৩২.১০ কালতামামি

কালতামামি
উপাধ্যায় দশ

১. কাল তামামির সময় আসে নাই

পাঠক, আগের অধ্যায়ে যে কালতামামি পড়িয়াছেন, এটা কিন্তু তেমন কালতামামি না। আগের-আগের কালতামামিগুলি ছিল কালের বা যুগের হিসাব নিকাশ। আর এখানে যে যুগের কথা বলিতেছি, তার হিসাব-নিকাশ করিবার সময় আজও আসেনাই। এ যুগের দুইটা স্তর। আসলে একই যুগের এপিঠ-ওপিঠ। এক স্তরে লাহোর প্রস্তাবের পঁচিশ-বছর স্থায়ী বিট্রেয়ালের অবসান; অপর স্তরে নয়া যুগের শুরু। লাহোর প্রস্তাবের বিট্রেয়াল-সম্পর্কে ইতিপূর্বেই অনেক আলোচনা হইয়াছে। আমিও করিয়াছি। আমার সম্প্রতি-প্রকাশিত বাংলা বই ‘শেরে বাংলা হইতে বংগবন্ধু’ ও ইংরাজি বই End of a Betrayal and Restoration of Lahore Resolution এ সম্ভাব্য সকল দিক হইতে এই স্তরের বিস্তারিত আলোচনা করা হইয়াছে। এই অধ্যায়ে সে সবের পুনরুক্তি করা উচিৎ হইবে না। এইটুকু বলিলেই যখে হইবে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাহোর-প্রস্তাবের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছাড়া আর বেশ কিছু নয়।

আর এই যুগের অপর পৃষ্ঠাকে আমাদের জাতীয় জীবনের নয়া যমানা বলিয়াছি। এটা আমাদের স্বাধীনতার যুগ। এ যুগ রু হইয়াছে মাত্র। এই স্বাধীনতারই আবার অনেক দিক। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, কৃষ্টিক বা সাহিত্যিক স্বাধীনতা, জাতীয় ব্যক্তিত্বের সম্যক বিকাশ ও পরিপূর্ণতা লাভের স্বাধীনতা এই সবের সমবিত একাণ ও বিকাশের নামই স্বাধীনতা। লাহোর প্রস্তাবের বিট্রেয়ালটা প্রমাণিত হইতে এবং সে বিক্রয়ালের অবসান ঘটানোর মত নিগেটিভ কাজটা করিতেই দীর্ঘ পঁচিশ  বর লাগিয়াছে। লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন ও রূপায়নের মত পঘিটিত কাজ করিতে তার চেয়ে দীর্ঘতর সময় লাগিলেও তাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। অথচ আমাদের স্বাধীনতার কাজ মাত্র দুই বছর সমাপ্ত হইতেছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে ভুল-ভ্রান্তি আমরা অনেক করিয়াছি। কিন্তু ভাল কাজও কম করি নাই। কল্পনাতীত ও আশাতীত অল্প সমক্সের মধ্যে আমরা দেশকে একটি শাসনতান্ত্রিক সংবিধান দিয়াছি। পার্লামেন্টারি শাসন পদ্ধতিকে দৃঢ়-ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি। আঠার বছর বয়কে তোটাধিকার দিয়া আমরা গণকে গণের দিকে প্রসারিত করিয়াছি। দুই বছরের ইতিহাসটা কম কৃতিত্বের রেকর্ড নয়। কিন্তু এটা শুরু মাত্র। সমস্যা আমাদের অনেক বলিয়াই দায়িত্বও আমাদের বেশী। করণীয় আমাদের অনেক। আমাদের গরিকের সংসার। গরিবের সংসার বলিয়াই সমস্যাও আমাদের অনেক। সংখ্যায়নয়। বিবৃতি ও গভীরতায়ও। শুধু ভিতরের নয়, বাহিরেরও। শুধু দেহের নয়, মনেরও। শুধু পায়ের নয়, মাথারও। শুধু চলার নয়, চিন্তারও। এমন সর্বব্যাপী সমস্যার সমাধান কেউ দুই বছরে আশা করিতে পারেন না। ঠিক পথে চলিয়াছি কি না, সেটাই আমাদের বিচার্য। যদি তা করিয়া থাকি, তবে ওয়েল বিগান হা ডান। এই ওয়েল বিগানের পথে যদি কোনও বাধা, বিভ্রান্তি বা কন্টক সৃষ্টি হইয়া থাকে, তবে সেটা অবশ্যই সর্বাগ্রে দূর করিতে হইবে। এমন কয়টি বিভ্রান্তি সত্যই সৃষ্টি হইয়াছে। সেগুলিকে কন্টক বলা যায়। সে কয়টির দিকে দেশবাসীর, রাষ্ট্রনায়কদের এবং সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই এই কালতামামির উদ্দেশ্য।

