কালতামামি
এগারই অধ্যায়
১. রাজনীতির দুই দিক
আমার নিজের দেখা রাজনীতির একটা যুগ এইখানে শেষ হইল। এক সালের হিসাব-নিকাশকে আমরা বলি সাল তামামি। একটা কালের হিসাব-নিকাশকে তাই কাল ভামামি বলিতে চাই। ইংরাজীতে যাকে বলা হয় রিট্রোসপেক্ট। কাল মানে এখানে একটা যুগ যুগ এখানে বার বছরের যুগ বা দশ বছরের ডিকেন্ড নয়। এটা একটা এরা, একটা যমানা, একটা আমল। জাতির ইতিহাসে ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ এক বিশেষ ধরনের ঘটনাবলীর একটা মুদ্দত। একটা পিরিয়ড। এই ঘটনাপুঞ্জ প্রধানতঃ রাজনীতিক।
এই রাজনীতির দুইটা দিক : একটা ভারতীয়, অপরটা বাংগালী। ভারতীয় রূপে এই রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ মাইল খুটি এই কয়টি : খিলাফত ও স্বরাজ আন্দোলন। গান্ধীজী ও আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে সারা ভারতে একটা অপূর্ণ গণ-বিপ্লব। অভাবনীয় হিন্দু-মুসলিম মিলন। জিন্নার কংগ্রেস ত্যাগ। আন্দোলনের ব্যর্থতা। আকস্মিক অবসান। সাম্প্রদায়িক দাংগা। জিন্নার হিন্দু-মুসলিম-আপোস চেষ্টা। কংগ্রেসের অনমনীয় মনোভাব। গোল টেবিল বৈঠক। সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন। কংগ্রেস ও লীগ কর্তৃক উহার প্রাদেশিক অংশগ্রহণ ও কেন্দ্রীয় অংশ বর্জন। কংগ্রেস কর্তৃক ছয়টি, মুসলিম লীগ কর্তৃক পাঁচটি প্রদেশে মন্ত্রিত্ব। ১৯১৬ সালের লাখনৌ প্যাকট নামে পরিচিত কংগ্রেস মুসলিম লীগ চুক্তি আমার দেখা রাজনীতির মধ্যে পড়ে না। কারণ ওটার সংগে আমার যে সাক্ষাৎ পরিচয় নাই, শুধু তাই নয়। ঐ সময়ে আমার কোনও রাজনৈতিক চেতনাই ছিল না। তখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র মাত্র। ওটা যে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা, বিশ্বযুদ্ধের খবরের ভিড়ের মধ্যে তাও আমার মনে হয় নাই। কিন্তু, আমার দেখা রাজনীতির মধ্যেও উপরে তার যে একটা ইমপ্যাক্ট, একটা প্রভাব ছিল তা আমি পরে বুঝিয়াছিলাম।
রাজনীতির বাংগালী রূপে প্রজা-আন্দোলন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রচেষ্টা, তাঁর বেংগল প্যাক্ট, কলিকাতা কর্পোরেশনে তার প্রয়োগ শুরু, দেশবন্ধুর আকস্মিক মৃত্যু, কংগ্রেসের প্রজা-স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ, বেংগল প্যাট বাতিল, মুসলমানদের কংগ্রেস ত্যাগ ও প্রজা-সমিতি গঠন ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য মাইল খুঁটি। ১৯০৫ সালে পূর্ব-বাংলা ও আসাম প্রদেশের সৃষ্টি ও ১৯১১ সালে তা বাতিল আমার দেখা রাজনীতিতে পড়ে না। কিন্তু আমার দেখা রাজনীতির উপর তার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ইমপ্যাক্ট হইয়াছিল, তৎকালীন মুসলিম সমাজের মনোভাব হইতে তা স্পষ্ট বুঝা যাইত। তাদের চিন্তার প্রভাব আমার নিজের পরবর্তীকালের রাজনৈতিক চিন্তায়ও কম পড়ে নাই। সেটা অবশ্য বুঝিয়াছিলাম অনেক দিন পরে।
এতকাল পরে পিছন দিকে তাকাইয়া একজন রাজনৈতিক কর্মী লেখক ও সাংবাদিক হিসাবে আমার যা মনে পড়ে, তার সারমর্ম এই যে ভারতের মুসলমানরা আগা-গোড়াই একটা রাজনৈতিক স্বতন্ত্র সত্তা হিসাবেই চিন্তা ও কাজ করিয়াছে। এটা তারা খিলাফত যুগের ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই’ বলার সময়েও যেমন করিয়াছে, সাম্প্রদায়িক দাংগার সময় ‘মারি অরি পারি যে প্রকারে’ বলার সময়ও তেমনি করিয়াছে। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের পত্তন, ১৯১৫ সালের লাখনৌ প্যাক্ট, ১৯২৩ সালের বেংগল প্যাকট, ১৯২৮ সালে কলিকাতা কংগ্রেস হইতে ওয়াক-আউট, ১৯২৯ সালে সর্বদলীয় মুসলিম কনফারেন্স, জিন্নার চৌদ্দ-দফা রচনা, ১৯৩০-৩৩ সালে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যোগদানও ইত্যাদি সব-তাতেই মুসলিম রাজনৈতিক চিন্তা-ধারার এই দিকটা সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়িয়াছে। কি কংগ্রেসের সাথে দেন দরবারে কি বৃটিশ সরকারের নিকট দাবি দাওয়ায়, এই কথাই বলা হইয়াছে। কি কংগ্রেসী মুসলিম নেতা আলী ভাই-আনসারী-আজমল খাঁ, কংগ্রেস বিরোধী নাইট নবাব সবাই এ ব্যাপারে মূলতঃ একই সুরে কথা বলিয়াছেন। কংগ্রেসের হিন্দু নেতৃবৃন্দের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও তারও আগে গোপাল কৃষ্ণ গোখেল-দাদাভাই নওরোযীর মত বাস্তববাদী উদার নেতা অনেক ছিলেন। তা না থাকিলে লাখনৌ প্যাকট হইত না। পরবর্তীকালে মিঃ সিঃ রাজা গোপালাচারির মত বাস্তববাদী দূরদশী হিন্দু নেতা না থাকিলে রাঁচি কনফারেন্সে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ সম্পর্কে ‘না গ্রহণ না বর্জন’ প্রস্তাবও গৃহীত হইত না। মুসলমানদের সাথে আপোস ও সহযোগিতা করিতে এঁরা অনেকদূর অগ্রসর হইতে রাযী ছিলেন। তাই তুর্কী সাম্রাজ্য ভাগ করিয়া ইংরাজ ফরাসী–গ্রীসের মধ্যে বন্টন করিয়া নেওয়ার প্রতিবাদে মুসলিম ওলামারা যখন শেখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বে ১৯১৯ সালে তর্কেমমাওয়ালাত (অসহযোগিতা) আন্দোলন ও আলী ভাই-র নেতৃত্বে ১৯২০ সালে খিলাফত আন্দোলন শুরু করেন, তখন এই আন্দোলনের মধ্যে প্যানইসলামিযমের বীজ আছে জানিয়া গান্ধীজীর নেতৃত্বে হিন্দুরা খিলাফত আন্দোলনকে নিজের করিয়া লন। খিলাফত আন্দোলনকে ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তির ধর্মীয় আন্দোলন বলিয়া মিঃ জিয়ার মত মুসলিম নেতা যেখানে ঐ আন্দোলনে যোগ দেন নাই, সেখানে হিন্দু নেতৃবৃন্দ অতি সহজেই এই আন্দোলন হইতে দূরে থাকিতে পারিতেন। কিন্তু তাঁরা তা করেন নাই। কারণ এরা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে সত্যই বিশ্বাসী ছিলেন এবং খিলাফতকে মুসলমানের ধর্মীয় দাবি বলিয়া বিশ্বাস করিতেন। মহাত্মা গান্ধী ১৯২০ সালে তাঁর ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ নামক ইংরাজী সাপ্তাহিকে লেখেনঃ ‘হিন্দু-মুসলিম একতা ছাড়া ভারতের কোনও মুক্তি নাই। গান্ধীজীর আগেও গোখেল-দাদাভাই হিন্দু-মুসলিম একতার উপর খুবই জোর দিয়াছিলেন। কিন্তু হিন্দু নেতৃবৃন্দের মধ্যে গান্ধীজীই সর্ব প্রথম হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে ভারতের মুক্তির অপরিহার্য শর্ত ‘সাইন-কোয়া-ন’ রূপে পেশ করেন। অবশ্য তাঁরও আগে জিয়া সাহেব বলিয়াছিলেনঃ ‘হিন্দু-মুসলিম একতা ছাড়া ভারতের মুক্তি নাই। কিন্তু মাইনরিটি মুসলমানের মুখেও মেজরিটি হিন্দুর মুখে কথাটার তাৎপর্য অনেক বেশ কম। হিন্দু নেতৃবৃন্দের মধ্যে একমাত্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনই কথাটাকে কাজে প্রয়োগ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু নিখিল ভারতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধতায় দেশবন্ধুর অরকাল স্থায়ী রাজনৈতিক জীবনে তা সফল হয় নাই। তাঁর অকাল ও আকস্মিক মৃত্যুর পর দেশবন্ধুর অনুসারী বাংলার হিন্দু নেতৃবৃন্দ নিজেরাই দেশবন্ধুর বেংগল প্যাকট বাতিল করিয়া ভারতীয় হিন্দু-নেতৃত্বের সাথে এক কাতারে দাঁড়ান।
২. সাম্প্রদায়িক মিলনের দুই রূপ
এইসব ঘটনা হইতে দুইটা সত্য প্রকট হইয়া উঠে। এক, ভারতীয় মুসলিম নেতৃত্ব স্বত্ত্ব সত্তা বজায় রাখিয়া হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের চেষ্টা করিয়াছেন। এক শ্রেণীর উদারপন্থী হিন্দু নেতা মুসলিম দাবি-দাওয়া মানিয়া লইয়া সাম্প্রদায়িক ঐক্যের সদিচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু অধিকাংশ হিন্দু মতের চাপে তাঁরা পিছাইয়া গিয়াছেন। দুই, এই ঐক্যচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণ এই যে ঐক্যবাদী মুসলিম নেতৃত্ব ও ঐক্যবাদী হিন্দু-নেতৃত্বের মধ্যে একটা মৌলিক বিরোধ ছিল। মুসলিম নেতৃত্ব চাহিয়াছিলেন দুই স্ব সত্তার মধ্যে রাজনৈতিক মিলন বা ফেডারেশন। পক্ষান্তরে হিন্দু-নেতৃত্ব চাহিয়াছিলেন সার্বিক মিশ্রণ বা ফিউশন। একমাত্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনই তাঁর উদার দূরদৃষ্টি বলে হিন্দু-মুসলিম-ঐক্যের বাস্তব রূপ দেখিতে পাইয়াছিলেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম-ঐক্যের পক্ষে দরদী ভাষায় প্রাণস্পর্শী বাগিতায় বলিয়াছিলেন : ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্য অর্থ সংমিশ্রণ নয়, মিলন। ফিউশন নয় ফেডারেশন। দুইটি স্বতন্ত্র সত্তাবিশিষ্ট সম্প্রদায় রাজনৈতিক কারণে ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হইবে মাত্র; মিশিয়া এক সদায় হইয়া যাইবেন না। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য অর্থ যদি দুই সম্প্রদায়ের মিশ্রণে এক সম্প্রদায় হওয়ার কথা হইত, তবে আমি সে ঐক্যের কথা বলিতাম না।‘ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ছিলেন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব হিন্দু। নিজের ধর্মমতে তাঁর অটুট প্রাণ-ভরা আস্থা ছিল। সে আস্থায় কোনও দ্বেষ ছিল না। ছিল শুধু ভালবাসা। তাই দেশবাসী মুসলমানের ধর্মের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ছিল তাঁর। নিজের বাপকে যে সন্তান শ্রদ্ধা করে, পরের বাপের প্রতি সেকদাচ অশ্রদ্ধা দেখাইতে পারেনা। ইহাই ছিল দেশবন্ধুর জীবনদর্শন। নিষ্ঠাবান হিন্দু হইয়াও হিন্দু-মুসলিম এঁকে কেমন করিয়া আন্তরিক বিশ্বাস করা যায়, দেশবন্ধু ছিলেন তার আদর্শ নিদর্শন। দেশবন্ধু পরে আমি আর একজন মাত্র বাংগালী হিন্দু নেতার মধ্যে এই গুণ দেখিয়াছি। ইনি ছিলেন সুভাষ বাবুর জ্যেষ্ঠ সহোদর মিঃ শরৎ বসু। তিনি দেশবন্ধুর মতই নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন। পূজা-অর্চনায় বিশ্বাস করিতেন। নিজের ধর্ম-মরে জন্য যে কোনও ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন। এমন ধর্ম-নিষ্ঠ হিন্দু শরতবাবু মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় প্রাপ্যাধিকার মানিয়া লইতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ও সংকোচ বোধ করিলে না।
কিন্তু অধিকাংশ হিন্দু নেতা চাহিতেন হিন্দু-মুসলমানে মিশ্রণ। তাই বলিয়া এঁরা সকলে দেশবন্ধু ও শরৎবাবুর মত নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন না। হিন্দুধর্মের প্রতি তাঁদের কোনও আস্থা ছিল না, তা নয়। হিন্দু-মুসলিম দুই সামাজিক পৃথক সত্তার স্থলে মিশ্রিত এক সম্প্রদায় হওয়ার অর্থে তাঁরাও না-হিন্দু-না মুসলমান কোনও নয়া সম্প্রদায় বুঝিতেন না। তাঁরা বুঝিতেন মাইনরিটি মুসলমান সমাজ বিপুল বেগবান হিন্দু সম্প্রদায়ে ‘হইবে লীন’। যেমন ক্ষুদ্র জলাশয়ের জল মহাসমুদ্রে লীন হয়। এটাকে তাঁর অন্যায় বা অসম্ভব মনে করিতেন না। ধর্মে পৃথক হইয়াও যখন ব্রাহ্ম-খৃষ্টান বৌদ্ধ জৈন-পার্শি-গুর্গা-শিখেরা মহান হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত থাকিতে বাধে নাই, তখন মুসলমানের বাধিবে কেন?
