[অসমাপ্ত । গল্পটির পেনসিলে লেখা খসড়া পাণ্ডুলিপি রাজশেখরের মৃত্যুর পরে পাওয়া যায়। লেখা অনেক আগের। শেষ করেন নি।]
মহাবীর প্রসাদ চৌধুরী—নাম অবাঙ্গালী হলেও লোকটি বাঙালী। তার উর্ধ্বতন তিন পুরুষ গোরক্ষপুরে বাস করতেন তাই ভাষায় আর আচার ব্যবহারে কিছু হিন্দী প্রভাব এসেছে। মহাবীর কলকাতায় এম. এ. ফিফথ ইয়ার পর্যন্ত পড়েছিল, সেই সময় থার্ড ইয়ারের ফুল্লরার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বাপের মৃত্যুর পর থেকে মহাবীর পড়া ছেড়ে দিয়ে হ্যারিসন রোডের পৈতৃক কাপড়ের দোকানটি চালাচ্ছে। সম্প্রতি ফুল্লরার সঙ্গে তার প্রেমোত্তর বিবাহ হয়েছে।
ফুল্লরার বাবা যদুগোপাল চন্দননগরে থাকেন, তিনি বনেদী বংশের সন্তান, কিন্তু এখন অবস্থা মন্দ হয়েছে। অনেক খরচ করে পাঁচ মেয়ের বিবাহ ভাল ঘরেই দিয়েছেন, দুজন সরকারী কর্মচারী, একজন অ্যাটর্নি, একজন প্রফেসর। শুধু ছোট জামাই মহাবীর দোকানদার। যদুগোপাল আগেকার চাল বদলাতে পারেন নি, তার ফলে তাঁর দেনা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। তিনি আশা করেন তাঁর দুই ছেলের ওকালতি আর ডাক্তরিতে ভাল পসার হবে এবং তারাই সব দেনা শোধ করবে।
একগুঁয়ে বলে মহাবীরের বদনাম আছে। শ্বশুরবাড়ির লোকেদের কাছে তাকে কিছু উপহাস আর গঞ্জনা সইতে হয়েছে। সে অনেক উপাধি পেয়েছে—খোট্টা, মেড়ো, ছাতুখোর, কাপড়াবালা, রামভকত, হনুমানজী ইত্যাদি। শালীরা বলেছে, তোমার দোকান তুলে দাও, একটা চাকরি যোগাড় করে নাও। ভগ্নিপতি কাপড় বিক্রী করে—এই পরিচয় দেওয়া যায় নাকি? স্ত্রী ফুল্লরার শাসনে তার কথাবার্তা অনেকটা দুরস্ত হয়েছে, এখন সে ঘৈলা লোটা গলাস কটোরা না বলে কলসী ঘটি গেলাস বাটি বলে।
যদুগোপালবাবুর বাড়িতে খুব আড়ম্বর করে জামাইষষ্ঠী হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি ফুল্লরা মহাবীরকে বলল, জামাইষষ্ঠী এসে পড়ল, আমি ছোড়দার সঙ্গে পরশু চন্দননগর যাচ্ছি। দিদিরা ত আগেই পৌঁছে গেছে। এবারকার ভোজে একটু বেশী ঘটা হবে। এখান থেকে দুজন বাবুর্চি যাবে, একগাড়ি আইসক্রীমও যাবে।
মহাবীর বলল, ঘটা করার কি দরকার। আমরা পাঁচটি জামাই কি পাঁচটি রাক্ষস যে ভূরিভোজন না করলে চলবে না? শ্বশুর মশায়ের তো শুনেছি মোটারকম দেনা আছে, এখন অনর্থক খরচ করাই অন্যায়। তুমি আর তোমার দিদিরা বারণ কর না কেন?
ফুল্লরা বলল, বছরের মধ্যে একটি দিন পাঁচ জামাই আর পাঁচ মেয়ে একত্র হবে, একটু ভাল খাওয়া দাওয়া করবে, জামাইকে তত্ত্ব পাঠানো হবে—এতে অন্যায়টা কি? তোমার দোকানদারি বুদ্ধি, কেবল মুনাফাই বোঝ। বংশের যা দস্তুর আছে তা কি ছাড়া যায়? দেনা তো সব বনেদী বংশেরই থাকে, তার জন্যে ভাববার কিছু নেই, আমার ভাইরা শোধ করবে।
মহাবীর বলল, আমার কিন্তু ঘোর আপত্তি আছে।
—খরচ করবেন আমার বাবা, তোমার মাথাব্যথা কেন? যেরকম একগুঁয়ে তুমি, জামাইষষ্ঠী বয়কট করবে না তো?
—নিমন্ত্রণ পেলে অবশ্যই রক্ষা করব, কিন্তু পোলাও কালিয়া চপ কাটলেট সন্দেশ রাবড়ি চর্ব্য—চূষ্য রাজভোগ খাব না।
—তবে খাবে কি, কচু না ছাতু?
—ছাতুই খাব।
—তোমার যেরকম বেয়াড়া গোঁ, ওখানে না যাওয়াই তোমার পক্ষে ভাল, একটা কেলেঙ্কারি করে বসবে। নিমন্ত্রণের চিঠি এলে একটা ছুতো করো, দোকানে কাজের চাপ, তাই যেতে পারব না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মহাবীর বলল, নিমন্ত্রণ এলে নিশ্চয়ই যাব, না এলেও যাব।
—দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করবে নাকি?
—দক্ষযজ্ঞে শিব নিজে যান নি, অনুচর বীরভদ্রকে পাঠিয়েছিলেন। সেরকম অনুচর আমার নেই, তাই নিজেই যাব। আমি কোনও উপদ্রব করব না, নিঃশব্দে অসহযোগ জানাবো।