ময়মনসিংহে সংগঠন
পাঁচই অধ্যায়
১. বিচিত্র সাম্প্রদায়িকতা
অতঃপর আমি শহর ফেলিয়া মফস্বলের দিকে মনোযোগ দিলাম। বস্তুতঃ বাধ্য হইয়াই আমি তা করিয়াছিলাম। মুসলিম শিক্ষিত সমাজ সাধারণভাবেই এই সময়ে কংগ্রেস-বিরোধী, হিন্দু-বিরোধী, এমনকি দেশের স্বাধীনতাবিরোধী হইয়া উঠিয়াছে। ত্রিশ-বত্রিশ জন মুসলমান উকিলের মধ্যে জনাতিনেক, পঞ্চাশ জন মোখতারের মধ্যে জন চারেক, শতাধিক মুসলিম ব্যবসায়ীর মধ্যে দু-এক জন ছাড়া আর সবাই কংগ্রেস ও হিন্দুদের নামে চটা। অসাম্প্রদায়িক কথা তাঁরা শুনিতেই রাযী না।
অথচ এদের অধিকাংশের সম্প্রদায়-প্রীতি ছিল নিতান্তই অদ্ভুত। এরা মুখে-মুখে এবং রাজনৈতিক ব্যাপারে হিন্দু ও কংগ্রেসের নাম শুনিতে পারিতেন না। কিন্তু ওকালতি ও মোখতারি ব্যবসায়ের বেলা হিন্দু সিনিয়র উকিল-মোখতারদেরেই কেস দিতেন এবং তাঁদের চেম্বারেই দেন-দরবারে কাল কাটাইতেন। কাপড়-চোপড় কিনিবার সময় এঁরা একমাত্র মুসলিম দোকান ‘মৌলবীর দোকান’ বাদ দিয়া ‘বংগলক্ষ্মী’ আর্য ভাণ্ডার’ প্রভৃতি হিন্দুর দোকান হইতে খরিদ করিতেন। হেতু জিগাসা করিলে বলিতেন,’ মৌলবীর দোকানে দাম অন্ততঃ টাকায় দু’পয়সা বেশি নেয়। পক্ষান্তরে আমরা তথাকথিত ‘হিন্দুর দালাল’ কংগ্রেসী মুসলমানরা খদ্দর কিনিবার সময়ও মুসলমানের কোনও খদ্দরের দোকান আছে কিনা খোঁজ লইতাম এবং ‘মৌলবীর দোকান’ ও অন্যান্য মুসলমান ব্যবসায়ীদেরে দোকানে খদ্দর রাখিবার পরামর্শ দিতাম।
এই সময় বংগীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি সার আঃ রহিম সেক্রেটারি মৌঃ মুজিবুর রহমান। কাজেই মুসলমানদের বিশেষ আকর্ষণ স্বরূপ আমি ঐ মুসলিম লীগের জিলা শাখা প্রতিষ্ঠা করিলাম। আমি নিজে নামে মাত্র প্রেসিডেন্ট হইয়া প্রবীণ উকিল মৌঃ আবদুস সোবহানকে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মৌঃ মুজিবুর রহমান খাঁ ফুলপুরীকে উহার সেক্রেটারি করিলাম। কিন্তু ঐ মুসলিম-স্বার্থবাদী সাম্প্রদায়িক মুসলমান উকিল-মোখতারেরা মুসলিম লীগেও যোগ দিলেন না। কারণ তাঁদের মতে স্বয়ং জিন্না সাহেবও ছদ্র-কংগ্রেসী। সুতরাং মুসলিম লীগ আসলে কংগ্রেসেরই শাখা মাত্র। তাঁদের মতে আঞ্জুমনে-ইসলামিয়াই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। সরকারের সমর্থনই মুসলমানদের একমাত্র পলিসি। ইংরাজরা না থাকিলে মুসলমানদের রক্ষা নাই।
মুসলমান শিক্ষিত সম্প্রদায়ের এই মনোভাবের মধ্যে কোনও যুক্তি ছিল না সত্য, কিন্তু ভণ্ডামিও ছিল না। আন্তরিকভাবেই তাঁরা বিশ্বাস করিতেন, ইংরাজের অবর্তমানে হিন্দু মেজরিটি শাসনে মুসলমানদের দুর্দশার চরম হইবে। জনৈক প্রবীণ খান সাহেব আমাকে বলিতেন : হিন্দুদের কাছে মুসলমান-প্রতিভারও কদর নাই। এই ধরুন না আমরা আপনাকে আঞ্জুমনের শীর্ষস্থানে বসাইয়াছিলাম। আর কংগ্রেস আপনাকে তিন নর ভাইস প্রেসিডেন্ট করিয়া রাখিয়াছে। কোনও দিন আপনেরে ওরা প্রেসিডেন্ট করিবে না কথাটা নিতান্ত চাছা-ছোলা কুড এবং মাকাঠিটা নিতান্ত স্কুল হইলেও কথাটার তলদেশে অনেক সত্য লুকায়িত ছিল। উহাই বাস্তব সত্য। কারণ বাস্তবজীবনে ঐ মাপিকাঠি দিয়াই সব জিনিসের বিচার হয়। অবস্থাগতিকে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তৎকালীন বিচারের মাপকাঠি ছিল উহাই। সম্ভবতঃ মধ্যবিত্তের বিচারের মাপকাঠি চিরকালই তাই।
২. কংগ্রেসের জমিদার-প্রীতি
পক্ষান্তরে কংগ্রেস কার্যতঃ ও নীতিতঃ প্রজা আন্দোলনের বিরোধী ছিল। ১৯২৮ সালের প্রজাস্বত্ব আইনের বেলা কংগ্রেসী মেম্বররা যে একযোগে প্রজার স্বার্থের বিরুদ্ধে জমিদার-স্বার্থের পক্ষে ভোট দিয়াছিলেন, এটা কোন এক্সিডেন্ট বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। কংগ্রেস নেতারা প্রজা আন্দোলনকে শ্রেণী-সংগ্রাম বলিতেন। শ্রেণী সংগ্রামের দ্বারা দেশবাসীর মধ্যে আত্মকলহ ও বিভেদ সৃষ্টি করিলে স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যাহত হইবে। এটাই ছিল তাঁদের যুক্তি। কিন্তু এ জিলার ব্যাপারে দেখা গেল, এটা তাঁদের মৌখিক যুক্তিমাত্র। ময়মনসিংহ জিলা কংগ্রেস-নেতৃত্বের উপর জমিদারদের প্রভাব ছিল অপরিসীম। বোম্বাই মাদ্রাজ যুক্ত প্রদেশ ও বিহার কংগ্রেস ঐ ঐ ঐ প্রদেশের কৃষকদের স্বার্থ লইয়া সংগ্রাম করিতেছে, এই সব যুক্তি দিয়াও আমি এ জিলার কংগ্রেস-নেতাদেরে টলাইতে পারিলাম না। লাভের মধ্যে আমি কংগ্রেসীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা ও সমর্থন হারাইলাম। তাঁদের যুক্তির মধ্যে প্রজা-আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাঁদের আসল মনোভাবটা ধরা পড়িত। তাঁরা প্রজা-আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক আন্দোলন বলিতেন এবং যুক্তিতে বোৰাই-বিহারের কৃষক আনোলন হইতে ময়মনসিংহ তথা বাংলার প্রজা-আন্দেলনের পার্থক্য দেখাইতেন। বাংলার জমিদাররা প্রধানতঃ হিন্দু এবং প্রজারা প্রধানতঃ মুসলমান। জমিদারিতে যা মহাজনি ব্যাপারেও তাই। মহাজনরা প্রধানতঃ হিন্দু এবং খাতকরা প্রধানতঃ মুসলমান। সুতরাং এদের হিসাবে, এবং কার্যতঃ সত্যই, প্রজা আন্দোলন ছিল হিন্দুর বিরুদ্ধে মুসলমানদের আন্দোলন।
কংগ্রেসীরা শুধু প্রজা-আন্দোলনে সমর্থন দিলেন না, তা নয়। তাঁরা কৌশলে ইহার বিরুদ্ধতা করিতে লাগিলেন। কিছুসংখ্যক কংগ্রেস-কর্মী দিয়া তাঁরা একটা কৃষক সমিতি খাড়া করিলেন। সেই সমিতির পক্ষ হইতে প্রচার চলিল যে প্রজা আন্দোলন আসলে জোতদারদের আন্দোলন। ঐ আন্দোলনে কৃষকদের কোন লাভ ত হইবেই না, বরঞ্চ কৃষকদের দুর্দশা আরও বাড়িবে। জোতদারদের শক্তি ও অত্যাচার দ্বিগুণ হইবে। প্রমাণ হিসাবে তাঁরা বর্গাদারদের দখলী, স্বত্বের কথাও তুলিলেন। কংগ্রেসের সাথে প্রজা সমিতির প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ বাধিয়া গেল।
এ অবস্থায় কংগ্রেসের সাথে আমার সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদের কথা। সে সংকল্পও একবার করিলাম। কিন্তু পারিলাম না। আমার প্রাদেশিক নেতা ও কেন্দ্রীয় প্রজা সমিতির সেক্রেটারি মওলানা আকরম খাঁ সাহেব সেই মুহূর্তে ছাড়িবার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি সহকারী সেক্রেটারি মোঃ নযির আহমদ চৌধুরী সাহেবের দ্বারা সমস্ত জিলা সমিতির সেক্রেটারিদের নামে কনফিডেনশিয়াল সারকুলার জারি করাইলেন : পূর্ব বাংলার মুসলিম মেজরিটি জিলাসমূহের কংগ্রেস কমিটিগুলি মুসলমানদের দ্বারা ক্যাপচার করার চেষ্টা হওয়া উচিৎ। আমার নিজেরও মত ছিল তাই।
৩. সাংগঠনিক অসাধুতা
আমি তদনুসারে কাজে লাগিয়া গেলাম। এ ব্যাপারে এ জিলার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শ্রদ্ধেয় সর্বজনমান্য ঋষিতুল্য কংগ্রেস নেতা ডাঃ বিপিন বিহারী সেন আমাদেরে পূর্ণ সমর্থন দিলেন। তিনি প্রকাশ্য সভায় ঘোষণা করিলেন : যে-জিলার শতকরা আশি জন অধিবাসী মুসলমান, সে জিলার কংগ্রেস নেতৃত্ব মুসলমানদের হাতেই থাকা উচিৎ। মুসলমান ছাড়া এ জিলার কংগ্রেসকে তিনি ‘রামহীন রামায়ণ’ বলিয়া বিদ্রূপ করিয়াছিলেন। তাঁর ও তাঁর সমর্থকদের সহায়তায় আমরা পর-পর দুই বছর কংগ্রেস ক্যাপচার করিবার চেষ্টা করিলাম। দুইবারই ব্যর্থ হইলাম। ইতিহাসটি এইঃ যে বছরে আমরা এই প্রয়াস শুরু করি, সে বছর পঞ্চাশ লক্ষ অধিবাসীর এই জিলার কংগ্রেসের প্রাইমারি মেম্বর-সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত হাজার। আমাদের দলের পক্ষে ভোট হইয়াছিল মাত্র আড়াই হাজার। আমরা মনে করিলাম, আগামী বছর আমরা প্রাইমারি মেম্বর করিব সাত দ্বিগুণে চৌদ্দ হাজার। দেখি, বেটারা আমাদের কেমনে হারায়। দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করিয়া পরের বছর মেম্বর করিলাম পনর হাজার। কিন্তু ফাঁইনাল ভোটার তালিকার সময় দেখিলাম, আমাদের পনরর মোকাবেলা অপর পক্ষ করিয়াছেন সাড়ে সতর হাজার। কাজেই সেবারও হারিয়া গেলাম। পরের বছর আমরা করিলাম বাইশ হাজার। কিন্তু ফাঁইনাল ভোটার তালিকায় তাঁদের হইল পঁচিশ।
কারণ এটা সাধু প্রতিযোগিতা ছিল না। কৌশলটা ছিল এই : আমরা অপযিশন দলের পক্ষ হইতে প্রাইমারি মেম্বর তালিকা দাখিলের পরে ‘পযিশন’ দল তাঁদের মেম্বর তালিকা দাখিল করিতেন। নিজেরা পযিশনে থাকায় অর্থাৎ আফিস তাঁদের হাতে থাকায় রাতারাতি জাল মেম্বর তালিকাভুক্ত করিয়া নিজেদের পক্ষের তালিকা ভারি করা অতি সহজ ছিল। যে কোনও গণ-প্রতিষ্ঠানের অফিস-কর্তারা এটা করিতে পারেন। স্বাধীনতা লাভের পর লীগ কর্তারা আলাদা পার্টি না করিয়া মুসলিম লীগ দখল করার যে দাওয়াত দিতেন, সেটাও ছিল এইরূপ দাওয়াত। আমরা এ কৌশলের কথা জানিতাম বলিয়াই একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান দখল করিয়া মসজিদ ত্যাগ না করিয়া ইমাম বদলাইবার চেষ্টা করি নাই। কংগ্রেসের নির্বাচন এই ভাবে ‘রিগ’ করিবার অভিজ্ঞতা হইতেই তৎকালে সব দলের রাজনৈতিক নেতারা একমত হইয়া সকল প্রকার নির্বাচনে ‘ইলেকশন ট্রাইবুন্যালের’ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। আমাদের বেলায় কিন্তু ইলেকশন ট্রাইবুন্যালেও কুলায় নাই। ময়মনসিংহ জিলায় ঐরূপ অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া আমরা প্রাদেশিক কংগ্রেসের কাছে নিরপেক্ষ ইলেকশন ট্রাইবুন্যালের তদন্ত দাবি করি। প্রাদেশিক কংগ্রেস সুদূর মাদ্রাজ হইতে নিরপেক্ষ মিঃ এ্যানিকে ট্রাইবুন্যাল নিযুক্ত করিয়া পাঠান। আমরা মিঃ এ্যানির কাছে জাল ভোটের অনেক সাক্ষ্য-সাবুদ দেই। কিন্তু আফিস-কর্তারা এমন নিখুঁতভাবে কাগয-পত্র ‘মিছিল’ করিয়া ফেলেন যে বিচারকের বিশেষ কিছু করিবার থাকে নাই।
এইভাবে কংগ্রেস ক্যাপচারের চেষ্টায় ব্যর্থ হইয়া একাগ্রচিত্তে প্রজাসংগঠনে লাগিয়া গেলাম। উপরোক্ত অবস্থাধীনেই আমি সংগঠনের মোড় শহর হইতে মফস্বলের দিকে ফিরাইলাম। উপরে যে সব নেতা আলেম ও বন্ধু-বান্ধবের নাম উল্লেখ করিয়াছি, তাঁদের সকলের ও প্রত্যেকের চেষ্টায় এ জিলার প্রজা-আন্দোলন দুর্বার ও প্রজা সমিতি অসাধারণ শক্তিশালী হইয়া উঠে।
৪. খান বাহাদুর ইসমাইল
আরেকটা ব্যাপারে অবস্থা আমাদের অনুকূলে আসিল। আমাদের সাংগঠনিক মর্যাদাও বাড়িয়া গেল। এই সময় জিলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ গ্রাহাম এ জিলার সর্বজনমান্য প্রবীণ নেতা খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেবকে পাবলিক প্রসিকিউটরি ও জিলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হইতে সরাইয়া খান বাহাদুর সাহেবেরই অন্যতম শিষ্য শরফুদ্দিন আহমদ সাহেবকে পাবলিক প্রসিকিউটরি, চেয়ারম্যানি ও খান বাহাদুরির ‘ট্রিপল ক্রাউন’ পরাইয়া দেন। বিনাকারণে বহুঁকালের পদ-মর্যাদাহারাইবার ফলে খান বাহাদুর সাহেবের চিরজীবনের স্বপ্ন ভংগ হয়। এক কালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ খান বাহাদুর সারা জিরার মুকুটহীন রাজা হঠাৎ একদিন নিজেকে অসহায় সর্বহারা দেখিলেন। এত কালের শিষ্য-শাগরেদরা তাঁকে দূর্গা-প্রতিমার মতই বিসর্জন দিলেন। পারিষদবর্গের ভগ্নাবশেষ অতি অল্পসংখ্যক লোকই বিপদে আহাজারি এবং ইংরাজ জিলা ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্দেশ্যে গালাগালি করিয়া শান্ত হইলেন। সান্ত্বনার কথা শুনিলেন তিনি আমার মুখে। আমি তাঁর গুণ, শক্তি ও জনপ্রিয়তার কথা বলিতাম। তিনি এ জিলার মুসলমানদের জন্য কি কি কাজ করিয়াছেন, সেদিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতাম। জনগণের প্রিয় নেতা সরকারী দরবার হইতে জনগণের মধ্যে নামিয়া আসায় তাঁকে আমি মোবারকবাদ দিতাম। তিনি যে অন্তরে বল ও সান্ত্বনা পাইতেন চোখে মুখেই তা প্রকটিত হইত।
এইভাবে তিনি প্রথমে আমার এবং পরে প্রজা-সমিতির গোঁড়া সমর্থক হইয়া উঠেন। দুইদিন আগে যিনি আমাকে মুসলিম সমাজের দুশমন ও যে প্রজা-সমিতিকে ছদ্মবেশী কংগ্রেস মনে করিতেন সেই আমাদের তারিফে তিনি পঞ্চমুখ হইলেন। ইতিপূর্বে বাংলা সরকার মুসলিম শিক্ষা সম্পর্কে রিপোর্ট করিবার জন্য খান বাহাদুর আবদুল মোমিনের নেতৃত্বে এক কমিটি গঠন করিয়াছিলেন। মাত্র কিছুদিন আগে এই কমিটি এ জিলায় তদন্তে আসিয়াছিলেন। তিনজন শিক্ষাবিদের মধ্যে বোধহয় কারো তুলের দরুন আমাকেও সাক্ষী হিসাবে ডাকা হইয়াছিল। আমার যবানবন্দিতে প্রচলিত শিক্ষা-পদ্ধতির আমূল সংস্কার দাবি করি; কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করি, এবং সরকারী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ধর্ম-শিক্ষা প্রচলনের বিরোধিতা করি। ইহাতে মোমিন সাহেব আমার উপর চটিয়া যান। সেই দিন সন্ধ্যায় মুসলিম ইনিষ্টিটিউটে খান বাহাদুর ইসমাইল সাহেবের সভাপতিত্বে এক অভ্যর্থনা সভায় মোমিন সাহেব কঠোর ভাষায় আমার নিন্দা করেন। আমাকে ঐ শহর হইতে বেত মারিয়া বাহির করিয়া দেওয়ার কথা হয়। জনৈক এডিশনাল এস, পি, ও ঐ সভায় বক্তৃতা করেন। তিনি ঐ কাজেরভার নেন।
আমাকে বেত মারিয়া বাহির করা না হইলেও সমাজ আটক করা হইয়াছিল। এই সময় এক মুসলমান জমিদার ভদ্রলোক তার মেয়ের বিয়ায় আমারে দাওয়াত করিলে শহরের মুসলিম নেতারা ঐ ভদ্রলোককে আলটিমেটাম দিয়া আমার নামের দাওয়াতনামা প্রত্যাহার করাইয়াছিলেন।
খান বাহাদুর ইসমাইল সাহেব ছিলেন আদত মহৎ ও ভদ্রলোক। তিনি নিজেই এসব কথা তুলিতেন, আমার আপত্তি সত্ত্বেও বলিয়া যাইতেন। আমি তখন বলিতাম। ‘আজ আর ও-সব কথা তুলিবার দরকার নাই। অবস্থা-গতিকেই ওসব ঘটিয়াছিল।‘ জবাবে তিনি গভীরভাবে বলিতেন : ‘তোমার জন্য দরকার নাই, আমার জন্যই দরকার। আমার একটা বিবেক আছে ত? তাকে সান্ত্বনা দিতে হইবে না?’ আমি বুঝিতাম ভদ্রলোকের ব্যথা কোথায়। তিনি একদিন বলিয়াছিলেন? ‘তোমারে বেত মাইরা বাইর করবার আগে হতভাগা নিমকহারামেরা আমারেই লাথি মাইরা বাইর কৈরা দিছে। পিতৃতুল্য এককালের শক্তিধক্সের বর্তমান মনোভাবকে অতি কৌশলে নাযুক হাতে হ্যাঁগুল করিতে হইত। পারিতামও। করিয়াও ছিলাম। সরকারী পদ মর্যাদার ভক্ত ছাড়াও খান বাহাদুর সাহেবের অনেক ব্যক্তিগত ভক্ত ও অনুসারী ছিলেন। খানবাহদুর সাহেব প্রজা-সমিতিতে যোগ দেওয়ায় এই সব লোক চোখ বুজিয়া প্রজা সমিতির সমর্থক হইয়া উঠিলেন। অনেকে সক্রিয়ভাবেসমিতিতে যোগদিলেন। এতদিন মফস্বলে প্রজা-সমিতির শক্তি সীমাবদ্ধ ছিল। এইবার শহরে তা প্রসারিত হইল।
৫. পুলিশ সুপার টেইলার
ইতিমধ্যে (ডিসেম্বর, ১৯৩১) গোলটেবিল-বৈঠক হইতে নিরাশ হইয়া মহাত্মা গান্ধী দেশে ফিরিয়া আসামাত্র গ্রেফতার হইলেন। কংগ্রেস বেআইনী ঘোষিত হইল (জানুয়ারি, ১৯৩২)। আমি তখনও কংগ্রেসের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। ডাঃ সেন ও আমি আরও অল্প কয়েকজন ছাড়া এ জিলার কংগ্রেসের বড়-বড় নেতারা প্রায় সকলেই গ্রেফতার হইলেন। আমরা নিজেদের দলাদলি তুলিয়া অঃ সেনের বাড়িতে সকল উপালের কয়েকজন কংগ্রেসী নেতা পরামর্শ-সতা করিলাম। ডাঃ সেন ও আমি শান্তি রক্ষার আবেদন করিলাম। প্রায় সকলেই একমত হইলাম। কেবলমাত্র দুইজন হিন্দু নেতা সক্রিয় আন্দোলনের জন্য উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা করিলেন। কিন্তু অধিকাংশে বিরুদ্ধতায় তাঁদের প্রস্তাব পরিত্যক্ত হইল। পরদিন কোর্টে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছি। এমন সময় একজন ডি. এস. পি. ও একজন ইনস্পেক্টর আসিয়া জানাইলেন, আমাকে তখনি এসপি, সাহেব ডাকিয়াছেন। তাঁরা গাড়ি নিয়াই আসিয়াছিলেন।
ময়মনসিংহে সংগঠন আমি তাঁদের সাথে যাইতে বাধ্য হইলাম। বাড়িতে শোকের ছায়া পড়িল। বৈঠকখানায় অপেক্ষমান মণ্ডলেদের মুখ কাল হইয়া গেল। সকলকে আশ্বাস দিয়া আমি কোর্টে যাওয়ার পোশাকেই এস. পি. সাহেবের কাছে রওয়ানা হইলাম। কি করিয়া জানি না কথাটা প্রচার হইয়া গিয়াছিল। বাড়ি হইতে বাহির হইয়াই দেখিলাম রাস্তার দুপাশে ভিড়। সকলে ধরিয়া লইয়াছিলেন, আমি গ্রেফতার হইয়াছি। অনেকেই রুমাল উড়াইয়া আমাকে বিদায় দিলেন।
এস. পি. মিঃ টেইলার। বড় কড়া লোক বলিয়া মশহর। আমাকে দেখিয়াই তিনি গর্জিয়া উঠিলেন। বুঝিলাম আগের দিনের সভার বিকৃত রিপোর্ট তীর কানে গিয়াছে। গর্জনের উত্তরে গর্জন করা আমার চিরকালের অভ্যাস। আমি তাই করিলাম। দু’চার মিনিটেই আশ্চর্য ফল হইল। টেইলার সাহেব নরম হইলেন। কাজেই আমিও হইলাম। টেবিলের উপর সিগারেটের একটা টিন একরূপ ভরাট ছিল। তিনি আমাকে সিগারেট অফার করিলেন। সিগারেট খাইতে-খাইতে কথা-বার্তা চলিল ঝাড়া পৌনে দুই ঘন্টা। কংগ্রেসের উদ্দেশ্য, দাবি-দাওয়া কার্যক্রম হইতে শুরু কলিয়া বিলাতের কনযাভেটিভ লিবারেল লেবার পার্টির পলিটিকস্ সবই আলোচনা হইল। প্রজা সমিতি ও প্রজা আন্দোলন সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা হইল। ফলে টেইলার সাহেব শেষ পর্যন্ত স্বীকার করিলেন ভারতবাসীর স্বাধীনতা দাবি ও প্রজাদের আন্দোলন করার অধিকার আছে। তবে কংগ্রেসের বেআইনী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ তিনি কঠোর হস্তে দমন করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমি তাঁকে বুঝাইলাম আমি এবং আমার মত অনেকেই এক দল কংগ্রেসীর হিংসাত্মক কর্মপন্থার ঘোরতর বিরোধী। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করা আমরা পক্ষপাতী। তাছাড়া আমি মূলতঃ প্রজা-কর্মী। স্বাধীনতার দাবিতে আমি কংগ্রেসের সমর্থক এইমাত্র। কাজেই শেষ পর্যন্ত প্রজা-সমিতির ও প্রজা আন্দোলনের খুঁটিনাটি ও শান্তি ভংগের কথাও উঠিল। বিভিন্ন স্থানে জমিদার মহাজনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাযের তিনি দুই-একটা দৃষ্টান্তও দিলেন। আমি দেখাইলাম, ও ধরনের কার্যে প্রজা সমিতির কোনও সম্পর্ক নাই। বরঞ্চ আমি জমিদার ও মহাজনদের বে-আইনী যুলুমের বহু দৃষ্টান্ত দিলাম। ঐসব ক্ষেত্রে পুলিশের সাহায্য চাহিয়া যে বিপরীত ফল হইয়াছে, তার প্রমান দিলাম। পৌনে দুই ঘন্টা আলাপে রা-টিনটার সবগুলি সিগারেট শেষ হইল। তিনি খালি টিনের দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিলেন : ‘আরেক টিন আনাইব কি?’ আমিও তেমনি হাসিয়া জবাব দিলামঃ ‘তা ত আনিতেই হইবে। বিড়ি-খোর কংগ্রেস-কমীকে বাড়িতে বন্দী করিয়া রাখিবার ইহাই শাস্তি।‘
এই মোলাকাতের ফল আশাতিরিক্ত ভাল হইল। তিনি সরলভাবে স্বীকার করিলেন, আমার মত লোকের নেতৃত্বে প্রজা-সমিতি শক্তিশালী সংগঠন হইলে সন্ত্রাসবাদী কংগ্রেসীদের প্রভাব কমিয়া যাইবে। আমি বলিলাম, প্রজা-সমিতির কর্মী নেতারা সভা-সমিতি করিতে গেলে পুলিশ তাঁদের পিছনে লাগে। তাতে জনসাধারণ ঘাবড়াইয়া যায়। প্রজাকর্মীদের কাজের খুব অসুবিধা হয়। এই অভিযোগের আও প্রতিকারের তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং আমার নিকট হইতে বিশিষ্ট প্রজা-কর্মীদের নাম নিজ হাতে লিখিয়া নিলেন।
অল্পদিন মধ্যেই ইহার সুফল পাওয়া গেল। প্রতি থানায় প্রজা-নেতাদের নামের তালিকা চলিয়া গেল। এস, পি, তাতে নির্দেশ জারি করিলেন। তালিকায় লিখিত নেতাদের কেউ ঐ এলাকায় সভা-সমিতি করিতে গেলে তাঁদের কাজে কোনও ব্যাঘাত না হয়, থানা-অফিসারদের সেদিকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে। আমাদের দেশের পুলিশ অফিসারদের ‘ডাকিয়া’ আনিতে বলিলে ‘ধরিয়া’ আনেন, ‘ধরিয়া’ আনিতে বলিলে কান ধরিয়া আনেন। তেমনি অপরদিকে বাধা না দিতে বলিলে একদম সহায়তা ও সমর্থন রু করেন। প্রজা-কর্মীদের বেলাও তাই হইল। আগে যেখানে পুলিশ তাঁদের কাজে বাধা দিতেন, ধমক দিতেন, এখন সেখানে তাঁরা সভার আয়োজনে সহযোগিতা করিতে ও উৎসাহ দিতে লাগিলেন।
ফলে কংগ্রেস-কর্মী ও নেতারা স্বভাবতঃই আমাকে ভুল বুঝিলেন এবং ঘরে বসিয়া কেউ কেউ ন্যায়তঃই আমার নিন্দাও করিলেন। কিন্তু আমি তাঁহাদের নিন্দায় বিচলিত হইলাম না। আমি ত আর ব্যক্তিগত স্বার্থে এটা করি নাই। সাধারণভাবে জিলার সর্বত্র পুলিশ যুলুম কমিয়া যাওয়ায় কংগ্রেস-কর্মীরাও পরে আমার উপর সন্তুষ্ট হইলেন। প্রজা-কর্মীরা পরম উৎসাহে কাজ করিতে লাগিলেন। প্রজা-সমিতির সুনাম ও প্রভাব দ্রুত বাড়িতে লাগিল। কিন্তু বেশিদিন আমরা এই সুবিধা ভোগ করিতে পারিলাম না। ময়মনসিংহ হইতে টেইলার সাহেব ট্রান্সফার হওয়ার দরুনই হউক, আর সরকারী নীতি পরিবর্তনের দরুনই হউক, আবার কর্মীদের উপর যুলুম হইতে লাগিল। সভা-সমিতি ও সংগঠনের কাজ কঠিন হইল।
আমি অগত্যা অন্য পথ ধরিলাম। প্রজা-সমিতি নিয়মতান্ত্রিক প্রজা সংগঠন বলিয়া সরকার হইতে স্বীকৃতি পাইবার একদম সনাতনী চেষ্টা শুরু করিলাম। জমিদার ও প্রজা দেশের ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার দুইটা পক্ষ। জমিদার সমিতিকে সরকার স্বীকৃতি দিয়াছেন; প্রজা-সমিতিকে দিবেন না কেন? এই সব যুক্তিতর্ক দিয়া আমি সরকারের সহিত লেখালেখি শুরু করিলাম। কালে ভদ্রে সংক্ষিপ্ত উত্তর পাইতাম। তাতে শুধু বলা হইত? বিষয়টা সরকারের বিবেচনাধীন আছে। গবর্নর বা মন্ত্রীরা দেশ সফরে বাহির হইলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরফ হইতে অভিনন্দনপত্র দেওয়ার রেওয়াজ তৎকালেও ছিল। ঐ সময় এ জিলার আঞ্জুমনে ইসলামিয়া, ল্যান্ড হোলডার্স এসোসিয়েশন, গৌড়ীয় মঠ, হরি সভা, রামকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ঐ সব উপলক্ষে দাওয়াতনামা পাইত। অভিনন্দন-অভ্যর্থনা তাদেরই মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কংগ্রেস মুসলিম লীগ ও প্রজা-সমিতি এইসব অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাইত না। কারণ সরকার এই সবকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলিতেন। আঙুমনে ইসলামিয়াও এই হিসাবে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল। কারণ চাকুরিতে মুসলমানদের দাবি-দাওয়া এবং কংগ্রেসের বিভিন্ন আন্দোলনের বিরুদ্ধতা করিয়া আঞ্জুমনে প্রস্তাব গৃহীত হইত। তবু সরকার সমস্ত সরকারী অনুষ্ঠানেই আজুনকে দাওয়াত দিতেন বোধ হয় এই জন্য যে, আমন কখনও সরকারী কাজের প্রতিবাদ করিত না।
৬. মন্ত্রি-অভিনন্দন
এই সময় সার আবদুল করিম গয়নবী একযিকিউটিভ কাউন্সিলার হিসাবে এ জিলায় তশরিফ আনেন। জমিদার সভা ও আঞ্জুমন তাঁকে অভিনন্দন দেওয়ার আয়োজন করে। পাঁচ বছর আগে ‘গজ চক্র’ মন্ত্রী হিসাবে তাঁর নিন্দা করিয়াছিলাম, সে কথা ভুলিয়া আমি প্রজা-সমিতির তরফ হইতে তাঁকে অভিনন্দন-পত্র দিবার দাবি করি। সংশিষ্ট ব্যক্তির বিনা অনুমতিতে অলিন্দন-পত্র দেওয়া যায় না বলিয়া জিলা ম্যাজিস্ট্রেট আমার পত্ৰখানা কলিকাতা পাঠাইয়া দিলেন। গনবী সাহেব আসিলেন এবং চলিয়া গেলেন। কিন্তু আমার পত্রের জবাব আসিল না।