২. জাতীয় ক্ষতিকর বিভ্রান্তি

এইসব বিভ্রান্তির মধ্যে প্রধান এইঃ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতায় পাকিস্তান ভাংগিয়া গিয়াছে; ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ মিথ্যা প্রমাণিত হইয়াছে।‘ এটা সাংঘাতিক মারাত্মক বিভ্রান্তি। অন্যান্য ক্ষতিকর বিভ্রান্তি মোটামুটি এটা হইতেই উদ্ভূত। এই বিভ্রান্তির সর্বপ্রথম ও প্রত্যক্ষ কুফল এই যে, এতে ভারত সরকারকে নাহক ও মিথ্যা বদনাম শোহইতে হইতেছে। পাকিস্তান যদি ভাংগিয়া থাকে, তবে ভারতই ভাংগিয়াছে। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হাসিলে ভারত সরকার সক্রিয় ও সামরিক সাহায্য করিয়াছেন। ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ যদি মিথ্যা প্রমাণিত হইয়া থাকে, তবে ‘৪৭ সালের ভারত বাটোয়ারার আর কোনও জাষ্টিফিকেশন থাকিতেছে না। কোরিয়া ভিয়েৎনাম ও জার্মানির মতই ভারতেরও পুনর্যোজনের চেষ্টা চলিতে পারে। ভারতবর্ষের বেলা সে কাজে বিলম্ব ঘটিলেও বাংলার ব্যাপারে বিশ্বের কোন কারণ নাই। উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি স্থাপনের পক্ষে এই ধরনের কথা ও চিন্তা যে কত মারাত্মক, বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা তা না বুঝিলেও ভারত ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়করা তা বুঝিয়াছেন। তাই উভয় পক্ষই কালবিলম্ব না করিয়া এ বিষধর সাপের মাথা ভাংগিয়া দিয়াছেন। ভারত সরকার এক মুহূর্ত বিলম্ব না করিয়া পশ্চিম প্রান্তে একতরফাভাবে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করিয়া পাকিস্তানের দিকে মৈত্রীর হাত বাড়াইয়াছেন। ওদিককার দখলিত ভূমি ও যুদ্ধবন্দী ছাড়িয়া দিয়াছেন। আর এদিকে বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়াছেন। বাংলাদেশের মাটি হইতে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী প্রত্যাহার করিয়াছেন। বাংলাদেশের সাথে মৈত্রী ও বাণিজ্য চুক্তি করিয়াছেন। বাংলাদেশকে জাতিসংঘের মেম্বর করিবার চেষ্টা করিতেছেন। এদিকে আমাদের প্রধান মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম সুযোগেই ঘোষণা করিয়াছেন : বৃহত্তর বাংলা গঠনের কোন ইচ্ছা আমার নাই। পশ্চিমবংগ ভারতেই থাকিবে। আমার দেশের বর্তমান চৌহদি লইয়াই আমি সন্তুষ্ট। অন্যের এক ইঞ্চি জমিও আমি চাইনা।

বাংলাদেশ-নেতৃত্ব আরো একটা ভাল কাজকরিয়াছেন। বাংগালী জাতির সংখ্যা সীমা নির্দেশ করিয়াছেন সাড়ে সাত কোটি। এটা সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের লোক সংখ্যা। এই ঘোষণার দরকার ছিল। আমাদের বাংগালী জাতীয়তার মূলনীতিতে ভারতের আতংকিত হইবার কারণ ছিল। ভারতে পাঁচ-ছয় কোটি নাগরিক আছেন যারা গোষ্ঠী গোত্র ও ভাষায় বাংগালী। এরা এককালে ছিলেন সারা ভারতের চিন্তা নায়ক। রাজনীতিতেও তাঁরা সারা ভারতকে নেতৃত্ব দিয়াছেন। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে কংগ্রেস-নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয়তা গ্রহণ করিবার আগেতক ঐরা বাংগালী জাতীয়তার, বাংগালী কৃষ্টি, বাংলার স্বাতন্ত্রের মুখর প্রবক্তা ছিলেন। ভারতীয় জাতীয়তার বৃহত্তর উপলব্ধিতে সেদিনকার সে বাংগালী-আবেগের অবলুপ্তি ঘটিয়াছে কি না, নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। তাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় এবং সে রাষ্ট্রের বাংগালী জাতীয়তাবাদের স্লোগানে ভারতীয় বাংগালীদের মধ্যে যুক্ত বাংলা ও বৃহত্তর-বাংলার আকর্ষণে বিভ্রান্তি ঘটা অসম্ভব নয়। এমনিতেই পূর্ব ভারতে একটু অস্থিরতা বিরাজ করিতেছে। তার উপর বাংগালী জাতীয়তার আবেগের ছোঁয়াচ লাগিতে দেওয়া উচিত হইবে না। এই কারণেই বাংগালী জাতীয়তার ব্যাপারে ভারত একটু সতর্ক। আমাদের রাষ্ট্ৰীয় চার মূলনীতির এক নীতি জাতীয়তায় তাই ভারত সরকারের অনীহা। ভারত সরকারের দলিল-দস্তাবেযে, নেতা-মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে আমাদের মূলনীতির তিনটার উল্লেখ থাকে। জাতীয়তাবাদের উল্লেখ থাকে না। বাংলাদেশের নেতৃত্ব ভারত সরকারের ও ভারতীয় নেতৃত্বের এই ইশারা বুঝিয়াছেন। তাই ঐ সাড়ে সাত কোটি বাংগালীর উল্লেখ। বস্তুতঃ ভারতীয় বাংগালীরা আর রাজনৈতিক অর্থে নেশন নন। তাঁরা এখন ভারতীয় নেশন। বাংগালীর পলিটিক্যাল নেশনহুডের ওয়ারিসি এখন ঐতিহাসিককারণেই বাংলাদেশেরউপর বর্তাইছে।

. লেজের বিষ

উভয় রাষ্ট্রের এই সুস্পষ্ট দৃঢ়তার লড়াঘাতে বিভ্রান্তির সাপের মাথাটা গুড়া হইয়াছে সত্য। কিন্তু সাপ আজও তার লেজনাড়িতেছে। এবং সাপের বিষ লেজে। তাই উম্মু রাষ্ট্রের কোনও কোনও অরাজনীতিক ও ‘বিদগ্ধ’ বুদ্ধিজীবীরা ‘পাকিস্তান ভাংগা’র ‘দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যর্থতা’র একাডেমিক ও থিওব্রেটিক্যাল ‘নির্ভুলতা’ আজও কপচাইয়া যাইতেছেন। এই সব বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধিসহ মন-অন্তর ও কলিজা দগ্ধ হইলেও তাঁদের মুখটা দন্ধ হইতে এখনও বাকী আছে। তাই তাঁদের মুখে শাশ্বত বাংলা, প্রবহমান বাংলা, সোনার বাংলা, হাজার বছরের বাংলা, গুরুদেবের বাংলা, বাংলার কৃষ্টি, বাংলার ঐতিহ্য, ইত্যাদি নিতান্ত ভাবাবেগের কবিত্বপূর্ণ কথাগুলিও রাজনৈতিক চেহারা লইয়া দেশে-বিদেশে বিষ ছড়াইতেছে। আমাদের দিক হইতেও বংগবন্ধু, জয় বাংলা, সোনার বাংলা, কবিগুরুর বাংলা, রূপসী বাংলা ইত্যাদি প্রতিধ্বনি করিয়া এপার-বাংলা-ওপার বাংলার ব্যাপারটাকে দুইটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় স্বাতন্ত্রের সীমান্তরেখা মসিলিপ্ত হইতে দিতেছি। আমাদের বিশেষ পরিস্থিতি ও অবস্থা, আমাদের বাংগালী জাতীয়তাবাদ, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, আমাদের জাতীয় সংগীত ও ভারতীয় জাতীয় সংগীত একই কবিগুরুর রচনা হওয়াটারও বিকৃতি করণের সুযোগ করিয়া দিতেছে। পাকিস্তানসহ দুনিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ যে আজও আমাদের দেশকে স্বীকৃতি দিতেছে না, আমাদের দেশবাসীসহ দুনিয়ার সব মুসলমানরা যে ভারত সরকারের প্রতি নাহক ও অন্যায় বৈরীভাব পোষণ করিতেছে, তার প্রধান কারণও এই বিভ্রান্তি।

অথচ প্রকৃত অবস্থাটা এই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় পাকিস্তানও ভাংগে নাই; দ্বিজাতিতত্ত্ব ও মিথ্যা হয় নাই। এক পাকিস্তানের জায়গায় লাহোর-প্রস্তাব মত দুই পাকিস্তান হইয়াছে। ভারত সরকার লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে আমাদের সাহায্য করিয়াছেন। তাঁরা আমাদের কৃতজ্ঞতার পাত্র। দুই রাষ্ট্রের নামই পাকিস্তান হয় নাই, তাতেও বিভ্রান্তির কারণ নাই। লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান শব্দটার উল্লেখ নাই, শুধু মুসলিম-মেজরিটি রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। তার মানে রাষ্ট্র-নাম পরে জনগণের দ্বারাই নির্ধারিত হওয়ার কথা। পশ্চিমা জনগণ তাদের রাষ্ট্র-নাম রাখিয়াছে পাকিস্তান। আমরা পূরবীরা রাখিয়াছি বাংলাদেশ। এতে বিভ্রান্তির কোনও কারণ নাই।

৪. অবিলম্বে কি করিতে হইবে?

