পাপ ও শাস্তি
উনিশা অধ্যায়
১. গবর্নর-জেনারেলের রাজনীতি
সাধারণ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় বরণ করিয়া মুসলিম লীগ নেতারা পূর্ব– বাংলার জনপ্রিতিনিধিদের জনপ্রিয় সরকারের বিরুদ্ধে এই অনিয়মতান্ত্রিক প্রতিশোধ নিয়া বেশি দিন সুখের ভাত খাইতে পারিলেন না। পাঁচ মাস যাইতে-নাযাইতেই গবর্নর-জেনারেল ২৩শে অক্টোবর তারিকে গণ-পরিষদ ভাংগিয়া দিলেন। গবর্নর জেনারেলের এই কাজের আইনগত প্রশ্নের দিক পরে পাকিস্তানের ফেডারেল কোর্টে বিস্তারিত আলোচনা হইয়াছিল। গণ-পরিষদের প্রেসিডেন্ট মৌঃ তমিযুদ্দিন খাঁ সাহেব গবর্নর-জেনারেলের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করিয়া সিন্ধু চিফ কোর্টে রীটের মামলা দায়ের করেন। চিফ কোট তমিযুদ্দিন খাঁ সাহেবের পক্ষে রায় দেন। গবর্নমেন্ট এই রায়ের বিরুদ্ধে ফেডারেল কোর্টে আপিল করেন। সেই সংগে গবর্নর-জেনারেলও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ২১৩ ধারার বিধান মতে ফেডারেল কোর্টের নিকট একটি রেফারেন্স করেন। ফেডারেল কোর্টে দীর্ঘদিন সওয়াল-জবাব হইয়াছিল। সে সব কথা এবং তার ফলাফল সবাই জানেন। এটাও জানা কথা যে গবর্নর-জেনারেলের এই কাজে পূর্ব-বাংলার জনসাধারণ এবং তাদের নেতাদের বেশির ভাগ আনন্দিত হইয়াছিলেন। অবশ্য এই আনন্দের মধ্যে কোনও সচেতন বুদ্ধি বা আদর্শবাদ ছিল না। এটা ছিল যালেম শত্রুকে নাজেহাল হইতে দেখার স্বাভাবিক অথচ নীচ অন্যায় অথচ তীব্র আনন্দ। গবর্নর-জেনারেলের এই কাজ অনিয়মতান্ত্রিক ডিক্টেটরি হইয়াছিল, একথা সবাই বুঝিয়াছিলেন। তবু আনন্দিত হইয়াছিলেন। কারণ স্বয়ং মুসলিম লীগ নেতারাই এই অনিয়মতান্ত্রিক ব্যভিচার শুরু করিয়াছিলেন। খাজা নাযিমুদ্দিনের সম্পূর্ণ বেআইনী ভাবে গবর্নর-জেনারেল হইতে প্রধানমন্ত্রী হওয়া, অনিয়মতান্ত্রিক ভাবেই প্রধানমন্ত্রিত্ব হইতে তাঁর বরখাস্ত, বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর অসংগতভাবে প্রধানমন্ত্রিত্ব দখল, পূর্ব-বাংলায় ৯২-ক ধারার প্রবর্তন, ইত্যাদি সব অনিয়মতান্ত্রিক কুকর্ম হয় মুসলিম লীগ-নেতারা নিজেরাই করিয়াছিলেন, নয় ত বুরোক্র্যাসির এ সব কাজে সহযোগিতা করিয়াছিলেন। কাজেই মুসলিম লীগ-নেতারা যখন পরের-জন্য—নিজেদের—খুঁদা কুঁয়ায় নিজেরাই পড়িলেন, তখন তাদের জন্য অশ্রুপাত করিবার কেউ রহিল না। তাঁদের দ্বারা উৎপীড়িত পূর্ব-বাংলার জনগণও তাদের নেতারা স্বভাবতঃই এটাকে শত্রুপক্ষের গৃহযুদ্ধ এবং এক শক্ত কর্তৃক আরেক শত্রুর নিধন মনে করিয়াছিলেন। আমার মানসিক প্রতিক্রিয়াও অবিকল ঐরূপ হইয়াছিল। কিন্তু বন্ধুবর আতাউর রহমান সাহেব যখন গবর্নর-জেনারেল গোলাম মোহাম্মদকে অভিনন্দন দিবার প্রস্তাব করিলেন, তখন আমি তাঁকে সমর্থন করিতে পারিলাম না। যুক্তফ্রন্টের আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা আতাউর রহমান সাহেবের প্রস্তাব সমর্থন করিলেন। ইতিমধ্যে পূর্ব-বাংলার ৯২-ক ধারা তুলিয়া পার্লামেন্টারি সরকার পুনঃ প্রতিষ্ঠার আলোচনা শুরু হওয়ায় প্রধানমন্ত্রিত্ব লইয়া কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেশ তীব্র হইয়া উঠিয়াছিল। হক সাহেবকে কেন্দ্রীয় সরকার দেশদ্রোহী ঘোষণা করায় এবং তিনি রাজনীতি হইতে অবসর গ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মধ্যে খুব স্বাভাবিকভাবেই আশা হইয়াছিল যে প্রধান। মন্ত্রিত্ব তাঁদের হাতেই আসিবে। মন্ত্রিত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গবর্নর-জেনারেল গোলাম মোহাম্মদই সর্বময় কর্তা, এটা ছিল জানা কথা। অতএব যুক্তফ্রন্টের পক্ষ হইতে যিনি গবর্নর-জেনারেলের গলায় মালা দিবেন, কার্যতঃ যুক্তফ্রন্টের নেতা হিসাবে তিনিই মন্ত্রিসভা গঠনে আহুত হইবেন। এ ধারণায় নেতাদেরে পাইয়া বসিল।
