যুক্তফ্রন্টের ভূমিকা
আঠারই অধ্যায়
১. যুক্তফ্রন্ট গঠন
এই সময় জনাব ফযলুল হক সাহেব পূর্ব-বাংলা সরকারের এডভোকেট জেনারেলের চাকুরিতে ইস্তাফা দিয়া রাজনীতিতে প্রবেশ করিলেন। মওলানা ভাসানী ও জনাব শহীদ সুহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে এবং ছাত্র-তরুণদের সক্রিয় সমর্থনে ইতিমধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ খুবই জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইয়াছে। কাজেই সকলেই আশা করিল হক সাহেব আওয়ামী লীগেই যোগ দিবেন। দু-একটা জনসভায় বক্তৃতায় এবং বিবৃতিতে তিনি তেমন কথা বলিলেনও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি কৃষক-শ্রমিক পার্টি নামে একটি পার্টি গঠন করিলেন। সুতরাং হক সাহেবের সহযোগিতার খাতিরে একাধিক পার্টির সমন্বয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করা ছাড়া উপায় থাকি না। যতই দিন যাইতে লাগিল, ছাত্র-তরুণ প্রভৃতি প্রগতিবাদী চিন্তাশীলদের মধ্যে এবং শেষ পর্যন্ত জনসাধারণের মধ্যে এইরূপ যুক্তফ্রন্ট গঠন করার দাবি সার্বজনীন হইয়া উঠিল।
আওয়ামী লীগ-কর্মী হিসাবে এ বিষয়ে আমাদের কর্তব্য নির্ধারণের অন্য আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের অধিবেশন ডাকা অত্যাবশ্যক হইয়া উঠিল। ১৯৫৩ সালের মে মাসে ময়মনসিংহ শহরে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা হইল। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ভাষণে আমি যুক্তফ্রন্ট গঠন করার পক্ষে যুক্তি দেই। আবেদন করি। শেষ পর্যন্ত কাউন্সিল কৃষক শ্রমিক পার্টির সাথে যুক্তফ্রন্ট গঠন করার অনুমতি দেয়। অতঃপর হক সাহেব ও ভাসানী সাহেব যুক্তবিবৃতিতে যুক্তফুন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতাহার রচনার ভার আমার উপরই পড়ে। আমি ইতিপূর্বেই আওয়ামী লীগের ৪২ দফার একটি নির্বাচনী ইশতাহার রচনা করিয়াছিলাম। উহাকেই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতাহার করিবার কথা মওলানা সাহেব বলিলেন। কৃষক-প্রজা পার্টির নেতারা বলিলেন তাঁদের একমাত্র আপত্তি এই যে ঐ ইশতাহারে দফার সংখ্যা বড় বেশি। উহাকে কাটিয়া-ছাঁটিয়া পঁচিশ–ত্রিশের মধ্যে আনিতে হইবে। তাঁদের সংগে আলোচনা করিয়া দেখিলাম যে ৪২ দফাঁকে কমাইয়া ২৮ দফা করিলেই তাঁদের ইচ্ছা পূর্ণ হয়। এর পর বিনা-বাধায় রচনা শেষ করার জন্য আমাকে একলা এক ঘরে বন্দী করা হইল।
২. ২১ দফা রচনা
আমি মুসাবিদায় হাত দিলাম। মুসাবিদা করিতে-করিতে হঠাৎ একটা ফন্দি আমার মাথায় ঢুকিল। এটাকে ইপিরেশন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে চিরস্থায়ী করিবার জন্য শহীদ মিনার নির্মাণ, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষার সেবাকেন্দ্র করার তিনটি দফা আওয়ামী লীগের ৪২ দফায়ও ছিল। এই তিনটি দফাঁকে যুক্তফ্রন্টের ইশতাহারের অন্তর্ভুক্ত করিতে কৃষক-শ্রমিক পার্টির। নেতারা রাখী হইয়াছেন। সুতরাং তা হইবে। তা হইলে যুক্তফ্রন্টের মতেও ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব-বাংলার ইতিহাসে একটা স্মরণীয় দিন। কাজেই ২১ ফিগারটাকে চিরস্মরণীয় করিবার অতিরিক্ত উপায় হিসাবে যুক্তফ্রন্টের কর্মসূচিকে ২১ দফার কর্মসূচি করিলে কেমন হয়? ৪২ দফা কাটিয়া ২৮ দফা করা গেলে ২৮ দফাঁকে কাটিয়া ২১ দফা করা যাইবে না কেন? নিশ্চয় করা যাইবে। তাই করিলাম। অতঃপর আমার কাজ সহজ হইয়া গেল। ইতিহাস বিখ্যাত ২১ দফা রচনা হইয়া গেল। এই একুশ দফা মেনিফেস্টো পরবর্তীকালে পূর্ব-বাংলার ছাত্র-জনতার জীবন-বাণী হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৮টি আসন দখল করিয়াছিল। শতকরা সাড়ে ১৭টি ভোট পাইয়াছিল। এত বড় জয়ের প্রধান কারণ ছিল এই ২১ দফা। আমি নিজে ছাত্র-তরুণ ও জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়া বুঝিয়াছি ২১ দফা সত্য-সত্যই তাদের মধ্যে নব জীবনের একটা স্বপ্ন সৃষ্টি করিয়া ছিল। যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব-দোষে কিভাবে এই বিপ্লবাত্মক পার্লামেন্টারি জয়টা নস্যাৎ হইয়াছিল, সে কথা আমি একটু পরে বলিতেছি। যুক্তফ্রন্টের ঐ বিজয় নস্যাৎ হওয়ার পর জনগণের দুশমনরা কিভাবে ২১ দফাঁকেও নস্যাৎ করিতে চাহিয়াছে এবং অনেকখানি সফল হইয়াছে, সে কথাটাই প্রসঙ্গক্রমে ও সংক্ষেপে আমি এখানে বলিতেছি।
৩. ২১ দফার যৌক্তিকতা
২১ দফাঁকে জনগণের শত্রুরা প্রথমতঃ ইউটোপিয়া ও মিথ্যা স্তোক বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। তাঁদের মতে ২১ দফার বেশির ভাগ ওয়াদাই ইম্প্যাকটিকেবল। যুক্তফ্রন্টের নেতারা জানিয়া-শুনিয়াই এইসব মিথ্যা ওয়াদা করিয়াছেন। ভোটারগণকে মিথ্যা স্তোক দিয়া ভোট নেওয়া হইয়াছে। ঐসব ওয়াদা পূরণের ইচ্ছা যুক্তফ্রন্ট নেতাদের ছিল না। দ্বিতীয়তঃ অনেকে বলিয়াছেন যে কি যুক্তফ্রন্টের নেতারা, কি প্রার্থীরা, কি ভোটাররা কেউ ১১ দফার বিষয় সিরিয়াসলি চিন্তাও করেন নাই। ঐসব ওয়াদার মর্ম বুঝিয়া ভোটাররাও ভোট দেয় নাই। প্রার্থীরাও ভোট চাহেন নাই। শুধু মুসলিম লীগ-নেতাদেরে গাল দিয়া এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ডাহা-ডাহা মিথ্যা অভিযোগ করিয়া ভোটারগণকে ভুল বুঝানো ও ক্ষেপানো হইয়াছে। মুসলিম লীগের উপর রাগ করিয়া ভোটাররা এই নিগেটিভ’ ভোট দিয়াছে। এই দুই শ্রেণীর বিরোধী দল ছাড়া যুক্তফ্রন্টের ভিতরেও ২১ দফার বিরোধী অনেকে ছিলেন। এদের কেউ-কেউ ২১ দফার এক হাজার টাকা মন্ত্রি-বেতনের দফাটাকে অবাস্তব এবং সাধারণ নির্বাচনের ছয় মাস আগে মন্ত্রিসভার পদত্যাগের দফাটাকে অতিরিক্ত সাধুতা বলিয়া অভিহিত করেন। ২১ দফার রচয়িতা বলিয়া আমাকেই এদের নিন্দা সহিতে হইত। বিশেষতঃ এক হাজার টাকা মন্ত্রি-বেতনে