স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ
নয়া অধ্যায়
উপাধ্যায় এক
প্রথম জাতীয় সাধারণ নির্বাচন
১. ‘পুনশ্চে’র অবসান
খোদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমাকে আর ‘পুনশ্চ’ লিখিতে হইল না। মেহেরবান আল্লা আমার মুনাজাত কবুল করিয়াছেন। আবার ‘পুনশ্চ’ লেখার দায়িত্ব হইতে আমাকে রেহাই দিয়াছেন। সে উদ্দেশ্যে সর্বশক্তিমান আল্লা আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে নয়া যমানার সূচনা করিয়াছেন। ফলে আমিও এবার পুনশ্চের’ বদলে ‘নয়া অধ্যায় লিখিবার সুযোগ পাইয়াছি। আমার ইচ্ছা আমাদের জাতীয় জীবনের এই নয়া অধ্যায়টি আমার বই–এর এক অধ্যায়েই শেষ হউক। এটা করিতে গিয়া দেখিলাম, যত সংক্ষেপই করি, অধ্যায়টি খুব বেশি বড় হইয়া যায়। পাঠকের সুবিধার খাতিরে, এবং বইটির সৌষ্ঠবের জন্যও, অধ্যায়টি একাধিক ভাগে ভাগ করা দরকার।
এ অবস্থায় আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করিয়া এই অধ্যায়ের ভাগগুলোর নামকরণ করিলাম ‘উপাধ্যায় (উপ+অধ্যায়)। ইদানিং উপ’ শব্দটা আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয় হইয়াছে। ‘জন’ মানে এখানে ‘বিদগ্ধ জন’। ‘উপ’ শব্দটার প্রচুর ব্যবহার আগেও ছিল। যেমন, উপকার’, উপদংশ’, ‘উপদেশ’ ‘উপপতি’, ‘উপপত্নী’, ‘উপবাস’, ‘উপমা’, ‘উপযুক্ত’, ‘উপসর্গ’, ‘উপসংহার’, ‘উপহার’ ও ‘উপহাস’। আরও অনেক আছে। মাত্র এক ডজনের উল্লেখ করিলাম। কিন্তু আমাদের বিদগ্ধ মনীষীরা সম্প্রতি ‘উপ’ শব্দটার প্রতি যে আসক্তি দেখাইতেছেন, তাতে ‘উপপতি’ ও ‘উপপত্নীর দিকেই পক্ষপাতিত্ব দেখান হইতেছে। ফলে ‘উপাচার্য’, ‘উপরাষ্ট্রপতি’, ‘উপকমিটি, উপকর্মাধ্যক্ষ’, ‘উপমহাধ্যক্ষ ইত্যাদির প্রচুর ব্যবহার চলিতেছে। আমি এই সুযোগ গ্রহণ করিলাম। উপাধ্যায়ের’ ভিন্ন অর্থ আছে, এই যুক্তিতে বিদগ্ধ মনীষীরা আমার এই নামকরণে আপত্তি করিতে পারিবেন না। তাঁদের আবিষ্কৃত ‘উপরাষ্ট্রপতির’ ‘উপ’ বিশেষণটি রাষ্ট্র’ ও ‘পতি উভয়টার গুণবাচক হইতে পারে, এমন বিভ্রান্তির ঝুঁকিই যখন তাঁরা লইয়াছেন, তখন ‘উপাধ্যায়ের বিভ্রান্তির ঝুঁকিতে তাঁদের আপত্তি হওয়া উচিৎ নয়।
গত সংস্করণের ‘শেষ কথা’ অনুচ্ছেদে আমি লিখিয়াছিলাম : পাকিস্তানের নেতাদের এই ডিগনিটি ও পাকিস্তানী জনগণের এই ম্যাজেস্টি সুরুজের কিরণের মতই আত্মশক্তিতে প্রকট হউক, পাকিস্তানের জীবনের অমাবস্যার ‘পুন’ আর কোনও দিন ঘটুক, এই মুনাজাত করিয়া এই ‘পুনশ্চ’ লেখা শেষবারের মত শেষ করিলাম।
কথাগুলি লিখিয়াছিলাম ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে। ঐ সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় নেতাদের অনেকেই এল. এফ. ও-র দরুন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিবেন কি না, ভাবিতেছিলেন। তাঁদের মতে এল, এফ, ও নির্বাচিত পরিষদের সার্বভৌমত্ব হরণ করিয়াছে। কাজেই ঐ ক্ষমতাহীন পরিষদে নির্বাচিত হইয়া জনগণের দাবিমত, এবং তাঁদের পার্টি মেনিফেস্টো মত শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করা যাইবেনা।
২. আওয়ামী নেতৃত্বের দূরদর্শিতা
তাঁদের যুক্তি অসার ছিল না। কিন্তু প্রশ্নটার আরেকটা দিক ছিল। সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনে এল. এফ. এ.-র কোনও প্রভাব ছিল না। এল, এফ. ও.-র প্রভাব শুরু হইত নির্বাচনের পরে, পরিষদের সার্বভৌম ক্ষমতার উপর। কাজেই আমি দৈনিক সংবাদপত্রে ইংরাজী ও বাংলা উভয় ভাষায় ঘন-ঘন প্রবন্ধ লিখিয়া এই তরফটার দিকে নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া তাঁদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিবার উপদেশ দিয়াছিলাম। তার পক্ষে অনেক যুক্তি-তর্কও পেশ করিয়াছিলাম। বলিয়াছিলাম, আমাদের রাজনৈতিক জীবনে অমাবশ্যার ‘পুনশ্চ’ ঠেকাইবার উহাই একমাত্র পথ।
জনপ্রিয় পার্টিসমূহের মধ্যে কার্যতঃ একমাত্র আওয়ামী লীগই ছয় দফার. ভিত্তিতে সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। জনগণ তাদের অন্তরের প্রতিনিধি নির্বাচন করিয়াছিল। তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সার্বভৌমত্বের সামনে সামরিক প্রেসিডেন্ট এল.এফ. ও.ঝড়ের মুখে তৃণখণ্ডের মত উড়িয়া গিয়াছিল। আমি এই বৃদ্ধ বয়সে আরেকবার ‘পুনশ্চ’ লেখার দায় হইতে বাঁচিয়া গেলাম। আমাদের রাজনৈতিক জীবনে, সুতরাং আমার-দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরে’, একটি নূতন অধ্যায় সংযোজিত হইল। আমাদের রাজনৈতিক জীবনের এই নয়া অধ্যায়ে কালে নিশ্চয়ই আরও নূতন-নূতন অধ্যায়, পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ, দফা ও উপ-দফা যোগ হইবে। কিন্তু ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরে সেসব নূতন-নূতন দফা-উপদফা যোগ করিবার জন্য আমি বাঁচিয়া থাকিব না। থাকিয়া কোন লাভও নাই। তার দরকারও নাই। কারণ আমার দেখা রাজনীতির বয়স তখনও পঞ্চাশই থাকিবে। আমার বই এর নামও ‘পঞ্চাশ বছর’ই থাকিবে। এই ধরুন না, ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে এই বই যখন প্রথম বাহির হয়, তখনও এর নাম ছিল ‘রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’। দুই বছর পরে ১৯৭০ সালে জুন মাসে যখন দ্বিতীয় সংস্করণ বাহির হয়, তখনও এর নাম ছিল ‘রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’। দুই বছরে আমার দেখা রাজনীতির বয়স একদিনও বাড়িল না। তারপর আরও তিন বছর পরে ১৯৭৩ সালে যখন এর তৃতীয় সংস্করণ বাহির হইতেছে, তখনও এর নাম ‘পঞ্চাশ বছর। এর কারণ তিনটা হইতে পারে। (১) ‘পঞ্চাশ’ শব্দটা এই বইয়ে সংখ্যার চেয়ে বেশি প্রতীক-নির্দেশক; (২) লেখকের রাজনৈতিক কর্ম ও চিন্তার ওটাই ভ্যানিশিং লাইন; (৩) এই মুদ্দতের রাজনীতি লেখকের দেখার চেয়ে ‘শুনাই বেশি। কারণ এতে লেখকের ব্যক্তিগত ও দৈহিক যোগাযোগ একেবারে নাই বলিলেই চলে।
৩. এবারের ‘দেখা’ গ্যালারির দর্শকের
এ মুদ্দতের রাজনীতিটা লেখকের দেখা মানে ইংরেজী ‘সি’ নয়, ‘অবযার্ভ’। গ্যালারির দর্শকরা যেমন মাঠের খেলা দেখেন, নিজেরা খেলেন না। কিন্তু গ্যালারির এই দর্শকদের মধ্যেও দুই কেসেমের লোক থাকেন। এক কেসেমের লোক জীবন-ভর দর্শক। খেলা দেখিয়াই তাঁদের আনন্দ। নিজেরা কোনও দিন প্রতিযোগিতায় ত খেলেন নাই, জীবনে কোনও দিন পায়ে বল বা হাতে ব্যাট নিয়াও দেখেন নাই। আর এক কেসেমের দর্শক আছেন, যাঁরা আগে খেলিতেন। এখন খেলা থনে অবসর নিয়াছেন। এখন শুধু খেলা দেখেন। সাবেক খেলোয়াড় বলিয়া খেলার ভাল-মন্দ, খেলোয়াড়দের দোষ-ত্রুটি, নিখুঁতভাবে বিচার করিবার ক্ষমতা এবং অধিকারও এদের আছে। বর্তমানের রাজনীতির খেলার মাঠের আমি এমনি একজন দর্শক মাত্র। এই উভয় খেলার মাঠের একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য এই যে প্রবীণ সাবেক খেলোয়াড় দর্শকরা নবীনদের খেলার দোষগুণের নিখুঁত ও নির্ভুল বিচার করিতে পারেন ঠিকই এবং দোষ-ত্রুটি দেখাইতেও পারেন বটে, কিন্তু নিজেরা খেলিতে পারেন না।
৪. ফুটবল যাদুকর সামাদের কথা
খেলার কথাটা উঠিয়া পড়ায় এ সম্পর্কে একটা গল্প মনে পড়িয়া গেল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের গোড়ার দিকে অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ও আমি প্রায় প্রতিদিন কলিকাতার গড়ের মাঠে ফুটবল খেলা দেখিতে যাইতাম। অধ্যাপক হুমায়ুন কবির তখন দৈনিক ‘কৃষকের’ ম্যানেজিং ডিরেক্টর, আর আমি এডিটর। ইউনিভার্সিটি হইতে খেলার মাঠে যাইবার পথে তিনি আমাকে তাঁর গাড়িতেই তুলিয়া নিতেন। ফুটবলের যাদুকর সামাদ সাহেব তখন খেলা হইতে সম্প্রতি রিটায়ার করিয়াছেন। নিয়মিত দর্শক। অনেক দিনই আমরা পাশাপাশি বসিয়া খেলা দেখিতাম। এমনি একদিন আমরা কৌতূহলে জিগ্গাস করিলাম : তরুণ খেলোয়াড়দের খেলা আপনার কাছে কেমন লাগে? তিনি বিনা দ্বিধায় জবাব দিলেন : খুব ভাল লাগে। একটু থামিয়া যোগ করিলেন। অবশ্য যদি ভাল খেলে।
‘আর যদি খারাপ খেলে তবে আপনার কেমন লাগে?
‘এক-একবার মনে হয় লাফায়ে মাঠে নেমে পড়ি।’ (‘লাফিয়ে’টা তখনও ভাষার মাঠে নামে নাই।) আমরা উভয়ে সমস্বরে প্রশ্ন করিলাম : ‘তবে নেমে পড়েন না কেন?’
সামাদ সাহেব হাসিয়া জবাব দিলেন : তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে, সত্যসত্যই খেলার মাঠে নামলে ওদের মতও খেলতে পারব না। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া এককালের লক্ষ দর্শকের হর্ষধ্বনির দ্বারা নন্দিত এই ফুটবলের যাদুকর বলিলেন : সব কাজেরই একটা বয়স আছে। কি বলেন আপনারা? আমরা কেউ জবাব দিবার আগেই তিনি হাসিয়া বলিলেন : বোধ হয় একমাত্র সাহিত্য-সেবা ছাড়া। আমরা সানন্দে হাসিতে যোগ দিলাম।
৫. গ্যালারিতে কেন?
ফুটবল খেলার বিশেষজ্ঞ সামাদ সাহেবের ফুটবল সম্পর্কে এই কথাটা আমার মতে রাজনীতিতেও প্রযোজ্য। কিন্তু এ বিষয়ে আমার সমর্থক বেশি নাই। তবে আমার যুক্তিতে জোর আছে বলিয়াই আমার বিশ্বাস। আমার মতে সরকারী চাকুরিয়াদের মতই পঞ্চাশ-ষাট বছর বয়সে রাজনীতিক নেতাদের সক্রিয় রাজনীতি থনে অবসর নেওয়া উচিৎ। কারণ এই বয়সের পরে রাজনীতিক নেতারা পার্লামেন্টারি রাজনীতির অযোগ্য হইয়া পড়েন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও, ডিক্টেটরি রাজনীতিতেও। গণতান্ত্রিক দলীয় রাজনীতিতে অযোগ্য হন এই কারণে যে তাঁরা তখন আর গণতান্ত্রিক থাকেন না। বয়স ও অভিজ্ঞতার দাবিতে তাঁরা বিরুদ্ধতা ও সমালোচনা সইতে পারেন না। আর ডিক্টেটরি রাজনীতি করিবার মত বেপরোয়া অযৌক্তিক মনোভাবের অধিকারীও তাঁরা এই বয়সে থাকেন না। এক কথায়, এই বয়সের লোকেরা গণতন্ত্রের জন্য একটু বেশি মাত্রায় শক্ত। আর ডিটেরির জন্য বেশি মাত্রায় নরম। আমার এই যুক্তি কেউ মানেন না। প্রায় সবাই বলেন, বয়স বৃদ্ধির সংগে-সংগে মানুষের রাজনীতিক দক্ষতা বাড়ে। বাংলার ফজলুল হক ও সুহরাওয়ার্দী, ইংলণ্ডের চার্চিল, পশ্চিম জার্মানীর কনরাড অডনেয়ার, ভারতের জওয়াহের লাল, যুগোস্লাভিয়ার টিটো প্রভৃতি সফল রাজনীতিকদের তাঁরা তাঁদের সমর্থনের নযির খাড়া করেন। আমার মতে ওঁরা দৃষ্টান্ত নন, ব্যতিক্রম মাত্র।
যা হোক, কেউ না মানিলেও আমি আমার যুক্তি মানিয়া লইয়াছি। পঞ্চাশ-ষাটে না করিলেও ষাট-পয়ষট্টিতে সক্রিয় রাজনীতি থনে অবসর গ্রহণ করিয়াছি। এটা স্বেচ্ছায় ঘটিয়াছে কি স্বাস্থ্যগত কারণে বাধ্যতামূলকভাবে ঘটিয়াছে, তা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। কারণ সক্রিয় রাজনীতি না করিলেও ‘নিক্রিয় রাজনীতি’ আজও করিয়া চলিয়াছি। কারণ সেই প্রবাদ বাক্যের কম্বল। আপনি কম্বল ছাড়িলেও কল আপনাকে ছাড়িবেনা। আমার দেখা রাজনীতির এই অধ্যায়ে, যাকে কার্যতঃ এই বই-এর শেষ অধ্যায় বলা যাইবে, যা লিখিতে বসিয়াছি, তাতে সেই কলের কাহিনীই সত্য প্রমাণিত হইবে।
৬. রাজনৈতিক ‘হরিঠাকুর’
কিন্তু একটু ভিন্ন ধরনে। কম্বলের সাথে রাজনীতির তুলনা না করিয়া রাজনীতিকের তুলনাই বোধ হয় ঠিক। কারণ আমি রাজনীতি ছাড়িবার পরও রাজনীতি আমাকে ছাড়ে নাই, এ কথা বলিলে রাজনীতির প্রতি অবিচার হইবে। রাজনীতি কখনও অনিচ্ছুক ব্যক্তির উপর ভর করে না। যাঁরা বলেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা রাজনীতির শিকার হইয়াছেন, তাঁদের মিথ্যাবাদী না বলিয়াও একথা বলা চলে যে, তাঁদের মনে রাজনীতি করিবার একটু কুৎকুতানি ছিল। হইতে পারে সেটা ছিল অবচেতন মনে। কিন্তু ছিল তা অবশ্যই। সেটা প্রকাশ পাইয়াছে দৃশ্যত বাহিরের একটু চাপে। চাপটাও হয়ত তিনিই সৃষ্টি করিয়াছেন। এটাকে আমি অন্যত্র বন্ধু-বান্ধবের অনুরোধে রাজনীতিতে,মানেইলেকশনে,যোগদান বলিয়াছি।
অহংকারের দায়ে অপরাধী না হইয়াও আমি বলিতে পারি, আমি বন্ধু-বান্ধবের অনুরোধের স্তর পার হইয়াছি। ওতে আমি আর আকৃষ্ট হই না। ফুটবলের যাদুকর সামাদ সাহেবের মতই এ বুড়া বয়সেও যে মাঠে নামিতে সাধ যায় না, তা নয়। কিন্তু সামাদ সাহেবের মতই নিজের অক্ষমতা সম্বন্ধেও আমি তীক্ষ্ণভাবে সজাগ। তাই আমি প্রথমদিকে বেশ আয়াসে এবং পরে বিনা-আয়াসে নিজেকে বিরত করিতে পারিয়াছি। এই কারণে আমি সক্রিয় রাজনীতি হইতে ধীরে ধীরে সরিয়াছি। মানে বায়োস্কোপের ছবির মত ‘ফেড-আউট’ করিয়াছি।
কিন্তু রাজনীতিকরা আমাকে বাধ্য করিয়াছেন নেপথ্যে অভিনয় করিতে। অবশ্য একেবারে মৃত সৈনিকের পাঠ নয়। আমাকে তাঁরা রাজনৈতিক চিন্তা হইতে মুক্তি দেন নাই। তাই আমি প্রায় এক যুগ হইতে ‘এলডার স্টেটসম্যান’ হইয়াছি। আমাদের দেশী ভাষায় বলা যায় রাজনৈতিক ‘হরিঠাকুর’। বন্ধুবর আতাউর রহমানের ভাষায় ‘হৈরাতাঁতী’’। হরিঠাকুরের কাহিনী বাংলার সব অঞ্চলেই চালু আছে। কারণ সব গাঁয়েই একজন বুড়া মুরুব্বির দরকার যাঁর জ্ঞান ও নিরপেক্ষতায় সকলের আস্থা আছে। কিন্তু আতাউর রহমান সাহেবের জন্মভূমি ঢাকা জিলার ধামরাই থানাটাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। এই ধামরাই থানায় ‘হরিঠাকুর’ নামে একজন এলডার-স্টেটসম্যান ছিলেন। তিনি ‘হরিঠাকুর’ নামেই বিখ্যাত ছিলেন। তাঁতী কূলে তাঁর জন্মের কথা কারও মনেই ছিল না। অসাধারণ জ্ঞানের জন্য দেশ-বিদেশে, মানে দশ গাঁয়ে, তাঁর প্রসিদ্ধি ছিল। জটিল সমস্যার সম্মুখীন হইয়া দূরদূরান্ত হইতে লোকজন দল বাঁধিয়া তাঁর কাছে আসিত। তাঁর-দেওয়া সমাধান যেসব সময়ে নির্ভুল বা গ্রহণযোগ্য হইত, তা নয়। কিন্তু তাতে হরিঠাকুরের বুযুর্গিও কমিত না। তাঁর দরবারের, মানে আংগিনার, ভিড়ও কমিত না। একটা নযির দিয়াই আতাউর রহমান সাহেব ‘হরিঠাকুরের’, তাঁর দেওয়া আদরের নাম ‘হৈরার’,বুদ্ধিমত্তার গভীরতা প্রমাণ করিয়া থাকেন। ঘটনাটা ছিল এই : একবার এই অঞ্চলের কয়েকজন পথিক একটা তালের আঁটি পথে পড়িয়া পাইল। ধামরাই অঞ্চলে খেজুর নারিকেল প্রচুর হইলেও সেখানে তালগাছ খুব কমই হয়। কাজেই তারা তালের আঁটি কখনও দেখে নাই। এ অবস্থায় ঐ অদ্ভুত জিনিসটা কি, তা লইয়া নিজেদের মধ্যে অনেক সলা-পরামর্শ ও বাদ-বিতণ্ডা করিল। একমত হইতে না পারিয়া শেষে তারা হরিঠাকুরের কাছে গেল। হরিঠাকুর প্রকৃত প্রবীণ জ্ঞানীর মতই বস্তুটি অনেকক্ষণ উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া দেখিলেন। চোখ বুজিয়া ধ্যান করিলেন। চোখ বড় করিয়া নিরীক্ষণ করিলেন। অবশেষে তিনি হাসিয়া ফেলিলেন। খানিকক্ষণ হাসিবার পর তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন। কিছুক্ষণ কাঁদিবার পর ঠাকুর আবার হাসিতে লাগিলেন। সমবেত ভক্তগণ ঠাকুরের এই অভূতপূর্ব আচরণ দেখিয়া বিস্মিত হইল। ঠাকুরকে এর কারণ জিগ্গাসা করিল। অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর ঠাকুর বলিলেন : এই একটা তুচ্ছ বস্তু তোরা চিনিতে পারিলি না, তাই আমি তোদের নির্বুদ্ধিতায় প্রথমে হাসিয়াছি। হাসিবার পরে তিনি কাঁদিলেন কেন, ভক্তদের এই প্রশ্নের জবাবে ঠাকুর বলিলেন : আমার অবর্তমানে তোদর কি দশা হইবে, সে কথা ভাবিয়া আমি কাঁদিয়াছিলাম। কাঁদিবার পর তিনি আবার হাসিলেন কেন, এই প্রশ্নের জবাবে ঠাকুর বলিলেন : “বস্তুটি কি আমি নিজেই তা বুঝি নাই, তোদর কি বুঝাইব? এই ভাবিয়া আমি হাসি ঠেকাইতে পারি নাই।”
ধামরাইর এই ঐতিহাসিক হরিঠাকুরের দশা হইয়াছে আমার। গত এক দশক ধরিয়া এই অবস্থা চলিতেছে। বন্ধুবর আতাউর রহমানই আমার এই পদবি চালু করিয়াছে। নিজের দলীয় সহকর্মীদের সহিত রাজনৈতিক জটিল প্রশ্নসমূহের আলোচনায় মতভেদ তীব্র হইয়া উঠিলেই তিনি বলেন : চল হৈরার কাছে যাই। এটা এখন সকল দলের মধ্যে চালু হইয়াছে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় লীগ, সমাজতান্ত্রিক পার্টি, মুসলিম লীগ (কনভেনশন ও কাউন্সিল), জমাতে ইসলামী, নিষামে ইসলাম, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির উভয় শাখা ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ইত্যাদি পরস্পর-বিরোধী মতবাদ ও কর্মপন্থার সকল দলের নেতা-কর্মীরা আমার উপদেশ ও পরামর্শ নিতে আসিয়া থাকেন। সাধারণ জাতীয় প্রশ্নের বেলা ত বটেই, তাঁদের যাঁর-তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ও কর্মপন্থার জটিল সমস্যাসমূহের মীমাংসা সম্বন্ধেও। ফলে আমার বাড়িতে সকাল-বিকাল ভিড় লাগিয়াই আছে। মনে হইবে আমি কতই না রাজনীতি করিতেছি। ডাক্তার বা উকিলের ব্যবসার দিক হইতে বিচার করিলে মনে হইবে আমার চেম্বার-প্র্যাকটিস একেবারে জমজমাট, যাকে বলে ‘রোরিং প্রাকটিস’। আমার অসুখ-বিসুখ, অবসর বিশ্রাম কোন অজুহাতই চলিবে না। বিনা খবরে, উইদআউট এপয়েন্টমেন্টে, যখন খুশি আমার কাছে আসার অধিকার সকলেরই আছে। আমার ‘না’ বলিবার অধিকার নাই। দু’দশ মিনিট দেরি করিবার উপায় নাই। খবর পাওয়ামাত্র বৈঠকখানায় হাযির হইতে হইবে। অন্যত্র কাজ আছে, বিলম্ব করিবার মত সময় নাই এই ধরনের যুক্তিতে তাঁরা ঘন-ঘন তাকিদও পাঠাইয়া থাকেন। এব্যস্ত হইয়া আমি বৈঠকখানায় আসিলে তাঁরা আলোচনাকে দীঘে-পাশে ও গভীরতায় যেভাবে প্রসারিত ও দীর্ঘায়িত করেন, তাতে মনে হয় না যে তাঁদের হাতে সময় নাই বা অন্যত্র কাজ আছে।
গত এক যুগ ধরিয়া আমি এই ‘হরিঠাকুরের’ কঠোর ও শ্রমসাধ্য দায়িত্ব পালন করিয়া আসিতেছি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মতবাদ আমার সকলেরই জানা। রাজনীতিতে আমি সেকিউলার ডেমোক্র্যাট, অর্থনীতিতে আমি সমাজবাদী। এসব বিষয়ে আমি বইপুস্তক ও বহু প্রবন্ধাদি লিখিয়াছি। সকল দলের রাজনৈতিক নেতা কর্মীরাই তা জানেন। সক্রিয় রাজনীতি না করিলেও আমি আদর্শবাদ ও কর্মপন্থার দিক হইতে আওয়ামী লীগের সমর্থক, এটা জানিয়াও নন-আওয়ামী লীগাররা আমার পরামর্শ নিতে আসেন। আমি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ঘোর বিরোধী জানিয়াও মুসলিম লীগ, জমাতে ইসলামী ও নিযামে ইসলামের নেতারাও আমার উপদেশ পরামর্শ চাহেন। উপদেশ দিবার আগে আমার সেকিউলার মতবাদের কথা, তাঁদের মতবাদে আমার কঠোর বিরোধিতার কথা, স্মরণ করাইয়া দিলেও তাঁরা আমার উপদেশের জন্য যিদ করেন। তারা বলেন এবং দৃশ্যতঃই বিশ্বাসও করেন যে, তাঁদের মতবাদের দিক হইতে আমি ঠিক পরামর্শই দিব। দেইও আমি। এ ব্যাপারে আমি উকিলের মতই আচরণ করি। উকিল যেমন আসামী-ফরিয়াদী উভয় পক্ষকেই তাদের স্বার্থ মোতাবেক নিরপেক্ষ উপদেশ দিতে পারেন, উপদেশ-প্রার্থীদের বিশ্বাস, রাজনীতিতে আমিও তা পারি এবং দেই। তবে আওয়ামী লীগের বেলায় আমার উপদেশ নিছক উকিলের মত নয়। আন্তরিকই। কারণ সংগঠনের দিক হইতে আমি আওয়ামী লীগার না হইলেও মনে-প্রাণে ও আদর্শে আমি আজও আওয়ামী লীগার। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতিক দলসমূহকেও আমি আন্তরিকতার সাথেই উপদেশ দিতাম। ধরুন, মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামীকেও আমি বলিয়াছি আপনারা যে মতাদর্শের রাজনীতিই করুন না কেন, দুইটা কথা মনে রাখিতে হইবে। এক, ধর্ম-সংস্কৃতির সাথে সাথে জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থের কথাও বলিতে হইবে। দুই, পার্টির নেতৃত্ব ও হেড অফিস পূর্ব-পাকিস্তানে থাকিতে হইবে। ওসব পার্টি-নেতারা যে আমার উপদেশ রাখিতেন, তা নয়। তবু তাঁরা উপদেশ চাইতে বিরত হন নাই। আমিও দিতে কৃপণতা করি নাই।
আমার অনেক হিতৈষী বন্ধু আমার এই আচরণের প্রতিবাদ করিতেন। অন্ততঃ আমার স্বাস্থ্যের নাযুক অবস্থার দরুন এ সব অকাজ হইতে বিরত থাকিতে বলিতেন। তাঁদের কথা যারা আমার উপদেশ মত কাজ করে না, তাদের নাহক উপদেশ দেই কেন? আমার জবাব; আমি ত কাউকে যাচিয়া উপদেশ দেই না। ওঁরাই উপদেশ নিবার জন্য তকলিফ করিয়া আমার কাছে আসেন। তাঁদের অনুরোধ না রাখা বেআদবি। আমার একটা যুক্তি, আমার বৈঠকখানাটা খয়রাতী দাওয়াখানা। যাঁরা দাওয়াই চান, তাঁদেরই দেই। দাওয়াই ব্যবহার করা-না-করা রোগীদের ইচ্ছা।
একটা নযির। জমাতে ইসলামীরা যখন দৈনিক বাংলা খবরের কাগ্য বাহির করা মনস্থ করিয়াছিলেন, তখন সম্পাদক পরিচালকসহ নেতৃবৃন্দ আমার কাছে আসিয়া কাগযের নাম সম্বন্ধে পরামর্শ চান। তাঁদের অভিপ্রায় জানিতে চাহিলে তাঁরা সংগ্রাম নামের কথা বলিলেন। আমি বাংগালী মুসলমানদের সাংবাদিকতার দীর্ঘদিনের ইতিহাস বর্ণনা করিয়া দেখাইয়া দিলাম যে আমাদের সাংবাদিকতার ঐতিহ্য খবরের কাগযের নাম সহজ-সরল চালু আরবী-ফারসী শব্দেই রাখা। ‘সংগ্রামের’ মত সংস্কৃত শব্দ নামে ব্যবহার করা এ দেশের রেওয়াজ নয়। উত্তরে তাঁরা যা বলিলেন এবং করিতেন তা বাংলাদেশে অবাংগালী মুসলিম নেতৃত্বের অসরল কমপ্লেক্স। সোজাসুজি বলিলেন : আপনারা বাংগালীরা নির্ভয়ে আরবী-ফারসী নামের কাগয চালাইতে পারেন, কিন্তু জমাতে ইসলামী তা করিলে লোকে বলিবে, বাংগালীদের সংস্কৃতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র চলিতেছে।
কমপ্লেক্সটা গভীর ও সুদূরপ্রসারী। এই কারণেই রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা বাংলা ভাষা ব্যবহারের সময় সংস্কৃত-ঘেষা ও কলিকাতার কথ্য বাংলাকেই প্রাধান্য দিয়া থাকেন।
এই সব পার্টির নেতারা আমার উপদেশ মানিতেন এটাও যেমন ঠিক নয়, কেউই যে আমার উপদেশ মানেন নাই, তাও সত্য নয়। বরং আমি যখন পাকিস্তানের রাজধানীর অবস্থিতিকেই পশ্চিম-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নতি ও পূর্ব-পাকিস্তানের অবনতির কারণ বলিয়া যুক্তি দিতেছিলাম, এবং এ বিষয়ে একাধিক ইংরাজী-বাংলা প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম তখন পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিল) নেতৃত্বের উদ্যোগে পাকিস্তানের রাজধানী কুড়ি বৎসরের জন্য ঢাকায় স্থানান্তর করিতে এবং অতঃপর পর্যায়ক্রমে দেশের রাজধানী উভয় অঞ্চলে প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব মুসলিম লীগে গৃহীত হইয়াছিল।
পক্ষান্তরে আমার ধানমণ্ডির বাড়িতে কেউ কেউ ‘হরিঠাকুরের আস্তানা’ না বলিয়া কাশিম বাজারের কুঠি (ষড়যন্ত্রের আজ্ঞা অর্থে) বলিয়াছিলেন : তাতেও তাঁদের প্রতি আমার বা আমার প্রতি তাঁদের মনোভাবের কোন অবনতি ঘটে নাই। প্রমাণ, তাঁরাও আমার ‘উপদেশ’ নিতে আসিতেন। আর সবার মতই তাঁরাও মনে করিতেন। স্বপক্ষেরটা উপদেশ, আর বিপক্ষেরটা ষড়যন্ত্র।
আমার দিককার আসল কথা, এই ধরনের উপদেশ দেওয়ার মধ্যে একটা আনন্দ ছিল। বোধ হয় মনের কোণে একটা গোপন অহংকারও ছিল। সবাই আমার উপদেশ নিতে আসেন, এটা আমার কম গৌরবের কথা নয়। এমন একটা অহমিকার ভাব হয়ত আমাকে পাইয়া বসিয়াছে। বাহিরে গিয়া নেতৃত্ব, বক্তৃতা ও মন্ত্রিত্ব করিয়া যশ খ্যাতি অর্জন করিতে পারি না; ঘরে বসিয়া একটু-একটু মুরুব্রিয়ানা করাটা মন্দ কি?
কাজেই এটা যে শুধু মৌখিক উপদেশেই সীমাবদ্ধ, তা নয়। অনেক সময় হাতে কলমে শারীরিক-মানসিক পরিশ্রমও করিতে হয়। আমার আপত্তি ত নাই, বরঞ্চ পরম উৎসাহেই এটা করিয়া থাকি। বক্তৃতা-বিবৃতি, মেনিফেস্টো ইত্যাদি রচনা করার দায়িত্ব এই বুড়া মানুষটাকে দেওয়া অনেক তরুণই নিষ্ঠুরতা মনে করিয়াছেন। কিন্তু এই বুড়ার উৎসাহ দেখিয়া হয়ত তাঁরা অবাকও হইয়াছেন। শুধু ওসব লিখিয়া দেওয়াই নয়, ওগুলো যাতে নির্ভুল রূপে ছাপা হয়, তার জন্য আমি নিজে প্রুফ দেখিবার জন্য যিদ করিয়াছি। যে লেখাটা আমার যত বেশি পছন্দ হইয়াছে, সেটা তত বেশি মনোযোগের সহিত প্রুফ দেখিয়াছি। আমার এই অভ্যাসের দরুন, অনেক কিছুর জন্যই নাহক আমাকে নিন্দা-প্রশংসা পাইতে হইয়াছে। একাধিক দৃষ্টান্তের মধ্যে আওয়ামী লীগের ছয় দফার নাম করা যায়। অনেকের, এমনকি খোদ আওয়ামী লীগারদেরও অনেকের, বিশ্বাস, ছয় দফা আমিই রচনা করিয়াছি। যুক্তফ্রন্টের একুশ দফাও আমিই রচনা করিয়াছিলাম। এই সুপরিচিত তথ্য হইতেই সকলে অতি সহজেই ছয় দফাও আমার রচনার কথাটা বিশ্বাস করিতে পারিয়াছেন। আসল সত্য তা নয়। আমি ছয় দফা রচনা করি নাই। ছয় দফার ব্যাখ্যায় বাংলা-ইংরাজী যে দুইটি পুস্তিকা আমাদের ‘বাঁচার দাবি’ ও ‘আওয়ার রাইট টু লিভ’ প্রকাশিত ও বহুল প্রচারিত হইয়াছে, এই দুইটি অবশ্যই আমি লিখিয়াছি এবং বরাবরের মত নির্ভুল ছাপা হওয়ার গ্যারান্টি স্বরূপ আমি নিজেই তাদের প্রুফও দেখিয়া দিয়াছি। মুজিবের ভালর জন্যই একথাটা গোপন রাখা স্থির হইয়াছিল। সে গোপনতার হুশিয়ারি হিসাবে প্রফ নেওয়া আনার দায়িত্ব পড়িয়াছিল তাজউদ্দিনের উপর। মানিক মিয়া, মুজিব, তাজউদ্দিন ও আমি এই চারজন ছাড়া এই গুপ্ত কথাটা আর কেউ জানিতেন না। অথচ অল্প দিনেই কথাটা জানাজানি হইয়া গেল। মুজিব তখন জেলে। আমি ভাবিলাম, মুজিবের কোনও বিরোধী পক্ষ তাঁর দাম কমাইবার অসাধু উদ্দেশ্যে এই প্রচারণা চালাইয়াছে। কাজেই আমি খুব জোরে কথাটার প্রতিবাদ করিতে থাকিলাম। পরে শেখ মুজিবের সহকর্মী মরহুম আবদুস সালাম খাঁ ও যহিরুদ্দিন সাহেবানের মুখে যখন শুনিলাম, স্বয়ং মুজিবই তাঁদের কাছে একথা বলিয়াছেন, তখন আমি নিশ্চিন্ত ও আশ্বস্ত হইলাম।
মোট কথা রাজনীতিক ‘হরিঠাকুর’ হইয়াও আমি কায়িক পরিশ্রম হইতে রেহাই পাই নাই। ধামরাইর হরিঠাকুর আমার মত পরিশ্রম নিশ্চয়ই করিতেন না। কিন্তু আনন্দ-ও গর্ব-বোধ নিশ্চয়ই করিতেন। দুনিয়ার সব দেশের সকল যুগের হরিঠাকুরদের বোধ হয় এটাই পুরস্কার এবং এ পুরস্কারের দামও কম নয়।