ওযারতি লস্ট
সাতাইশা অধ্যায়
১. সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার বিপদ
১৯৫৭ সালের জুলাই মাসের শেষদিকে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ পার্টির দলত্যাগী কতিপয় সদস্য, গণতন্ত্রী দলের কর্মকর্তা এবং বামপন্থী হিন্দু সদস্যদের কতিপয় লইয়া আইন-পরিষদের মধ্যেও জন-ত্রিশেক সদস্যের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হইল। এঁদের সকলেই আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার সমর্থক ছিলেন। আওয়ামী লীগের সহিত ঝগড়া করিয়া মওলানা ভাসানী এই নূতন দল করায় এই দল সরকার-বিরোধী হইবে, স্বভাবতঃই লোকের মনে এই আশংকা হইল। ন্যাশনাল এসেন্নির একজন আওয়ামী সদস্য এই নতুন দলে যোগ দেওয়ায় কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগ অন্ততঃ এক ভোটে দূর্বল হইল, এটাও লোজনের চোখ এড়াইল না। জুন মাসের শেষ দিক হইতেই কেন্দ্রে শহীদ মন্ত্রিসভার পনের গুজব কোথা হইতে যেন রটান হইতেছিল। আওয়ামী লীগের এই ভাংগনে এবং আইন-সভায় আওয়ামী লীগের শক্তি হ্রাসের ফলে এই গুজবে আরও ইন যোগান হইল। অনেকগুলি উপ-নির্বাচন সামনে লইয়াই মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগকে এই আঘাত করিয়াছিলেন। তার কয়েকটিতে মওলানা নিজস্ব প্রার্থী খাড়া করিয়া আওয়ামী লীগের মোকাবিলাও করিলেন। কিন্তু সব কয়টিতে আওয়ামী লীগ জিতিল। কাজেই আইন সভার বাহিরে আপাততঃ কোনও বিপদ নাই, আমাদের এবং লোকজনেরও এই আশা হইল। কিন্তু মন্ত্রিসভার বিপদ ঘটে নাই। বিশেষতঃ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বিপদ।
সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার পতনে আর কোনও ক্ষতি না হউক যুক্ত নির্বাচন-প্রথার ভিত্তিতে আসন্ন সাধারণ নির্বাচন বানচাল হইবে এবং তাতে প্যারিটি-শৃংখলিত পূর্ব পাকিস্তানের সমূহ ক্ষতি হইবে, একথা চিন্তা করিয়া পূর্ব-বাংলার জনসাধারণ, বিশেষ করিয়া কৃষক-শ্রমিক পার্টির অধিকসংখ্যক মেম্বর, বিচলিত হইলেন। হক সাহেব তখন পূর্ব-পাকিস্তানের গবর্নর। সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার শক্তিহ্রাস ও পতনের সম্ভাবনায় তিনিও বিচলিত হইলেন। শহীদ সাহেবের সহিত তাঁর বহুদিনের ব্যক্তিগত শত্রুতার কথা ভুলিয়া তিনি তাঁর কৃষক-শ্রমিক পার্টির মেম্বারদের শহীদ সাহেবের সহিত আপোস করিবার উপদেশ দিলেন। তাঁদের একদল প্রতিনিধি করাচি গিয়া প্রধানমন্ত্রীর সহিত আলোচনা করিলেন। সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার ও আওয়ামী লীগের আসন্ন বিপদের অতিরিক্ত সুযোগ লইয়া তাঁরা একটু বেশী দাম হাকিলেন। সাবেক যুক্তফ্রন্টের পযিশনে ফিরিয়া যাইবার দাবি করিলেন। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া মুজিবুর রহমান ও আমি এই আলোচনায় শরিক ছিলাম। শহীদ সাহেব আশাতিরিক্ত কুটনৈতিক ভাষায় তাঁদেরে বিদায় করিলেন। তাঁর উপর মুজিবুর রহমান তাঁদের সাথে ভাল ব্যবহার না করায় তাঁরা স্বভাবতঃই রাগ করিয়া ফিরিয়া আসিতেছিলেন। আমি নিতান্ত বন্ধভাবে তাঁদেরে তাঁদের চড়া দাবি ত্যাগ করিয়া বাস্তববাদী হইতে উপদেশ দিলাম। প্রতিনিধি দলের মধ্যে অ-মেম্বর আমার বিশেষ বন্ধু মিঃ রেযায়ে-করিমও ছিলেন। তিনি আমার কথার মর্ম বুঝিলেন। ঢাকায় ফিরিয়া আসিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে এই আপোস-ফরমূলার অনুমোদন চাহিলেন। কৃষক-শ্রমিক পার্টির মধ্যে ভাংগন আসিল। জনাব আবু হোসেন সরকারকে অপসারিত করিয়া তাঁর স্থলে মিঃ সৈয়দ আযিযুল হককে (নান্না মিয়া)। পার্টির নয়া লিডার করা হইল। আওয়ামী লীগের সহিত আপোস বিরোধীরা সরকার সাহেবের নেতৃত্বে আলাদা পার্টি করিলেন।
২. আত্মরক্ষার চেষ্টা