অতএব কাল বিলম্ব না করিয়া নর্মাল অবস্থায় ফিরিয়া যাইতে হইবে। পাকিস্তান বাংলাদেশ পরম্পরকে স্বীকৃতি দিয়া তিন রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করিতে হইবে। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আপোস আলোচনার মাধ্যমে নয়া ও সাবেক সমস্ত বিবাদ-বিতর্ক মিটাইয়া ফেলিতে হইবে। যুদ্ধবন্দীদেরমুক্তি দিয়া আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ১০ই জানুয়ারির বিঘোষিত উদার-নীতি কার্যকর করিবে বাংলাদেশ। আর পঁচিশ  বছরের নাহোক, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জায়দাদের অংশ দিয়া বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার কাজে সাহায্য করিবে পাকিস্তান। পঁচিশ  বছরের এজমালী সংসারের লেনদেনে দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক যে পারস্পরিক গড়িয়া উঠিয়াছে, আজ দুই সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে সেই পারস্পরিকতাকে জনগণের উপকারে লাগাইতে হইবে। লড়াই করিয়া পাকিস্তান-বাংলাদেশ পৃথক হইয়াছে বলিয়াই তাদের মধ্যে মৈত্রী ও সহযোগিতা হইবে না, এটা কোন কাজের কথা নয়। মার্কিন মুলুক ও ইংলণ্ড লড়াই করিয়াই পৃথক হইয়াছিল। লড়াইর সে তিক্ততা, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি, প্রতিশোধের স্পৃহা, ক্ষয়ক্ষতির ধ্বংস লীলা, কোনোটাই ইংগ মার্কিন মৈত্রী ও সহযোগিতায় বাধা দিতে পারে নাই। যুদ্ধশেষে তারা এমন মিত্র হইয়াছে যে দুই শ বছরের সুদীর্ঘ মুদ্দতও সে-মৈত্রী ও সহযোগিতায় ফাটল ধরাইতে পারে নাই। পাক-বাংলাদেশ সম্পর্ক তেমন হইতে পারে।

