পৃথক পথে যাত্রা শুরু
উপাধ্যায় তিন
১. ভূট্টা-ইয়াহিয়া ষড়যন্ত্র
২৭শে জানুয়ারি জনাব ভুট্টো সদলবলে ঢাকা আসিলেন। আসিবার আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে ভুট্টো সাহেবের কয়েক দফা বৈঠক হইল। ভুট্টা সাহেব তিন-চার দিন ঢাকা অবস্থান করিলেন। আওয়ামী নেতাদের সাথে অনেক দেন-দরবার করিলেন। আওয়ামী লীগের ছয় দফার বিরুদ্ধে নানারূপ যুক্তি-কুযুক্তি দিলেন। কিন্তু তারা কি চান, কোন্ বিষয়ে ছয় দফার পরিবর্তন চান, এক কথায় তারা কি ধরনের সংবিধান চান, ঘুণাক্ষরেও তা খুলিয়া বলিলেন না। সবশেষে আবার দেখা হইবে’ বলিয়া বিদায় হইলেন। আওয়ামী লীগের সাথে ঘোরর মতভেদ হইয়াছে, আলোচনা ভাংগিয়া গিয়াছে, আকারে-ইংগিতেও তুন্ত্রেী সাহেব বা তাঁর সংগীদের কেউ এমন কোন কথা বলিলেন না। কিন্তু আমি ভুট্টা সাহেবের নীরব বিদায়ের মধ্যে একটা অশুভ ইংগিতের আভাস পাইলাম। এটা ছিল জানুয়ারির শেষ দিন। আমি ঐ রাত্রেই একটি বিবৃতি মুসাবিদা করিলাম। পরদিন খবরের কাগযে পাঠাইয়া সম্পাদকদেরে নিজে অনুরোধ করিলাম। নিউ এজেন্টদেরেও তেমনি বলিলাম। পরদিন ‘অবরভার’ ও মনিং-নিউয়’ ‘ডুয়েল সেন্টার হেডিং দিয়া আমার বিবৃতিটা পুরা ছাপিলেন। বাংলা দৈনিকগুলিও তাই করিলেন। এজেন্সিরা পশ্চিম-পাকিস্তানে কোড় করায় ‘ডন’, ‘পাকিস্তান টাইমস’ ইত্যাদি কাগফও যথেষ্ট স্থান দিলেন। আমি সে বিবৃতিতে শেখ মুজিব ও ভুট্টোকে আপোসের আবেদন জানাইলাম। ভুট্টা সাহেব করাচি ফিরিয়াই পিণ্ডি গেলেন। পিডিতে কয়েকদিন কাটাইয়া পেশওয়ার গেলেন। সেখানকার এক ক্লাবে বক্তৃতা করিতে গিয়া ১৫ই ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করিলেন, তিনি ঢাকায় আহত পরিষদ বৈঠক বয়কট করিবেন। বয়কটের হুমকি দিয়াই তিনি ক্ষান্ত হইলেন না। অন্যান্য মেম্বরদেরেও তিনি শাসাইলেন। তাঁর বয়কট উপেক্ষা করিয়া যেসব পশ্চিম পাকিস্তানী মেম্বর ঢাকা যাইবার চেষ্টা করিবেন, তাঁদের ঠ্যাং ভাংগিয়া অথবা কান্না কাটিয়া ফেলিবেন। ঢাকাকে তিনি কসাইখানা বলিলেন। মিঃ ভুট্টোর এইসব বেআইনী ও অপরাধমূলক উক্তির বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বা সরকারী কেউ একটি কথাও বলিলেন না। মিঃ ভুট্টোর এই হমকি সত্ত্বেও পিপলস পার্টি ও কাইউম লীগের মেয়রগণ ছাড়া আর সবাই ঢাকার টিকিট বুক করিয়া ফেলিলেন। কয়েকজন মেম্বর ঢাকা পৌঁছিয়াও গেলেন। শোনা যায়, খোদ-পিপলস পার্টির কয়েকজন মেম্বরও টিকিট বুক করিয়াছিলেন। মনে হইতেছিল, ভুট্রোর হুমকি সত্ত্বেও ঢাকা সেশন সফল হইবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে।
২. পরিষদের বৈঠক বাতিল
এমন সময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ২৮শে ফেব্রুয়ারি করাচি আসিলেন। ভুট্টো সাহেবের বাড়িতে খানাপিনা করিলেন। ১লা মার্চ তারিখে করাচি রেডিও হইতে প্রেসিডেন্টের নিজের গলার ভাষণে নয়, পঠিত এক বিবৃতিতে বলা হইল : পরিষদের ৩রা মার্চের বৈঠক স্থগিত। এই ঘোষণায় আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবকে এই সর্বপ্রথম কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হইল।
সন্ধ্যা ছয়টার রেডিওতে প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণায় ঢাকাবাসী, সারা পূর্ব পাকিস্তানবাসী, স্তম্ভিত, বিক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়া উপযুক্ত যোগ্য নেতার কাজ করিলেন। মেজরিটি পার্টির নেতা এবং ভাবী প্রধানমন্ত্রীকে জিগ্গাসা না করিয়া অনির্দিষ্ট কালের জন্য পরিষদ স্থগিত করিয়া প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অনিয়মতান্ত্রিক অপরাধ করিয়াছিলেন। শেখ মুজিবের সময়োপযোগী অসীম ধৈর্যে ও স্থৈর্যে আমি মুগ্ধ ও গর্বিত হইয়াছিলাম। আমি অসুস্থ না থাকিলে নিজে তাঁর বাসায় যাইতাম। কিন্তু রাত্রি সাড়ে আটটার দিকে তিনি নিজে আমাকে ফোন করিয়া যা বলিলেন, তাতেই আমি পূর্বোক্ত-মত মুগ্ধ ও গর্বিত হইলাম। তিনি বলিলেন, তিনি সাত দিনব্যাপী সাধারণ হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন করা ঠিক করিয়াছেন। আমি সানন্দে আমার ঐকমত্য জানাইলাম। তবে অসহযোগের সাথে অহিংস কথাটা যোগ করিতে অনুরোধ করিলাম। তিনি হাসিয়া জবাব দিলেন, সেটা করাই হইয়াছে। আমি তাঁকে ‘কংগ্রেচুলেট’ করিলাম। তিনি জবাবে বলিলেন : ‘শুধু দোওয়া করিবেন।‘ আমি সত্য-সত্যই দোওয়া করিলাম। করিতে থাকিলাম বলাই ঠিক। কারণ ওটাই ছিল আমার জন্য সহজ।
৩. অহিংস অসহযোগের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত
পরদিন বিদেশীরা দেখিয়া ত বিস্মিত হইলেনই, আমরাও কম বিস্মিত হইলাম। অভূতপূর্ব, অপূর্ব, অভাবনীয় সামগ্রিক সাড়া। যেন যাদু-বলে রাস্তা-ঘাট, হাট বাজার, অফিস-আদালত, হাইকোর্ট-সেক্রেটারিয়েট অচল, নিথর, নিস্তব্ধ। শুধু রাজধানী ঢাকা শহরে নয়। পরে জানা গেল, সারা পূর্ব-পাকিস্তানে ঐ একই অবস্থা। খবরের কাগযে সারাদেশের শহর-বন্দরের রিপোর্ট পড়িলাম। আর কল্পনায় পঞ্চাশ বছর আগের ১৯২০-২১ সালের খেলাফত-কংগ্রেসের অসহযোগ-হরতালের চিত্র দেখিতে লাগিলাম। মহাত্মা গান্ধী ও আলী ভাই এর ডাক সেদিন বাতাসের আগে দেশব্যাপী ছড়াইয়া পড়িত। তাঁদের আহ্বানে দেশবাসী একযোগে যে হরতাল অসহযোগ পালন করিত, তা দেখিয়া বিস্মিত হইতাম। মনে করিতাম, এমনটা আর হয় নাই, হইবে না। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২রা মার্চের ঘটনা আমার বিশ্বয় সকল সীমা ছাড়াইয়া গেল। কোথাও কোনও অনুরোধ-উপরোধ ক্যানভাস্-পিকেটিং এর দরকার হইল না। স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া সবাই যেন এ কাজ করি। এটা যেন সকলেরই কাজ। ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পরিষদ মূলতবি করিবেন, এটা পূর্ব-পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ আগে হইতেই জানিতেন। ১লা মার্চ সকাল না হইতেই ঢাকা শহরে সৈন্য মোতায়েন হইল। কাজেই প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটা জনসাধারণের বিস্ময় উদ্রেক করিলেও শাসকদের নিশ্চয়ই বিস্ময় উদ্রেক করে নাই। বরঞ্চ আওয়ামী-নেতারা যে হরতাল ঘোষণা করেন, সেটা ব্যর্থ করিবার জন্য তাঁরা বিশেষ তৎপরতা অবলম্বন করেন। রাস্তায়-রাস্তায় টহল দিয়া জনগণের মনে ভীতি সৃষ্টির সকল প্রকার পন্থা গ্রহণ করেন। ঢাকা শহরে ও মফস্বলের অনেক জায়গায় গুলি-গোলা চলে। বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। সরকারী কর্মচারীদেরে অফিস-আদালতে হাযির করার জন্য, দোকানপাট খোলা রাখিবার জন্য, সকল প্রকার চেষ্টা-তদ্ধির করা হয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না।
এ সবই অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। পাঠকদের প্রায় সকলেই নিজের চোখে দেখিয়াছেন। অনেকেই খবরের কাগযে পড়িয়াছেন। সকলেরই মনে থাকার কথা। তবু এ সবের উল্লেখ করিলাম এই জন্য যে মাত্র ন’মাস পরে ক্ষমতায় বসিয়া শাসকদল সরকারী-বেসরকারী সকল প্রকার কর্মচারীসহ গোটা দেশবাসীর এই ঐক্যের কথা বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছিলেন। সে কথার আলোচনা করিব পরে।
৩রা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আরেকটা বাজে কাজ করিলেন। তিনি বার নেতা’র এক বৈঠক ডাকিলেন। এই বার নেতার মধ্যে দুই জন পূর্ব-পাকিস্তানী, আর দশজন পশ্চিম পাকিস্তানী। পরিষদ বাইপাস করার ছিল এটা একটা ফন্দি। বার নেতার মধ্যে এক দিকে প্রেসিডেন্ট ও অপর দিকে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্য কোনও ফরমূলা নির্ধারিত হওয়া অসম্ভব ছিল, এটা সবাই জানিতেন। তবু এমন বৈঠক ডাকা হইয়াছিল দুরভিসন্ধি-বলে। কাজেই আওয়ামী-নেতা শেখ মুজিব সংগত কারণেই এটা অগ্রাহ্য করিলেন। তিনি এক প্রেস-কনফারেন্সে অহিংস অসহযোগ চালাইয়া যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
পূর্ব-পাকিস্তানের একচ্ছত্র প্রতিনিধি শেখ মুজিব ঐ বৈঠক গ্রাহ্য করায় পূর্ব-পাকিস্তানের অপর একমাত্র নিমন্ত্রিত নেতা নূরুল আমিন সাহেবও বৈঠকে যোগ দিতে অসম্মতি জানাইলেন।
এক-লাগা পাঁচ দিন পূর্ব-পাকিস্তানে, মানে পাকিস্তানের মেজরিটি অঞ্চলে, কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারের কোন অস্তিত্ব ছিল না। সরকারী-বেসরকারী সকল প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হইতেছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের নির্দেশে। কেন্দ্রীয়-প্রাদেশিক সরকারের সমস্ত অফিসাররাও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মানিয়া চলিতেছিলেন। সামরিক বাহিনী ক্যান্টনমেন্টের বাহিরে আসা হইতে বিরত ছিল।
একটা নীরব অহিংস বিপ্লবের মধ্য দিয়া পূর্ব-পাকিস্তানে বিপুল ভোটাধিক্যে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের ডিফ্যাক্টো শাসন কায়েম হইয়া গেল। বিদেশীরাও স্বীকার করিলেন, পূর্ব-পাকিস্তানীরা একাত্মভাবে, টু-এ-ম্যান, আওয়ামী লীগের সমর্থক।
৪. ডিক্টেটরের নতি স্বীকার
৬ই মার্চ সন্ধ্যা ছয়টার রেডিওতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নিজ গলায় ঘোষণা করিলেন, তিনি ২৫শে মার্চ ঢাকায় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করিলেন। প্রেসিডেন্টের সে ঘোষণায়ও রাষ্ট্রপতির মর্যাদা-উপযোগী শরাফত ছিল না। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় তাঁর মনের ক্ষোভ ভাষায় ফাটিয়া পড়িতেছিল। কিন্তু ওসবকে আমি কোন গুরুত্ব দিলাম না। পরিষদের বৈঠক ডাকা হইয়াছে, এটাই আমার কাছে ছিল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আওয়ামী লীগের জয়। জনমতের সামনে ডিক্টেটরের নতি স্বীকার।
প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণায় সবাই নিন্তি ও খুশি হইয়াছিলেন। দুই-একজন করিয়া অনেকেই আমার বৈঠকখানায় সমবেত হইলেন। সকলের মুখেই স্বস্তির ভাব। যা একটা সংকট কাটিয়া গেল। রাত সাড়ে আটটার দিকে আমি মুজিবের নিকট হইতে টেলিফোন পাইলাম। প্রথমে তাজুদ্দিন সাহেব ও পরে শেখ মুজিবের সাথে কথা হইল। আওয়ামী লীগের কর্তব্য সম্বন্ধে আমার মত জানাইলাম। তাঁদের মত ছিল, বিনাশর্তে তাঁরা ২৫শে মার্চের পরিষদে যোগ দিবেন না। আমার মত ছিল, শর্ত তাঁরা যাই দেন, ২৫শে মার্চের বৈঠকে তাঁরা অবশ্যই যোগ দিবেন। আমার যুক্তিটা ছিল এইরূপ : ২৫শে মার্চের বৈঠকে আওয়ামী লীগ হাযির হইয়া নিজস্ব মেজরিটির জোরে আওয়ামী লীগ পার্টির একজন স্পিকার, পশ্চিম পাকিস্তান হইতে দওলতানা ও ওয়ালি খাঁর সাথে পরামর্শ করিয়া সিনিয়র ডিপুটি স্পিকার ও পূর্ব-পাকিস্তান হইতে (তার মানে আওয়ামী লীগ) জুনিয়র ডিপুটি স্পিকার নির্বাচন করিবেন। এইভাবে স্পিকার, দুইজন ডিপুটি স্পিকার ও প্যানেল-অব-চেয়ারমেন নির্বাচন শেষ করিয়া মেজরিটি পার্টির নেতা ও লিডার-অব-হাউস হিসাবে শেখ সাহেব স্পিকারকে অনুরোধ করিবেন–এক সপ্তাহের জন্য হাউস মুলতবি করিতে। উদ্দেশ্য ও উভয় অঞ্চলের নেতাদের মধ্যে শাসনতান্ত্রিক সংবিধান সম্বন্ধে একটা সমঝোতার আলোচনা। ইতিপূর্বে ৩রা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে বার নেতার বৈঠক ডাকিয়াছিলেন, সম্ভব হইলে সেই নেতৃ-বৈঠকই লিডার-অব-দি হাউস হিসাবে শেখ মুজিবই ডাকিবেন। উচিৎ বিবেচিত হইলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকেও সেই বৈঠকে দাওয়াত করা হইবে। বিশ্ববাসী জানিবে, নিরংকুশ মেজরিটি হইয়াও শেখ মুজিব পশ্চিম-পাকিস্তানের নেতাদের সাথে সমঝোতায় আসিবার কতই না আন্তরিক চেষ্টা চালাইতেছেন। আওয়ামী লীগ ছয় দফা-ভিত্তিক সংবিধান রচনায় ধমতঃ হলফ-বদ্ধ। ওটা ছাড়া কিছুতেই রাযী হইতে পারেন না। স্পষ্টতঃই ঐ এক সপ্তাহের মুলতবিতে কাজ হইবে na। এক সপ্তাহ পরে পরিষদের বৈঠক হইবে। সেখানেও লিডার-অব-দিহাউস শেখ মুজিব আরও এক সপ্তাহের জন্য হাউস মুলতবি করিতে স্পিকারকে অনুরোধ করিবেন। এইভাবে যতদিন ইচ্ছা পর-পর হাউস মুলতবি করিয়া যাইবার ক্ষমতা ও অধিকার শেখ মুজিবের হাতে চলিয়া আসিবে। প্রেসিডেন্টের মর্যর উপর হাউস আর নির্ভরশীল থাকিবে না।
৫. আমার পরামর্শ
আমার পরামর্শটা শেখ মুজিব ও তাজুদ্দিন সাহেবের পসন্দ হইল বলিয়া জানাইলেন। কিন্তু একটা অসুবিধা হইয়া গিয়াছে। তাঁরা পরিষদে যোগ দিবার পূর্বশর্ত রূপে চারিটি দাবি করিয়া ইতিমধ্যেই সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়া ফেলিয়াছেন, বলিলেন। সে বিবৃতি সাকুলেট হইয়া বিদেশে ও পশ্চিম পাকিস্তানে চলিয়া গিয়া থাকিবে। অগত্যা আর কি করা যায়? তখন আমি জানিতে চাহিলাম, শর্ত চারিটি কি কি? তাঁরা জানাইলেন, শর্ত চারিটি এই :
(১) সৈন্যবাহিনী ব্যারাকে ফিরাইয়া নিতে হইবে।
(২) ১লা মার্চ হইতে সৈন্যবাহিনী যে হত্যাকাণ্ড ও যুলুম করিয়াছে, তার তদন্ত করিয়া পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের নিকট রিপোর্ট দাখিল করিতে হইবে। (বলা আবশ্যক, সামরিক কর্তৃপক্ষ ইতিপূর্বেই একটি তদন্তের নির্দেশ দিয়াছিলেন। কিন্তু সে তদন্তের রিপোর্ট সামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিলের কথা ছিল। আওয়ামী লীগ দাবি করিয়াছে, সামরিক কর্তৃপক্ষের বদলে সিভিল গবর্নমেন্টের নিকট রিপোর্ট দাখিল করিতে হইবে।)
(৩) মার্শাল ল প্রত্যাহার করিতে হইবে।
(৪) এই মুহূর্তে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ট্রান্সফার করিতে হইবে।
আমি শর্ত চারিটির প্রথম দুইটি সমর্থন করিলাম। পরের দুইটিতে আপত্তি করিলাম। আমি বলিলাম, এ সময়ে মার্শাল ল প্রত্যাহারের দাবি চলিতে পারে না। একটা সংবিধান (ইন্টারিম হইলেও) না করিয়া মার্শাল ল প্রত্যাহারের অর্থ ভ্যাকিউয়াম সৃষ্টি করা। তাতে ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকিবেন না। তাঁর-দেওয়া এল, এফ, ও, থাকিবে না। এল, এফ, ওর অধীন নির্বাচন থাকিবে না। নির্বাচন বাতিল হইলে গণপ্রতিনিধি থাকিবেন না। আর এই মুহূর্তে ক্ষমতা হস্তান্তর সঙ্গে আমি বলিলাম : ওটা তোমাদের চাহিতে হইবে না। ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নিজেই ব্যস্ত। কারণ আমাদের মহাজন রাষ্ট্রেরা আমাদের টাকা ডিভ্যালু করিবার ঘোর চাপ দিতেছে। ডিভ্যালু না করা পর্যন্ত নূতন ঋণ দিবে না, বলিয়া দিয়াছে। ইয়াহিয়ার ইচ্ছা তিনি নিজে টাকা ডিভ্যালু না করিয়া নির্বাচিত রাজনীতিকদের সিভিলিয়ান গবর্নমেন্টের হাত দিয়া ঐ বদকাজটা করাইবেন।
নেতারা ব্যাপারটা উপলব্ধি করিলেন, মনে হইল। এখন কি করা যায়। গায়ে পড়িয়া ত শর্ত প্রত্যাহার করা যায় না। ঠিক হইল, আলোচনার সময় দরকষাকষিতে প্রথম দুইটার উপর জোর দিয়া দ্বিতীয় দুইটা স্যাক্রিফাইসের ভাণ করা হইবে। অপর পক্ষকে জিতিবার সান্ত্বনা দিতে হইবে।
৬. আমার পরামর্শ কাজে লাগিল না
শান্তিতেই রাতটা কাটাইলাম। কিন্তু পর দিন সকালে খবরের কাগ পড়িয়া আবার শান্তি হারাইলাম। ঐ চারটি শর্ত গৃহীত হইলেই আওয়ামী লীগ পরিষদে যোগ দিবে, এ কথাও বিবৃতিতে বলা হয় নাই। বলা হইয়াছে? প্রেসিডেন্ট চার শর্ত পূরণ করিলে আওয়ামী লীগ পরিষদে যোগ দিবে কি না বিবেচনা করিয়া দেখিবে। কথাটায় আরো জোর দিয়া শেখ মুজিব বলিয়াছেন : “আমি আমার দেশবাসীর মৃতদেহ পাড়াইয়া পরিষদে যোগ দিতে পারি না।”
বয়সে তরুণ হইলেও শেখ মুজিব ‘ম্যান-অব-স্ট্রং কমন সেন্স’ আমি তা জানিতাম। সগৌরবে এ কথা বলিয়াও বেড়াইতাম। সেই ‘ম্যান-অব-ইং কমন সেন্স’ এমন যুক্তি দিলেন কেমন করিয়া? আমি তাঁকে টেলিফোনে ধরিবার চেষ্টা সারাদিন ধরিয়া করিলাম। শেখ মুজিব তখন কল্পনাতীত রূপে ব্যস্ত। স্বাভাবিক কারণেইলগত্যা ঠিক করিলাম, যাঁকে পাই তাঁকেই বলিব মুজিবকে আমার সাথে ফোনে কথা বলিতে। অত ব্যস্ততার মধ্যে মুজিবকে আসিতে বলা বা তা আশা করা উচিৎ না। আমার স্বাস্থ্যের যা অবস্থা, তাতে আমার পক্ষে যাওয়াও অসম্ভব। কাজেই প্রথম চেষ্টাতেই যখন কোরবান আলী সাহেবকে পাইলাম, তাঁকেই বলিলাম আমার অভিপ্রাটা। কোরবান আলী চেষ্টা করিয়াও সফল হইলেন না, বুঝা গেল। অগত্যা আমার পুত্র মহবুব আনামকে পাঠাইলাম। আমার ছেলের যাওয়ায়, অথবা কোরবান আলী সাহেবের চেষ্টায়, অথবা দুইজনের সমবেত চেষ্টায়, অবশেষে শেখ মুজিব কথা বলিলেন। আমি সোজাসুজি আমার কথায় গেলাম। বলিলাম : পরিষদ তোমার। ন্যায়ত ও আইনত: তুমি হাউসের নেতা। ওটা আসলে তোমারই বাড়ি। নিজের বাড়ি যাইতে শর্ত কর কার সাথে। ইয়াহিয়া অনধিকার প্রবেশকারী। তাঁর সাথে আবার শর্ত কি?
আমি বোধ হয় রাগিয়া গিয়াছিলাম। মুজিব হাসিলেন। বলিলেন : এত সব হত্যাকাণ্ডের পরও আবার আমাকে পরিষদে যাইতে বলেন? চট করিয়া খবরের কাগষে প্রকাশিত ‘মৃতদেহ’ কথাটা আমার মনে পড়িল। বলিলাম : হাঁ, নিজের লোকের মৃতদেহের উপর দিয়াই তুমি পরিষদে যাইবা। কারণ ও-বাড়ি তোমার। সে বাড়িতে ডাকাত পড়িয়াছে। তোমার বাড়ির কিছু লোকজন ডাকাত্রে হাতে খুন হইয়াছে। ডাকাত তাড়াইবার জন্যই তোমার নিজের লোকজনের মৃতদেহ পাড়াইয়া বাড়িতে ঢুকিতে হইবে। ডিক্টেটর ইয়াহিয়া জনমতের চাপে আওয়ামী লীগের দাবির সামনে মাথা নত করিয়াছেন। কাজেই আগামী কালের সভায় তুমি বিজয়-উৎসব উদযাপনের নির্দেশ দিবা। শেখ মুজিব আসলে রসিক পুরুষ। আমার উপমাটা তিনি খুব উপভোগ করিলেন। বিজয়-উৎসবের কথায় খুশি হইলেন। হাসিলেন। বলিলেন : আমার আজকার বক্তৃতা শুনিবেন। রেডিওতে ব্রডকাস্ট হইবে সোজাসুজি ময়দান হইতে। আপনার উপদেশ মতই কাজ হইবে। কোনও চিন্তা করিবেন না। দোওয়া করিবেন।’ ‘লিভ ইট টু মি’, ’কোনও চিন্তা করিবেন না দোওয়া করিবেন’ কথা কয়টি মুজিব এর আগেও বহুদিন বলিয়াছেন। আত্ম-প্রত্যয়ের দৃঢ়তার সুস্পষ্ট প্রকাশ। কথা। কয়টা ওঁর মুখে শুনিলেই আমি গলিয়া যাইতাম। ও দিনও গলিলাম। মানে, আশ্বস্ত হইলাম।
৭. অশুভ ইংগিত
পূর্বনির্ধারিত সময়-মত ৭ই মার্চ সকাল সাড়ে আটটায় আমার স্ত্রীকে লইয়া আমি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই; অথবা বলা যায় আমার স্ত্রীই আমাকে লইয়া হাসপাতালে যান। দুজনেরই অসুখ, দুজনেই ডাক্তারের পরীক্ষাধীন। দুজনেরই ই.সি.জি.,দুইজনেরই এক্সরে। কাজেই দুইজন প্রায় সমান। দুজনারই ডাক্তার রাবি ও ডাঃ হকের চেম্বারে যাওয়ার কথা। আমার একজন ডাক্তার বেশি। কান ও নাকের জন্য আমার ডাঃ আলী আফল খাঁর চেম্বারেও যাওয়ার কথা।
এসব সারিতে এগারটা বাজিয়া গেল। ডাক্তারদের সবাই আমার প্রেঙ্কে বন্ধু। সবারই মুখে উদ্বেগ ও বুকে চাঞ্চল্য। তাঁদের সকলের জিগ্গাসা : আজ শেখ সাহেব ময়দানের বক্তৃতায় কি বলিবেন? আমাদের ভাগ্যে কি হইবে? ভাবখানা এই যে আমি যেন সবই জানি। যত বলিলাম আমি তাঁদেরই মত অন্ধকারে ততই তাঁরা সকলে চাপিয়া ধরিলেন। রেডিওলজিস্ট ডাঃ শামসুল হকের বিশাল চেম্বারে বসিলাম। ডাক্তার-ছাত্রদের ভিড়। চা-বিস্কুটের ফরমায়েশ হইয়া গেল। শুধু একা আমি কথা। বলিলাম না। যাঁর-যা অভিজ্ঞতা-অভিমত সবাই বলিলাম। তার মধ্যে ডাঃ ফযলে রাবি সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর সংবাদ দিলেন। তিনি মাত্র ঘন্টা দুই আগে ধানমন্ডি ব্রোগী দেখিতে গিয়াছিলেন। শেখ সাহেবের বাড়ির কাছেই তাঁর রোগী। তিনি দেখিয়া আসিয়াছেন, এক বিশাল জনতা শেখ সাহেবের বাড়ির সামনে ভিড় করিয়াছে। তিনি জানিতে পারিয়াছেন, জনতার পক্ষ হইতে শেখ সাহেবকে বলা হইতেছে, আজকার সভায় স্বাধীনতা ঘোষণার ওয়াদা না করিলে শেখ সাহেবকে বাড়ি হইতে বাহির হইতে দেওয়া হইবে না। ভিড়ের মধ্যে তরুণের সংখ্যাই বেশি, বোধ হয় সব ছাই হইবে। ডাঃ রাবি আরও আশংকা প্রকাশ করিলেন, আজকার সভায় স্বাধীনতার কথা বলা হইলে সামরিক বাহিনী জনতার উপর গুলিবর্ষণ করিবে, এমন গুজব শহরময় ছড়াইয়া পড়িয়াছে। এ অবস্থায় একটা চরম বিপদ ঘটিতে পারে বলিয়া সকলেই আশংকা প্রকাশ করিলেন। এ বিষয়ে আমার মত কি সবাই জানিতে চাহিলেন।
আমি সবাইকে সান্ত্বনা দিবার চেষ্টা করিলাম। আগের রাতে ও সকালে মুজিবের সাথে আমার টেলিফোনে আলাপের কথাটা প্রকাশ না করিয়া যতটুকু বলা যায়, ততটা জোর দিয়া বলিলাম : ‘এমন কিছুই ঘটিবে না। আজকার সভায় শেখ মুজিব ঠিকই উপস্থিত থাকিবেন। দূরদশী দায়িত্বশীল নেতার মতই বক্তৃতা করিবেন। গুলি-গোলার আশংকা তাঁদের অমূলক।’ বলিলাম বটে, কিন্তু আমার নিজের বুক আশংকায় দুরু দুরু করিতে থাকিল। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদার প্রতি সামরিক বাহিনী ও পশ্চিমা নেতাদের অনমনীয় অগণতান্ত্রিক মনোভাব আমাকে সত্যই ভাবাইয়া তুলিয়াছিল। ‘বেলুচিস্তানের খুনী’ বলিয়া মশহুর জেনারেল টিক্কা খান নয়া গবর্নর নিযুক্ত হইয়াছেন। তিনি ঢাকায় পৌঁছাইয়াছেন বা পৌঁছাইতেছেন, খবরটা জানাজানি হইয়া গিয়াছিল। প্রায় বারটার দিকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হইতে বাসায় ফিরিলাম। ফিরিবার পথে দেখিলাম, তখন হইতেই ময়দানে জনতার ভিড় হইতেছে।
ভালয়-ভালয় শেখ সাহেবের সভা হইয়া গেল। আগেই জানাজানি হইয়া গিয়াছিল যে শেখ মুজিবের বক্তৃতা সোজাসুজি সভাস্থল হইতে ব্রডকাস্ট করা হইবে। এ খবর বা ধারণা ভিত্তিহীন ছিল না। আগের দিন ৬ই মার্চ রেডিও-টেলিভিশনের আটিস্টরা বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে এক সভা করিয়া জনগণের এই সংগ্রামে তাঁদের একাত্মতা ঘোষণা করিয়াছিলেন। বেগম শায়লা আর্জুমন্দবান এই সভায় সভানেত্রিত্ব করিয়াছিলেন। কামরুল হাসান, গোলাম মোস্তফা, খান আতাউর রহমান, মোস্তফা যামান আরাসী, আনওয়ার হোসেন, রাযযাক, হাসান ইমাম, ওয়াহিদুল হক, আযিযুল ইসলাম প্রভৃতি অনেক খ্যাতনামা রেডিও টেলিভিশন আটিস্ট মর্মস্পর্শী বক্তৃতা করিয়াছিলেন।
কিন্তু মার্শাল ল কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে সভাস্থল হইতে সে বক্তৃতা ব্রডকাস্ট হইতে পারিল না। তবে সভা-ফেরতা লোকের মুখে শুনিলাম, বিপুল জনতার সমাবেশ হইয়াছিল। শেখ সাহেবও প্রাণখোলা বক্তৃতা করিয়াছেন। একাই। যা আশংকা করা হইয়াছিল তাহয় নাই। শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নাই। কাজেই জেনারেল টিক্কা খানও হাতসাফাই দেখাইতে পারেন নাই।
পরদিনই চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হইল। বেতার কর্মীদর দৃঢ়তায় সরকার নরম হইলেন। পরদিন সকাল আটটায় রেডিওতে ও সন্ধ্যায় টেলিভিশনে শেখ সাহেবের বক্তৃতা শুনিতে ও সভার অপূর্ব দৃশ্য দেখিতে পাইলাম। স্বভাবতঃই ইতিমধ্যে গত পাঁচদিনে উভয় পক্ষের অবিবেচক ও উচ্ছংখল লোকজনের দোষে অনেক খুন-খারাবি হইয়া গিয়াছিল। ফলে সভায় ভীষণ উত্তেজনা। অত উত্তেজনার মধ্যেও শেখ মুজিব জন-নেতার উপযোগী ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা দেখাইয়া বক্তৃতা শেষ করিয়াছেন। অহিংস অসহযোগ চালাইয়া যাইবার বিস্তারিত নির্দেশ দিয়াছেন। রাষ্ট-পরিচালকের আস্থা লইয়াই নির্দেশগুলো উচ্চারণ করিয়াছেন। তাঁর ঐসব আদেশ-নির্দেশ পালিত হইবেই, সামরিক সরকার শত চেষ্টায়ও তাঁর নির্দেশ পালনে জনগণকে বা সরকারী কর্মচারীগণকে বিরত করিতে পারিবেন না, তেমন কর্তৃত্বের আত্মবিশ্বাস শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বরে ফুটিয়া উঠিল। আমি শুধু পুলকিত হইলাম না, আশস্তও হইলাম। এমন অবস্থায় নেতার যে মনোবল ও আত্মবিশ্বাস একান্ত দরকার শেখ মুজিবের তা আছে। কাজেই এদিককার কোনও ভাবনা আমার হইল না।
আমার ভাবনা, শুধু ভাবনা নয়, দুশ্চিন্তা হইল অন্যদিকে। শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আহত পরিষদের সভা আহ্বানকে আওয়ামী লীগের ও জনগণের বিজয়ের কথা বলিলেন না। বিজয়-দিবস উদযাপনের কথাও ঘোষণা করিলেন না। বরঞ্চ পূর্ব প্রকাশিত চার শর্তেরই পুনরাবৃত্তি করিলেন। ঐসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরে পরিষদে যোগ দেওয়ার কথা বিবেচনা করিবেন, সে কথারও পুনরুক্তি করিলেন। সেই একই কথা : শহীদদের মৃতদেহের উপর দিয়া ২৫শে মার্চের পরিষদে যোগ দিতে না পারার কথা। আমার সমস্ত স্বপ্ন ও কল্পনা এক দমকা হাওয়ায় মিলাইয়া গেল। শেখ মুজিবের মত অসাধারণ কাণ্ডজ্ঞানী ও বাস্তববাদী জননেতা পরিষদে যাওয়া-না-যাওয়ার আকাশ-পাতাল প্রভেদটা, দুই এর রাজনৈতিক তাৎপর্যটা এবং সগ্রামের ট্যাকটিক্সের পার্থক্যটা বুঝেন নাই, এটা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হইল না। সংগ্রামের এই সুস্পষ্ট ট্যাকটিক্যাল এডভানটেজটা শেখ মুজিবের মত অভিজ্ঞ সংগ্রামী নেতা না বুঝিয়া শত্রুপক্ষের হাতে তুলিয়া দিতেছেন, এটা আমার মত কিছুতেই মানিয়া লইল না। কাজেই মনে হইল, ডাঃ ফযলে রাবির কথাই ঠিক। তিনি বলিয়াছিলেন : শেখ মুজিবের বাড়ি-ঘেরাও করা চার-পাঁচ হাজার তরুণকে যেভাবে স্বাধীনতা স্বাধীনতা চিৎকার করিতে তিনি দেখিয়া আসিয়াছেন, তাতে শেখ সাহেব নিজের জ্ঞান-বুদ্ধিমত কাজ করিতে পারিবেন বলিয়া তাঁর বিশ্বাস হইতেছিল না। আমি তাঁর কথাটা উড়াইয়া দিয়াছিলাম। এখন বুঝিলাম, ডাঃ রাবির ধারণাই ছিল ঠিক। অসাধারণ ব্যক্তিতশালী মুজিব তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন নাই সত্য, তবে তরুণদের চাপে অন্ততঃ তাদের মন রাখিলেন। শুধুতাদের দেখাইবারউদ্দেশ্যেই পরিষদে যোগনা দিবার ব্যাপারটায় ঐরূপ বীরত্বব্যঞ্জক ব্র্যাভাডা প্রদর্শন করিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার দাবিদার তরুণদের খুশি করিবার জন্য শেখ মুজিব আরো দুইটা কাজ করিলেন। প্রথমতঃ উপসংহারে তিনি বলিলেন : আজিকার সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। দ্বিতীয়তঃ কিছুদিন ধরিয়া তিনি সব বক্তৃতার শেষ করিতেন এক সংগে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় পাকিস্তান’ বলিয়া। এই দিনকার সভায় প্রথম ব্যতিক্রম করিলেন। শুধু ‘জয় বাংলা’ বলিয়া বক্তৃতা শেষ করিলেন। যাঁরা নিজেরা উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন বলিয়া দাবি করেন, তাঁদের কেউ কেউ আমার এই কথার প্রতিবাদ করেন। তাঁরা বলেন, শেখ মুজিব ৭ই মার্চের সভাতেও ‘জয় বাংলা’ ‘জয় পাকিস্তান’ বলিয়া বক্তৃতা শেষ করিয়াছিলেন। আমি যখন বলি যে পরদিন আমি রেডিও-টেলিভিশনে নিজ কানে তাঁর বক্তৃতা শুনিয়াছি এবং তাতে ‘জয় পাকিস্তান’ ছিল না, তার জবাবে তাঁরা বলেন, পরদিন রেকর্ড ব্রডকাস্ট করিবার সময় ঐ কথাটা বাদ দেওয়া হইয়াছিল। যাক আমি নিজ কানে যা শুনিয়াছিলাম, তাই লিখিতেছি। বক্তৃতা শেষ করিয়াই মুজিব সভামঞ্চ ত্যাগ করিলেন। তাজুদ্দিন সাহেব মুহূর্তমাত্ৰ সময় নষ্ট না করিয়া খপ করিয়া মাইকের স্ট্যাণ্ড চাপিয়া ধরিলেন এবং বলিলেন : এইবার মওলানা তর্কবাগীশ মোনাজাত করিবেন। সভার কাজ শেষ। মওলানা সাহেব তখনি মাইকের সামনে দুই হাত তুলিয়া মোনাজাত শুরু করিলেন। সমবেত বিশ-পঁচিশ লক্ষ লোকের চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখ হাত উঠিয়া পড়িল। মোনাজাতের সময় এবং তকবিরের সময় কথা বলিতে নাই। তাই কেউ কথা বলিলেন না। নড়িলেন না। যখন মোনাজাত শেষ হইল, তখন শেখ মুজিব চলিয়া গিয়াছেন। পট করিয়া মইকের লাইন কাটিয়া গিয়াছে। স্পষ্টতঃই বুঝা গেল, আর কেউ কিছু বলিতে না পারুক, এই জন্যই এ ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। এতে এটা নিঃসন্দেহে বোঝা গেল যে তথাকথিত ছাত্রনেতা ও তরুণদের যবরদস্তি ও হুমকি ধমকেও সেদিন শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার ইচ্ছা ছিল না। আমার বিবেচনায় এটা শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতারই প্রমাণ।
৮. পরিষদে যোগ দিলে কি হইত?
কিন্তু এই ঘটনার আর একটা দিক আছে। সে কথা আগেই বলিয়াছি। আরও আলোচনা একটু পরে করিতেছি। এখানে পরিষদে যোগ দেওয়ার ট্যাকটিকাল দিকটারই কথা বলিতেছি। ৬ই মার্চের রাতে ও পরের সকালে টেলিফোনের আলাপে এই দিকটার দিকেই আমি শেখ মুজিবের মনোযোগ আকৰ্ষণ করিয়াছিলাম। আমি বলিয়াছিলাম : তুমি পরিষদে যোগ দাও। প্রথম দিনে স্পিকার, ডিপুটি স্পিকার নির্বাচন কর। এ বিষয়ে এত বিস্তারিত আলোচনা হইয়াছিল যে কাকে স্পিকার করা হইবে, সে সম্বন্ধেও আমি আমার মত জানাইয়াছিলাম। আইউবের অনুকরণে দুইজন ডিপুটি স্পিকার করিতেও বলিয়াছিলাম। এক নম্বর ডিপুটি স্পিকার পশ্চিম পাকিস্তান হইতে ও দুই নম্বর ডিপুটি স্পিকার পূর্ব-পাকিস্তান হইতে (তার অর্থ আওয়ামী লীগার হইতে) নিবার পরামর্শ দিয়াছিলাম। পশ্চিম-পাকিস্তানের কাকে এক নম্বর ডেপুটি স্পিকার করা হইবে, সে সম্বন্ধে ওয়ালী খাঁ ও দণ্ডলতানার মতামত লইতেও বলিয়াছিলাম। এসব খুটিনাটির সবগুলিই ছিল ট্যাকটিকাল পন্থা। কিন্তু আসল কথা ছিল স্ট্রাটেজির সুস্পষ্ট সুবিধার কথা। সে সম্পর্কে আমি বলিয়াছিলাম। স্পিকার-ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের পরেই তুমি লিডার অব-দি-হাউসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইবা। তুমি স্পিকারকে সযোধন করিয়া বলিবা, উভয় পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে একটা সমঝোতা আনার জন্য প্রেসিডেন্ট যে অনুরোধ করিয়াছেন, সে উদ্দেশ্যে স্পিকার মহোদয় যেন সাত দিনের জন্য হাউস মুলতবি করিয়া দেন। তোমার ইশারা-মত স্পিকার তাই করিবেন। তোমরা আলোচনায় বসিবা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপস্থিতিতেই এটা হইতে পারে। আলোচনা সভায় তোমাদের পক্ষের বক্তব্য হইবে।
সংবিধান সম্বন্ধে একমাত্র আওয়ামী লীগেরই ভোটারদের কাছে নির্বাচনী-ওয়াদা আছে। পশ্চিমা কোনও পার্টিরই তেমন কোন ওয়াদা নাই। তাছাড়া নির্বাচনের পরে আওয়ামী-মেম্বররা আল্লাকে হাযির-নাযির জানিয়া জনতার সামনে হলফ লইয়াছেন। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের ছয় দফাঁকে ভিত্তি করিয়াই সংবিধান রচনা করা হউক।
তোমাদের পক্ষের বক্তব্য শুনিয়া পশ্চিমা-নেতারা রাযী হইলে ত ভালই। রাযী হইলেও তোমার কোনও অসুবিধা নাই। সাত দিন পরে আবার পরিষদের বৈঠক বসিবে। প্রথমেই তুমি দাঁড়াইয়া স্পিকারকে বলিবা ও আমাদের আলোচনা সাফল্যের পথে অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছে। আরও একটু সময় দরকার। আরও সাত দিনের জন্য সভা মুলতবি হউক।
যতদিন ইচ্ছা তুমি এমনি করিয়া হাউস মুলতবি করাইবা।
এই পন্থার এভানটেজ এই যে হাউসের উপর প্রেসিডেন্টের কোনও ক্ষমতা থাকিবে না। একক ক্ষমতা থাকিবে স্পিকারের। স্পিকার যতদিন ইচ্ছা এমনিভাবে হাউস চালাইতে থাকিবেন। প্রেসিডেন্ট কিছুই করিতে পারিবেন না, এল, এফ, ও, নির্ধারিত এক’শ বিশ দিনের আগে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অতদিন যাইবে না। তার আগেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াসহ পশ্চিমা নেতারা বলিয়া ফেলিবেন যে, স্ট্র্যাটেজি ও ট্যাকটি উভয়টাতেই পশ্চিমারা তোমার কাছে হারিয়া গিয়াছেন। তোমার কথামত শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করিতে তাঁদের অধিকাংশই রাযী হইবেন। তা নাও যদি হয়, তবু যে ডেডল সৃষ্টি হইবে, তাতেও তোমার জয় হইবে।
আমার ধারণা ছিল, মুজিব আমার যুক্তির সারবত্তা মানিয়া লইয়াছেন। তিনি সেমতেই কাজ করিবেন। কিন্তু ৭ই মার্চের বক্তৃতায় আমি নিরাশ হইয়াছিলাম। তবু আশা ছাড়ি নাই। পরবর্তী এক ঘোষণায় শেখ মুজিব বলিয়াছিলেন, তিনি মওলানা ভাসানী, জনাব আতাউর রহমান খাঁ ও অধ্যাপক মুযাফফর আহমদের সংগে আলোচনা করিবেন। কথা শুনামাত্র ন্যাপ নেতাদেক্সে জানাইলাম, আতাউর রহমান খা সাহেবকে নিজে বলিলাম, শেখ মুজিবের সংগে আলাপ করিতে। আতাউর রহমান সাহেব বলিলেন : যদিও এ ঘোষণা খবরের কাগয়ে পড়া ছাড়া আর কিছুই তিনি জানেন না, মানে শেখ মুজিব তাঁকে টেলিফোনেও অনুরোধ করেন নাই, তবু তিনি যাইবেন এবং যাতে মওলানা সাহেব ও মুযাফফর সাহেবও যান, তার চেষ্টাও তিনি করিতেছেন। আমি আতাউর রহমান সাহেবকে মুজিবের বরাবরে আমার উপদেশের কথা বলিলাম এবং তিনিও যাতে শেখ সাহেবকে অমন পরামর্শ দেন, সেজন্য তাঁকে অনুরোধ করিলাম। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় আসিবার আগেই যাতে এটা হয়, তারও আবশ্যকতা আতাউর রহমান সাহেবকে বুঝাইলাম।
তিনি রাযী হইলেন। একরূপ নিজেই উদ্যোগী হইয়া শেখ মুজিবের সাথে দেখা করিলেন। সেখান হইতে তিনি সোজা আমার বাসায় আসিলেন। তাঁদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হইয়াছে। সে আলোচনায় আমার মত পরামর্শ তিনিও দিয়াছেন। বরঞ্চ আরো বেশি দৃঢ়তার সংগে আরো অগ্রসর পরামর্শ তিনি দিয়াছেন। তাঁর পরামর্শ ও যুক্তি মোটামুটি আমারই মত হইয়াছে। তবে তিনি আরও একটু আগাইয়া বলিয়াছেন যে, নিজের মেজরিটির জোরেই ছয়-দফা ভিত্তিক একটি সংবিধান রচনা করিয়া ফেলাই শেখ মুজিবের উচিৎ। মোট কথা পরিষদ বয়কট করার তিনি বিরোধী, দৃঢ়তার সংগে সে কথা তিনি শেখ মুজিবকে বলিয়া দিয়া আসিয়াছেন।
সুতরাং দেখা গেল, আমরা যাঁরা শেখ মুজিবকে পরামর্শ দিবার দাবি রাখি, দায়িত্বও আছে এবং যাঁদের পরামর্শের দাম আছে বলিয়া আওয়ামী লীগের ও জনগণের অনেকে মনে করেন, তাঁদের অনেকেনা হউক, কেউ-কেউ আমরা মুজিবকে পরিষদে যোগ দিবার পরামর্শ দিয়াছিলাম এবং সেটা দিয়াছিলাম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সংগে তাঁর সাক্ষাৎ হইবার আগেই। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা আসেন ১৫ই মার্চ এবং ঐ দিন হইতে অন্ততঃ ২৪শে মার্চ পর্যন্ত পুরা দশ দিন শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে কথাবার্তা হয়। এ কথাবার্তার বিষয়ে পরে আলোচনা করিব। এখানে ও-কথাটার উল্লেখ করিলাম এই জন্য যে আমাদের পরামর্শ রাখিবার হইলে সে সুযোগ শেখ মুজিবের প্রচুর ছিল। তবু যে শেখ মুজিব আমাদের পরামর্শমত কাজ করেন নাই, তার অনেক কারণ থাকিতে পারে। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যা তখনও ছিল, আজও আছে, তা এই যে, শেখ মুজিব চাপে পড়িয়াই আমাদের পরামর্শমত কাজ করিতে পারেন নাই। যা হোক, পরিষদে যোগ না দেওয়াটা, আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায়, শেখ মুজিবের একটা মস্তবড় ভুল। এ ভুলের দমই ২৫শে মার্চের নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটিয়াছিল। অন্যথায় তা ঘটিত না। ব্যাপার অন্যরূপ হইত। তাতেও শেখ মুজিবেরই জয়হইত।
৯. অপর দিক
এ সমস্ত ব্যাপারটারই অন্য একটা দিক আছে, সে কথাও আগেই বলিয়াছি। সে দিকটারই আলোচনা এখন করা যাউক।
আমি যেমন মনে করি, ৭ই মার্চের সভায় শেখ মুজিব ভুল করিয়াছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পরিষদ ডাকার ব্যাপারটার সুযোগ গ্রহণ না করিয়া, তেমনি একশ্রেণীর লোক আছেন যাঁরা মনে করেন, ৭ই মার্চে শেখ মুজিব ভুল করিয়াছিলেন ঐ দিন স্বাধীনতা ঘোষণা না করিয়া। এদের কেউ কেউ কাগযে-কলমে সে কথা বলিয়াছেন, অনেকে আমার সাথে তর্কও করিয়াছেন। তাঁদের মত এই যে, শেখ মুজিব যদি ৭ই মার্চের ঘোড়-দৌড়-ময়দানের পঁচিশ লাখ লোকের সমাবেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া গবর্নর হাউস, রেডিও স্টেশন ও ক্যান্টনমেন্ট দখল করিতে অগ্রসর হইতেন, তবে একরূপ বিনা-রক্তপাতে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করিতে পারিতেন। তাতে পরবর্তী কালের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ও নয় মাসের যুদ্ধ, তাতে ভারতের সাহায্য, এসব কিছুরই দরকার হইত না।
এই মতের আমি দৃঢ়তার সংগে প্রতিবাদ করি। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায়, এ ধরনের কথা যাঁরা বলেন অথবা চিন্তা যাঁরা করেন, তাঁদের রাজনীতি বা সমরনীতির কোনও অভিজ্ঞতা নাই। তাঁরা বড় জোর থিওরিস্ট মাত্র। ৭ই মার্চের সভায় স্বাধীনতা ঘোষণাটা না করিয়া মুজিব কত বড় দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়াছিলেন, সেটা বুঝিবার মত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ঐসব থিওরিস্টের নাই। এ সম্পর্কে অনেক কথাই বলা যায়। সে সব কথারই মোটামুটি দুইটা দিক আছে। ৭ই মার্চ শেখ মুজিবের সামনে সে দুইটা দিকই সমান জোরে উপস্থিত ছিল। এক, যুক্তির দিক। দুই, বাস্তব দিক। সংক্ষেপে এই দুইটা দিক সম্বন্ধেই বলা চলে, কোন দিক হইতেই ৭ই মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করা সমীচীন হইত না। যুক্তির দিক হইতে হইত না এই জন্য যে, প্রেসিডেন্টের পক্ষে বেআইনীভাবে পরিষদের বৈঠক বাতিল করাটাই স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষে যথেষ্ট কারণ ছিল না। আর বাস্তবতার দিক হইতে এটা সমীচীন হইত না এই জন্য যে তাতে সভায় সমবেত বিশ লাখ নিরস্ত্র জনতাকে সংগীন উঁচা-করা সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর গুলির মুখে ঠেলিয়া দেওয়া হইত। তাতে নিরস্ত্র জনতাকে জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বহুগুণে বিপুল নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের শিকার বানানো হইত। হত্যাকাস্ত্রে বাদেও যেসব নেতা বাঁচিয়া থাকিতেন, তাঁদেরে গ্রেফতার করা হইত। বিচারও একটা হইত। তার ফলও জানা কথা। ফলে স্বাধীনতার বা অটোনমির আন্দোলন বহুদিনের জন্য চাপা পড়িত। পূর্ব-পাকিস্তান বা বাংলাদেশের পক্ষে সেটাই হইত অনেক বেশি গুরুতর লোকসান।
অতএব, ৭ই মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা না করিয়া শেখ মুজিব যোগ্য জননেতার কাজই করিয়াছেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। রাজনীতির দিক হইতেও শেখ মুজিবের এই আচরণ যে নির্ভুল হইয়াছিল এবং জনগণের সমর্থন পাইয়াছিল, তার বড় প্রমাণ এই যে অসহযোগ আন্দোলন তাতে স্তিমিত না হইয়া বরঞ্চ আরও জোরদার হইয়াছিল। স্বাধীনতা ঘোষণা না করিয়াও শেখ মুজিব কার্যতঃ পরবর্তী আঠার দিন স্বাধীন পূর্ব-পাকিস্তানের শাসন-তার হাতে পাইয়াছিলেন। স্টেট ব্যাংকসহ সবগুলি ব্যাংক, টেলি, পোস্ট অফিস সবই শেখ মুজিবের ডাইরেকটিভ-মত চলিয়াছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের কোন দখল বা আধিপত্যই তখন ছিল না। রাজনীতির অবস্থাও তাই ছিল। ১ই মার্চ মওলানা ভাসানী ও আতাউর রহমান খাঁ পল্টন ময়দানে এক জনসভায় আওয়ামী লীগ দাবির সমর্থন করেন। ইয়াহিয়া ও পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতাদের শেখ মুজিবের সাথে আপোস করিতে উপদেশ দেন। মুজিবের দাবি লাহোর-প্রস্তাব-ভিত্তিক, এ কথাও তাঁরা স্মরণ করাইয়া দেন। উভয় নেতাই পশ্চিমা-নেতৃবৃন্দ ও কেন্দ্রীয় সরকারকে বলেন : শেখ মুজিবকে আপনারা অবিশ্বাস বা উপেক্ষা করিবেন না। পূর্ব-পাকিস্তানের গোটা জনতাই মুজিবের পিছনে।
প্রশাসনিক পর্যায়ে চিফ সেক্রেটারি মিঃ শফিউল আযমের সভাপতিত্বে ১২ই মার্চ সি. এস. পি, এসোসিয়েশন ও ই. পি. সি. এস. পি. এসোসিয়েশনের যুক্ত বৈঠকে আওয়ামী লীগের দাবি ও আন্দোলনের সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হয়।
বিচার বিভাগেরও সেই কথা। ঢাকা হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস মিঃ বদরুদ্দিন সিদ্দিকী নব-নিযুক্ত গবর্নর লেঃ জেনারেল টিক্কা খানকে হলফু পড়াইতে অস্বীকৃতি জানাইয়া ইতিহাস সৃষ্টি করেন। এইভাবে মুজিবের জয় সর্বাত্মক ও পরিপূর্ণ হয়।