আনন্দীবাঈ
বহু কারবারের মালিক ত্রিক্রমদাস করোড়ী তাঁর দিল্লির অফিসের খাস কামরায় বসে চেক সহি করছেন। আরদালী এসে একটা কার্ড দিল—এম. জুলফিকার খাঁ। ত্রিক্রমদাস বললেন, একটু সবুর করতে বল।
কিছুক্ষণ পরে সহি করা চেকের গোছা নিয়ে কেরানী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ত্রিক্রমদাস ঘণ্টা বাজিয়ে আরদালীকে ডেকে কার্ডখানা দিয়ে বললেন, আসতে বল।
জুলফিকার খাঁ এসে বললেন, আদাব আরজ। শেঠজী, আমি ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে আসছি।
উদ্বিগ্ন হয়ে শেঠজী প্রশ্ন করলেন, ইনকমট্যাক্স নিয়ে আবার কিছু গড়বড় হয়েছে নাকি?
—তা আমার মালুম নেই। আমার ডিপার্টমেন্টে আপনার নামে একটা সিরিয়স চার্জ এসেছে।
—কেন, আমার কসুর কি?
—আপনি তিনটি শাদি করেছেন।
একটু হেসে ত্রিক্রম বললেন, য়হ বাত? যদি করেই থাকি তাতে আমার কসুর কি? আমি তো হিন্দু সৈকড়োঁ শাদি করতে পারি, আপনাদের মতন চারটি বিবিতে আটকে থাকবার দরকার নেই।
খাঁ সাহেব হাত নেড়ে বললেন, হায় হায় শেঠজী, আপনি রুপায়ই কামাতে জানেন, মুলুকের খবর রাখেন না। হিন্দু বৌদ্ধ জৈন আর শিখ একটির বেশি শাদি করতে পারবে না—এই আইন সম্প্রতি চালু হয়ে গেছে তা জানেন না?
—বলেন কি! আমি নানা ধান্দায় ব্যস্ত, সব খবর রাখবার ফুরসত নেই। নতুন ট্যাক্স কি বসল, নতুন লাইসেন্স কি নিতে হবে, এই সবেরই খোঁজ রাখি। কিন্তু আপনার খবরে বিশ্বাস হচ্ছে না, আমার ফুফা (পিসে) ইরচন্দজী দুই জরু নিয়ে বহুত মজে মে আছেন, তাঁর নামে তো চার্জ আসে নি।
—আইন চালু হবার আগে থেকেই তো তাঁর দুই জরু আছে, তাতে দোষ হয় না। কিন্তু আপনি হালে তিন শাদি করেছেন, তার জন্যে কড়া সাজা হবে, দশ বৎসর জেল আর বিস্তর টাকা জরিমানা হতে পারে।
শেঠজী ভয় পেয়ে বললেন, বড়ী মুশকিল কি বাত, এখন এর উপায় কি?
—দেখুন শেঠজী, আপনি মান্যগণ্য আমীর আদমী, আপনাকে মুশকিলে ফেলতে আমরা চাই না। এক মাস সময় দিচ্ছি, এর মধ্যে একটা বন্দোবস্ত করে ফেলুন।
—কত টাকা লাগবে?
—আপনি একটি জরুকে বহাল রেখে আর দুটিকে ঝটপট খারিজ করুন। তার জন্যে কত খেসারত দিতে হবে তা তো আমি বলতে পারি না, উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। আর এদিকে কত টাকা লাগবে সে তো আপনার আর আমার মধ্যে, তার কথা পরে হবে।
মাথা চাপড়ে ত্রিক্রমদাস বললেন, হো রামজী, হো পরমাৎমা, বাঁচাও আমাকে । একটিকে সনাতনী মতে বিবাহ করেছি, আর একটিকে আর্যসমাজী মতে, আর একটির সঙ্গে সিভিল ম্যারিজ হয়েছে। খারিজ করব কি করে?