মুসলিম নেতৃবৃন্দ স্পষ্টতঃই এমন ঐক্যে বিশ্বাস করিতেন না। মুসলিম নেতারা এটাকে নিছক একটা রাজনৈতিক ঐক্য হিসাবে দেখিয়াছেন। সামাজিক ঐক্য হিসাবে দেখিবার উপায় ছিল না। হাজার বছর মুসলমানরা হিন্দুর সাথে একদেশে একত্রে বাস করিয়াছে। হিন্দুদের রাজা হিসাবেও, হিন্দুদের প্রজা হিসাবে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই হিন্দু-মুসলমানে সামাজিক ঐক্য হয় নাই। হয় নাই এইজন্য যে হিন্দুরা চাহিত আর্য-অনাৰ্য্য শক-হন যে ভাবে মহাভারতের সাগরতীরে লীন হইয়াছিল, মুসলমানরাও তেমনি মহান হিন্দু সমাজে লীন হইয়া যাউক। তাদের শুধু ভারতীয় মুসলমান থাকিলে চলিবে না, ‘হিন্দু-মুসলমান’ হইতে হইবে। এটা শুধু কংগ্রেসী বা হিন্দু-সভার জনতার মত ছিল না, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথেরও মত ছিল।
৩. অবাস্তব দৃষ্টিভংগি
এই কারণে ১৯২০ হইতে ১৯৪০ সাল এই বিশ বছরে ভারতীয় রাজনীতির হিন্দু-মুসলিম আপোস চেষ্টা প্রধানতঃ যুক্ত বনাম পৃথক নির্বাচন প্রশ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই নির্বাচনের প্রশ্নটাকে হিন্দুরাজনীতিক নেতৃত্ব কিরূপ গুরুত্বপূর্ণ মনে করিতেন সেটা প্রমাণিত হয় তফসিলী হিন্দুদের পৃথক-নির্বাচনাধিকার স্বীকৃতির বিরুদ্ধে মহাত্মাজীর আমরণ অনশন-ব্রতে। ম্যাকডোনাল্ড সাহেবের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে মুসলমানদের মত তফসিলী হিন্দুদেরও পৃথক নির্বাচন দেওয়া হইয়াছিল। ১৯৩২ সালের আগস্ট মাসে যখন এই এওয়ার্ড ঘোষণা করা হয়, তখন মহাত্মাজী পুণা জেলে বন্দী। সেখান হইতেই তিনি সেপ্টেম্বর মাসে এই ব্যবস্থার প্রতিবাদে আমরণ অনশন-ব্রত গ্রহণ করেন। তফসিলী নেতৃবৃন্দ শুধুমাত্র মহাত্মাজীর জান বাঁচাইবার জন্য আসন সংরক্ষিত যুক্ত নির্বাচন প্রথা মানিয়া লন। বৃটিশ সরকারও ত্বরিতে এই প্রস্তাব মানিয়া লইয়া এওয়ার্ড সংশোধন করেন। মহাত্মাজী অনশন ভংগ করেন। লক্ষণীয়, মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের প্রতিবাদে মহাত্মাজী অনশন করেন নাই। কারণ সুস্পষ্ট। প্রথমতঃ মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন অধিকার আগে হইতে স্বীকৃত ছিল। দ্বিতীয়তঃ গান্ধীজী মুসলমানদের পৃথক সত্তা স্বীকার করিতেন। সুতরাং দেখা যাইতেছে, পৃথক নির্বাচনকে হিন্দু-নেতৃবৃন্দ বরাবরই এই নযরে দেখিয়া আসিয়াছেন। মুসলিম নেতৃত্বও কাজেই অন্য ন্যরে দেখেন নাই। এই কারণেই মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলী ভাই, ডাঃ আনসারী, মাওলানা আযাদ প্রভৃতি যাঁরা বরাবর যুক্ত নির্বাচন সমর্থন করিয়াছেন, তাঁরা অবিমিশ্র যুক্ত নির্বাচন চান নাই। ‘মোহাম্মদ আলী ফরমুলা’ নামে মওলানা মোহাম্মদ আলীর প্রস্তাবিত যে নির্বাচন পদ্ধতি একবার আলোচনার বিষয়বস্তু হইয়াছিল, তাতেও দুই স্তরে নির্বাচন হওয়ার প্রস্তাব ছিল। প্রথম স্তরে শুধু মুসলিম ভোটাররা আসন-সংখ্যার চেয়ে বেশি প্রার্থী নির্বাচন করিবে। ঐ নির্বাচিত প্রার্থীদের মধ্য হইতেই দ্বিতীয় স্তরে হিন্দু মুসলমান যুক্ত ভোটে মেম্বর নির্বাচিত হইবেন। পদ্ধতিগত-মত-বিরোধে শেষ পর্যন্ত এই স্কীমও পরিত্যক্ত হয়। নির্বাচন প্রথার প্রশ্নকে হিন্দু নেতৃবৃন্দ এমন গুরুত্ব দিতেন বলিয়াই প্রতিনিধিত্ব ও সরকারী চাকুরির হারের বেলা তাঁরা নিতান্ত বানিয়া-নীতিতে দরকষাকষি করিয়াও একটু-একটু করিয়া ডোর ছাড়িয়াছেন। কিন্তু কিছু বেশি আসনের বদলে নির্বাচনের বেলা এক ইঞ্চি টলেন নাই। লাখনৌ প্যাটে স্বতন্ত্র নির্বাচন মানিয়া লইয়া যে সব হিন্দু-নেতা ভুল করিয়াছিলেন, হিন্দুরা কোনদিন তাঁদের ক্ষমা করেন নাই। তেমন ভুলের পুনরাবৃত্তি করিতেও তাঁরা রাযী ছিলেন না।
দৃষ্টিকোণের এই মৌলিক পার্থক্য হেতু হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সবচেয়ে বাস্তবদশী মুসলিম প্রবক্তা জিন্না সাহেবকে হিন্দু নেতারা ভুল বুঝিয়াছিলেন। মুসলিম নেতাদের মধ্যে একমাত্র মিঃ জিন্নাই রাজনৈতিক সংগ্রামে হিন্দু-মুসলিমকে ও কংগ্রেস-লীগকে খুব কাছাকাছি রাখিয়া চলিয়াছেন। সাম্প্রদায়িক আপোসে হিন্দু নেতৃত্বের অনমনীয় মনোভাবের মুখেও তিনি কংগ্রেসের সাথে একযোগে মুসলিম লীগকে দিয়া সাইমন কমিশন বয়কট করাইয়াছেন। রাউভটেবল কনফারেন্সে ভারতবাসীর রাষ্ট্রীয় দাবি-দাওয়া ও ডোমিনিয়ন স্টেটাসের পক্ষে কঠোর ইংরাজ বিরোধী বক্তৃতা করিয়াছেন। ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস লীগে নির্বাচনী মৈত্রী করিয়াছেন। বাংলা পাঞ্জাব সিন্ধু সরহদ্দ প্রভৃতি মুসলিম মেজরিটি প্রদেশ জিন্না সাহেবের এই লীগ-কংগ্রেস নির্বাচনী-মৈত্রী মানিয়া লয় নাই সত্য, কিন্তু যুক্তপ্রদেশ বোম্বাই মাদ্রাজ প্রভৃতি মুসলিম মাইনরিটি প্রদেশে সে চুক্তি ফলপ্রসূ হইয়াছিল। তথাপি কংগ্রেস ঐসব প্রদেশে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিবার সময় মুসলিম লীগের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মানিয়া লইতে অস্বীকার করিল। নির্বাচনের আগে ও পরে কংগ্রেসের এই দুই রকম মতকে জিন্না সাহেব বিশ্বাস ভংগ মনে করেন। ফলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে তাঁর আজীবন আস্থা একরূপ ভাংগিয়া যায়। কিন্তু তাতেও জিন্না সাহেব তাঁর আসল ভূমিকা হইতে মুহূর্তের জন্য বিচ্যুত হন নাই! সেকথাটা একটু পরে বলিতেছি।
৪. বাংগালী জাতীয়তা বনাম ভারতীয় জাতীয়তা
হিন্দু-নেতৃত্বের অনমনীয় মনোভাবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের প্রদর্শিত পথ হইতে তাঁদের অদূরদর্শী বিচ্যুতিতে কিভাবে রাজনীতির মোড় ফিরিয়াছিল, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমি লাভ করিয়াছি বাংলার রাজনীতিতে। বাংলার রাজনীতি ভারতীয় রাজনীতি হইতে ছিল বেশকিছু পৃথক ও স্বতন্ত্র। নিখিল ভারতীয় ভিত্তিতে হিন্দুরা যে নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক শাসন চাহিতেন, বাংলার বেলা তা চাহিতেন না। বাংগালী হিন্দুরা বাংলায় মেজরিটি শাসন ও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন উভয়টারই বিরোধী ছিলেন। এটা ছিল অবশ্য হিন্দুদের সাম্প্রতিক মনোভাব। উনিশ শতকের শেষে বিশ শতকের গোড়ার দিকে হিন্দু কবি সাহিত্যিক ও রাষ্ট্র নেতারা ‘বাংগালী জাতিত্ব’ ‘বাংলার বিশিষ্ট’ ‘বাংলার কৃষ্টি’ ‘বাংলার স্বাতন্ত্র’ ইত্যাদি প্রচার করিতেন। অনেকে বিশ্বাসও করিতেন। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় ভোটাধিকার প্রসারে বাংলার রাষ্ট্রীয় অধিকার মেজরিটি মুসলমানের হাতে চালিয়া যাইবে এটা যে দিন পরিষ্কার হইয়া গেল, সেই দিন হইতেই হিন্দুর মুখে বাংগালী জাতিত্বের কথা, বাংলার কৃষ্টির কথা আর শোনা গেল না। তার বদলে ‘ভারতীয় জাতি’ ‘ভারতীয় কৃষ্টি’ ‘মহাভারতীয় মহাজাতি’ ও ‘আৰ্য সভ্যতার’ কথা শোনা যাইতে লাগিল। এর কারণও ছিল সুস্পষ্ট। শেরে-বাংলা ফজলুল হক একদা বলিয়াছিলেন : ‘পলিটিকস অব বেংগল ইয় ইন রিয়েলিটি ইকনমিক্স অব বেংগল। বাংলার অর্থনীতিই বাংলার আসল রাজনীতি। খুব সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিপর্যয়ে বাংলার গোটা মুসলমান সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্রে অধঃপতিত জাতিতে পরিণত হয়। ধর্ম ও কৃষ্টির ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম দুইটা স্বতন্ত্র সমাজ আগে হইতেই ছিল। অর্থনীতিতে মুসলমানদের এই অধঃপতনে জীবনের সকল স্তরে হিন্দু ও মুসলমান সুস্পষ্ট দৃশ্যমান দুইটা পৃথক জাতি হইয়া গেল। পরিস্থিতিটা এমন হৃদয়বিদারক ছিল যে কংগ্রেসের নিষ্ঠাবান কর্মী হইয়াও আমি কংগ্রেস সহকর্মীদের সামনে জনসভায় কঠোর ভাষায় এই পার্থক্যের কথা বলিয়া হিন্দু বন্ধুদের বিরক্তি ভাজন হইতাম। আমি বলিতাম : বাংলার জমিদার হিন্দু প্রজা মুসলমান বাংলার মহাজন হিন্দু খাতক মুসলমান; উকিল হিন্দু মক্কেল মুসলমান; ডাক্তার হিন্দু রোগী মুসলমান; হাকিম হিন্দু আসামী মুসলমান; খেলোয়াড় হিন্দু দর্শক মুসলমান; জেইলার হিন্দু কয়েদী মুসলমান ইত্যাদি ইত্যাদি। এইভাবে আমি তালিকা বাড়াইয়া যাইতাম। যতই বলিতাম ততই উত্তেজিত হইতাম। ততই তালিকা বাড়িত। হাজারবার কওয়া এই কথাগুলিই তীব্রতম কর্কশ ভাষায় বলিয়াছিলাম ১৯৩৩-৩৪ সালে ময়মনসিংহের এক রিলিফ কমিটির বৈঠকে। সেবার ব্রহ্মপুত্র নদীতে বন্যা হইয়া দুকুল ভাসিয়া গিয়াছিল। বন্যা-পীড়িত দুর্গতদের জন্য অন্যান্যদের মত বার এসোসিয়েশনের পক্ষেও একটা রিলিফ কমিটি করা হয়। বেশ টাকা উঠিয়াছিল। প্রায় সব টাকাই হিন্দুরাই দিয়াছিলেন। মুসলমানদের দান খুবই নগন্য। এই তহবিলের টাকা বন্টনে এক সভায় সমিতির প্রেসিডেন্ট রায় বাহাদুর শশধর ঘোষের সাথে আমার তর্ক বাধে। তিনি আমাকে স্মরণ করাইয়া দেন যে চাঁদাদাতারা প্রায় সবাই হিন্দু। আর যায় কোথায়? আমি গর্জিয়া উঠিলাম। আমার হাজার-বার-কওয়া ঐসব কথা মুখস্থ বলিয়া গেলাম এবং উপসংহার করিলাম : অতএব বাংলার দাতা হিন্দু ভিক্ষুক মুসলমান। রায় বাহাদুর ও সমবেত মেম্বরদেয়ে আমি স্মরণ করাইয়া দিলাম বাংলার হিন্দুদের যার ঘরে যত টাকা আছে সব টাকা মুসলমানের। মুসলমান চাষী-মজুরের মাথার-ঘাম পায়ে ফেলিয়া-রোযগারকরা টাকায় হিন্দুরা সিন্দুক ভরিয়াছে, দালান ইমরাত গড়িয়াছে; গাড়ি-ঘোড়া দৌড়াইতেছে। রায় বাহাদুরের নিজের টাকা ব্যাংক ও বাড়ির কথাও উত্তেজনার মুখে বলিয়া ফেলিলাম। রায় বাহাদুরসহ উপস্থিত সকলে হতভম্ব হইয়া গেলেন। কিন্তু রায় বাহাদুর ছিলেন বিচক্ষণ সুচতুর জ্ঞানী লোক। তিনি রাগ গোপন করিলেন। বিতরণের পন্থা হিসাবে আমার প্রস্তাবটা মানিয়া লইলেন, আসন্ন ঝড় কাটিয়া গেল। ব্যাপারটার মধুর উপসংহার হইল।
৫. প্রজা আন্দোলনের স্বরূপ
এটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। কারণ ব্যাপারটা অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সমাজ জীবনের সকল খুটিনাটিতেও এই পার্থক্য পবিত, প্রকটিত ও প্রতিফলিত হইয়াছিল। বাংলার মুসলমানদের নিজের আন্দোলন বলিতে ছিল একমাত্র প্রজা-আন্দোলন। তিতুমীর পীর দুদু মিয়া ও ফকির আন্দোলনের ঐতিহাসিক পুরাতন নযির টানিয়া না আনিয়াও বলা যায়, বাংলার প্রজা-আন্দোলন খিলাফত-স্বরাজ আন্দোলনেরই দশ বছর আগেকার আন্দোলন। আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা হইতেই বলিতে পারি, এ আন্দোলন গোড়ায় ছিল মুসলমানদের সামাজিক মর্যাদার দাবি। শুধু হিন্দু জমিদাররাই মুসলমান প্রজাদিগকে তুই-তুংকার করিয়া অবজ্ঞা করিতেন এবং তাঁদের কাঁচারিতে ও বৈঠকখানায় এদের বসিতে আসন দিতে অস্বীকার করিতেন, তা নয়। তাঁদের দেখাদেখি তাঁদের আমলা-ফয়লা তাঁদের আত্মীয়স্বজন, তাঁদের ঠাকুর-পুরোহিত, তাঁদের উকিল-ডাক্তাররাও মুসলমানদের নিজেদের প্রজা ও সামাজিক মর্যাদায় নিম্নস্তরের লোক মনে করিতেন। এটা জমিদারপ্রজার স্বাভাবিক সাধারণ সম্পর্ক ছিল না। ছিল হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক। কারণ একদিকে বামন-কায়েত প্রজারা জমিদারের কাছারি বৈঠকখানায় বসিতে পাইত। অন্যদিকে বর্ণ হিন্দুর কাছে অমন নিগৃহিত হইয়াও নিম্নশ্রেণীর হিন্দু তালুকদার বা ধনী মহানজরাও মুসলমানদের সাথে বর্ণহিন্দুদের মতই ব্যবহার করিত।
এইভাবে ব্যবহারিক জীবনে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানরা ছিল দুইটি পৃথক সমাজ, ভিন্ন জাত ও স্ব সম্প্রদায়। এদের মিশ্রণে এক সম্প্রদায় ছিল কল্পনাতীত। বিরাট ধর্মীয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লব ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। হিন্দুর দিক হইতেও না মুসলমানের দিক হইতেও না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন যে এই দুই সম্প্রদায়ের স্বান্ত বজায় রাখিয়া হিন্দু-মুসলিম ফেডারেশন করিতে চাহিয়াছিলেন, সেটা মুসলমানের চেয়ে হিন্দুর মনের দিকে কম চাহিয়া নয়। এটাই ছিল রাজনৈতিক বাস্তববাদ। অধিকাংশ হিন্দুনে দেশবন্ধুর এই বাস্তব দৃষ্টির অধিকারী ছিলেন না বলিয়াই তাঁর অবর্তমানে বাংলার মুসলমানরা কংগ্রেস ছাড়িয়া প্ৰজা-পার্টি গঠন করিয়াছিল। সকল দলের সকল মতের এমনকি পরস্পর বিরোধী মতের মুসলমানরা যে ১৯২১ সালে সার আবদুর রহিমের নেতৃত্ব প্রজা-সমিতি গঠন করেন এবং কংগ্রেসী-অকংগ্রেসী জেল-খাটা প্রমহী ও খেতাবধারী মডারেটরা এক পার্টিতে মিলিত হইতে পারেন, এটা বাহির হইতে বিশ্বয়কর মনে হইলেও আসলে তা ছিল না। এক বছর আগে বাংলার আইন পরিষদে কংগ্রেসী হিন্দু মেষরাই প্রজাস্বত্ব বিলের ভোটাভুটিতে এই সাদায়িক কাতারবন্দি এলাইনমেন্ট করিয়া সেই পথ প্রদর্শন করিয়াছিলেন। সে বিলে কংগ্রেসী-অকশ্রেণী প্রজা-জমিদার সব হিন্দু জমিদারের পক্ষে এবং কংগ্রেসী-অকংগ্রেসী প্রজা-জমিদার সব মুসলমান প্রজার পক্ষে ভোট দিয়াছিলেন। তাই প্রজা-সমিতি নামে ও রপে অসাম্প্রদায়িক হইলেও উপরোক্ত কারণে উহা ছিল আসলে বাংলার মুসলিম প্রতিষ্ঠান। বক্তৃত প্রজা-সমিতি গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা মওলানা মোহামদ আকরম খাঁ আমাদেরে বলিয়াই ছিলেন : “হিন্দুরা যেমন অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেস নামে হি-প্রতিষ্ঠান চালায়, আমরাও তেমনি অসাম্প্রদায়িক প্রজা-সমিতি নামে মুসলিম প্রতিষ্ঠান চালাইব।” দশ বছর পরে তারই স্থান দখল করে মুসলিম লীগ খোলাখুলি সাম্প্রদায়িক নামে ও দাবিতে। হিন্দুদের অনেকেই যে প্রজা-আন্দোলনকে আসলে সাম্প্রদায়িক আন্দোলন বলিতেন, সেটা নিতান্ত মিথ্যা অভিযোগ ছিল না। আগেই বালিয়াছি, এই মুদতে বাংলার আর্থিক সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর আগাগোড়াই এমন দুই-জাতি-ভিত্তিক ছিল যে এজী-খাত নামের চুলে ধরিয়া টান দিলে মুসলমান নামের মাথাটি আসিয়া পড়িত। অপর পক্ষে জমিদার-মহাজনের নামের টানে হিন্দুরাও কাতারবন্দি হইয়া যাইত। প্রজা-আন্দোলনের ডাকে যে কাতারবন্দিটা হইত, তা ছিল এই কারণেই মুসলমান জনসাধারণের আর্থিক ও সামাজিক মুক্তি চেষ্টা, সামাজিক মর্যাদার দাবি। প্রজা আন্দোলনকে যে অনেকে কৃষক-বিরোধী জোতদার আন্দোলন বলিয়া নিন্দা করিতেন, তাঁদের কথাও একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না। প্রজা-আন্দোলন সত্যসত্যই কৃষক আন্দোলন ছিল না। লাংগল যার মাটি তার যিকিরটা তখনও উঠে নাই। ১৯৩৩ সালে বাংলা সরকারের প্রচারিত এক প্রশ্নাবলীর উত্তরে ময়মনসিহ প্রজা-সমিতির কার্যকরী কমিটির সভায় উপস্থিত বত্রিশজন মেম্বরের মধ্যে মাত্র তিনজন বর্গাদারকে দখলী স্বত্ব দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়াছিলেন। অন্যান্যেরা শুধু বিরুদ্ধে ভোটই দেন নাই, তীব্র ও ক্রুদ্ধ প্রতিবাদও করিয়াছিলেন।
৬. প্রজা বনাম কৃষক-প্রজা
আসলে ব্যাপার এই যে বাংলার অধিকাংশ জিলায় প্রজা মানেই কৃষক, কৃষক মানেই প্রজা। তাঁদের শতকরা আশিজন নিজের হাতে নিজের জমিতে হালচাষও করেন। কিছু জমি বর্গাও দেন। এঁদের বিপুলসংখ্যক মেজরিটির পরিবারপিছে দশ একরের বেশি জমি নাই। কাজেই তাঁদের জোতদার বলা যায় না। এদের প্রকৃত নাম কৃষক প্রজা। এই জন্যই ১৯৩৬ সালে নিখিল বংগ প্রজা সমিতির নাম বদলাইয়া যখন কৃষকপ্রজা রাখা হয়, তখন কোনও বিপ্লবী পরিবর্তনের কথা কারও মনে পড়ে নাই। কালক্রমে গণআন্দোলনের প্রসারে ও সার্বজনীন ভোটাধিকারের রাস্ত্রীয় প্রয়োগে এই কৃষক-প্রজা সমিতিই একদিন ভূমিহীন কৃষক ও শ্রমিকসহ বাংলার জনগণের প্রকৃত গণপ্রতিষ্ঠান হইত যদি না নিখিল ভারতীয় সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক অন্যদিকে মোড় ফিরাইত। এটা শুধু মুসলমান দিকের কথা নয়, হিন্দুর দিকের কথা। গণতন্ত্রের বিকাশের প্রসারের সংগে সংগে হিন্দুরা যখন বুঝিতে পারেন যে স্বায়ত্তশাসিত বা স্বাধীন বাংলার গণতান্ত্রিক রাষ্টপরিচালনায় হিন্দু রাষ্ট্রীয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূঞ্জিত অধিকার বিপন্ন হইবে, সেই দিন হইতেই তারা বাংলার মুসলিম মেজরিটির আওতা হইতে নিখিল ভারতীয় হিন্দু মেজরিটির আশ্রয়ে চলিয়া গেলেন। বাংলাদেশ ভারতের প্রদেশ হইল। বাংগালী জাতি ভারতীয় জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশমাত্র হইয়া গেল। এদিকে না গিয়া বাংলার কংগ্রেস যদি বাস্তববাদী দৃষ্টিভংগি লইয়া প্ৰজাপার্টির সহিত সহযোগিতা করিত, তবে ভারতের না হউক বাংলার রাজনীতি অন্যরূপ ধারণ করিত। বাংলার কংগ্রেস তথা বংলার হিন্দু নিখিল ভারতীয় হইয়া পড়ায় বাংলার মুসলমানদের নিখিল ভারতীয় না হইয়া উপায়ান্তর ছিল না।
এই ঘটনাটিই ঘটে ১৯৩৭ সালে হক মন্ত্রিসভা গঠনের সময়। এই কারণেই আমি এ সম্পর্কিত খুটিনাটি বিবরণ দেওয়া দরকার মনে করিয়াছি। হক মন্ত্রিসভা গঠনের সময় বাংলার কংগ্রেসের নেতৃত্ব ঐ অবাস্তব ও অদূরদশী মনোভাব গ্রহণ করার ফলে হক সাহেব তথা প্ৰজাপার্টির মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। এর পরে হক সাহেবের তথা গোটা মুসলিম বাংলার লীগে যোগদান করা এবং প্রজাপার্টির মৃত্যু ঘটা ঐতিহাসিক ঘটনা-স্রোতেই অনিবার্য হইয়া পড়িয়াছিল। বস্তুতঃ বাংলার নিজস্ব রাজনীতির অবসান ঐদিনই ঘটিয়াছিল।
হিন্দু-মুসলিম-সম্পর্কের এই তিক্ততার জন্য শুধু হিন্দুদেরেই দায়ী করিলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হইবে। ১৯২৮ সালে বাংলার হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক সভায় সার আবদুর রহিম ও ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের মধ্যে যে কথা কাটাকাটি হইয়াছিল সেদিক পাঠকদের দৃষ্টি আবার আকর্ষণ করিতেছি। ঐ সভায় ডাঃ রায় বলিয়াছেন : ‘মুসলমানরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয় না; শুধু প্রতিনিধিত্ব ও চাকরি-বাকরিতে অংশ চায়। সার আবদুর রহিম অবশ্যই সে কথার জবাব দিয়াছিলেন। কিন্তু একটু ধীরভাবে বিচার করিলে স্বীকার করিতে হইবে, ডাঃ রায়ের ঐ অভিযোগ ভিত্তিহীন ছিল না। বস্তুতঃ আইন সভায় প্রতিনিধিত্ব ও সরকারী চাকুরিতে মুসলমানদের দাবি-দাওয়া মানিয়া লওয়ার ব্যাপারে হিন্দু-নেতৃত্বের কৃপণতার ও শাির যথেষ্ট কারণ ছিল। ডাঃ রায়ের কথাটা তাঁর ব্যক্তিগত মত ছিল না। ওটা ছিল সাধারণভাবে হিন্দুদের এবং বিশেষভাবে কংগ্রেসের নেতৃত্বের অভিযোগ। এমন যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তিনি পর্যন্ত বলিয়াছেন : ‘দেশকে ভাল না বাসিয়া দেশের স্বার্থে কোনও কাজ না করিয়া মুসলমানরা শুধু ফললাভে সিংহের ভাগ বসাইতে চায়।