শিমলা চুক্তি এ সব ব্যাপারে হইবে একটি আদর্শ দলিল। এটা দৃশ্যতঃ ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত হইলেও কার্যত এটা তিন রাষ্ট্রেরই চুক্তিপত্র। এর মধ্যে গোটা উপমহাদেশের কল্যাণের পন্থা নির্ধারিত ও নির্দেশিত হইয়াছে। এই চুক্তি আন্তরিকতার সাথে কার্যকর করিলেই স্পিরিট-অব-পার্টিশন বাস্তবায়িত হইবে। উপমহাদেশের চিরস্থায়ী শান্তি ও মৈত্রীর যে মহা পরিকল্পনা লইয়া ‘৪৭ সালে ভারত বর্ষ ভাগ হইয়াছিল, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার পথে উন্নতি অগ্রগতির যে সোনালী স্বপ্ন দেখিয়া কংগ্রেস-নেতৃত্বে হিন্দুরা দেশের তিন-চতুর্থ মেজরিটি হইয়াও এক-চতুর্থ মাইনরিটি মুসলমানদের দাবিতে দেশ ভাগ করিতে সম্মত হইয়াছিলেন, সেই স্পিরিটকে পুনরুজ্জীবিত ও বাস্তবায়িত করিয়া সেই সোনালী স্বপকে সফল করিতে হইবে। পঁচিশ  বছরের পাক-ভারত সহযোগিতা যে স্পিরিট-অব-পার্টিশন রূপায়িত করিতে পারে নাই, আজ বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের সহযোগিতা সেটাকে বাস্তবায়িত করিবেই। তিন রাষ্ট্রের মধ্যে এই দৃঢ় মনোভাব সৃষ্টি করিতে হইবে। স্পিরিট–অব-পার্টিশন বাস্তবায়নের পঁচিশ  বছরের ব্যর্থতা হইতে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে। অপরের কাঁধে দোষ চাপাইয়া সে ব্যর্থতার কৈফিয়ত দিলে চলিবে না। দোষ নিশ্চয়ই উভয় পক্ষেরই আছে। অপর পক্ষ দেখাইয়া দিবার আগেই যদি আমি নিজের দোষ বুঝিতে পারি, তবে উভয় পক্ষেরই সুবিধা হয়। উভয় পক্ষেরই এই সুবিধার কথাটা আগে পশ্চিম ফ্রন্টে প্রয়োগ করা যাক।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার স্থায়ী শান্তির কাঁটা জম্মু ও কাশ্মীর সমস্যা। পঁচিশ  বছরের অভিজ্ঞতা উভয় পক্ষকে বাস্তবাদী হইবার ইংগিত দিতেছে। পাকিস্তানকেও স্বীকার করিতে হইবে, তার পক্ষে জাতিসংঘের প্রস্তাব পঁচিশ  বছরেও কাজে লাগে নাই। ভারতকেও স্বীকার করিতে হইবে, শুধু দখলটাই ন্যায় সৃষ্টি করে না, শান্তি প্রতিষ্ঠা ত করেই না। কাজেই উভয় পক্ষকেই কাশ্মির বাটোয়ারায় রামি হইতে হইবে। নেহরুজী বাঁচিয়া থাকিলে ‘৬৫ সালের যুদ্ধের আগেই এটা মিটিয়া যাইত। নেহরু-আইউবের মধ্যে কাশির বাঁটোয়ারার যে স্কিম প্রায় গৃহীত হইয়া গিয়াছিল, সেই ধরনের কিছু-একটা পুনরায় বিবেচনা করিতে হইবে। উপমহাদেশের স্থায়ী শাস্তির যে মহান উদ্দেশ্য লইয়া কংগ্রেস নেতৃত্ব ’৪৭ সালে ভারত বর্ষ বাটোয়ারায় রাযি হইয়াছিলেন, সেই মহান উদ্দেশ্যের সাফল্যকে নিশ্চিত করিবার প্রয়োজনেই কাশির-বাটোয়ারায় রাবি হইতে হইবে। এটা না করাকেই আমি ১৯৫৭ সালে পণ্ডিত নেহরুর কাছে শান্তির জন্য গাছ-বাটোয়ারার পর পাতাপতুড়ি লইয়া অশান্তি জিয়াইয়া রাখার সাথে তুলনা করিয়াছিলাম। পণ্ডিতজীর নামটা যখন উঠিয়াই পড়িল, তখন শুধু কাশ্মীর সম্পর্কে কেন, বাংলা সম্পর্কেও তাঁর চিন্তা ধারার সাথে আমাদের পরিচয় থাকাদরকার। ‘এপার বাংলা-ওপার-বাংলার’ প্রগতিবাদীদের জন্যই এটা বেশী দরকার। এ সম্পর্কে এই বই-এর চব্বিশা অধ্যায়ের ‘ভারত সফরের’ ৪৪১ পৃষ্ঠায় ‘নেহরুর সাথে নিরালা তিনঘন্টা’ শীর্ষক অনুচ্ছেদটির দিকে আমি পাঠকগণের মনোযোগ আকর্ষণ করিতেছি। সেখানে দেখিবেন, পণ্ডিতজীর মতে ‘ভারত নিজের স্বার্থেই দুই বাংলার একত্রীকরণের বিরোধী।‘ এই বিরোধের কারণ সুস্পষ্ট। ‘যুক্ত বাংলা’ স্বাধীন সার্বভৌমই হউক, আর ভারত ইউনিয়নের অংগ-রাজ্যই হউক, উভয়টাই সংঘাতের পথ। বাস্তবতার বিচারে ওটা অসম্ভব, ভারত-বাংলাদেশ-মৈত্রীর দিক হইতে অবাঞ্ছনীয়, উপ-মহাদেশীয় শান্তির পরিপন্থী। এ সব জানিয়াও যাঁরা একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ও অপর স্বাধীন রাষ্ট্রের একটা অংগ-রাজ্যকে সমমর্যাদার স্তরে আনিয়া কথা বলেন, তাঁরা সাধারণভাবে উপমহাদেশীয় শান্তির বিরুদ্ধে ও বিশেষভাবে ভারত-বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করেন। উভয় রাষ্ট্রের শান্তিবাদী দেশপ্রেমিকদেরই এটা বিষবৎ পরিত্যজ্য। পূর্বাঞ্চলের স্থাপিত শান্তির বিরুদ্ধে নতুন উস্কানি না দিয়া অবশিষ্ট বিরোধ মিটানোর দিকেই সকলের দৃষ্টি দেওয়া উচিৎ। কাশ্মির-প্রশ্নটাই এই অবশিষ্ট বিরোধ। এর সমাধান-চেষ্টাই পুনঃপুনঃ করা উচিৎ। ১৯৬২ সালে যেটা হইতে-হইতে হয় নাই, ১৯৭৩ সালে সেটা হইতে পারে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনাতেই আপোস হইয়া যাইবার পরিবেশ এখন সৃষ্টি হইয়াছে। প্রয়োজন হইলে এমন মহৎ কাজে বাংলাদেশ মধ্যস্থতা করিতে পারে। উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তিতে তিনটি রাষ্ট্রেরই স্বার্থ সমভাবে জড়িত। এ অবস্থায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিরোধ মিটাইতে ভারত, ভারত-পাকিস্তান বিরোধ মিটাইতে বাংলাদেশ এবং ভারত-বাংলাদেশ বিরোধ মিটাইতে পাকিস্তান আগাইয়া আসিবে, এটা শুধু স্বাভাবিক নয়, পারস্পরিক কর্তব্যও বটে।