কি করিয়া চলিতে পারে? যেখানে সরকারী কর্মচারিরা তিন হাজার, হাইকোর্টের জজের চার হাজার টাকা বেতন পান, সেখানে সকল কর্মচারি ও বিচারকের কর্তা মন্ত্রীরা হাজার টাকা বেতনে মান-মর্যাদা ও শান শওকত বজায় রাখিয়া চলিতে পারেন না। আমার মাথার এই সিধা সহজ কথাটা না ঢুকায় তাঁরা নিজেদের মধ্যে আমাকে হয় নির্বোধ নয় একরোখা সোজা কথায় পাগল) বলিয়া অভিহিত করিতেন। কিন্তু প্রকাশ্যভাবে কিছু বলিতেন না। তথাপি তাঁদের মতামত আমার কানে আসিত। আমি তাঁদের অভিমত মন দিয়া বিচার করিয়াছি। কিন্তু আমার মত পরিবর্তনের কোনও কারণ আজও খুঁজিয়া পাই নাই। পূর্ণ-আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন রাষ্ট্রভাষা বর্ধমান হাউস শহীদ মিনার ইত্যাদি সব বিষয়ের দাবি যে নিতান্ত বাস্তব ও যুক্তিসংগত ছিল, কাজের মধ্যে দিয়া ও জনগণের পূর্ণ সমর্থনে আজ তা প্রমাণিত হইয়াছে। শুধু বাকি আছে হাজার টাকা মন্ত্রি-বেতনের দফাটা। জন গণের নির্বাচিত প্রতিনিধি মন্ত্রীদের বেতন কি হইবে, তা বিচার করিবার মাপকাঠি আমার মতে দুইটিঃ (১) জনগণের মাথাপিছু আয়ের অনুপাত; (২) দেশে জীবন যাত্রার সাধারণ মানের অনুপাত। আমার ব্যক্তিগত মত এই যে চালে-চলনে এবং খোরাকে-পোশাকে জাতীয় নেতারা জনগণ হইতে খুব বেশি দূরে থাকিবেন না। আমার এই অভিমত কোনও অস্পষ্ট অনির্দিষ্ট ও অবাস্তব আইডিয়েলিযম নয়। এর বুনিয়াদ গণিতিক ও স্ট্যাটিসটিক্যাল। ভারতের কংগ্রেসী মন্ত্রীরা এবং চীনের ও ভিয়েৎনামের জাতীয় নেতা মাওসেতুং ও হোচিমিনের জীবন-মান ও বেতনই এ ব্যাপারের আদর্শ নযির। আমার দেশবাসীর গড়পড়তা মাথাপিছু আয় কত এবং তাদের সাধারণ জীবন মান কি, এ সম্পর্কে দুই মত হওয়ার উপায় নাই। সরকারী কর্মচারি ও নির্বাচিত প্রতিনিধি প্রভৃতি দেশ-শাসকগণ জনগণের জীবন-মান হইতে কতদূরে যাইতে পারেন, তারও একটা সুপ্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রেওয়াজ আছে। এই তিনটি ফ্যাক্টর একত্র করিয়া বিচার করিলে বুঝা যাইবে যে ২১ দফার মন্ত্রি-বেতনের ধারাটা অবাস্তব পাগলামি নয়।
৪. জনগণ ও শাসক-শ্রেণী
অফিসারদের বেতনের সংগে তুলনায় যে মন্ত্রিবেতন দৃষ্টিকটু মর্যাদাহানিকর রূপে কম হইয়া পড়ে, সেটাও আমার বিবেচনার মধ্যে ছিল। আইন ও শাসনতান্ত্রিক বাধা হেতু ২১দফায় তার উল্লেখ করা হয় নাই। আমাদের দেশের শাসন-খরচা বেশি। এ সম্বন্ধে দুইমত নাই। এটাকে বহু বিশেষজ্ঞ মাথা-ভারি শাসনযন্ত্র বলিয়াছেন। রাষ্ট্রের রূপ অবাধ অর্থনীতি বা রাস্তায়ত্ত সমাজবাদ, এসব গুরুতর বিষয়ে তর্ক তুলার স্থানও এটা নয়। তার দরবারও নাই। জনগণের কল্যাণই সকল মতের চরম কথা। তা যদি হয় তবে শেষ পর্যন্ত জনগণের ইচ্ছা-অনুযায়ী সব ব্যবস্থা হইবে এটাও জানা কথা। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ খতম হইবেই। রাষ্ট্রনায়করা যদি বিদেশী হন তবে এই মিলেনিয়াম বা সত্যযুগ লাভের প্রতিবন্ধকতা হয়। তাই স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ এ যুগের বাণী। রাষ্ট্রনায়করা দুই রকমে বিদেশী হইতে পারেন : (১) ভিন্ন দেশ হইতে আগত বিদেশী; (২) দেশজাত বিদেশী। আমরা ১৯৪৭ সালে প্রথম। শ্রেণীর বিদেশীদের হাত হইতে উদ্ধার পাইয়াছি। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর বিদেশীদের হাত হইতে রক্ষা পাই নাই। পাওয়ার ভরসাও দেখিতেছি না। বেশি লম্বা না করিয়া এক কথায় আমি আমার মনোভাব ব্যক্ত করিতেছি। পোশাক-পরিচ্ছদে এবং কথাবার্তায় আমাদের রাষ্ট্রনায়করা আজও বিদেশী। আমাদের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভা জজ ম্যাজিস্ট্রেট প্রত্যেকে, আফিস-আদালত সেক্রেটারিয়েট, স্কুল-কলেজ সমস্ত বিভাগের এবং ব্যবসায়ী মহলের প্রায় সকলে, এখনও ইংরেজী শোশাক সগৌরবে পরিতেছেন। দেখিলে কে বুঝিবেন এটা পূর্ব-বা পশ্চিম-পাকিস্তান? জাতীয় পোশাকই জাতির স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের সবচেয়ে লক্ষণীয় ও উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। একথা সবাই যেন বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছেন। যেমন পোশাকে, তেমনি ভাষায়। আমরা কেউ পারত পক্ষে ইংরেজী ছাড়া কথা বলি না। চিঠি-পত্র লিখি না। ইংরেজীকেই আমরা ভদ্রলোকের ভাষা মনে করি। যারা বাংলায় কথা বলি, তারাও পূর্ব-বাংলার ভাষা বলি না। পশ্চিম বাংলার কথ্য ভাষাকেই আমরা ভদ্রলোকের বাংলা মনে করিয়া থাকি। এই অবস্থার দুইটা প্রধান কুফল: (১) আমরা দেশের জনসাধারণ হইতে এমন দূরে থাকিতেছি যে কার্যতঃ আমাদিগকে বিদেশী বলা চলে। (২) আমরা নিজেরা আত্মসম্মান-বোধ হারাইতেছি এবং জনগণের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ সৃষ্টির প্রতিবন্ধকতা করিতেছি। এসব কথা ২১ দফার মন্ত্রি-বেতনের ধারার আলোচনায়। প্রাসংগিক এই জন্য যে যদি দেশের শাসকরা বিদেশী ত্যাগ করিয়া দেশী হন তবে ঐ বেতনই যথেষ্ট মনে হইবে। আমার এখনও দৃঢ় বিশ্বাস, যতই দিন যাইবে ততই এটা সত্য প্রমাণিত হইবে যে ২১ দফা পূর্ব-বাংলার জনগণের মুক্তির সনদ। যুক্তফ্রন্টের এম. এল. এ. অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম (বর্তমানে বাংলা। কলেজের প্রিন্সিপাল) একুশ দফার রূপায়ণ’ নামক যে সুচিন্তিত যুক্তিপূর্ণ বই লিখিয়াছেন, তা পড়িলেই এ বিষয়ে অনেক ভ্রান্ত ও অস্পষ্ট ধারণা দূর হইবে।
৫. যুক্তফ্রন্ট্রে প্রচারে বিলম্ব