—ঘাবড়াবেন না শেঠজী, আপনার টাকার কমি কি? দু—চার লাখ খরচ করলে সব মিটে যাবে। দুটি স্ত্রীকে মোটা খেসারত দিয়ে কবুল করিয়ে নিন যে তারা আপনার অসলী জরু নয়, শুধু মুহব্বতী পিয়ারী। তারপর আমরা ব্যাপারটা চাপা দিয়ে দেব। দেরি করবেন না, এখনই কোনও ভাল উকিল লাগান। আচ্ছা, আজ আমি উঠি, হপ্তা বাদ আবার দেখা করব। আদাব।
ত্রিক্রমদাসের বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশী। তাঁর বৈবাহিক ইতিহাস অতি বিচিত্র। দু বৎসর আগে তাঁর একমাত্র পত্নী কয়েকটি ছেলে মেয়ে রেখে মারা যান। তার কয়েক মাস পরে তিনি আনন্দীবাঈকে বিবাহ করেন। তারপর সম্প্রতি তিনি আরও দুটি বিবাহ করেছেন কিন্তু তার খবর আত্মীয়—বন্ধুদের জানান নি। এখনকার পত্নীদের প্রথমা আনন্দীবাঈ হচ্ছেন খজৌলি স্টেটের ভূতপূর্ব দেওয়ান হরজীবনলালের একমাত্র সন্তান, বহু ধনের অধিকারিণী। হরজীবন মারা গেলে তাঁর এক দূর সম্পর্কের ভাই অভিভাবক হয়ে ভাইঝিকে ফাঁকি দেবার চেষ্টায় ছিলেন, কিন্তু মেয়ের মামাদের সাহয্যে ত্রিক্রমদাস আনন্দীকে বিবাহ করে তাঁর সম্পত্তি নিজের দখলে আনলেন। আনন্দীবাঈএর বয়স আন্দাজ পঁচিশ, দেখতে ভাল নয়; একটু ঝগড়াটে, উচ্চবংশের অহংকারও আছে।
ত্রিক্রমদাসের ব্যবসার কেন্দ্র আর হেড অফিস দিল্লিতে, তা ছাড়া বোম্বাই আর কলকাতায় তাঁর যে ব্রাঞ্চ অফিস আছে তাও ছোট নয়। তিনি বৎসরে তিন—চার বার ওই দুই শাখা পরিদর্শন করেন। আনন্দীর সঙ্গে বিবাহের কিছুকাল পরে তিনি বোম্বাই যান। সেখানকার ম্যানেজার কিষনরাম খোবানী একদিন তাঁর মনিবকে নিমন্ত্রণ করে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন। তিনি সিন্ধের লোক দেশ ত্যাগের পর দিল্লি চলে আসেন, তারপর শেঠজীর ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার হয়ে বোম্বাইএ বাস করছেন। কিষনরাম শৌখিন লোক, তাঁর ফ্ল্যাট বেশ সাজানো। তিনি তাঁর স্ত্রী আর শালীর সঙ্গে নিজের মনিবের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
শেঠজী সেকেলে লোক, আধুনিক মহিলাদের সঙ্গে তাঁর মেশবার সুযোগ এ পর্যন্ত হয় নি। কিষনরামের শালী রাজহংসী ঝলকানীকে দেখে তিনি মোহিত হয়ে গেলেন। কি ফরসা রং, কি সুন্দর সাজ! পরনে ফিকে নীল সালোয়ার আর ঘোর নীল কামিজ, তার উপর চুমকি বসানো ফিকে সবুজ দোপাট্টা ঝলমল করছে। কথাবার্তা অতি মধুর, কোনও জড়তা নেই, হেসে হেসে এটা খান ওটা খান বলে অনুরোধ করছে।
খাওয়া শেষ হল। কিষনরামকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে শেঠজী রাজহংসী ঝলকানীর সব খবর জেনে নিলেন। মেয়েটির বাপ মা নেই। একমাত্র ভাই সিংগাপুরে ভাল ব্যবসা করে, কিন্তু বোনের কোনও খবর নেয় না, অগত্যা কিষনরাম তাঁর শালীকে নিজের কাছে রেখেছেন। সে ভাল অভিনয় করতে পারে, গাইতে পারে, সিনেমায় নামবার ইচ্ছা আছে, কিন্তু কিষনরাম ও তাঁর স্ত্রীর মত নেই।
শেঠজী তখনই মতি স্থির করে বললেন, আমার সঙ্গে রাজহংসীর বিবাহ দাও, ওকে আমি খুব সুখে রাখব। এই বোম্বাই শহরেই আমার জন্যে জলদি একটা বাড়ি কিনে ফেল, রাজহংসী সেখানে থাকবে, আমিও বৎসরের বেশীর ভাগ বোম্বাইএ বাস করব। এখানকার কারবার ফালাও করতে চাই।
আনন্দীবাঈ—এর কথা শেঠজী চেপে গেলেন। কিষনরাম জানতেন যে তাঁর মালিক বিপত্নীক, সুতরাং তিনি খুশী হয়ে সম্মতি দিলেন। রাজহংসীও রাজী হলেন, শেঠজীর বেশী বয়সের জন্যে কিছুমাত্র আপত্তি প্রকাশ করলেন না। আর্যসমাজী পদ্ধতিতে বিবাহ হয়ে গেল। তার পর নূতন বাড়িও কেনা হল, রাজহংসী সেখানে বাস করতে লাগলেন।
কিছুদিন পরে ত্রিক্রমদাস তাঁর কলকাতার কারবার পরিদর্শন করতে গেলেন। ওখানকার ম্যানেজার পরিতোষ হোড়—চৌধুরী খুব কাজের লোক, আলিপুরে সাহেবী স্টাইলে থাকেন। তিনি তাঁর মনিবকে ডিনারের নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানে পরিতোষের স্ত্রী আর ভগ্নীর সঙ্গে ত্রিক্রমদাসের পরিচয় হল। মিস বলাকা হোড়—চৌধুরীকে দেখে শেঠজী অবাক হয়ে গেলেন। রাজহংসীর মতন রূপসী নয় বটে, কিন্তু শাড়ি পরবার ভঙ্গীটি কি চমৎকার, আর বাত—চিত আদব কায়দাও কি সুন্দর! মেমসাহেবদের মতন ইংরেজী উচ্চারণ করে, আর হিন্দী বলতে ভুল করে বটে কিন্তু সেই ভুল কি মিষ্টি! শেঠজী একেবারে কাবু হয়ে পড়লেন। পরিতোষ হোড়—চৌধুরী তাঁকে জানালেন, বলাকা এম. এ.পাস, নাচ—গানে কলকাতায় ওর জুড়ী নেই, সিনেমাওয়ালারা ওকে পাবার জন্যে সাধাসাধি করছে, কিন্তু পরিতোষের তাতে মত নেই। ত্রিক্রমদাস নিজেকে সামলাতে পারলেন না, বলে ফেললেন, মিস বলাকা, মৈ তুমকো শাদি করুংগা।
বলাকা সহাস্যে উত্তর দিলেন, তা বেশ তো, কিন্তু দিল্লির গরম তো আমার সইবে না, আর আপনাদের দাল—রোটি ভাজী দহিবড়া আমার হজম হবে না।
শেঠজী বললেন, আরে দিল্লি যেতে তোমাকে কে বলছে? আমি এই আলিপুরে একটা মোকাম কিনব, তুমি সেখানে তোমার দাদার কাছাকাছি বাস করবে। আমি বছরের আট—ন মাস এখানেই কাটাব, কলকাতার কারবার ফালাও করতে চাই। তোমাকে দাল—রোটি খেতে হবে না, মচ্ছি—ভাতই খেয়ো। মচ্ছি খেতে আমিও নারাজ নই, কিন্তু বড় বদবু লাগে।
বলাকা বললেন, আমি গোলাপী আতর দিয়ে ইলিশ মাছ রেঁধে আপনাকে খাওয়াব, মনে হবে যেন কালাকন্দ খাচ্ছেন।
বলাকা তাঁর দাদার কাছে শুনেছিলেন যে শেঠজী বিপত্নীক। তিনি তখনই বিবাহে রাজী হলেন। কুড়ি দিন পরে সিভিল ম্যারিজ হয়ে গেল।
ত্রিক্রমদাস পালা করে দিল্লি থেকে বোম্বাই আর কলকাতা যেতে লাগলেন, তাঁর দাম্পত্যের ত্রিধারায় কোনও ব্যাঘাত ঘটল না। পরমানন্দে দিন কাটাতে লাগল। তার পর অকস্মাৎ একদিন জুলফিকার খাঁ দুঃসংবাদ দিয়ে শেঠজীর শান্তিভঙ্গ করলেন।
উকিল খজনচাঁদ বি. এ. এল এল বি. ত্রিক্রমদাসের অনুগত বিশ্বস্ত বন্ধু, ইনকমট্যাক্সের হিসাব দাখিলের সময় তাঁর সাহায্য না নিলে চলে না। শেঠজী সেই দিনই সন্ধ্যার সময় খজনচাঁদের কাছে গিয়ে নিজের বিপদের কথা জানালেন।
খজনচাঁদ বললেন, শেঠজী,আপনি নিতান্ত ছেলেমানুষের মতন কাজ করেছেন। আমাকে আপনি বিশ্বাস করেন, কিন্তু ওই মুম্বইবালী আর কলকাত্তাবালীকে কথা দেবার আগে একবার আমাকে জানালেন না, এ বড়ই আফসোস কি বাত।
শেঠজী হাত জোড় করে বললেন, মাফ কর ভাই বুড়ো বয়সে একটা স্ত্রী থাকতে আরও দুটো বিয়ে করবার লোভ হয়েছে এ কথা লজ্জায় তোমাকে বলি নি। এখন উদ্ধারের উপায় বাতলাও।
কিছুক্ষণ ভেবে খজনচাঁদ বললেন, আনন্দীবাঈকে কিছু বলবার দরকার নেই, শুনলে উনি দুঃখ পাবেন, কান্নাকাটি করবেন। আর দুজনকে একে একে আপনি সব কথা খুলে বলুন। ওঁরা হচ্ছেন মর্ডান গার্ল, আত্মমর্যাদাবোধ খুব বেশী। আপনার কুকর্ম জানলে রেগে আগুন হবেন, আপনার মুখ দেখতে চাইবেন না। তাতে আমাদের সুবিধাই হবে, মোটা খেসারত দিলে আর আপনার দুই ম্যানেজারকে কিছু খাওয়ালে সব মিটে যাবে। দু—চার লাখ খরচ হতে পারে, কিন্তু আপনার তা গায়ে লাগবে না।
এই পরামর্শ ত্রিক্রমদাসের পছন্দ হল না। তিনি বললেন, খজন—ভাই তুমি আমার প্রাণের কথা বুঝতে পারছ না। আমি বিজনেস বাড়াতে চই, তার জন্যে নামজাদা লোকের সঙ্গে মেশা দরকার। আমি যদি মন্ত্রী আর বড় বড় অফিসারদের পার্টি দিই তবে আমার বাড়ির কোন লেডী অতিথিদের আপ্যায়িত করবে? আনন্দী? রাম কহো। রাজহংসী আর বলাকা হচ্ছে এই কাজের কাবিল। বাতিল করতে হলে আনন্দীকেই করতে হবে, তাতে আমার কলিজা ফেটে যাবে, অনেক টাকার সম্পত্তি ছাড়তে হবে, কিন্তু তার জন্যে আমি প্রস্তুত আছি। মুশকিল হচ্ছে—রাজহংসী আর বলাকার মধ্যে কাকে রাখব কাকে ছাড়ব তা স্থির করা বড় শক্ত, তবে আমার বেশী পছন্দ কলকাত্তাবালী বলাকা দেবী। ওকে যদি নিতান্ত না রাখতে পারি তবে ওই মুম্বইবালী রাজহংসী। টাকার জন্যে ভেবো না, দশ—পনড্র লাখ তক খরচ করতে আমি তৈয়ার আছি।
খজনচাঁদ অনেক বোঝালেন যে আনন্দীবাঈ তাঁর আইনসম্মত স্ত্রী, তাঁর দাবী সকলের উপরে। তাঁকে ত্যাগ করতে হলে অনেক জুয়াচুরির দরকার হবে, তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি ছেড়ে দিতে হবে, তার ফলে মোট লোকসান খুব বেশী হবে, আনন্দীবাঈ—এর সেই বদমাশ কাকার শরণাপন্ন হতে হবে। কিন্তু ত্রিক্রমদাস কিছুতেই তাঁর সংকল্প ছাড়লেন না। অগত্যা খজনচাঁদ বললেন, বেশ, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনি দেরি না করে তিনজনকেই সব কথা খুলে বলুন। ওঁদের মনের ভাব দেখে আমি যা করবার করব।
কালবিলম্ব না করে ত্রিক্রমদাস এয়ারোপ্লেনে বোম্বাই গেলেন এবং সোজা রাজহংসীর বাড়িতে উপস্থিত হলেন। রাজহংসী তাঁর ড্রইংরুমে বসে একটি সুবেশ যুবকের সঙ্গে গল্প করছিলেন। আশ্চর্য হয়ে বললেন, আরে শেঠজী, হঠাৎ এলে যে! কোনও খবর দাও নি কেন? এঁকে তুমি চেন না, ইনি হচ্ছেন মিস্টার ঝুমকমল মটকানী, দূর সম্পর্কে আমার ফুফেরা (পিসতুতো) ভাই হন, হিসাবের কাজে ওস্তাদ। এখানকার অফিসের অ্যাকাউণ্টেণ্ট তো বুড়ো হয়েছে, তাকে বিদায় করে এই ঝুমক—মলকে সেই পোস্টে বসাও।
ত্রিক্রমদাস বললেন, আমি ভেবে দেখব। রাজহংসী, তোমার সঙ্গে আমার একটা জরুরী কথা আছে।
ঝুমকমল চলে গেলে ত্রিক্রমদাস ভয়ে ভয়ে তাঁর তিন বিবাহের কথা প্রকাশ করলেন। কিন্তু তার রিঅ্যাকশন যা হল তা একেবারে অপ্রত্যাশিত। রাজহংসী হেসে গড়িয়ে পড়ে বললেন, বাহবা শেঠজী, তুমি দেখছি বহুত রঙ্গীলা আদমী! তোমার আরও দুই জরু আছে তাতে হয়েছে কি, আমি ওসব গ্রাহ্য করি না, তুমি নিশ্চিন্ত থাক সব ঠিক হৈ। তবে কথাটা যেন জানাজানি না হয়। …হ্যাঁ ভাল কথা, এই বাড়িটা জলদি আমার নামে রেজিস্টারি করা দরকার, মিউনিসিপ্যালিটি বড় হয়রান করছে।
শেঠজী বললেন, আচ্ছা, তার ব্যবস্থা হবে। আজ আমি থাকতে পারব না, জরুরী কাজে এখনই কলকাতা রওনা হব।
কলকাতায় পৌঁছে ত্রিক্রমদাস সোজা আলিপুরে বলাকার কাছে গেলেন। ড্রইংরুমে একজন সুদর্শন ভদ্রলোক পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন আর বলাকা তালে তালে নাচছিলেন। ত্রিক্রমকে দেখে বলাকা বললেন, একি শেঠজী, হঠাৎ এলে যে! এঁকে বোধ হয় চেন না, ইনি হচ্ছেন লোটনকুমার ভড়, দূর সম্পর্কে আমার মাসতুতো ভাই, নাচের ওস্তাদ। এঁর কাছে আমি কবুতর—নৃত্য শিখছি। দেখবে একটু?
ত্রিক্রম বললেন, এখন আমার ফুরসত নেই। বলাকা, তোমার সঙ্গে আমার বহুত জরুরী কথা আছে।
লোটনকুমার উঠে গেলে ত্রিক্রমদাস কম্পিত বক্ষে তাঁর তিন বিবাহের কথা প্রকাশ করলেন। বলাকা গালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বললেন, ওমা তাই নাকি! ওঃ শেঠজী, তুমি একটি আসল পানকৌড়ি, নটবর নাগর। তা তুমি অমন মুষড়ে গেছ কেন তিনটে বউ আছে তো হয়েছে কি? ঠিক আছে, তুমি ভেবো না, আমি হিংসুটে মেয়ে নই। কিন্তু তুমি যেন সবাইকে বলে বেড়িয়ো না। …হ্যাঁ ভাল কথা, দেখ শেঠজী, একটা নতুন মোটরকার না হলে চলছে না, পুরানো অস্টিনটা হরদম বিগড়ে যাচ্ছে। তুমি হাজার কুড়ি টাকার একটা চেক আমাকে দিও, তার কমে ভাল গাড়ি মিলবে না।
ত্রিক্রমদাস বললেন, আচ্ছা, তা ব্যবস্থা হবে। আমি এখন উঠি, আজই দিল্লি যেতে হবে।
ত্রিক্রমদাস দিল্লিতে এসেই খজনচাঁদের কাছে গিয়ে সকল বৃত্তান্ত জানালেন। তার পর তাঁকে সঙ্গে করে নিজের বাড়িতে এনে ড্রইংরুমে অপেক্ষা করতে বললেন।
অন্দরমহলে গিয়ে ত্রিক্রম আনন্দীবাঈকে শোবার ঘরে ডেকে আনলেন। আনন্দী বললেন, তিন দিন তোমার কোনও পাত্তা নেই, চেহারা খারাপ হয়ে গেছে, ব্যাপার কি, গভরমেণ্টের সঙ্গে আবার কিছু গড়বড় হয়েছে নাকি?
ত্রিক্রমদাস মাথা হেঁট করে তাঁর গুপ্তকথা প্রকাশ করলেন। আনন্দী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন, তারপর কোমরে হাত দিয়ে চোখ পাকিয়ে বললেন, ক্যা বোলা তুম নে?
শেঠজী একটু ভয় পেয়ে বললেন, আনন্দী, ঠন্ডা হো যাও, সব ঠিক হো জাগা।
বাংলা সাহিত্য যতই সমৃদ্ধ আর উঁচুদরের হক, হিন্দী ভাষায় গালাগালির যে শব্দসম্ভার আছে তার তুলনা নেই। আনন্দীবাঈ হাত—পা ছুড়ে নাচতে লাগলেন। হোজ—পাইপ থেকে জলধারার মতন তাঁর মুখ থেকে যে ভর্ৎসনা নির্গত হতে লাগল তা যেমন তীব্র তেমনি মর্মস্পর্শী। তার সকল বাক্য ভদ্রজনের শ্রোতব্য নয়, ভদ্র—নারীর উচ্চার্যও নয়, কিন্তু আনন্দীবাঈ—এর তখন হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে। তিনি উত্তরোত্তর উত্তেজিত হচ্ছেন দেখে শেঠজী হাত জোড় করে আবার বললেন, আনন্দী, মাফ করো, সব ঠিক হো জাগা।
আনন্দী গর্জন করে বললেন, চোপ রহো শড়ক কা কুত্তা, ডিরেন কা ছুছুন্দর! এই বলেই বাঘিনীর মতন লাফিয়ে গিয়ে শেঠজীর দুই গালে খামচে দিলেন। তারপর পিছু হটে তাঁর বাঁ হাত থেকে দশগাছা মোটা মোটা চুড়ি খুলে নিয়ে স্বামীর মস্তক লক্ষ্য করে ঝনঝন শব্দে নিক্ষেপ করলেন। শেঠজীর কপাল ফেটে রক্ত পড়তে লাগল, তিনি চিৎকার করে ধরাশায়ী হলেন। ততোধিক চিৎকার করে আনন্দীবাঈ তাঁর পূজোর ঘরে চলে গেলেন এবং মেঝেয় শুয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
বাড়িতে মহা শোরগোল পড়ে গেল। আত্মীয়া যাঁরা ছিলেন তাঁরা আনন্দীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। শেঠজীর জন্যে খজনচাঁদ তখনই ডাক্তার ডেকে আনালেন।
সাত দিন পরে শেঠজী অনেকটা সুস্থ হয়েছেন এবং দোতলার বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে গুড়গুড়ি টানছেন। তাঁর মাথায় এখনও ব্যাণ্ডেজ আছে, মুখে স্থানে স্থানে স্টিকিং প্লাসটারও আছে।
খজনচাঁদ এসে বললেন, কহিএ শেঠজী, তবিঅত কৈসী হৈ।
শেঠজী বললেন, অনেক ভাল। শোন খজন—ভাই রাজহংসী আর বলাকার সঙ্গে আমি সম্পর্ক রাখতে চাই না। তুমি তুরন্ত বোম্বাই আর কলকাতায় গিয়ে একটা মিটমাট করে ফেল, যত টাকা লাগে আমি দেব। ওই মুম্বইবালী আর কলকাত্তাবালী শুধু আমার টাকা চায়, আমাকে চায় না, কিন্তু আনন্দী আমাকেই চায়। খুশবু পাচ্ছ? আনন্দী নিজে আমার জন্যে অড়হর ডালের খিচড়ি বানাচ্ছে। আর এই দেখ, গলাবন্ধ বুনে দিয়েছে।
খজনচাঁদ বললেন, বহুত খুশী কি বাত। শেঠজী , ভাববেন না, আমি সব ঠিক করে দেব। আপনি আনন্দীবাঈকে মথুরা বৃন্দাবন দ্বারকায় ঘুরিয়ে আনুন, তাঁর মেজাজ ভাল হয়ে যাবে।
পত্নীর সেবায় ত্রিক্রমদাস শীঘ্র সেরে উঠলেন। খজনচাঁদের চেষ্টায় রাজহংসী আর বলাকার সঙ্গে মিটমাট হয়ে গেছে, জুলফিকার খাঁও পান খাবার জন্যে মোটা টাকা পেয়েছেন। কলকাতার সব চেয়ে বড় জ্যোতিষসম্রাট জ্যোতিষচন্দ্র জ্যোতিষার্ণবের কাছ থেকে আনন্দীবাঈ হাজার টাকা দামের একটি বশীকরণ কবচ আনিয়ে স্বামীর গলায় বেঁধে দিয়েছেন। এই পুরশ্চরণসিদ্ধ কবচের ফলও আশ্চর্য। শেঠজী আজকাল তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধুদের কাছে বলে থাকেন, সিবায় আনন্দী সব আওরত চুড়ৈল হৈ—অর্থাৎ আনন্দী ছাড়া সব স্ত্রীলোকই পেতনী।*
১৮৭৮ শক (১৯৫৬)