কলিকাতায় শেষ দিনগুলি
পনরই অধ্যায়
১. আলীপুরের বন্ধুরা
১৯৪৭ সালের শেষ দিক হইতে ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত পৌনে তিন বছর রাজনীতির সাথে আমার কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। ‘ইত্তেহাদের সম্পাদনা উপলক্ষে আমাকে কলিকাতায় থাকিতে হইয়াছিল। শহীদ সাহেবের উপর নাযিমুদ্দীন মন্ত্রিসভার বিরূপ ভাব ছিল। তাঁরা নানা অজুহাতে ‘ইত্তেহাদ’ ঢাকায় আনার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিলেন। অধিকন্তু একাধিকবার ব্যান’ করিয়া ‘ইত্তেহাদ’কে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত করিলেন। পক্ষান্তব্রে শহীদ সাহেব বহু মুসলিম-লীগ কর্মী, ছাত্র নেতা ও এম, এল, এ.-র পুনঃপুনঃ অনুরোধ সত্ত্বেও ঢাকায় আসিলেন না। ওদিকে কায়েদে-আযম ও লিয়াকত খাঁর পুনঃ অনুরোধেও তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও মন্ত্রিত্ব গ্রহণে রাখী হইলেন না। কাজেই আমাদের নেতা শহীদ সাহেবের মতই এবং সাথেই আমরা কোনমতে কলিকাতায় দিন কাটাইতে লাগিলাম। কোনমতে বলিলে ঠিক বলা হইবে না। পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করিয়া পাকিস্তান হাসিল করিয়া তার পরেও পাকিস্তানী হিসাবে হিন্দুস্থানে থাকাটাকে নিতান্ত বিবেচনার কাজ দাবি করা যাইতে পারে না। তবু এই সময়ে পশ্চিম বাংলা সরকার ও পশ্চিম বাংলার সুধী সমাজ সাধারণভাবে এবং সাংবাদিকরা বিশেষভাবে আমাদের সাথে যে ভদ্র ব্যবহার করিয়াছিলেন তার দৃষ্টান্ত বিরল। মুসলিম লীগের প্রচার-সম্পাদক হিসাবে আমার লিখিত ও সম্পাদিত প্রচার-পুস্তিকায় অন্যান্য স্থানের মতই আলীপুর কোট এলাকা ভরিয়া গিয়াছিল। এই কারণে ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রতি আলীপুরের উকিল ব্যারিস্টাররা খুবই বিক্ষুব্ধ থাকার কথা। ঝগড়া-গগাছের গরম তর্ক-বিতর্ক তাঁদের সাথে আমার অনেক হইয়াছে। এ অবস্থায় পাকিস্তান হাসিলের পর আমাকে আলীপুরে ওকালতি করিতে দেখিয়া তাঁরা অনেকেই নিশ্চয়ই বিস্মিত হইয়াছিলেন। কেউ-কেউ নিশ্চয়ই চটিয়া গিয়াছিলেন। তা সত্ত্বেও বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট হয় নাই। তাঁরা আগের মতই হাসিমুখে একদিন বলিলেন : ‘এখনও এখানে আছ যে? পাকিস্তান চেয়েছিলে, পাকিস্তান পেয়েছ। তবে আর এখানে বসে আছ কেন?’ আমিও বরাবরের মত হাসিমুখে বলিলাম তোমরা হিন্দুরা বড় চালাক। আমিন বাধ্য কৈরা বাঁটোয়ারার ছাহামে আমাদেরে ঠকাইছ। বাংগালরে তোমরা হাইকোর্ট দেখাইছ। ফলে আমাদের ভাগে জমি কম পড়ছে। কাজেই আরো কিছু জমি খাবার মতলবে আমরা জনকতক এখানে কিছুদিন থাকব ঠিক করছি। সকলে হো-হহ করিয়া উচ্চস্বরে হাসিয়া উঠিলেন। রসিকতা করিবার ও বুঝিবার সময় ওটা ছিল না। তবু আমি রসিকতা করিলাম। হিন্দু বন্ধুরা তার রস গ্রহণ করিলেন। এসব ব্যাপারে হিন্দু-মনের উদারতার তুলনা নাই।
২. আজাদের উপর হামলা
কিন্তু ওটা ব্যক্তিগত কথা। পাকিস্তানী প্রচারকদের মধ্যে ‘আজাদ’ পত্রিকা গ্রগণ্য। হিন্দুরা স্বভাবতঃই আজাদের উপর সবচেয়ে বেশি বিক্ষুব্ধ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই কলিকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিল। পনর দিন যাইতে-না যাইতেই ২রা সেপ্টেম্বর রাত্রে ‘আজাদ’ আফিস গুণ্ডাদের দ্বারা আক্রান্ত হইল। ফলে ৩রা সেপ্টেম্বর ‘আজাদ’ বাহির হইতে পারিল না। হিন্দু সাংবাদিকরাই উদ্যোগী হইয়া সভা ডাকিলেন। অমৃতবাজার পত্রিকার চিত্তরঞ্জন এভিনিউস্থ সিটি আফিসে সম্পাদকদের এক বৈঠক হইল। প্রায় পঁচিশ জন সম্পাদক বৈঠকে যোগ দিলাম। সর্বসম্মতিক্রমে গুণ্ডাদের নিন্দা করা হইল। নির্বিবাদে আজাদ প্রকাশের সর্ব প্রকার ব্যবস্থা করার জন্য একটি সাব-কমিটি গঠিত হইল। ‘অমৃতবাজারের’ মিঃ তুষারকান্তি ঘোষ, ‘স্টেটসম্যানের মিঃ আয়ান স্টিফেন, স্বরাজের শ্রীযুক্ত সত্যেন মজুমদার, আনন্দবাজারের শ্রীযুক্ত চলাকান্ত ভট্টাচার্য ও ‘ইত্তেহাদের আমি সহ সকল সম্পাদকের স্বাক্ষরে এক আবেদন প্রচার করা হইল। ফলে ‘আজাদ’ নিয়মিত প্রকাশিত হইতে থাকিল। ইতিমধ্যে মহাত্মাজী অনশন-ব্রত গ্রহণ করায় দাঙ্গা প্রশমিত হইল। ৪ঠা সেপ্টেম্বর সুহরাওয়ার্দী সাহেবের হাতে কমলার রস খাইয়া তিনি অনশন ভাঙ্গিলেন। মোটামুটি শান্তি স্থাপিত হইল। ঈদ ও দূর্গাপূজা আসন্ন বলিয়া উভয় পর্ব যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধা হয়, তার জন্য লেখক-সাহিত্যিকদের পক্ষ হইতে মিঃ তারা শংকর বানার্জি, মিঃ পংকজ কুমার মল্লিক ও আমি একটি যুক্ত আবেদন প্রচার করিলাম।
সুহরাওয়ার্দী সাহেবের পাকিস্তানে না যাওয়াটা আমার ভাল লাগিতেছিলনা। আমার বিশ্বাস ছিল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসাবে সুহরাওয়ার্দী সাহেব করাচি গেলে ‘ইত্তেহাদ’ ঢাকায় নেওয়া শুধু সম্ভব হইত না ত্বরানিতও হইত। আজাদ’ ‘মনিং নিউ ইত্যাদি সরকার-সমর্থক কাগযগুলি ঢাকায় নেওয়ার সব ব্যবস্থাই হইয়া গিয়াছে সরকারী সমর্থনে। অথচ ইত্তেহাদ’ ঢাকায় জমি-বাড়ি যোগাড় করিয়াও শুধু বিজলি সরবরাহ ও টেলিপ্রিন্টার স্থাপনাদি ব্যাপারে সরকারী কোনও সহায়তা পাইতেছিল না। বরঞ্চ ‘ব্যান’ করিয়া তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হইতেছিল। আমার ও আমার সহকর্মী সকলের বিশ্বাস ছিল সুহরাওয়ার্দী সাহেব পাকিস্তানে গেলেই এর একটা সুরাহা হইত।
৩. সুহরাওয়ার্দীর সংগত অভিমান
কিন্তু তিনি কেন্দ্রের মন্ত্রিত্ব নিলেন না। কায়েদে-আযম ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খাঁর অনুরোধের জবাবে তিনি জানাইলেন ভারতীয় মুসলমানদের একটা হিল্লা না করিয়া তিনি ভারত ছাড়িতে পারেন না। তিনি এ ব্যাপারে কায়েদে-আযমের কাছে যেসব তার ও চিঠি দিয়াছিলেন, আমি তা দেখিয়াছিলাম। তাতে তিনি বলিয়াছিলেন : ‘আপনার সুদক্ষ পরিচালনায় পাকিস্তানের হেফাযত করিবার যোগ্য লোকের অভাব নাই। কারণ মুসলিম লীগের প্রায় সব নেতাই পাকিস্তানে চলিয়া গিয়াছেন। কিন্তু পিছনে-ফেলিয়া-যাওয়া বেচারা ভারতীয় মুসলমানদের হেফাযত করিবার কেউ নাই। আমাকে এদের সেবা করিতে দিন।’ কথাটা খুবই মহৎ। কিন্তু অনেকেই বলিতেন, এটা সুহরাওয়ার্দীর মনের কথা ছিল না। তিনি রাগ করিয়াই পাকিস্তানের মন্ত্রী হইতে অসম্মত হইয়াছিলেন। অপরের মত আমার নিজেরও এই সন্দেহই ছিল। কায়েদে আযম ও লিয়াকত খাঁর উপর রাগ করিবার, অন্ততঃ অভিমান করিবার, অধিকার সুহরাওয়ার্দীর ছিল। সুহরাওয়ার্দীর প্রতি বিরুদ্ধভাব নবাবযাদা লিয়াকতের বরাবরই ছিল। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুহরাওয়ার্দীর বদলে বাধ্য-অনুগত ভাল মানুষ খাজা নাযিমুদ্দিনকেই তিনি বেশি সমর্থন করিতেন। এসব কথা সুহরাওয়ার্দীর অজানা ছিল না। কিন্তু কায়েদে-আযমও এসব ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব করিবেন, এটা সুহরাওয়ার্দী কিছুতেই বিশ্বাস করিতেন না। কিন্তু দেখা গেল, কায়েদে-আযম-সুহরাওয়ার্দীর হক প্রাপ্য সমর্থনটুকুও তাঁকে দেন না। পাঞ্জাব ও বাংলা দুইটা প্রদেশই ভাগ হইয়াছিল। কিন্তু ভাগ হওয়ার ফলাফল দুই প্রদেশে এক হয় নাই। প্রদেশ ভাগের যুক্তিতে বাংলার মুসলিম লীগ ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইল এবং বিভক্ত মুসলিম লীগ পার্টির দ্বারা নয়া লীডার তথা প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ব্যবস্থা হইল। পাঞ্জাবের মুসলিম লীগও অখও রহিল। পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রীও বজায় থাকিলেন। এই এক যাত্রায় ভিন্ন ফলের কারণ সোজাসুজি এই যে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ লিয়াকত খাঁর বাধ্য-অনুগত ছিলেন না। লিয়াকত আলী খাঁ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। সবাই তাঁর বাধ্য-অনুগত। এতে কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট থাকিলেন না। পূর্ব-বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগকেও তাঁর ‘জি হুজুর তাবেদার’ করিতে চাহিলেন করিলেনও তিনি। সুহরাওয়ার্দীকে বাদ দিয়া প্রধানমন্ত্রী পূর্ব-বাংলায় যে তাবেদার জি হুজুর প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ পার্টি খাড়া করিলেন, তাঁদের ‘তাবেদারি পূর্ব বাংলাকে এবং পরিণামে পাকিস্তানকে কোথায় নিয়াছে, আজকার ইতিহাসই তার সাক্ষ্য দিতেছে এবং ভবিষ্যতেও দিবে।
তারপর সুহরাওয়ার্দীকে ডিংগাইয়া মিঃ ফযলুর রহমান, ডাঃ মালেক প্রভৃতি যাঁদেরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় নেওয়া হইতে লাগিল, তাতেই প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খা ও তাঁর সমর্থক কায়েদে-আযমের মনোভাব সুহরাওয়ার্দীর কাছে সুস্পষ্ট হইয়া গেল। এ অবস্থায় সুহরাওয়ার্দী যদি অভিমান করিয়া থাকেন, তবুও তাকে দোষ দেওয়া যায় না। বরঞ্চ তাঁকে উচ্চ প্রশংসা করিতে হয় এই জন্য যে তিনি কোনও অভিযোগ করিয়া তাঁর অসম্মতি জানান নাই। যুক্তি হিসাবে এক মহৎ আদর্শের কথাই বলিয়াছিলেন : অভিযোগ করাটা তাঁর আত্মসম্মানে বাধিত বলিয়াই তা তিনি করেন নাই।
৪. সুহরাওয়ার্দীর মিশন
গোড়াতে ‘ভারতীয় মুসলমানদের হেফাযত’ করাটা তাঁর অজুহাত মাত্র ছিল এটা ধরিয়া নিলেও পরে এটাই হইয়া উঠে সুহরাওয়ার্দী সাহেবের নিশা। তিনি শুধু নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া কলিকাতার হিন্দু দাঙ্গাকারীদের উদ্যত খড়গের সামনেই গলা বাড়াইয়া দেন নাই, তিনি উভয় রাষ্ট্রের মাইনরিটির রক্ষার জন্য মাইনরিটি চার্টারও রচনা করিয়াছিলেন। উহাতে উভয় রাষ্ট্রের নেতাদের দস্তখত লইবার জন্য দিল্লী-করাচি দৌড়াদৌড়িও করিয়াছিলেন। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে সাহস ও অধিকারবোধ জিয়াইয়া তুলার জন্য ১৯৪৭ সালের ৯ই ও ১০ই নবেম্বর তিনি ৪০নং থিয়েটার রোডস্থ নিজের বাসভবনে নিখিল ভারতীয় মুসলিম কনভেনশন নামে এক প্রতিনিধিত্বমূলক সম্মিলনীর অনুষ্ঠান করেন। ঐ সম্মিলনীতে মওলানা হত মোহানী প্রভৃতি মুসলিম লীগের সাবেক নেতৃবৃন্দ এবং স্বয়ং সুহরাওয়ার্দী সাহেব পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য হৃদয়স্পর্শী আবেদন করেন। মাইনরিটির অধিকার রক্ষার দাবি-দাওয়া করিয়া এবং সুস্লাওাদী-রচিত মাইনরিটি-চাটার মানিয়া লওয়ার জন্য উভয় রাষ্ট্রের সরকারকে সুরাধ করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।
সুহরাওয়ার্দী সাহেব শুধু সভা-সম্মিলনী করিয়াই ক্ষান্ত থাকেন নাই। তিনি নিজে যেমন উভয় রাষ্ট্রের সমঝোতার ব্যাপার লইয়া দিল্লী-করাটি দৌড়াদৌড়ি করেন, কলিকাতায় শেষ দিনগুলি তেমনি পশ্চিম বাংলার প্রধানমন্ত্রী ডাঃ প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ ও গবর্নর ডাঃ কৈলাস নাথ কাটজুকে পূর্ব বাংলার সফরে উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে পশ্চিম বাংলার উভয় নেতা ঢাকা আগমন করেন। উভয়েই বিরাট বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন। কলিকাতা বসিয়া আমরা সংবাদ পাই এবং সে সব সংবাদ ‘ইত্তেহাদে’ প্রকাশ করি যে লক্ষ-লক্ষ পাকিস্তানী জনতা পশ্চিম বাংলার ঐ দুই নেতাকে অভিনন্দন দেন এবং সোল্লাসে তাঁদের বক্তৃতা শুনেন। ডাঃ প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ নিজে ঢাকার লোক। নিজের ঋষি তুল্য মহৎ জীবনের জন্য তিনি মুসলমানদের কাছেও সমভাবে সম্মানিত ও জনপ্রিয় ছিলেন। আর ডাঃ কাটজু যুক্ত প্রদেশের মুসলিম কালচারে পুষ্ট আরবী-ফারসী উর্দুতে পণ্ডিত উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক হিন্দু। উভয়ে পূর্ব বাংলার জনতার কাছে আন্তরিক অভিনন্দন পাইয়াছিলেন এতে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
এই দুই উদার নেতার শাসনাধীনে পশ্চিম বাংলার মুসলমানরা আশাতিরিক্ত শান্তি, ও নিরাপত্তায় বাস করিতেছিল। এটা আমি নিজেকে দিয়াই বুঝিতেছিলাম। আমি কাল শিরওয়ানী পরিয়া বিক্ষুব্ধ হিন্দু জনতার সাথে ও মধ্যে ট্রামে চড়িয়া আলীপুর কোর্টে যাইতাম আসিতাম নিরাপদে ও নির্ভয়ে। পাশে বসা হিন্দু বন্ধুদের সাথে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ও হিন্দুস্থান-পাকিস্তান সম্পর্কে আলোচনা করিতাম মুক্তকণ্ঠে।
প্রধানমন্ত্রী ডাঃ ঘোষের অনুরোধে ও শহীদ সাহেবের উৎসাহে আমি নিজে কলিকাতা ও হাওড়ার মুসলিম ‘পকেট’গুলিতে যাইতাম বক্তৃতা করিয়া তাদের সাহস দিতে এবং দেশ ছাড়িয়া না যাইতে। যতদিন ডাঃ ঘোষ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ততদিন কলিকাতার মুসলমানদের মধ্যে একটা স্বস্তির ভাব আমি সর্বত্র লক্ষ্য করিয়াছি। কালাবাজারী ও মুনাফাখখারদেরে শাস্তি দিতে গিয়া দুর্ভাগ্যবশতঃ তিনি কংগ্রেস পার্টির মেজরিটির সমর্থন হারান। ১৯৪৮ সালের ১৫ই জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তাফা দেন। মুসলমানদের মধ্যে আবার ত্রাসের সঞ্চার হয়। ইতিমধ্যে সর্দার প্যাটেলের নির্দেশে পাকিস্তানকে নগদ টাকার অংশ প্রাথমিক ৫৫ কোটি টাকা দিতে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক অস্বীকার করে। ইহার এবং দিল্লীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিবাদে মহাত্মাজী আমরণ অনশন গ্রহণ করেন। তাতে আমরা কলিকাতার মুসলমানরা ভয়ানক উৎকণ্ঠিত হইয়া পড়ি। এ সময়ে ডাঃ ঘোষের মত লোক প্রধানমন্ত্রিত্বে ইস্তাফা দেওয়া মুসলমানদের জন্য সকল দিকেই অশুভ ঘটনা বলিয়া মনে হইল।
কিন্তু ২০শে জানুয়ারি ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় পশ্চিম বাংলার প্রধানমন্ত্রী হইয়াই কঠোর হস্তে সাম্প্রদায়িকতা দমন করেন এবং ডাঃ ঘোষের নীতি পুরাপুরি অনুসরণ করিয়া চলেন। তিনি আমাকে রাইটার্স বিল্ডিং-এ তাঁর চেম্বারে ডাকিয়া সকল প্রকার সাহায্য ও সহায়তার আশ্বাস দেন এবং সরকারের সাথে সহযোগিতা করিতে অনুরোধ করেন। ডাঃ ঘোষের সময় যেভাবে মুসলিম মহল্লায় সভা-সমিতি করিয়া বেড়াইতাম, পরিত্যক্ত মসজিদ মেরামত ও পুনর্বহাল করাইতাম, ডাঃ রায়ের আমলেও তাই করিতে লাগিলাম। বরঞ্চ ডাঃ রায়ের কাছে যেন আরও বেশি দরদ ও সহানুভূতি পাইলাম।
৫. বাস্তুত্যাগ-সমস্যা
এই সময়ে উভয় রাষ্ট্রের ভিতরকার সম্পর্কের মধ্যে বাত্যাগ সমস্যাটাই ছিল সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অংকশাস্ত্রের দিক দিয়া হিন্দুস্থানের চেয়ে পাকিস্তানের জন্যই ছিল এটা অধিকতর সমস্যা-সংকুল। আদম-এওয়াজের স্কিম বাটোয়ারার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কিন্তু যে মনোভাব ও প্রচার-প্রচারণার মধ্যে দেশ ভাগ হইয়াছে, সে পরিবেশে বাস্তুত্যাগ দুর্নিবার হইয়া উঠিবে, এটা নেতাদের অল করিয়া ভাবা উচিৎ ছিল। এক দিকে জিন্ন সাহেব অপরদিকে গান্ধী-নেহরুর মত উদার ও উঁচুস্তরের লোকদের পক্ষে অমন বলা বা চিন্তা করা সম্ভব নাও হইতে পারে কিন্তু সাধারণ মানুষের কথাটাই বলিয়াছিলেন সর্দার প্যাটেল। তিনি বলিয়াছিলেন : যারা পাকিস্তান চাহিয়াছিল পাকিস্তান পাওয়ার পর তাদের কারও হিন্দুস্থানে থাকার অধিকার নাই। কথাটা অন্যায় নয়, অসঙ্গত নয়, অযৌক্তিক নয়। কিন্তু পার্টিশনের সময়েই সর্দারের এ কথা বলা উচিত ছিল। আর ভাবা উচিৎ ছিল পাকিস্তানের নেতাদেরও। তা যখন হয় নাই, তখন একমাত্র কর্তব্য হইল বলা : ‘যে যেখানে আছ, সেখানেই থাক’। গান্ধীজিন্না তাই বলিয়াছিলেন : দুই সরকারও সেই নীতির কথাই ঘোষণা করিয়াছিলেন। কিন্তু আমার ঐ সময়ে মনে হইয়াছিল, ঐ সুন্দর নীতিটাকে কাজে-কর্মে পালন করিতেছিলেন সরকার হিসাবে একমাত্র পশ্চিম বাংলা সরকার, আর ব্যক্তি হিসাবে একমাত্র শহীদ সুহরাওয়ার্দী।
এই ব্যাপারে এবং এই সময়ে পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ দুইটা গুরুতর পরীক্ষার সম্মুখীন হইয়াছিলেন। দুইটা ব্যাপারেই শহীদ সাহেবের সুস্পষ্ট অভিমত ছিল এবং তিনি তা সংবাদপত্রে বিবৃতি মারফত প্রকাশও করিয়াছিলেন। এক, পাকিস্তান হাসিল হওয়ার পর পাকিস্তানের জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নাম আর মুসলিম লীগ থাকা উচিৎ নয়। দুই, পাকিস্তানের হিন্দুদের রাজনৈতিক আনুগত্য বিচারে উদার বাস্তব দৃষ্টি অবলম্বন করা উচিৎ।
৬. মুসলিম লীগ বনাম ন্যাশনাল লীগ
প্রথমতঃ নিখিল ভারত মুসলিম লীগই পাকিস্তান হাসিল করিয়াছে। সত্য, কিন্তু পাকিস্তান হাসিলের পর ইহা বিদ্যমান থাকা উচিৎ নয়। এখন ইহা ভাঙ্গিয়া দিয়া পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ স্থাপন করা দরকার। সে লীগে অমুসলমান পাকিস্তানীদের প্রবেশাধিকার থাকা আবশ্যক। ইহা কায়েদে-আযমের মত বলিয়া তৎকালে পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের জানা ছিল। অনেকের মতও তাই ছিল বলিয়া শোনা যাইত। কিন্তু সুহরাওয়ার্দী সাহেবই প্রথম সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়া এই মত দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। কথাটা স্পষ্টতঃই যুক্তিসঙ্গত। সুতরাং তাঁর বিবৃতিতে সেই সুস্পষ্ট যুক্তিটারই উপর জোর দেন। পাকিস্তান হাসিল করিয়াছে মুসলিম লীগ ঠিকই; মুসলমানদের দাবিতেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তাও ঠিক। কিন্তু আদম-এওয়াজ না হওয়ায় এবং দাবিটাও সেরূপ না থাকায় পাকিস্তানে যেমন অনেক হিন্দু আছে, ভারতেও তেমনি অনেক মুসলমান রহিয়াছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে উভয় রাষ্ট্রেই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকার করিতে গেলেই জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িক হইতেই হইবে। ভারতের যেমন ন্যাশনাল কংগ্রেস আছে, পাকিস্তানেরও তেমনি ন্যাশনাল লীগ করিতে হইবে, কথাটা যুক্তিসঙ্গত এবং কায়েদে আযমের মতও তাই; এই ধারণায় আরো অনেক মুসলিম নেতা শহীদ সাহেবের এই মত সমর্থন করেন। কিন্তু সকলকে বিস্মিত করিয়া আমি শহীদ সাহেবের এই মতের প্রতিবাদ করি শহীদ সাহেবের কাগ্য ‘ইত্তেহাদেই’। ‘ইত্তেহাদের’ সম্পাদক হিসাবেই। ইত্তেহাদ শহীদ সাহেবের সমর্থন করিবে এটাত জানা কথা। কিন্তু এইবারই পাঠকরা প্রথম জানিতে পারিলেন যে “ইত্তেহাদের’ সম্পাদকের সত্যই স্বাধীনতা ছিল। এর আগে আমি কতবারই না কতজনকে বলিয়াছিলাম শহীদ সাহেবের কাগযের আমি মাইনা করা সম্পাদক হইলেও তিনি কোনও দিন আমার লেখায় হস্তক্ষেপ করেন নাই; আমার মতামত প্রভাবিত করিবার চেষ্টাও কোনদিন করেন নাই। কিন্তু বন্ধুরা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করেন নাই। বন্ধুবর আবুল হাশিমের মত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির লোকও আমার স্বাধীনতায়’ আস্থা স্থাপন করেন নাই। ১৯৪৭ সালের গোড়ার দিকে মওলানা আকরম খাঁ মুসলিম লীগের সভাপতিত্বে ইস্তফা দেন। হক, সাহেব ও হাশিম সাহেবের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। ‘ইত্তেহাদে’ আমি হক সাহেবকে সমর্থন করি। হাশিম সাহেব তখন শহীদ সাহেবের রাজনৈতিক জুড়ী এবং দোর্দণ্ড প্রতাপ লীগ নেতা। তাঁকে ফেলিয়া হক সাহেবকে সমর্থন করায় হাশিম সাহেব মনে করিলেন, শহীদ সাহেবই আমাকে দিয়া হক সাহেবকে সমর্থন করাইতেছেন। আমি এই যে বুঝাইলাম, শহীদ সাহেব কোনও দিন আমার সম্পাদকীয় কর্তব্যে হস্তক্ষেপ করেন না, ইশারা-ইঙ্গিতেও আমার মতামত প্রভাবিত করেন না। কোনও কথাই হাশিম সাহেব বিশ্বাস করিলেন না। হাশিম সাহেবের সন্দেহ ভঞ্জনের জন্য শহীদ সাহেব নিজে চেষ্টা করিলেন। তাও তিনি বিশ্বাস করিলেন না।
১৯৪৭ সালের শেষের দিকে যখন ‘ইত্তেহাদে’ শহীদ সাহেবের বিবৃতি ছাপিয়া সেই সংখ্যাতেই এবং পরবর্তী কয়েক সংখ্যায় শহীদ সাহেবের প্রতিবাদে সম্পাদকীয় লেখা হয় মাত্র তখনই হাশিম সাহেব সহ বন্ধুরা স্বীকার করেন, হাঁ, শহীদ সাহেবের ‘ইত্তেহাদে’ সম্পাদকের স্বাধীনতা আছে। শহীদ সাহেব নিজে তাতে দুঃখিত হন নাই। কিন্তু হাশিম সাহেব হইয়াছিলেন। বছরের গোড়ার দিকে তিনি আমার নিন্দা করিয়াছিলেন শহীদ সাহেবকে মানার অপরাধে; এখন তিনি আমার নিন্দা করিলেন শহীদ সাহেবকে না মানার অপরাধে। কারণ পাকিস্তান মুসলিম লীগের বদলে ন্যাশনাল লীগ করার তিনিও পক্ষপাতি ছিলেন।
মুসলিম লীগ ভাঙ্গিয়া দিয়া ন্যাশনাল লীগ করার পক্ষে যত যুক্তি আছে, তার একটারও বিরুদ্ধতা আমি করি নাই। বরঞ্চ ঐ সব যুক্তির আমি পূর্ণ সমর্থক। আমার যুক্তিটা ছিল সময়ের ব্যাপারে সীমাবদ্ধ। আমার বক্তব্য ছিল মুসলিম লীগ ভাঙ্গিবার সময় এখনও আসে নাই। পাকিস্তান হাসিল করাতেই মুসলিম লীগের কার্য শেষ হয় নাই। পাকিস্তানের কনস্টিটিউশন না হওয়া পর্যন্ত সে কৰ্তব্য শেষ হইবে না। আমার যুক্তি ছিল এই : পাকিস্তান-সংগ্রামে মুসলিম লীগ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় রূপের কোন নির্দিষ্ট কাঠামো দেয় নাই। এটা না করিয়াই যদি মুসলিম লীগ আত্ম-বিলোপ করে তবে সেটা হইবে যুদ্ধ জয় করিয়া শান্তি প্রতিষ্ঠার আগেই সৈন্যবাহিনী ডিমবিলাইজ করার মত। আমি ওটাকে পলিটিক্যাল এসকেপিযম’ বলিয়াছিলাম। রাষ্ট্রীয় রূপ দেওয়ার আগে পাকিস্তান ছিল মাত্র একটি ভূখন্ড। এই ভূখন্ড পাইয়াই মুসলিম লীগ সরিয়া পড়িতে পারে না। জনগণকে পাকিস্তানের কত ভাবাবেগপূর্ণ রঙ্গিন চেহারা দেখাইয়া পাকিস্তানের পক্ষে ভোট লওয়া হইয়াছে। সে রাষ্ট্রের রূপ দিয়া জনগণের অধিকারকে শাসনতন্ত্রে বিধিবদ্ধ না করিয়া মুসলিম লীগ যদি সরিয়া পড়ে তবে সেটা হইবে বিট্রেয়াল। সেজন্য আমি প্রস্তাব করিয়াছিলাম : পাকিস্তানের একটি গণতান্ত্রিক
কলিকাতায় শেষ দিনগুলি শাসন রচনার সঙ্গে-সঙ্গে গণ-পরিষদ এবং মুসলিম লীগ এক সাথে আত্ম বিলোপ করিবে। তার আগে নয়। আমার সম্পাদকীয় শুনিয়া শহীদ সাহেব অসন্তুষ্ট ত হনই নাই, বরঞ্চ বলিয়াছিলেন : তোমার কথায় জোর আছে।
৭. মাইনরিটির আনুগত্য
দুই, পাকিস্তানের অমুসলমানদের আনুগত্য সম্বন্ধে শহীদ সাহেব দূরদর্শী জাতীয় নেভার যোগ্য কথাই বলিয়াছিলেন : সকল এলাকা ও অঞ্চলের হিন্দুরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধ করিয়াছিল নীতি হিসাবে। পাকিস্তান স্থাপিত হওয়ার পর কাজেই হিন্দুরা সাধারণভাবে সন্দেহের পাত্র হইয়া পড়ে। ওরা কি পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকিবে? এমন সন্দেহ স্বাভাবিক। প্যাটেলপন্থীদের যুক্তি পাকিস্তানী হিন্দুদের প্রতিও প্রযোজ্য একথা মনে করাও অস্বাভাবিক নয়। যারা পাকিস্তান চাহিয়াছিল, তাদের যদি হিন্দুস্থানে থাকার অধিকার না থাকে, তবে যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধ করিয়াছিল, তাদের পাকিস্তানে থাকা উচিত নয়। এটা সাধারণ লজিক। কিন্তু সুহরাওয়ার্দী বিবৃতি দিয়া বলিলেন : পাকিস্তানের হিন্দুদের বেলা এ যুক্তি চলিবে না। তিনি বলিলেন, হিন্দুস্থানের মুসলমানও পাকিস্তানের হিন্দুর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রহিয়াছে। যুক্ত প্রদেশ ও মাদ্রাজ ইত্যাদি হিন্দু-প্রধান অঞ্চলের মুসলমানরা যখন পাকিস্তান দাবি করিয়াছিল, তখন তারা জানিয়া-বুঝিয়াই করিয়াছিল যে তাদের বাসস্থান পাকিস্তানে পড়িবে না। কাজেই তারা মনের দিক দিয়া প্রস্তুত ছিল? হয় তারা বাস্তৃত্যাগ করিয়া পাকিস্তানে চলিয়া যাইবে, নয় ত হিন্দুস্থানের বাসিন্দা হিসাবে নিজ নিজ বাসস্থানে থাকিয়া যাইবে। কিন্তু পাকিস্তানের হিন্দুদের বেলা তা বলা চলে না। পূর্ব বাংলার বা পশ্চিম পাঞ্জাবের হিন্দুরা মনের দিক দিয়া প্রস্তুতির সময় পায় নাই। শেষ পর্যন্ত তারা আশা করিয়াছিল, দেশ ভাগ হইবে না। কাজেই তাদের বাস্তুত্যাগ বা আনুগত্য পরিবর্তনের কোনও প্রশ্নই উঠে নাই। এখন যখন দেশ ভাগ হইয়া হিন্দুস্থান-পাকিস্তান হইয়া গিয়াছে, তখন হিলুদিগকে মনের দিক দিয়া প্রস্তুত হইবার উপযুক্ত সময় দিতে হইবে। যে সব হিন্দু দেশ ভাগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান ত্যাগ করে নাই, ধরিয়া নিতে হইবে তারা পাকিস্তানী হইতে চায়; দেশ ভাগের মানসিক ধাক্কা সামলাইয়া মনের দিক দিয়া পাকিস্তানী হওয়ার জন্য তাদের সময় দিতে হইবে। এখনই এই মুহূর্তে তাদের আনুগত্য লইয়া খোঁচাখুঁচি ঝাঁকাঝাঁকি করা অন্যায় হইবে। হিন্দুরা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানী হইবে কি না, এটা শুধু তাদের মনের উপর নির্ভর করে না; মুসলমানদের ব্যবহারের উপরও অনেকখানি নির্ভর করে। পাকিস্তানকে মুসলমানরা শুধু মুসলমানের দেশ মনে করে কি না, হিন্দুরা পাকিস্তানে সমান অধিকার লইয়া সসম্মানে থাকিতে পারিবে কি না, এ সব বিচার করিতে সময়ের দরকার। হিন্দুদেরে সে সময় দিতে হইবে এবং ইতিমধ্যে মুসলমানদেরও নিজের কর্তব্য পালন করিতে হইবে।
৮. বাস্তুত্যাগে পাকিস্তানের বিপদ
সুহরাওয়ার্দীর এই সব যুক্তি সাধারণ মানবতার দিক দিয়া অকাট্য ন্যায়-ত যুক্তিসঙ্গত ত ছিলই, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা হিসাবেও অবশ্য পালনীয় ছিল। পাকিস্তানের জন্য আরও বেশি ছিল। উভয় রাষ্ট্রই থিওরেটিক্যালি নয়া রাষ্ট্র হইলেও পাকিস্তান ছিল বাস্তবিকই নয়া। শাসনতন্ত্র, অর্থনীতি, শান্তি রক্ষা ও দেশ রক্ষা সব দিক হইতেই পাকিস্তানকে গড়িতে হইতেছিল একদম অ আ ক খ হইতে; ইংরেজীতে যাকে বলা হয় ফ্রম দি স্ক্র্যাচ। এই সময় তার জটিল সমস্যাকে আরও জটিল করিয়া তুলিতেছিল লক্ষ লক্ষ লোকের বাস্তুত্যাগ। বাস্তুত্যাগীদের পুনর্বাসন উভয় রাষ্ট্রের জন্যই ছিল একটা বিরাট ও বিপুল সমস্যা। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য ছিল এটা অনেক বেশি জটিল। তার উপর যদি সব মুসলমান বা তাদের অধিকাংশ ভারত ছাড়িয়া, পাকিস্তানে আসা শুরু করে, তবে তাদেরে সামলানো পাকিস্তানের পক্ষে কার্যতঃ অসম্ভব হইয়া পড়িবে। বস্তুতঃ চরম সাম্প্রদায়িকতাবাদী একদল হিন্দু সর্দার প্যাটেলের আশকারা পাইয়া সব মুসলমানকে এক সঙ্গে তাড়া করিয়া পাকিস্তানে ঠেলিয়া দিয়া পাকিস্তান ডুবাইয়া দিবার কথাও তুলিয়াছিল। ‘ট্রাংকেটেড’ ‘মথইটেন’ ছাঁটাই-করা পোকায়-খাওয়া পাকিস্তানের ক্ষুদ্রায়তনের ভূখণ্ডকে এরা জলে-ভাসা যাত্রী ভর্তি ছোট নৌকার সাথে তুলনা করিতেছিল। তারা বিশ্বাস করিত এই যাত্রীভর্তি তল-তলায়মান নৌকায় জোর করিয়া আরও কিছু যাত্রী তুলিয়া দিলেই এ নৌকা ডুবিয়া যাইবে। কথাটা নিতান্তই বাজে কথা ছিল না। দশ কোটি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে মাত্র ছয় কোটি লইয়া পাকিস্তান হইয়াছিল। বাকী চার কোটিই হিন্দুস্থানে ছিল। কাজেই বাস্তুত্যাগীর চাপে পাকিস্তান খতম করার আশা একদল পাকিস্তান-বিরোধীর মাথায় আসিয়াছিল। গান্ধী-নেহরু আজাদের দূরদর্শিতায় এবং তাঁদের সত্যিকার অনুসারীদের সহায়তায় এ বিপর্যয় ঘটিতে পারে নাই। পাকিস্তানের পক্ষ হইতে পরিপূরক নীতি অনুসৃত না হইলে এ বিপর্যয় ঠেকানো যাইত না। নেহরু-লিয়াকত চুক্তি এই সুষ্ঠু দূরদর্শী নীতির দলিল। কিন্তু সুহরাওয়ার্দীর দুঃখ ছিল, পাকিস্তান সরকার অনেক দেরিতে এই নীতির মূল্য ও তাৎপর্য উপলব্ধি করিয়াছিলেন। সুহরাওয়ার্দীর ৪৭-৪৮ সালের শান্তি মিশন ও শান্তি-সেনা পরিকল্পনা ছিল মূলতঃ এবং প্রধানতঃ পাকিস্তানের কল্যাণের স্কিম। দুই বাংলার মধ্যে শান্তি রক্ষা করিয়া বাস্তুত্যাগ বন্ধ করা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জীবন-মরণের প্রশ্ন। নাযিমুদ্দিন মন্ত্রিসভায় অদূরদর্শী ক্ষুদ্রতা সুহরাওয়ার্দীর ঐ দূরদশী নীতি কার্যকরী করিতে দেয় নাই। তার জের আমরা আজও টানিতেছি।
মহাত্মাজীর হত্যায় ভারতীয় মুসলমানদের মনে আরেকটা আচমকা সাংঘাতিক ধাক্কা লাগে। পাকিস্তানী নেতাদের জন্য ছিল এটা একটা হুশিয়ারি। তবু তাঁরা হুশিয়ার হন নাই।
৯. মহাত্মাজীর নিধন
১৯৪৮ সালের ৩০শা জানুয়ারি বিকাল চারটায় চৌরঙ্গির মোড়ে বেড়াইতেছিলাম। বেড়াইতেছিলাম মানে পুস্তকের দোকান হইতে দোকানান্তরে বই হাতাইয়া ফিরিতেছিলাম। বিভিন্ন বই-এ তরা এই সব বুক স্টলে পুস্তক দেখিয়া বেড়ানো ছিল আমার চিরকালের অভ্যাস। বেশির ভাগ সময় অবশ্য আমি ফুটপাতের পুরান পুস্তকের দোকানে ঘুরিতাম। ফুটপাতের দোকানদাররা প্রায় সবাই ছিল মুসলমান। সাম্প্রতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় এদের দোকান আর তেমন বসে না। সেজন্য চৌরঙ্গির নয়া পুস্তকের দোকানগুলিই এখন আমার প্রধান হামলা স্থল। কিনার চেয়ে অবশ্য হাতাইতামই বেশি। কিন্তু তাতে কোনও অসুবিধা হইত না। দোকানদাররা আমাকে কিছু বলিত না। একটানা বার বছর ধরিয়া এই সব দোকানের লোকেরা কালা-শেরওয়ানী-পরা এই লোকটাকে তাদের দোকানে দেখিয়া আসিতেছে। কিছু কিছু লোক আমাকে ‘উকিল ছাব’ বা এডিটর ছাব’ বলিয়া জানিত। নাম কেউ জানিত না। তবু তাদের নিজস্ব পন্থায় আমার সম্মান করিত অর্থাৎ দেখিতে চাহিলে যে-কোন বই দেখাইত যদিও জানিত শেষ পর্যন্ত আমি ঐ বইটা কিনিবনা। একেবারে যে কিনিতাম না, তাও নয়। শ টাকার বই ঘাটিয়া শেষ পর্যন্ত আট-আনা-এক টাকার একখানা অবশ্যই কিনিতাম। তাও আবার সব দিন নয়। এ অভ্যাস আমার তাদের মুখস্থ হইয়া গিয়াছিল। আমাকে দেখিলেই তারা মুচকি হাসিয়া এ-ওর দিকে চাহিত। আমাকে দেখিয়া তারা যে হাসিতেছে, তা আমিও বুঝিতাম। কিন্তু গায় মাখিতাম না। আমিও হাসিতাম। কারণ তারা বলিত : ‘আই এ ছাব’। মনে মনে বোধ হয় বলিত : দু’চারঠো দেখুকে চলে যাই এ ছাব।’
এমনি এক পুস্তকের দোকানে ঐদিনও পুস্তক ঘাটিতেছিলাম। পিছনের কুঠরি হইতে একজন বাহির হইয়া আমাকে দেখিয়া হাত তুলিয়া সালাম করিল এবং বলিল : ছোনা সাব, গান্ধীজীকো ত গুলি মারা।
আমি এইরূপ চিৎকার করিয়া বলিলাম : ক্যা কাহা।
দোকানদার তার কথা রিপিট করিল।
‘কাহাঁ ছোনা, কৌন কাহা?’ আমি জিজ্ঞাস করিলাম।
‘আবহি রেডিও মে বোলা’। দোকানদারবলিল।
‘যিন্দা হ্যাঁয় ইয়া মারা গ্যায়ে?’ শেষ আশা লইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম।
দোকানদার বলিল : রেডিওতে তা বলে নাই।
আমি বেহুশের মত এসপ্ল্যানেডে ফিরিয়া আসিলাম।
ট্রামে উঠিলাম। পার্ক সার্কাস ট্রামে চড়িয়া বুঝিলাম, ট্রাম-যাত্রীরা কেউ কিছু জানেনা। বলিলাম না কিছু। যদি উত্তেজনা দেখা দেয়। বলিয়া যদি ভুল বুঝাবুঝির ভাগী হই।
আফিসে ফিরিয়া আগে নিউডিপার্টে গেলাম। টেলিপ্রিন্টারে নিউ তখনও আসে নাই। নিজেই খবরটা ঘোষণা করিলাম। কোনও আলোচনায় যোগ না দিয়া নিজের কামরায় আসিলাম। টেবিলের উপর মাথায় হাত রাখিয়া চিন্তা করিতে লাগিলাম।
অল্পক্ষণ মধ্যেই টেলিফোন আসা শুরু হইল। কিছুক্ষণ পরেই লোকের ভিড় হইতে লাগিল। লোক মানে মুসলমান। পার্ক সার্কাস মুসলমান এরিয়া। এখানকার নেতৃস্থানীয় লোকেরা ত বটেই, দূর-দূরান্তের মুসলিম নেতারাও আসিয়া ‘ইত্তেহাদ’ আফিসে ড্ডি জমাইলেন। আমার সহকর্মী বন্ধুরা যথাসম্ভব লোকজনকে নিচে হইতেই বিদায় করিতে লাগিলেন। কিন্তু কলুটোলা-যাকারিয়া স্ট্রিটের একদল বড় লোক নেতাকে আমার কামরায় আসিতে না দিয়া পারিলেন না। এরা সকলে মোটর চড়িয়া আসিয়াছেন। কুড়ি-পঁচিশ জনের কম হইবে না। অত চেয়ার আমার কামরায় ছিল না। প্রায় আধাআধি লোক দাঁড়াইয়া থাকিলেন। আমি চেয়ার আনাইতে চাহিলে তাঁরা দৃঢ়ভাবে মানা করিলেন। কাজেই অর্ধেক বসা-অর্ধেক খাড়া অবস্থায় আলোচনা শুরু হইল।
এঁদের নেতা নাখোদা মসজিদের পেশ-ইমাম সাহেব। বড় আলেম। তেমনি বড় পাগড়ি। ইতিমধ্যে টেলিপ্রিন্টারে বিস্তারিত বিবরণ আসিয়া পড়িয়াছিল। সব তাদেরে শুনাইলাম। সব শুনিয়া পেশ ইমাম সাহেব বলিলেন : ‘গান্ধীজী ত মারা গ্যায়ে, আর মুসলমানোঁকা ক্যা হোগা?’
প্রশ্নটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। মুসলমানরা গান্ধীজীকে এতটা বিশ্বাস করিত। এমনি আশ্রয়স্থল মনে করিত তাঁকে! এই মাত্র পনর দিন আগে আমরণ অনশনব্রত করিয়া তিনি দিল্লী ও উপকণ্ঠের মুসলমানদের জীবন রক্ষা করিয়াছেন। হিন্দুদের-হাতে-ভাঙ্গা মসজিদগুলি তাদেরে দিয়াই মেরামত করাইয়াছেন। পাকিস্তানের প্রাপ্য পঞ্চান্ন কোটি টাকা দেওয়াইয়াছেন। সেই মহাত্মাজীই আজ আততায়ীর গুলিতে নিহত হইলেন মুসলমানদের পক্ষ নেওয়ার অপরাধে। কাজেই স্বাভাবিক প্রশ্নঃ ‘আব মুসলমানোঁকা ক্যা হোগা?
আমার অজ্ঞাতে বিনা চিন্তায় আমার মুখ হইতে বাহির হইয়া পড়িল। ‘মহাত্মাজী মারা গ্যায়ে ছহি, লেকেন আল্লা ত নেহী মরা।’
সবাই স্তম্ভিত হইলেন। আমি নিজেও। অন্য সবার মত, তাঁদেরই সাথে, আমার মুখে আমিও ঐ কথাটা শুনিলাম। তার আগে আমিও জানিতাম না, ঐ কথাটাই আমি বলিতেছি। বাস্তবতার ক্ষেত্রে ও-কথার কোনও অর্থ হয় না। কাজেই পেশ-ইমামের প্রশ্নের জবাব ওটা নয়। তবু ওটা ছাড়া বলিবার ছিলইবা কি? চরম বিপদে মুসলমানের মুখে ও-কথা ছাড়া আর কি আসিতে পারে?
তবু পেশ-ইমাম সাহেবের মনেই কথাটা আছর করিল বেশি। অত বড় ভারত বিখ্যাত আলেম। অত বড় পাগড়ি! অত লম্বা দাড়ি। তিনি ভাবিতেও বোধ হয় পারেন নাই, এই দাড়ি-মোচ-মুড়ানো নাংগা-ছের ইংরাজী-দাঁ খুব-সম্ভব-বেনামাযী একটা লোকের মুখে অমন কথা শুনিবেন। কিন্তু বিস্মিত হওয়ার চেয়ে তিনি লজ্জা পাইলেন বেশি। তাঁর চোখে-মুখে তা স্পষ্ট ফুটিয়া উঠিল। তিনি নিজের সঙ্গীদের উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন : এডিটর সাহেব ছহি বাৎলাইয়াছেনঃ মুসিবত দিয়াই আল্ল মোমিনের ঈমানের জোর পরখ করেন। এর পর যা কথাবার্তা হইল, তার প্রতিক্রিয়া খুবই ভাল হইল। চিন্তাকূল ভীতিগ্রস্ত বিষণ্ণ মুখে যারা আসিয়াছিলেন, আশাপূর্ণ আশ্বস্ত হাসিমুখে তাঁরা ফিরিয়া গেলেন।
১০. আমার নযরে গান্ধী
মহাত্মাজীকে আমি কতটা ভালবাসিতাম, ঐদিনের আগে আমি নিজেও তা বুঝিতে পারি নাই। মহাত্মাজীর জীবন-দর্শন এবং তাঁর রাজনৈতিক মতবাদও আমাকে অনেকখানি প্রভাবিত করিয়াছিল। এতটা করিয়াছিল যে ১৯৪২ সালে কোন এক সময়ে আমার কমিউনিস্ট বন্ধুদের সাথে তর্কে-তর্কে বলিয়া ফেলিয়াছিলাম; গান্ধীম ইয এ্যান ইমপ্রুভমেন্ট আপ-অন মার্কসিযম। অনেকখানি কনভিকশন লইয়াই ও-কথা বলিয়াছিলাম। আজও তাঁর মৃত্যুর বিশ বছর পরেও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আমার অটুট আছে। কিন্তু সেদিন তাঁর অমন মৃত্যুতে আমি যেন নেতৃবৃন্দসহ সমগ্র ভারতবাসীর উপর সাধারণভাবে এবং হিন্দুদের উপর বিশেষভাবে ক্ষেপিয়া গিয়াছিলাম। আমার এই ক্ষেপামি কতদূর গিয়াছিল, তা প্রকাশ করিয়াছিলাম এক প্রবন্ধে। সে প্রবন্ধ ‘ইত্তেহাদের সম্পাদকীয় নয়, পশ্চিম বাংলা সরকারের প্রকাশিত এক পুস্তকে। মহাত্মাজীর হত্যার স্মারকস্বরূপ পশ্চিম বাংলা সরকার একখানা পুস্তক প্রকাশ করেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী শ্রীযুক্ত প্রফুল্ল সেনের উদ্যোগে ও সম্পাদনায় এই পুস্তক লেখা হয়। চৌদ্দ-পনর জন সাহিত্যিকের সঙ্গে আমারও একটি লেখা নেওয়া হয়। আমার লেখাটিকেই তিনি প্রাপ্যাধিক সম্মানের স্থান দেন। ঐ প্রবন্ধে আমি গোটা হিন্দু জাতিকে কষিয়া গাল দিয়াছিলাম। বলিয়াছিলামঃ হিন্দু জাতির নীচতাই মহাত্মাজীর উচ্চতার প্রমাণ। রোগ যত কঠিন হয়, তত বড় ডাক্তার দরকার হয়। মহাত্মা গান্ধী এমন মুনি-ঋষি-তুল্য মহৎ ব্যক্তি ছিলেন যে আফ্রিকার জঙ্গলে যদি তিনি খালি গায় খালি পায় খালি হাতে বেড়াইতেন, তবে সেখানকার বাঘ-ভালুক ও সাপ-বিচ্ছও তাঁকে আঘাত করিত না। তেমন মহাপুরুষের গায় হাত দিবার, তাঁকে খুন করিবার, লোক হিন্দু সমাজ ছাড়া আর কোন মানব-গোষ্ঠীতে পাওয়া যাইত না। এতে প্রমাণিত হইল যে হিন্দু জাতি মানব জাতির মধ্যে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট। সেই সঙ্গে এটাও প্রমাণিত হইল যে মহাত্মাজী বর্তমান বিশ্বের মহত্তম ও উচ্চতম মহাপুরুষ। কারণ আল্লা নিকৃষ্টতম অধঃপতিত জাতির চিকিৎসার জন্য নিশ্চয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষই পাঠাইয়াছিলেন।
এই কঠোর গালাগালির জন্যই নাকি আমার প্রবন্ধকে সম্মানের স্থান দেওয়া হইয়াছিল। প্রফুল্ল বাবু নিজে ও আরও বহু হিন্দু নেতা ও লেখক-সাংবাদিক মুখে ও টেলিফোনে আমাকে মোবারকবাদ দিয়াছিলেন। রাগটা কিছু কমিলে আমি বুঝিয়াছিলাম, হিন্দুস্থানে বসিয়া হিন্দু জাতিকে এমন গাল দিয়া সম্মান ও তারিফ কলিকাতায় শেষ দিনগুলি পাইলাম। মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমন কথা বলিলে তা পাকিস্তানেই থোক, আর হিন্দুস্থানেই হোক, মহাত্মাজীর পিছে-পিছেই আমাকে দুনিয়া ত্যাগ করিতেই হইত। কাজেই শেষ পর্যন্ত বুঝিলাম ও হিন্দু সমাজ নীচ বটে কিন্তু সে নীচতা বুঝিবার মত উচ্চতাও তাদের আছে।
গান্ধী-ভক্তি দেখাইতে গিয়া কায়েদে-আযমকেও আমি ছাড়িয়া কথা কই নাই। মহাত্মাজীর মৃত্যু উপলক্ষে শোক-বাণীতে কায়েদে-আযম বলিয়াছিলেন : ‘ভারত একজন মহান হিন্দু হারাইল। আমি ইত্তেহাদের সম্পাদকীয় প্রবন্ধে বলিলাম : কায়েদে-আযমের বলা উচিৎ ছিল : মহাত্মাজীর হত্যায় পাকিস্তান হারাইল একজন ফ্রেণ্ড, দুনিয়া হারাইল একজন ফিলোসফার, আর ভারত হারাইল একজন গাইড। তিনি সত্য-সত্যই এদের একজন ফ্রেণ্ড, ফিলোসফার ও গাইড ছিলেন। ইতিহাস বরাবরই এ সাক্ষ্য বহন করিবে।
১১. আহত সিংহ
‘ইত্তেহাদ’ আফিসের খুবই কাছে একই পার্কস্ট্রিটের অপর পাশে হক সাহেবের বাসা। পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকাতে সমগ্র রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও রাষ্ট্র-নেতারাও চলিয়া আসিয়াছেন। হক সাহেব আমাদের মতই তখনও কলিকাতায় পড়িয়া আছেন। পাকিস্তান-প্রস্তাবের প্রস্তাবক হইয়াও তিনি শেষ পর্যায়ে জিন্না সাহেবের সাথে ঝগড়া করিয়া মুসলিম লীগ হইতে বাহির হইয়া যান। পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধী আখ্যায়িত হন। জিন্না সাহেব বলেন : ‘ফযলুল হকের কপালে ওয়াটারলু (চরম পরাজয় ও রাজনৈতিক মৃত্যু) ঘটিয়াছে। যারা ফযলল হককে জানিত তারা এটাও জানিত যে শেরে-বাংলার মৃত্যু ঘটে নাই। বাংলার সিংহ আসলে সাংঘাতিক আহত হইয়া তখন নিজের ঘা চাটিতেছিলেন। ইংরাজীতে বলা হয় : লায়ন লিকিং হিজ উণ্ডস্। সিংহ চাটিয়াই নিজের ঘা শুকায়। ১১৬নং পার্কস্ট্রিটে বসিয়া-বসিয়া বাংলার সিংহ তখন তাই করিতেছিলেন। অবসর কাটাইবার জন্য তিনি প্রায়ই বিকালে আমার রুমে আসিয়া গল্প-গোযারি করিতেন। একদিন কথা-প্রসঙ্গে বলিলাম : আপনের মত জনপ্রিয় নেতা বাংলায় আর একজনও ছিলেন না। এমন একদিন ছিল যেদিন আপনে ইন্তেকাল করলে আপনের জানাযায় লক্ষ লোক হৈত। আজ খোদা-না-খাস্তা আপনে এন্তেকাল করলে পাঁচশ লোকও হৈব কি না সন্দেহ।
হক সাহেব তাঁর স্বাভাবিক ছাত-ফাটা হাসি হাসিয়া বলিলেন : তোমরা আমার রাজনৈতিক দুশমনরা নিশ্চিন্ত থাকতে পার, তোমাদেরে খুশী করবার লাগি এখনই আমি মরতেছি না। আমার সময় মতই আমি মরব। আমার জনপ্রিয়তা কমছে কি বাড়ছে, সেদিনই তোমরা তা বুঝতে পারবা।
বাপের তুল্য বুড়া মুরুব্বির মরার কথা মুখের উপর বলিয়া বেআদবি করিয়াছি। মনে অনুতাপ হইল। শোধরাইবার আশায় দরদের সুরে তাঁর বিভিন্ন ভুল-ভ্রান্তির কথা তুলিলাম। ঐ সব ভুল না করিলে তিনি আন-পপুলার হইতেন না। তিনি স্বীকার করিলেন না। তাঁর কোনও ভুল হয় নাই। তাঁর দুশমনেরা পশ্চিমাদের খপ্পরে পড়িয়া তাঁর মিথ্যা বদনাম দিয়া সাময়িকভাবে তাঁকে বেকায়দায় ফেলিয়াছে। আমি প্রতিবাদে বলিলাম ও অন্যায় না করলে মিথ্যা বদনাম কেউ দিতে পারে না। কই আমার বদনাম ত কেউ করে না।
তিনি আবার ছাত-ফাটা হাসি হাসিলেন। বলিলেন : ‘তোমার বদনাম লোকে কেন করব? তুমি কোন্ ভাল কাজটা করছ? লোকের কোন্ উপকারটা করছ? আগে লোকের উপকার কর। দু’চারটা ভাল কাজ কর। তখন দেখবা লোকে তোমার বদনাম শুরু করছে। আম গাছেই লোকে ঢিল মারে। শেওড়া গাছে কেউ মারে না। ফজলী আমের গাছে আরও বেশী মারে।’ ফযলুল হকের এ কথার সত্যতা বুঝিতে আমার দশ-পনর বছর লাগিয়াছিল।