বছর খানেক পরে আমার চেষ্টা ফলবতী হইল। এই সময় নবাব কে. জি, এম. ফারুকী কৃষি ও সমবায় মন্ত্রী হন। আমি যখন ‘দি মুসলমানের’ সহ-সম্পাদক তখন হইতেই আমি ফারুকী সাহেবের সহিত পরিচিত। তাঁরই ময়মনসিংহ সফর উপলক্ষে আমি প্রজা-সমিতির তরফ হইতে তাঁকে অভিনন্দন দিবার প্রস্তাব করিয়া জিলা ম্যাজিট ও নবাব ফারুকী উভয়ের কাছে পত্র দিলাম। আমার প্রার্থনা মনযুর হইল। আমি অভিনন্দন-পত্রের মুসাবিদায় বসিলাম।
তৎকালে অভিন্দনপত্রের এ্যাডভান্স কপি জিলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাখিল করার নিয়ম ছিল। তিনি সেজন্য আমাকে তাগিদ করিতে লাগিলেন। কিন্তু আমি দিলাম না। কারণ তা দেখিলে আমাকে উহা পড়িবার অনুমতি দেওয়া হইত না। আমি জানিতাম জিলা ম্যাজিস্ট্রেট যাই করুন অনারেবল মিনিস্টার আমার অভিনন্দন গ্রহণ করিবেনই।
যথাসময়ে শশী লজের বিশাল আংগিনায় সুরম্য সুসজ্জিত প্যাণ্ডলে মন্ত্রি অভিনন্দনের কাজ শুরু হইল। আমি বিশিষ্ট প্রজা-নেতাদের সংগে লইয়া সভায় উপস্থিত হইলাম। বুনিয়াদী অভিনন্দন-দাতা হিসাবে আঞ্জুমনের দাবি অগ্রগণ্য। আঞ্জুমনের অভিন্দন পড়া শেষ হইলেই আমি দাঁড়াইলাম। আমন ও অন্যান্য সমস্ত প্রতিষ্ঠানের অভিনন্দন-পত্ৰ বরাবর ইংরাজীতে হইত। সেবারও তাই হইল। কিন্তু আমি বাংলায় অভিনন্দন-পত্র লিখিয়াছিলাম। সব অভিনন্দন পত্রেই মন্ত্রী মহোদয়ের এবং সরকারের দেদার প্রশংসা থাকিত। প্রজা-সমিতির অভিনন্দনে মন্ত্রী বা সরকারের আরিফের একটি কথাও থাকিল না। তার বদলে থাকিল জমিদার মহাজনের অত্যাচার ও প্রজা-খাতকের দুরবস্থার করুণ কাহিনী। লিখিয়াছিলাম মনোযোগ দিয়া মর্মস্পর্শী ভাষায়। পড়িলামও প্রাণ ডালিয়া। পড়া শেষ হইলে এক মিনিট স্থায়ী করতালি-ধ্বনি এবং মারহাবা-মারহাবা আওয়ায হইল। অভিনন্দনের বাঁধাই কপিটা মন্ত্রী মহোদয়ের হাতে দেওয়ার সময় তিনি আমার হাত ধরিয়া বেশ খানিকক্ষণ এমন জোরে ঝাঁকি দিতে লাগিলেন যে তাতেও আবার নূতন করিয়া কলি–ধ্বনি হইল। আমি মঞ্চ হইতে নামা-মাত্র সুট-পরা একজন অফিসার আগ বাড়িয়া আমাকে জড়াইয়া ধরিলেন। বলিলেন : ‘কি শুনাইলেন আজ। কানা রুখতে পরি না।‘ দেখিলাম সত্যই ভদ্রলোকের দুই গাল বাইয়া পানি পড়িতেছে। এর হাত হইতে। একরূপ ছিনাইয়া আরেক জন অফিসার আমাকে জড়াইয়া ধরিলেন। তারপরে আরেকজন-আরেকজন এইভাবে চলিল। পরে জানিয়াছিলাম, প্রথমে যে ভদ্রলোক আমাকে জড়াইয়া ধরিয়াছিলেন এবং যাঁর চোখে আমি আসু দেখিয়াছিলাম তিনি ছিলেন ইন্সপেক্টর অব রেজিস্ট্রেশন খান বাহাদুর ফযলুল কাদির এবং দ্বিতীয় জন ছিলেন কো-অপারেটিভ সহ-রেজিষার (পরে রেজিয়ার খান বাহাদুর আরশাদ আলী। সভাশেষে আমি যখন শশী লজ হইতে বাহির হইয়া আসি, তখন বহুলোক আমাকে ঘেরিয়া মিছিল করিয়া বাহির হন। আমি যেন কোনও যুদ্ধ জয় করিয়া আসিয়াছি।
অতঃপর সরকারী মহলে এবং আঞ্জুমন নেতাদের কাছে আমার কদর বাড়িয়া গেল। আজকালকার পাঠকরা হয়ত আস্তিনের আড়ালে হাসিতেছেন। কিন্তু মনে রাখিবেন ওটা ইংরাজের আমল। তৎকালে দেশে বিশেষতঃ মুসলিম সমাজে মানুষের মর্যাদা সরকারী স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির অনুপাতে উঠা-নামা করিত। অনারেবল মিনিস্টার আমার খাতির করায় পরদিন হইতে জিলা অফিসাররা আমাকে খাতির করিতে লাগিলেন। তাতে কোট-আদালতেও আমার দাম বাড়িল। রাস্তা-ঘাটেও আদাব-সালাম বেশ পাইতে লাগিলাম। ফলে প্রজা-সমিতির শক্তি বাড়িল।