আনন্দ মিস্ত্রী

আনন্দ মিস্ত্রী

বিশ্বকর্মা এঞ্জিনিয়রিং ওআর্কসের কর্তা রঘুপতি রায় নিবিষ্ট হয়ে একটি জটিল নকশা পর্যবেক্ষণ করছেন এমন সময় তাঁর কামরার দরজায় মৃদু ধাক্কা পড়ল। রঘুপতি বললেন, আসতে পার।

ফোরম্যান প্রসন্ন সামন্ত দরজা খুলে ঘরে এল। তার পিছনে আরও আট—দশ জন ঠেলাঠেলি করছে দেখে রঘুপতি বললেন, ব্যাপার কি?

প্রসন্ন বলল, আমাদের একটি আরজি আছে বাবু, এরা তাই নিবেদন করতে এসেছেন।

রঘুপতি বললেন, সবাই ভেতরে এস।

চল্লিশ বৎসর আগেকার কথা। এখনকার তুলনায় তখন ধনিক বেশী শোষণ করত, শ্রমিক বেশী শোষিত হত, কিন্তু কর্মী আর কর্মকর্তার মধ্যে হৃদ্যতার অভাব ছিল না। বিশ্বকর্মা কারখানার লোকে বলত, রঘুপতি রায় কড়া মনিব কিন্তু মানুষটা অবুঝ নয়, দয়ামায়া আছে।

কারখানায় নানা বিভাগ থেকে এক—এক জন এসেছে, কেরানী আর কারিগর দুইই উপস্থিত হয়েছে। রঘুপতি প্রশ্ন করলেন, কি চাও তোমরা?

ফোরম্যান প্রসন্ন সামন্ত মুখপাত্র হয়ে এসেছে, কিন্তু সে একটু তোতলা, মাঝে মাঝে কথা আটকে যায়। বাইসম্যান অনন্ত পালকে সামনে ঠেলে দিয়ে প্রসন্ন বলল, তুই বল রে অনন্ত, বেশ গুছিয়ে বলবি।

অনন্তর বয়স বাইশ—তেইশ, ছাত্রবৃত্তি পাস, সুশ্রী চেহারা, ঝাঁকড়া চুল, শখের যাত্রায় নায়ক সাজে, বেহালাও বাজায়। সে নমস্কার করে ঢোক গিলে বলল, আমাদের আরজিটা হচ্ছে সার—আনন্দ মিস্ত্রীকে জবাব দিতে হবে।

রঘুপতি আশ্চর্য হলেন। ফিটার মিস্ত্রী আনন্দ মণ্ডল অতি নিুণ কারিগর, সকল যন্ত্রেই তার সমান হাত, কোন কাজে কিছুমাত্র খুঁত রাখে না। বয়স বত্রিশ—তেত্রিশ, কথা কম বলে, নেশা করে না, অন্য দোষও শোনা যায় না। কারখানার সকলেই তাকে ভালবাসে, কেবল ফোরম্যান প্রসন্ন আর টার্নম্যান এককড়ির তার ওপর একটু ঈর্ষা আছে। আজ দল বেঁধে এতলোক আনন্দকে তাড়াতে চাচ্ছে কেন? রঘুপতি বললেন, তার অপরাধ কি?