৫. বাংলাদেশের কৃষ্টিক স্বকীয়তা

পূর্ব-প্রান্তের সমস্যাটা রাজনৈতিক না হইলেও তার গুরুত্বও কম নয়। ইংরাজ আমলের দুই শ বছর আজকার বাংলাদেশ ছিল কলিকাতার হিস্টারল্যাণ্ড। কাঁচামাল সরবরাহের খামার বাড়ি। পঁচিশ  বছরের পাকিস্তান আমলে এই খামারে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও কিছু শিল্প বাণিজ্য গড়িয়া উঠিয়াছে সত্য, কিন্তু কৃষ্টিক স্বকীয়তা আজিও গড়িয়া উঠে নাই। পাকিস্তান সরকারের এদিককার চেষ্টা ছিল পূর্ব-পাকিস্তানে পশ্চিম-পাকিস্তানী কৃষ্টি চালাইবার অপচেষ্টা, পূর্ব-পাকিস্তানের নিজস্ব কালচার উন্নয়নের কোনও চেষ্টা হয় নাই। বাংগালী মুসলমানদের যে নিজস্ব কোনও কালচার আছে, সে উপলব্ধিই পশ্চিমা শাসকদের ছিল না। তাঁরা বাংলা ভাষাকে যেমন হিন্দুর ভাষা মনে করিতেন, বাংলার কৃষ্টি অর্থেও তেমনি হিন্দু কৃষ্টি বুঝিতেন। পাঞ্জাবী-সিন্ধী ভাষা-কৃষ্টির মতই বাংলাদেশেও একটা মুসলিম-প্রধান দৈশিক ভাষা-কৃষ্টি গড়িয়া উঠিতে পারে তা যেন তাঁদের মাথায় ঢুকেই নাই। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্প-বাণিজ্য এখন যেমন তাকে অর্থনীতিতে স্বয়ম্ভর করিবে, নিজস্ব কৃষ্টি সাহিত্যেও তেমনি এ দেশ জাতীয় স্বকীয়তা লাভ করিবে। বাংলাদেশ আর আগের মত কলিকাতার সাহিত্যকর্মের বাজার থাকিবে না।

বাংলাদেশের জাতীয় রূপ ও তার শিল্প-সাহিত্যের প্রাণ ও আংগিক সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করিতে হইলে গত ছয়শ বছরের বাংলার ইতিহাসকে দুইভাগে বিচার করিতে হইবে। ইংরাজ আমলের দুই শ বছর বাংগালী মুসলমানদের অন্ধকার যুগ। এই যুগের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাদের কোনও অবদান বা শরিকি নাই। এটা সম্পূর্ণভাবে একক হিন্দুদের সাহিত্য-সংস্কৃতি। এই যুগের মুসলমানদেরে দেখিয়াই হিন্দু লেখক সাহিত্যিকরা বলিয়া থাকেন : বাংগালী মুসলমানদের কাছে একটি মাত্র কালচার তার নাম এগ্রিকালচার। এ অবস্থায় ‘বাংগালী কালচার’, ‘বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি’ বলিতে তাঁরা যে হিন্দু-বাংলার সংস্কৃতি বুঝিয়া থাকেন, তাতে তাঁদেরে দোষ দেওয়া যায় না। সে কালচার যে অবিভাজ্য, তাও সত্য কথা। কারণ সে কালচারের হেঁসেল শ্রীকান্তের টগর বৈষ্টবীর হেঁসেলের মতই অলংঘ্য।

কিন্তু ইংরাজ আমলের আগের চারশ বছরের বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস গৌরবের ইতিহাস। সেখানেও তাদের রূপ বাংগালী রূপ। সে রূপেই তারা বাংলাভাষা ও সাহিত্য সৃষ্টি করিয়াছে। সেই রূপেই বাংলার স্বাধীনতার জন্য দিল্লীর মুসলিম সম্রাটের বিরুদ্ধে লড়াই করিয়াছে। সেই রূপেই বাংলার বার ভূঁইয়া স্বাধীন বাংলা যুক্তরাষ্ট্র গঠন করিয়াছিলেন। এই যুগ বাংলার মুসলমানদের রাষ্ট্রিক, ভাষিক, কৃষ্টি ও সামরিক মনীষা ও বীরত্বের যুগ। সে যুগের সাধনা মুসলিম নেতৃত্বে হইলেও সেটা ছিল উদার অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু-বৌদ্ধরাও ছিল তাতে অংশীদার। এ যুগকে পরাধীন বাংলার রূপ দিবার উদ্দেশ্যে হাজার বছর পরে আজ বাংলা স্বাধীন হইয়াছে বলিয়া যতই গান গাওয়া ও স্লোগান দেওয়া হউক, তাতে বাংলাদেশের জনগণকে ভূলান যাইবে না। আৰ্য জাতির ভারত দখলকে বিদেশী শাসন বলা চলিবে না; তাদের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, রাজপুত, কায়েস্থকে বিদেশী কলা যাইবে না, শুধু শেখ সৈয়দ-মোগল পাঠানদেরেই বিদেশী বলিতে হইবে, এমন প্রচারের দালালরা পাঞ্জাবী দালালদের চেয়ে বেশী সফল হইবে না। এটা আজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সর্বজনস্বীকৃত সত্য যে, কৃষ্টিক স্বকীয়তাই রাষ্ট্রীয় জাতীয় স্বকীয়তার বুনিয়াদ। কাজেই নয়া রাষ্ট্র বাংলাদেশের কৃষ্টিক স্বকীয়তার স্বীকৃতি উপমহাদেশের তিন জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌম সমতা-ভিত্তিক স্থায়ী শাস্তির ভিত্তি হইবে।

. উপমহাদেশীয় ঐক্যজোট

এইভাবে তিনটি জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যকার সাবেক ও বর্তমান বিরোধসমূহ এবং ভবিষ্যৎ বিরোধের সম্ভাবনা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে মিটাইয়া ফেলিবার পরই আমাদের প্রকৃত গঠনমূলক কাজ শুরু হইবে। তিনটি রাষ্ট্র আজ নিজ-নিজ প্রতিরক্ষার নামে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিতেছে, তার আর দরকার থাকিবে না। সে অর্থ অতঃপর জনগণের সেবায় নিয়োজিত হইবে। উপমহাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে তখন সামগ্রিকভাবে বিচার করিবার সময় আসিবে। সমবেত বৈজ্ঞানিক কারিগরি উপায়ে সে সম্পদের সৃমবায়িত সদ্ব্যবহার হইবে। শুরু হইবে সেটা উপমহাদেশের অর্থনৈতিক জোটে। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিটি ধরনের ঐক্যজোট হইবে আমাদের মডেল। এটা সফল হইলে চোরাচালান ও কালোবাজারি ইত্যাদি উপমহাদেশীয় অনেক অর্থনৈতিক সমস্যারই সমাধান হইবে। পরিণামে এই ঐক্য জোটে শ্রীলঙ্কা, বার্মা, নেপাল, ভূটান, সিকিম ও আফগানিস্তান আকৃষ্ট হইবে। আকৃষ্ট তাদের হইতেই হইবে। শান্তি-নিরাপত্তা তাদেরও দরকার। শান্তি আসতে পারে ঐক্য জোটের মাধ্যমেই। মনে রাখিতে হইবে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়াইবার একমাত্র উপায় বিশ্ব-শান্তি। বিশ্বশান্তি বড় কাজ। এক ধাপে তা আসিবে না। আঞ্চলিক শান্তি হইতে মহাদেশীয় শান্তি এবং মহাদেশীয় শান্তি হইতেই বিশ-শান্তি। তাই বিশ্ব-নেতৃত্ব আজ আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার ধারণাটা মানিয়া লইয়াছেন। পরবর্তী অনুচ্ছেদে তার আলোনা করিব। এখানে শুধু আঞ্চলিক শান্তির কথাই বলিতেছি। আঞ্চলিকই হউক আর বিশ্বই হউক শান্তির বড় শত্রু অস্ত্র নির্মাতা ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। অস্ত্র-শিল্প যাদের কায়েমী স্বার্থ হইয়া গিয়াছে, শান্তি তাদের স্বার্থবিরোধী। রোগ-ব্যাধি না থাকিলে ডাক্তার-ফার্মেসীর যে দশা, মালি-মোকদ্দমা থাকিলে উকিল-টাউটদের যা অবস্থা, যুদ্ধ না জানিলে অ-পিপতিদেরও সেই অবস্থা। সৌভাগ্যবশতঃ উপমহাদেশের হিন, রাষ্ট্র ও তাদের উপরোল্লিখিত পড়শীদের কেউই আমরা যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণে আজো ‘শিল্পোন্নত’ হই নাই। যুদ্ধ ফেলিয়া শান্তি ধরিবার এটাই আমাদের মাহেন্দ্রক্ষণ। এটা.এখন আমাদের লাভের কারবার। আমাদের মধ্যে অস্ত্র-নির্মাণের কায়েমী স্বার্থ একবার গড়িয়া উঠিলে শান্তি স্থাপন হইবে তখন লোকসানের কারবার। শান্তির মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দানা বখিবে তার পরিণতি খুবই ত হইবে। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ধারাটি যেমন রাজনৈতিক ঐক্যের দিকে হাত বাড়াইতেছে, আমাদের ঐক্যজোটও তেমন পরিণতি লাভ করিতে পারে। ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বে ইং সেন্টারিস্ট ও ইউনিয়নিস্টদের মোকাবিলায় ফেডারেলিস্টদের প্রাধান্য যত বাড়িবে, সর্ব ভারতীয় ও সর্ব-উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক ঐক্য ও পুনর্মিলন ততই বাঞ্ছনীয় ও সহজ হইয়া উঠিবে।

উপমহাদেশীয় এই ঐক্যজোটে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক কারণেই নেতৃত্ব দিবে ভারত। ভাররে এটা দাবি করিতে হইবে না। প্রতিবেশীদের আস্থা অর্জন করিলেই। তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়াই তাকে নেতা মানিবে। দাবি করিলে বরঞ্চ এই স্বাভাবিক গতি বিধিত হইবে। তা ছাড়া ভারত যখন সকল ব্যাপারে সত্যই বড়, সেই কারণেই উদার হওয়া তারই পক্ষে সম্ভব। এটা তার কর্তব্যও। ছোটদের মধ্যে যে কমপ্লেক্স থাকিবার কথা, ভারতের তা থাকিতে পারে না। ঘোট ও দুর্বলের জন্য যেটা হীনমন্যতা, বড় ও সবলের জন্য সেটাই উদারতা ও মহত্ত্ব। এই কারণেই ভারত যখন এর ব্যত্যয় করে, তখন আমি দুঃখিত হই। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনও রাষ্ট্র যখন নিতান্ত সদিচ্ছা লইয়াও ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ মিটাইবার কথা বলে, তখন ভারতের কেউ কেউ বলিয়া বসেন, ভারত ও পাকিস্তানকে সমপর্যায়ে ফেলিয়া বিচার করা উচিৎ না। কথাটা যে-অর্থেই বলা হউক না কেন, এটার ভুল ব্যাখ্যা হইতে পারে। বরঞ্চ ভারতের নেতৃত্ব যখন প্রকৃতির দান, তখন ভারত বলিবে : আমি নেতা নই; এই উপমহাদেশের সবাই সমান; এখানকার নেতৃত্ব সমবেত নেতৃত্ব। নেতা যত বেশী বলেন : আমি নেতা নই, তাঁর নেতৃত্ব তত জোরদার ও দীর্ঘস্থায়ী হয়।

৮. এশীয় ঐক্যজোট

এই পথে উপমহাদেশীয় ঐক্যজোট গঠিত হইলে পরবর্তী পদক্ষেপই হইবে এশীয় ঐক্যজোট। আজ ইউরোপীয় ঐক্য ও ইউরোপীয় নিরাপত্তার মতই এশীয় ঐক্য ও এশীয় নিরাপত্তার কথা সত্য হইতে চলিয়াছে। ঐক্য ও নিরাপত্তা আজ আর অস্ত্র-প্রতিযোগিতায় সীমিত নয়। সেটা বরঞ্চ আজ অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতায় রূপান্তরিত হইতেছে। ইউরোপীয় ঐক্য ও নিরাপত্তার জন্য আজ সোভিয়েট ব্লক ও পশ্চিমা গণতন্ত্রী রাষ্ট্র সমবেতভাবে চেষ্টা করিতেছে। এশিয়াতেও এটা হইতে বাধ্য। বলিতে গেলে এশিয়া মহাদেশই এ বিষয়ে অন্যান্য মহাদেশের পিছনে পড়িয়া রহিয়াছে। মার্কিন মহাদেশের প্রায় সকল রাষ্ট্রই অর্গেনিযেশন-অব-আমেরিকান স্টেট (ও. এ. এস) গঠন করিয়াছে সকলের আগে। আফ্রিকা মহাদেশের জাতীয় রাষ্ট্রগুলিও ইতিপূর্বেই অর্গেনিযেশন-অব-আফ্রিকান ইউনিটি (ও. এ. ইউ) গঠন করিয়া ফেলিয়াছে। ইউরোপীয় মহাদেশের পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূরে ই.ই.সি. সংস্থা ও রাশিয়ার নেতৃত্বে পূর্ব-ইউরোপীয় সমাজবাদী রকের মধ্যে ঐক্যজোটের চেষ্টার কথা ত আগেই বলিয়াছি। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি রাষ্ট্রের এসোসিয়েশন-অব-সাউথ-ইস্ট এশীয়ান স্টেট (এশিয়ান), আরব লীগ ও রক ইরান-পাকিস্তানের আর, সি, ডি.-কে এশীয় ঐক্যজোটের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে বিচার করিতে হইবে। এশীয় ঐক্যজোটের নেতৃত্ব পাইবে চীন প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক কারণেই। চীন ও ভারতের বিরোধ এই ঐক্যজোটের প্রতিবন্ধক হইবে, মনে হইতে পারে। কিন্তু আমি যে পরিবেশের কল্পনা করিতেছি, তাতে চীন-ভারত বিরোধের অবসান হইবেই। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেকার কাশির-বিরোধের মীমাংসা হইতে পারিলে চীন-ভারতের ম্যাকমেইন লাইনের বিরোধ মিটান যাইবে না কেন? চীন-ভারতের বিরোধ মিটানোর ব্যাপারে আগামীতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারে। এ বিষয়ে এবার বাংলাদেশ-পাকিস্তান যে ভূমিকা পালন করিবে, সেটা হইবে ৬০-৬২ সালের ভূমিকা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্ব-শান্তি আজ গোটা দুনিয়ার শ্লোগান। মানবজাতির কল্যাণের জন্যই এটা অপরিহার্য। এই বিশ্বশান্তির পদক্ষেপ হিসাবে এশীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা যখন সম্যক উপলব্ধ হইবে, তখন এশিয়ার শ্রেষ্ঠ দুইটি রাষ্ট্র ভারত ও চীন সে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় কোনও ত্যাগ স্বীকারকেই অসাধ্য বিবেচনা করিবে না।

অতএব দেখা গেল, বিশ্বশান্তির জন্য এশীয় ঐক্য এবং এশীয় ঐক্যের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে এই উপমহাদেশীয় ঐক্য-শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের ভূমিকা হইবে অনন্য সাধারণ। বস্তুতঃ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম এই বিপুল সম্ভাবনার বিশাল ভোরণ-দ্বার খুলিয়া দিয়াছে।

বাংলাদেশের নয়া নেতৃত্ব এই বিপুল সম্ভাবনাকে সফল করিয়া তুলুন, খোদার দরগায় এই মোনাজাত করিয়া আমার এই বই সমাপ্ত করিলাম। খোদা হাফেজ। ১৬ই নবেম্বর ১৯৭৩।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *