হক মন্ত্রিসভা গঠন
দশই অধ্যায়
১. কৃষক-প্রজা-মুসলিম লীগ কোয়েলিশন
কংগ্রেস-নেতাদের সাথে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ হওয়ায় লীগ-নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনায় কোনও অসুবিধা হইল না। ফলে এক দিনেই সব ঠিক হইয়া গেল। এগার জনের মন্ত্রিসভা হইবে। মুসলমান ছয়, হিন্দু পাঁচ। মুসলিম ছয় জনের মধ্যে কৃষক প্রজা তিন, মুসলিম লীগ তিন। হিন্দু পাঁচ জনের মধ্য বর্ণহিন্দু তিন জন ও তফসিলী হিন্দু দুইজন থাকিবেন। মুসলিম লীগ মন্ত্রীদের নাম আগেই ঠিক হইয়া গিয়াছিল। কৃষক-প্রজা পার্টির তরফে হক সাহেব ছাড়া আর থাকিবেন মৌঃ সৈয়দ নওশের আলী ও মৌঃ শামসুদ্দিন আহমদ। লীগ পক্ষে থাকিবেন নবাব বাহাদুর হবিবুল্লাহ, সার নাযিমুদ্দিন, মিঃ শহীদ সহরাওয়াদী। দুই-এক দিনের মধ্যে হিন্দু মন্ত্রীদেরও নাম ঠিক হইয়া গেল। বর্ণ হিন্দুদের পক্ষে থাকিবেন মিঃ নলিনী রঞ্জন সরকার, মিঃ বিজয় প্রসাদ সিংহ রায় ও কাসিম বাজারের মহারাজা শ্রীশ নন্দী। তফসিলী হিন্দুদের পক্ষে থাকিবেন মিঃ মুকুন্দ বিহারী মল্লিক ও মিঃ প্রসন্নদেব রায়কত।
২. গভীর রাত্রের নাটক
অতঃপর আমার কোনই কাজ ছিল না। তবু বন্ধুদের অনুরোধে সুয়ারিং-ই সিরিমনিটা দেখিবার জন্য কলিকাতায় আরেক দিন থাকিয়া গেলাম। পরদিন সুয়ারিং হইবে। সার্বিক শান্তি ও আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে হঠাৎ বিকালের দিকে গুজব রটিল বন্ধুবর শামসুদ্দিন বাদ পড়িয়া যাইতেছেন। শামসুদ্দিন সাহেব স্বভাবতঃই চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। আমরাও কম চঞ্চল হইলাম না। সন্ধ্যার শো সিনেমা দেখার প্ল্যান স্যাক্রিফাইস করিয়া বন্ধু-বান্ধব সহ হক সাহেবের কাছে গেলাম। তিনি গুজবের সত্যতা অস্বীকার করিলেন। আমরা খুশী হইয়া বিদায় হইলাম। কিন্তু হক সাহেব সকলকে বিদায় দিয়া শুধু আমাকে থাকিতে বলিলেন। রাত্রি নয়টার সময় তিনি একা আমাকে লইয়া বাহির হইলেন। ড্রাইভারকে কিছুই বলিলেন না। অথচ ডাইভার মাত্র পাঁচ-সাত মাইল বেগে যেন নিজের ইচ্ছামত গাড়ি চালাইতে লাগিল। অনেকক্ষণ চালাইল। মনে হইল সারা কলিকাতা শহর ঘুরিল। ঘোড়ার গাড়ি এমনকি রিকশা সামনে পড়িলেও তা পাশ কাটাইয়া গেল না। পিছন-পিছন যাইতে লাগিলাম। আমি প্রথমে এ সব কিছুই লক্ষ্য করিলাম না। কারণ হক সাহেব খুব উঁচু স্তরের কথাবার্তা বলিতে থাকিলেন। বাংলার সাত কোটি গরিব কৃষক-প্রজার ডাল-ভাত্রে ব্যবস্থা করিবার যে মহান দায়িত্ব ও পবিত্র কর্তব্য আল্লাহ আজ তাঁর ঘাড়ে চাপাইয়া দিয়াছেন, সেটা তিনি কেমন করিয়া যে পালন করিবেন, সে চিন্তায় তীর বুক কাঁপিতেছে। শুধু মুখে বলিলেন না, আমার একটা হাত টানিয়া নিয়া তীর বুকে লাগাইলেন। সত্যই তাঁর বুক ধড়ফড় করিতেছিল। পরম ভক্তিতে আমার বুক ভরিয়া গেল। এই সব কথার মধ্যে হক সাহেবের গাড়ি মাত্র দুইবার থামিল। একবার বেনিয়াপুকুর রোডের এক দর্যির দোকানে; আরেকবার মেছুয়া বাজার স্ট্রিটের এক হাকিম সাহেবের ডিস্পেনসারিতে। দুই জায়গায় তিনি বড় জোর আধ ঘন্টা খরচ করিলেন। বাকী সব সময় গাড়ি চলিতেই থাকিল। ঐ সব উঁচুস্তরের কথার উপসংহারে হক সাহেব বলিলেন যে তাঁর ঐ মহান দায়িত্ব পালনে গরিবের দুশমনরা অনেক রকমে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করিবে। এসব বিঘ্ন অতিক্রম করিতে আল্লাহ তাঁহাকে নিশ্চয়ই সাহায্য করিবেন। তবে তিনি সে কাজে আমার সহযোগিতার উপর অনেকখানি নির্ভর করেন।কারণ আমি মন্ত্রী-মেম্বর না হওয়ায় আমার মূল্য, সকলের কাছে অনেক বেশি। আমি গর্ব ও আনন্দে উৎসাহের সংগে সে আশ্বাস দিতে দিতেই গাড়ি আসিয়া একটা প্রাসাদের গাড়ি-বারান্দায় থামিল। একটা লোক দৌড়িয়া আসিয়া গাড়ির দরজা খুলিয়া হক সাহেবকে কুর্নিশ করিল। হক সাহেব বাহির হইলেন। অপর দিককার দরজা দিয়া আমি বাহির হইলাম। বাহির হইয়াই বুঝিলাম এটা মিঃ নলিনী রঞ্জন সরকারের লোয়ার সারকুলার রোডস্থ প্রসাদতুল্য বাড়ি ‘রঞ্জনী’। বারান্দার বিশাল ঘড়িতে দেখিলাম বারটা বাজিবার মাত্র পাঁচ মিনিট বাকী।
দারওয়ান আমাদেরে লইয়া দুতালায় ড্রয়িংরুমে পৌঁছাইল। বিশাল অপরূপ সজ্জিত ড্রয়িংরুম। সমস্ত ফার্নিচার শান্তি নিকেতনের তৈরি। রাবীন্দ্রিক প্যাটার্নের। এক নলিনী বাবু আমাদেরে অভ্যর্থনা করিলেন। বুঝিলাম এই এনগেজমেন্ট আগেরই ঠিক করা। বিশাল কামারার এক কোণে তিন জন ঘেষাঘেষি করিয়া বসিলাম। সংগে-সংগেই কফি আসিল। বেয়ারাকে বিদায় দিয়া নলিনী বাবু নিজে কফি তৈয়ার করিতে এবং কথা বলিতে লাগিলেন। হক সাহেব ও নলিনী বাবু উভয়েই বলিলেন যে আজিকার আলোচ্য বিষয়টা ভয়ানক গোপনীয়; সুতরাং আমি এটা কারও কাছে ঘুণাক্ষরেও বলিতে পারিব না সে মর্মে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হইবে। আমি যথারীতি সে প্রতিশ্রুতি দিলাম। এরপর অনেক ভূমিকা করিয়া, একজন অপর জনের সমর্থন করিয়া, একজন অপর জনের মুখ হইতে কথা কাড়িয়া নিয়া, যা বলিলেন তার সারমর্ম এই যে শামসুদ্দিন সাহেবকে মন্ত্রী করিতে লাট সাহেব অসম্মত হইয়াছেন। তাঁর জন্য যিদ করিলে, তাঁকে বাদ দিয়া মন্ত্রিসভা গঠন না করিলে, পরের দিন শপথ নেওয়া হয় না। মন্ত্রিসভা গঠনে বিলম্ব হইয়া যায়। শেষ পর্যন্ত হক সাহেবের মন্ত্রিসভা নাও হইতে পারে। ইউরোপীয় দল সায় নামুদ্দিনকে প্রধান মন্ত্রী করিবার চেষ্টা আজ, ত্যাগ করে নাই। লাট সাহেব শামসুদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধে গিয়াছেন এই জন্য যে শামসুদ্দিন সাহেব অতীতে জেল খাঁটিয়াছেন এবং বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র দ্রোহিতার আই. বি. রিপোর্ট আছে। আমি তর্ক করিলাম : জেল-খাটা কংগ্রেস নেতাদের মন্ত্রী করিতে লাট-বড়লাটের খোশামোদ করিতেছেন, মন্ত্রী নির্বাচনের একক অধিকার প্রধান মন্ত্রীর লাট সাহেবের তাতে হস্তক্ষেপের কোনও অধিকার নাই। মন্ত্রিসভা গঠনের শুরুতেই যদি প্রধান মন্ত্রী লাট সাহেবের ধমকে কাৎ হইয়া পড়েন তবে লাট সাহেব সুবিধা পাইবেন, কৃষক-খাতকদের স্বার্থের প্রতি কাজেই লাট সাহেব বাধা দিবেন ইত্যাদি। আমার চেয়ে অনেক বয়স্ক ও অভিজ্ঞ এই দুই নেতা আমাকে অনেকক্ষণ ধরিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন। আমি বুঝিলাম না। বরঞ্চ তাঁদের কথায় আমার সন্দেহ হইল যে লাট সাহেবের কথাটা ভাওতা মাত্র। এই দুই নেতাই শামসুদ্দিন সাহেবকে বাদ দিবার সংকল্প করিয়াছেন। কাজেই আমার যিদ বাড়িয়া গেল। তাছাড়া যুক্তিতেও তাঁরা আমার সহিত পারিয়া উঠিতেছিলেন না। তাঁদের একমাত্র যুক্তি ছিল এই যে শামসুদ্দিন সাহেবকে লাট সাহেব কিছুতেই গ্রহণ করিবেন না। তাঁরে নিয়া যিদ করিলে সার নাযিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হইয়া যাইতে পারেন। আমাদের কাছে তৎকালে এই এক যুক্তিই লাখ যুক্তির সমান। কাজেই আমি বোধ হয় দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিলাম। একদিকে প্রিয় বন্ধু ও কৃষক-প্রজা সমিতির সেক্রেটারি নির্যাতিত ও ত্যাগী দেশ-কমী শামসুদ্দিনের মন্ত্রিত্ব, অপর দিকে কোটি-কোটি কৃষক খাতকের স্বার্থ। বোধ হয় একটু বাহ্যজ্ঞানও হারাইয়া ছিলাম। খুব সম্ভব কল্পনা রাজ্যে বিচরণ করিতেছিলাম। দু’জনের কে ঠিক মনে নাই, একজন বলিলেন, শামসুদ্দিনের সীটটা খালি রাখিয়া পরের দিন দশজন মন্ত্রী লইয়া মন্ত্রিসভা গঠিত হইয়া যাক, পরে লাট সাহেবকে বুঝাইয়া-সুঝাইয়া রাযী করিয়া শামসুদ্দিনকে নিলেই চলিবে। আমি বোধ হয় মন্দের ভাল হিসাবে এতেই রাযী হইয়াছিলাম। কারণ এক সময় যখন নলিনী বাবু আমার জবাবের জন্য যিদ করিতেছিলেন, তখন আমার পক্ষ হইতে হক সাহেবই জবাব দিয়াছিলেন : সে ত জবাব দিয়াই দিছে। আগামীকাল দশজনের মন্ত্রিসভা করতে তার ত আপত্তি নাই। আবুল মনসুর, চল এইবার উঠি।
হক সাহেব সত্যসত্যই উঠিয়া পড়িলেন। আমি শেষ চেষ্টা স্বরূপ বলিলাম। ‘শামসুদ্দিনকে তবে কবে নেওয়া হৈব?’ হক সাহেব আমার হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে বলিলেন : ‘লিভ ইট টুমি। আমি কি সমিতির সেক্রেটারি ছাড়া বেশি দিন মন্ত্রিত্ব করতে পারব? যত শীঘগির পারি তারে নিয়া নিবই। এইটা আমার ওয়াদা, তারে আমি একদিন মন্ত্রী করবই। তুমি কোনও চিন্তা কৈর না।‘
ফিরিবার পথে গাড়িতে হক সাহেব আমাকে বলিলেন : দেখছ মনসুর, বেটার শয়তানিটা? কি কৌশলেই না সে হিন্দু-মুসলিম মন্ত্রীদের সংখ্যা সমান করবার ব্যবস্থা কৈরা ফেলছে। নিশ্চয়ই বেটা লাটে বুদ্ধি এটা।
আমি চমকিয়া উঠিলাম। এই দিক হইতে ব্যাপারটা আমি মোট্রেই চিন্তা করি নাই ত। হক সাহেব আরও দেখাইলেন যে লোকটা যে শুধু হিন্দু-মুসলিম কোটাই ফিফটি ফিফটি করিতেছে তা নয়। মুসলিম কোটায় মুসলিম লীগের মোকাবিলায় হক সাহেবের পার্টির দুইজন করিতেছে। মন্ত্রিসভায় তাঁকে মাইনরিটি করিবার ব্যবস্থা হইয়াছে। প্রধান মন্ত্রী হইয়াও তিনি কিছু করিতে পারিবেন না। প্রজা-পার্টির কোটায় আর নেওয়াই বা যায় কাকে? আমি একগুয়েমি করিয়া দাঁড়াই নাই। রেযায়ে করিম ও হুমায়ুন কবিরটা ইলেকশনে ফেল করিয়াছে। হাসান আলীটা একেবারে নাবালক ইত্যাদি।
একদমে একতরফাভাবে এই সব কথা বলিতে-বলিতে গাড়ি আমার বাসার সামনে আসিয়া পড়িল। আমি কোনও জবাব দিতে পারিলাম না, আমার পায়ের একযিমাটা খুবই টাটাইতেছিল। এতক্ষণে শরীরে বেশ তাপ উঠিয়াছে বলিয়া মনে হইল। আদাব দিয়া বিদায় হইলাম। পরদিন সকাল দশটার আগেই তার বাসায় যাইতে আমাকে নির্দেশ দিয়া হক সাহেব চলিয়া গেলেন।
রাত্রে আমার একযিমাটা আরও বেশি টেকিয়া গেল। শরীরের তাপ বাড়িল। সকালে উঠিয়াই বুঝিলাম ঘটিতে পারি না। কুচকি ফুলিয়া গিয়াছে। কাজেই চেষ্টা চরিত করিয়া হক সাহেবের বাড়িতে পৌঁছাইতে আমার প্রায় এগারটা বাজিয়া গেল। তখন বোধ হয় আমার গায় এক শ’ তিন ডিগ্রি জ্বর। কিন্তু হক সাহেবের বাড়ি গিয়া যা শুনিলাম ও দেখিলাম, তাতে আমার জ্বর ছাড়িয়া শরীর-মন ঠাণ্ডা বরফ হইয়া গেল। নবাবযাদা হাসান আলী অধ্যাপক হুমায়ুন কবির প্রভৃতি বন্ধুরা বিষণ্ণ মুখে কানাকানি করিতেছেন। আমার বিল দেখিয়া তাঁরা আমার উপর রাগ করিয়া আছেন। শামসুদ্দিন সাহেব ও আশরাফুদ্দিন সাহেব গোস্বা করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। এ সবের কারণ হক সাহেব শামসুদ্দিন সাহেবকে সংগে না লইয়াই শপথ নিতে চলিয়া গিয়াছেন। ইহাতে সবাই আপ-সেট হইয়া গিয়াছেন। গত রাত্রের ঘটনা বেচারারা কিছুই জানিতেন না। হক সাহেবের বাড়িতে যে লোকের ভিড় ছিল, তাঁদের অধিকাংশই স্বভাবতঃই আনন্দ-উল্লাসে মাতোয়ারা। বেচারা শামসুদ্দিনের কথাটা তাঁদের আনন্দের মাত্রা খুব বেণি কমাইতে পারে নাই। এই পরিবেশ আমাদের ভাল লাগিল না, অথবা আমাদের বিষণ্ণ মুখ তাঁদেরই ভাল লাগিল না। নিকটেই নবাবযাদা হাসান আলীর বাড়ি। আমরা সেখানে চলিয়া আসিলাম। ক্রমে সেখানেও ভিড় বাড়িল। আনেক গরম কথাবার্তা হইল। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত করা গেল না। আমার শরীরের তাপ ও একফিমার টাটানি অসহ্য হইল। নবাবদা তাঁর গাড়িতে আমাকে বাসায় পৌঁছাইয়া দিলেন। আমার বাসা মানে বন্ধুবর আয়নুল হক খাঁ সাহেবের বাসা। তিনি তখন ৪৯ নং আপার সারকুলার রোডে থাকিতেন। আমি তাঁর মেহমান ছিলাম। নবাবযাদার বাড়ির বৈঠকে সাব্যস্ত হইল যথাসম্ভব সত্বর কলিকাতায় উপস্থিত সমস্ত কৃষক-প্রজা নেতাদের একটি সভা ডাকিয়া আমাদের কর্তব্য ঠিক করা হইবে।
৩. হক-মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ
বিকালের দিকে খবর পাইলাম হক মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করিয়াছেন। শামসুদ্দিন সাহেবের জায়গা খালি রাখা হয় নাই। তাঁর স্থলে নবাব মোশাররফ হোসেন সাহেবকে দিয়া কৃষক-প্রজা-কোটা পূর্ণ করা হইয়াছে। আমি আসমান হইতে পড়িলাম। ভয়ানক রাগ হইল। এমন সময় হক সাহেবের একখানা পত্র পাইলাম। নবাব্যাদা নিজেই এই পত্র লইয়া আসিয়াছেন। চিঠিখানা খুবই লম্বা। তাতে তিনি তাঁর স্বাভাবিক ওজস্বিনী ভাষায় সমস্ত অবস্থা বর্ণনা করিয়াছেন। অপর পক্ষ তাঁকে মন্ত্রিসভায় মাইনরিটি করিবার যে ষড়যন্ত্র করিয়াছিল তা রুখিবার জন্যই তিনি শামসুদ্দিনের সীটটা খালি না রাখিয়া নবাব মোশাররফ হোসেনকে দিয়া তা পূর্ণ করিয়াছেন। নবাব। সাহেব কৃষক-প্রজা পার্টির কার্যক্রম পুরাপুরি গ্রহণ করিয়াছেন। হক সাহেব আমাকে বিশ্বাস করিতে অনুরোধ করিয়াছেন যে কেবল মাত্র কৃষক-প্রজা-পার্টির স্বার্থেই তিনি এ কাজ করিয়াছেন। আমি কারও কথায় যেন তাঁকে তুল না বুঝি। যে মুহূর্তে তিনি বুঝিবেন যে তাঁর পক্ষে প্রজার স্বার্থরক্ষা অসম্ভব হইয়াছে সেই মুহূর্তে তিনি পদত্যাগ করিবেন। আমি যেন তাঁর উপর আস্থা রাখিয়া তাঁর কাজে সহযোগিতা করি। আমি যেন তাঁর পক্ষ হইতে শামসুদ্দিনকে বলি : হক সাহেব শামসুদ্দিনের কথা ভুলেন। নাই, তুলিবেন না; তাঁকে তিনি একদিন-না-একদিন মন্ত্রী করিবেনই। উপসংহারে তিনি আমার অসুখের জন্য দুঃখ করিয়াছেন এবং আল্লার কাছে আমার রোগমুক্তির জন্য সর্বদাই দোয়া করিতেছেন, তা লিখিয়াছেন। প্রথম সুযোগেই তিনি আমাকে দেখিতে আসিবেন সে আশ্বাসও দিয়াছেন।
হক সাহেবের এই পত্র লইয়া বিশেষ চিন্তা করিবার অবসর পাইলাম না। একা দু-দশ মিনিট শুইয়া থাকিতে পারিলাম না। সারা বিকাল কৃষক-প্রজা-নেতা ও এম এল এ-দের যাতায়াত চলিল। সন্ধ্যার দিকে শুনিলাম, ঐদিন প্রজা-নেতাদের জরুরী বৈঠক দেওয়া হইয়াছে। আমার সুবিধার জন্য আমারই বাসায় স্থান করা হইয়াছে। দুতালার বিশাল ছাদে সভার আয়োজন হইয়াছে।
সন্ধ্যার পর সিঁড়িতে অবিরাম জুতার খটাখট আওয়াযে বুঝিলাম সভার সময় হইয়াছে। ইযিচেয়ারে শোওয়াইয়া ধরাধরি করিয়া আমাকে ছাদে তুলা হইল। দেখিলাম অল্প কালের মধ্যেই আলো ও আসনের সুন্দর ব্যবস্থা হইয়াছে। আশাতীত রকম নেতৃ-সমাগম হইয়াছে। গম্ভীর পরিবেশে আলোচনা শুরু হইল। অল্পক্ষণেই সভা গরম হইয়া উঠিল। বক্তাদের কথায় বুঝা গেল হক সাহেব ইতিমধ্যেই প্রচার করিয়াছেন, আমার সম্মতি লইয়াই ঐ ভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করিয়াছেন। আমার নিকট হক সাহেব পত্র লিখিয়াছেন, একথা দেখিলাম অনেক বক্তাই জানেন। অনেকেই আমার নিন্দা করিলেন। দু-দশ জন আমার নিকট লেখা হক সাহেবের পত্র দেখিতে চাহিলেন। আমার সৌভাগ্য বশতঃ নিন্দার ভাগী আমি একা ছিলাম না। বন্ধুবর আশরাফুদ্দিনকে আমার চেয়ে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করা হইল। অনেক বাই বলিলেন, চৌধুরী আশরাফুদ্দিনের চেষ্টাতেই শামসুদ্দিন সাহেবকে বাদ দিয়া নবাব সাহেবকে নেওয়া হইয়াছে। আশরাফুদ্দিন সাহেবনবাব সাহেবকে লইয়া একাধিকবার হক সাহেবের সাথে দেখা করিয়াছেন তারও চাক্ষুষ সাক্ষী পর্যন্ত পাওয়া গেল। চৌধুরী সাহেব ও আমি উভয়েই আত্মপক্ষ সমর্থন করিবার চেষ্টা করিলাম। চৌধুরী সাহেবের বক্তব্য আমার ঠিক মনে নাই। তবে যতদূর মনে পড়ে তিনি বলিয়াছিলেন যে শামসুদিন সাহেবকে বাদ দেওয়া যখন একদম অবধারিত হইয়া গিয়াছিল, তখনই তিনি নিতান্ত মন্দের ভাল হিসাবে ঐ ব্যবস্থায় রাযী হইয়াছিলেন। আমি অসুখের দরুল বেশি কথা বলিতে পারিলাম না। তবে হক সাহেবের পত্রখানা আমার খুব উপকারে লাগিল। তাতে ইহা স্পষ্ট বোঝা গিয়াছিল যে হক সাহেবের কাজে আমার পূর্ব-সম্মতি ছিল
৪. উপদেষ্টা বোর্ড
যা হোক, বক্তাদের উত্তাপ শেষ পর্যন্ত কমিয়া গেল। ধীর-স্থিরভাবে আলোচনা শুরু হইল। মন্ত্রিসভা বয়কট করা বুদ্ধিমানের কাজ হইবে না। তাতে হক সাহেবেকে জমিদারদের হাতে অসহায় অবস্থায় ছাড়িয়া দেওয়া হইবে, এ বিষয়ে আমরা একমত হইলাম। অতএব মন্ত্রিসভার উপর কড়া নযর রাখিয়া ইহার সহিত সহযোগিতা করিয়া যাওয়াই সাব্যস্ত হইল। সুষ্ঠভাবে এই কাজ করিবার উদ্দেশ্যে মন্ত্রিসভার একটা উপদেষ্টা বোর্ড গঠনের দাবি করা হইল। এই উপদেষ্টা বোর্ড গঠনে এবং তাতে প্রজ সমিতির মেজরিটির ব্যবস্থা করায় হক সাহেবকে রাযী করার ভার আমার উপর দেওয়া হইল। এইভাবে ভালয়-ভালয় সেদিনকার উত্তেজনাপূর্ণ সতার কাজ শেষ হইল।
হক সাহেবের ধারণা হইয়াছিল যে তাঁর পত্রের মর্ম অনুযায়ী আমিই সেদিনকার সতাটা সামলাইয়াছিলাম। কাজেই তিনি অতি সহজেই আমার প্রস্তাবে রাখী হইয়াছিলেন এবং মন্ত্রিসভাকে রাযী করিয়াছিলেন। সকল দলের ইলেকশনী ওয়াদার ভিত্তিতে একটি সাধারণ কর্মপন্থা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে শীঘ্রই একটি উপদেষ্টা বোর্ড গঠিত হইল। ইহাতে ছয়জন সদস্য থাকিলেন। এতে মুসলিম লীগের পক্ষে থাকিলেন নবাব বাহাদুর হবিবুল্লাহ, সার নার্যিমুদ্দিন ও মিঃ শহীদ সুহরাওয়াদী। কৃষক-প্রজা পার্টির তরফে থাকিলেন হক সাহেব, সৈয়দ নওশের আলী এবং আমি। প্রস্তাব হইল মন্ত্রিসভা এই উপদেষ্টা বোর্ডের প্রস্তাব কার্যকরী করিতে বাধ্য থাকিবেন। ফলে মন্ত্রী ও এম.এল.এরা এই বোর্ডকে ‘সুপার ক্যাবিনেট’ আখ্যা দিলেন।
ইতিমধ্যে বন্ধুদের চেষ্টায় এবং হক সাহেবের সহায়তায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা হইল। অটো-ভ্যাক্সিন চিকিৎসায় আমি সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিলাম। মন্ত্রিসভার কাজ পুরাপুরি শুরু হইবার আগেই উপদেষ্টা বোর্ডের সভা হওয়া দরকার। সে মতেই ইহার বৈঠক দেওয়া হইল এবং আমি মফস্বলের লোক বলিয়া আমার সুবিধার খাতিরে দিনের-পর-দিন ইহার বৈঠক চালাইবার ব্যবস্থা হইল। প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন, মহাজনি আইন প্রণয়ন, কৃষিখাতক আইন অনুসারে সালিশী বোর্ড গঠন, প্রাথমিক শিক্ষা আইন কার্যকরী। করণ প্রভৃতি যরুরী প্রশ্নগুলি সম্বন্ধে সর্বসম্মত কর্মসূচী গৃহীত হইয়া গেল। কিন্তু দুইটি বিষয়ে একমত হইতে না পারায় দিনের পর দিন উহার আলোচনা পিছাইয়া যাইতে। লাগিল এর একটি জমিদারি উচ্ছেদ, অপরটি মন্ত্রি-বেতন। জমিদারি উচ্ছেদে মুসলিম। লীগ প্রতিনিধিরাও রাযী ছিলেন বটে, কিন্তু বিনা-ক্ষতিপূরণে তাঁরা কিছুতেই রাযী হইতেছিলেন না। আর মন্ত্রি-বেতন প্রশ্নে তাঁরা প্রজা-সমিতির নির্বাচনী ওয়াদা কিছুতেই গ্রহণ করিতেছিলেন না। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে কৃষক-প্রজা সমিতির নির্বাচনী ওয়াদায় ছিল মন্ত্রীরা এক হাজার টাকার বেশি বেতন নিতে পারিবেন। জমিদারি উচ্ছেদ সম্পর্কে আলোচনা লম্বা করা সম্ভব। কিন্তু মন্ত্রি-বেতনের আলোচনায় বিলম্ব করা যায় না। কারণ মাস গেলেই মন্ত্রীদের বেতন লইতে হইবে। কাজেই শেষ পর্যন্ত একদিন মন্ত্রি-বেতনের আলোচনা শুরু হইল। আমি প্রস্তাব দিলাম এবং সৈয়দ নওশের আলী সমর্থন করিলেন, মন্ত্রীরা এক এক হাজার টাকা বেতন পাইবেন। এই আলোচনায় একটি অপ্রিয় ঘটনা ঘটিয়াছিল এবং এই অপ্রিয় ঘটনা হইতেই পরবর্তীকালে জনাব শহীদ সাহেবের সহিত আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। সেজন্য ঘটনাটি ঘোট হইলেও এখানে তার উল্লেখ করিতেছি। এক হাজার টাকা মন্ত্রি বেতনের নৈতিক ও অর্থনৈতিক যুক্তির বিরুদ্ধে লীগ-নেতাদেরও কিছু বলিবার ছিল না। তাঁদের একমাত্র যুক্তি ছিল, মাত্র এক হাজার টাকায় মন্ত্রীদের চলা অসম্ভব। সুতরাং প্রস্তাবটি অবাস্তব। লীগ নেতাদের এই যুক্তির জবাবে আমি বলিয়াছিলাম যে মন্ত্রীরা বিনা-তাড়ায় বাড়ি পাইবেন, বিনা-খরচে গাড়ি পাইবেন, ভ্রমণে টি এ. ডি.এ.পাইবেন, বিনা খরচে চাপরাশী আরদালী পাইবেন। সুতরাং হাজার টাকা বলিতে গেলে মন্ত্রীদের নিট আয় থাকিবে। অতএব টাকার অপ্রতুলতার যুক্তি ঠিক নয়। প্রস্তাবটা কাজেই অবাস্তব নয়।
আমার প্রস্তাবের সমর্থনে কংগ্রেসের পাঁচশ টাকা মন্ত্রি-বেতনের এবং অন্যান্য দেশের মন্ত্রি-বেতনের দু’একটা নযির দিলাম। এই তক স্বভাবতঃ খুবই গরম হইয়াছিল। উভয় পক্ষ হইতে তীব্র ও রুঢ় কথাও আদান-প্রদান হইতেছিল। হঠাৎ শহীদ সাহেব উত্তেজিত সুরে আমাকে বলিলেন : ‘তুমি দেড় শ টাকা আয়ের মফস্বলের উকিল। তুমি কলিকাতাবাসী ভদ্রলোকের বাসা-খরচের জান কি?’
আমি এই আক্রমণে আরও রাগিয়া গেলাম। পকেট হইতে এক টুকরা হিসাবের কাগ্য সশব্দে টেবিলের উপর রাখিয়া ক্রোধ-কম্পিত গলায় বলিলাম : এই হিসাবে কলিকাতাবাসী একটি ভদ্র-পরিবারের সমস্ত আবশ্যক খরচ ধরা হইছে। এতে শুধু মদ ও মাগির হিসাব ধরা হয় নাই। ও দুইটা ছাড়া আর কি এই হিসাবে বাদ পড়ছে, দেখাইয়া দেন।
শহীদ সাহেব রাগে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিলেন। আমিও উঠিলাম। হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম আর কি? সভা ভাংগিয়া যায়। নবাব বাহাদুর হবিবুল্লাহ ছিলেন হাড়ে-মজ্জায় আদৎ শরিফ লোক। তিনি মধ্যে পড়িলেন। আমরা উভয়ে সমান দোষী হইলেও নিজের দলের শহীদ সাহেবকেই তিনি দোষী করিলেন এবং আমার কাছে মাফ চাইতে তিনি শহীদ সাহেবকে কড়া হুকুম দিলেন, অন্যথায় তিনি পদত্যাগ করিবেন বলিয়া হমকি দিলেন। কিন্তু এর দরকার ছিল না। শহীদ সাহেব দিল-দরিয়া লোক। তিনি হাত বাড়াইয়া শুধু আমার হাত ধরিলেন না, টানিয়া আমাকে জড়াইয়া ধরিলেন এবং বলিলেন : মাফ কর এবং তুলিয়া যাও। আমিও ঐ কথা বলিলাম। উভয়েই উভয়কে মাফ করিলাম বটে, কিন্তু ভুলিলাম না। সেই হইতে আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়িতে লাগিল। পরবর্তীকালে তিনি অনেক দায়িত্বপূর্ণ কাজ দিয়া আমাকে বিশ্বাস করিয়াছেন এবং আমি সাধ্যমত সে বিশ্বাস রক্ষা করিয়াছি।
৫. নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভংগ
যাহোক শেষ পর্যন্ত স্থির হইল মন্ত্রি-বেতনের প্রশ্নটা কোয়ালিশন পার্টি মিটিং-এ দেওয়া হইবে। আমি এম, এল, এ. না হওয়া সত্ত্বেও এ্যাডভাইযারি বোর্ডের মেম্বর হিসাবে আমাকে পার্টি মিটিং ডাকা হইবে। আমি সানন্দে এই সিদ্ধান্ত মানিয়া লইলাম। কারণ আমি জানিতাম সকল দলের মেম্বরদের বিপুল সংখ্যাধিক্য লোক মন্ত্রি-বেতন হাজার টাকার পক্ষপাতী। কিন্তু পার্টি মিটিং-এর দিন আমি নিরাশ হইলাম। কারণ কৌশলী মন্ত্রীরা মেম্বারদের জন্য আড়াইশ টাকা বেতনের প্রস্তাব করিলেন এবং মেম্বরও মন্ত্রি-বেতনটা একই প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত করিলেন। তাতে মন্ত্রীদের বেতন আড়াই হাজার এবং প্রধান মন্ত্রীর জন্য অতিরিক্ত পাঁচশ টাকার ব্যবস্থা হইল। রকম সর্বসম্মতিক্রমে অর্থাৎ নেমক (বিনা প্রতিবাদে) প্রস্তাবটি পাস হইয়া গেল।
কৃষক-প্রজা কর্মীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া শুরু হইল। চারিদিকেই নৈরাশ্য দেখা দিল। মন্ত্রিসভা গঠনে কৃষক-প্রজা সমিতির সুস্পষ্ট পরাজয় ঘটিয়াছে, এ ধারণা ক্রমে বন্ধমূল হইল। ইতিমধ্যে পরোক্ষ নির্বাচনে অধ্যাপক হুমায়ুন কবির সাহেবকে ব্যবস্থাপক সভার (উচ্চ পরিষদ) মেম্বর করিতে পারায় আমাদের একটু সুবিধা হইল। কৃষক-প্রজা কর্মীরা আমরা সবাই একমত ছিলাম যে আমাদের পক্ষ হইতে হক সাহেবের উপর ন্যর রাখা কর্তব্য। প্রথমতঃ ইউরোপীয় দল মুসিলম লীগ নেতারা এবং হিন্দু জমিদাররা হক সাহেবকে বাধ্য হইয়া প্রধানমন্ত্রী মানিয়া লইলেও তলেতলে তাঁকে ডিসক্রেডিট করিবার চেষ্টা তাঁরা চালাইয়া যাইতেছেন। দ্বিতীয়তঃ, হক সাহেব কখন কি করিয়া বসেন, তার ঠিক নাই। এ অবস্থায় হক সাহেবের সহিত ঘনিষ্ঠ ও তাঁর বিশ্বস্ত দু-এক জন কৃষক-প্রজা-নেতার সর্বদাই হক সাহেবের সংগে সংগে থাকা দরকার। শামসুদ্দিন সাহেব স্বভাবতঃই কাজ করিতে রাযী না হওয়ায় অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ও নবাবযাদা হাসান আলীর উপর এই দায়িত্ব পড়িল।
সমিতির সেক্রেটারী শামসুদ্দিন সাহেবকে মন্ত্রী না করা হইছে কৃষক-প্রজা কর্মীদের মধ্যে যে অসন্তোষ ধূমায়িত হইতেছিল, মন্ত্রী-বেতন আড়াই হাজার ও মেম্বর-বেতন আড়াই শ’ রায় কর্মীদের মধ্যে সে অসন্তোষ আরও বাড়িয়া গেল। শেষ পর্যন্ত জমিদারি উচ্ছেদের প্রশ্নটাকে শিকায় তুলিয়া যখন ফ্লাউড কমিশন নিয়োগ করা হইল, তখন কর্মীদের অসন্তোষ প্রকাশ্য ক্রোধে পরিণত হইল। আমি স্বস্তির সংগে ময়মনসিংহ বসিয়া ওকালতি করিতে পরিলাম না। হক সাহেব আমাদের কথা রাখেন না দেখিয়া ‘দুত্তোর যা-ইচ্ছা তাই হোক’ বলিয়া রাজনীতি হইতে হাত ধুইয়াও ফেলিতে পরিলাম না। কেবলি মনে হইত, হক সাহেবের নেতৃত্বকে সফল করা এবং তাঁকে দিয়া কৃষক-প্রজা সমিতির নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করার দায়িত্ব আমার কম নয়। এই সব চিন্তা করিয়া অবসর পাইলেই, এমনকি অনেক সময় ওকালতি ব্যাঘাত করিয়াও, কলিকাতা ছুটিয়া যাইতাম। এতে মণ্ডকেলরা অসন্তুষ্ট হইতেন। আমার ব্যবসার অনিষ্ট হইত। কিন্তু আমি এটা উপক্ষো করিতাম। কারণ পাঁচ-সাত বছরের আমার এই অভিজ্ঞতা হইয়াছে যে স্বয়ং মণ্ডলেরাই এ সম্পর্কে দুই অবস্থায় দুই রকম কথা বলেন। একজন আসিয়া শুনিলেন আমি সেই রাত্রের ট্রেনেই অন্যত্র মিটিং করিতে যাইতেছি। পরদিনই তাঁর কেসের শুনানি। তিনি চিৎকার করিয়া বলিলেন : ‘আপনে যাইতেছেন সভা করতে; আমার কেসের তবে কি হৈব?’ আমি বলিতাম, ‘আমি হাকিমেরে কৈয়া রাখছি। দরখাস্ত দিলেই টাইম দিবেন।‘ তাতেও মওক্কেল সন্তুষ্ট হইতেন না। নিজের স্বার্থের কথা বাদ দিয়া আমার হিতের চিন্তা করিতেন। বলিতেন : ‘এভাবে কেবল সভা কৈরা বেড়াইলে আপনের ওকালতি চলব কেমনে?’ আমি হাসিয়া বলিতাম : ‘এর পর আর সভা-সমিতি না কৈরা শুধু ওকালতিই করব। কথা দিয়া ফেলছি বৈলাই আজ যাইতেছি।‘ কয়েকদিন পরে ঐ ভদ্রলোকই এক সভার আয়োজন করিয়া বিজ্ঞাপনে আমার নাম ঘোষণা করিয়া আমাকে নিতে আসিয়াছেন। আমি মাথা নাড়িয়া বলিলাম : ‘অসম্ভব, আমি যাইতে পারব না। কাল আমার খুব বড় মামলা আছে।‘ ভদ্রলোক বিস্মিত হইয়া বলিলেন : ‘ওঃ আপনেও শেষ পর্যন্ত টাকা চিনছেন? আপনেও যদি আর দশ জনের মতই টাকা রোযগারে ধাওয়া করেন, তবে প্রজা-আন্দোলন চাংগে তুইলাই যান। মামলার কপালে যাই থাকুক, আমাদের সভায় আপনের যাইতেই হৈব। আপনে না গেলে ঐ অঞ্চলের জনসাধারণ আমারে মাইরা ফেলব, আপনেরেও ছাড়ব না।‘ সুতরাং আমি মামলা মুলতবির ব্যবস্থা করিয়া সভা করিতে যাইতাম।
এইভাবে আমি কৃষক-প্রজা পার্টির পার্লামেন্টারি রাজনীতির সাথেও সম্পর্ক রাখিতে বাধ্য হইতাম। কলিকাতা যাতায়াত করিতাম। এতে আমার ওকালতির ব্যাঘাত, আর্থিক ক্ষতি ও পরিবারের কষ্ট হইত, বুঝতাম। কিন্তু উপায়ন্তর ছিল না। নিজের নেতৃত্ব বজায় রাখিবার গরযেই তা করিতে হইত। প্রধান মন্ত্রী হক সাহেব আমার কথা রাখেন না, এ কথা এ জিলার কেউ বিশ্বাস করি না। তাদের ধারণা আমি হক সাহেবের উপদেষ্টা। আমার বুদ্ধি ছাড়া তিনি কখনও কোনও কাজ করেন না। হক সাহেবের এমন আস্থা আমি হারাইয়াছি, রাজনৈতিক চালে মুসলিম লীগের কাছে হারিয়া গিয়াছি, ময়মনসিংহের ভোটাররা কৃষক-প্রজা পার্টিকে ভোট দিয়া ভুল করিয়াছে, এসব কথা স্বীকার করিতেও আত্ম-সম্মানে কেমন বাধিত। পক্ষান্তরে বড়-বড় কথা বলিয়া ধাপ্লা দিয়া কৃষক-প্রজার ভোট নিয়াছি, এ কথাও বলা যায় না, কারণ কথাটা সত্য নয়। কাজেই বলিতে হয় হক সাহেব ঠিকই আছেন। মুসলিম লীগের জমিদার মন্ত্রীরা হিন্দু-জমিদার মহাজন মন্ত্রীদের সাথে জোট পাকাইয়া হক সাহেবকে কোন্ঠাসা করিয়াছেন। কথাটা যে একদম মিথ্যা নয়, তার প্রমাণও হাতে কলমে পাইলাম। আমার ‘নয়া পড়া’ নামে একটি শিশুপাঠ্য বই পাঁচ বছর ধরিয়া পাঠ্য থাকার পর আরবী-ফারসী শব্দের ‘আথিশয্য-দোষে’ বাদ গেল হক সাহেবের প্রধান মন্ত্রী-শিক্ষা মন্ত্রিত্বের আমলে। তিনি চিৎকার হৈ চৈ করিয়া ছাত ফাটাইয়াও প্রতিকার করিতে পারিলেন না। আমি আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হইলাম। দুঃখিত হইলাম। কিন্তু সহ্য করিলাম। রিযনেবল হইলাম।
চিন্তিত হইলাম তার চেয়ে বেশি। কৃষক-প্রজা-পার্টি ও কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সাথে মন্ত্রিসভার একটা সংঘাত ক্রমেই আসন্ন হইয়া আসিতেছে, তা স্পষ্টই দেখিতে পাইলাম।