৩২.০৭ নৌকার হাইলে মুজিব

নৌকার হাইলে মুজিব
উপাধ্যায় সাত

১. শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তন

আমাদের স্বাধীনতা হাসিলের ঠিক পঁচিশ  দিন পরে আমাদের নেতা শেখ মুজিব ১০ই জানুয়ারি দেশে ফিরেন। বিপুল জনতা তাঁকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা দেয়। গোটা দেশ আনন্দ-উল্লাসে ফাটিয়া পড়ে।

যদিও বিগত এক সপ্তাহ ধরিয়াই আমরা শেখ মুজিবের মুক্তির খবর শুনিবার আশায় প্রবল আগ্রহে অপেক্ষা করিতেছিলাম,কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই মুক্তির খবরটা। একেবারে দুশ্চিন্তামুক্ত ছিল না। মুজিবের মুক্তির খবরটা কতকটা রহস্যাবৃত হইয়া উঠিল। আমরা খবর পাইলাম, প্রত্যাশিত মুক্তি-দিবসের আগের দিন ভারত সরকার মুজিবকে আনিবার জন্য রেডক্রসের একটি বিমান তাড়া করিয়া পিভি এয়ারপোর্টে হাযির রাখিয়াছেন। অথচ শেখ মুজিব ৮ই জানুয়ারি সে বিমানে না চড়িয়া পি, আই, এ.-এর একটি বিশেষ বিমানে চড়িয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছেন। তিনি কোথায় গিয়াছেন কেউ জানেন না। রেডিও পাকিস্তানের খবরানুসারে প্রেসিডেন্ট ভুট্টোও মুজিবের গন্তব্যস্থান সম্বন্ধে কিছু বলেন নাই। তিনি নিজে এয়ারপোর্টে উপস্থিত থাকিয়া পি, আই. এ. বিমানে মুজিবকে তুলিয়া দিয়াছেন। অথচ শেখ মুজিবকে কোথায় নেওয়া হইতেছে, তা তিনি বলেন নাই। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি রসিকতা করিয়া বলিয়াছেন : পিঞ্জরার পাখী উড়িয়া গিয়াছে। সাংবাদিকদের পীড়াপীড়িতে অবশেষে মিঃ ভূট্টো বলিলেন : শেখ মুজিবের অনুরোধেই তাঁর গন্তব্যস্থান গোপন রাখা হইতেছে। গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়া তিনি নিজেই সে কথা বলিবেন। মিঃ ভুট্টোর এ ঘোষণায় ঢাকায় আমরা কোনও তসল্লি পাইলাম না। ভুট্টোর বিরুদ্ধে আমাদের আক্রোশ তখনও একেবারে তাজা। আমাদের দুঃখ-দুর্দশার জন্য ইয়াহিয়ার চেয়ে ভুট্টোর অপরাধ এক রত্তি কম নয়, এ কথা আমরা তখনও ভুলি নাই। অতএব সেই ভুট্টো আমাদের নেতার জীবন লইয়া আবার কোন খেলা শুরু করিয়াছেন, তা ভাবিয়া আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইলাম। মাত্র এক রাত্রি আমাদের দুশ্চিন্তায় কাটিল। ৯ই জানুয়ারি আমরা বিভিন্ন রেডিও মারফত জানিলাম শেখ মুজিব পি. আই. এ. বিমানে চড়িয়া লন্ডনে পৌঁছিয়াছেন। এ সংবাদে আমরা মুজিবের মুক্তি ও নিরাপত্তা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইলাম বটে, কিন্তু আরেকটা চিন্তা আমাদেরে ভাবনায় ফেলিল। ভারতের ভাড়া-কা রেডক্রস বিমানে না চড়িয়া এবং সোজা ঢাকায় না আসিয়া পি, আই. এ. বিমানে চড়িয়া লন্ডন গেলেন কেন? ভারতের সংগে মন-কষাকষি ও ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এটা মিঃ ভুট্টোর একটা চাল বলিয়া আমাদের সন্দেহ হইল। শেষ পর্যন্ত আমাদের সে সন্দেহও দূর হইল। শেখ মুজিব বৃটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের বিমানে চড়িয়া দিল্লি হইয়া ১০ই জানুয়ারি ঢাকা পৌঁছিলেন। দিল্লিতে ভারত সরকার তাঁর বিপুল অভ্যর্থনার আয়োজন করেন। আমাদের আশংকা তখনকার মত দূর হয়। পরে জালিয়াছিলাম, আমাদের আশংকা নিতান্ত ভিত্তিহীন ছিল না। এ ধরনের কিছুটা চেষ্টা হইয়াছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের, বিশেষতঃ তৎকালীন রাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুস সামাদ আযাদের চেষ্টায় সবই ভালয়-ভালয় সমাধা হইয়া যায়।

