নয়া যমানার পদধ্বনি
উপাধ্যায় দুই
১. আওয়ামী লীগের বিপুল জয়
এই বইয়ের গত সংস্করণের শেষ পাতায় লিখিয়াছিলাম গণতন্ত্রের চাবিকাঠি এখন আর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাতে নাই। এটা এখন নেতাদের, তথা নির্বাচিত পরিষদের, হাতে। কথা কয়টা লিখিয়াছিলাম ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মুখে। পরে সত্যসত্যই সে নির্বাচন হইয়াছিল ঐ সালের ৭ই ডিসেম্বর। পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলেই এক দিনে। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব-পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের দুটি বাদে সব কয়টি, মানে ১৬৭টি দখল করিয়াছিল। ঘূর্ণিঝড়ের দরুন উপকূলের নয়টি নির্বাচনী এলাকার নির্বাচন এক মাস পরে হইয়াছিল। তার সব কয়টিও আওয়ামী লীগই দখল করিয়াছিল বলিয়া সে কথা আলাদা করিয়া বলিলাম না। বস্তুতঃ নির্বাচনের ফলাফল ও পরিণামের দিক হইতে তা নিতান্তই অবান্তর। পশ্চিমাঞ্চলের নির্বাচনের ফলাফল ঠিক তেমন না হইলেও প্রায় কাছাকাছি। সেখানকার জাতীয় পরিষদ সদস্যের ১৪৪টির মধ্যে ৮৪টি আসন মিঃ ভুট্রোর পিপলস্ পার্টি দখল করিয়াছিল। ফলে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলে দুই পার্টি একক মেজরিটি লাভ করিল। কোনটিই অপর অঞ্চলে একটিও আসন লাভ না করায় দুইটিই আঞ্চলিক পার্টি হইয়া গেল। পাকিস্তানের দুইটি অঞ্চল যে বস্তুতঃ দুইটির পৃথক স্বতন্ত্র দেশ, দুইটির রাজনৈতিক চিন্তায়, অর্থনৈতিক স্বার্থে, সুতরাং নেতৃত্বে, যে কোন ঐক্য বা সাদৃশ্য নাই, একথা পশ্চিমা নেতারা বা শাসকগোষ্ঠী কোনওদিন মানেন নাই। ১৯৭০ সালের এই নির্বাচনে পশ্চিমা নেতাদের দাবি মিথ্যা ও পূরবী নেতাদের দাবি সত্য, সুস্পষ্ট ও নিঃসন্দেহরূপে তা প্রমাণিত হইল। পাকিস্তান পার্লামেন্টের জন্য যতদিন মেম্বর সংখ্যার প্যারিটি ছিল, ততদিন ঐ ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সত্য পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য বিপদজ্জনক ছিল না। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া প্যারিটির স্থলে জনসংখ্যা-ভিত্তিক আসনের বিধান করায় এই বিপদ অবশ্যম্ভাবী ও আসন্ন হইয়া গিয়াছিল।
২. প্যারিটির জাতীয় তাৎপর্য
পাঠকগণের স্মরণ আছে ‘পুন’ শীর্ষক আগের অধ্যায়ে আমি জেনারেল ইয়াহিয়ার এ কাজের বিস্তারিত সমালোচনা করিয়াছিলাম। আমি বলিয়াছিলাম, পূর্ব পাকিস্তানের কোন জনপ্রিয় নেতা বা পার্টিই প্যারিটি বাতিলের দাবি করেন নাই। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একরূপ নিজ দায়িত্বেই প্যারিটি ভাংগিয়া ‘ওয়ানম্যান ওয়ানভোট’ নীতির ভিত্তিতে এল, এফ, ও, জারি করিলেন। দৃশ্যতঃ তিনি পূর্ব-পাকিস্তানীদের উপর সুবিচার করিবার মতলবেই এটা করিয়াছিলেন। গোড়াতে যে প্যারিটির উপর পশ্চিমা নেতারা এত জোর দিয়াছিলেন, যে প্যারিটি না হইলে পশ্চিমারা কোনও সংবিধান রচিত হইতেই দিবেন না বলিয়াছিলেন, সেই পশ্চিমা নেতারাই হঠাৎ পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রতি সুবিচার করিবার জন্য এতটা ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন কেন? পশ্চিমা নেতাদের বেশির ভাগ, অন্ততঃ প্রভাবশালী অংশের বেশির ভাগ, রাযী না হইলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্যারিটি ভাংগিয়া জনসংখ্যা ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের ফরমূলা পুনঃ প্রবর্তন করিতেন না, এটা নিশ্চয় করিয়া বলা যায়। দৃশ্যতঃ পূর্ব পাকিস্তানের উপর এই সুবিচারটা তাঁরা স্বেচ্ছায় ও অযাচিতভাবে কেন করিলেন, সকলের মনে এ প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় পশ্চিমা নেতারা বেশ কিছুদিন দেখিয়া-শুনিয়া এটা উপলব্ধি করিয়াছিলেন যে, দুই অঞ্চলের মধ্যে প্রতিনিধিত্বের প্যারিটি দাবি করিয়া এবং পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের নিকট হইতে সে দাবি আদায় করিয়া, নিজের ফাঁদে তাঁরা নিজেরাই পড়িয়াছিলেন। প্রতিনিধিত্বের প্যারিটির প্রতিদানে আওয়ামী লীগের সার্বিক প্যারিটি দাবি করায়, যুক্ত-নির্বাচন চালু করায় এবং সুহরাওয়ার্দী সাহেবের শতকরা ৯৮ ভাগ অটনমি পাওয়ার উল্লাসে পশ্চিমা নেতারা ধীরে ধীরে প্যারিটির রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝিতে সমর্থ হইয়াছেন।
১৯৫৫ সালের ঘটনা যাঁদের মনে আছে, তাঁরা সবাই জানেন যে, সুহরাওয়ার্দী যখন প্যারিটির কথা লইয়া পূর্ব-বাংলায় আসেন, তখন হক সাহেব ও মওলানা ভাসানী উভয়েই তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। হক সাহেব খবরের কাগযে বিবৃতি দেন এবং পল্টন ময়দানে জনসভা করেন। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত মিটিংয়ে তাঁর তীব্র বিরোধিতার ব্যাখ্যা করেন। তারপর শহীদ সাহেবের সংগে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর হক সাহেব ও তাসানী সাহেব প্যারিটি মানিয়া নেন। হক সাহেব শুধু একা মানিয়া নেন নাই, তাঁর কে, এস, পি, পার্টিকে দিয়া মানাইয়াছিলেন। ঐ সময়কার কে, এস, পি, পার্টিতে অনেক বিদ্বান, অভিজ্ঞ ও দূরদশী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, তাও সকলের জানা আছে। তাঁরাও প্যারিটি মানিয়া নেন। বস্তুতঃ প্যারিটিভিত্তিক ’৫৬ সালের শাসনতন্ত্র তাঁরাই রচনা করেন।
এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পূর্ব-বাংলার তৎকালীন নেতারা চোখ বুজিয়া বিনা বিচারে প্যারিটি মানিয়া নেন নাই। বরঞ্চ আগে তুমুল প্রতিবাদ করিয়া নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পরে মানিয়া লওয়ায় এটাই বুঝা যায় যে, সুহরাওয়ার্দী সাহেব প্যারিটির পক্ষে জোরদার যুক্তি দিয়াছিলেন এবং হক সাহেব ও ভাসানী সাহেব এবং তাঁদের পার্টিদ্বয় বিশেষ বিচার-বিবেচনা করিয়াই তা গ্রহণ করিয়াছিলেন। হক সাহেব ও তাঁর দলের বিশেষ দায়িত্ব এই যে, তাঁরা পরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী মন্ত্রিসভার মেম্বর হিসাবে প্যারিটিকে শাসনতন্ত্রের ভিত্তি করিয়াছিলেন। এ দায়িত্ব নিশ্চয়ই তাঁরা দূরদর্শী রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লইয়াই পালন করিয়াছিলেন।
পক্ষান্তরে আমরা আওয়ামী লীগাররা শাসনতন্ত্রের বিরোধিতা করিয়াছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত ওয়াকআউটও করিয়াছিলাম। কিন্তু সে ওয়াক-আউট প্রতিনিধিত্বে। প্যারিটির প্রতিবাদে ছিল না। অন্যান্য ব্যাপারেও প্যারিটি না করায়, যুক্ত-নির্বাচন প্রথা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত না করায়, এবং পূর্ব-পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না। দেওয়ায়, এক কথায়, পাঁচ-দফা মারি চুক্তির খেলাফে সংবিধান রচিত হওয়ার প্রতিবাদেই আমরা ওয়াক-আউট করিয়াছিলাম এবং শাসনতন্ত্রিক বিলে দস্তখত দিতে অস্বীকার করিয়াছিলাম।
এইভাবে শান রচিত হওয়ার পর বছর না ঘুরিতেই আমাদের নেতা সেই সংবিধানের অধীনেই মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিলেন এবং সকলকে বিস্মিত করিয়া বলিলেন : পূর্ব-পাকিস্তানের শতকরা ৯৮ ভাগ অটনমি হাসিল হইয়া গিয়াছে। সকল দলের পূর্ব-পাকিস্তানীদের মত আমরা তাঁর অনুচরেরাও তাঁকে ‘গাযী গাযী করিয়া ধরিয়াছিলাম। তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে স্বীয় উক্তির যে ব্যাখ্যা দিয়াছিলেন, তাতে আমাদের অনেকেরই চোখ খুলিয়াছিল। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা আমাদেরে বিশিত-পুলকিত করিয়াছিল। সে ব্যাখ্যাটির সারমর্ম ও উপসংহার তাঁর ভাষায় ছিল এই : ৪৬ সালে দিল্লী প্রস্তাব পেশ করিয়া আমি লাহোর প্রস্তাব ‘বিট্রে করিয়াছি, এটাই ছিল তোমাদের ক্ষোভ। প্যারিটি ও ওয়ানইউনিটে আজ পাকিস্তান লাহোর প্রস্তাবের কাঠামোতে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হইল। এখন তোমাদের ক্ষোভ দূর হওয়া উচিৎ। আমাদের হইয়াছিলও তাই। তিনি বুঝাইয়াছিলেন, লাহোর প্রস্তাবে ভারতের দুই কোণে দুইটি স্বাধীন স্বতন্ত্র পাকিস্তান হওয়ার কথা। দিল্লী প্রস্তাবে ঐ দুইকে এক করা হইয়াছিল। এই প্রস্তাবটি পেশ করেন সুহরাওয়ার্দী সাহেব নিজে। এই প্রস্তাবে দুইয়ের জায়গায় এক পাকিস্তান হইয়াছিল বটে, লাহোর প্রস্তাবের আর সবটুকুই অপরিবর্তিত ছিল। সে প্রস্তাবে পূর্ব ও পশ্চিমের দুইটি ভূখণ্ডকে দুইটি অঞ্চল বা রিজিওন করা হইয়াছিল। দুই রিজিওনে দুইটি স্বাধীন ফেডারেশন না হইয়া দুই রিজিওন মিলিয়া একটি মাত্র ফেডারেশন হওয়ায় রিজিওন দুইটি স্বতঃই অটমাস ও সভারেন ইউনিট হইয়া গিয়াছিল। এটাই পরবর্তীকালে অগ্রাহ্য করিয়া পাকিস্তানকে মামুলিকভাবে নামমাত্র ফেডারেশন ত করা হইলই, তার উপর পূর্ব-বাংলাকে পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশ ও অর্ধডজন দেশীয় রাজ্যের ভিড়ের মধ্যে মাত্র একটি প্রদেশ গণ্য করা হইল। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে প্যারিটি ও ওয়ান ইউনিটে। এই দিক হইতে প্যারিটি ও ওয়ান ইউনিটে লাহোর প্রস্তাবের পুনঃ প্রতিষ্ঠা হয়।
কিন্তু তাই বলিয়া এটাকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের শতকরা ১৮ বলা যায় কেমন করিয়া? সেটাও শহীদ সাহেব বুঝাইয়াছিলেন। পরবর্তীকালে তার প্রমাণও দিয়াছিলেন। মারি চুক্তির প্যারিটির মধ্যে প্রতিনিধিত্বের প্যারিটি ছাড়া আরও দুইটি কথা ছিল? এক, সর্ববিষয়ে সামগ্রিক প্যারিটি, দুই, যুক্ত-নির্বাচন। ‘৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে শুধু প্রতিনিধিত্বের প্যারিটিটাই ছিল। বাকী দুইটি ছিল না। হক সাহেব ও তাঁর পার্টির সবাই যুক্ত নির্বাচনের সমর্থক হইয়াও ‘৫৬ সালের শাসনতন্ত্র উহা ঢুকাইতে পারেন নাই। কারণ কোয়ালিশনের অপর শরিক মুসলিম লীগাররা পৃথক নির্বাচনকে ঈমানের অংগ ও পাকিস্তানের ভিত্তি মনে করিতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে সুহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হইয়া পশ্চিম-পাকিস্তানের সেই পৃথক নির্বাচন ওয়ালাদেরই যুক্ত-নির্বাচন গ্রহণ করাইয়াছিলেন। এই কাজের ভিতর দিয়া সুরাওয়ার্দীর প্রজ্ঞা ও নেতৃত্ব প্রখর ঔজ্জ্বল্যে ঝলমল করিয়া উঠিয়াছিল। আর কিছুদিন গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকিলে পশ্চিমা ভাইদেরে দিয়া তিনি প্যারিটির বাকী শর্ত সামগ্রিক প্যারিটিও গ্রহণ কাইতে পারিবেন, এ বিশ্বাস তাঁর তখনও ছিল, পরেও সে বিশ্বাস ভাংগে নাই। আমি আজও বিশ্বাস করি, এ বিশ্বাস তাঁর ভিত্তিহীন ছিল না।
৩. পশ্চিমা নেতাদের বোধোদয়
এটাই বুঝিয়াছিলেন পশ্চিমা নেতারা হক সাহেব ও সুহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর পাঁচ-সাত বছর পরে। তাই প্যারিটির বদলে ‘ওয়ানম্যান ওয়ান ভোট পুনঃ প্রবর্তন করিয়া দুই পাকিস্তানকে এক পাকিস্তান, এক দেশ, এক রা করিবার এবং পূর্ব-পাকিস্তানকে দুই শরিকের এক শরিকের বদলে ছয় শরিকের এক শরিক করার জন্য ইয়াহিয়া এই ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পশ্চিমের ওয়ান ইউনিট ভাংগিয়া আগের মত শুধু চারটা প্রদেশ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই। ট্রাইবাল এরিয়া নামে প্রকারান্তরে একটি পঞ্চম প্রদেশ স্থাপন করিয়াছিলেন। এতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াব দুইটা মতলব ছিল। এক, পূর্ব-পাকিস্তান দুই শরিকের একজন হইতে ছয় শরিকের একজন হইল। এটা শাসনতান্ত্রিক সংবিধানে নিশ্চিত হইয়া গেল। দুই, পূর্ব-পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি হইলেও এখানে কোন অবস্থাতেই এক পার্টি মেজরিটি হইতে পারিবে না। ইয়াহিয়া যখন এ, এফ, ও, করেন, তখন পূর্ব পাকিস্তানে পার্টির সংখ্যা ছিল স্পষ্টতঃই তেরটা। ‘৭০ সালের নির্বাচনের সিম্বল বিতরণের সময় দেখা গেল পার্টি-সংখ্যা আঠার।
তেরই হোক আর আঠারই তোক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াসহ পশ্চিমা নেতারা আশা করিয়াছিলেন যে : (১) সব দল না হইলেও বেশিরভাগ দলই কিছু কিছু আসন পাইবে, (২) যতই জনপ্রিয় হোক আওয়ামী লীগ ন্যাশনাল এসেমব্লির পূর্ব-পাকিস্তানের ভাগের ১৬৯টি আসনের মধ্যে একশ’র বেশি আসন পাইবে না, (৩) বাকি আসনগুলোর অধিকারী জমাতে ইসলামী, নিযামে ইসলাম ও দুই-তিনটা মুসলিম লীগের সকলেই ঈং সেন্টারের শাসন রচনার ব্যাপারে পশ্চিমা পার্টিগুলির সাথে থাকিবেন। এমনকি সরকার গঠনের ব্যাপারে তাঁরা আওয়ামী লীগের চেয়ে পশ্চিমা দলগুলোর সাথেই কোয়েলিশন করিবেন। তাঁদের হিসাবটা স্পষ্টতঃই ছিল এইরূপ : কাউন্সিল মুসলিম লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগের তিন শাখা, নিযামে ইসলাম, জমাতে ইসলামী ও জমিয়াতুল ওলামায়ে ইসলামের দুই শাখা মূলতঃ, এবং শাসনতান্ত্রিক সংবিধানের ব্যাপারে একই ইসলাম-পছন্দ’ পার্টি। এঁদের যে পার্টিই যত আসন দখল করুন, সবই শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা নেতৃত্বের স্ট্রং সেন্টারের সমর্থক দলের পুষ্টিসাধন করিবেন। ফলে তিন শ’ আসনের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তান হইতে একশ’ আসনও যদি আওয়ামী লীগ পায়, তবে বাকী দুইশ’ আসনের অধিকারী’ ইসলাম পছন্দ দলসমূহই কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে মেজরিটি হইবে এতে আর কোনও সন্দেহ থাকিতেছে না। আওয়ামী লীগের পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে মেজরিটি পাইবার সম্ভাবনা ছিল খুবই বেশি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে পশ্চিমা নেতারা এটার থনেও আওয়ামী লীগকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন।
সংবাদপত্র পাঠকদের সকলের স্মরণ আছে, কেন্দ্রীয় পরিষদ কর্তৃক শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনার পরে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হইবে, এটাই ছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রথম ঘোষণা। তারপর কি মনে করিয়া তিনি সে ঘোষণা পাল্টাইয়া কেন্দ্রীয় পরিষদের অব্যবহিত পরেই প্রাদেশিক নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। একই নির্বাচনী খরচায় দুইটা নির্বাচন হইয়া যাইবে, এটাই ছিল দৃশ্যতঃ এই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য। বাহ্য উদ্দেশ্যটা এতই গ্রহণযোগ্য ছিল যে, কোনও কোনও আওয়ামী নেতাও এই ফাঁদে পা দিয়াছিলেন। তাঁরাও এই পরিবর্তিত ব্যবস্থাকে অভিনন্দিত করিয়াছিলেন।
৪. ইয়াহিয়ার মতলব
কিন্তু ইয়াহিয়ার আসল উদ্দেশ্য অত শুভ ছিল না। সংবিধানটা তাঁদের ইচ্ছামত ইং সেন্টারের দলিল হইবে, এ বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন। এই সংবিধানের পরে প্রাদেশিক নির্বাচন হইলে পূর্ব-পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের জোর দূর্বার হইয়া উঠিবে। কারণ স্ট্রং সেন্টারের শাসনতান্ত্রিক সংবিধানের প্রতিক্রিয়া পূর্ব-পাকিস্তানে বিরূপ ও, আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়েঅনুকূল হইয়া পড়িবে। সংবিধানের আগে প্রাদেশিক নির্বাচন হইয়া গেলে আওয়ামী লীগ এই সুবিধা পাইবে না। ইহাই ছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পেটের কথা।
এইভাবে আওয়ামী লীগের মিজরিটি পাইবার বিরুদ্ধে সকল প্রকারের ফুল-প্রুফ ব্যবস্থা করিয়াই নির্বাচন দেওয়া হইয়াছিল।
কিন্তু নির্বাচনের ফল হইল উল্টা। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রায় সব পূর্ব পাকিস্তানী আসন আওয়ামী লীগ জয় করিল। ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় পরিষদের ও ১৭ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হইল। ইতিমধ্যে মাত্র এক মাস আগে ১২ই নবেম্বর পূর্ব-পাকিস্তানের সমুদ্র উপকূলবর্তী কয়েকটি জেলায় ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম ঝড়-তুফান ও সাইক্লোন-টর্ণেডো হইয়াছিল। তার ফলে অসংখ্য জীবন নাশ ও বর্ণনাতীত ক্ষয়ক্ষতি হইয়াছিল। সেজন্য কেন্দ্রীয় পরিষদের ১টি ও প্রাদেশিক পরিষদের ১৭টি আসনের নির্বাচন হইতে পারিল না। ঐসব এলাকার নির্বাচন পরবর্তী ১৭ই জানুয়ারি হইয়াছিল। ফলে কেন্দ্রীয় পরিষদের ১৬২টি আসনের মধ্যে দুইটি বাদে আর ১৬০টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টির মধ্যে ২৮০টি আসনই আওয়ামী লীগ দখল করিল। পরবর্তী ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচিত মেম্বরদের ভোটে কেন্দ্রীয় পরিষদের ৭টি ও প্রাদেশিক পরিষদের ১০টি মহিলা আসনের সব কয়টি আওয়ামী লীগ পাইল। একমাত্র পিডিপি.নেতা নূরুল আমীন সাহেব ছাড়া দুইটি কভেনশন মুসলিম লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, নেমে ইসলাম ইত্যাদি কেন্দ্র-ঘেষা সবগুলো দল নির্বাচনে নিশ্চিহ্ন হইয়া গেল। এইভাবে কেন্দ্রীয় পরিষদের মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসন পাইয়া একক মেজরিটি পার্টি হইল। ইয়াহিয়াসহ সব পশ্চিমা নেতাদের মাথায় আসমান ভাংগিয়া পড়িল। সুফলের আশা যত উচ্চ হয়, বিফলের পতনটা হয় তেমনি গভীর খাদে। এটা শুধু পশ্চিমাদের নির্বাচনে হারার ব্যাপার ছিল না। তাঁদের জন্য ছিল এটা ভেস্টেড ইন্টারেস্টের বিপদ-সংকেত। তাই তাঁরা স্ততি, ক্রুদ্ধ ও দিশাহারা হইয়া পড়িলেন। অথচ মার্শাল ল’র ছাতার তলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইয়াছিল বলিয়া এই নির্বাচনে নকল ভোট ইত্যাদি দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হইয়াছিল, এ কথাও বলা গেল না।
ফলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াসহ পশ্চিমা নেতারা অমন দিঘিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁদের পরবর্তী সব কাজই এই জ্ঞানশূন্যতার প্রমাণ। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলি। অথচ নির্বাচনে যাঁরা জিতিলেন, তাঁদের হাতে ক্ষমতা দিব না, দিলে পাকিস্তান বিপন্ন হইবে, এমন মনোভাব শুধু অগণতান্ত্রিক নয় বুদ্ধি বিভ্রান্তিরও লক্ষণ। এমন বিভ্রান্ত লোকের নিকট হইতে সুস্থ বুদ্ধি আশা করা যাইতে পারে না।
কিন্তু আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায়, ভুল শুধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পশ্চিমা নেতারাই করেন নাই। তুল আমাদের নেতা শেখ মুজিবও করিয়াছিলেন। সেসব কথাই পরে, যথাস্থানে আলোচনা করিব।
কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি এটা বুঝিতে পারি নাই। মানে বুঝিতে সময় লাগিয়াছিল। বরঞ্চ আমি প্রথমে ঠিক উল্টাটাই বুঝিয়াছিলাম। পশ্চিমা নেতারা তিন সাবজেক্টের সেন্টার আগেই মানিয়া লইয়াছিলেন। সেজন্য আমার বিভিন্ন লেখায়ও আনন্দ প্রকাশ করিয়াছিলাম। পশ্চিমা নেতাদের দেখাদেখি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও গণতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন, এটাও যেন আমার কাছে সুস্পষ্ট হইয়া গিয়াছিল। পাকিস্তানের ইতিহায়ে শুধু পাকিস্তান কেন, পাক-ভারত উপমহাদেশে, এমন কি গোটা আফ্রো-এশিয়ায়, এই সর্বপ্রথম নির্বাচন প্রতিযোগিতায় শরিক সব পার্টির নেতাদের রেডিও-টেলিভিশনে নিজ নিজ পার্টি-প্রোগ্রাম সম্বন্ধে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবার সুযোগ দেওয়া হইল। এটা করিলেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। আফ্রো-এশিয়ান গণতন্ত্রের জীবনে একটা নুতন ইতিহাস সৃষ্টি করিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। দেশবাসী খুশী না হইয়া পারে? আমি ত উৎসাহে ফাটিয়া পড়িবার মত হইলাম। এবার গণতন্ত্র না আসিয়া যায় না। শুধু গণতন্ত্রই পাকিস্তান টিকাইয়া রাখিতে পারে। আর কিছুতে নয়। সেই গণতন্ত্র নিশ্চিত হইল। অতএব পাকিস্তানের জীবনের মস্তবড় ফাঁড়া কাটিয়া গেল।
৫. আমার হিসাবে ভুল
কত বড় মূর্খ আমি। জমাট-বাঁধা এই মূঢ়তার প্রথম পরত কাটিল নির্বাচনের পরে। পশ্চিমা ভাইয়েরা নির্বাচনের আগে ছয় দফার আপত্তি করিলেন না। নির্বাচনের পরেই তাঁদের যত আপত্তি। তারা শুধু বেজার হইলেন না। ছয় দফা না বদলাইলে, মানে, নির্বাচনী ওয়াদা লোফ না করিলে আওয়ামী লীগের সাথে পশ্চিমারা সহযোগিতা করিতেই রাযী নহেন। সব দলের নির্বাচন প্রার্থীরাই এতকাল বলিয়া আসিয়াছেন, এই নির্বাচনের আগেও বলিয়াছেন, নির্বাচনী ওয়াদা খেলাফ করা সব পার্টির স্বভাব। আওয়ামী লীগও নির্বাচনের পরে তাই করিবে। নির্বাচনে হারিয়া পূরবী অ-আওয়ামী নেতারা চুপ মারিয়া গেলেন। কিন্তু পশ্চিমা নেতারা এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলিতে লাগিলেন, ছয়-দফা-ভিত্তিক সংবিধান তাঁরা মানিবেন না। কারণ তাতে পাকিস্তানের ঐক্য-সংহতি নষ্ট হইবে। এ সবই নির্বাচনের পরের কথা। নূতন কথা।
এ কথার রাজনৈতিক অর্থ ও ন্যায়নৈতিক তাৎপর্য কি, তার বিচার করা যাক। প্রথমতঃ আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ওয়াদা ছয় দফা রদ-বদল করিলে কি দাঁড়ায়? সকলেরই স্মরণ আছে, বহুদিন ধরিয়া রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ভোটারদের সাধারণ ও কম অভিযোগ ছিল এই যে, নির্বাচনের আগে নির্বাচন-প্রার্থী নেতারা যা বলেন, নির্বাচনের পরে তাঁরা তা ভুলিয়া যান। এক কথায় তাঁরা নির্বাচনী ওয়াদা খেলাফ করেন। ভোটারদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও তঞ্চকতা করেন।
অভিযোগটা পুরাতন ও সত্য। মোটামুটি সব পার্টির সব নেতাদের সম্বন্ধেই একথা বলা চলে। প্রমাণ অনেক। দু’চারটার কথা বলা যাক। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টি ৩৫ সালের ভারত শাসন ‘ভিতর হইতে ভাংগিবার (টু-রেক ফ্রম উইদ ইন) ওয়াদায় ভোট নিয়া মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন। কৃষক-প্রজা-পার্টি জমিদারি উচ্ছেদের ওয়াদায় ভোট নিয়া ফ্লাউড কমিশন বসাইয়াছিলেন। মুসলিম লীগ ‘৪৬ সালের নির্বাচনে ৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের উপর ভোট দিয়া নির্বাচনে জিতিবার পরে গুরুতর ওয়াদা খেলাফ করিলেন লাহোর প্রস্তাবে বর্ণিত পূর্ব-পশ্চিমে দুই মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের বদলে পশ্চিম-ভিত্তিক এক পাকিস্তান বানাইলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট একুশ দফার ওয়াদায় নির্বাচিত হইয়া সব ‘দফার’ রফা করিলেন। মোট কথা, কি অবিভক্ত ভারতে, কি পাকিস্তানে, নির্বাচনের ইতিহাস এক ঢালা নির্বাচনী ওয়াদা খেলাফের ইতিহাস। শেখ মুজিবসহ আমরা সংশ্লিষ্ট নেতাদের অনুসারীরা সব সময় না হোক, অধিকাংশ সময় নেতাদের এই সব ওয়াদা ভংগের প্রতিবাদ করিয়াছি। নেতারা ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’, ‘দেশের বৃহত্তর কল্যাণ’, ইত্যাদি ভাল-ভাল কথার যুক্তিতে নিজেদের কাজ সমর্থন করিয়াছেন। আমরা নেতাদের যুক্তি না মানিলেও কাজে-কর্মে তাঁদের নেতৃত্ব মানিয়া চলিয়াছি। কিন্তু মনের দিক হইতে আমরা কখনও সন্তুষ্ট ছিলাম না।
৬. মুজিবের দূরদর্শিতা
নেতাদের এই ওয়াদা খেলাফের ঐতিহ্যের প্রেক্ষিতে যখন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নূতন নেতা শেখ মুজিব নির্বাচনী ওয়াদায় দৃঢ়তা দেখাইলেন, তখন ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর কাজে প্রীত ও গর্বিত হইলাম। শেখ মুজিব দুই দিক হইতে এই দৃঢ়তা দেখাইলেন। প্রথমতঃ নির্বাচনের আগে তিনি ছয় দফাঁকে সাধারণ ওয়াদা না বলিয়া রেফারেন্ডাম বলিলেন। তাঁর কথার তাৎপর্য ছিল এই যে, হয় তাঁর পক্ষে স্থ বলিবেন, নয় ‘না’ বলিবেন। তার মানে, ভোটাররা হয় তাঁর পক্ষে সব ভোট দিবেন, নয়ত এক ভোটও দিবেন না। পূর্ব-পাকিস্তানের ভোটাররা সবই বলিলেন। শেখ মুজিব প্রায় সব আসন পাইলেন। শুধু নির্বাচনে নয়, তিনি রেফারেণ্ডামেও জিতিলেন। শাসনতন্ত্র রচনার ব্যাপারে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের একক মুখপাত্র হইলেন।
নির্বাচনের পরে শেখ মুজিব যা করিলেন সেটা আরও প্রশংসার যোগ্য। নির্বাচনের ইতিহাসে একটা অনুকণযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা। নির্বাচনের পরে ৩রা জানুয়ারি, ১৯৭১, তিনি সুহরাওয়ার্দী ময়দানে বিশ লাখ লোকের বিরাট জনসমাবেশে মেম্বারদেরে দিয়া হলফ করাইলেন-নিজে হলফ করিলেনঃ ‘ছয় দফা ওয়াদা খেলাফ করিব না।‘
এই হলফনামা ছিল একটি মূল্যবান দলিল। হলফ গ্রহণ ছিল একটি সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সেজন্য এ সম্বন্ধে একটু বিস্তারিত আলোচনা করিতেছি। ঘটনাটি নানা কারণে স্মরণীয়।
১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারি বেলা ২টার সময় ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে পরে সুহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমক্ষে আওয়ামী মেম্বররা হলফ উঠাইবেন, এটা আগেই ঘোষণা করা হইয়াছিল। ফলে সে সভায় বিপুল জনসমাগম হইয়াছিল। আওয়ামী লীগ টিকিটে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় মেম্বর-সংখ্যা তখন ১৫১ এবং প্রাদেশিক মেম্বর সংখ্যা ২৬৭। কারণ ঘূর্ণীঝড়-বিধ্বস্ত উপকূল অঞ্চলের নির্বাচন তখনও হইতে পারে নাই। ফলে মোট ৪১৮ জন আওয়ামী সদস্যের সকলেই এই শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়াছিলেন।
হলফনামা একটি ছাপা দলিল। আল্লার নামে এই হলফনামার শুরু হইয়াছিল। আরবী ‘বিসমিল্লাহিররাহমানির রাহিম’-এর হুবহু বাংলা তর্জমা করিয়া লেখা হইয়াছিল ও পরম করুণাময় আল্লাহর নামে হলফ করিয়া আমি অংগীকার করিতেছি যে আমাদের নির্বাচনী ওয়াদা ছয় দফা অনুসারে শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করিব।
এ কাজে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সহযোগিতা কামনা করিতেছি ইত্যাদি। হলফনামায় ব্যাংক, ইনশিওরেন্স ও পাট ব্যবসায় জাতীয়করণের অংগীকারসহ আরও কিছু প্রতিজ্ঞা করিয়া দুইটি জয়ধ্বনিতে হলামার উপসংহার করা হইয়াছিল। এই দুইটি মুদ্রিত জয়ধ্বনি ছিল : ‘জয় বাংলা’, ‘জয় পাকিস্তান’।
মুদ্রিত হলফনামার এক এক কপি সমবেত ও কাভারবন্দী মেম্বরদের প্রত্যেকের হাতে ছিল। পার্টি নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বুলন্দ আওয়াযে হলকে এক একটি বাক্যাংশ পড়িয়া গিয়াছেন, আর সমবেত কাতারবন্দী মেম্বররা সমস্বরে নেতার কথা আবৃত্তি করিয়াছেন। এতে গোটা অনুষ্ঠানের পরিবেশটা একটা ধর্মীয় গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। সমবেত প্রায় বিশ লাখের বিশাল জনতা পরম শ্রদ্ধায় অবনত মস্তকে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এই হলফের প্রত্যেকটি কথা নীরবে শুনিয়াছে। একটি ‘টু’ শব্দও হয় নাই। অনুষ্ঠান শেষে জনতা বিপুল হর্ষধ্বনি করিয়া তাদের সমর্থন ও উল্লাস জানাইয়াছে।
ধর্মীয় গাম্ভীর্য্যের হলকে আরও রাজনৈতিক গুরুত্ব দিবার জন্য সমবেত জনতার কাছে শেখ মুজিব আরও বলিলেন : ছয় দফা নির্বাচনী ওয়াদা আপনাদের নিকট আমাদের দেওয়া আমাদের পবিত্র ওয়াদা। এ ওয়াদা যদি আমরা খেলাফ করি, তবে আপনারা আমাদের ক্ষমা করিবেন না। আরও বেশি জোর দিবার জন্য শেখ মুজিব বলিলেন। আমি নিজেও যদি এই ওয়াদা খেলাফ করি, তবে আপনারা নিজ হাতে আমাকে জীবন্ত মাটিতে পুঁতিয়া ফেলিবেন। নিজেদের নির্বাচনী ওয়াদার নির্ভুলতা
ও কার্যকারিতা সম্বন্ধে দৃঢ় প্রত্যয় না থাকিলে এমন নিরংকুশ সুস্পষ্ট চরম অনঢ় ওয়াদা কেউ করিতে পারেন না। ফলতঃ এই ঘটনার পরে শেখ মুজিবের পক্ষে কোন কারণে, কোন যুক্তিতেই ছয়-দফা-বিরোধী কাজ করা সম্ভব ছিল না।
বস্তুতঃ আমার জ্ঞান-বিশ্বাস মতে শেখ মুজিব ইচ্ছা করিয়াই এটা করিয়াছিলেন। তিনি ভাবিয়া-চিন্তিয়াই এভাবে নির্বাচনী ওয়াদা খেলাফের সব রাস্তা ও ছিদ্র বন্ধ করিয়াছিলেন। পাঠকগণ,তখনকার অবস্থাটা একবার বিবেচনা করুন। একেই ত ৪১৮ জন মেম্বরের এত বড় পার্টি। তাতে আবার সুস্পষ্ট কারণেই এদের মধ্যে সবাই পরীক্ষিত, অনুগত, পুরাতন ও নিযোগ্য নন। বোধগম্য কারণেই অনেক অজানা অচেনা প্রার্থীকে নমিনেশন দিতে হইয়াছে। এঁদের মধ্যে কেউ সুযোগ-সুবিধা পাইলে দলত্যাগ করিবেন না, এমনটা আশা করা বুদ্ধিমানের কাজ হইত না। আরও একটা কারণ ছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ পশ্চিমারা শুধু রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারীই ছিলেন না, বিপুল ধন-বিত্ত-প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন। পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে তাঁদের করণীয় কাজও খুব বেশি ছিল না। রাষ্ট্রক্ষমতা, অর্থ-বিত্ত ও প্রতিপত্তির সাহায্যে আওয়ামী লীগের অন্ততঃ গণপরিষদে নির্বাচিত নবাগতদের মধ্যে এক দলকে হাত করিয়া আওয়ামী লীগের, মানে পূর্ব পাকিস্তানের, মেজরিটিকে নিষ্ক্রিয় করা মোটই কল্পনাতীত ছিল না। তাই শেখ মুজিব বিশ লাখ লোকের জনসমাবেশে মেম্বরদেরে দিয়া ঐ হল রাইয়াছিলেন। নিজেও হল নিয়াছিলেন। এতে এক সংগে দুইটা লাভ হইয়াছিল। এক আওয়ামী মেম্বারদেরে হুশিয়ার করা হইয়াছিল। দুই, পশ্চিমা নেতা ও ধনকুবেরদেরেও হুশিয়ার করা হইয়াছিল। আওয়ামী মেম্বরদের মধ্যে যদি কারো কোনও উচ্চাভিলাষ থাকিয়াও থাকিত, তবে ঐ বিশাল জনতার দরবারে হল নেওয়ার ফলে সে উচ্চাকাংখা সেই মুহূর্তে পলাইয়াছিল।
আর পশ্চিমা ধনকুবের নেতাদের কারও মনে যদি আওয়ামী দল ভাংগিবার পরিকল্পনাবিয়া থাকিত, তবে ঐ ঘটনার পরে তাঁরাও এই দিককার আশা ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
৭. পশ্চিমা নেতাদের সংকীর্ণতা
কাজেই শেখ মুজিবের এই দূরদর্শিতায় আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম। কিন্তু দুই মাস না যাইতেই আমার সে মোহ কাটিয়া গিয়াছিল। তখন আমার মনে হইয়াছিল শেখ মুজিব যদি আওয়ামী মেম্বরদের আনুগত্যকে অমন দুর্ভেদ্য না করিতেন, তবেই বোধ হয় মন্দের ভাল হইত। আওয়ামী লীগের মেম্বরদের আনুগত্যে অর্থাঘাত অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিল বলিয়াই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াসহ পশ্চিমা নেতারা ভোটারদের অস্ত্রাঘাত করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। কেন করিয়াছিলেন? কারণ পশ্চিমা নেতারা পাকিস্তানের ঐক্য, পাকিস্তান-সৃষ্টির ইতিহাস, লাহোর প্রস্তাব, পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি ইকবালের কথা, সবই ভুলিয়া গিয়াছিলেন। অথচ এই তিনটি বস্তুর কথা পশ্চিমা শাসক ও নেতারা চব্বিশ ঘন্টা উচ্চারণ করিতেন। পাকিস্তানের ঐক্যে যদি তাঁরা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করিতেন, তবে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের মেজরিটিশাসন তাঁরা মানিয়া লইতেন। তাঁরা ভাবিতেন গণতন্ত্রে মেজরিটিরই শাসন। আওয়ামী নেতৃত্বকে তাঁরা যদি গোটা পাকিস্তানের নেতা নাও মানিতেন, তবু তাঁরা ভাবিতে পারিতেন। তেইশ বছর পশ্চিমারা পাকিস্তান শাসন করিলেন, করুক না পূরবীরা পাঁচবছর। তা তাঁরা পারেন নাই। পারেন নাই এইজন্য যে, পূর্ব-পাকিস্তানকে তাঁরা পাকিস্তানের সমান অংশীদার মনে করিতেন না। এ অঞ্চলটাকে তাঁরা তাঁদের উপনিবেশ মনে করিতেন।
কালক্রমে এটা তাঁদের সাধারণ মনোভাবে রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছিল। পাকিস্তানের সৃষ্টির গোড়াতে পশ্চিমা ভাইদের মনে যাই থাকুক, অবস্থা ও পরিবেশে দীর্ঘদিনের অভ্যাসে যেটা তাঁদের কাছে অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক দাবির রূপ পাইয়াছিল তা এই যে, পশ্চিম-পাকিস্তানটাই পাকিস্তান। পূর্ব-পাকিস্তানটা সেই পাকিস্তানের অংশ মাত্র। একটা অপরটার অংশ হইলে অপরটাও একটার অংশ, এটা তেমন ব্যাপার নয়। তাই এর উল্টাটাও সত্য নয়। অর্থাৎ পূর্ব-পাকিস্তানই পাকিস্তান, আর পশ্চিম-পাকিস্তানটা সেই পাকিস্তানের অংশ মাত্র, কোনও পশ্চিমা তাই-ই এ ধরনের চিন্তায় অভ্যস্ত ছিলেন না। আলাস্কাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশ মনে
করিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই আলাস্কার অংশ মনে করিলে যেমনটি হয়, এখানেও তেমনটাই হইত। শুধু আয়তন নয়, রাষ্ট্রক্ষমতার অধিষ্ঠানও এই মনোভাব সৃষ্টির ও বৃদ্ধির গোড়ায় কার্যকরী ছিল। পশ্চিম-পাকিস্তানে বসিয়া সার্ভে-অব-পাকিস্তান পাকিস্তানের যে সরকারী ম্যাপ প্রকাশ করিতেন, সেটা আসলে পশ্চিম-পাকিস্তানেরই ম্যাপ। সেই ম্যাপের এক কোণে ইনসেট হিসাবে পূর্ব-পাকিস্তান, জুনাগড় ও মানবাদারের একটি করিয়া ক্ষুদ্রাকৃতি ম্যাপ থাকিত। এটাই পশ্চিমা ভাইদের মনের ম্যাপ। এ মনোতাবের বিচারে, পশ্চিম-পাকিস্তানের আয়তন ছোট হইলেও বাধিত না। আকারে ছোট হইয়াও ইংল্যাণ্ড বৃহদাকারের আমেরিকাকে নিজের উপনিবেশ মনে করিত।
৮. পরিষদের বৈঠক আহ্বান
এমন পরিবেশে পূর্ব-পাকিস্তানী মেজরিটি সারা পাকিস্তান শাসন করিবে, এ সম্ভাবনা পশ্চিমা ভাইদের মনে দুঃসহ হইয়া উঠিল। নির্বাচনের পর দুই মাস অতিবাহিত হইয়া গেল। তবু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পরিষদের বৈঠক ডাকিতে বিলম্ব করিতে লাগিলেন। অবশেষে মেজরিটি পার্টির লিডার শেখ মুজিব ১৫ই ফেব্রুয়ারি পরিষদের বৈঠক ডাকিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে জোর তাকিদ দিলেন। ইয়াহিয়া পরিষদের মেজরিটি লিডারের কথা অগ্রাহ্য করিয়া মাইনরিটি লিডার মিঃ ভুট্টোর পরামর্শ-মত ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ পরিষদের বৈঠকদিলেন। বৈঠকটার স্থান দেওয়া হইল ঢাকায়। আমরা অনেকেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উদার গণতান্ত্রিক মনোভাবের তারিফ করিয়া বিবৃতি দিলাম, প্রবন্ধ লিখিলাম।
কিন্তু পরবর্তী ঘটনাসমূহ হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইল যে, এটাও ছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংগ। ষড়যন্ত্রটার ধারাবাহিকতা এইরূপ ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১৩ই জানুয়ারি হইতে ১৫ই জানুয়ারি ঢাকায় অবস্থান করিয়া শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা করিলেন। হাসিমুখে ঢাকা ত্যাগ করিলেন। শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলিলেন। ছয় দফায় তাঁর খুব বেশি আপত্তি নাই বলিয়া গেলেন। কিন্তু ছয় দফা বা ভাবী শাসনতন্ত্র সম্বন্ধে সোজাসুজি কোনও স্পষ্ট কথা বলিলেন না। কিন্তু ঘুরাইয়া-পেচাইয়া সর্বপ্রথম ছয় দফাঁকে পাকিস্তানের ঐক্য-বিরোধী এমনকি তাঁর নিজের রচিত এল.এফ.ও. বিব্রাধী এই ধরনের নূতন কথা বলিলেন। তিনি ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে খুব নরম সুরে বলিলেন : শাসনতান্ত্রিক সংবিধান সম্বন্ধে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের ঐক্যমত হওয়া দরকার।
৯. মুজিবের ভুল
এই সময় পশ্চিম-পাকিস্তানের কতিপয় নেতা শেখ মুজিবকে একবার পশ্চিম পাকিস্তান সফরের দাওয়াত দিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, বিরোধী প্রচারে ছয় দফা সম্পর্কে পশ্চিম-পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হইয়াছে, শেখ মুজিবের এই সফরে তার অবসান হইবে। সহকর্মীদের পরামর্শে মুজিবর রহমান এই সফরে অসম্মতি বা অক্ষমতা জানাইলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, তিনি আওয়ামী পার্লামেন্টারি পার্টির কাজে এই সময়ে এতই ব্যস্ত থাকিবেন যে, তাঁর পক্ষে পশ্চিম-পাকিস্তান সফর সম্ভব হইবে না। প্রকাশ্যে এই যুক্তি দেওয়া হইল বটে, কিন্তু আমি জানিতে পারিলাম, সহকর্মীরা মুজিবকে এইরূপ বুঝাইয়াছেন যে, এই সফরের দাওয়াত আসলে শেখ মুজিবের জীবননাশের পশ্চিম-পাকিস্তানী ষড়যন্ত্র মাত্র। আমি একথা বিশ্বাস করিলাম না। কারণ আমি শেখকে বেপরোয়া সাহসী যুবক বলিয়াই জানিতাম। কিন্তু কারণ যাই হোক, মুজিবের এই সিদ্ধান্তে আমি দুঃখিত হইলাম। আমার তখনও বিশ্বাস ছিল, আজও আছে, মুজিব ঐ সফরে গেলে তার সুফল ফলিত, মুজিবের অসাধারণ বাগ্নিতায় পশ্চিম-পাকিস্তানের জনগণ তাঁর সমর্থক হইয়া উঠিত। পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতি ও কায়েমী স্বার্থীরা বিদ্বেষপ্রসূত মিথ্যা প্রচারের দ্বারা ছয় দফা ও মুজিবের বিরুদ্ধে জনগণের মনে যে ভ্রান্ত ও ভয়ংকর চিত্র আঁকিয়াছে, মুজিব অতি সহজেই তা দূর করিতে পারিতেন। আমি অতীতে অনেক বার নিজ চোখে দেখিয়াছি, শেখ মুজিব তাঁর ভাংগা-ভাংগা অশুদ্ধ উর্দুতে বক্তৃতা করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানী বড়-বড় জনসভা জয় করিয়াছিলেন এবারও তার অন্যথা হইত না।
কাজেই এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করা মুজিবের উচিৎ হয় নাই, এটা আমি তখনও মনে করিতাম, আজও মনে করি। মুজিব ঐ সময়ে পশ্চিম-পাকিস্তান সফরে গেলে পরবর্তী মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ঘটনাসমূহ ঘটিত না। কারণ, তাতে শেখ মুজিবের ইমেজ পশ্চিম-পাকিস্তানের জনগণের নযরে ইয়াহিয়া-ভূট্টোর ইমেজ ছাড়াইয়া যাইত।