এরপর আওয়ামী লীগ পক্ষ হইতে আনুষ্ঠানিকভাবে আলাপ-আলোচনা চালান হইল। লিডারের অনুমতিক্রমে আমি ঢাকা আসিলাম। আতাউর রহমান, মুজিবুর রহমান, মানিক মিয়া ও আমি সকলেই আলোচনায় অংশ গ্রহণ করিলাম। মানিক মিয়া ও আমি চৰ্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত থাকিলাম। বন্ধু রেযায়ে-করিমের বাড়িতে রোজ রাত্রে আলাপ-আলোচনা চলিতে লাগিল। কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতারা বিশেষতঃ নান্না মিয়া ও মোহন মিয়া প্রশংসনীয় বাস্তব-বুদ্ধির পরিচয় দিলেন। এরূপ বিনাশর্তে তাঁরা আওয়ামী লীগ কোয়েলিশনে যোগ দিতে রাযী হইলেন। কথা হইল লিডারের পছন্দমত কে, এস, পি.র দুই-একজনকে মন্ত্রী নিবেন। আগামী নির্বাচনে কৃষক-শ্রমিক পার্টি তাঁদের মনোনীত প্রার্থীর তালিকা লিডারের নিকট পেশ করিবেন। লিডারের সিলেকশনই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হইবে। এই কোয়েলিশনের ফলে এই মুহূর্তে অন্ততঃ ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জন (চল্লিশও হইতে পারে) মেম্বর আওয়ামী কোয়েলিশনে যোগ দিবেন। তাতে আতাউর রহমান সরকারের স্থায়িত্ব নিরাপদ হইবো ন্যাপ দলের অনিশ্চিত সমর্থনের কোনও দরকারই থাকিবে না। অধিকন্তু আওয়ামী লীগ কোয়েলিশন নিরংকুশ মুসলিম মেজরিটির দল হইবে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় এরও প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল। এই ভাবে সব ঠিক হইয়া যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় আসিলেন। গবর্নমেন্ট হাউসে উঠিলেন। তাঁর কাছে আমরা বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করিলাম। কিন্তু বলিলেন : কৃষক-শ্রমিক পার্টিকে কোয়েলিশনে আনিয়া এটাকে নিরংকুশ মুসলিম মেজরিটির দল করিতেছি দেখিয়া হিন্দু মেম্বররা তুল না বুঝেন, সে জন্য তাঁদের মত লওয়া আমি উচিৎ মনে করি। আমরা সোল্লাসে তাতে সায় দিলাম। কারণ আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনার গতিধারা সম্বন্ধে হিন্দু মন্ত্রীদের অবহিত করিয়া রাখিয়াছি। তাঁরা জানিতেন কৃষক শ্রমিক পার্টি আওয়ামী লীগের মতই সেকিউলারি দল। কাজেই তাঁদের কোন আপত্তি ছিল না। লিডার হিন্দুদের মধ্যে ধীরেন বাবু ও মনোরঞ্জন বাবুর সাথে আমাদের সামনেই আলোচনা করিলেন। তাঁরা সাগ্রহে এ ব্যবস্থায় সম্মতি দিলেন। তফসিলী হিন্দু মন্ত্রীদ্বয়ের মত আছে, তাও লিডারকে জানান হইল। তিনি প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমানকে বলিয়া দিলেনঃ ‘সবঠিক হইয়া গেল। এখন ব্যবস্থার ব্যবস্থা কার’ মানে কবে-তক কাকে কাকে মন্ত্রীর শপথ দেওয়া হইবে তার ব্যবস্থা কর, আমি এই কথাই বুঝিলাম। কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতাদেরেও তাই বলিয়া দেওয়া হইল। নান্না মিয়ারা গবর্নমেন্ট হাউসের হক সাহেবের দখলে হাযিরই ছিলেন। তাঁরাও সুখবরটা গবর্নরকে দিতে গেলেন। প্রাইম মিনিস্টার সিলেট ও যশোহর ভ্রমণে গেলেন। আমরাও যার-তার কাজে গেলাম।
নির্ধারিত দিনে চিফ মিনিস্টারের পলিটিক্যাল সেক্রেটারি মিঃ যমিরুদ্দিন আহমদের বাসায় বৈঠক বসিল। কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতারা তাঁদের সংখ্যা শক্তির প্রমাণ স্বরূপ প্রায় ত্রিশজন মেম্বর লইয়া বৈঠকে উপস্থিত থাকিলেন। আমাদের পার্টির কারো মনে যদি কোনও দ্বিধা-সন্দেহ থাকিয়াও থাকে, তবে তাঁদের এই সংখ্যা শক্তি প্রদর্শনের পরে তাঁদের দ্বিধা নিশ্চয় দূর হইবে এবং আজই কোয়েলিশন ঘোষণা ও ওঁদের মধ্য হইতে দুই-এক জন মন্ত্রী শপথ গ্রহণ করা হইবে, এ সম্পর্কে আমার নিজের এবং উপস্থিত অনেকের আর কোনও সন্দেহ থাকিল না। আমাদেরই মনের অবস্থা যখন এই, তখন কে, এস. পি. নেতাদের মনোভাব সহজেই অনুমেয়। আমরা সকলে গলা লম্বা ও কান খাড়া করিয়া প্রাইম মিনিস্টারের অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।
৩. চেষ্টা ব্যর্থ
প্রাইম মিনিস্টার আসিলেন। হাসিহীন গম্ভীর মুখে বসিলেন। এটা-ওটা দুই-এক কথা বলিলেন। তারপর বস্ত্রপাতের মত ঘোষণা করিলেন যে প্রস্তাবিত কোয়েলিশন আপাততঃ সম্ভব নয়। পাবলিকও এটা চায় না। তিনি নিজেও চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন, এটা উচিৎ হইবে না। প্রাইম মিনিস্টারের কথায় ফাইনালিটি মানে চূড়ান্তের সুর মালুম হইল। আমি বুঝিলাম ইতিমধ্যে প্রাইম মিনিস্টারকে অন্যরূপ বুঝাইতে কেউ সমর্থ হইয়াছেন। প্রাইম মিনিস্টার আমাদের সুপ্রিম নেতা। তাঁর অনিচ্ছায় কিছু হইবেও না। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কে, এস, পি, র-ও আমাদের দলে আসা উচিৎ নয় তাঁদের মর্যাদার দিক হইতেও না, আমাদের ঐক্য-সংহতির দিক হইতেও না। সুজাং আমাদের এতদিনের চেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যর্থ হইল। বুঝিলাম কে, এস. পির সাথে শুধু আপাতত নয়, ভবিষ্যতেও কোনও দিন কোয়েলিশন করার সম্ভাবনা তিব্লোহিত হইল। কিন্তু এসবই আমাদের দিককার কথা। ওঁদের দিককার কথাও ত ভাবিতে হইবে। কে.