যুক্তফ্রন্ট গঠনে গোড়ার দিকে দুই দলের কোনও কোনও উপনেতার মধ্যে কোনও কোনও বিষয়ে মন-কষাকষি হইল। সে মন-কষাকষি দুই প্রধান নেতা হক সাহেব ও ভাসানী সাহেবের মধ্যে সংক্রমিত হইল। ফলে যুক্তফ্রন্টের ভিত্তি পাকা যুক্তফ্রন্টের ভূমিকা হইতে অযথা বিলম্ব হইল। যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গিয়া যায় যায় আর কি? হক সাহেবের সমর্থক ও ভাসানী সাহেবের সমর্থকদের মধ্যে ঢাকা শহরে বেশকিছুটা বিক্ষোভ প্রতিবিক্ষোভও হইয়া গেল। খোদা-খোদা করিয়া শেষ রক্ষা পাইল। শহীদ সাহেবের দূরদশী আত্মত্যাগের ফলেই এটা সম্ভব হইল। হক সাহেব, ভাসানী সাহেব ও শহীদ সাহেবের দ্বারা সুপ্রিম নমিনেটিং বোর্ড গঠিত হইবে এটা স্পষ্টই বোঝা গেল। এতে আওয়ামী-নেতৃত্ব ভারি হইয়া যাইবে, নমিনেশনে কৃষক-শ্রমিক পার্টির প্রতি অবিচার হইবে, প্রধানতঃ এই ধারণার বশেই এই ভুল বুঝাবুঝির শুরু। এই ভুল বুঝাবুঝি দূর করিলেন স্বয়ং শহীদ সাহেব। তিনি বলিলেন : সুপ্রিম পার্লামেন্টারি বোর্ড হইকেন মাত্র দুইজ : হক সাহেব ও ভাসানী সাহেব। তিনি নিজে হইবেন মাত্র ‘গ্লরিফাইড হেডক্লার্ক’। নমিনেশনের ব্যাপারে তিনি হক-ভাসানীর যুক্ত সিদ্ধান্ত মানিয়া লইবেন। শহীদ সাহেবের এ ঘোষণায় সমস্ত ভুল বুঝাবুঝি দূর হইল।
এ সবের দরল যুক্তফ্রন্টের প্রচারকার্য বিলম্বিত হইল। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের সহায় হইলেন আল্লা। মুসলিম লীগের সুবিধার জন্যই বোধ হয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচন এক মাস পিছাইয়া দিয়া ফেব্রুয়ারি হইতে ৮ই মার্চ নিয়া গেলেন। এই মূলতবিটা যুক্তফ্রন্টের বরাতে শাপে বর এবং মুসলিম লীগের রাতে বরে শাপ হইল। যুক্তফ্রন্টের সেক্রেটারিদ্বয় : জনাব আতাউর রহমান খী ও চৌধুরী কফিলুদিন যাঁর-তাঁর নির্বাচনী এলাকায় মনোযোগ দিতে বাধ্য হইলেন। হক সাহেব ও ভাসানী সাহেব প্রচার উপলক্ষে মফসসলেই থাকিলেন। আফিস সেক্রেটারি জনাব কমরুদ্দিন আহমদের সাহায্যে শহীদ সাহেব একাই যুক্তফ্রন্টের ‘রিফাইড হেড ক্লার্ক’ রূপে যুক্তফ্রন্ট আফিস জীবন্ত রাখিলেন। প্রার্থীগণের ভিড় তাঁর কাছেই হইতে থাকিল। আহার-নিদ্রা ত্যাগ করিয়া তিনি সত্য-সত্যই চবিশ ঘন্টা প্রার্থীদের দাবি-দাওয়া শুনিতে লাগিলেন। দুই শ সাইত্রিশটি মুসলিম আসনের জন্য এগার শর বেশি মনোনয়ন-প্রার্থী দরখাস্ত করিলেন। এদের প্রত্যেকের এবং তাঁদের সমর্থকদের সকলের সাথে দেখা করা ও তাঁদের কথা শোনা ছিল একটা অমানুষিক দানবীয় ব্যাপার। শহীদ সাহেব এই দানবীয় কাজটিই করিলেন হাসি মুখে। গোসল বাদ দিতে হইল। মোলাকাতীদের সামনেই তিনি গোগ্রাসে মুরগীর আধার ঠাকরাইয়া খাইয়া-খাইয়া দিনের-পর-রাত ও রাতের পর-দিন কাটাইতে লাগিলেন। তথাকথিত সুপ্রিম পার্লামেন্টারি বোর্ড মানে হক সাহেব ওভাসানী সাহেব প্রার্থী মনোনয়নের ধারে-কাছেও আসিলেন না। সব দায়িত্ব বর্তাইল শহীদ সাহেবের কাঁধে। তিনি আওয়ামী লীগ-কৃষক-শ্রমিক দলের প্রায় বিশ জন নেতা লইয়া একটি সিলেকশন বোর্ড করিলেন। বাছাইর কাজ এঁরাই করিলেন। প্রায় সব গুলি বাছাই উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে হওয়ায় নিবিরোধে শহীদ সাহেব এ কাজ করিতে পারিলেন। এক স্তরে প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের ভিড় এড়াইবার জন্য শহীদ সাহেব সিলেকশন বোর্ডের আমাদের সকলকে লইয়া পলাইয়া চৌধুরী হামিদুল হক সাহেবের আন্দর বাড়িতে আশ্রয় লইলেন। সেখানে নন-স্টপ বৈঠকে নমিনেশনের কাজ শেষ করা হইল। সবাই ভালয় ভালয় হইয়া গেল। যদিও হক সাহেব ও ভাসানী সাহেব মফসসলে বসিয়াই এখানে-ওখানে দুই একটা নমিনেশনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়া কিছু-কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিয়াছিলেন, কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু ক্ষতি হয় নাই। দুই এক জায়গায় যুক্তফ্রন্টের অফিশিয়াল নমিনি হারিয়া গেলেও তাতে খাঁটি জন প্রতিনিধিরাই নির্বাচিত হইয়াছিলেন।
৬. প্রচারকার্য শুরু
যুক্তফ্রন্টের প্রচারে গোড়ার দিকে কোনও সিস্টেম ছিল না। হক সাহেব ও ভাসানী সাহেবের ব্যক্তিগত সফরসূচিই ছিল যুক্তফ্রন্টের একমাত্র রসা। এই উভয় নেতার জনপ্রিয়তা ছিল এই সময় আকাশচুী। ফলে তাতেই আমাদের কাজ এরূপ চলিয়া যাইত। কিন্তু নিশ্চিত হইবার উপায় ছিল না। তার কারণ ছিল দুইটি প্রথমত জনমত তখনও তেমন সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করে নাই। দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী ও প্রাদেশিক প্রধানন্ত্রী নুরুল আমিন সাহেব মুসলিম লীগ কমী-বাহিনী ও গ্রীন শাট নামক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী লইয়া প্রচারে নামিয়াছেন। তার উপর আই. জি. ডি. আই. জি, জিলা ম্যাজিস্ট্রেট কমিশনাররাও তাঁদের কী বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী স্পেশিয়াল ট্রেনে দেশ ভ্রমণ ও প্রচার শুরু করিয়াছেন। কায়েদে-আষমের ভগিনী মোহমো মিস ফাতেমা জিন্নাহু, মওলানা এহতেশামূল হক থানবীর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের বড়-বড় আলেম পাকিস্তানের সংহতি ও ইসলামের নামে প্রচারে বাহির হইয়াছেন। এ অবস্থায় চুপ করিয়া বসিয়া থাকা যায় না।
শহীদ সাহেব সিস্টেমেটিক প্রচারের কর্মপন্থা নির্ধারণ করিলেন। পশ্চিম পাকিস্তান হইতে সীমান্ত-গান্ধী খান আবদুল গফফার খাঁ, নবাবদা নসর, শেখ হিসামুদিন, গোলাম মোহাম্মদ খা, সূন্দোর মাহমুদুল হক ওসমানী, মিয়া ইফতেখারুদ্দিন প্রভৃতি বই নেতা আনিলেন। তাঁদের সকলের সুনির্দিষ্ট সফর-তালিকা করিলেন। সেই তালিকা ঠিক-ঠিক মত পালন করিয়া শহীদ সাহেব এই নেদেত্রে লইয়া প্রচারে বাহির হইলেন। আমার জিলা ময়মনসিংহ উতয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ টার্গেট ছিল বলিয়া শহীদ সাহেবও এ জিলার প্রতি বিশেষ মন দিলেন। সব নেতাদের লইয়া তিনি এ জিলায় আসিলেন। আমার গরীবখানায় মেহমান হইলেন। ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখ করিতেছি দুইটি কারণে। প্রথমত, সীমান্ত পার খা ও আওয়ামী নেতা গোলাম মোহাম্মদ সুলখোরের প্রচারধারার তারিফ করিতে হয়। উভয় নেতা বিশেষতঃ গফফার খার পাঠানী ‘অশুদ্ধ’ উর্দু বাংগালী শ্রোতাদের খুবই সহজবোধ্য হইয়াছিল। তাঁর ভাংগা উর্দু আমাদের পাড়াগাঁয়ে মুসলিম জনতার যুক্তফ্রন্টের ভূমিকা যবানের প্রায় কাছাকাছি ছিল। সে ভাষায় তিনি যে সব কথা বলিয়াছিলেন, পূর্ব বাংলার শেষিত জনগণের প্রতি দরদে-রা ছিল সে সব উক্তি। এই কারণে তাঁর বক্তৃতায় জনগণের প্রতি অমন আবেদন ছিল। অন্যান্য উর্দু বক্তাদের সাথে সীমান্ত গান্ধীর পার্থক্য ছিল এইখানে। দ্বিতীয়তঃ এই উপলক্ষে আওয়ামী লীগাররা বিশেষতঃ আমি নিজে সীমান্ত-গান্ধীর পাখতুনিস্তান আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত ও খুটি-নাটি প্রশ্ন করি। উত্তরে তিনি স্পষ্টই বলেন যে তাঁর দাবি, সীমান্ত প্রদেশের জাতি-গোত্রহীন ও অপমানকর নাম বদলাইয়া তার একটা জাতিভাষাগত নাম দেওয়া। যথা : বেলুচিস্তান, সিন্ধু, পাঞ্জাব ও বাংলা। এই প্রদেশের লোক পুত য় পাখতুন ভাষা– ভাষী বলিয়া তার নাম হওয়া উচিৎ পাতুনিস্তান। তাঁর দ্বিতীয় দাবি, ঐ প্রদেশ বায়ত্তশাসিত হইবে। পাকিস্তানের প্রদেশ হিসাবেই সে পাখতুনিস্তান থাকিবে। পাকিস্তানের বাইরে স্বাধীন রাষ্ট্র বা আফগানিস্তানের অংগ হিসাবে পাখতুনিস্তানের কনা তিনি কোনও দিন করেন নাই। কথাটা আমরা বিশ্বাস করিয়াছিলাম। ১৯৪৮ সালে করাটিতে পাকিস্তান গণ-পরিষদে দাঁড়াইয়া তিনি এই কথাই বলিয়াছিলেন : সে কথাও আমার মনে পড়িল। আমি কলিকাতায় বসিয়া ‘ইত্তেহাদের’ সম্পাদকীয় প্রবন্ধে তাঁর এই দাবি সমর্থন করিয়াছিলাম, সে কথাও আমার স্মৃতি-পটে উদিত হইল। পরবর্তীকালে শহীদ সাহেব গফফার খাঁর এই দাবি সমর্থন করিয়াছিলেন। ১৯৫৫ সালে মারিতে দ্বিতীয়গণ-পরিষদের প্রথম বৈঠক উপলক্ষে খান আবদুল গফফার খা তৎকালীন আইন মন্ত্রী আমাদের নেতা শহীদ সাহেবের সাথে আমাদের উপস্থিতিতে যে আলাপ করিয়াছিলেন, তাতেও এই দাবিরই তিনি পুনরাবৃত্তি করিয়াছিলেন। এই দাবির সমর্থনে ১৯৫৬ সালে শাসন বিলে আমি সীমান্ত প্রদেশের নাম পাঠানিস্তান করিবার সংশোধনী দিয়াছিলাম। পক্ষান্তরে মুসলিম লীগ নেতারা গফফার খাঁর বিরুদ্ধে কি বিভ্রান্তিক প্রচারণাটাই না করিয়াছিলেন এবং আজও করিতেছেন।
এইভাবে সীমান্ত গান্ধীর রাজনীতি সম্বন্ধে আমাদের কর্মীদের অনেক ভ্রান্ত ধারণা হইয়াছিলভার ফলে তাঁর প্রচারকার্য যুক্তফ্রন্টের খুবই কাজে লাগিয়াছিল।
৭. জনগণের সাড়া
যাহোক হক-ভাসানী-সুহরাওয়ার্দীর সমবায়ে দেশময় যে প্রাণ-চাঞ্চল্যের বন্যা আসিল, তাতে মুসলিম লীগের মত ক্ষমতাসীন দল ভাসিয়া গেল। ফল যে এমন হইবে, পনর দিন আগেও আমি তা বুঝিতে পারি নাই। জনগণের উৎসাহ পল্লীগ্রামের নারীজাতির মধ্যেও ছড়াইয়া পড়িল। আমার নিজের এলাকায় দেখিয়াছি পর্দা রক্ষা করিয়াও দলে-দলে মেয়েরা ভোট-কেন্দ্রে আসিয়াছে। পর্দা রক্ষার জন্য তারা এইরূপ অভিনব ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছে। চারজন যুবক একটা মশারির চার কোণা ধরিয়াছে। পনর বিশজন মেয়ে-ভোটার এই মশারির নিচে খিচি-বিচি করিয়া ঢুকিয়াছে। তারপর মশারি চলিয়াছে। মশারির মধ্যে মেয়েরা চলিয়াছে। প্রতি গ্রাম হইতে। মিছিল করিয়া ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসিয়াছে। কাগ ও বাঁশের খাবাসি দিয়া যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন-প্রতীক বিশাল আকারের নৌকা বানাইয়া লইয়াছে জনসাধারণ নিজেরাই। সেই নৌকা কাঁধে করিয়া ‘যুক্তফ্রন্ট যিন্দাবাদ’ ‘ইক-ভাসানী বিন্দাবাদ’ যিকির দিতে-দিতে তারা ভোটকেন্দ্রে আসিয়াছে। এতে ভোটর ফলাফল আগেই বুঝা গিয়াছিল। তোটাররা এই ভোট-যুদ্ধকে একটা পবিত্র জেহাদ মনে করিয়াছে। কাজেই সকলেই এটাকে নিজের কাজ মনে করিয়াছে। পয়সা দিয়া, তয় বা লোভ দেখাইয়া কাইতে হয় নাই। শুধু যুক্তফ্রন্টকে ভোট দেওয়াই তারা পবিত্র কর্তব্য মনে করে নাই। অপর পক্ষে ভোট দেওয়াকে তারা জনগণের দুশমনি মনে করিয়াছে। আমার নিজের-দেখা একটা সত্য ঘটনা বলি। আমার প্রতিদ্বন্দী মুসলিম লীগ-প্রার্থী ছিলেন আমার সোদর-এতিম বন্ধু ও আত্মীয় ‘আজাদ’-সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দিন। ভোটার ও জনগণের এই মতিগতি দেখিয়া আমরা উভয়েই বুঝিলাম, শামসুদ্দিন সাহেবের যামিন বাযেয়াফত হইয়া যাইতেছে। উতয়ে একত্রে তাঁর যামিনের টাকা বাঁচাইবার চেষ্টা করিলাম। উভয়ে এক গাড়িতে উঠিলাম। ভোটার ও ওয়ার্কারদেরে বুঝাইলাম। কিছু ভোট শামসুদ্দিন সাহেবকে দিয়া তাঁর যামিনের টাকা বাঁচানো দরকার। শামসুদ্দিন সাহেবের টাকা ত আমাদেরই টাকা। শামসুদ্দিন সাহেবের টাকা বাঁচাইতে কারও আপত্তি ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হইল, মুসলিম লীগকে ভোট দিতে হয় যে। ও-কাজ করিতে ত কেউ রাযী না। কাজেই শামসুদ্দিন সাহেবের যামিন বাযেয়াফত হইল। মোট একত্রিশ হাজার রেকর্ডেড ভোটের মধ্যে তিনি পাইলেন মাত্র যোল শ। এটা শুধু আমার এলাকার কথা নয়। পূর্ব-বাংলার সর্বত্রই এই অবস্থা। যুক্তফ্রন্টের এই জয়কে দেশে-বিদেশে অনেকেই ব্যালট-বাক্সে—’বিপ্লব’ আখ্যায়িত করিয়াছেন। দেশের জনগণ স্বেচ্ছায়, নিজেদের টাকায়, বাজি পোড়াইয়া আনন্দ-উৎসব করিয়া মিছিল বাহির করিয়া স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস করিয়াছে। নূরুল আমিন-বিজয়ী খালেক নেওয়াযকে লইয়া ঢাকা শহরবাসী যে অভাবনীয় অভূতপূর্ব মিছিল করিয়াছিল, তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। যুক্তফ্রন্টের তিন-নেতার এক নেতা শহীদ সাহেবকে করাচিছে যে রাজকীয় সম্বর্ধনা দেওয়া হইয়াছিল, মুসলিম লীগের মুখপত্র ‘ডনের’ ভাষায় ইহা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিনে কায়েদে আযমের সম্বর্ধনার চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। করাচির নাগরিকদের এই সম্বর্ধনা শুধু পূর্ব-বাংলার স্বার্থে দেওয় হয় নাই। করাচিবাসী পূর্ব-বাংলার জনগণের এই বিজয়কে নিশ্চয়ই গণতার জয় মনে করিয়াছিল। জনগণের এই জয়ের প্রতীক হিসাবেই শহীদ সাহেবকেরাচি এই সম্বর্ধনা দিয়াছিল। নইলে করাচির স্থায়ী বাশো শহীদ সাহেবকে নিজের ঘর এই সম্বর্ধনা দেওয়ার কোনও যুক্তি ছিল না।
৮. দুর্বলতার বীজ
কিন্তু ভোটারদের এই আশা ও আস্থার মর্যাদা নেতারা দিতে পারিলেন না। লিডার নির্বাচনের দিন হইতেই, বরঞ্চ আগে হইতেই, আমাদের মধ্যে ফাটল দেখা দেয়। এই ফাটল রোধ করার চেষ্টা একমাত্র শহীদ সাহেব ছাড়া আর কেউ করেন নাই। সে কথাটাই এখানে বলিতেছি।
কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে, আরও নির্দিষ্ট করিয়া বলিলে হক সাহেব ও শহীদ সাহেবের মধ্যে মনের অমিল আগে হইতেই ছিল। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী মনোনয়নে সে বিরোধ ক্রিয়া করিয়াছিল আরও প্রসারিত রূপে। কারণ এই দুই মহান নেতার নিচে উভয় দলের আরও অনেক নেতা ছিলেন। নিজ-নিজ দলীয় স্বার্থ-বোধ তাঁদের ব্যবহারে ও কাজে-কর্মে নিশ্চয় প্রতিফলিত হইয়াছিল। এটা দানা বাঁধে লিডার নির্বাচন উপলক্ষ করিয়া। যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী নির্বাচিত হইয়াছিলেন মোট ২২৮ জন। এঁরা সকলেই মুসলমান। যুক্তফ্রন্ট শুধু মুসলিম আসনই কনটেস্ট করিয়াছিল। ২৩৭টি মুসলিম সিটের মধ্যে ২২৮টিই দখল করিয়াছিল। এই ২২৮টির মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৪৩, কৃষক-শ্রমিক ৪৮, নেযামে-ইসলাম ২২, গণতন্ত্রী ১৩ ও খিলাফতে রবানী ২ জন পাইয়াছিল। নিযামে-ইসলাম দল কার্যতঃ হক সাহেবের পৃষ্ঠপোষিত দল বলিয়া তাকেও কে. এস. পি. দল বলা যাইতে পারিত। কাজেই হক সাহেবের নিজ মেষর ছিলেন ৭০ জন। গণতন্ত্রী ও ররাণী পার্টির সদস্যরা প্রোগ্রামের ভিত্তিতে উভয় দলের মধ্যে ব্যালান্স রাখিবেন, এটা বুঝা যাইতেছিল।
১৯৫৪ সালের ২রা এপ্রিল লিডার নির্বাচনের দিন নির্ধারিত হইল। আগের রাত্রে আওয়ামী লীগ দলীয় মেম্বরদের একটি ইনফর্মাল বৈঠক হইল সিমসন রোডস্থ যুক্তফ্রন্ট অফিসে। ঐ সভায় তরুণ মেম্বরদের অনেকেই প্রায় একবাক্যে শহীদ সাহেবকে এইরূপ পরামর্শ দেনঃ লিডার নির্বাচনের আগেই হক সাহেবকে মন্ত্রি-সভার তালিকা প্রস্তুত ও পোর্টফলিও ভাগ করিতে হইবে। গবর্নরের নিকট একটি চিঠির আকারে ঐরূপ তালিকা করিয়া তাতে হক সাহেবের দস্তখত দিতে হইবে। তার তিটি কপি হইবে। একটি হক সাহেবের ও অপরটি ভাসানী সাহেবের নিকট থাকিবে। তৃতীয়টি গবর্নরের নিকট দাখিল করিবার জন্য শহীদ সাহেবের হাতে থাকিতে হইবে। এই দলিলে দস্তখত না হওয়া পর্যন্ত হক সাহেবকে লিডার নির্বাচন করা হইবেনা। কথাগুলি অবশ্য একসঙ্গে বলা হয় নাই, একজনও বলেন নাই। সকলে মিলিয়া বলিয়াছিলেন, কথায়-কথায় উঠিয়াছিল। কিন্তু শহীদ সাহেব এক কথায় ওদের সকলের সকল প্রস্তাব উড়াইয়া দিলেন। তিনি বলিলেন : জনগণ হক সাহেবকে আগেই লিডার নির্বাচন করিয়া রাখিয়াছে। মেম্বররাও সেই ওয়াদা করিয়া ভোট আনিয়াছেন। এখন আর তাঁর উপর কোনও শর্ত আরোপ করা চলে না। করিলে এটা হইবে হদ্দ বেইমানি। প্রস্তাবকরা অবশ্যই বলিলেন : তাঁরা সত্যসত্যই হক সাহেবকে ছাড়া অন্য কাউকে লিডার নির্বাচন করিতে চান না। শুধু চাপ দিয়া একটা সর্বদলীয় উঁচুস্তরের মন্ত্রিসভা গঠন করিতে চান। তাঁরা বলিলেন : বিনাশর্তে হক সাহেবকে স্বাধীনভাবে ছাড়িয়া দিলে লিডার নির্বাচিত হওয়ার সংগে-সংগে তিনি তাঁর পার্শ্ব চরদের দ্বারা বিপথে পরিচালিত হইবেন। শহীদ সাহেব ভাসানী সাহেব একত্রে চেষ্টা করিয়াও হক সাহেবকে আর ওদের খপ্পর হইতে বাঁচাইতে পারিবেন না। হক সাহেবের রাজনীতিক জীবনের ইতিহাস হইতে তাঁরা একাধিক নয়ির দিলেন। তাঁদের যুক্তি শহীদ সাহেবের মনঃপুত হইল না। তিনি এসব যুক্তিকে সন্দেহ-পরায়ণ ক্ষুদ্র মনের পরিচায়ক বলিলেন। তিনি আশ্বাস দিলেন, অতীতে যাই হইয়া থাকুক, জীবন সন্ধ্যায় হক সাহেব আর ভুল করিবেন না। যাঁরা শহীদ সাহেবের আশ্বাস মানিলেন, তাঁরা চুপ করিলেন। যাঁরা করিলেন না, শহীদ সাহেব ধমকাইয়া তাঁদের চুপ কইলেন। তিনি আরও বলিলেন, কোনও ক্রমেই মন্ত্রিসভা গঠনে বিঘ্ন সৃষ্টি করা উচিৎ নয়। কারণ সাত-আট দিন আগে (২৩শে মার্চ) চন্দ্রঘোনা কাগযের কলে বাংগালী ও উর্দুভাষী শ্রমিকদের মধ্যে এক রক্ষক্ষয়ী দাংগা হইয়া যাওয়ায় গবর্নর চৌধুরী খালিকুযমান হক সাহেবকে তাড়াতাড়ি মন্ত্রিসভা গঠনের তাকিদ দিতেছেন। ভাসানী সাহেব এ ব্যাপারে কিছু বলিলেন না। তরুণদের প্রস্তাব গৃহীত হইল না। তাঁদের প্রায় সার্বজনীন অসন্তোষের মধ্যে অনেক রাত্রে সভা ভংগ হইল।
৯. ভাংগন শুরু
পরদিন ২রা এপ্রিল মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে যুক্তফ্রন্ট পার্টির প্রথম অধিবেশন হইল। সর্বসম্মতিক্রমে হক সাহেব লিডার নির্বাচিত হইলেন। শহীদ সাহেব তাঁকে মোবারকবাদ দিলেন। মওলানা সাহেব মোনাজাত করিলেন। ডিপুটি-লিডার, সেক্রেটারি, হুইপ প্রভৃতি আর কোনও কর্মকর্তা নির্বাচন না করিয়া শুধু গণ-পরিষদ সম্পর্কে একটি প্রস্তাব পাস করিয়াই সভা ভংগ হইল।
