ধনু মামার হাসি
ভোলানাথ ছিল আমাদের ক্লাসের ছেলেদের সর্দার। তার বয়েস সকলের চাইতে বেশী, পর পর তিন বৎসর ফেল করে ক্লাস নাইনে স্থায়ী হয়ে আছে। তার সঙ্গেই আমার বেশী ভাব ছিল।
আমাদের শহরটা বড় নয়, মোটে একটি সিনেমা। মাঝে মাঝে ফুটবল ম্যাচ হত, পূজোর সময় থিয়েটার হত, পূজোও জাঁকিয়ে হত। এসব ছাড়া আমাদের ফুর্তির অন্য উপায় ছিল না। একদিন হেডমাস্টার বললেন, কাল শনিবার ছুটির পর তোরা থাকবি, স্বামী ব্যোমপ্রকাশজী এসেছেন, তাঁর লেকচার শুনবি।
নীরস হিন্দী বক্তৃতা শোনবার আগ্রহ আমাদের ছিল না, কিন্তু খোলা মাঠে দল বেঁধে বসাতেও একটা মজা আছে। ব্যোমপ্রকাশ এক ঘণ্টা ধরে সুদপদেশ দিলেন। চুরি, মিথ্যা কথা, অবাধ্যতা প্রভৃতি কুকর্মের পরিণাম, পাপের শাস্তি, পুণ্যের পুরস্কার, প্রভৃতি সম্বন্ধে অনেক কথা বলে পরিশেষে একটি মন্ত্র সর্বদা আমাদে ইয়াদ রাখতে বললেন—নেকী করনা ঔর বদী ছোড়না, অর্থাৎ ভাল কাজ করবে আর মন্দ কাজ ছাড়বে।
বক্তৃতা শেষ হলে আমরা সকলে খুব হাততালি দিলাম। ভোলা আমার পাশেই বসেছিল, হঠাৎ সে খ্যাঁক খ্যাঁক করে বিশ্রী রকম হেসে উঠল। আমি বললাম, ওকি রে?
ভোলা বলল, একটু হেসে নিলাম। এই নতুন হাসিটা প্র্যাকটিস করছি, ধনু মামার কাছে শিখেছি।
—ধনু মামা আবার কে?
—আমার দিদিমার পিসেমশাই ধনঞ্জয় দত্ত, খুব বুড়ো মানুষ। মা তাঁকে বলে ধনু দাদা, তাই তিনি আমার মামা হন। দশ দিন হল এসেছেন, আমাদের বাড়িতেই বরাবর থাকবেন। চমৎকার হাসেন ধনু মামা, কিন্তু বেশী নয়, খুব যখন ফুর্তি হয় তখন।
—তোর তা শিখবার কি দরকার?
—নতুন বিদ্যে শিখতে হয় রে। তুইও তো মুখে দুটো আঙুল পুরে সিটি বাজানো শিখছিস। আমার হাসিটা এখনও ঠিক হচ্ছে না, সুর দুরস্ত করতে আরও সাত দিন লাগবে। চল না আমাদের বাড়ি, ধনু মামার হাসি শুনে আসবি। একটা চার পয়সা দামের ছোট খাতা কিনে নে। ধনু মামা যদি জিজ্ঞেস করে—কি করতে এসেছ হে ছোকরা? তুই অমনি খাতা খানা এগিয়ে দিয়ে বলবি—আজ্ঞে, একটি বাণী নিতে এসেছি।
মোড়ের দোকান থেকে খাতা কিনে ভোলার সঙ্গে চললাম। তার বাপ ঠিকাদারি করেন, বেশীর ভাগ বাইরেই ঘুরে বেড়ান। বাড়িতে তার মা আছেন, দুটো ছোট ভাইও আছে। ভোলার কাছে শুনলাম, ধনঞ্জয় দত্তর তিন কুলে কেউ নেই, কিন্তু বুড়োর নাকি বিস্তর টাকা আছে। তিনি ওদের বাড়িতে স্থায়ী হয়ে বাস করবেন এতে ভোলার বাবা আর মা খুব খুশী হয়েছেন।
ধনু মামা রোগা বেঁটে মানুষ কালো রং তোবড়া গাল, আসল বা নকল কোনও দাঁত নেই? সাদা চুল, খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি গোঁফ, বোধ হয় সাত দিন নাপিতের হাত পড়ে নি। তাঁর শোবার ঘরে তক্তপোশে উবু হয়ে বসে হুঁকো টানছেন, ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেছে।
আমি প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিলাম। ভোলা পরিচয় দিল—এ আমার বন্ধু রামেশ্বর, এক ক্লাসে পড়ে।
ধনু মামা কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে ব্যাঙের মতন মোটা গলায় বললেন, কি মতলবে এসেছিস রে?
খাতাটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, আজ্ঞে বাণী নিতে।
—বাণী? সে আবার কি?
ভোলা আমার হয়ে উত্তর দিল, বাণী জানেন না? সদুপদেশ আর কি, যাতে এর আখেরে ভালো হয় সে রকম কিছু কথা আপনার কাছে চাচ্ছে।
ধনু মামার ঠোঁটে একটু হাসি ফুটে উঠল। বললেন, মন দিয়া লেখাপড়া শিখিবে, সদা সত্য কহিবে, চুরি করিবে না—এই সব তো?
আমি বললাম, আজ্ঞে হাঁ, ওই রকম যা হক কিছু।
ধনু মামা বললেন, রত্তিরে ভাল দেখতে পাই না, হাতও কাঁপে। একটা কবিতা বলছি, তুই লিখে নে, নীচে আমি দস্তখত করে দেব। লেখ—পরের ধন লইবে না, তাহাতে বিপদ; চোরের ধন লইতে পার, অতি নিরাপদ।
অদ্ভুত বাণী শুনে আমি হাঁ করে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ধনু মামা বললেন, কি রে, পছন্দ হল না বুঝি।
ভয়ে ভয়ে বললাম, আপনি ঠাট্টা করছেন সার।
ধনু মামা মাথাটি পিছনে হেলিয়ে চোখ মিটমিট করে উপর দিকে চাইলেন। তাঁর বদনমণ্ডলের সবটা কুঁচকে গেল এবং তাতে যেন তরঙ্গ উঠতে লাগল। তারপর মুখ থেকে বিকট হাসির আওয়াজ বেরুল—খ্যাঁক খ্যাঁক খ্যাঁক। আমার গায়ে ঠেলা দিয়ে ভোলা চুপি চুপি বলল, শুনলি তো?
ধনু মামা বললেন, এই ভোলা, একে আমার কাছে এনেছিস কেন রে? এ তো দেখছি ভাল ছেলে, তোর মতন বকাটে নয়। আমার কথা শুনলে এর স্বভাব বিগড়ে যাবে।
ভোলা বলল, আপনি জানেন না ধনু মামা, এই রামেশ্বর হচ্ছে ওয়েট ক্যাট, মানে ভিজে বেড়াল। আপনি নির্ভয়ে একে উপদেশ দিতে পারেন।
ধনু মামা বললেন, উপদেশ তো তোরা বিস্তর শুনেছিস, আমি আর বেশী কি বলব। তবে যেটুকু আমি আবিষ্কার করেছি তা তো ওকে বলেই দিলাম।
সাহস পেয়ে আমি বললাম, কি করে আবিষ্কার করলেন বলুন না মামাবাবু।
প্রসন্ন মুখে ধনু মামা বললেন, জানতে চাস? আচ্ছা, বলছি। তোরা তো সোজা ইস্কুল থেকে এসেছিস, জলটল খাস নি তো? ওরে ভোলা, তোর মার কাছ থেকে পয়সা চেয়ে নিয়ে চট করে তিতু ময়রার দোকান থেকে এক পো গজা আর এক পো জিলিপি কিনে আন।
ভোলা খাবার আনতে গেল। ধনু মামা আমাকে বললেন, খাবার আসুক, তোরা খেতে খেতে আমার গল্প শুনবি। ততক্ষণ বরং তুই আমার পা টিপে দে।
আমি ধনু মামার পদসেবা করতে লাগলাম। একটু পরেই ভোলা খাবারের ঠোঙা নিয়ে এল, বাড়ির ভিতর থেকে দু গেলাস জলও আনল। ধনু মামা বললেন, খেতে লেগে যা তোরা। না না, আমার জন্য রাখতে হবে না, আমি ও সব খাই না।
গজায় কামড় দিয়ে আমি বললাম, এইবার বলুন মামাবাবু।
ধনু মামা বললেন, দেখ, যা বলব তা ঠিক তত্ত্বকথা নয়। আর কেউ হলে এসব রহস্য প্রকাশ করত না, কিন্তু আমি কারও তোয়াক্কা রাখি না। বয়েস বিস্তর হয়েছে, ডাক্তার বলেছে রক্তের চাপ দু শ চল্লিশ থেকে হঠাৎ এক শ চল্লিশে নেমেছে। লক্ষণ ভাল নয়, বেশ বুঝছি শিগগির এক দিন মুখ থুবড়ে পড়ে মরব। ফাদার কনফেসার কাকে বলে জানিস? যে পাদরীর কাছে খ্রীষ্টানরা মাঝে মাঝে নিজের কুকর্ম স্বীকার ক’রে মন হালকা করে তাকেই বলে।
ভোলা বলল, গল্প শুনেছি—গেঁয়ো লোক গঙ্গাস্নানে এসেছে, পুরুত তাকে মন্ত্র পড়াচ্ছে—আম্র চুরি, জাম্র চুরি, ভাদ্রমাসে ধান্য চুরি, মন্দ স্থানে রাত্রিযাপন, মদ্যপান আর কুঁকড়া ভক্ষণ, হক্কল পাপ বিমোচন, গঙ্গা গঙ্গা—সেই রকম নাকি?
—হাঁ। আজ তোরাই আমার ফাদার কনফেসার। আমার ইতিহাসটা বলছি শোন—
অনেক বছর আগেকার কথা। তখন আমার বয়স আঠারো—উনিশ, নাম ছিল হাবুলচন্দ্র। লেখাপড়া বেশী শিখি নি, অবস্থা খুব খারাপ, বাড়িতে মা ছাড়া কেউ ছিল না। মারা যাবার আগের দিন মা বললেন, বাবা হাবুল, এই পাড়াগাঁয়ে বেকার বসে, থাকিস নি, দহরমগঞ্জে তোর কাকার কাছে যাবি, যা হক একটা হিল্লে লাগিয়ে দেবেন।
মা মারা গেলে দহরমগঞ্জে গেলাম, বেশ বড় জায়গা। কাকা ওখানকার মস্ত কারবারী গয়াপ্রসাদ প্রয়াগদাসের ফার্মে চালান লিখতেন। এই ফার্মের পত্তন করেছিলেন গয়াপ্রসাদ। তিনি গত হলে তাঁর ছেলে প্রয়াগদাস মালিক হন। আমি যখন ওখানে যাই তখন প্রয়াগদাসের বয়েস আন্দাজ পঞ্চাশ। গুটিকতক নাবালক ছেলে মেয়ে আছে, দ্বিতীয় পক্ষের একটি স্ত্রীও আছে। প্রয়াগদাস বাতে পঙ্গু হয়ে প্রায় বিছানাতেই শুয়ে থাকতেন, অগত্যা তাঁর খুড়তুতো ভাই বৃদ্ধিচাঁদকে ম্যানেজার করে ব্যবসা চালাবার সমস্ত ভার দিয়েছিলেন। বৃদ্ধিচাঁদের বয়েস প্রায় তিরিশ, নিঃসন্তান, স্ত্রী গত হলে আর বিয়ে করেন নি।
সে সময়ে আমার চেহারাটি এমন মর্কটের মতন ছিল না, বেশ নাদুস নুদুস বেঁটে গড়ন, ফুলো ফুলো গাল, একটু বোকা বোকা ভাব। দেখতে যেন চোদ্দ—পনেরো বছরের ছেলে। লোকে বলত, এই হাবুলটা হচ্ছে হাবা গোবা। আমি মনে মনে হাসতাম আর যতটা পারি বোকা সেজে থাকতাম। তাতে লাভও হত। লোকে আমাকে বিশ্বাস করত, অনেক সময় আমার সামনে গুপ্ত কথা বলে বসত। কাকা আমাকে বৃদ্ধিচাঁদের কাছে নিয়ে গিয়ে হাত জোড় করে বললেন, হুজুর, আপনাদের আশ্রয়ে বুড়ো হয়ে গেছি, আমি আর ক দিন। দয়া করে আমার ভাইপো এই হাবুলচন্দরকে যা হয় একটা কাজ দিন।
বৃদ্ধিচাঁদ আমার মুখের দিকে চেয়ে একটু হাসলেন, তারপর পিঠে একটা কিল মেরে বললেন, আরে হাব্বু, তুই তো বৌরা পাগল আছিস, কোন কাম করবি? আচ্ছা, এখন তোকে পাঁচ টাকা মাহিনা দিব, আমার খাস আরদালী হয়ে ইধর উধর চিঠঠি লিয়ে যাবি। পারবি তো? আমি খুব ঘাড় দুলিয়ে বললাম, জী হুজুর, পারব।
তখনই আরদালীর পদে বাহাল হয়ে গেলাম। বৃদ্ধিচাঁদ শৌখিন লোক, তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে গদিতে বসতেন না, টেবিল চেয়ার আলমারি দিয়ে তাঁর আফিস—ঘর সাজিয়েছিলেন; ঘণ্টা বাজিয়ে আমাকে ডাকতেন। আমার কাজ খুব হালকা, বৃদ্ধিচাঁদের খাস কামরার দরজার পাশে একটা টুলে বসে থাকতাম, তাঁর ছোটখাটো ফরমাশ খাটতাম, মাঝে মাঝে তাঁর চিঠি বিলি করতাম। চিঠি বইবার জন্য তিনি আমাকে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ দিয়েছিলেন।
হাবা গোবা মনে করে সবাই আমাকে ঠাট্টা করত, আমি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতাম আর বোকার মতন হাসতাম। কিন্তু কান সর্বদা খাড়া থাকত, গুজগুজ ফিসফিস করে কে কি বলছে সব মন দিয়ে শুনতাম। ক্রমশ আমার কানে এল—বৃদ্ধিচাঁদ খুব তুখড় কাজের লোক, সকলের সঙ্গে তাঁর ব্যবহারও ভাল। কিন্তু হাতটান আছে, ফার্মের টাকা সরিয়ে থাকেন, জুয়ো খেলেন, নেশা করেন, অন্য দোষও আছে।
রামনবমীর দিন ওঁদের নতুন খাতা হত। তার আগের দিন বড় বড় খদ্দেররা তাদের দেনা চুকিয়ে দিত। আমি বাহাল হবার পাঁচ—ছ মাস পরেই ওঁদের বছর কাবার হল, যাকে বলে সাল তামামি। রাত্রি পর্যন্ত কাজ চলবে তাই আমাদের জলখাবারের জন্যে প্রচুর কচৌড়ি আর লাড্ডু আনা হল। অনেক রাত পর্যন্ত টাকা আসতে লাগল, বৃদ্ধিচাঁদ তার কামরায় বসে নিজেই নোট আর টাকা গনতি করতে লাগলেন, আমি নোটের বাণ্ডিল বাঁধতে লাগলাম। চেক খুব কম, খুচরো টাকাও কম, বেশীর ভাগই পাঁচ শ, এক শ আর দশ টাকার নোট।
রাত এগারোটার সময় কাজ শেষ হল, আমলারা ছুটি পেয়ে চলে গেল। বৃদ্ধিচাঁদ আমাকে বললেন, হিসাব মিলাতে আমার কিছু দেরি হবে, হাব্বু, তুই দরজায় বসে থাক, আমার কামরায় কাকেও ঢুকতে দিবি না। আর শোন—এই প্যাকিটটা তোর কাছে রাখ, কাল মথুরানাথ মিসিরের কিতাবের দোকানে ফেরত দিয়ে বলবি, এসব জাসুসী কহানী (অর্থাৎ ডিটেকটিভ গল্প) বৃদ্ধিচাঁদজী পড়তে চান না, ভক্তমাল গ্রন্থ যদি থাকে তো তাঁকে যেন পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বই—এর প্যাকেটটা আমার চিঠি বিলির ব্যাগে পুরে আমি কামরার বাইরে পাহারায় বসলাম। বৃদ্ধিচাঁদ দরজা বন্ধ করে হিসাব মিলাতে লাগলেন। দরজার কবজার কাছে একটু ফাঁক ছিল, তাই দিয়ে আমি উঁকি মেরে দেখতে লাগলাম। ঘরে কেরোসিনের একটা বড় ল্যাম্প জ্বলছে, বৃদ্ধিচাঁদ টেবিলের উপর নোটের বাণ্ডিলগুলো নাড়াচাড়া করছেন, মাঝে মাঝে একটা বোতল থেকে মদ ঢেলে খাচ্ছেন। তাঁর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল, একটু পরেই খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দ বার হল, যেন খ্যাঁকশেয়াল ডাকছে। তিনি চেক আর খুচরো টাকা লোহার আলমারিতে বন্ধ করলেন, আর সমস্ত নোটের গোছা এক সঙ্গে খবরের কাগজে জড়িয়ে সরু দড়ি দিয়ে বাঁধলেন। তার পর পাশের ঘর থেকে একটা ছোট স্টীল ট্রাংক এনে মেঝেতে রেখে খুললেন। তাতে কাপড় চোপড় আছে।
ঠিক এই সময় আপিসে ঘরের সামনের রাস্তায় একটা ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়াল। সইস চেঁচিয়ে আমাকে বলল, এ হাব্বু, মাইজী এসেছেন, বৃদ্ধিচাঁদজীকে জলদি আসতে বল।
মাইজী হচ্ছেন কারবারের মালিক, প্রয়াগদাসের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, বৃদ্ধিচাঁদ যাকে ভাবীজী অর্থাৎ বউদিদি বলেন। আমি দরজা একটু ফাঁক করে বললাম, হুজুর, মাইজী এসেছেন, আপনাকে ডাকছেন। বৃদ্ধিচাঁদ বিরক্ত হয়ে বললেন, আঃ, আসবার সময় পেলেন না, এত রাত্রে টাকা চাইতে এসেছেন! কাজের সময় যত সব বখেড়া। আমাকে তো এখনই রওনা হতে হবে, ট্রেনের টাইম হয়ে এল। হাব্বু তুই ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ভিতরে বসে থাক, কেউ যেন না ঢোকে। আমি ভাবীজীকে বিদায় করে এখনই আসছি।
বৃদ্ধিচাঁদ তাঁর তোরঙ্গের কাপড়ের মধ্যে নোটের বাণ্ডিলটা গুঁজে দিলেন। ডালা বন্ধ করতে পারলেন না, একটু উঁচু হয়ে রইল। আমাকে বললেন, হাব্বু তুই তোরঙ্গের উপরে বসে থাক, আমি তুরন্ত আসছি।
বৃদ্ধিচাঁদ বেরিয়ে যেতেই সিদ্ধিদাতা গণেশ আমাকে বুদ্ধি দিলেন। তাড়াতাড়ি তোরঙ্গ থেকে নোটের বাণ্ডিলটা বার করে আমার ব্যাগে পুরলাম আর ব্যাগে যে বই—এর প্যাকেট ছিল তা তোরঙ্গে গুঁজে দিলাম। নোটের বাণ্ডিল আর বই—এর প্যাকেট আকারে প্রায় সমান ছিল।
একটু পরে বৃদ্ধিচাঁদ ফিরে এলেন। দেখলেন, আমি তোরঙ্গের উপর গট হয়ে বসে আছি, আমার চাপে ডালাটি ঠিক হয়ে বসেছে। ডালা একটু তুলে ভিতরে হাত দিয়ে দেখলেন বাণ্ডিলটা ঠিক আছে কিনা। তার পর চাবি বন্ধ করে বৃদ্ধিচাঁদ ব্যস্ত হয়ে আমাকে বললেন, আমি এখনই বহরমপুর রওনা হচ্ছি, ব্যাংকে টাকা জমা দিতে হবে। আর সময় নেই, তুই আমার তোরঙ্গটা স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দে।
বৃদ্ধিচাঁদ আপিস—ঘরে তালা লাগিয়ে তার চাবিটা আমাকে দিয়ে বললেন, কাল সকালে বৈজনাথবাবুকে দিয়ে আসবি। বৈজনাথ ছিলেন ফার্মের বড়বাবু, দূর সম্পর্কে মালিকের শালা।
আমার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে আর বৃদ্ধিচাঁদের তোরঙ্গ মাথায় নিয়ে আমি আগে আগে চললাম, বৃদ্ধিচাঁদ আমার পিছনে চললেন। স্টেশন খুব কাছে। সেখানে পৌঁছে টিকিট কেনা মাত্র ট্রেন এসে পড়ল। তোরঙ্গটা আমার হাত থেকে নিয়ে বৃদ্ধিচাঁদ উঠে পড়লেন, আর আমাকে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে বললেন, তোর বকশিস। তখনই ট্রেন ছাড়ল।