একসঙ্গে কয়েকজন বলে উঠল, অতি বদ লোক বাবু, তার সঙ্গে আমরা কাজ করতে পারব না।

অনন্ত বলল, তোমরা চুপ কর, যা বলবার আমি বলছি। শুনুন সার। আনন্দ মিস্ত্রীর বউ আছে, বুড়ী নয়, কানা খোঁড়া নয়, কুচ্ছিতও নয়, কাজকর্মে তাঁর জুড়ি মেলে না। আমরা তাঁকে বউদিদি বউমা কাকী এই সব বলি। পাঁচ বছরের একটি ছেলে আর দু বছরের একটি মেয়েও আছে। আনন্দ তবু আর একটা বিয়ে করবে। খিদিরপুরের মেকেঞ্জি কোম্পানির কারখানায় মুকুন্দ মিস্ত্রী ছিলেন না? চৌকস কারিগর, খুব নাকডাক। আনন্দ তাঁর কাছে কাজ শিখেছিল। সেই মুকুন্দ ঘোষ মাস খানিক হল মারা গেছেন। তাঁরই মেয়েকে আনন্দ বিয়ে করবে, আসছে মাসেই বিয়ে। সামন্ত মশায় তাকে বিস্তর বুঝিয়েছেন—ছি ছি আনন্দ, এই কুবুদ্ধি ছাড়, তোমার ঘরে অমন সতীলক্ষ্মী রয়েছে, বিনা দোষে তাঁর ঘাড়ে একটা সতিন চাপাতে চাও কেন?

টার্নম্যান এককড়ি নশকর বলল, শুধু সতিন? শুনেছি সতিনের মাকে পর্যন্ত নিজের বাড়িতে এনে রাখবে। আনন্দর মতিচ্ছন্ন হয়েছে, আমাদের কোনও কথা শুনবে না, বিয়ে করবেই। তাই আমরা বললাম, আচ্ছা বিয়ে কর, কিন্তু সতীলক্ষ্মীর মনে যে কষ্ট দিচ্ছ সেই পাপ আমরা সইব না, ম্যানেজার বাবুকে বলে তোমার চাকরিটি মারব। আমাদের এতজনের কথা বাবু কখনও ঠেলবেন না।

রঘুপতি বললেন, আবার একটা বিয়ে করা আনন্দর খুবই অন্যায় হবে। আমি তাকে বোঝাবার চেষ্টা করব। কিন্তু সে যদি আমার কথা না শোনে তবে কি করতে পারি? আনন্দের সঙ্গে আমাদের শুধু কাজের সম্পর্ক, সে দুটো বিয়ে করছে কি চারটে বিয়ে করছে তার বিচারের অধিকার আমার নেই।

পাকা দাড়িওয়ালা টিণ্ডেল দিলাবর হুসেন কারখানার বয়লার—এঞ্জিন চালায়। সে এগিয়ে এসে বলল, এখতিয়ার আপনার জরুর আছে হুজুর, আপনি হলেন আমাদের ওআলিদ মায়—বাপ, আমাদের বেচাল দেখলে আপনি সাজা দেবেন।

রঘুপতি হেসে বললেন, ওহে দিলাবর, তোমাদের সমাজে তো চারটে বিবি ঘরে আনবার ব্যবস্থা আছে, তবে আনন্দর বেলা দোষ ধèছ কেন? হিন্দুমতে শুধু চারটে নয়, যত খুশি বিয়ে করা যেতে পারে।

রং—মিস্ত্রী বেলাত আলী বলল, সে কি একটা কাজের কথা হল বাবু মশায়? যার বিস্তর টাকা সে যত খুশি বিয়ে করলে কসুর হয় না, কিন্তু আমাদের মতন গরিব লোকের একটার বেশী জরু আনা খুব অন্যায়। মুসলমানদের মধ্যেও জাস্তি শাদির রেওয়াজ কমে আসছে। দু—চার জন সেকেলে লোক করছে বটে, কিন্তু হিঁদুর বাড়িতে তো বেশী বউ দেখা যায় না। যাদের যেমন রীতি তাই তো মানতে হবে বাবু। মুসলমান মুরগি খেতে পারে, কিন্তু হিঁদু কেন খাবে। হিঁদু কচ্ছপ খেতে পারে, কিন্তু মুসলমান কেন খাবে?

রঘুপতি বললেন, তোমরা সকলেই কি এই চাও যে আনন্দ যদি আর একটা বিয়ে করে তবে তাকে বরখাস্ত করতেই হবে?