. মুজিবের উপস্থিতির আশু কল

 যা হোক, শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তনের ফল ফলিতে লাগিল। প্রায় পাঁচ লাখ লোকের বিশাল জনতা সুহরাওয়ার্দী ময়দানে নেতার মুখের কথা শুনিবার জন্য আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করিতেছিল। শেখ মুজিব এয়ারপোর্ট হইতে সোজা সুহরাওয়ার্দী ময়দানে গিয়া জনসভায় বক্তৃতা করেন। বরাবরের ওজস্বী বাগ্মী শেখ মুজিব। সে হিসাবে ঐদিনকার বক্তৃতা তেমন ভাল হয় নাই। সেকথা তিনি নিজেই বুঝিয়াছিলেন। কিন্তু সদ্য-স্বাধীনতাপ্রাপ্ত নতুন রাষ্ট্রের পথনির্দেশক হিসাবে শেখ মুজিবের সেদিনকার বক্তৃতা অতিশয় মূল্যবান ও ঐতিহাসিক ছিল। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে, তাঁর স্থলবর্তী হইবার যোগ্য প্রবীণ নেতৃত্বের অবর্তমানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তাৎপর্য আওয়ামী তরুণ নেতাদের কাছে সুস্পষ্ট ছিল না। ছয় দফা মেনিফেস্টোর ভিত্তিতে নির্বাচন বিজয়ী আওয়ামী নেতৃত্বের এই বিভ্রান্তিকর কারণ পরে যথাস্থানে আলোচনা করিব। এখানে শুধু এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে একটা বিভ্রান্তি সত্যই সৃষ্টি হইয়াছিল। সে বিভ্রান্তি পাকিস্তানের পরিণাম, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জাতীয় স্বকীয়তা, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি সকল ব্যাপারে পরিব্যাপ্ত ছিল। ফলে তাদের মধ্যে এমন ধারণাও সৃষ্টি ইয়াছিল যে, নিজেদের মুসলমান ও নিজেদের রাষ্ট্রকে ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ বলিলে সাধারণভাবে হিন্দুরা বিশেষভাবে ভারত সরকার অসন্তুষ্ট হইবেন। এ ধারণা যে সত্য ছিল না, তা বুঝিতে যে রাজনৈতিক চেতনা ও অভিজ্ঞতা থাকা দরকার, তরুণ আওয়ামী নেতা মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেরই তা ছিল না। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম বাংলাদেশকে ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ আখ্যা দিয়া যে সদিচ্ছা প্রণোদিত প্রশংসা করিয়াছিলেন, অতিউৎসাহী ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ একজন অফিসার সে প্রশংসা প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন এই হীনমন্যতা হইতেই। আমাদের রেডিও-টেলিভিশন হইতে কোরআন তেলাওয়াত আসোলামু আলায়কুম ও খোদা হাফেয বিতাড়িত হইয়াছিল এবং ও সবের স্থান দখল করিয়াছিল ‘সুপ্রভাত’ ‘শুভসন্ধা’ ও ‘শুভরাত্রি’ এই কারণেই। বাংলাদেশের জনসাধারণ আমাদের স্বাধীনতার এই রূপ দেখিয়া চমকিয়া উঠিয়াছিল এমন পরিবেশেই।

শেখ মুজিকে প্রত্যাবর্তন এক মুহূর্তে এই কুয়াশা দূর করিয়া দিয়াছিল। ১০ই জানুয়ারির ঐ একটি মাত্র বক্তৃতার তুফানে বাংলাদেশের আসমান হইতে ঐ বিভ্রান্তিকর কালমেঘ মিলাইয়া গিয়াছিল। শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আম্রোজনীয় ঘোষণা করিয়াছিলেন : (১) আমি মুসলমান আমার বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র (২) আমাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আমি মিঃ ভূট্টার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু সে কৃতজ্ঞতার দরুন আমি দুই অঞ্চল মিলিয়া এক পাকিস্তান রাখিবার তার অনুরোধ রাখিতে পারিলাম না। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রই থাকিবে (৩) তাদের সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের জনগণের উপর যে অকথ্য যুলুম করিয়াছে, দুনিয়ার ইতিহাসে তার তুলনা নাই। তবু বাংগালী জাতি তাদের ক্ষমা করিয়া প্রমাণ করিবে, বাংগালী জাতি কত উদার। আমি মিঃ ভুট্টোর সাফল্য কামনা করি। তিনি আমাদের সাফল্য কামনা করুন। তাঁরা সুখে থাকুন, আমাদের সুখে থাকিতে দিন।

শেখ মুজিবের এই তিনটি ঘোষণাই জনগণের অন্তরের কথা ছিল। বিপুল হর্ষধ্বনি করিয়া সেই বিশাল জনতা শেখ মুজিবের উক্তি সমর্থন করিয়াছিল। উপ-নেতা ও কর্মচারীরা না জানিলেও নেতা জানিতেন ও জনগণ বুঝিতেন, বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র নয় বটে কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্র।

চিন্তার বিভ্রান্তি এইভাবে দূর হইবার অল্পদিনের মধ্যে কাজের বিভ্রান্তির অবসান করিলেন মুজিব নেতৃত্ব। রেডিও-টেলিভিশনে আবার কোরআন তেলাওয়াত, আস্সালামু আলায়কুম, খোদা হাফেয বহাল হইল। ধর্ম ও জীবন সম্পর্কে কোরআন-হাদিস-ভিত্তিক সাপ্তাহিক আলোচনা আবার শুরু হইল। সরকারী ফাংশনেও মিলাদ-মহফিল হইতে লাগিল। জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল।

শেখ মুজিবের দক্ষ সুনিপূণ ডিপ্লোমেটিক কৌশলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যেকার ভুল বুঝাবুঝির একটা মুনাসিব সুরাহা হইয়া গেল। এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন সমাপ্ত হইবার বহু আগেই দুই মাসের মধ্যে ১২ ই মার্চ তারিখে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের মাটি হইতে সরিয়া গেল। ভারত-বাংলাদেশ-মৈত্রীর বিরুদ্ধে প্রচারণার একটা আন্তর্জাতিক ফাঁড়া কাটিয়া গেল।

. পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা প্রবর্তন

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমদ আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী ছিলেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এইভাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ধারা মানিয়া চলাতে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর অনুপস্থিতিতেই বাংলাদেশ সরকারেরও প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার ক্যাবিনেট প্রথার না প্রেসিডেন্ট শিয়াল প্রথার সরকার ছিলেন, তা বুঝিবার উপায়ও ছিল না; দরকারও ছিল না। সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকিলেই তা যেমন ক্যাবিনেট সরকার হয় নাঃ আবার প্রেসিডেন্ট কোনও সরকারী আদেশ-নির্দেশ দিলেই তা প্রেসিডেশিয়াল হইয়া যায় না।বিশেষতঃ যুদ্ধ চলাকালে, যখন পার্লামেন্টে বসিবার সুযোগ-সুবিধা নাই, তখন সরকারের সাংবিধানিক চরিত্র লইয়া চিন্তা করিবার দরকার বা সুযোগ ছিল না।

স্বাধীনতার দিন দশেক পরে সরকার ঢাকায় আসিয়া কোনও কাজ শুরু করিবার আগেই পনর দিনের মধ্যে শেখ মুজিব ঢাকায় আসেন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসাবেই। এই সময়েই বাংলাদেশ সরকারের শাসনতান্ত্রিক চরিত্র নির্ধারণের সুযোগ আসে। শেখ মুজিব কালবিলম্ব না করিয়া দিন-পাঁচেকে মধ্যেই ১৪ই জানুয়ারী তারিখে নিজে প্রেসিডেন্ট পদ ত্যাগ করিয়া প্রধানমন্ত্রী হন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে আইনমাফিক প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেন। গোটা দেশবাসী আনন্দে উল্লসিত হয়। পার্লামেন্টারি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যও, উভয় পদাধিকারীর ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা ও যোগ্যতার বিচারেও নয়া রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য দুই ব্যক্তির চেয়ে যোগ্যতর পদাধিকারী কল্পনা করা যাইত না। শেখ মুজিবের অভিপ্রায় অনুসারেই এটা ঘটিয়াছে, জনগণের মধ্যেও সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। আওয়ামী লীগ বরাবর পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সমর্থক, তার ছয় দফা মেনিফেস্টো অনুসারে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার গঠন করিতে শেখ মুজিব বাধ্য ছিলেন, এ সব যুক্তি দিয়া শেখ মুজিবের ঐ পদক্ষেপকে ছোট করার উপায় ছিল না। কারণ শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে একদল তরুণের মধ্যে এই অভিমত খুবই সোঙ্গার হইয়া উঠিয়াছিল যে, বাংলাদেশের এই সরকার বিপ্লবী সরকার। পাকিস্তানী আমলের নির্বাচনও সে নির্বাচনের মেনিফেস্টো বর্তমান সরকারের জন্য প্রাসংগিকও নয়, বাধ্যকরও নয়। এ ধরনের কথা যাঁরা বলিতেছিলেন তাঁরা অধিকাংশই তথাকথিত বামপন্থী। ৭০ সালের নির্বাচনে তাঁরা একটি আসনও দখল করিতে না পারায় একরূপ নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা-সংগ্রামে তাঁদের যথেষ্ট অবদান ছিল। মুক্তি বাহিনীতে তাঁদের জোর ছিল। কাজেই তাঁদের মনে আশা হইয়াছিল, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে যে নতুন সরকার গঠিত হইবে, তাতে অংশ পাইবার অধিকারও তাঁদের আছে। পাকিস্তানী আমলের নির্বাচনের অধ্যায়টা আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস হইতে মুছিয়া ফেলিতে পারিলেই এটা সম্ভব। এতে এক ঢিলে দুই পাখী মারা হইয়া যাইবে। এক, বামপন্থীরা সরকারের অংশীদার হইতে পারিবেন। দুই, পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সম্ভাবনারও অবসান হইবে। একমাত্র বিপ্লবী সরকারের স্লোগানের মাধ্যমেই এটা সম্ভব ছিল। কিন্তু যতই বিপ্লবী সরকার বলা হোক শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ছাড়া কোন সরকার পরিচালনই সম্ভব ছিল না। কাজেই ঐ ‘বিপ্লবী’দের দাবি ছিল, শেখ মুজিবকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়া একটি বিপ্লবী সরকার গঠিত হউক।

সর্বময় ক্ষমতার লোভে অনেক রাজনৈতিক নেতারই মাথা ঠিক থাকে না। শেখ মুজিব যদি পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের ট্রেনিং প্রাপ্ত নেতা না হইতেন, তিনি যদি পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে অগাধ বিশ্বাসী না হইতেন, তবে ঐ বিপ্লবীদের লোভনীয় প্রস্তাবের ফাঁদে পা দিতেন। কিন্তু শেখ মুজিব সে ফাঁদে পা দিলেন না। অথরিটারিয়ানিয়মের ক্ষমতা-লোভের সামনেও তিনি মাথা ঠিক রাখিলেন। বরঞ্চ সাবধান হইলেন। অতি ক্ষিপ্রতার সাথে তিনি বিচারপতি আবু সাঈদের মত একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজ্ঞ ও পন্ডিত ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট করিয়া নিজে প্রধান মন্ত্রিত্বে নামিয়া আসিয়া সহকর্মী বিপ্লবীদেরে, দেশবাসীকে এবং বিশ্ববাসীকে জানাইয়া দিলেন, তিনি বাংলাদেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করিতে চান, আর কোনও গণতন্ত্র নয়। আর নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরেও তিনি সত্যি-সত্যি সরেন পার্লামেন্ট রূপেই স্থাপিত করিতে চান, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরে তা দেখাইবার জন্য সর্বাপেক্ষা অভিজ্ঞ শ্রদ্ধেয় ও আদর্শবাদী প্রবীণ নেতা শাহ আবদুল হামিদ সাহেবকে স্পিকার ও দীর্ঘদিনের সহকর্মী, নিষ্ঠাবান ও চরিত্রবান আওয়ামী লীগার মোহাম্মদ উল্লাকে ডিপুটি স্পিকার নিয়োগ করাইলেন। প্রতিভাবান উচ্চশিক্ষিত নির্বাচিত সহকর্মীদের লইয়া তিনি একটি মর্যাদাবান মন্ত্রিসভা গঠন করিলেন।

৪. চাঁদে কলংক

কিন্তু অকস্মাৎ ২৪ শে জানুয়ারি আমাদের রাজনৈতিক চাঁদে কলংক দেখা দিল। কলংক ত নয়, একেবারে রাহু। সে রাতে চাঁদ দ্বিখন্ডিত হইল। রাহু দুইটি। প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডার নম্বর ৮ ও ৯ একটার নাম দালাল আইন। আরেকটার নাম সরকারী চাকুরি আইন। উভয়টাই সর্বগ্রাসী ও মারাত্মক। একটা গোটা জাতিকে, অপরটা গোটা প্রশাসনকে দ্বিখন্ডিত করিয়াছে। দুইটাই রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষতি করিয়াছে। সে সবের প্রতিকার দুঃসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। অথচ এ দুইটা পদক্ষেপই ছিল সম্পূর্ণ অনাবশ্যক।

সব দমননীতি-মূলক আইনের মতই দালাল আইনের ফাঁক ছিল নির্বিচারে অপপ্রয়োগের। হইয়াও ছিল দেদার অপপ্রয়োগ। ফলে নির্যাতন চলিয়াছে বেএন্তেহা। যে আওয়ামী লীগ নীতিতঃই নিবর্তনমূলক আইনের বিরোধী, একজন লোককেও বিনা বিচারে একদিনও আটক না রাখিয়া দেশ শাসন যে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য, সেই আওয়ামী লীগেরই স্বাধীন আমলে অল্পদিনের মধ্যেই ত্রিশ-চল্লিশ হাজার নাগরিক গ্রেফতার হইয়াছেন এবং বিনা বিচারের প্রায় দুই বছর কাল আটক আছেন। বেশী না হইলেও প্রায় সমসংখ্যক লোক বাড়ি-ঘর ছাড়িয়া ভিন্ন-ভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করিয়া বেড়াইতেছেন। গ্রেফতারিত ব্যক্তিরা যামিনাদি ব্যাপারে আদালত সুবিধা পাইতেছে না। অতি অল্পসংখ্যক লোক ছাড়া কারো বিরুদ্ধে চার্জশীট হইতেছে না। এমনকি, তদন্তও শেষ হয় নাই। এই সবই সর্বাত্মক দমন আইনের উলংগ রূপ ও চরম অপপ্রয়োগ।

তবু এটাই এ আইনের চরম মারাত্মক রূপ নয়। নাগরিকদের ব্যক্তিগত তোগান্তি ছাড়াও এ আইনের একটা জাতীয় মারাত্মক দিক আছে। এই আইন গোটা জাতিকে ‘দেশপ্রেমিক’ ও ‘দেশদ্রোহী’ এই দুই ভাগে বিভক্ত করিয়াছে। অথচ দেশবাসীর চরিত্র তা নয়। ১০ই জানুয়ারি শেখ মুজিব যখন দেশে ফিরেন, তখন তিনি কোনও দলের নেতা ছিলেন না। নেতা ছিলেন তিনি গোটা জাতির। তাঁর নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হইয়া মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা আনিয়াছিলেন সেটা কোন দল বা শ্রেণীর স্বাধীনতা ছিল না। সে স্বাধীনতা ছিল দেশবাসীর সকলের ও প্রত্যেকের। এমন কি, যাঁরা স্বাধীনতার বিরোধিতা করিয়াছিলেন তাঁদেরও। সব দেশের স্বাধীনতা লাভের ফল ভাই। ভারতের স্বাধীনতা অনিয়াছিলেন কংগ্রেস অনেকেই তার বিরোধিতা করিয়াছিলেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা আনিয়াছিলেন মুসলিম লীগ। অনেকেই তার বিরোধিতা করিয়াছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর সবাই সে স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করিতেছেন। স্বাধীনতার বিরোধিতা করার অপরাধে কাউকে শাস্তি ভোগ করিতে হয় নাই। কোনও দেশেই তা হয় না। কারণ স্বাধীনতার আগে ওটা থাকে রাজনৈতিক মতভেদ। শুধু স্বাধীনতা লাভের পরেই হয় ওটা দেশপ্রেম ও দেশদ্রোহিতার প্রশ্ন। সব স্বাধীনতা সংগ্রামের বেলাই এটা সত্য। বাংলাদেশের ব্যাপারে এটা আরও বেশি সত্য। বাংলাদেশের সংগ্রাম শুরু হয় নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়, নির্বাচনের মাধ্যমে। সে নির্বাচনে স্বাধীনতা নির্বাচনী ইশ্যু ছিল না। আওয়ামী লীগও অন্যান্য পার্টির মতই পাকিস্তান-ভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচীর ভিত্তিতে নির্বাচন লড়িয়াছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক বিজয়ী হয়। পাকিস্তানের সামরিক সরকার সে নির্বাচন না মানিয়া তলওয়ারের জোরে পূর্ব-পাকিস্তানীদেরে শিখাইতে চায়। তখনই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। এ সংগ্রামের জন্য আওয়ামী লীগ প্রস্তুত ছিল না। অন্য সব দল ত নয়-ই। এই সশস্ত্র সংগ্রাম অন্যান্য দেশের মত দীর্ঘস্থায়ী হয় নাই। ন মাসেরও কম সময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। এটা সম্ভব হইয়াছিল শুধুমাত্র ভারতের সামরিক সহায়তায়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম যদি দীর্ঘস্থায়ী হইত, তবে সংগ্রাম চলিতে থাকা অবস্থায় দলীয় স্তরেও আমাদের ঐক্য সাধিত হইয়া যাইত। মাত্র ন মাসের যুদ্ধেই আমাদের দেশবাসী জনগণের স্তরে ঐক্যবদ্ধ হইয়া গিয়াছিল, আমি ‘জন-যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদে তা আগেই বলিয়াছি। জনগণের সে ঐক্য নেতৃস্তরেও প্রসারিত হইত, তাতে কোনও সন্দেহ নাই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ অল্পদিনেই শেষ হইয়া যাওয়ায় সকল দলের জাতীয় স্তরে সেটা দানা বাঁধতে পারে নাই। ৭০ সালের নির্বাচনের সময়ে যে নেতার বা পার্টির যে মতই থাকুক না কেন, ২৫শে মার্চের পরবর্তী নৃশংসতার পরে নিশ্চয়ই সে মত বলিয়াছিল। প্রমাণ, নির্বাচনের আগে পর্যন্তও যে-সব বড় বড় নেতা বরাবর আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করিয়াছেন, এবং যাঁদের অনেকেই দালালি আইনে আটক হইয়াছেন, তাঁদের বেশীর ভাগেরই পুত্র-নাতিসহ পরিবারের লোকেরা মুক্তি যোদ্ধাদের সহযোগিতা করিয়াছেন। মত ও মনের এই পরিবর্তন সর্বাত্মক ও সর্বজনীন হয় কালক্রমে। রাষ্ট্র নায়কের উচিৎ বিরোধীদেরে সে সময় দেওয়া।

১০ই জানুয়ারির বক্তৃতার জের টানিয়া শেখ মুজিব যদি বলিতেন : স্বাধীনতার আগে আপনাদের যাঁর যে মতই থাকুক না কেন, আজ স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার কাজে সবাই আমাকে সহায়তা করুন। এ স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব গোটা দেশবাসীর। কারণ এ স্বাধীনতা তাদের সকলের, তবে আমার জ্ঞান ও বিশ্বাস, সকল দলের নেতারা শেখ মুজিবের পিছনে আসিয়া দাঁড়াইতেন।

তা না করিয়া যে পদক্ষেপ নেওয়া হইল, তার ফল হইল বিরূপ। ১০ই জানুয়ারি যেখানে শেখ মুজিবের বিরোধী একজনও ছিলেন না, কয়েক দিনের মধ্যে সেখানে চল্লিশ হাজার লোক তাঁর বিরোধী হইলেন। কয়েক মাস পরে চল্লিশ হাজার বাড়িয়া চল্লিশ লাখ হইল। তাঁদের বিরোধিতা সক্রিয় না হইলেও ক্রিয়াশীল হইল। নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থায় ফাটল ধরিল। আনাস্থা হইতে সন্দেহ, সন্দেহ হইতে অবিশ্বাস, অবিশ্বাস হইতে শত্রুতা পয়দা হইল। পল্লী গ্রামের স্বাভাবিক সামাজিক নেতৃত্ব যে আলেম সমাজ ও মাতর শ্রেণী, তাঁদের প্রভাব তছনছ হইয়া গেল। ছাত্র-তরুণদের উপর শিক্ষক-অধ্যাপকদের আধিপত্যের অবসান ঘটিল। সে সামগ্রিক সন্দেহ, দলাদলি ও অবিশ্বাসের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রত্যর্পণ ব্যাহত হইল। দেশের আইন শৃংখলার প্রতি কারো শ্রদ্ধা থাকিল না। স্বভাব-দুস্কৃতিকারীরা এর সুযোগ গ্রহণ করিল। সে সার্বজনীন অশান্তি ও বিশৃংখলা পুলিশ বাহিনীর আওতার বাহিরে চলিয়া গেল।

তারপর প্রায় দুই বছর পরে যখন সরকার তথাকথিত দালালদেরে ক্ষমা করিলেন, তখন সে ক্ষমায় মহত্ত্ব ত থাকিলই না, দুই বছরের তিক্ততায় তা রাষ্ট্রের কোনও কল্যাণেই লাগিল না। চাকা আর উল্টা দিকে ঘুরিল না।

এই একই প্রসেসে সরকারী চাকুরি আইন প্রশাসন-যন্ত্রের মেরুদন্ড ভাংগিয়া দিয়াছে। আজো তা আর জোড়া লাগে নাই। সকল রাষ্ট্র বিজ্ঞানীর মত হিসাবে গণতান্ত্রিক দুনিয়ার সর্বত্র এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য বলিয়া গৃহীত ইয়াছে যে প্রশাসনিক নির্বাহীদের চাকরির উপর নির্বাচিত নির্বাহীদের প্রভাব যত কম হইবে, রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য ততই মংগল। চাকুরির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা না থাকিলে রাষ্ট্রের সমূহ ক্ষতি হয়। এক দিকে প্রশাসনিক নির্বাহীরা সততার সংগে নিজেদের কর্তব্য পালন করিতে পারে না। অপর দিকে দেশের প্রতিভাশালী উচ্চশিক্ষিত তরুণরা সরকারী চাকুরি গ্রহণে অনুৎসাহী হইয়া পড়েন। বহু কালের অভিজ্ঞতার ফলে তাই প্রশাসনিক নির্বাহী নিয়োগের কাজটা নিরপেক্ষ অরাজনৈতিক চাকুরি কমিশনের উপর দেওয়া হইয়াছে। প্রমোশন-ডিসমিযাল ও উন্নতি-অবনতির জন্যও তেমনি কড়া নিয়ম কানুনের একটা ঐতিহ্য গড়িয়া ভোলা হইয়াছে। পক্ষান্তরে যে দেশের যেখানেই এর ব্যতিক্রম হইয়াছে, সেখানেই দুর্নীতি প্রবেশ করিয়াছে। প্রশাসনিক কাঠামোতে ঘুণে ধরিয়াছে। রাষ্ট্রের ঘোরতর অকল্যাণ হইয়াছে।

এটাই ঘটিয়াছে বাংলাদেশের প্রশাসন-যন্ত্র। ১নং অর্ডার এই কাজটি করিয়াছে। এত কালের স্থায়ী প্রশাসনিক নির্বাহীদের চাকুরির স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা ও উন্নতি এক চোটে নির্বাচিত নির্বাহীদের মর্যির উপর নির্ভরশীল করা হইয়াছে। এতে প্রশাসনিক নির্বাহীদের যোগ্যতা ও কর্মতৎপরতা নৈতিক সততা ও প্রশাসনিক দক্ষতা হইতে এক লাফে বাণিজ্যিক লাভ-লোকসানের দাড়ি পাল্লায় চড়িয়া বসিয়াছে। বুদ্ধি-বিবেকমতে দায়িত্ব পালনের চেয়ে এখন হইতে কর্তাভজাই উন্নতির একমাত্র সোপান হইয়া গিয়াছে।

বাংলাদেশের সরকারী কর্মচারীদের বরাতে এমনটা ঘটার কোনও কারণ ছিল না-না এফিশিয়েনসির দিক হইতে, না দেশের প্রতি কর্তব্যবোধের দিক হইতে। স্বাধীনতার আগে এঁদের যোগ্যতা ও দক্ষতায় কেউ সন্দেহ করেন নাই। এতদিন পাকিস্তান সরকারের চাকুরি করিয়াছেন বলিয়া স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারী কর্তব্য করিতে পারিবে না, এটা মনে করিবারও কোনও কারণ ছিল না। সরকারী কর্মচারীর প্রচলিত দায়িত্ব-বোধ ও মাথার উপর সামরিক শাসনের খড়গ লইয়াও যাঁরা ২রা মার্চ হইতে ২৫শা মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নির্দেশিত অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়া চাকুরি ও জান খোয়াইবার ঝুঁকি লইয়াছিলেন, তাঁদের বিপদ মুক্তি-যোদ্ধাদের বিপদের চেয়ে কম সাংঘাতিক ছিল না। যাঁদের নেতা চীফ সেক্রেটারী মিঃ শফিউল আযম এসোসিয়েশনের সভা করিয়া আওয়ামী লীগের দাবির সমর্থন করিয়াছিলেন, যে জুডিশিয়ারির নেতা চীফ জাস্টিস বদরুদ্দীন সিদ্দিকী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নব নিয়োজিত গভর্নর টিক্কা খানকে হলফ পড়াইতে অস্বীকার করিয়া চাকুরি ও জীবন উভয়টার বিপদের ঝুঁকি লইয়াছিলেন, সেই প্রশাসন-যন্ত্র ও বিচার বিভাগ বাংলাদেশ সরকারের হাতে এমন ব্যবহার পাইবেন, এটা কেই ভাবিতে পারেন নাই। তার ফলও রাষ্ট্রের জন্য ভাল হয় নাই। আমরা আজ তার সাজা ভোগ করিতেছি।

জনগণের আস্থা, প্রশাসনিক সততা ও আদালতের স্বাধীনতাই সকল রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি, এটা শুধু রাষ্ট্র বিজ্ঞানের কথা নয়, আওয়ামী লীগেরও দীর্ঘকাল-পোষিত মুলনীতি। যতই সাময়িক বিচ্যুতি ঘটুক শেষ পর্যন্ত তার নীতির প্যাডিউলাম ঠিক জায়গায় আসিয়া স্থির হইবেই।

৫. প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ৭ই ফেব্রুয়ারি কলিকাতা সফরে গেলেন। গড়ের মাঠে বিশাল জনসভায়, কলিকাতা কর্পোরেশনের নাগরিক সম্বর্ধনার জবাবে এবং কলিকাতা প্রেসক্লাবের সভায় ভারতের জনগণ, ভারত সরকার ও ভারতীয় সংবাদ পত্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাইয়া তাঁর স্বাভাবিক ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা করিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য মিসেস ইন্দিরা গান্ধী কলিকাতা আসিয়াছিলেন। তিনিও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় গড়ের মাঠের জনসভায় বক্তৃতা করেন। গবর্নমেন্ট হাউসে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে তিনি এক নৈশভোজের আয়োজন করেন। ভোজ-শেষের বক্তৃতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সরকারের জন্য এগার শ মোটরগাড়ি, বাস, ট্রাক ইত্যাদি উপহার দেন।

৮ই ফেব্রুয়ারির রাতের খবরে টেলিভিশনে যখন এই খবর প্রচারিত ও প্রদর্শিত হয়, তখন আমি আমার পরিবারের এবং সমবেত বন্ধু-বান্ধবের কাছে ভারত-সরকারের বন্ধুত্ব ও উদারতার তারিফ করিবার সুযোগ পাইলাম ও করিলাম। সমবেত বন্ধু বান্ধবের মধ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারও উপস্থিত ছিলেন। আমার ইন্দিরা প্রশংসায় বাধা দিয়া বলিলেন : মাত্র ওয়ানফিফথ ফেরত পাইলাম, সার।

কৌতূহলে সবাই তাঁর পানে তাকাইলেন। আমিই প্রশ্ন করিলাম : এ কথার মানে?

তিনি জবাবে বিস্তারিত যা বলিলেন, তার সারমর্ম এই যে, ২৫শে মার্চের পর আমাদের দেওয়ানী, পুলিশ ও জংগী অফিসাররা এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষীয় লোকেরা বিভিন্ন জেলা-মহকুমা ট্রেজারি ও ব্যাংক হইতে হাজার হাজার কোটি টাকা ছাড়াও সাড়ে পাঁচ হাজার বিভিন্ন শ্রেণীর অটোমোবাইল নিয়া ভারতে আশ্রয় নিয়াছিলেন। আজ শ্রীমতি ইন্দিরা তার মাত্র এক-পঞ্চশাংশ ফেরত দিলেন।

সমবেত সবাই তাঁর কথা কৌতূহলের সাথে শুনিলেন। আমি ভদ্রলোকের অকৃতজ্ঞতা, নীচতা ও এমন ব্যাপারে বিচারের মাপকাঠির ক্ষুদ্রতায় চটিতে ছিলাম। তাঁর কথা শেষ হওয়া মাত্র আমি বিদ্রুপের ভাষার বলিলাম : আপনারা ঐসব মোটরগাড়ি ভারত-সরকারের কাছে জমা রাখিয়াছিলেন বুঝি?

ভদ্রলোক চুপ করিয়া রহিলেন। আমি আবার বলিলাম ঐ এগারশত গাড়িও যদি তাঁরা না দিতেন, তবে কি করিতেন আপনারা? একটু থামিয়া আবার বলিলাম : ঐ অবস্থায় ওসব আপনাদের হাতে পড়িলে একটাও ফেরত দিতেন না।

আমাদের মুক্তি-সংগ্রামে সহায়তা করিবার ভারতের এক শ একটা কারণ ছিল, আমি তা বুঝিতাম। তার মধ্যে ভারতের নিজস্ব স্বার্থও ছিল, তাও আমি জানিতাম। কিন্তু তাই বলিয়া ভারতের সাহায্যের মহৎ দিকটা এত তাড়াতাড়ি আমরা ভুলিয়া যাইব, এটা আমি কিছুতেই মার্জনা করিতে পারি নাই।

পরদিন উভয় প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা সম্পর্কে একটি সুন্দর যুক্ত-বিবৃতি প্রকাশিত হইল। তাতে উভয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার কথা ছাড়াও বলা হইল যে, আগামী ২৫শে মার্চের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য অপসারণের কাজ সমাপ্ত হইবে।

আমি এ ঘোষণায় আহ্লাদিত হইলাম এবং শেখ মুজিবের কূটনৈতিক সাফল্যে গর্বিত হইলাম।

কার্যতঃ বাংলাদেশ হইতে সৈন্য অপসারণের কাজটা নির্ধারিত তারিখের অনেক আগেই সমাপ্ত হইল। ১২ই মার্চ তারিখে ভারতীয় সৈন্য ঢাকা ত্যাগ করিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান একটি প্রাণস্পর্শী সংক্ষিপ্ত ভাষণে তাদের বিদায় সম্ভাষণ জানাইলেন।

পাঁচ দিন পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় আসিলেন। ঢাকাবাসী তাঁকে সাড়ম্বরে প্রাণঢালা বিপুল সম্বর্ধনা জানাইল। সুহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই উদ্দেশ্যে নির্মিত সুউচ্চ মঞ্চেও উভয় প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা করিলেন। মিসেস গান্ধী তিনদিন ঢাকায় অবস্থান করিয়া বিভিন্ন সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন। অবশেষে ১৯শে মার্চ তিনি ঢাকা ত্যাগ করিলেন। ঐ তারিখে উভয় প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা সম্পর্কে একটি যুক্ত ইশতাহার বাহির হইল।

. ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী-বাণিজ্য চুক্তি

মিসেস গান্ধীর তিনদিন স্থায়ী বাংলাদেশ সফরের ফলে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে দুইটি মূল্যবান সুদূরপ্রসারী চুক্তি স্বাক্ষরিত হইল। একটি ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি, অপরটি ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য চুক্তি। প্রথমটি স্বাক্ষরিত হয় যুক্ত ইশতেহার প্রকাশের তারিখেই ১৯শে মার্চ। দ্বিতীয়টি স্বাক্ষরিত হয় দশ দিন পরে ২৮শে মার্চ।

এই দুইটি চুক্তি লইয়াই বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিশেষতঃ রাজনৈতিক মহলে ভূল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল এবং ফলে প্রকাশ্যে তুমুল প্রতিবাদের ঝড় উঠিয়াছিল। মৈত্রী চুক্তির ফলে বাংলাদেশ সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হইয়াছে বলিয়া বিরোধী দলসমূহের নেতারা এই চুক্তির নিন্দা করিতে লাগিলেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কদের কৃতজ্ঞতা-বোধ ও দুর্বলতা ও অসহায় অবস্থার সুযোগ লাইয়া শক্তিমান ভারত এই অসম চুক্তি আদায় করিয়াছেন বলিয়া ভারত-বিরোধী একটা মনোব আপনি মাথা চাড়া দিয়া উঠিল।

ঐ অবস্থায় বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় পরিবেশটা আরও তিক্ত হইয়া উঠিল। মৈত্রী চুক্তিকে যেমন ভারতের রাজনৈতিক আধিপত্যের দলিল বলা হইতেছিল, বাণিজ্যচুক্তিকে তেমনি ভারতের অর্থনৈতিক আধিপত্যের দলিল বলা হইতে লাগিল।

কিন্তু আমার বিবেচনায় বাণিজ্য চুক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি করার অনেক কিছু থাকিলেও মৈত্রী চুক্তিতে আপত্তির বিশেষ কিছু নাই। ভারতের সহিত মৈত্রী ও সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য একটা অমূল্য সম্পদ। পাকিস্তান আমলেও আমি বলিতাম ও বিশ্বাস করিতাম, পাক-ভারত মৈত্রী ও সহযোগিতা উভয় দেশের জন্য কল্যাণকর ও অপরিহার্য। বাংলাদেশের বেলা এটা আরও সত্য। ভারতের সহিত বন্ধুত্ব না রাখিয়া বাংলাদেশ কখনও নিরাপদ হইতে পারে না। এই দিক হইতে বিচার করিলে আলোচ্য মৈত্রী চুক্তিকে বাংলাদেশের স্বার্থেই অভিনন্দিত করিতে হয়। এই চুক্তির হায়াত ২৫ বছর হওয়াটাও সে কারণেই সমর্থনযোগ্য। এই চুক্তির সমালোচকরা ৯ ও ১০ দফা বিরোধিতা করেন যে কারণে আমার বিবেচনায় সে কারণটাও যুক্তিপূর্ণ নয়। চুক্তির দুই পক্ষের কেউই অপর পক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতের কোন সাহায্য করিতে পারিবেন না, একপক্ষ তৃতীয়-পক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হইলে অপর পক্ষ তার সাহায্যে আসিবেন, অথবা একপক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে তৃতীয় কোন পক্ষের সহিত চুক্তিবদ্ধ হইতে পারিবেন না, এর একটাও আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করে নাই।

আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্বের বিচার এভাবে করা হয় না। চুক্তি মাত্রেই পক্ষগণের স্বাধীনতা খানিকটা ক্ষুণ্ণ হয়। আলোচ্য চুক্তিতে তার বেশী কিছু হয়। নাই। চুক্তির যে শর্তে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হইয়াছে, তাতে ভারতের সার্বভৌমত্বও সমভাবে ক্ষুণ্ণ হইয়াছে। তা না হইলে কোন চুক্তিই হইতে পারে না। কাজেই আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় মৈত্রী চুক্তির বিরুদ্ধে কিছুই বলিবার নাই।

কিন্তু বাণিজ্য চুক্তির বিরুদ্ধে একথা বলা চলে না। এই চুক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবাদিক মহল যেভাবে প্রতিবাদমুখর হইয়া উঠিয়াছে, গোটা দেশবাসী যেভাবে চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে, তা মোটেই অযৌক্তিক নয়। বাংলাদেশের স্বার্থ এই চুক্তিতে সত্যই ঘোরতর ভাবে উপেক্ষিত হইয়াছে। বিশেষতঃ এই চুক্তির সীমান্ত বাণিজ্যের বিধানটা যেন বাংলাদেশের পক্ষ হইতে চোখ বুজিয়া সই করা হইয়াছে। বহু ত্রুটির মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ক্রটি দশ মাইল এলাকাকে সীমান্ত আখ্যা দেওয়া। বাংলাদেশের মত দীঘে-পাশে ক্ষুদ্রায়তন দেশের মোট আয়তনের এক চতুর্থাংশের বেশী এলাকাকে সীমান্ত বলার অর্থ কার্যত গোটা দেশটাকেই সীমান্ত বলিয়া স্বীকার করা। বাংলাদেশ ও ভারতের মোট চৌদ্দশ মাইল ব্যাপী সীমান্ত রেখার দশ মাইল এলাকাকে বর্ডার ট্রেডের জন্য মুক্ত করিয়া দেওয়ার পরিণাম কি, যে-কোন কান্ডজ্ঞানী লোকের চোখে তা ধরা পড়া উচিৎ ছিল। এর ফলে ভারত-বাংলাদেশের গোটা বর্ডার এলাকাই চোরাচালানের মুক্ত এলাকা হইয়া পড়ে। এটা বুঝিতে বাংলাদেশ সরকারেরও বেশি সময় লাগে নাই।

অথচ বাংলাদেশের (তৎকালে পূর্ব-পাকিস্তান) যে জিরাটিয়াদের স্বার্থ রক্ষাই গোড়ায় বর্ডার-ট্রেডের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, যে জিরাটিয়াদের বিশেষ সুবিধাই ছিল ১৯৫৭ সালে সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার সম্পাদিত পাক-ভারত বাণিজ্য-চুক্তির প্রধান শর্ত, ভারত বাংলাদেশের বাণিজ্য চুক্তির বর্ডার-টেড হইতে সেই জিরাতিয়াদেরেই বাদ দেওয়া হইয়াছে।

সুখের বিষয় বছর না ঘুরিতেই এই চুক্তি বাতিল করা হইয়াছে। কিন্তু এই চুক্তি যে বিপুল আয়তনের চোরাচালান বিপুল শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে সংঘবদ্ধ হইবার সুযোগ করিয়া দিয়াছে তার কজা হইতে বাংলাদেশ আজও মুক্ত হইতে পারে নাই। আরও সুখের বিষয় এই যে এই বাণিজ্য চুক্তি বিশেষতঃ এর বর্ডার ট্রেডের অংশ, যে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী ভারত সরকারও তা মানিয়া লইয়াছেন। বর্তমান ভারত সরকার এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব যে সত্য-সত্যই বাংলাদেশের হিতৈষী, আমাদের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও সার্বিক স্বকীয়তা স্বনির্ভরতা যে তাঁদের কাম্য, এ সম্বন্ধে সন্দেহ করার কোনও কারণ নাই। বিশাল ভারতে অসংখ্য দল ও মতের মধ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য ও কৃষ্টিক স্বকীয়তা-বিরোধী কিছু লোক থাকা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাঁদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপে ভারত সরকারেরও কংগ্রেস পার্টির আন্তরিকতায় সন্দেহ করিবার কোনও কারণ নাই। এ বিষয়ে পরে আরও আলোচনা করিব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *