষের উদ্দেশে লিখতে লাগল, তুমি চটে উঠলে—এ হল অ্যাণ্টিথিসিস। এখন দরকার সিন্থিসিস, তা হলেই সব মিটে যাবে। তোমরা দুজনে আমার মঠে চলে এস, নিত্য সৎকথা শোন, আর এই দুখানা বই দিচ্ছি, ভাল করে প’ড়ো—প্রেমসিন্ধুতরঙ্গভঙ্গিমা এবং ডায়ালেকটিক্যাল ভৈষ্ণভিজম। পড়লে যুগপৎ শ্রীকৃষ্ণে ঐকান্তিকী ভক্তি আর শ্রীমার্কসে অচলা নিষ্ঠা হবে। তারপর ধূর্জটি আর তার স্ত্রী মার্কসীয় মঠে চলে গেল।

যতীশ বললে, ধূর্জটি বোকা নয়, তবে কবিরা বড় সেণ্টিমেণ্টাল হয়, ভাবের ঝোঁকে অনেক সময় কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তার স্ত্রীও শুনেছি খুব চালাক মেয়ে। আমার বিশ্বাস ওরা বেশী দিন মঠে টিকতে পারবে না, শীঘ্রই অরুচি হয়ে যাবে।

ভূপতি মুখুজ্যে উঠে পড়ে বলল, তোমরা বস, আমি চললুম। কর্তাবাবুর খেয়াল হয়েছে কুর্মঅবতার যাত্রা শুনবেন, তারই বায়না দিতে শিবপুরে যেতে হবে। যে ছোকরা কূর্ম সাজে তার নাচ নাকি অতি অপূর্ব।

সাত দিন পরে ভূপতি আবার অড্ডায় উপস্থিত হয়ে হাত নেড়ে সুর করে বলল,

শুন ন—গ—র—বা—আ—সি—গণ

বিচিত্র খবর চিত্তচমৎকরণ।

আমাদের মিসেস ধূর্জটিচরণ

ছিরু ঘোষকে করেছেন দংশন,

আর ধূর্জটি দিয়েছে বেদম পিটন।

স্বামী—স্ত্রী করেছে স্বগৃহে গমন

আর ছিরুর হাতে হয়েছে সেপটি ভীষণ,

আর—জি—করে হবে অ্যাম্পুটেশন।

পিনাকী সর্বজ্ঞ বললেন, আঃ ভাঁড়ামি রাখ, সমস্ত কথা খোলসা করে বল।

ভূপতি বলল, খোলসা করেই তো বললুম। আচ্ছা ছন্দোবদ্ধ বাক্য যদি আপনাদের বোধগম্য না হয় তবে গদ্যতেই বলছি। ধূর্জটি আর তার স্ত্রী ফিরে এসেছে শুনে আজ সকালে ওদের ওখানে গিয়েছিলুম। বিশ্রী ব্যাপার। মঠে যাবার দিন কতক পরে ছিরু মহারাজ ওদের বলল, এখানে স্বামী—স্ত্রীর একত্র থাকা নিষিদ্ধ, মেয়েরা আর পুরুষরা আলাদা আলাদা মহলে বাস করবে, নতুবা সাধনার বিঘ্ন হবে। শ্যামসুন্দরই একমাত্র পুরুষ, শ্রীরাধাই একমাত্র নারী। স্ত্রীপুরুষ সকলেই রাধা—ভাবে ভাবিত হতে হবে, সেই হল আসল কমিউনিজম। তারপর একদিন শংকরীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে ছিরু বলল, শ্যাম সে পুরুষোত্তম পতি সে পুরুষাধম। আমার দেহেই শ্যামের অধিষ্ঠান হয়েছে। শ্রীরাধে, তুমি আমাকে ভজনা কর। হাত ধরে টানাটানি করতেই শংকরী চিৎকার করে উঠল, আর ছিরুর ডান হাতে এক ভীষণ কামড় বসিয়ে দিল। চিৎকার শুনে ধূর্জটি ছুটে এসে ছিরুকে বেদম কিল চড় লাথি লাগাল। মঠে মহা হইচই, ধূর্জটি আর তার স্ত্রী সোজা বাড়ি চলে গেল। তাদের মিটমাট হয়ে গেছে। শুনলুম ধূর্জটি কবিতা ছেড়ে দিয়ে সরল বীজগণিত রচনা করবে, আর শংকরী রবিবারের কাগজে নতুন রান্না লিখবে—কাঁকড়ার কচুরি, পেঁয়াজের পায়েস, এই সব।

যতীশ বলল, এই ব্যাপারের পর ছিরুর ভক্তরা বিগড়ে যায় নি?

—তা কেন যাবে, অবতারদের সবই তো লীলাখেলা।

—ছিরুর হাত সত্যিই অ্যাম্পুটেট করবে নাকি?

—ডাক্তারের যদি কর্তব্যজ্ঞান থাকে তবে নিশ্চয়ই করবে।

১৩৬২ (১৯৫৫)