সকলে একসঙ্গে বলে উঠল, হাঁ, তাই আমরা চাই, অন্যায় আমরা বরদাস্ত করব না।

রঘুপতি বললেন, আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। কারও নাম করব না, কিন্তু এই কারখানায় এমন লোক দু—তিন জন আছে যারা খুব নেশা করে, মাইনে পাবার পর তিন—চার দিন বুঁদ হয়ে কামাই করে, শুনেছি স্ত্রীকে মারধরও করে। তাদের তাড়াতে চাও না কেন?

এককড়ি নশকর বলল, সে তো বাবু মদের ঝোঁকে করে, নেশা ছুটে গেলেই আবার যে—কে—সেই সহজ মানুষ। কিন্তু বাড়িতে সতীলক্ষ্মী স্ত্রী থাকতে তার ঘাড়ে একটা সতিন চাপানো যে বারমেসে অষ্টপ্রহর জুলুম।

রঘুপতি বললেন, বেশ, তোমরা সবাই যখন একমত তখন আনন্দকে আমি বলব, আবার একটা বিয়ে করার মতলব ছাড়, না হয় চাকরি ছাড়।

সকলে তুষ্ট হয়ে নিজের নিজের কাজে ফিরে গেল।

যোগেন হাজরা এই কারখানার নকশা—বাবু অর্থাৎ ড্রাফটসম্যান, সে সকলের সব খবর রাখে। রঘুপতি তাকে ডেকে বললেন, ওহে যোগেন, ব্যাপারটা কি? আনন্দ হঠাৎ আর একটা বিয়ে করতে চায় কেন, আর আনন্দর বউ—এর ওপরেই বা কারখানা সুদ্ধ লোকের এত দরদ কেন?

যোগেন বলল, শুনেছি আনন্দের ছেলেবেলায় মা—বাপ মারা গেলে খিদিরপুরের মুকুন্দ মিস্ত্রীই তাকে মানুষ করে। আনন্দর যত কিছু বিদ্যে সব সেই মুকুন্দর কাছে শেখা। বামপন্থী স্ক্রু কাটা, ড্রিল দিয়ে চৌকো ছেঁদা করা, নরম লোহার ওপর কড়া ইস্পাতের ছাল ধরানো, এসব কাজ মুকুন্দর কাছেই আনন্দ শিখেছে, কারখানার আর কেউ এসব পারে না। গুরুর ওপরে আনন্দর ভক্তি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু স্ত্রী থাকতে মুকুন্দর মেয়েকে বিয়ে করবার কি দরকার বুঝি না। হয়তো কিছু গোলমাল আছে, কারখানার কেউ তা জানে না, আনন্দও কিছু ভাঙতে চায় না। আর, আনন্দর বউএর ওপর সকলের দরদ কেন জানেন? খুব পরোপকারী কাজের মেয়ে, যেমন রাঁধিয়ে তেমনি খাটিয়ে, দেখতেও সুশ্রী। এই সেদিন তালের বড়া করে আমাদের সবাইকে খাওয়ালে। বিশ্বকর্মা পূজোর যোগাড় আর তিন—চার শ লোকের ভোজের রান্নাও সে প্রায় একাই করে। কিন্তু ভারী কুঁদুলী। কারিগররা তার ভক্ত বটে, কিন্তু তাদের বউরা তাকে দেখতে পারে না।

—কি রকম ভক্ত তা বুঝি না। আনন্দর চাকরি গেলে তার বউএর তো ক্ষতি হবে।

—কি জানেন? সতীর পুণ্যে পতির স্বর্গবাস, কিন্তু পতির পাপে সতীর সর্বনাশ। তবে এখানকার চাকরি গেলেও আনন্দের কাজের অভাব হবে না।

আনন্দ মণ্ডলকে ডাকিয়ে এনে রঘুপতি বললেন, এসব কি শুনছি হে আনন্দ? তুমি নাকি আর একটা বিয়ে করবে?

মাথা নীচু করে আনন্দ বলল, আজ্ঞে হাঁ।

—সে কি। তোমার স্ত্রী তো খুব ভাল মেয়ে শুনতে পাই, বিনা দোষে তার ঘাড়ে একটা সতিন চাপাবে? এই কুমতলব ছাড়।

—ছাড়বার উপায় নেই বাবু। মুকুন্দ মিস্ত্রী মশায়ের মেয়েকে আমার বিয়ে করতেই হবে?

—মুকুন্দ মিস্ত্রী তোমার বাপের মতন ছিলেন, তাঁর কাছে তুমি কাজ শিখেছ, এসব আমি জানি। কিন্তু তোমার স্ত্রী থাকতে আবার বিয়ে করা অন্যায় নয় কি?

—উপায় নেই বাবু।

—উপায় নেই এ যে বিশ্রী কথা আনন্দ। দেখ, তুমি কাজের লোক, তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়। কিন্তু তোমার কুমতলব শুনে কারখানার সবাই খেপে উঠেছে, তাদের আপত্তি আমি অগ্রাহ্য করতে পারি না। তুমি আমাকে কথা দাও যে বিয়ে করবে না। তাতে রাজী না হও তো কাজে ইস্তফা দিতে হবে।

—যে আজ্ঞে। আজ মাসের বিশ তারিখ, মাস কাবারের সঙ্গে সঙ্গে কাজ ছেড়ে দেব।

আনন্দ নমস্কার করে চলে গেল।

রঘুপতি রায় কারখানারই এক অংশে বাস করেন। সন্ধ্যাবেলা তিনি বারান্দায় বসে আছেন আর বিষণ্ণ মনে আনন্দের কথা ভাবছেন, এমন সময় বাইসম্যান অনন্ত এসে বলল, সার, আনন্দ মিস্ত্রীর স্ত্রী যশোদা বউদি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

রঘুপতি বললেন, এখানে নিয়ে এস।

একটি ঘোমটাবতী মেয়ে ভূমিষ্ট হয়ে প্রণাম করল। অনন্ত তাকে বলল, লজ্জা ক’রো না বউদি, যা বলবার বাবু মশায়কে বল।

ঘোমটার ভেতর থেকে তীক্ষ্ন কণ্ঠে যশোদা বলল, এ কেমন ধারা বিচার বাবু মশায়? আমার সোয়ামী দুটো বিয়ে করুক দশটা করুক, সে আমি বুঝব। কারখানার অলপ্পেয়েদের তার জন্যে মাথাব্যথা কেন? মানুষটার কাজে কোন গলদ নেই, আপনি তাকে স্নেহও করেন, তবে কিসের জন্যে তার অন্ন মারবেন? আমরা আট—দশ বছর বরানগরে এই কারখানায় আছি, এ জায়গা ছেড়ে এখন কোথায় যাব?

রঘুপতি বললেন, কারখানা সুদ্ধ লোকের আপত্তি আমি অগ্রাহ্য করতে পারি না। তাদের রাগ হবারই কথা, তোমার মতন ভাল মেয়ের একটা সতিন আসবে, কারখানার কেউ তা সইতে পারছে না।

ঘোমটা খুলে ফেলে যশোদা হাত নেড়ে বলল, আ মর! সতিন কি কারখানার না আমার? আমার সতিন আমি বুঝব, ঝাঁটাপেটা করে সিধে করে দেব, তোরা হতভাগারা এর মধ্যে আসিস কেন? হাঁ রে অনন্ত, তুইও ওদের দলে নেই তো? কি আমার দরদী লোক সব। আপনি কারু কথা শুনো নি বাবু, মিস্ত্রী যেমন কাজ করছে করুক।

রঘুপতি বিব্রত হয়ে বললেন, তোমার কথা বিবেচনা করে দেখব। আচ্ছা, এখন এস বাছা।

পরদিন সন্ধ্যার সময় অনন্ত রঘুপতির কাছে এসে বলল, মুকুন্দ মিস্ত্রী মশায়ের স্ত্রী আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

রঘুপতি বললেন, তোমার ভাবগতিক তো বুঝতে পারছি না অনন্ত। আনন্দর বিরুদ্ধে তুমিই কাল বলেছিলে, আবার তার স্ত্রীকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিলে, আজ আবার মুকুন্দ স্ত্রীর সঙ্গে এসেছ। তোমার ইচ্ছেটা কি?