‘ ‘সিংহের ভাগ’ কথাটা অতিশয়োক্তি কিন্তু মোটের উপর কথাটা সত্য। ঐতিহাসিক যত কারণ ও পারিপার্শ্বিক যত যুক্তিই থাকুক না কেন, এই যুগের বাস্তব অবস্থা ছিল এই যে মুসলমানরা সাধারণভাবে ও শিক্ষিত সম্প্রদায় বিশেষভাবে নিজেদের মাতৃভূমিকে আপন দেশ মনে করি না। তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কামে-কাজে এটা মনে হওয়া মোটই অযৌক্তিক ছিল না যে মুসলমানরা নিজের দেশের চেয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম, দেশগুলিকেই বেশি আপন মনে করে। প্রথমতঃ মুসলমানদের কোনও সুস্পষ্ট রাজনৈতিক চিন্তা-ধারা ছিল না। যদি কিছু থাকিয়া থাকে সেটা ছিল প্যানইসলামিযম। ‘মুসলিম হায় হাম সারা জাহী হামরা’ই যেন ছিল তাদের সত্যকার রাষ্ট্র-দর্শন। ১৯২০-২১ সালে খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলন যে ভারতীয় মুসলমানদের একটা অভূতপূর্ব। গণ-আন্দোলনে পরিণত হইয়াছিল, সেটা খিলাফত ও তুর্কী সাম্রাজ্যের জন্য যতটা ছিল, ভারতের স্বরাজ্যের জন্য ততটা ছিল না। এটা হাতে-নাতে প্রমাণিত হইল দুই বছরের মধ্যে। ১৯২৩ সালে কামাল পাশা যখন খলিফাঁকে দেশ হইতে তাড়াইয়া খিলাফতের অবসান ঘোষণা করিলেন, তখনই ভারতের মুসলমানদের উৎসাহে ভাটা পড়িল। খিলাফত কমিটি মরিয়া গেল, মুসলমানরা কংগ্রেস ছাড়িয়া দিল। এতে তারা এটাই বুঝাইল যে খিলাফতই যখন শেষ হইয়া গেল, তখন দেশের স্বাধীনতায় তারা আর ইন্টারেস্টেড নয়।
৭. মুসলিম রাজনীতির বিদেশ-মুখিতা
এটার না হয় রাজনৈতিক কারণ ছিল। কিন্তু জন-সেবার মধ্যে ত কোনও রাজনীতি আসিবার কথা নয়। সেখানেও মুসলমানদের মনোভাব ছিল বিদেশ-মুখী। মুসলমানদের মধ্যে ধনী ও দানশীল লোকের খুব বেশি অভাব ছিল না। কিন্তু সারা ভারতে মুসলমানদের ব্যক্তিগত দানে একটা হাসপাতাল বা কলেজ স্থাপনের নযির নাই। সমস্ত দানশীলতা এদের মসজিদ নির্মাণে সীমাবদ্ধ। ওটাও নিশ্চয়ই মুসলিম জনতার সুবিধার জন্য ততটা ছিল না যতটা ছিল সওয়াব হাসিল করিয়া নিজে বেহেশতে যাইবার উদ্দেশ্যে। নৈসর্গিক বিপদ-আপদেও তারা অর্থ-সাহায্য যে না করিতেন তা নয়। কিন্তু সেটাও দেশে নয় বিদেশে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হইতেই বলিতেছি। এই বাংলাতেই মুসলিম প্রধান এলাকাতে যদি বন্য-মহামারী হইত, তবে তার রিলিফের কাজেও হিন্দুদাতাদের উপরই নির্ভর করিতে হইত; মুসলমান দাতারা থলির মুখ খুলিতেন না। হাজারের মধ্যে একটা নযির দেই। উত্তর বাংলার এক বিশাল এলাকার বন্যা হইয়া প্রায় আশি লক্ষ লোক বিপন্ন হইল। ইহাদের বিপুল মেজরিটি ছিল মুসলমান। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের নেতৃত্বে সংকট-ত্রাণ সমিতির প্রায় কোটি টাকা চাঁদা তুলিয়া বহুদিন পর্যন্ত এই এলাকায় রিলিফ চালাইল। এই সমিতির বেঘসেবক হিসাবে কাজ করিয়া আমরা কলিকাতার ধনী মুসলমানদের নিকট উল্লেখযোগ্য কোনও চাঁদা পাই নাই। কিন্তু এর কিছুদিন পরে তুরস্কের আনাতোলিয়ার ভূমিকম্পের দুর্গতের রিলিফের জন্য মোহাম্মদ আলী পার্কের এক জনসভাতেই তিন লাখ টাকা চাঁদা উঠাইয়াছিল। ফলে হিন্দু প্রতিবেশী ত দূরের কথা কোন নিরপেক্ষ বিদেশী পর্যটকেরও এই সময়ে মুসলমানদের ব্যবহারে মনে হইত এরা ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভালমন্দের চেয়ে মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম জাহানের ভাল-মন্দের কথাই বেশি চিন্তা করে। এই ভাব-গতিক দেখিয়া হিন্দু নেতৃবৃন্দের এমন সন্দেহ হওয়াও বিচিত্র বা অযৌক্তিক ছিল না যে মুসলমানদের দাবি-দাওয়া-মত চাকরি-বাকরি দিলেও তারা ভারতের রাজনৈতিক অধিকারের জন্য লড়িবার বদলে ইংরাজ সরকারকেই সমর্থন করিবে। এটা আরও বেশি সম্ভব মনে হইত এই জন্য যে এই মুদতে মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব মোটের উপর ছিল নাইট-নবাব ও খান বাহাদুরদের হাতে। এরা বিশ্বাস করিতেন এবং খোলাখুলি বক্তৃতা বিবৃতিতে বলিতেনও যে যতদিন এদেশে ইংরাজ আছে ততদিনই আমরা বাঁচিয়া আছি। ইংরাজ চলিয়া যাওয়ার সাথে সাথে হিন্দুরা আমাদেরে শেষ করিয়া ফেলিবে। হিন্দু নেতা সরকারী কর্মচারী ও উকিল মোখতারাদি ব্যবসায়ী এবং সর্বোপরি জমিদার-মহাজনদের অদূরদশী ব্যবহারে মুসলমানের এই সন্দেহ আরও দৃঢ় হইত। বাস্তবে প্রমাণিত হইত। মোট কথা ভারতের মুসলমানরা এই যুগে ছিল কার্যতঃ একটা দেশহীন ধর্মসম্প্রদায় মাত্র। নিজের দেশকে অবস্থা-বৈগুণ্যে এরা হিন্দুর দেশ মনে করিত। কেউ কেউ এই ‘দারুলহর্ব’ ছাড়িয়া পশ্চিমে ‘দারুল ইসলামে’ হিজরত করিবার কথাও ভাবিতেন। কাজেই এই ‘হিন্দুর দেশ’ হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা বা অর্থনৈতিক উন্নতির কথা তাঁরা ভাবিতে যাইবেন কেন? এই দেশ যে তাঁদের, এই দেশ শাসন করিবার অধিকার ও এই দেশের কল্যাণ সাধনের দায়িত্ব যে তাঁদের, তাঁদেরই ভাইয়েরা যে কৃষক-মদুর হিসাবে দেশের খোরাকি ও অন্যান্য সম্পদ সৃষ্টি করিতেছে মাথার ঘাম পায় ফেলিয়া, একথা যেন তাঁদের মনেই পড়িত না। কাজেই দেশগপ্রাণ, দেশের জন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তৃত, পরাধীনতার জ্বালায় দগ্ধ এবং স্বাধীনতা-সংগ্রামেলিও হিন্দুরা যদি মুসলমান নেতাদের দেশপ্রেমে সন্দেহ করিয়া থাকে, তবে তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
৮. বাস্তববাদী জিন্নাহ
এই সার্বিক বিভ্রান্তি-বিরোধের অন্ধকার যুগে যে একজন মাত্র লোক বাস্তববাদীর দৃষ্টিকোণ হইতে সকল অবস্থায় হিন্দু-মুসলিম আপোসের কথা বলিয়াছিলেন, তিনি ছিলেন মিঃ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তাঁর মৈত্রী প্রচেষ্টার যে বিশেষ দিকটা তৎকালে আমরা বুঝিতে পারি নাই এবং পরবর্তীকালে পরিষ্কার হইয়া উঠিয়াছিল, তা এই যে তিনি শুধু মুসলমানদের অধিকারের কথা বলেন নাই, তাদের দায়িত্বের কথাও বলিয়াছেন। আরও স্পষ্ট ভাষায় বলিতে গেলে বলিতে হয় তিনিই একমাত্র মুসলিম নেতা যিনি মুসলমানদের বিদেশ-মুখিতা হইতে স্বদেশমুখী করিয়াছেন। কংগ্রেসের বাইরে তিনিই একমাত্র মুসলিম নেতা যিনি মুসলমানদের ইংরেজ বিরোধিতায় কংগ্রেসের পাশাপাশি রাখিয়াছিলেন। নিজেদের অধিকারের জন্য হিন্দুদের বিরুদ্ধে লড়িবার সংগে সংগে দেশের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য ইংরাজের সহিত সংগ্রামে তিনিই মুসলমানদের আগাইয়া নিয়াছেন। জিন্না সাহেবের এই রাষ্ট্রদর্শনের সবটুকু ব্যক্তিগতভাবে আমি তখনও বুঝি নাই, একথা সরলভাবে স্বীকার করিতেছি। এই কারণে আমি কখনও-কখনও তাঁর ভক্ত সমর্থকও যেমন ছিলাম, আবার কখনও কখনও তেমনি কঠোর সমালোচকও ছিলাম। যে সময় এবং যে কাজে তাঁর সমর্থন করিয়াছিলাম, তাও করিয়াছি তাঁর খাতিরে নয় কংগ্রেসের খাতিরে। অর্থাৎ যে-যে। কাজে কংগ্রেসের সাথে তাঁর মিল ছিল, যখন-যখন তিনি কংগ্রেসের নীতির সমর্থন করিয়াছিলেন, কংগ্রেসের সাথে সাথে সংগ্রাম করিয়াছেন, যখন-তখন তিনি মুসলিম .নাইট-নবাব ইত্যাদি খেতাবধারীকেইংরাজের পো-ধরা বলিয়া গাল দিয়াছেন, তখন–তখন আমি পরম উৎসাহে তার সমর্থন করিয়াছি। পক্ষান্তরে যখন তিনি কংগ্রেসের বিরোধিতা করিয়াছেন, তখন আমিও তাঁর বিরোধিতা করিয়াছি। লাখনৌ-প্যাকট গ্রহণ হইতে শুরু করিয়া সাইমন কমিশন বয়কট ও ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে হিন্দু প্রধান প্রদেশগুলিতে কংগ্রেস-লীগ নির্বাচনী মৈত্রী পর্যন্ত সব কাজই আমার আন্তরিক সমর্থন পাইয়াছে। পক্ষান্তরে ১৯২১ সালে যখন তিনি কংগ্রেসের খিলাফত ও অসহযোগ নীতির প্রতিবাদে কংগ্রেস ত্যাগ করেন তখন আমি তাঁর উপর মনে মনে ক্রুদ্ধ হইয়া উঠি। খিলাফত আন্দোলনকে যখন তিনি অবস কিউরেন্টিস্ট ধর্মীয় গোড়ামি আখ্যা দেন, আর রাজনীতিতে ধর্ম আমদানির দোষারোপ করেন, তখন আমি তার মুসলমানী ঈমানেই সন্দেহ করিয়া বসি এবং তিনি যে শিয়া সেকথাও স্মরণ করি। পক্ষান্তরে তিনি যখন গান্ধীজীর হরিজন অস্পৃশ্যতা ও গো-রক্ষা নীতিকে অবস্ কিওরেন্টিস্ট ধর্মীয় গোড়ামি বলিয়া নিন্দা করেন এবং রাজনীতিতে ধর্মের আমদানির বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন তখন আমার বিশ্বাস ও মতবাদে একটা প্রচন্ড ঝকি লাগে। জিন্না সাহেবের অভিমতের একটা দাম আছে বলিয়াও আমার মনে হয়। কিন্তু এটাই যে সেকিউলারিযম বা ধর্ম-নিরপেক্ষ রাজনীতি তখনও তা বুঝি নাই।
মোট কথা, এই যুগের রাজনীতির মধ্যে তেসরা দশকের আগেরও চৌথ দশকের শেষ দিকে কয়েক বছর ছাড়া জিন্না সাহেবের ব্যক্তিগত নেতৃত্ব দেখিতে কুয়াশাচ্ছন্ন থাকা সত্ত্বেও আসলে কিন্তু তা ছিল না। গান্ধীজী ও আলী ভাইর চান-সুরুজের মত প্রখর চাকচিক্যপূর্ণ সর্বগ্রাসী ব্যক্তিত্ব ও দৈত্যের মত দুঃসাহসিক নেতৃত্ব দেশবাসীর হৃদয় এমনভাবে জয় করিয়াছিল যে জিন্না সাহেবকে এই মুদতে কিছুদিনের জন্য দেশে ও বিদেশে রাজনৈতিক নির্বাসন যাপন করিতে হইয়াছিল। কিন্তু পরবর্তী কালের ইতিহাস প্রমাণ করিয়াছে যে, এই যুগেও তিনি তাঁর চির জীবনের স্বপ্নসাধ হিন্দু মুসলিম আপোসের ভিত্তিতে ভারতীয় রাজনীতিতে একটা সুস্থতা আনিবার চিন্তাতেই নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু আমি তৎকালে অত গভীরে তলাইয়া দেখি নাই। তার কয়েকটি কারণ ছিল। আমি বাংলার রাজনীতিকে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করিতাম, ভারতীয় রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করিতাম না। ওটাকে বরং আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ মনে করিতাম। বাংলায় মুসলিম মেজরিটি ছিল বলিয়াই বোধ হয় আমি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধী ছিলাম। জমিদারি উচ্ছেদকে বাংলার গণ-মুক্তির বুনিয়াদ ও কৃষক-প্রজা সমিতিকে বাংলার ভবিষ্যৎ জাতীয় প্রতিষ্ঠান মনে করিতাম। জিন্না সাহেব এই দুইটা মৌলিক ব্যাপারেই ভিন্নমত পোষণ করিতেন। তাঁর রাজনীতিও ছিল স্বভাবতঃই নিখিল ভারতীয়।