আমি তাড়াতাড়ি কাকারবাসায় ফিরে এলাম এবং নোটের বাণ্ডিলটা সুদ্ধ ব্যাগটা বালিশের মতন মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম মোটেই হল না। বৃদ্ধিচাঁদের হাসিটা ছিল ছোঁয়াচে। সমস্ত রাত জেগে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগলাম। আমার একটা তোবড়া টিনের তোরঙ্গ ছিল, তাতেই সর্বস্ব থাকত। সকালে সেই তোরঙ্গে নোটের বাণ্ডিল রেখে বৈজনাথবাবুর বাড়ি গিয়ে তাকে অপিসের চাবি দিলাম। বৃদ্ধিচাঁদ বহরমপুর গেছেন শুনে তিনি বললেন, বহুত তাজ্জ্বব কি বাত। তখনই তিনি প্রয়াগদাসের কাছে গেলেন।
বেলা দশটা নাগাদ হই হই কাণ্ড। সমস্ত শহরে রটে গেল—বৃদ্ধিচাঁদ বিস্তর টাকা নিয়ে পালিয়েছেন, ফার্মের আপিস পুলিসে ঘেরাও করেছে, প্রয়াগদাসের দু জন উকিলও সেখানে গেছেন। আমি কাকাকে বললাম, আমার মনিব তো ফেরার, এখানে থেকে কি করব, কলকাতায় গিয়ে কাজের চেষ্টা করি গে। কাকার তখন বুদ্ধি লোপ পেয়েছে, কিছুই বললেন না। আমি আমার টিনের তোরঙ্গ নিয়ে কলকাতায় চলে গেলাম। শুনেছিলাম দুদিন পরে পুলিশ আমাকে সাক্ষী তলব করেছিল, কিন্তু আমি তখন নাগালের বাইরে।
এর পরের কথা খুব সংক্ষেপে বলছি। কলকাতায় পৌঁছেই নামটা বদলে ধনঞ্জয় করলাম। যে হোটেলে উঠেছিলাম, দু দিন পরে সেখানেই বাজার সরকারের চাকরি জুটে গেল। তার জন্যে অবশ্য পঞ্চাশ টাকা জমানত দিতে হয়েছিল।
ভোলা বলল, ধনু মামা, আসল কথাই তো আপনি বললেন না। কত টাকা সরিয়েছিলেন?
—এখন পর্যন্ত ঠিক করে গুণতে পারি নি,—খাজাঞ্চীর কাজ তো আমার রপ্ত নেই। একবার গুণে হল দেড় লাখের কাছাকাছি, আর একবার হল চোদ্দ হাজার কম, আর একবার ত্রিশ হাজার বেশী। ভাবলাম, দুত্তোর, ঠিক করে জেনে কি হবে, টাকা তো ব্যাংকে দিচ্ছি না, আমার কাছেই থাকবে। তারপর রোজগারের চেষ্টায় লেগে গেলাম, সে সব বৈষয়িক কথা তোদের ভাল লাগবে না। একটা বিয়েও করেছিলাম, কিন্তু বউটা টিকল না। আমার এই রুপো বাঁধানো কলি হুঁকোটি সেই বিয়েতেই দান পেয়েছিলাম। পঞ্চাশ বছর ধরে অনেক রকম ব্যবসা করেছি, তেজারতিও করেছি। রোজগার মন্দ হয় নি। আমার বাবুগিরি আর বদখেয়াল ছিল না, তাই পুঁজির টাকা খরচ হয় নি, বরং একটু বেড়েই গেছে। শেষ বয়সে আর রোজগারের ইচ্ছে রইল না, শক্তিও গেছে, তাই কলকাতা ছেড়ে এই নিরিবিলিতে বাস করতে এসেছি। এইবার গীতাখানা একবার পড়ে ফেলতে হবে।
ভোলা বলল, বৃদ্ধিচাঁদের কি হল?
—তাঁর নামে হুলিয়া বেরিয়েছিল, শুনেছি তিনি সাধু সেজে হরিদ্বারে ছিলেন, পুলিস সেখানেই তাঁকে ধরে। অনেক দিন মামলা চলল, বৃদ্ধিচাঁদ তার জবান বন্দিতে বলেছিলেন—চুরি তো করেছে সেই শয়তান হাব্বু শালা, আমি শুধু বদনামের ভয়ে ভেগেছিলাম। তাঁর কথা কেউ বিশ্বাস করে নি। বৃদ্ধিচাঁদের নিশ্চয় জেল হত, কিন্তু তাঁর ভাবীজী তাঁকে বাঁচিয়ে দিলেন। স্ত্রীর অনুরোধে প্রয়াগদাস মকদ্দমা মিটিয়ে ফেললেন, শুনেছি বৃদ্ধিচাঁদ আসামে গিয়ে কাঠের কারবার ফে�দেছিলেন।
ভোলা বলল, আচ্ছা ধনু মামা, আপনার অত টাকা কাকে দিয়ে যাবেন?
—তোর মাকে অনেক টাকা দেব, আমার খুব সেবা করছে কিনা। বাকী আমার সঙ্গেই যাবে।
—সেকি! মরে গেলে কেউ টাকা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে নাকি?
—আমি ঠিক পারব, তোরা দেখে নিস।
ধনু মামার কথা শেষ হল। আমি তাঁর কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে গেলাম।
সাত দিন পরে একজন লোক আমাদের ইস্কুলে খবর দিল, ধনু মামা হঠাৎ মারা গেছেন, ভোলাকে তার মা এখনই বাড়ি যেতে বলছেন। ছুটি নিয়ে আমিও ভোলার সঙ্গে গেলাম।
ধনু মামাকে উঠোনে শোয়ানো হয়েছে। তাঁর মুখ একটু ফাঁক হয়ে আছে, যেন হাসতে হাসতেই মারা গেছেন। পাড়ার জন কতক মেয়ে পুরুষ ভোলার মাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন। তিনি চিৎকার করে হাত নেড়ে বলছেন, পাজী হতভাগা নিমকহারাম বুড়ো, এত দিন সেবা যত্ন করলাম, আর দিয়ে গেলেন মোটে দু শ! সর্বনেশে কুচুণ্ডে জোচ্চোর ছ্যাঁচড়। আমাকে না হয় ফাঁকি দিলি, দান ধ্যানের জন্যও তো রেখে যেতে পারতিস!
ভোলা খোঁজ নিয়ে আমাকে যা জানাল তা এই। —ধনু মামার তোরঙ্গ থেকে দুটো বাণ্ডিল আর একটা লেখা কাগজ বেরিয়েছে। ছোট বাণ্ডিলটার উপর লেখা আছে— ভোলার জননী কল্যাণীয়া শ্রীমতী নন্দরানীকে আমার উপার্জিত এই দুই শত টাকা নগদ দান করিলাম; ইহাই যথেষ্ট, স্ত্রীলোকের অধিক লোভ ভাল নহে। বড় বাণ্ডিলের উপর লেখা আছে—খুলিবে না, ইহা আমার দৈবলব্ধ নিজস্ব ধন, যেমন আছে তেমনি আমার চিতায় দেবে। কাগজটায় লেখা আছে—আমার যে রুপো বাঁধানো ঢাকাই কলি হুঁকা আছে, তাহা শ্রীমান ভোলানাথ পাইবে; এবং আমার আঙ্গুলে যে রুপোর গণেশ—মার্কা আংটি আছে তাহা ভোলানাথের বন্ধু শ্রীমান রামেশ্বর পাইবে।
ভোলার মা কিন্তু ধনু মামার অন্তিম ইচ্ছা পালন করেন নি, বড় বাণ্ডিলটাও খুলে দেখেছেন। তাতে বিস্তর নোট আছে বটে, কিন্তু তার দাম এক পয়সাও নয়, সমস্ত কাঁচি দিয়ে কুচি কুচি করে কাটা! তাঁর দৈবলব্ধ ধনের অপব্যবহার যাতে না হয় ধনুমামা তার পাকা ব্যবস্থা করে গেছেন। ভোলার মা সেই নোটের কুচি ঝেঁটিয়ে ফেলে দিলেন। হুঁকোটি ভোলার ভোগে লাগেনি, তার মা আছড়ে ভেঙে ফেলে রুপোর পাত খুলে নিলেন। কিন্তু আমাকে বঞ্চিত করেন নি, গণেশ—মার্কা রুপোর আংটিটা আমাকে দিয়েছিলেন। ধনু মামার সেই স্মৃতিচিহ্ন আমি সযত্নে রেখেছি।
১৩৬২ (১৯৫৫)