কিন্তু আওয়ামী-নেতাদের এই আশা পূর্ণ হইল না। গবর্নর-জেনারেল ঢাকা আসিবার আগেই কাগযে বিবৃতি দিলেন যে হক সাহেবকে তিনি রাষ্ট্রের দুশমন মনে করেন না, বরঞ্চ একজন বন্ধু মনে করেন। এটা ছিল ধূর্ত গোলাম মোহাম্মদের একটা চাল। এই চালে স্বয়ং হক সাহেবও পড়িলেন। ঐ ঘোষণার পরে গবর্নর-জেনারেলের গলায় মালা দিতে হক সাহেবও প্রস্তুত হইলেন। অবশেষে ১৪ই নবেম্বর বড়লাট ঢাকা আসিলে হক সাহেব ও আতাউর রহমান সাহেব উভয়েই তাঁর গলায় মালা দিলেন। কার্যন হলে অভিনন্দন হইল। আমার মনটা এইসব ব্যাপারে এতটা তিক্ত হইয়াছিল যে আমি ঢাকা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও বিমান বন্দরে গেলাম না। এই সব ফাংশনেও যোগ দিলাম না। আমার কেবলই মনে হইতেছিল যে গবর্নর-জেনারেলকে লইয়া এইরূপ লাফালাফি করা ঠিক হইতেছে না।
কিন্তু এই মাল্যদানের আশু কোনও ফল হইল না। পূর্ব-বাংলায় পার্লামেন্টারি সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইল না।
২. শহীদ সাহেবের ভল
১৯৫৪ সালের ১১ই ডিসেম্বর সুহরাওয়ার্দী সাহেব করাচি ফিরিয়া আসিলেন। তিনি ইতিপূর্বেই করাচিতে ঐ তারিখে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একটি বৈঠক আহবান করিয়াছিলেন। সেই বৈঠকে যোগদান করিবার জন্য অন্যান্য বন্ধুদের সাথে আমিও করাচি গেলাম। যথাসময়ে আমরা শহীদ সাহেবকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা করিলাম। বিপুল সম্বর্ধনা হইল। আওয়ামী লীগের সমর্থক ছাড়াও বিমানবন্দরে বহু নেতার সমাগম হইল। কারণ ইতিমধ্যেই এই গুজব খুব জোরদার হইয়া উঠিয়াছিল যে শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করিয়া মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন বড়লাট একরূপ ঠিক করিয়াই ফেলিয়াছেন।
শহীদ সাহেবের কাঁচারি রোডের বাড়িতে যথাসময়ে আওয়ামী লীগের বর্ধিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসিল। শহীদ সাহেব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করিয়া মূল্যবান বক্তৃতা করিলেন। তিনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিবেন কি না, সে সম্বন্ধে মেম্বরদের পরামর্শ জিগাসা করিলেন। উভয় পাকিস্তান হইতে যাঁরা বক্তৃতা করিলেন, তাঁদের প্রায় সকলেই বলিলেন : শহীদ সাহেব একমাত্র প্রধানমন্ত্রী রূপেই মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিবেন, অন্যথায় নয়। তাছাড়া একথাও কেউ-কেউ বলিলেন যে মৌঃ তমিযুদ্দিন সাহেবের রীট দরখাস্ত তখনও সিন্ধু চিফ কোর্টের বিচারাধীন রহিয়াছে। কাজেই অনিশ্চিত পরিবেশে শহীদ সাহেবের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হইবে না। এইভাবে শহীদ সাহেব আওয়ামী-নেতাদের মতামত জ্ঞাত হইয়া তিনি গবর্নর-জেনারেলের সাথে দেখা করিতে গেলেন। সাড়ে চার ঘন্টা কাল তাঁদের মধ্যে আলোচনা হইল। পরদিনের আওয়ামী লীগের বৈঠকে শহীদ সাহেব ঐ আলোচনার সারমর্ম প্রকাশ করলেন। তাতে বোঝা গেল, বড়লাটের মতে শহীদ সাহেবকে গোড়াতেই প্রধানমন্ত্রী কার অসুবিধা আছে। প্রথমে তাঁকে সাধারণ মন্ত্রী হিসাবেই মোহাম্মদ-আলী কেবিনেটে ঢুকিতে হইবে। তারপর অল্পদিন মধ্যেই শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করিয়া মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হইবে। শহীদ সাহেব মন্ত্রিসভায় ঢুকামাত্রই তাঁর উপর শাসনত্ম রচনার ভার দেওয়া হইবে। শহীদ সাহেব আমাদিগকে বুঝাইতে চাহিলেন যে প্রধানমন্ত্রিত্বটা বড় কথা নয়, বড় কথা শাসনন্ত্র রচনা।
কিন্তু মেম্বররা শহীদ সাহেবের সহিত একমত হইলেন না। তখন তিনি প্রস্তাব দিলেন যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ হইতে ৪ জন করিয়া নেতৃস্থানীয় আওয়ামী–নেতা লইয়া গোপন পরামর্শ করিবেন। আমরা তাতেই রাযী হইলাম। হোটেল মেট্রোপপালের শহীদ সাহেবের কামরায় আটজন নেতাকে লইয়া তিনি গোপন পরামর্শ বৈঠক করিলেন। যতদূর মনে হয় পূর্ব-পাকিস্তানের পক্ষ হইতে জনাব আতাউর রহমান খাঁ, মানিক মিয়া, কোরবান আলী ও আমি ঐ বৈঠকে উপস্থিত থাকিলাম। এই বৈঠকে শহীদ সাহেব যে সব কথা বলিলেন তার সারমর্ম এই : (১) বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ তাঁকে কসম খাইয়া বলিয়াছেন যে শহীদ সাহেবের কেবিনেটে ঢুকার তিনদিন কারও মতে তিন সপ্তাহ) মধ্যে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করিয়া মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করিবেন; (২) ঐ সময়ে আওয়ামী লীগ হইতে আরও দুইজন মন্ত্রী নেওয়া হইবে; (৩) শাসন রচনার ভার শহীদ সাহেবকে দেওয়া হইবে; (৪) ছয় মাসের মধ্যে শাসন রচনার কাজ শেষ করিয়া একটি অর্ডিন্যান্স বলে উহাকে ইন্টারিম কনস্টিটিউশন রূপে প্রয়োগ করা হইবে; (৫) ঐ শাসনতন্ত্র অনুসারে এক বছরের মধ্যে দেশময় সাধারণ নির্বাচন শেষ করা হইবে; (৬) ঐ ভাবে নির্বাচিত পার্লামেন্টের শাসনতন্ত্র যে কোনও রূপে সংশোধন করার পূর্ণ অধিকার থাকিবে।
শহীদ সাহেব আমাদিগকে আরও জানাইলেন যে বড় লাট এই সব কথা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও প্রভাবশালী কয়েকজন মন্ত্রীর সামনেই বলিয়াছেন এবং তাঁদের সম্মতি সহকারেই বলিয়াছেন। এই ক্ষুদ্র সভারও প্রায় সকলেই আমরা গবর্নর-জেনারেলের সরলতা ও আন্তরিকতায় সন্দেহ প্রকাশ করিলাম। কাজেই আমরা সকলে যদিও এই সব শর্ত গ্রহণযোগ্য বলিয়া স্বীকার করিলাম তবু এই সব শর্ত প্রতিপালিত হওয়ার ব্যাপারে আমরা ঘোর সন্দিহান থাকিলাম। শহীদ সাহেব এই বৈঠকে আমাদের দেশ প্রেমে আবেগপূর্ণ আবেদন করিলেন। বলিলেন : দেশের শাসন ও গণতন্ত্রই বড় কথা; কোনও এক ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রিত্বটা বড় কথা নয়। আমরা শহীদ সাহেবের সহিত এ ব্যাপারে একমত হইয়াই বলিলাম : (১) প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্যই শহীদ সাহেবের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দরকার নাই। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রী হইলেই এই সব শর্ত কার্যকরী হইবে; অন্যথায় হইবে না; (২) এই সব শর্ত যে বড়লাট প্রতিপালন করিবেন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করা; (৩) অল্প কয়েকদিন পরেই যখন শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী রাই হইবে এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীরও যখন তাতে আপত্তি নাই, সে অবস্থায় সেটা এখনই কার্যে পরিণত না করার কোনও কারণ নাই।
আমাদের এই বৈঠক দীর্ঘক্ষণ ধরিয়া চলিল। এই বৈঠক চলিতে থাকা কালেই ডাঃ খান সাহেব, জেনারেল আইউব ও মেজর জেনারেল ইঙ্কান্দর মির্যা তিনজন মন্ত্রী পৃথক-পৃথক ভাবে শহীদ সাহেবের সংগে দেখা করিতে আসিলেন। কি কথা তাঁদের মধ্যে হইল তার খুটিনাটি আমরা জানিলাম না। তবে শহীদ সাহেবকে মন্ত্রিসভায় নিবার প্রবল আগ্রহ যে বর্তমান মন্ত্রিসভার আছে, এটা বোঝা গেল। কিন্তু আমাদের সন্দেহ দূর হইল না। আমরা শহীদ সাহেবকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম যে আমরা প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের উপর জোর দিতেছি না, বড়লাটের আন্তরিকতার পরখ হিসাবেই এর উপর জোর দিতেছি।
আমাদের বৈঠক চলিল। কিন্তু আমার একটি ব্যবসাগত অনিবার্য কারণে ময়মনসিংহে ফিরিয়া আসা অত্যাবশ্যক হইয়া পড়িল। বড় মামলা। নানী হইবেই। আর তারিখ পাওয়া যাইবে না। টেলিগ্রাম আসিয়াছে। শহীদ সাহেবকে টেলিগ্রাম দেখাইলাম। ছুটি চাহিলাম। নিজে তিনি উকিল মানুষ। উকিলের অসুবিধা তিনি ভাল বুঝিলেন। ছুটি দিলেন। কিন্তু হুকুম দিলেন। তোমার মতামতটা সংক্ষেপে লিখিয়া রাখিয়া যাও। আমি তাই করিলাম। শহীদ সাহেবের হাতে আমার লিখিত নোটটা দিয়া ১৬ই ডিসেম্বর আমি কাটি ত্যাগ করিলাম। শহীদ সাহেব সাধারণতঃ কাগ-পত্র ফেলেন না। আমার নোটটাও ফেলেন নাই। অনেকদিন পরেও আমার হাতের-লেখা ঐ নোটটা শহীদ সাহেবের ফাঁইলে দেখিয়াছি। তাতে ৮টি দফা ছিল। উপরে বর্ণিত সর্ব সক্ষত ৩টি দফা আগে লিখিয়া পরে নিম্নলিখিত ৫টি দফা আমার ব্যক্তিগত দায়িত্বে লিখিয়াছিলাম : (৪) যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার নির্বাচনী ওয়াদার ১৯নং দফা অনুসারে ৩ বিষয়ের কেন্দ্রীয় সরকারের বিধান শাসনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে বড়লাট ও মন্ত্রিসভার সংগে এখনই বোঝাঁপড়া করিতে হইবে; (৫) ইন্টারিম কনস্টিটিউশন অনুসারে নির্বাচিত গণ-পরিষদের সিম্পল-মেজরিটি ভোটে শাসনতন্ত্র সংশোধনের অধিকার থাকিবে; (৬) পূর্ব-বাংলায় অবিলম্বে ৯২-ক ধারার অবসান করিয়া পার্লামেন্টারি শাসন প্রবর্তন করিতে হইবে; (৭) শহীদ সাহেবের মন্ত্রিসভায় প্রবেশের আগে বড়লাটের নিকট হইতে এইসব শর্তাবলী লিখিতভাবে আদায় করিতে হইবে; (৮) মন্ত্রিসভায় প্রবেশের আগেই শহীদ সাহেবকে একবার পূর্ব-বাংলা সফর করিতে এবং যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সাথে আলোচনা করিতে হইবে।
যে-কোন অবস্থায় ও পরিস্থিতিতে শহীদ সাহেবের একবার পূর্ব-বাংলায় আসা আমার বিবেচনায় খুব জরুরী হইয়া পড়িয়াছিল। কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতাদের অনেকের প্রতি কোনও-কোনও আওয়ামী নেতার মনোভাব ভাল ছিল না স্বাভাবিক কারণেই। তবুও শহীদ সাহেবকে করাচি বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা করিবার জন্য অনেক কে, এস. পি. নেতা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সেইদিন ও পরের দিন শহীদ সাহেবের বাড়িতেও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের বৈঠক হইতেছে এই টেকনিক্যাল গ্রাউন্ডে তাঁদের সভায় উপস্থিত থাকিতে বা শহীদ সাহেক্কের সাথে কথা বলিতে দেয়া নাই। এটা আমার কাছে অশোমনেহইয়াছিল। তারপর করাচি ত্যাগের সময় আমি জানিতে পারিলাম, ক সাহেব প্রধানমন্ত্রীর ডাকে করাচি আসিয়াছেন। এটা ফুট ভাংগার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর আরেকটা চেষ্টা, সে কথা করাটিতে সমাগত দুচারজন কে. এস. পি নেতাও বলিলেন। আমিও তাঁদের সাথে একমত হইলাম। তারা আরও বলিলেন এবং আমি একমত হইলাম যে করাচিতেই হক সাহেব ও শহীদ সাহেবের মোলাকাত হওয়া দরকার। এ সম্পর্কে আতাউর রহমান সহ আওয়ামী নেতারা আমার সাথে একমত হইলেন। এই ব্যবস্থা করিবার জন্য সকলকে অনুরোধ করিয়া আমি আশা-ভরা মন লইয়া করাচি ত্যাগ করিলাম। শহীদ সাহেবের সাথে দেখা করিবার আমার সময় হইল না।
২০শে ডিসেম্বর বাসায় বসিয়াই রেডিও শুনিলাম,শহীদ সাহেব মন্ত্রিসভায় প্রবেশ করিয়াছেন। আমার আশঙ্কা দৃঢ় হইল। মনটা খারাপ হইল। শহীদ সাহেবকে মোবারকবাদ পাঠাইতে মন উঠিল না। কাজেই বিলম্ব করিলাম। বন্ধু-বান্ধবের পীড়াপীড়িতে অবশেষে যাও একটি টেলিগ্রাম করিলাম, তাতে লিখিলাম। ‘গ্রেচুলেশনস। হোপ ইউ যা এ্যাকুটেড ওয়াইলি।’ শহীদ সাহেব পরে বলিয়া ছিলেন আমার টেলিগ্রামে তিনি দুঃখিত হইয়াছিলেন। জবাবে আমি বলিয়াছিলাম। ‘আমি ভাঁর চেয়ে বেশিদুঃখিত হইয়াছিলাম।‘
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুইটি কারণে আমার মন সান্ত্বনা পাইল। এক, শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ সাহেবের উদ্যোগে মুক্তি পাইলেন। দুই, শীঘ্রই মওলানা ভাসানী সাহেবকে দেশে ফিরিতে দেওয়া হইবেলিয়া সংবাদ প্রচারিত হইল।
৩. ভুলের মাশুল
অল্পদিন মধ্যেই প্রমাণিত হইল যে শহীদ সাহেবকে ধাঙ্গ দেওয়া হইয়াছে। একমাত্র মুজিবুর রহমান সাহেবকে মুক্তি দেওয়া ছাড়া আর কোনও ব্যাপারে বড়লাট বা তাঁর সহ-ঘরা শহীদ সাহেবের কথা রাখিতেছেন না, এটা স্পষ্ট হইয়া গেল। মওলানা ভাসানীকে দেশে ফিরিবার আদেশ ক্রমেই বিলম্বিত হইতে লাগিল। আওয়ামী লীগ হইতে আরও দুইজন মন্ত্রী গ্রহণ করা ত দূরের কথা, শহীদ সাহেবের অমতে হক সাহেবের দলের বন্ধু আবু হোসেন সরকারকে ৪ঠা জানুয়ারি মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করা হইল। বক্সের কাগমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদে এবং হক সাহেব ও শহীদ সাহেকের বিবৃতিতে বোঝা গেল, যুক্তফ্রন্টে বেশ বড় রকমের ভাংগন ধরিয়াছে। আমার বরাবর ধারণা ছিল যে গবর্নর-জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ নিজে এবং তাঁর পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী, হক সাহেব ও শহীদ সাহেবের মধ্যে বিরোধ বাঁধাইয়া যুক্তফ্রন্ট ভাংগিবার ষড়যন্ত্র করিতেছেন। মওলানা ভাসানী দেশে থাকিলে এই চেষ্টায় তাঁরা সফল হইতে পারিবেন না এই আশঙ্কাতেই তাঁরা মওলানা সাহেবকে দেশে ফিরিতে দিতেছিলেন না। এই ব্যাপারে কি শহীদ সাহেব, কি হক সাহেব, দুই জনের একজনও দেশকে উপযুক্ত নেতৃত্ব দিতে পারিতেছেন না বলিয়া আমার মনটা খুবই খারাপ হইয়াছিল। দুই নেতাই শাসন-নিয়ন্ত্রণের উর্ধ্বে। একজনের কথায় নির্ভর করা যায় না; আরেকজন কারও পরামর্শ মানেন না। এ অবস্থায় একটি মাত্র লোক যিনি উভয়কে শাসন করিতে পারিতেন, তিনি ছিলেন মওলানা ভাসানী। দুর্ভাগ্যবশতঃ তিনি ঠিক এই সময়েই দেশে নাই। আজ আমার মনে হইতেছে, মওলানা সাহেবের ঐ সময়ে বিদেশে যাওয়াটা ঠিক হয় নাই। তিনি থাকিলে বোধ হয় হক সাহেব ও শহীদ সাহেবের ঐ ব্যক্তিগত বিরোধ এবং পরিণামে যুক্তফ্রন্টের ভাংগন রোধ করিতে পারিতেন। কিন্তু আমার মনে হইলে কি হইবে? পার্টির বা দেশের সবচেয়ে যে সংকট মুহূর্তে মওলানা সাহেবের প্রয়োজন হইয়াছে সবচেয়ে বেশি, ঠিক সেই মুহূর্তেই তিনি দুপ্য হইয়াছেন।
৪. হক-নেতৃত্বে অনাস্থা
যুক্তফ্রন্টের অন্তর্বিরোধ আরও বাড়িল। আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি মুজিবুর রহমান সাহেব হক সাহেবের বিরুদ্ধে এক অনাস্থা প্রস্তাব আনিলেন। এই প্রস্তাবের পক্ষে দস্তখত অভিযান শুরু হইল। অভিযানের গোড়ায় মুজিবুর রহমান সাহেব বলিলেন : এ অনাস্থা-প্রস্তাব আওয়ামী লীগের তরফ হইতে নয় যুক্তফ্রন্টের তরফ হইতে। এতে কিছু সংখ্যক আওয়ামী মেম্বর ব্যক্তিগত বিচার-বিবেচনার স্বাধীনতা দাবি করিলেন। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ডাকিয়া। আওয়ামী মেম্বরদের উপর ম্যাডেট দেওয়া হইল।
এই ধরনেরসভায় কোনদিনই শান্তিপূর্ণ সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত হয় না। গণ্ডগোলেই সভা শেষ হয়। এই অভিজ্ঞতা আমার অনেক দিনের ছিল। কাজেই ‘ইত্তেফাঁক– সম্পাদক মানিক মিয়া সাহেব ও আমি এই অনাস্থা প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করিলাম। কিন্তু আমাদিগকে এই বলিয়া চুপ করা হইল যে এটা শহীদ সাহেবের নির্দেশ এবং মওলানা সাহেবেরও এতে মত লওয়া হইয়াছে। কিন্তু ব্যাপারটা আমার মনঃপূত হইল না।
এই ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য আমি শেষ পর্যন্ত শহীদ সাহেবের ও মওলানা সাহেবের সহিত টেলিফোনে যোগাযোগ করিবার চেষ্টা করিলাম। শহীদ সাহেবকে পাওয়া গেল না। মওলানা সাহেবকে পাইলাম। অনাস্থা-প্রস্তাবে তাঁর অনুমোদনের কথা তিনি অস্বীকার করিলেন। বলিলেন এ কাজে বিরত থাকিবার জন্য, তিনি আমাদের কয়েকজনের নামে পত্র দিয়াছেন। আমার চিঠি ময়মনসিংহের ঠিকানায় দিয়াছেন বলিয়া তখনও আমার হাতে পৌঁছে নাই। যাহোক তিনি অনাস্থা প্রস্তাব বিবেচনার সভা স্থগিত রাখিবার জোর পরামর্শ দিলেন।
আমি তাঁর অনুরোধ রক্ষার কোনও উপায় দেখিলাম না। কাজেই সে চেষ্টা করিলাম না। বরঞ্চ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির ম্যানডেটের জোরে জিতিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু শহীদ সাহেব ঢাকা না আসায় ও মওলানা সাহেবের বিরুদ্ধতার কথা জানাজানি হইয়া যাওয়ায় জয়ের সম্ভাবনা কমিয়া গেল। আমি আপোসের চেষ্টা করিলাম। বন্ধুবর আবদুস সালাম খাঁ সাহেবই এ আপোস করাইয়া দিতে পারিতেন। কারণ তিনি পঁচিশ জনের মত আওয়ামী মেম্বর লইয়া হক সাহেবের সমর্থন করিতে ছিলেন। আমি তাঁকে এই আপোস-ফরমূলা দিলাম পার্টির সভায় একই প্রস্তাবে প্রাদেশিক নেতা হিসাবে হক সাহেবের উপর ও কেন্দ্রীয় নেতা হিসাবে শহীদ সাহেবের উপর আস্থা জ্ঞাপন করা হইবে। সালাম সাহেব আমার ফরমূলা খুবই পছন্দ করিলেন। কিন্তু বলিলেন : বড়ই দেরি হইয়া গিয়াছে। ইট ই ট লেইট। আমি তাঁকে পরামর্শ দিলাম : কিচ্ছু দেরি হয় নাই। সালাম সাহেবের আর কিছু করিতে হইবে না। তিনি সোজা হক সাহেবের কাছে গিয়া বলিবেন : আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবের পর তাঁর আর স্বাধীনতা নাই। তিনি ইতিপূর্বে হক সাহেবকে সমর্থনের যে ওয়াদা করিয়াছিলেন তা হইতে তিনি মুক্তি চান। সত্য-সত্যই সালাম সাহেবের ঐ ওয়াদা খেলাফ করিতে হইবে না। কারণ এ কথা শোনা মাত্র হক সাহেব সালাম সাহেবকে আশপাসের জন্য ধরিবেন। সালাম সাহেব তখন আমার ফরমূলায় আপোস করাইবার সুযোগ পাইবেন।
সালাম সাহেব আমার অনুরোধ রাখিতে পারেন নাই। ফলে নির্ধারিত দিনে ১৯৫৫ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি এসেমরি হলের রিফ্রেশমেন্ট রুমে যুক্তফ্রন্টের এই ঐতিহাসিক বৈঠক বসিল। সভার প্রাক্কালেও উভয় পক্ষের আপোস-কামী কতিপয় সদস্যের সহযোগিতায় আপোসের একটা চেষ্টা করিলাম। কিন্তু উভয় পক্ষের চরমপন্থীদেরই জয় হইল। সভার কাজ শুরু হইল। এ ধরনের সভায় বরাবর যা হইয়া থাকে তাই হইল। উভয় পক্ষের প্রস্তাব পাস হইল। উভয় পক্ষই জিতিল। উভয় পক্ষের খবরের কাগযে যার-তার প্রস্তাবের সমর্থকদের যেসংখ্যা বাহির হইল তার যোগফল মোট মেম্বরের চেয়ে বেশি। উভয় পক্ষই জয় দাবি করিলেন। আওয়ামী লীগ ওয়ালারা বলিলেন : আওয়ামী লীগের জয়। কৃষক-শ্রমিক ওয়ালারা বলিলেন : কৃষক-শ্রমিক পার্টির জয়। দুই দলের কেউ তখন বুঝিলেন না যে জয় তাঁদের কারও হয় নাই। আসল জয় হইয়াছে গণ-দুশমন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি।
৫. আশার আলো নিভিল
এই ভাবে যুক্তফ্রন্ট ভাংগিয়া গেল। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের বড় শরিক আওয়ামী লীগ এই ভাংগনের কোনও সুবিধা উপভোগ করিতে পারিল না। বরঞ্চ ছোট শরিক কৃষক শ্রমিক পার্টিই দৃশ্যতঃ এবং স্পষ্টতঃ সব সুবিধা লুটিতে লাগিল। আওয়ামী লীগের নেতা শহীদ সাহেব কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকার দরুন আওয়ামী লীগের কোনও সুবিধা ত হইলই না, বরঞ্চ প্রতিপদে বেকায়দা হইতে লাগিল। গবর্নর-জেনারেল এই সময়ে কতকগুলি বেআইনী ও অগণতান্ত্রিক অর্ডিন্যান্স জারি করিলেন। কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও তার নেতা হক সাহেব জনসভা করিয়া এবং বিবৃতি দিয়া সে সবের প্রতিবাদ করিতে লাগিলেন। তাঁদের দলের প্রতিনিধি মিঃ আবু হোসেন সরকার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও এইসব অগণতান্ত্রিক কাজের জন্য শুধু শহীদ সাহেবকেই দোষী করিতে লাগিলেন। আওয়ামী লীগ আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনও সাফাই দিতে পারিল না। কারণ শহীদ সাহেবের মুখ চাহিয়া ঐ সব অগণতান্ত্রিক অর্ডিন্যান্সের প্রতিবাদও তাঁরা করিলেন না। আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানীকে দেশে ফিরাইয়া আনার আন্দোলন ও জনসভা আওয়ামী লীগের বদলে কৃষক-শ্রমিক পার্টিই করিতে লাগিল। এতে আওয়ামী লীগের মর্যাদা দ্রুত হ্রাস পাইতে লাগিল। এই সময় গবর্নর-জেনারেল একটি গণ-পরিষদের বদলে একটি শাসনতন্ত্র কনভেনশন গঠনের জন্য এক অর্ডিন্যান্স জারি করিলেন। এটা স্পষ্টতঃই অগণতান্ত্রিক হইল। কৃষক-শ্রমিক পার্টি এই অগণতান্ত্রিক পন্থার তীব্র প্রতিবাদ করিল। তাছাড়া কনভেনশনের সদস্যসংখ্যায় দুই পাকিস্তানের প্যারিটি-প্রবর্তন করায় পূর্ব-বাংলার সর্বত্র ইহার প্রতিবাদ উঠিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ শহীদ সাহেবের খাতিরে এ সব অন্যায়েরও প্রতিবাদ হইতে বিরত রহিল। আমরা আওয়ামী লীগের কর্মীরা শরমে মরমে মরিতে লাগিলাম। মওলানা ভাসানী কলিকাতা হইতে কনভেনশনের প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়া আওয়ামী লীগের মুখ রক্ষা করিলেন। এই সময়ে কনভেনশনের পক্ষে ক্যানভাস করিবার জন্য শহীদ সাহেব ও ইঙ্কান্দর মির্যা ঢাকায় আসিলেন। উদ্দেশ্য ও শহীদ সাহেব আওয়ামী লীগকে ও মির্যা সাহেব কৃষক-শ্রমিক পার্টিকে কনভেনশন গ্রহণ করাইবেন। একই সময়ে গবর্নমেন্ট হাউসের এক অংশে শহীদ সাহেব আওয়ামী লীগকে লইয়া এবং অপর অংশে মির্যা সাহেব কৃষক-শ্রমিক পার্টিকে লইয়া দরবারে বসিলেন। শহীদ সাহেবের পরামর্শে আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত কনভেনশন সম্পর্কে এই মত প্রকাশ করিল যে যদি মওলানা ভাসানী ঢাকায় আসিয়া আওয়ামী লীগের সভায় কনভেনশন সমর্থন করেন, তবে আওয়ামী লীগ তাতেই রাযী আছে। পক্ষান্তরে গবর্নমেন্ট হাউসের অপর অংশে ইস্কান্দর মির্যা কৃষক-শ্রমিক পার্টিকে যা বুঝাইলেন, তার ফল এই হইল যে পরদিনই হক সাহেব নিজ বাড়িতে কৃষক-শ্রমিক পার্টির আনুষ্ঠানিক সভা ডাকিয়া কনভেনশন ও প্যারিটির তীব্র প্রতিবাদ করিলেন এবং সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন গণ পরিষদ দাবি করিলেন। ঐ সংগে প্রস্তাবিত কনভেনশন বয়কট করার প্রস্তাবও গৃহীত হইল। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগও বয়কটের প্রস্তাব করিল। আর সব পার্টিই গণতন্ত্র ও পূর্ব-বাংলার স্বার্থে সগ্রামে অবতীর্ণ হইল। শুধু আওয়ামী লীগ চুপ করিয়া থাকিল। কনভেনশনের নির্বাচনের নমিনেশন পেপার দাখিলের দিন তারিখ পিছাইয়া দিয়া মির্যা সাহেব ও শহীদ সাহেব করাচি ফিরিয়া গেলেন। দিন সাতেক পরে ২৫শে এপ্রিল তারিখে কলিকাতা হইতে মওলানা ভাসানীকে সংগে লইয়া শহীদ সাহেব আবার ঢাকায় আসিলেন। আমাদের মধ্যে বিপুল আনন্দ ও আশা জাগিল। আওয়ামী লীগের সভা বসিল। শহীদ সাহেবের প্রাণস্পর্শী বক্তৃতা শুনিয়া আওয়ামী লীগ কভেনশন সম্পর্কে চিন্তা করিবার এবং আরও আলোচনা করিবার সময় চাহিল। শহীদ সাহেব এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যুক্তি দিলেন। মওলানা সাহেব অগত্যা নমিনেশন পেপার দাখিলের পক্ষে মত দিলেন। পরদিন আমরা নমিনেশন পেপার দাখিল করিলাম। আর কোনও পার্টি নমিনেশন ফাঁইল করিল না। আমরা অনেকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হইবার আশায় মনে-মনে খুশি হইলাম। কিন্তু বড়লাট নমিনেশন পেপার দাখিলের তারিখ আবার পিছাইয়া দিলেন। আমরা নিরাশ হইলাম। মওলানা ভাসানীর গাল খাইলাম। কিন্তু এর পরেও আমাদের কপালে আরও অপমান ছিল। ১০ই এপ্রিল ফেডারেল কোর্ট কনভেনশন গঠনে বড়লাটের ক্ষমতা নাই, সাধারণ গণ-পরিষদ গঠন করিতে হইবে, বলিয়া রায় দিলেন। ১৯৫৫ সালের ২৮শে মে বড়লাট ফেডারেল কোর্টের রায় মোতাবেক নয়া গণ-পরিষদ গঠনের অর্ডিন্যান্স জারি করিলেন। গণতন্ত্রের নিশ্চিত জয় হইল। কিন্তু এ জয়ে আওয়ামী লীগ শরিক হইতে পারিল না। গণতন্ত্রের জয়ও যে কোনও দিন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের পরাজয় ও লজ্জার কারণ। হইতে পারে, ঐ দিনই প্রথম আমার সে কথা মনে পড়িয়াছিল। কিন্তু এখানেই আমাদের পরাজয়ের শেষ হয় নাই। দুর্দশা আরও ছিল বরাতে।
৬. বিভেদের শাস্তি
যুক্তফ্রন্টের মধ্যে আওয়ামী লীগই বিপুল মেজরিটি পার্টি। সূতরাং ৯২-ক ধারা উঠিলে মন্ত্রিত্ব আওয়ামী লীগেরই প্রাপ্য। তাছাড়া বড়লাট শহীদ সাহেবকে কথা দিয়াছেন বলিয়াও তিনি আমাদেরে জানাইয়াছেন। চিফ সেক্রেটারি মিঃ এন. এম. খাও নিজ-মুখে আমাদেরে সে কথা বলিয়াছেন। তবু শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী স্বয়ং ঢাকায় উপস্থিত থাকিয়া কৃষক-শ্রমিক পার্টিকে মন্ত্রিত্ব দিয়া দিলেন। অস্থায়ী গবর্নর বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের অমতেই তিনি এটা করিলেন। গবর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ তখন লণ্ডনে। শহীদ সাহেবও তাঁর সাথে। তবু তিনি এটা ঠেকাইতে পারিলেন না। প্রধান মন্ত্রীর নিজ-মুখে-কওয়া দেশদ্রোহী’ হক সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করা যায় না বলিয়া তাঁর নমিনি মিঃ আবু হোসেন সরকারকে প্রধানমন্ত্রী করা হইল। তবু মেজরিটি পার্টি আওয়ামী লীগকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হইল না। কৃষক শ্রমিক পার্টির মন্ত্রিসভা হওয়ায় কুড়ি জন আওয়ামী সদস্যসহ দুইজন আওয়ামী নেতা মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিলেন। নেযামে-ইসলাম পার্টি, কংগ্রেস পার্টি ও তফসিলী হিন্দুরাও মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিলেন। গণতন্ত্রী দলও এই মন্ত্রী-সভাকে সমর্থন দিল। সুতরাং কার্যতঃ এবং নামতঃও এই মন্ত্রিসভা যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা হইল। শুধু আওয়ামী লীগ পার্টি বাদ পড়িল। আওয়ামী লীগ পার্টির কুড়ি জন সদস্য আওয়ামী মুসলিম লীগ পার্টি নামে কোয়েলিশন পার্টির অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এবং ১৯ জন আওয়ামী সদস্য শেষ পর্যন্ত কৃষক-শ্রমিক পার্টিতে যোগ দেওয়ায় আওয়ামী লীগের সদস্যসংখ্যা ১০৪ জনে আসিয়া দাঁড়াইল।
এটা অচিন্তনীয় ব্যাপার ছিল না। আমাদের দেশে বিশেষতঃ মুসলমানদের মধ্যে পার্টি-চৈতন্য ও পার্টি-আনুগত্য আজও দানা বাঁধে নাই। বেশ কিছুসংখ্যক লোক আজও ‘ব্যাণ্ডওয়াগেন’-নীতি, দেশী কথায় ‘মামার জয়’-নীতির অনুসারী। তাছাড়া আওয়ামী লীগের আনুগত্য দাবির মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক জোর ছিল সত্য, কিন্তু নৈতিক জোর ছিল না। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ স্বাধীন ও স্বন্ত্র পার্টি হিসাবে নিজস্ব নমিনি দাঁড় করায় নাই। যুক্তফ্রন্টের অংগ দল হিসাবেই নির্বাচন করিয়াছিল। নির্বাচনী ওয়াদা একুশ দফাও আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো ছিল না। যুক্তফ্রন্টের মেনিফেস্টো ছিল। কাজেই নির্বাচিত সদস্যদের নৈতিক ও রাজনৈতিক আনুগত্য ছিল যুক্তফ্রন্টের কাছে। এ অবস্থায় ৩৯ জন আওয়ামী মেম্বরের যুক্তফ্রন্টের নামে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করাটা আশ্চর্যের বিষয় ছিল না। বরঞ্চ আরও বেশিসংখ্যক মেম্বর যে বিদ্রোহ করেন নাই, এটা আওয়ামী লীগের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ও আওয়ামী মেম্বরদের শৃংখলা-বোধের পরিচায়ক।
এইভাবে আওয়ামী লীগ পার্টি আইন-পরিষদের মুসলিম অংশেও মাইনরিটি পার্টিতে পরিণত হইল। অতঃপর আইন-পরিষদের মেম্বরদের ভোটে যে ৩১ জন মুসলমান গণ-পরিষদের মেম্বর নির্বাচিত হইলেন, তাতে আওয়ামী লীগ পাইল মাত্র ১২টি। পক্ষান্তরে কৃষক-শ্রমিক ও নেযামে ইসলাম-গণন্ত্রী কোয়েলিশন পাইল ১৬টি। মুসলিম লীগ ১টি ও স্বতন্ত্র ২টি। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীই এই একমাত্র মুসলিম লীগ সদস্য।
এইভাবে আমাদের ভুল ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর অপচেষ্টায় আওয়ামী লীগ পার্টি পর পর তিন-তিনটা মার খাইল। যুক্তফ্রন্ট ভাংগিল। মেজরিটি-পার্টি আওয়ামী লীগ মাইনরিটি হইল। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে মোহাম্মদ আলীর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী শহীদ সাহেব মাইনরিটি-নেতা হইলেন।