অনন্ত বলল, আমার একার ইচ্ছে অনিচ্ছাতে কি হবে সার, কারখানার সকলের যা ইচ্ছে আমারও তাই। তবে কিনা মেয়েদেরও বলবার অধিকার আছে, তাই তাঁদের সঙ্গে আমাকে আসতে হয়েছে।

মুকুন্দ মিস্ত্রীর স্ত্রী সিন্ধুবালা রঘুপতিকে প্রণাম করে বলল, বাবুমশায়, আপনি সব কথা শুনে ন্যায্য বিচার করবেন এ ভরসায় খিদিরপুর থেকে বরানগরে ছুটে এসেছি। ওই যে আপনাদের আনন্দ মণ্ডল, আমার সোয়ামীই ওকে মানুষ করেছেন। মিস্ত্রী মশায় বলতে আনন্দ অজ্ঞান, তাকে গুরুঠাকুরের মতন ভক্তি করত, এখনও করে। ওর যা কিছু বিদ্যে সব কর্তার কাছে শেখা। মারা যাবার সময় তিনি আনন্দকে বলে গেছেন—আনন্দ, আমার পুঁজি তো কিছু নেই, ছেলেটাও লক্ষ্মীছাড়া, কোথায় থাকে কি করে কেউ জানে না। আমি কোম্পানির কোআটারে থাকি, মরবার পর আমার পরিবারের এখানে স্থান হবে না। আমার স্ত্রী আর মেয়ে সুশীলার কি দশা হবে? আনন্দ, তুমি যদি এদের ভার নাও তো আমি নিশ্চিন্ত হয়ে মরতে পারি। তাই শুনে আনন্দ বলল, মিস্ত্রী মশায়, আপনার পা ছুঁয়ে দিব্যি করছি, আমি এঁদের ভার নিলাম। কর্তা গত হলে আনন্দ আমায় বলল, মা, ভাববেন না, মেয়েকে নিয়ে আমার বাসায় চলে আসুন।

রঘুপতি বললেন, আনন্দ ভালই বলেছ। কিন্তু তার স্ত্রী থাকতে আপনার মেয়েকে বিয়ে করবে কেন? মেয়ের বিয়ে তো অন্য লোকের সঙ্গে দিতে পারেন।

কপাল চাপড়ে সিন্ধুবালা বলল, তা যে হবার জো নেই বাবু, উপায় থাকলে সতিনের ঘরে মেয়ে দেব কেন?

—উপায় নেই কেন?

—আমার মেয়েকে আর কে নেবে বাবা? সে রূপে গুণে লক্ষ্মী কিন্তু বোবাকে কেউ চায় না। ছেলেবেলায় ছ মাস জ্বরে ভোগার পর থেকে সে আর কথা কইতে পারে না।

—ভারী দুঃখের কথা। কিন্তু আনন্দর সঙ্গে তার বিয়ে দেবার দরকার কি? আনন্দর বউ—এর অনিষ্ট কেন করবেন? আপনারা না হয় আনন্দর বাড়িতেই থাকবেন, কিন্তু মেয়ের তো অন্য পাত্র জুটতে পারে। না হয় যোগাড় করতে কিছুদিন দেরি হবে।

—সোমত্ত আইবুড়ো মেয়েকে আনন্দর বাড়িতে রাখলে যে বদনাম হবে বাবা। আমাদের জাতের লোক ভারী নচ্ছার, আনন্দ আমাদের ওখানে আনাগোনা করে তাইতেই আত্মীয় কুটুমরা নানা কথা রটিয়েছে।

রঘুপতি বললেন, আজ আপনি আসুন। আমি একটু ভেবে দেখি, অন্য উপায় হতে পারে কিনা। দু—এক দিনের মধ্যে এই অনন্তকে দিয়ে আপনাকে খবর পাঠাব।

পরদিন রঘুপতির আজ্ঞায় প্রসন্ন সামন্ত সদলে তাঁর কামরায় উপস্থিত হল, আনন্দ মণ্ডলও এল। মুকুন্দ মিস্ত্রীর স্ত্রীর কাছে যা শুনেছেন। সব বিবৃত করে রঘুপতি বলেলেন, আচ্ছা আনন্দ মুকুন্দর মেয়ের জন্যে যদি একটি পাত্র যোগাড় করতে পারি তা হলে কেমন হয়?

আনন্দ বলল, তার চাইতে ভাল কিছুই হতে পারে না বাবু। কিন্তু পাত্র পাবেন কোথায়? মকুন্দ মিস্ত্রী মশায় ঢের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বোবা মেয়েকে কেউ নিতে রাজী হয় নি।

রঘুপতি বললেন, আমার প্রস্তাবটা তোমরা মন দিয়ে শোন। শুনেছি মেয়েটি সুশ্রী, কাজকর্মও সব জানে, শুধু কথা বলতে পারে না। তোমরা সবাই তার জন্যে একটি ভাল পাত্রের সন্ধান কর। যদি এই কারখানায় একটি কাজ দেওয়া হয় আর ভাল যৌতুক দেওয়া হয় তবে পাত্র পাওয়া অসম্ভব হবে না। আমি যৌতুকের জন্যে এক শ টাকা চাঁদা দেব, তোমরাও যা পার দাও।

যারা এসেছিল তারা মৃদুস্বরে কিছুক্ষণ জল্পনা করল। তারপর এককড়ি নশকর বলল, বাবু মশায় যা বললেন, তা খুব ন্যায্য কথা। মুকুন্দ মিস্ত্রীকে আমরা সবাই ভক্তি করতাম, তাঁর মেয়ের বিয়ের যোগাড় আমাদেরই করা উচিত। আমরা সবাই মাইনে থেকে টাকায় দু পয়সা হিসেবে চাঁদা দিতে রাজী আছি, তাতে আন্দাজ তিন শ টাকা উঠবে, আপনার টাকা নিয়ে হবে চার শ। যৌতুক ভালই হবে, তার ওপর আপনি এখানে একটা কাজ তো দেবেন। আমরা সাধ্যমত পাত্রের খোঁজ করব, কিন্তু সুপাত্র পাওয়া বড় শক্ত হবে বাবু!

অনন্ত পাল বলল, পাত্র খোঁজবার দরকার নেই, আমিই বিয়ে করব।

প্রসন্ন সামন্ত চুপি চুপি বলল, সে কি রে অনন্ত, আমার সেই শিবপুরের শালীর মেয়েকে বিয়ে করবি নি? টাকার লোভে বোবা মেয়ে নিবি?

অনন্ত চেঁচিয়ে বলল, টাকা চাই না, অমনিই বিয়ে করব।

অনন্তর পিঠ চাপড়ে রঘুপতি বললেন, বাহবা অনন্ত! উপস্থিত সকলে খুশী হয়ে কলরব করে উঠল।

দুদিন পরে রঘুপতির কামরার দরজা একটু ফাঁক করে আনন্দ মিস্ত্রী বলল, আসতে পারি বাবু? সামন্ত মশায় লিলুয়া জুট মিলে ক্রেন খাটাতে গেছেন, তাই আমাকেই এরা বলবার জন্যে ধরে এনেছে। আমাদের একটা আরজি আছে বাবু।

রঘুপতি বললেন, সবাই ভেতরে এস। আবার কিসের আরজি? কাকে তাড়াতে চাও?

আনন্দ বলল, আমাদের সকলের নিবেদন—বাইসম্যান অনন্ত পালের মাইনেটা কিছু বাড়িয়ে দিতে আজ্ঞা হ’ক।

—সে তোমাদের বলতে হবে না। আসছে মাসেই তো তার বিয়ে? ওই মাস থেকেই তার মাইনে বাড়বে।

শারদীয় ‘গল্প—ভারতী’

১৩৬১ (১৯৫৪)

____________

‘কৃষ্ণকলি’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত নয়।