এস. পি. নেতারা যে নিজেদের দল ভাংগিয়া আমাদের সাথে কোয়েলিশনে তাঁদের মেজরিটি মেম্বরকে রাযী করিয়াছেন, আজ যে তাঁরা ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জন মেম্বরকে একত্রে করিয়া আমাদের লিডারের সামনে হাষির করিতে পারিয়াছেন, তার একমাত্র সুস্পষ্ট কারণ এই যে ভীরা নিজেদের সমর্থকদের কাছে প্রাইম মিনিস্টারের-দেওয়া নিশ্চিত পাকা কথাই জানাইয়াছেন। সুহরাওয়ার্দী একবার কথা দিলে তার আর দুল করেন না, এটা সবার স্বীকৃত সত্য। সেই বিশ্বাসেই ঐ মেম্বাররা আজ এখানে উপস্থিত। প্রাইম মিনিস্টার যে-সুরে ও যে-ধরনে কথাটা উড়াইয়া দিলেন, তাতে সকলেই বুঝিলেন তিনি কাকেও কোনও কথা দেন নাই পাকা কথা ত দূরের কথা। আমি কলনা-নেত্রে দেখিলাম, এখান হইতে বাহিরে গিয়াই কে এস পি মেম্বরেরা তাঁদের নেতাদের ধরিবেন। বলিবেনঃ ‘শহীদ সাহেব ত মিথ্যা বলিতে পারেন না। আপনারাই আমাদেরে ব্লাফ দিয়া এতদিন ঘুরাইয়াছেন। আজ এখানে আনিয়া অপমান করিয়াছেন। অনুসারীদের আস্থা হারানো নেতাদের পক্ষে চরম শাস্তি। কে এস পির যে সব নেতা এতদিন আমাদের সাথে বন্ধুত্ব করিবার আন্তরিক চেষ্টা করিলেন, তাঁদেরে বন্ধুত্ব দিতে পারিলাম না বটে, কিন্তু নিজেদের অনুসারীদের দিয়া তাঁদেরে অপমান করাইবার কোনও অধিকার আমাদের নাই। আমার বিবেক চিল্লাইয়া উঠিল : এদেরে অন্যায় অভিযোগ ও অনুচিত, অপমান হইতে বাঁচাও।
আমি আমার লিডারের আস্থা ও মন্ত্রিত্ব হারাইবার একটা রিস্ক নিলাম। প্রধানমন্ত্রীর, ঐ ধরনের কথার প্রতিবাদে কেউ যখন কথা বলিলেন না, কে এস. পি. নেতাদের যে কথা বলিবার সম্পূর্ণ অধিকার থাকা সত্ত্বেও শুধু ভদ্রতার খাতিরে অথবা বিস্ময়ে বলিতে পারিলেন না, তখন সেই কথাটা বলিবার দায়িত্ব নিলাম আমি। আমি প্রধানমন্ত্রীর পাশ ঘেষিয়া বসিয়াছিলাম। সকলে আমার সরু গলা শুনিতে নাও পারেন সেই আশংকায় আমি ঐ বসা মজলিসেই দাঁড়াইলাম এবং বলিলাম : তবে কি আমরা বুঝিব, প্রাইম মিনিস্টার তাঁর গত কয়দিনের ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি হইতে সরিয়া গিয়াছেন? তিনি ইচ্ছা না করিলে কিছু হইবে না ঠিক, কিন্তু এটা সকলের জানা দরকার যে প্রাইম মিনিস্টার কেএসপির সাথে আপোস করিতে চাহিয়াছিলেন এবং তাঁর কথামতই আজ এরা এই বৈঠকে হাযির হইয়াছেন। প্রধানমন্ত্রী আমার কথার প্রতিবাদ করিলেন না? ’হ্যাঁ’ ‘না’ কিছু বলিলেনও না। কিন্তু তাতেই আমার কাজ হইয়া গেল। কৃষক-শ্রমিক নেতাদেরে তাঁদের সমর্থকদের হামলা হইতে বানোই আমার উদ্দেশ্য ছিল। সে উদ্দেশ্য সফল হইল। অতঃপর প্রধানমন্ত্রী করাচি যাওয়ার জন্য বিমান বন্দরেরওয়ানা হইলেন। আমি বুঝিলাম, বিপদ আসন্ন।
৪. ইউনিট সম্পর্কে ভ্রান্ত নীতি
কয়েক মাসের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের আরেক খপ্পরে পড়িলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশগুলির জনমত যাচাই না করিয়াই উহাদিগকে ভাংগিয়া এক প্রদেশ করা হইয়াছিল। কাজেই সেখানকার অসন্তোষ ছাই-চাপা আগুনের মত ধিকিধিকি জ্বলিতেছিল। সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার আমলে যথেষ্ট দেওয়ানী আযাদির আবহাওয়া বিদ্যমান থাকায় ঐ ব্যাপারে প্রবল জনমত ফাটিয়া পড়িল। জনগণের চাপে আইন-পরিষদের মেম্বাররাও এক ইউনিট ভাংগিয়া প্রদেশগুলির পূনঃ প্রবর্তনের পক্ষে মত দিলেন। এই সময় রিপাবলিকান পার্টিই পশ্চিম পাকিস্তানের রুলিং পার্টি। এই পার্টির এক সভায় জাবেদা ভাবে এক-ইউনিট ভাংগিয়া স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশগুলি পুনঃ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হইল। এই দেখিয়া অপযিশন পার্টি মুসলিম লীগ দলও ঐ একই রকম প্রস্তাব গ্রহণ করিলেন। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের তিনটি পার্লামেন্টারি দল যথা মুসলিম লীগ, রিপাবলিকান ও ন্যাপ সকলেই একমত হইয়া পরিষদে এক-ইউনিট ভাংগার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করিলেন। এক-ইউনিট করার সময় আওয়ামী লীগ উহার বিরোধিতা করিয়াছিল। তাদের যুক্তি ছিল অগণতান্ত্রিক পন্থায় ঐ ব্যবস্থা মাইনরিটি প্রদেশসমূহের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে। আওয়ামী লীগ বরাবর বলিয়াছে, ব্যাপারটা সম্পূর্ণরূপে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ব্যাপার। পূর্ব পাকিস্তানীরা উহাতে সম্পর্কিত শুধু এই কারণে যে যদিও পূর্ব-পাকিস্তানীদের মোকাবিলা পশ্চিম-পাকিস্তানের সকল প্রদেশকে সংঘবদ্ধ করিবার সংকীর্ণ উদ্দেশ্য হইতেই পাঞ্জাবী নেতারা ও অফিসাররা এই ফন্দি আবিষ্কার করিয়াছিলেন, তথাপি পশ্চিম পাকিস্তানের একটি যোনাল ফেডারেশন-গোছের ঐক্যবদ্ধতা লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানের সব প্রদেশের সকল দলের নেতারা সেই এক ইউনিট ভাংগিয়া দিবার প্রস্তাব কায় আওয়ামী লীগের এবং পূর্ব-পাকিস্তানীদের স্কুল দৃষ্টিতে খুশী হওয়ার কথা। খুশী হইলামও। কিন্তু আমাদের নেতা প্রধানমন্ত্রী সহরাওয়াদী আমাদের বিবেচনায় বিস্ময়কর রূপে উন্টা বুঝিলেন। এ সম্পর্কে কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনা আগে হইতে চলিতে থাকিলেও সরকারী দল, রিপাবলিকান পার্টি ও অপযিশন দল মুসলিম লীগ পার্টি একমত হইয়া যখন ফরম্যালি এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন, তখন প্রধানমন্ত্রী ও আমরা কতিপয় পূর্ব-পাকিস্তানী মন্ত্রী পূর্ব-বাংলা সফর করিতেছি। এই সংবাদ খবরের কাগযে প্রকাশ হওয়ার দুই একদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী করাচি ফিরিয়া গেলেন। পূর্ব-পাকিস্তান হইতে প্রধানমন্ত্রীর বিদায়-উপলক্ষে আমিও মফস্সল হইতে ঢাকায় ফিরিয়া আসিলাম। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান সাহেবও প্রধানমন্ত্রীর বিদায়-প্রাক্কালে গবর্নমেন্ট হাউসে উপস্থিত থাকিলেন। আমাদের কথাবার্তায় স্বভাবতঃই পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের ঐ প্রস্তাবের কথা উঠিল। প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ করিলেন যে প্রেসিডেন্টের সহিত তাঁর এ ব্যাপারে চূড়ান্ত আলাপ-আলোচনা হইয়া গিয়াছে। করাচি ফিরিবার পরই প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী একই সময়ে এ বিষয়ে রেডিও ব্রডকাস্ট করিবেন।
এমন রাজনৈতিক ব্যাপারে মির্যার নাম শুনিয়া আমি ঘাবড়াইয়া গেলাম। কারণ এ ব্যাপারে মির্যা ষড়যন্ত্র করিতেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে ভূল বুঝাইবার সাধ্যমত চেষ্টা করিতেছেন, এসব কথা আমি অনেকের মুখে, এমনকি কোনও-কোনও সহকর্মী মন্ত্রীর মুখেই শুনিয়াছিলাম। কাজেই আমি স্বভাবতঃই কৌতূহলী হইয়া প্রশ্ন করিলাম : প্রস্তাবিত ব্রডকাস্টে তাঁরা কি বলিবেন? প্রধানমন্ত্রী জানাইলেনঃ প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই ইউনিট ভাংগিবার বিরোধিতা করিবেন। আমার আশংকা সত্য হইল। গবর্নমেন্ট হাউসে উপস্থিত আমরা সকলে সমবেতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে এই ধরনের রেডিও-বক্তৃতা হইতে বিরত থাকিতে অনুরোধ করিলাম। অনেক যুক্তি-তর্ক দিলাম! প্রধানমন্ত্রী অটল রহিলেন। প্রেসিডেন্টের সহিত তাঁর কথা হইয়া গিয়াছে। তাঁর সাথে ত তিনি ওয়াদা খেলাফ করিতে পারেন না। অতঃপর আমরা মির্যার ষড়যন্ত্রের কথা বলিলাম। প্রমাণাদি পেশ করিলাম। তাঁকে খানিকটা নরম লাগিলেও আমার আশংকা দূর হইল না। প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে চড়িয়া আমি এয়ারপোর্টতক তাঁর সাথে গেলাম। তাঁর হাত চাপিয়া ধরিয়া কাকুতি-মিনতি করিয়া দুইটা অনুরোধ করিলাম। প্রথম, তিনি কেবিনেটে আলোচনা না করিয়া রেডিও-ব্রডকাস্ট করিবেন না। দুই, করাচি এয়ারপোর্টে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলিবেন? এ ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের রায়-মতই কাজ হইবে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে ধমক দিলেন : ‘তুমি আমাকে রাজনীতি শিখাইতে আসিয়াছ? কি ভাবে সাংবাদিকদেরে ফেস্ করিতে হয়, তাও তুমি আমাকে শিখাইবে? লিডারকে আমি চিনি। তিনি আমার উপর এমন রাগও করেন, আবার কথাও মানেন। আমি তাঁর ধমকে রাগ বা গোস্বা না করিয়া হাসিয়া বলিলাম : আপনেরে আমি কি শিখাইব? আপনার কাছে আমি যা শিখিয়াছি, তাই আপনেরে স্মরণ করাইয়া দিতেছি মাত্র। তিনি তাঁর স্বাভাবিক আকর্ণ-বিস্তৃত নিঃশব্দ হাসি হাসিয়া বলিলেন : আগের কথা ভুলিয়া যাও আবুল মনসুর, এখন আমি মনে করি, এক-ইউনিট ভাংগিবার অর্থ পাকিস্তান ভাংগিয়া যাওয়া। আমি স্তষ্ঠিত হইলাম। এই ভাষা আমার কাছে চিনা লাগিল। মনে পড়িল প্রেসিডেন্ট-হাউসে প্রেসিডেন্ট মির্যা ও ডাঃ খান সাহেবের মুখে এই ভাষাই শুনিয়াছিলাম। লিডার তবে সত্য-সত্যই মির্যার খপ্পরে পড়িয়াছেন! আমি মির্যার বিরুদ্ধে অনেক কথা বলিলাম। তার মধ্যে এও বলিলাম যে মির্যা শুধু প্রধানমন্ত্রীকে দিয়াই বক্তৃতা করাইবেন; অসুখ বিসুক বা অন্য কোনও অজুহাতে তিনি গা ঢাকা দিবেন। কথাটা আমি নিতান্ত যিদের বশে বলিলাম। নিজেও ওতে বিশ্বাস করি নাই। কাজেই প্রধানমন্ত্রী আমাকে বধ্যৎবলিয়া উড়াইয়া দিলেন। তবু আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অর্থাৎ বিমানের সিঁড়িতে খানিকদূর আগাইয়া মুসাফের সময় খুব জোরে হাত চাপিয়া বলিলাম : স্যার, আমার অনুরোধ দুইটা রক্ষা করিবেন। তিনি যেন হাতের ধাক্কায় আমার শেষ কথাটা মাটিতে ফেলিয়া দিয়া সেই হাতই আরও উঁচা করিয়া সালাম দিতে-দিতে জাহাজে ঢুকিয়া পড়িলেন। আমি মনে-মনে অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিলাম। নিশ্চয় লিডার মির্যার খপ্পরে পড়িয়া একটা কাণ্ড করিয়া বসিবেন। এই সময় আমরা পূর্ব-পাকিস্তানী মন্ত্রীরা প্রায় সবাই টুওরেছিলাম। বন্ধুবর যহিরুদ্দিনকে ব্যাপার বুঝাইয়া করাচি পাঠাইলাম পরদিনই। তিনি মুহূর্তকাল বিলম্ব না করিয়া চলিয়া গেলেন। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি হইতে টেলিফোনযোগে আমাকে জানাইলেন : আশংকিত বিপদের সম্ভাবনা কতকটা দূর হইয়াছে। কারণ প্রধানমন্ত্রী জ্বরে শয্যাগত। রেডিও-বক্তৃতা করা সম্ভব নয়।
কতকটা আশ্বস্ত হইলাম। লিডারের কাছছাড়া না হইতে বন্ধুকে উপদেশ দিলাম। পরবর্তী টেলিফোনেই আবার চিন্তিত হইলাম। যহিরুদ্দিন জানাইলেন, রেডিও পাকিস্তানের যন্ত্রপাতি ও কর্মচারিরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে হাযির।
রেডিওর পরবর্তী বৈঠকেই প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা প্রচারিত হইয়া গেল। পার্থক্য শুধু এই প্রধানমন্ত্রীরটা তাঁর নিজ গলায়। প্রেসিডেন্টেরটা তাঁর নিজ গলায় নয়। রেডিওর বুলেটিন রিডারের গলায়।
আশংকা সত্যে পরিণত হইতেছে দেখিয়া টুওর প্রোগ্রাম বাতিল করিলাম। করাচি ফিরিয়া গেলাম। প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলিয়া বুঝিলাম, ওয়ান-ইউনিটের ব্যাপারকে তিনি মূলনীতির প্রশ্ন করিয়াছেন। দৃঢ়-সংকল্প হইয়াছেন। সে সংকল্পের সামনে আমার সমস্ত যুক্তি অর্থহীন হইয়া গেল। তিনি এক কথায় বলিলেন: এজন্য তাঁর মন্ত্রিত্ব গেলেও তিনি পরওয়া করেন না। তাঁর মন্ত্রিত যাওয়া শুধু একটা মন্ত্রিসভার পতন নয়, সাধারণ নির্বাচন ভণ্ডুল হইয়া যাওয়া, একথাও তাঁকে স্মরণ করাইয়া দিলাম। তিনি বলিলেন : আমার আশংকা অমূলক ও অতিরঞ্জিত।
লিডার এই পথে আরও অগ্রসর হইলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের তিনটি পার্লামেন্টারি পার্টিই একমত হইয়া এক-ইউনিট ভাংগিয়া পূর্বতন স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশে ফিরিয়া যাইতে রাখী হইয়াছেন, এটা যে পশ্চিম পাকিস্তানের জনমতের বিরুদ্ধে, তা প্রমাণের জন্য তিনি টুওর প্রোগ্রাম করিলেন। পাঞ্জাব ও বাহওয়ালপুরেই প্রথম সফর। আমরা নিশ্চিত পতনের অপেক্ষায় ঘরে বসিয়া থাকিলাম। প্রতিদিন খবরের কাগযে প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ-লক্ষ লোকের বিরাট জনসভায় প্রাণস্পর্শী বক্তৃতার রিপোর্ট পড়িতে লাগিলাম। সে সব বক্তৃতায় তিনি এক ইউনিট বিরোধীদের পাকিস্তানের অনিষ্টকারী বলিয়া বর্ণনা করিতে লাগিলেন। এইসব সভায় প্রায় সবগুলিই রিপাবলিকান পার্টির মন্ত্রীদের দ্বারা আমাোজিত এবং তাঁদের উপস্থিতিতেই সমবেত। পরে দুই-একজন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রী কাঁদ-কাঁদ ভাষায় আমাকে বলিয়াছিলেন : ‘আমাদের চেষ্টায় ও টাকায় আয়োজিত সভায় আমাদের টাকায় সজ্জিত মঞ্চে বসিয়া আমাদের-কেনা মালা গলায় লইয়া আমাদের সামনে আমাদেরে দেখাইয়া আমাদের ভোটারদেরে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন : এরা পাকিস্তানেরদুশমন। লজ্জায়-ঘৃণায় আমাদের মাথা হেট হইয়াছে।
৫. রিপাবলিকান দলে প্রতিক্রিয়া
করাচিতে এর ফল ফলিল। প্রেসিডেন্ট আমাকে ডাকিলেন। তিনি কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী মন্ত্রীর-লেখা পত্র আমাকে পড়িতে দিলেন। সব কয়টাতেই লেখা, প্রধানমন্ত্রী তাঁদেরে এবং তাঁদের পার্টিকে ট্রেটর বলিয়া গাল দিয়াছেন। এ অবস্থায় তাঁরা এই প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কাজ করিতে অনিচ্ছুক। এই সব পত্রে এক-ইউনিট ছাড়াও অন্য ব্যাপারের উল্লেখ বা ইংগিত আছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের প্রতি কবে এমন অভদ্র ব্যবহার করিয়াছিলেন, তারও উল্লেখ আছে। প্রধানমন্ত্রীর রিপাবলিকান দলের বিরুদ্ধে নবাব গুরমানী-পরিচালিত মুসলিম লীগ পার্টির সহিত ষড়যন্ত্রেরও অভিযোগ আছে। প্রেসিডেন্ট ডাঃ খান সাহেব-সহ কতিপয় রিপাবলিকান নেতার টেলিগ্রামও আমাকে দেখাইলেন। তাতে লেখা ছিলঃ তাঁরা সবাই পরের দিন করাচি আসিতেছেন একটা হেস্তনেস্ত করিতে।
সেদিন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যুগোশ্লাভ ভাইস-প্রেসিডেন্টের একটা স্টেট রিসেপশন ছিল। পূর্বাহ্নেযুগোশ্লাভিয়ার ভাইস-প্রেসিডেন্টের সহিত প্রেসিডেন্ট হাউসের দুতলায় দরবার হলে আমার ইন্টারভিউ। এটা হওয়ার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রীর সাথে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আরেকটা কি গুরুতর কাজে ব্যাপৃত থাকায় আমার উপরই এই মোলাকাতের ভার পড়ে। প্রায় দুই ঘন্টা মোলাতের পর নিচে নামিয়া দেখিলাম ডাঃ খান সাহেব, সৈয়দ আমজাদ আলী, তাঁর সহোদর শাহ ওয়াজেদ আলী ও কতিপয় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সহিত দরবার করিতেছেন। আমাকে গোপন করিবার চেষ্টা করিলেন না। বরঞ্চ ডাকিয়া তাঁদের দরবারে নিলেন। প্রেসিডেন্টের সামনেই এবং স্পষ্টতঃ তাঁর অনুমোদনক্রমে বলিলেন, তাঁরা আমাদের লিডারের প্রধানমন্ত্রিত্ব আর সমর্থন করিবেন না, স্থির সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। আমার কর্তব্য তাঁকে পদত্যাগ করিতে পরামর্শ দেওয়া। আমি সাধ্যমত তাঁদের সাথে তর্ক করিলাম। যুক্তি তর্ক দিলাম। সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় বেশ নরম ভাবও দেখাইলেন। কিন্তু অন্যান্যেরা অনমনীয় থাকিলেন। কথা শোনা গেল প্রধানমন্ত্রী আসিতেছেন। কাজেই ইচ্ছাকরিয়াই আমি দেরি করিলাম। প্রধানমন্ত্রী আসিলেন। প্রেসিডেন্টের সহিত গোপন পরামর্শ করিলেন। আমরা বারান্দায় ও সম্মুখস্থ বিশাল সেহানে পায়চারি করিতে-করিতে গ্রুপ ডিসকাশন করিতে লাগিলাম।
প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সহিত আলাপ শেষ করিয়া বাহির হইলেন। সকলের সহিত হাস্য-রসিকতা করিয়া আমার হাত ধরিয়া বাহির হইয়া গাড়ি-বারান্দায় আসিলেন। আমি কোনও প্রশ্ন করিবার আগেই নিতান্ত স্বাভাবিক সহজ গলায় যুগোস্লাভিয়ার ভাইস-প্রেসিডেন্টের সহিত আমার মোলকাতের কথা জিগ্গাসা করিলেন। কি কি বিষয়ে আলাপ হইল, তার খুটিনাটি জানিতে চাহিলেন। আমি নিজের অধৈর্য গোপন করিয়া তাঁর সব কথার সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়া আসল কথা পাড়িলাম। প্রেসিডেন্টের সহিত তাঁর কি কথা হইল? তিনি হাতের ধাক্কায় আমার কথাটা উড়াইয়া দিলেন। বলিলেন : ওটা কিছু না, সব মিটিয়া গিয়াছে।
৬. সিকান্দরের জয়
সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী-ভবনে স্টেট-রিসেপশন। অভিজাত জন-সমাবেশ। আলোক মালায় সজ্জিত বিশাল আংগিনা লোকে লোকারণ্য। সবাই আসিয়াছেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী মন্ত্রীরা একজনও আসেন নাই। টোটাল বয়কট। কেউ সেটা লক্ষ্য করিবার এবং কানাঘুষা আরম্ভ হইবার আগেই প্রধানমন্ত্রী ফাংশন শুরু করিলেন। উভয় রাষ্ট্র নেই.পরস্পরের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়া বক্তৃতা করিলেন এবং টোস্ট প্রস্তাব ও স্বাস্থ্য পান করিলেন। খাওয়ার ধুম লাগিল।
কিন্তু সাংবাদিকরা খাওয়ায় ভুলিবার পাত্র নন। তাঁরা তাঁদের কাজ শুরু করিলেন। এ-ওর কাছে, মন্ত্রীদের কাছে এবং বিশেষ করিয়া আমার নিকট, নানারূপ প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। বিদেশী সম্মানিত অতিথির সহিত আলোচনায় রত বলিয়া প্রধানমন্ত্রী তাঁদের নাগালের বাইরে। সুতরাং আমাদের উপরই শিলাবৃষ্টি হইতে লাগিল। কি হইল? কেন পশ্চিম পাকিস্তানী মন্ত্রীরা পার্টিতে আসিলেন না। তাঁরা নাকি একযোগে পদত্যাগ করিয়াছেন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং পদত্যাগ করিয়াছেন কিংবা করিবেন কি না? তিনি নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করিবেন কি না? ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন। আসন্ন অবশ্যম্ভাবী বিপদের আশংকায় আমারও বুক কাঁপিতে ও গলা শুকাইয়া আসিতে লাগিল। কিন্তু অতি কষ্টে সব গোপন করিয়া হাস্য-রসিকতা করিয়া সাংবাদিকদের বুঝাইতে চাহিলাম তাঁরা যা শুনিয়াছেন সব ভূল। তাঁরাও ছাড়িবার পাত্র নন। আমিও হারিবাঃ পাত্র নই।
এমনি করিয়া অনেক রাত হইয়া গেল। আস্তে-আস্তে মেহমানরা এবং ফলে সাংবাদিকরাও চলিয়া গেলেন। থাকিলাম আমরা মাত্র পূর্ব-পাকিস্তানী দুইজন মন্ত্রী মিঃ দেলদার আহমদ ও আমি এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল প্রাইভেট সেক্রেটারি মিঃ আফতাব আহমদ খান। আমাদের সাথে পরামর্শ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর চেম্বারে নিয়া গেলেন। দরজা বন্ধ করিয়া তিনি আমাদেরে প্রেসিডেন্ট মির্যার একটি পত্র দেখাইলেন। তাতে প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান পার্টির অনাস্থার কথা জানাইয়া প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগের উপদেশ দিয়াছেন। কিছুক্ষণ পরামর্শ করিবার পর প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের পত্রের জবাব মুসাবিদা করিলেন। আমরা সকলে তাঁর সাথে একমত হইলাম। চিঠি টাইপ হইল। তাতে বলা হইল, প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট ডাকুন। পার্লামেন্টের মোকাবিলা না করিয়া প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিতে পারিবেন না। প্রেসিডেন্টের কাছে এই পত্র পাঠান হইল। সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্যও দেওয়া হইল।
পরদিন রিপাবলিকান বন্ধুরা বলিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর জবাবটা খবরের কাগযে দিয়া সর্বনাশ করিয়া ফেলিয়াছেন; নইলে একটা আপোস-রফা হইতে পারিত। এখন আর তার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু আমরা বুঝিলাম ওটা বাজে কথা। পশ্চিমারা জোট বাঁধিয়াছেন। কিছুতেই সুহরাওয়ার্দী সাহেবের প্রাধান্য মানিবেন না। আমরা আভাস পাইয়াছিলাম আগের রাত্রেই। লিডার সত্য-সত্যই গুরমানী-দণ্ডলতানা গ্রুপের উপর রসা করিতেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলাপে বুঝিলাম, তিনি গতরাত্রের ঐ চিঠির পরে সত্যসত্যই প্রেসিডেন্টের কাছে পদত্যাগপত্র দিয়াছেন। এ সম্বন্ধে বেশী ঘাটাঘাটি করিতে আমাদের মানা করিলেন। আমাকে গোপনে বলিলেন, ঐ পদত্যাগপত্রে কিছু ক্ষতি হয় নাই। কুদ্ধ রিপাবলিকানদের মোকাবিলায় প্রেসিডেন্টের হাত শক্ত করিবার। জন্যই তিনি তা করিয়াছেন। তাঁর কথায় বুঝিলাম, প্রেসিডেন্ট তাঁকে বুঝাইয়াছেন, ঐ পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা মানেই মুসলিম লীগর্কে মন্ত্রিসভা গঠন করিতে আহ্বান করা। মুসলিম লীগ মানেই গুরমানী দওলতানা। ‘তোমরা যদি তাই চাও, আমি তাই করিব। প্রেসিডেন্টের এই কথা শুনামাত্র রিপাবলিকানরা প্রেসিডেন্টকে এবং প্রয়োজন হইলে শহীদ সাহেবকে খোশামূদ করিয়া শহীদ সাহেবের মন্ত্রিসভা বজায় রাখবেন।
লিডারের যুক্তি ও পন্থাটা আমার খুব না পসন্দ না হইলেও আমি ওটা বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। কিন্তু দেখিলাম লিডার মির্যার এই আশ্বাসে খুবই বিশ্বাস করিয়াছেন। এতটা বিশ্বাস করিয়াছেন যে তিনি ইতিমধ্যে পোর্ট ফলিও রদ-বদল করিবার চিন্তা, হয়ত বা, আলোচনাও শুরু করিয়াছেন। এমনকি আমাকে শিল্প বাণিজ্যের বদলে ফাইন্যান্স দিলে কেমন হয়, তাও জিগাসা করিলেন। লিডারের শিশুসুলভ সরলতায় দুঃখিত হইলাম। কিন্তু তাঁর আত্মবিশ্বাস দেখিয়া সাহসও পাইলাম। আমি জানিতাম পশ্চিমা সওদাগর-শিল্পপতিদের ঘা কোথায়। বলিলাম : আপনার মন্ত্রিসভার স্থায়িত্বের জন্য পোর্টফলিও কেন আমি মন্ত্রিত্বও ত্যাগ করিতে পারি। সেজন্য আপনি কোনও ভাবনা করিবেন না। কিন্তু কথা এই যে আমি ফাইন্যান্সের জানি কি? লিডাব্রে তাঁর স্বাভাবিক শ্রুতিকটু কিন্তু ধারাল রসিকতায় বলিলেন : ওহহ, যেন মন্ত্রিত্ব নিবার আগে তুমি শিল্প-বাণিজ্যের একটা এক্সপার্ট ছিলে। মাথায় পড়িলে সবই তুমি পারিবে। তাছাড়া আমি আছি তা ধরিয়া নিলাম পোর্টফলিও রদ-বদলের শর্তে লিডার ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকানদের সাথে রফা করিয়াই ফেলিয়াছেন। খুশীই হইলাম। যে কোনও মূল্যে আগামী ইলেকশন পর্যন্ত শহীদ মন্ত্রিসভার টিকিয়া থাকা দরকার। সেই দরকার মন্ত্রিসভায় থাকিয়া ইলেকশনে সুবিধা করিবার উদ্দেশ্যে নয়। কারণ সে রকম সুবিধায় আমি কোনও দিনই বিশ্বাসী ছিলাম না। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের অবস্থা দেখিয়া আরও অনেকের সে বিশ্বাস বদলাইয়াছে। তবু যে আমি সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত শহীদ মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব সারা অন্তর দিয়া কামনা করিতাম, তা শুধু নির্বাচন-প্রথার জন্য। অনেক কষ্টে আমরা যুক্ত নির্বাচন প্রথার আইনটি পাস করিয়াছি। শহীদ মন্ত্রিসভার পতনের সাথে-সাথে যুক্ত নির্বাচন-প্রথা বাতিল হইবে, এ সম্পর্কে আমার আশংকার মধ্যে কোনও ফাঁক ছিল না।
কিন্তু আমার আশংকাই সত্যে পরিণত হইল সন্ধ্যার দিকে। প্রেসিডেন্টের দফতর হইতে পত্র আসিল তিনি প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেবের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করিয়াছেন এবং নয়া মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত আগের মতই কাজ চালাইয়া যাইতে বলিয়াছেন। লিডার চিরকালের ‘অসংশোধনীয় আশাবাদী। মির্যা তাঁর সাথে চালাকি করিতেছেন এটা তিনি তখনও বিশ্বাস করিলেন না। করিলেও আমাদেরে জানিতে দিলেন না। বিশেষতঃ চুন্দ্রিগড়-দওলানা সকালে-বিকালে লিডারের সাথে যোগাযোগ করিয়া তাঁর মনের ধারণা আরও দৃঢ় করিতে লাগিলেন। বস্তুতঃ এক সন্ধ্যায় লিডার আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। চুন্দ্রিগড় ও দওলতানা আসিবার কথা। বুঝিলাম, লিডার নাহক আশা করিতেছেন না। সন্ধ্যা আসিল, গেল। রাতও আসিল। কিন্তু চুন্দ্রিগড়-দণ্ডলতানা আসিলেন না। অগত্যা লিডারই টেলিফোন করিলেন। কয়েকবার। শেষে যখন তাঁদেরে পাওয়া গেল, তখন তাঁরা বলিলেন, এই আসিতেছেন। আশা করিলাম নিজেদের মধ্যে কথা একদম ফাইনাল করিয়াই আসিতেছেন। ভালই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা আসিলেন না। বোধ হয় পরের দিনের কথা বলিলেন। লিডার আমাকে বলিলেন : ‘আজ যাও, কাল খবর দিব।
লিডার আর খবর দিলেন না। তবু প্রতিদিনই যাইতে থাকিলাম। প্রধানমন্ত্রীর অনেকগুলি দফতর। তাছাড়া প্রায় সব দফতরের কতকগুলি ফাঁইলে প্রধানমন্ত্রীর ‘এপ্রুভাল’ দরকার। সেগুলিও জমিয়াছিল। প্রধানমন্ত্রী সে সব ফাঁইলের গাদা লইয়া বসিলেন। আমি ব্যাপার অনুমান করিলাম। তাছাড়া লিডারও বলিলেন : ফাইল জমা থাকিলে ডিসপোযসব করিয়া ফেল। এসব ইশারা বুঝিতে বেশী আকেলমন্দ লাগে না। কিন্তু আমার ফাইল বড়-একটা জমা হইত না। সাধ্যমত ঠিক সময়ে ফাইল ডিসপোয-অব করা আমার অভ্যাস। একরূপ বাতিকও বলিতে পারেন। মুত্তাকী মাযী মানুষ যেমন মাযের ওয়াক্ত হইলে নমায় না পড়া পর্যন্ত একটা বেচায়নি বোধ করেন, আমার ছিল তেমনি অভ্যাস। ফাইল পড়িয়া থাকিলে আমার গায় যেন সূড় সূড়ি লাগিত। কোনও অফিসার যদি বলিতেন : সার, আমার ফাইলটা আজও আপনার টেবিলে পড়িয়া আছে, তবে তখন আমি লজ্জা পাইতাম। আমার দুইজন প্রাইভেট সেক্রেটারি ছিলেন, দুই দফতরের জন্য। দুই জনই পুরান অভিজ্ঞ ও অফিসার শ্রেণীর দক্ষ সেক্রেটারি ছিলেন। তাঁরা তৎপরতার সংগে বিভাগীয় প্রতিযোগিতার ভিত্তিতেই যেন যাঁর-তাঁর দফতরের ফাইল ডিসপোষ করাইতেন। ফেলিয়া রাখার উপায় ছিল না। টুওরে থাকিবার সময়ও রাত্রে এবং ট্রেনে-ভ্রমণের সময় সেলুনে এরা ফাইল নিয়া হাযির। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর ইশারার উত্তরে আমি বিশেষ ব্যস্ত হইলাম না। তবু কয়দিন নিয়মিত সময়ের বেশী সময় কাজ করিতে লাগিলাম।