আওয়ামী লীগের তরুণ এম, এল, এ.-রা যা আশঙ্কা করিয়াছিলেন, তাই হইল। মন্ত্রিসভা গঠন লইয়া হক সাহেবের সাথে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবের মতান্তর হইল। এই মতান্তর শুধু দূর্ভাগ্যজনক ছিল না, এজাজনকও ছিল। কারণ এ মতান্তর পজিসি লইয়া হয় নাই, হইয়াছিল মন্ত্রিত্ব লইয়া। সে মতভেদও মাত্র দুইদলের দুইজন তরুণের মন্ত্রিত্ব লইয়া। যে দশ-এগার জন সিনিয়র পলিটিশিয়ান লইয়া হক মন্ত্রিসভা গঠিত হইবে, হক সাহেবের নেতৃবৃন্দের ও এম. এল. এ.-দের, এমনকি জনসাধারণের, তা একরূপ জানাই ছিল। যে দুইজন তরুণের মন্ত্রিত্ব লইয়া মতভেদ শুরু হয়, তার একজন কৃষক-শ্রমিক পার্টির, অপর জন আওয়ামী লীগের। একজন হক সাহেবের প্রিয়পাত্র, অপরজন শহীদ সাহেবের। হক সাহেব পার্টিলিডার নির্বাচিত হওয়ার পরেই তাঁর বাড়িতে তিন-নেতার যে বৈঠক হয়, এতেই এই বিরোধ দেখা দেয়। হক সাহেব তাঁর লোকটির নাম প্রস্তাব করায় শহীদ সাহেবও তাঁর লোকটির নাম করেন। এটা ছিল নিছক বিদাশিদির ব্যাপার। নইলে শহীদ সাহেবের লোকটিকে মন্ত্রী করার ইচ্ছা শহীদ সাহেবের নিজেরই ছিল না। বস্তুতঃ ঐ দিনই সকালের দিকে কিছু সংখ্যক আওয়ামী লীগ-কমী ঐ লোককে মন্ত্রী করার দাবি করাতে শহীদ সাহেব কমীদেরে ত ধমকাইয়া দেনই, উপরন্তু তাঁর প্রিয়পাত্রটিকেও ধমকাইয়া দেন। তাঁকে বলেন যে তিনিই ঐসব ছেলে-ছোকরা যোগাড় করিয়া আনিয়াছেন। তিনি অবশ্যই প্রতিবাদ করেন। কিন্তু শহীদ সাহেব সে প্রতিবাদে বিশ্বাস করেন নাই। যা হোক শহীদ সাহেব তাঁকে এই বলিয়া সান্তনা দিয়া বিদায় করেন যে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি করা তিনি আগে হইতেই ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন। শহীদ সাহেব উপস্থিত সকলের সামনেই তাঁকে ভালরূপে বুঝাইয়া দেন যে ঐ কাজে তাঁর দুইটা উদ্দেশ্য রহিয়াছে। প্রথমতঃ হক সাহেবের মত অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ও এডমিনিস্ট্রেটরের সাথে কাজ করিয়া তিনি অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করিতে পারিবেন। দ্বিতীয়তঃ হক সাহেবকে দিয়া আওয়ামী লীগ সংগঠনের এবং নির্বাচন-প্রতিশ্রুতি পালনের তাতে অধিকতর সুবিধা হইবে। শহীদ সাহেবের এই সারবান যুক্তিতে আমরা সকলেই খুশী হইয়াছিলাম। তিনিও শহীদ সাহেবের উপদেশ মানিয়া লইয়াছিলেন।
পরে হক সাহেবের বাড়িতে হক সাহেবের প্রিয়পাত্রের মোকাবিলা স্বরূপ শহীদ সাহেবই ঐ নাম করায় এটা স্পষ্টই বোঝা গিয়াছিল, হক সাহেবকে দিয়া তাঁর প্রস্তাবিত নাম প্রত্যাহার করাইবার জন্যই শহীদ সাহেব এটা করিয়াছিলেন। ভাসানী সাহেবও এটাই বুঝিয়াছিলেন। হক সাহেব তাঁর প্রস্তাবিত নামটি প্রত্যাহার করেন নাই। বরঞ্চ নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই তাঁর ঐ লোকটি দরকার বলিয়া নেতৃদ্বয়ের কাছে আপিল করেন। ভাসানী সাহেব কোনও-এক পক্ষে শক্ত হইলেই ব্যাপারটা মিটিয়া যাইত। কিন্তু তিনি তা হন নাই। ফলে এই ছোট কথার উপর যে বিরোধ দেখা দিল তাকে কেন্দ্র করিয়াই অল্পদিন মধ্যেই যুক্তফ্রন্টে ভাংগন দেখা দিয়াছিল।
হক সাহেব আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়া তিনজন মন্ত্রী লইয়া মন্ত্রিসভা গঠন করিয়া ফেলিলেন। এ বিরোধ মিটাইবার জন্য অনেক বন্ধু-বান্ধবসহ আমি দুতিয়ালি ও। বৈঠক করিলাম। সব ব্যর্থ হইল। ভগ্ন স্বাস্থ্য লইয়া শহীদ সাহেব করাচি গেলেন। এবং। কিছুদিন পরেই চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেলেন। ঐ একই বিমানে প্রধানমন্ত্রী হক সাহেব তার মন্ত্রী ও অনেক কৃষক-শ্রমিক মেম্বর লইয়া কেন্দ্রীয় সরকারের আমন্ত্রণে কাচি গেলেন। মওলানা ভাসানী ক্ষুণ্ণ মনে মফস্সলের বাড়িতে গিয়া বসিলেন। যুক্তফ্রন্টে বড় রকমের ফাটল ধরিল। আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে যাতে এই ফাটল বৃদ্ধির কোনও কাজ না হয় সে জন্য আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকিয়া আমরা সর্ব অবস্থায় এক মন্ত্রিসভাকে সমর্থন করিবার প্রস্তাব গ্রহণ করিলাম। আওয়ামী লীগ হইতে মন্ত্রী নিবার সমস্ত দেন দরবারের একক ক্ষমতা মওলানা ভাসানীর উপর ন্যস্ত করিলাম।
মাসাধিককাল মন্ত্রিত্ব করিবার পর হক সাহেব আওয়ামী লীগ হইতে মন্ত্রী গ্রহণ করিয়া মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের প্রস্তাব দিলেন। মওলানা সাহেবকে এই সংবাদ দিলে তিনি স্বয়ং না আসিয়া আমাদের কয়েকজনকে ক্ষমতা দিলেন। আমরা আপোস করিলাম। অবশেষে ১৫ই মে তারিখে আরও দশজন মন্ত্রী লইয়া হক মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত হইল। আমিও তার মধ্যে একজন ছিলাম।
কিন্তু শপথ গ্রহণ করিবার অব্যবহিত পরেই গবর্নমেন্ট হাউস হইতেই আমরা খবর পাইলাম আদমজী জুট মিলের শ্রমিকদের মধ্যে দাংগা হইয়াছে। হক সাহেবের নেতৃত্বে আমরা সব মন্ত্রীরাই ঘটনাস্থলে গেলাম। স্তম্ভিত হইলাম। শত-শত মৃতদেহ ডিংগাইয়া আমাদের পথ চলিতে হইল। যারা মরিয়াছে তাদের কথা ভাবিবার সময় নাই। আরও যে মরিতেছে, তাদের মৃত্যু ঠেকাইবার জন্য ছুটিলাম। উভয় পক্ষ সশস্ত্র অবস্থায় তখনও নূতন করিয়া প্রতিশোধ নিবার জন্য পায়তারা করিতেছে। আমরা মন্ত্রীরা বিভিন্ন ফ্রন্টে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করিতে লাগিলাম। আমি নিজে যে ফ্রন্টে পড়িলাম সেখানেই বিনা মাইকে চিৎকার করিয়া গলা ফাটাইলাম। সন্ধ্যা হইয়া আসার দরুনই হোক আর আমাদের চেষ্টায়ই হোক, শেষ পর্যন্ত উত্তেজিত জনতা কতকটা শান্ত হইল। বিষণ্ণ মনে ফিরিয়া আসিলাম। এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ১৯৪৬ সাল হইতে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কলিকাতার বিভিন্ন দাংগায়ও দেখি নাই। পরবর্তী কয়েক রাত আমি ঘুমাইতে পারি নাই।
১০. পরাজয়ের প্রতিশোধ
নির্বাচনে অমন শোচনীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ লইবার জন্য মুসলিম লীগ-নেতারা ওৎ পাতিয়াই ছিলেন। কালাহান নামক একজন মার্কিন সাংবাদিক হক সাহেবের বিরুদ্ধে প্রচার করিয়া বেড়াইতেছিলেন। আদমজী মিলের এই দাংগায় মুসলিম লীগ নেতারা নূতন অজুহাত পাইলেন। কোনও কোনও বিষয়ে পূর্ব-বাংলা সরকারের ক্ষমতা হ্রাস করিয়া কেন্দ্রীয় সরকার এক নির্দেশ জারি করিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের এই নির্দেশাবলী আলোচনার জন্য কেবিনেটের বিশেষ মিটিং দেওয়া হইল। চিফ সেক্রেটারি হাফিয মোহাম্মদ ইসহাক সাহেব আমাদিগকে হুশিয়ার হইতে উপদেশ দিলেন। তিনি আভাসে-ইগতে জানাইলেন যে এই সব নির্দেশ অমান্য করিলে অধিকতর বিপদের আশঙ্কা আছে। আমরা মন্ত্রীরা কেন্দ্রীয় সরকারের এই অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক নির্দেশ মানিতে রাযী হইলাম না বিপদ যত বড়ই আসুক। কয়েকদিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার হক সাহেবকে করাচিতে তলব করিলেন। মিঃ আবু হোসেন সরকার ও আমি ছাড়া আর সব মন্ত্রী করাচি যাত্রায় হক সাহেবের সংগী হইলেন। সেখানে হক সাহেবের বিরুদ্ধে পাকিস্তান বিরোধিতার অভিযোগ আনা হইল মিঃ কালাহানের পর্যন্ত সাক্ষ্য লওয়া হইল। পূর্ব-বাংলার প্রধানমন্ত্রীর আনুগত্য যাচাই করা হইল একজন বিদেশী রিপোর্টারের উক্তির দ্বারা। এমন অপমানও হক সাহেবকে সহ। করিতে হইল। হক সাহেব ও তাঁর মিনিস্টাররা সকলে মাথা নত করিয়াই সব মানিয়া নিলেন। তাঁরা অনুগত পাকিস্তানী, পূর্ব-বাংলার স্বাধীনতা তাঁরা চান না, এই মর্মে সকলে এক যুক্ত বিবৃতি দিলেন। কিন্তু এতেও কিছু হইল না। হক সাহেব ও তাঁর সহকমী মন্ত্রীরা করাচি হইতে ঢাকায় ফিরিবার আগেই ৯২-ক ধারা-বলে গবর্নরের শাসন প্রবর্তন করা হইল। গবর্নর চৌধুরী খালিকু্যমান ও চিফ সেক্রেটারি হাফিয় ইসহাকের বদলে শক্তিশালী গবর্নর রূপে ইসকান্দর মির্যাকে ও শক্তিশালী চিফ সেক্রেটারি রূপে মিঃ এন. এম, খাকে পাঠান হইল। এটা যে হইবে তা আমি আগের দিনই জানিতে পারিয়াছিলাম। কারণ ঐদিন গবর্নর খালিকুযযামান সাহেব আমাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছিলেন। করাচির ঘটনাবলী সম্পর্কে আমার মত কি জানিতে চাহিলেন। হক সাহেবও তাঁর সংগী মন্ত্রীদের যুক্ত বিবৃতিতে ব্যাপারটা মিটিয়া গিয়াছে বলিয়া আমার ধারণার কথা গবর্নরকে বলিলাম। গবর্নর তখন আমাকে খোলাখুলি বলিলেন : আমার বিশ্বাস তোমাদের মন্ত্রিত্বও শেষ, আমার গবর্নরিও শেষ। এ বিশ্বাসের কারণ কি জিগ্গাসা করায় তিনি আমাকে জানাইলেন যে কেন্দ্রীয় সরকার ১২-ক ধারা প্রয়োগের প্রস্তাব করিয়াছেন। তাঁর জবাবে গবর্নর ঐ প্রস্তাবের বিরোধিতা করিয়াছেন। তাঁর ধারণা কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের মতে অটল থাকিবেন। আমি গবর্নর হাউসহইতে বাসায় ফিরিয়া বন্ধুবর আবু হোসেন সরকারকে ব্যাপার জানাইলাম। তিনি জবাব দিলেন : যে-কোনও পরিস্থিতির জন্য তিনি প্রস্তুত। রাত্রিবেলাই ৯২-ক ধারা প্রবর্তনের কথা আমরা জানিতে পারিলাম। কিন্তু তার আগেই হক সাহেব ও তাঁর মন্ত্রীরা যে অবস্থায় ঢাকা আসিলেন তাতেই আমরা বুঝিয়াছিলাম ব্যাপার ভাল নয়।
খুব বিশ্রী ও অভদ্রভাবে ৯২-ক ধারা জারি হইয়াছিল। একথা না বলিয়া উপায় নাই। ১২-ক ধারা জারি করিবার সংগে-সংগে অন্যতম মন্ত্রী আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকারী মন্ত্রিভবন হইতে গেরেফতার করা হইল। আমাদের বাড়ি হইতে সরকারী গাড়ি টেলিফোন পিয়ন চাপরাশী গার্ড সবই তুলিয়া নেওয়া হইল। সুপ্রতিষ্ঠিত রেওয়াজ এই যে মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পরও পনর দিন মন্ত্রীরা সরকারী বাড়িতে থাকিতে এবং সমস্ত সুবিধা ওঅধিকার ভোগ করিতে পাবেন। কিন্তু আমাদের বেলা তা করা হইল না। পরদিন সকালে উঠিয়া আমরা একেবারে মাঠে মারা যাইবার উপক্রম হইলাম। আগের দিন, যারা সরকারী উর্দি-পরা সরকারী প্রহরি-বেষ্টিত অবস্থায় সরকারী গাড়িতে চলাফেরা করিতেছিলাম, তারাই পরদিন ঈদের মাঠে গেলাম কয়েক মাইল রাস্তা হাঁটিয়া। কারণ মন্ত্রি-ভবনের মত বড়লোকের এলাকায় রিকশা পাওয়ার উপায় নাই। এজন্য আমি কোনও দুঃখ করিলাম না। কেন্দ্রীয় সরকার যেরূপ ভীত-চকিত অবস্থায় এই ৯২-ক ধারা প্রবর্তন করিয়াছিলেন তাতে তাঁরা যে রাতের বেলাই আমাদিগকে সরকারী ভবন হইতে ধাক্কাইয়া বাহির করিয়া দেন নাই, অথবা আমাদের পিঠের নিচে হইতে সরকারী খাট-পালং এবং আমাদের পাছার নিচে হইতে চেয়ার-সোফা টানিয়া নেন নাই, এজন্য আমি মনে-মনে কেন্দ্রীয় সরকারকে ধন্যবাদ দিলাম। চৌধুরী খালিকুযযামানকে গবর্নরি হইতে এবং হাফিয ইসহাককে চিফ সেক্রেটারিগিরি হইতে যেভাবে জরুরী তারের আগায় বরতরফ করিলেন এবং গবর্নর রূপে মেজর-জেনারেল ইসকান্দর মির্যা এবং চিফ সেক্রেটারি রূপে মিঃ এন, এম. খ যেরূপ তলোয়ার ঘুরাইতে-ঘুরাইতে ভারতের আকাশ-বাতাস কম্পিত করিয়া ‘ধর-ধর-মার-মার’ বলিতে-বলিতে পূর্ব-বাংলার দিকে বাতাসের আগে ছুটিয়া আসিতেছিলেন, তাতে সকলেরই বোধ হয় মনে হইয়াছিল তাঁর পূর্ব-বাংলার বিদ্রোহ দমন করিতেই আসিতেছেন। নব-নিযুক্ত গবর্নর ইসকান্দর মির্যা ভারতের বুকে দৌড়াইতে-দৌড়াইতেই ঘোষণা করিলেন : ‘ভাসানীকে আমি গুলি করিয়া হত্যা করিব।‘ বলা আবশ্যক মওলানা ভাসানী তখন পূর্ব-বাংলায় ছিলেন না। তিনি বর্ধিত হক মন্ত্রিসভার শপথের পরেই বিশ্বশান্তি সম্মিলনে যোগ দিবার জন্য সুইডেনের রাজধানী স্টকহমে চলিয়া গিয়াছিলেন।
১১. নেতৃত্বের দুর্বলতা
পরদিন বেলা দুইটায় সিমসন রোডস্থ যুক্তফ্রন্ট অফিসে যুক্তফ্রন্ট পার্টির এক সভা ডাকা হইল। উক্ত সভায় যাইবার জন্য আমরা জনাব আবু হোসেন সরকারের সরকারী বাড়িতে সমবেত হইলাম। পদচ্যুত মন্ত্রীদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আর সকলে এবং প্রায় শ-দেড়েক এম, এল, এ, ঐ সভায় সমবেত হইলাম। সমবেত মেম্বরদের মধ্যে কেউ-কেউ জানাইলেন যে যুক্তফ্রন্ট আফিস পুলিশে ঘেরাও করিয়াছে। পার্টির লিডার হক সাহেবকে সভায় আসিতে দেওয়া হইতেছে না। ব্যাপার জানিবার জন্য মিঃ আবদুস সালাম খাঁ ও আমি একটি বেসরকারী জিপে চড়িয়া সিমসন রোডে গেলাম। গেটে পুলিশ আমাদের পথরোধ করিয়া দাঁড়াইল। একজন অফিসার আসিয়া আমাদিগকে জানাইলেন : যুক্তফ্রন্ট আফিস তালাবদ্ধ করা হইয়াছে। এখানে কোনও সভা করিতে দেওয়া হইবে না। যতদূর মনে পড়ে, ঐ অফিসারটি হোম ডিপার্টমেন্টের একটি আদেশনামাও আমাদিগকে দেখাইয়াছিলেন।
আমরা ফিরিয়া আসিয়া অবস্থা রিপোর্ট করিলাম। তখন সর্বসম্মতিক্রমে ঐ ইনফরম্যাল মিটিংকেই যুক্তফ্রন্টের ফরম্যাল মিটি ঘোষণা না হইল। লিডার উপস্থিত না থাকায় এবং পার্টির কোনও ডিপুটি লিডার না থাকায় সর্বসম্মতিক্রমে চৌধুরী আশরাফুদ্দিন আহমদ সভাপতি নির্বাচিত হইলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের এই অনিয়মতান্ত্রিক ৯২-ক ধারা প্রবর্তনের নিন্দা করিয়া, পার্টি-লিভারকে নষবশী ও অন্যতম মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে গেরফতার করার তীব্র প্রতিবাদ করিয়া সর্ব সম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হইল। অতঃপর কর্মপন্থা হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারের এই আদেশ অমান্য করিয়া ভূতপূর্ব মন্ত্রিগণের এবং এম, এল, এ. গণের সমবেতভাবে কারাবরণ করার প্রশ্ন আলোচিত হইল। এই কর্মপন্থায় অধিকাংশের সমর্থন দেখা গেল। এই সংগ্রামে পার্টি-লিডারের নেতৃত্বের আশায় তার সাথে সাক্ষাৎ করা হির হইল। প্রস্তাবিত সংগ্রামে পার্টিকে নিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য মৌঃ আতাউর রহমান খ, মৌঃ কফিলুদ্দিন চৌধুরী ও মোঃ আবদুল লতিফ বিশ্বাসকে লইয়া একটি সূতোর বোর্ড গঠন করা হইল। সভা চলিতে থাকা অবস্থায় এখানেও পুলিশের হামলা হইল। পুলিশ অফিসাররা আমাদিগকে তৎক্ষণাৎ ঐ স্থান ত্যাগ করিতে নির্দেশ দিলেন।
সভা ভাংগিয়া গেল। আমরা বেশ কয়েকজন তখন হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করিয়া সমস্ত অবস্থা ও আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানাইলাম এবং আইন অমান্যে। আমাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিলাম। আমরা তাঁকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম যে তাঁর নেতৃত্বে যদি আমরা মন্ত্রীরা এবংসমবেত শ দেড়েক এম, এল, এ. জেলে যাই, তবে কেন্দ্রীয় সরকার এক সপ্তাহ কালও ২-ক ধারা চালু রাখিতে পারিবেন না। সপ্তাহ পার না হইতেই কেন্দ্রীয় সরকার হক মন্ত্রিসভাকে পুনর্বহাল করিবেন আর জনগণ আমাদিগকে জেলগেটে মাল্য-ভূষিত করিয়া মিছিল করিয়া সেক্রেটারিয়েটে লইয়া আসিবে।
হক সাহেব আমাদের এই গোলাবি চিত্রে টনিলেন না। বরঞ্চ আমাদিগকে মফসসলে যার-তাঁর এলাকায় গিয়া জনগণকে বিপ্লবী বেআইনী ধ্বংসাত্মক কাজে নিয়োগ করিবার অবাস্তব ইমপ্র্যাকটিক্যাল ও অনিষ্টকর উপদেশ ও পরামর্শ দিলেন। আমরা নিরাশ হইয়া ফিরিয়া আসিলাম। বুঝিয়া আসিলাম শেরে-বাংলা হক সাহেব বেশ একটু ভয় পাইয়াছেন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের সংগে একটা আপোস করিবার চেষ্টা তলে-তলে করিতেছেন।
কাজেই আমরা কেউ কিছু করিলাম না। কিন্তু হক সাহেব ও যুক্তফ্রন্টের এই দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করিলেন। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী ১৬ই জুন তারিখে এক বেতার বক্তৃতায় হক সাহেবকে স্বীকারোক্তিকারী দেশদ্রোহী বলিয়া ঘোষণা করিলেন। হক সাহেব নিজ ঘরে নযর-বন্দী হইলেন। অতঃপর তাঁর সাথে দেখা-শোনায় খুব কড়াকড়ি করা হইল। গেটে পুলিশের কাছে নাম দস্তখত দিয়া আমি কয়েকবার হক সাহেবের সাথে দেখা করিলাম। শেরে-বাংলাকে খুবই উদ্বিগ্ন দেখিলাম। অনেক জেরা করিয়াও তাঁর কথিত স্বীকারোক্তি সম্বন্ধে হা-না স্পষ্ট কিছু আদায় করিতে পারিলাম না। তিনি ঘুরাইয়া-প্যাচাইয়া এমন ধরনের সব শিশু শুলভ কথা বলিলেন, যাতে আমি বুঝিলাম তিনি ঐ গোছের কিছু-একটা করিয়া ফেলিয়াছেন।
হক সাহেব নযর-বন্দী, মওলানা ভাসানী দেশে নাই, শহীদ সাহেবও গুরুতর অসুখ অবস্থায় বিদেশে। চারিদিকেই অন্ধকার। সুই সাহসী নেতৃত্বের অভাবে ছাত্র তরুণরা, বিভ্রান্ত। শেখ মুজিবুর রহমান সহ প্রায় দুই হাজার আওয়ামী লীগ কর্মী ইউনিভার্সিটির ছাত্র সহ প্রায় দুইশ ছাত্র গেরেফতার হইল। তার মধ্যে আমার দ্বিতীয় পুত্র সলিমুল্লা হলের জেনারেল সেক্রেটারি মহবুব আনামও ছিল। এমনি করিয়া দেশের আকাশে-বাতাসে নৈরাশ্যের ও অস্ফুট ক্রোধের গুমরানো ক্রন্দন শ্রুত হইতে থাকিল।
যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে পূর্ব বাংগালীর রাষ্ট্রীয় জীবনে যে সৌভাগ্য-সূর্য উদিত হইয়াছিল, তাতেই এমনি করিয়া তাতে গ্রহণ লাগিল। পরবর্তী কালের ইতিহাস প্রমাণ করিয়াছে, সে গ্রহণ আজও ছাড়ে নাই। পিছনের দিকে তাকাইয়া এত দিন পরেও আজ মনে হয়, যদি তিন প্রধানের বিরোধ না হইত, যদি যুক্তফ্রন্টের সর্ব সম্মত মন্ত্রিসভা গঠিত হইতে পারিত, যদি হক সাহেব ও শহীদ সাহেব স্ব স্ব প্রিয়পাত্রের জন্য যিদ না করিতেন, যদি মওলানা ভাসানী নিরপেক্ষ দৃঢ়তা অবলম্বন করিতেন, যদি হক সাহেব লিডার নিযুক্ত হইয়াই গণ-পরিষদের মেম্বরগিরি নিজে ছাড়িতেন এবং অন্যান্যদেরে ছাড়িবার নির্দেশ দিতেন, যদি তিনি ২১ দফা কর্মসূচি রূপায়ণে ধীর ও দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হইতেন, যদি হক সাহেব কলিকাতা সফরে গিয়া রাজনৈতিক দুশমনদেরে অজুহাত না দিতেন, তবে পূর্ব বাংলার ভাগ্যে কি কি কল্যাণ হইতে পারিত, সারা পাকিস্তানের ভাগ্যে কি কি শুভ পরিণাম হইত, তা আজ সহজেই অনুমেয়। পূর্ব-বাংলার সরকারের জনপ্রিয়তার সংগে তাঁর ঐক্য ও স্থায়িত্বের মুখে নির্বাচনে পরাজিত সরকারী দল আমাদের দাবি মানিয়া লইতেন। গণ-পরিষদে নয়া নির্বাচন হইত। নয়া নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা অবিলম্বে পূর্ব-বাংলার গ্রহণযোগ্য শাসনতন্ত্র রচিত হইত; পাকিস্তানে গণতন্ত্র শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে রূপায়িত হত। পরবর্তীকালের ক্রমবর্ধমান চরম দূর্ভাগ্যসমূহের একটাও ঘটিতে পারিত না।