ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক
উপাধ্যায় চার
১. ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমন
এমনি অবস্থায় ১৫ই মার্চ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন। সে আসাটাও ছিল শেখ মুজিবের অনুমতিসাপেক্ষ। তিনি ১২ই মার্চ পিণ্ডি হইতে করাচি আসিয়া যেন শেখ মুজিবের অনুমতির অপেক্ষাই করিতেছিলেন। ১৩ই মার্চ ন্যাপ নেতা খান আবদুল ওয়ালী খ শেখ মুজিবের সাথে তাঁর ধানমণ্ডির বাসভবনে অনেকক্ষণ আলোচনা করেন। এরপর শেখ মুজিব রিপোর্টারদেরে বলেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা আসিলে তিনির সাথে আলোচনায় বসিতে রাযী আছেন। ধরিয়া নেওয়া যাইতে পারে মুজিব-ওয়ালী আলোচনার এটাও একটা বিষয় ছিল। শেখ মুজিব এমন একটা কিছু বলুন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ইচ্ছাও বোধ হয় তাই ছিল। শেখ মুজিবের এই ঘোষণায় তাঁর দিক হইতে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই পরিষ্কার হইয়াছিল। তবু কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অভিপ্রায় কিছুই বোঝা যাইতেছিল না। ১৫ই মার্চ বেলা অপরাহ্ন আড়াইটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের আগে পর্যন্ত রেডিও পাকিস্তানে বা সংবাদ-এজেন্সির তরফ হইতে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয় নাই। কাজেই বোঝা যায়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমনটা গোপন রাখাই সরকারের ইচ্ছা ছিল। ফলে জনসাধারণ এ বিষয়ে কিছুই জানিতে পারে নাই। এয়ার পোর্ট হইতে প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত সারা রাস্তায় সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ই.পি.আর, মোতায়েন দেখিয়া যা কিছু অনুমান করা গিয়াছিল মাত্র।
যা হোক বেলা আড়াইটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা পৌঁছিলেন। তাঁর সাথে আসিলেন প্রধান সেনাপতি জেনারেল আবদুল হামিদ, পীরযাদা ও গুলহাসান প্রভৃতি আরো কয়জন জেনারেল। এদের সংগে আসিলেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি জাস্টিস এ, আর, কর্নেলিয়াসও। তিনি তৎকালে প্রেসিডেন্টের আইনমন্ত্রীও ছিলেন।
এয়ারপোর্টে প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা করিতে গবর্নর লেঃ জেনারেল টিক্কা খান ও আরও কতিপয় সামরিক-অসামরিক অফিসার ছাড়া আর কেউ যান নাই। প্রেসিডেন্ট এয়ারপোর্ট সমবেত রিপোর্টারদের এড়াইয়া সোজা প্রেসিডেন্ট ভবনে চলিয়া যান। প্রেসিডেন্ট ভবনে সাংবাদিকরা তাঁর সাথে দেখা করিতে চাহিলে প্রেসিডেন্ট তাতেও অসম্মত হন। প্রেসিডেন্টের পি. আর, ও, সাংবাদিকদের আরও বলেন যে, প্রেসিডেন্ট কতদিন ঢাকায় থাকিবেন, কবে ফিরিয়া যাইবেন, তাও তিনি বলিতে পারিবেন না। মোট কথা, সমস্ত ব্যাপারটাই ছিল ঢাকৃঢাক ঘুরঘুর অবস্থা। তবে প্রেসিডেন্ট আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সংগে সাক্ষাত করিবেন কিনা, এই প্রশ্নের উত্তরে প্রেসিডেন্টের পি, আর, ও, সাংবাদিকদেরে স্মরণ করাইয়া দিলেন যে, প্রেসিডেন্ট গত জানুয়ারি মাসের ১১ই ও ১২ই তারিখে আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। পি. আর, ও, বোধ হয় পরোক্ষভাবে বলিতে চাহিয়াছিলেন যে প্রেসিডেন্ট আওয়ামী, নেতৃবৃন্দের সাথে কথাবার্তা বলিতেই আসিয়াছেন। কিন্তু এই সহজ কথাটাই সোজাভাবে বলিতে পারেন নাই। সব অবস্থা এমনই অনিশ্চিত ছিল। ১১ই ও ১২ই জানুয়ারি সত্যসত্যই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সাথে কথাবার্তা বলিয়াছিলেন : প্রথম দিনের সাক্ষাতটা ছিল ইয়াহিয়া-মুজিবের মধ্যকার একান্ত ব্যক্তিগত মোলাকাত। কারও পক্ষে কোন সহযোগী ছিলেন না। দ্বিতীয় দিনের মোলাকাতে শেখ মুজিবের সংগে ছিলেন তাঁর প্রথম কাতারের সহকর্মীদের মধ্যে সৈয়দ নযরুল ইসলাম, তাজুদ্দিন আহমদ, খোন্দকার মুশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মনসুর আলী, এ, এইচ, এম কামরুজ্জামান। প্রেসিডেন্টের সহযোগী ছিলেন লেঃ জেঃ পীরযাদা ও পূর্ব-পাকিস্তানের তৎকালিন গবর্নর ভাইস-এডমিরাল আহসান। সে আলোচনা সন্তোষজনক হইয়াছিল বলিয়া তৎকালে জানান হইয়াছিল।
২. বৈঠক শুরু
সংবাদপত্র রিপোর্টাররা তথা জনসাধারণ আগে হইতে কিছু জানিতে না পারিলেও পরদিন ১৬ই মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও আওয়ামী নেতৃবৃন্দের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। প্রথম দিনের বৈঠক ১৫০ মিনিট স্থায়ী হয়। উভয় পক্ষেই কয়েকজন করিয়া সহকারী ছিলেন। দ্বিতীয় দিনের (১৭ই মার্চ) বৈঠকও ১৫০ মিনিট স্থায়ী হয়। এই দিনের বৈঠক ছিল একান্ত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বা শেখ মুজিবের সাথে কোনও সহকারী ছিলেন না। তবে দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে যোগদানের আগে শেখ সাহেব তাঁর প্রথম কাতারের নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করিয়া গিয়াছিলেন।
এই বৈঠক চলে বিরতিহীনভাবে ২০শে মার্চ পর্যন্ত। দুই পক্ষ হইতে যুক্তভাবে কি কোনও পক্ষ হইতে এককভাবে এইসব আলোচনার বিষয়বস্তু বা আলোচনার ধারার বিষয়ে কোনও বিবৃতি বাহির হয় নাই। কিন্তু সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিব নিজে, কখনও তাঁর সহকর্মীদের কেউ-কেউ, বলিয়াছেন : আলোচনায় অগ্রগতি হইতেছে।
এই মুদ্দতের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক নেতা শেখ মুজিবের সাথে তাঁর বাড়িতে দেখা-সাক্ষাত ও আলোচনা করেন। এঁদের মধ্যে ন্যাপ নেতা আবদুল ওয়ালী খা মুসলিম লীগের নেতা মমতাজ দণ্ডলতানা, জমিয়তে-ওলামার নেতা মুফতি মাহমুদ প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এদের সংগে শেখ মুজিবের কি আলোচনা হইয়াছে, তা প্রকাশ নাই।
৩. বৈঠক ব্যর্থ
তবে এই আলোচনা চলিতে থাকাকালেই ২১শে মার্চ তারিখে স্টুডেন্টস্ অ্যাকশন কমিটি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এই আপিল করেন যে ২৩শে মার্চকে বরাবরের মত ‘পাকিস্তান-দিবস’ রূপে পালন না করিয়া প্রতিরোধ দিবস উদযাপন করিতে হইবে এবং পাকিস্তান নিশানের বদলে স্বাধীন বাংলাদেশ পতাকা উত্তোলন করিতে হইবে। বলা আবশ্যক যে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা’ রূপে একটি পতাকা একদল ছাত্র ইতিমধ্যেই চালু করিয়াছিল। ৭ই মার্চের ঘৌড়দৌড় মাঠের সভায় এই পতাকা অনেক দেখা গিয়াছিল। শেখ মুজিবকে দিয়া এই পতাকা উড়াইবার মানে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করিবার খুব জোর চেষ্টা হইয়াছিল। শেখ মুজিব বুদ্ধিমত্তার সাথে এই চেষ্টা প্রতিহত করেন।
এ অবস্থায় ২১শে মার্চ (বুধবার) ছাত্র-সংগ্রাম কমিটির ঐ ঘোষণায় অনেকেই বিভ্রান্ত হইয়াছিলেন। অনেকেই ধরিয়া নিয়াছিলেন যে, ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক ব্যর্থ হইতে যাইতেছে। একদিকে শেখ মুজিবসহ আওয়ামী নেতৃবৃন্দ বলিতেছেন আলোচনার অগ্রগতি হইতেছে, অপর দিকে আওয়ামী লীগের ছাত্রফ্রন্ট বলিতেছেন, ‘স্বাধীন বাংলা পতাকা উড়াইতে এবং পাকিস্তান দিবস’ পালন না করিতে। এটা স্পষ্টতঃ অনেকের জন্যই বিভ্রান্তিকর ছিল। কিন্তু আমার মত অনেক বুদ্ধিমান এই বলিয়া ও ভাবিয়া সান্ত্বনা পাইয়াছিলেন যে, আলোচনায় প্রেসিডেন্ট ও পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতাদেরে চাপ দিবার উদ্দেশ্যেই আওয়ামী নেতারা ছাত্রদেরে দিয়া ওটা করাইতেছেন। আসলে ওটা স্বাধীনতা-টাধীনতা কিছু নয়।
২১শে মার্চ ঘটনার বা দুর্ঘটনার আরও উন্নতি বা অবনতি হয়। পনর জন সহকর্মী লইয়া পিপলস পার্টির নেতা যুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা আসেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ডাকেই তিনি আসিয়াছেন।
ঐ দিন তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে দেখা করেন। শেখ মুজিবও ঐদিন প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করেন। কিন্তু দুইজনই আলাদাভাবে।
৪. পরিষদ আবার মুলতবি
পরদিন সোমবার (২২শে মার্চ) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, শেখ মুজিব ও মিঃ ভুট্টোর মধ্যে সাক্ষাৎকার হয়। এর পর ২৩শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ভবন হইতে এক ঘোষণায় বলা হয় যে, ২৫শে মার্চ পরিষদের যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হইল। পরিষদ-বৈঠক স্থগিতের এই ঘোষণা শেখ মুজিবের সম্মতিক্রমে হইয়াছিল বলিয়া ঘোষণায় দাবি করা হইয়াছিল।
শেখ মুজিব বা আওয়ামী লীগের তরফ হইতে এই স্থগিতের ঘোষণার কোন প্রতিবাদ করা হয় নাই। শেখ মুজিব ও মিঃ ভুট্রোর সহিত আলোচনার পরপরই প্রেসিডেন্ট এই ঘোষণা করায় যুক্তিসংগতভাবেই সকলেরই এই ধারণা হইয়াছিল যে, শেখ সাহেবের সম্মতিক্রমেই এটা ঘটিয়াছিল। প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় প্রকৃত অবস্থাই বলা হইয়াছে।
এই কারণে এই ঘোষণা প্রকাশের সাথে-সাথেই আমার মনে হইয়াছিল যে শেখ মুজিব শুধু চালে ভুল করেন নাই, তিনি ইয়াহিয়া-ভুট্রোর পাতা ফাঁদে পা দিলেন। বাস্তবিক পক্ষে আসন্ন পরিষদ-বৈঠকই ছিল শেখ মুজিবের হাতের প্রধান হাতিয়ার। এটা কি করিয়া তিনি বিরুদ্ধ পক্ষের হাতে তুলিয়া দিলেন, একথা আমি তখনও বুঝি নাই, আজও বুঝিতে পারি নাই।
বস্তুতঃ মুজিবের আন্তরিক শুভানুধ্যায়ী ও সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও, বরঞ্চ এই কারণেই, মুজিব-চরিত্রের এই দিকটা আমাকে পীড়া দিয়াছে। ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ না করিয়া বরঞ্চ ঘটনার দ্বারাই তিনি নিয়ন্ত্রিত হইয়াছেন বেশি। মুজিব অক্লান্ত পরিশ্রমী, দুর্জয় সাহসী ও দক্ষ সংগঠক হওয়া সত্ত্বেও দরকারের সময় সিদ্ধান্ত নিতে তিনি দ্বিধা করিয়াছেন। এই দ্বিধার সুযোগে ঘটনা নিজের গতিতে বা অন্য কোন অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হইয়াছে। তাতেও মুজিবের দৃশ্যমান কোন ক্ষতি হয় নাই। দৃশ্যতঃ মুজিব কোনও কাজে অসফল হন নাই। কিন্তু তাঁর সবগুলো সাফল্যই চান্স বা ঘটনাচক্রের দান। এ বিষয়ে আমার জানা সব রাজনৈতিক নেতার মধ্যে শেখ মুজিবই সবচেয়ে ভাগ্যবান। শত্রু-মিত্র, পক্ষ-বিপক্ষ প্রকৃতি-পরিবেশ সবাই যেন মুজিবের অনুকূলে ষড়যন্ত্র করিয়াই বিভিন্ন দিকে ভিন্ন-ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছেন। যিনি যাই করিয়া থাকুন, পক্ষেই করিয়া থাকুন, আর বিপক্ষেই করিয়া থাকুন, সব গিয়া যোগ হইয়াছে মুজিবের জমার খাতায়। এতে নিঃসন্দেহে লাভ হইয়াছে প্রচুর। কিন্তু লোকসান হইয়াছে তার চেয়ে বেশি। তফাত শুধু এই যে, লাভটা দৃষ্টিগোচর, আর লোকসানটা অদৃশ্য। উভয়টাই আপাত। ভাগ্য তাঁর পক্ষে, অগণিত ঘটনায় তা প্রমাণিত হইয়াছে। তাঁর ধারণাও সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। সে বিশ্বাসের কথা তিনি একাধিকবার সগৌরবে প্রকাশও করিয়াছেন। এই বিশ্বাসেই তিনি তাঁর ভাগ্যকে, তথা ঘটনাকে, নিজের কাজে লাগাইবার বদলে ঘটনা-স্রোতে গা ভাসাইয়া দিয়াছেন। আলোচ্য ঘটনা এই দিককার সব চেয়ে বড় নযিরের একটি।
সকলেরই মনে থাকিবার কথা, ৩রা মার্চ তারিখে ঢাকায় ন্যাশনাল এসেমরির বৈঠক বসিবে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই ঘোষণার পর হইতেই পশ্চিমা পাকিস্তানের বিভিন্ন পার্টির নেতারা ঢাকায় আসিয়া শেখ মুজিবের সাথে দেখা করিতে, ও তাঁকে সমর্থনের আশ্বাস দিতে শুরু করেন। আর পশ্চিম পাকিস্তানী এম, এন, এ.-রা পি, আই. এ.র ঢাকার টিকিট কিনিতে শুরু করেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারি মিঃ ভুট্টো পেশোয়ার হইতে ঢাকার বৈঠক বয়কট করার হুমকি দেওয়ার পরও পশ্চিম-পাকিস্তানী মেম্বরদের ঢাকার টিকিট কিনার এই হিড়িক অব্যাহত থাকে। এটা সংবাদপত্রে প্রকাশিত সত্য যে, ভুট্রোর হুমকির পরও ৭৭ জন পশ্চিম-পাকিস্তানী এম. এন. এ. ঢাকার বৈঠকে যোগদানে আগ্রহী ছিলেন। পিপলস পার্টি ছাড়া আর সব পার্টি-নেতারাই ভুট্টোর এই হুমকির নিন্দা করিয়াছিলেন। খোদ পিপল্স পার্টিরও কতিপয় মেম্বর তাই করিয়াছিলেন। পশ্চিম-পাকিস্তানের মোট এম. এন. এ. সংখ্যা ১৪৪ জনের মধ্যে ৮৫ জনই পিপলস পার্টির। অবশিষ্ট ৫৯ জনই শুধু অন্য পার্টির। ঢাকা-যাত্রী মেম্বর সংখ্যা ৭৭ জন হওয়ায় স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, অন্ততঃ ১৮ জন পিপল্স পার্টির এম. এন. এ. মিঃ ভুট্টোর নির্দেশ অমান্য করিয়াই ঢাকা বৈঠকে যোগদানে ইচ্ছ ছিলেন।
এটা পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে খুবই স্বাভাবিক। শেখ মুজিব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে একক ক্লিয়ার মেজরিটি পার্টির নেতা। কিন্তু তাঁর এই একক মেজরিটিতে পশ্চিম-পাকিস্তানের কোনও মেম্বর না থাকায় তিনি পশ্চিম-পাকিস্তানের যেকোনও পার্টির সহিত কোয়ালিশন করিয়া স্থায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব চালাইতে পারেন, এটা সকলের নিকট সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। তাই শেখ মুজিবের সমর্থন লাভের জন্য প্রতিযোগিতা লাগিয়া গেল। শুধু মন্ত্রিত্বের লোভের কথা নয়। মন্ত্রিত্বে শরিক হইতে পারিলে দলগত সুবিধাও আপনিই হইবে, এটাও সকলের জানা কথা। মিঃ ভুট্টো পশ্চিম-পাকিস্তানের রাজনীতিতে নবাগত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভটা তাঁর একান্তই আকস্মিক সৌভাগ্য। মিঃ ভুট্টোর এই আকস্মিক বিজয়ে মিঃ মমতাজ দওলতানা, মিঃ ওয়ালী খাঁ, মওলানা মওদুদী প্রভৃতি পশ্চিম-পাকিস্তানী প্রবীণ নেতারা নিশ্চয়ই খুবই বিস্মিত, দুঃখিত ও লজ্জিত হইয়াছিলেন। এটাকে নিতান্ত সাময়িক দুর্ঘটনা বলিয়াও তাঁরা মনে করিয়াছিলেন। পূর্ব-পাকিস্তানের একক নেতা শেখ মুজিবের সমর্থনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ঢুকিতে পারিলে অল্পদিনেই তাঁরা এই সাময়িক পরাজয় পাড়ি দিতে পারিবেন, এমন আশা তাঁরা নিশ্চয়ই করিয়াছিলেন। এই আশায় তাঁরা ছয়-দফা-ভিত্তিক শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনায়ও রাযী হইতেন। আসলে ‘ছয়-দফা’ যে পাকিস্তানের সংহতি-বিরোধী ছিল না, এ বিষয়ে ইয়াহিয়া ভুট্টো, দওলতানা-ওয়ালী খাঁ, মওদুদী-মাহমুদ সবাই একমত ছিলেন। ছয়-দফার জন্য যে মুজিব ভুট্টো-ইয়াহিয়া আলোচনা ভাংগে নাই, সত্য কথা এই যে আপোস আলোচনা মোটেই ভাংগে নাই, ২৫শে মার্চের হামলা যে সম্পূর্ণ অন্য কারণে হইয়াছিল, সে কথার বিস্তারিত আলোচনা অন্যত্র করিয়াছি। এখানে এ বিষয়টার উল্লেখ করিলাম এই জন্য যে, ছয়-দফা-ভিত্তিক সংবিধান রচনায় শেখ মুজিবের সমর্থন করিতে পশ্চিম-পাকিস্তানের অন্য সব পার্টিই রাযী হইতেন। পশ্চিম পাকিস্তানের সুস্পষ্ট মেজরিটি দল পিপলস পার্টিকে বাদ দিয়া পাকিস্তানের সংবিধান রচনা রাজনৈতিক বা ন্যায়নৈতিক দিক হইতে ঠিক হইত কি না, সেটা আলাদা কথা। কিন্তু পিপলস পার্টিকে বাদ দিয়া অন্য যে-কোনও বা সব পার্টিকে লইয়া মন্ত্রিত্ব গঠন যে কোনও দিক হইতেই শেখ মুজিবের পক্ষে অন্যায় হইত না, এ বিষয়ে কোনও তর্কের অবকাশ নাই। শেখ মুজিবের মত সংগ্রামী ও অভিজ্ঞ নেতা এ ব্যাপারে কোনও ভূল করিতে পারেন না, এ বিশ্বাসেই পশ্চিম-পাকিস্তানের অন্যান্য সব পার্টিসমূহের নেতারা সদলবলে শেখ মুজিবের এমন জোর সমর্থন দিয়াছিলেন।
ইয়াহিয়া-ভুট্রোর স্তোক বাক্যে বা চাপে শেখ মুজিব পরিষদের বৈঠক পুনরায় মুলতবি করেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী এম. এন. এ.-দের পৃথক-পৃথক অধিবেশনে রাযী হওয়াতেই ঐসব পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতার স্বপ্নভংগ হইল। শেখ মুজিবের সহায়তায় তাঁদের হারানো নেতৃত্ব পুনরুদ্ধারের আশা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হইল। তার উপর পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানে পৃথক-পৃথকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে শেখ মুজিব রাযী হওয়ায় পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতারা স্পষ্টই বুঝিলেন, শেখ মুজিব গোটা পাকিস্তানের নেতৃত্বে নিজ হাতে না রাখিয়া পশ্চিম-পাকিস্তানের নেতৃত্ব ভুট্টোর হাতে ছাড়িয়া দিয়াছেন।
পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতারা সম্পূর্ণ নিরাশ হইয়া দেশে ফিরিয়া গেলেন এবং একেবারেই নীরব ও নিরুৎসাহ হইয়া গেলেন। নির্বাচনে একটি সীটও না পাইয়া শেখ মুজিব সেখানে যে শক্তির অধিকারী হইয়াছিলেন, এভাবে তা হাতছাড়া হওয়ায় অতঃপর শেখ মুজিবের ভাগ্য সম্পূর্ণভাবে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর হাতে ন্যস্ত হইয়া গেল। আমি সেদিনও বিশ্বাস করিতাম এবং আজও করি যে, পশ্চিম-পাকিস্তানের ঐসব নেতা শেখ মুজিবের সমর্থক থাকিলে ২৫শে মার্চের ঐ নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক মূঢ়তা সংঘটিত হইত না।
২৩শে মার্চ ছুটির দিন বলিয়া কোনও বৈঠক হয় নাই। যা হোক, ২৪শে মার্চও প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগের তিনজন নেতা জনাব সৈয়দ নয়রুল ইসলাম, জনাব তাজুদ্দিন আহমদ ও ডাঃ কামাল হুসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের সংগে সাক্ষাৎ করেন। এই বৈঠক সম্পর্কে ২৫শে মার্চের দৈনিক খবরের কাগযে আওয়ামী লীগের তরফে এইরূপ সংবাদ বাহির হয়?
আওয়ামী লীগ নেতৃবৰ্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য বংগবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে মূলনীতি সংক্রান্ত যে সমঝোতা হইয়াছে, তদনুযায়ী বিশদ পরিকল্পনা গতকাল বুধবার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে পেশ করিয়াছেন। বৈঠক শেষে জনাব তাজুদ্দিন আহমদ জানাইয়াছেন যে, বংগবন্ধুর সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর মূলনীতি সংক্রান্ত যে মতৈক্য হইয়াছে, তদনুযায়ী তাঁরা গতকাল উপদেষ্টাদের কাছে বিশদ পরিকল্পনা পূর্ণাংগভাবে পেশ করিয়াছেন। পরিস্থিতির যাতে আরও অবনতি না ঘটে, তার জন্য আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদেরে বিল-নীতি পরিহার করার আহবান জানাইয়াছেন। তাঁরা জানাইয়াছেন যে, আওয়ামী লীগের ফরমূলা পুরাপুরি পেশ করা হইয়াছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘোষণার প্রতীক্ষা করিতেছেন।
৫. পাক-বাহিনীর হামলা
এই পরিবেশে ২৫শে মার্চের রাত সাড়ে এগারটায় পাক-বাহিনী হামলা করে। হামলাটা ছিল স্পষ্টতই আকস্মিক। নেতৃবৃন্সমধ্যে আলোচনা চলিতে থাকা অবস্থায় এমন আকখিক সামরিক হামলা হওয়াতে অনেকেই মনে করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও তাঁর সংগীদের আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনাটা ছিলনিতান্তই লোক-দেখানো ব্যাপার। দস্তুরমত শয়তানি। সামরিক প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে তাঁরা সময় নিতেছিলেন মাত্র।
যাঁরা এমন মনে করেন বা বলেন, তাঁদের পক্ষে অবশ্য এটা অনুমান মাত্র। কিন্তু এই অনুমান সমর্থিত হইয়াছে সরকারী কথার দ্বারা। পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ৫ই আগষ্ট তারিখে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ হইতে ‘ইস্ট পাকিস্তান ক্রাইসেস : হোয়াট হাপেড’ শীর্ষক একটি হোয়াইট পেপার বাহির হয়। এটি একটি বড় আকারের পুস্তক। এই পুস্তকে বলা হয় যে, ২৫/২৬ মার্চের মধ্যরাত্রির পরে আওয়ামী লীগ সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণা করিবার জন্য দিন ক্ষণ (যিরো আওয়ার নির্বাচিত করিয়াছিল। স্পষ্টতই ২৫শে মার্চের মধ্যরাত্রের আগেই সামরিক হামলার যুক্তিযুক্ততার সমর্থনেই পাকিস্তান সরকার এই ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উথাপন করিয়াছেন। এই হোয়াইট পেপারে দাবি করা হইয়াছে যে, আলোচনা চলাকালেই সরকার এই ষড়যন্ত্রের কথা সুস্পষ্টভাবে জানিতে পারিয়াছিলেন। যে সব প্রমাণ সরকার পাইয়াছিলেন, হোয়াইট পেপারে তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। সে সব প্রমাণে বিশ্বাস স্থাপন করিলেখীকার করিতেই হইবে যে ২৫শে মার্চের রাত্রিবেলার হামলাটা ছিল নিছক একটা ডিফেসিত মুভ। যুক্তিটা এই? ‘ওরাই আক্রমণ করিতে চাহিয়াছিল। তাই আমরাই আগে হামলা করিয়া তাদের অসদুদ্দেশ্য ব্যর্থ করিয়া দিলাম।‘ কথাটা তথ্য হিসাবে কতদুর সত্য, তার বিচারে তদন্ত দরকার। কিন্তু যুক্তি হিসাবে কথাটা কতটা টেকসই, তার বিচার এখনিরা চলে।
‘ওরা ও আমরা’ পক্ষ দুইটা এখানে আওয়ামী লীগ ও সরকার। আওয়ামী লীগ পার্টি সাম্প্রতিক নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দল। আর সরকার মিলিটারি বুরোক্রাসি সমর্থিত বিপুল ও অসাধারণ শক্তিশালী গবর্নমেন্ট। এই দুই পক্ষের মধ্যে সামরিক কায়দায় অফেনসিডিপেনসি স্ট্যাটিজির কথা সরকারের মাথায় ঢুকাটা নিতান্তই অদ্ভুত ও অসাধারণ। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী মেজরিটি পার্টি হইলেও তখনও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। কাজেই এ এই বিরোধের দুই পক্ষকে দুইটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরোধ বলা চলে না। পূর্ব-পাকিস্তানে নির্বাচন-বিজয়ী দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইবার পরও কেন্দ্রীয় সরকারের বিবেচনায় তাঁরা বেয়াড়া প্রতীয়মান হইলে তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করিয়া কেন্দ্রীয় শাসন প্রবর্তন একাধিকবার করা হইয়াছে। শেরে-বাংলা ফযলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে একটি ব্যালটবাক্স বিপ্লব আখ্যায়িত করা হইয়াছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের মর্যাদায় ওটা একটা চরম আঘাতও বিবেচিত হইয়াছিল। প্রতিশোধ স্বরূপ কেন্দ্রীয় সরকার হক মন্ত্রিসভাকে এবং স্বয়ং হক সাহেবকে পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতার যদুকারী দেশদ্রোহী অভিহিত করিয়াছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক শেরে-বাংলাকে গৃহবন্দী করা হইয়াছিল এবং অন্যতম মন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করা হইয়াছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশেই এ সব কাজ করা হইয়াছিল বটে, কিন্তু হাতে-কলমে তা করিয়াছিলেন প্রাদেশিক সরকারের দেওয়ানী ও পুলিস অফিসাররাই। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এইসব অফিসার মন্ত্রিগণকে মনিব বা বস মানিয়াছিলেন। তাঁদের হুকুমে কাজ করিয়াছিলেন। আর পর মুহূর্তেই কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে বকে গ্রেফতার করিতেও তারা দ্বিধা করেন নাই। কারণ এটাই তাদের ট্রেনিং। নিজস্ব ও ব্যক্তিগত মতামত ও অভিরুচির উর্ধ্বে ও বাহিরে ‘সরকারের’ নির্দেশ পালনই এদের শিক্ষা। সরকার এখানে ইমপার্সনেল অব্যক্তিক একটা ইনস্টিটিউশান, একটা প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রীরা যতক্ষণ ক্ষমতায় থাকেন, ততক্ষণ তাঁরাও কার্যতঃ সরকার। কিন্তু তাঁদেরে সরকারের অংগ বলাই ঠিক। কারণ তাঁদেরে ছাড়াও, তাঁদের বাইরেও, সরকারের অস্তিত্ব আছে এবং সেটাই আসল সরকার। এটা বুরোক্র্যাসি, আমলা। এই অন্ত্র বা শাসনযন্ত্র কাজ করে প্রেসিডেন্ট, গবর্নর, চিফ সেক্রেটারি, হোম সেক্রেটারি, আই, জি, ডি, আই, জি, ডি, সি., এস. পি এই চ্যানেলের মাধ্যমে। এটাই বৃটিশ পার্লামেন্টারি সিস্টেমের ধারা এরা পার্মানেন্ট অফিশিয়াল বা স্থায়ী সরকারী কর্তকর্তা। নির্বাচিত সরকার বা মন্ত্রীরা এদের মাধ্যমে ও সহযোগিতায় সরকার পরিচালনা করেন।
৬. সনাতন নীতির বরখেলাফ
এ বিষয়ে এখানে এত কথা বললাম এ জন্য যে, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ তারিখে পাকিস্তান সরকার পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের মাধ্যমে প্রচলিত নিয়ম ও ধারায় কাজ করেন নাই। পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা প্রেসিডেন্ট। তাঁর অধীনস্ত ও হকুমবরদার গবর্নর। গবর্নরের হকুমবরদার চিফ সেক্রেটারি, হোম সেক্রেটারি, আই. জি, ডি, সি, এস, পি, ইত্যাদি সরকারী অংগ-প্রত্যংগ সবই মওজুদ ছিল ঘটনার দিন। আওয়ামী লীগ নেতারা প্রেসিডেন্টের সাথে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার আঁড়ালে সশস্ত্র বিপ্লবের আয়োজন করিতেছেন, এটা বুঝিতে পারার সংগে সংগেই তাঁদের সবাইকে এবং শহরে উপস্থিত আরও কিছু নেতৃস্থানীয় আওয়ামী লীগারকে গ্রেফতার করিলেই সনাতন প্রচলিত সরকারী নিয়মে কাজ করা হইত। এই গ্রেফতারের প্রতিক্রিয়ায় ছাত্র-তরুণ ও জনগণের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দিলে তারও প্রতিরোধ করার সনাতন পন্থা সরকারের জানা ছিল। শাসনযন্ত্রের মেশিনারি তাতে অভ্যস্ত ছিল। ঐ সনাতন পন্থায় সরকার অগ্রসর হইলে ২৫শে মার্চ ও তার পরে যা যা ঘটিয়াছিল, তাও ঘটিত না। অত-অত লোক-ক্ষয়ও হইত না। শক্তিশালী যালেম শাসক ও নিরস্ত্র মযলুম শাসিতের সম্পর্কের বেলা বরাবর যা হইয়াছে, এখানেও তাই হইত।
কিন্তু ঐ দিনকার পাকিস্তান সরকার ঐ সনাতন শাসক-শাসিতের সনাতন পন্থা গ্রহণ না করিয়া, এমনকি সে চিন্তা না করিয়া, দুই যুধমান শত্রু পক্ষের মনোভাব ও কর্মপন্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। কঠিন বলিয়াই তৎকালীন পাক-সরকার পরবর্তীকালেও উত্তর দিবার চেষ্টা করেন নাই। চেষ্টা করিবার পথও তাঁরাই রুদ্ধ করিয়াছিলেন। কারণ আওয়ামী লীগের নেতা, সরকারের নযরে সবচেয়ে বড় অপরাধী, শেখ মুজিবকেসত্য-সত্যই তাঁরা গ্রেফতার করিয়াছিলেন। শেখ মুজিবও বরাবন্ত্রের মতই বিনা-বাধায় ধরা দিয়াছিলেন। সরকারের কথিত বুধমান প্রতিপক্ষের সেনাপতির মত তিনি আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে কোন বাধাও দেন নাই, আত্মগোপনের চেষ্টাও করেন নাই। এটা কি আক্রমণোদ্যত শত্রুপক্ষের সেনাপতির কাজ? নিশ্চয়ই না। অতএব শেখ মুজিবের ঐ দিনকার আচরণই ‘হোয়াইট পেপারে’ বর্ণিত আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত হামলার অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করিয়াছে।
৭. প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আচরণ
তারপর ধরা যাক, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ২৫শে মার্চের আচরণটা। ঐ দিনকার দৈনিক কাগসমূহে প্রকাশিত খবরে জানা গিয়াছিল যে, আগের সন্ধায় আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁদের চূড়ান্ত বক্তব্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নিকট লিখিতভাবে পেশ করিয়াছেন এবং ২৫শের সন্ধ্যা-তক প্রেসিডেন্টের উত্তরের অপেক্ষা করিতেছেন। প্রেসিডেন্টের জবাব নুকূল হইবে বলিয়াই তাঁরা আশা করিতেছে। কিন্তু ২৫শে মার্চের সন্ধ্যায় বাস্তবে কি ঘটিয়াছিল? রাত আটটার দিকে প্রেসিডেন্টের তরফ হইতে কোনও আহট না পাইয়া আওয়ামী নেতারা জানিতে পারিলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট ভবন ছাড়িয়া ক্যান্টনমেন্টে চলিয়া গিয়াছেন। পরে শুনিতে পাইলেন, তিনি সন্ধ্যা ছয়টার সময়েই করাচির পথে ঢাকা ত্যাগ করিয়াছেন। পরদিন ২৬শে মার্চ পাকিস্তান রেডিওতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আওয়ামী নেতা শেখ মুজিবকে গাল দিয়াও আওয়ামী লীগ বে-আইনী ঘোষণা করিয়া যে অসাধু ও অভদ্র বিবৃতি দিলেন, আওয়ামী লীগ নেতাসহ পূর্ব-পাকিস্তানীরা বিশ্বয়ে সে বক্তৃতা শুনিল এবং বুঝিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সত্য-সত্যই আগের সন্ধ্যায় গোপনে ঢাকা ত্যাগ করিয়াছিলেন। এটা কি একজন হেড-অব-দি-স্টেট ও হেড-অব-দি গবর্নমেন্টের যোগ্য কাজ হইয়াছিল? কেন তিনি নিজের এবং রাষ্ট্রের এমন মর্যাদাহানিকর কাজ করিলেন। যে সব কথা তিনি ২৬শে মার্চের রেডিও পাকিস্তানের ব্রডকাস্টে বলিয়াছিলেন, তার একটা কথাও তিনি ঢাকায় বসিয়া, আলোচনা চলাকালে অথবা আলোচনা শেষে,বলেন নাই। আলোচনাঅচলাবস্থায় আসিয়াছেবাভাংগিয়া যাইতেছে, এমন কোনও আভাসও তিনি বা তাঁর পক্ষে অন্য কেউ দেন নাই। শেখ মুজিবকে ও আওয়ামী লীগকে তিনি যে দেশদ্রোহী এবং সেজন্য যে অনেক আগেই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ ছিল, একথা ঘুণাক্ষরেও তিনি দেশবাসীকে জানিতে দেন নাই। সে সব কথাই কি তিনি ঢাকা রেডিওতে বলিতে পারিতেন না। তিনি কি আওয়ামী লীগ-নেতাদের সামনেই বলিতে পারিতেন না যে, তাঁদের দাবি-দাওয়া পাকিস্তানের অখণ্ডতা-ও স্থায়িত্ব-বিরোধী; অতএব তিনি তা গ্রহণ করিতে পারিলেন না? তিনি ঢাকা বসিয়াই আওয়ামী লীগকে সশস্ত্র ষড়যন্ত্রের দায়ে বে-আইনী ঘোষণা করিতে পারিতেন না? তিনি কি নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে ভয় পাইয়াই এই সাবধানতা অবলম্বন করিয়াছিলেন? সোজা কথায়, তিনি কি ভয়ে ঢাকা হইতে পলাইয়াছিলেন? আমার বিশ্বাস হয় না। আমার বিবেচনায় তিনি ভয়ে পলান নাই, পলাইয়াছিলেন তিনি লজ্জায়। একজন জেনারেল ত দূরের কথা, একজন সামান্য সৈনিকও এমন ভীরু হইতে পারেন, আমার মন তা মানিয়া লইতে পারিতেছে না। তাছাড়া, তিনি যদি নিজের নিরাপত্তা সম্বন্ধেই এত ভয় পাইয়াছিলেন, তবে আর সবার নিরাপত্তার কথা তাঁর মনে পড়ে নাই কেন? সামরিক গবর্নরসহ আরও অনেক কয়জন জেনারেল ও লক্ষাধিক সৈন্য তখনও ঢাকা ও পূর্ব-পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে মোতায়েন ছিলেন। ওঁদের কারও নিরাপত্তার কথা তিনি ভাবেন নাই কেন? কাজেই তিনি ভয়ে নয়, লজ্জায় পলাইয়াছিলেন। ২৬শে মার্চের বক্তৃতায় তিনি যেসব উক্তি করিয়াছিলেন, আওয়ামী নেতাদের মুখামুখি মোকাবেলায় তিনি সেসব কথা বলিতে পারিতেন না। জঘন্য অপরাধী মন লইয়া কারও মুখামুখি ওসব কথা বলা যায় না। রেডিওই ঐ ধরনের উক্তির উপযুক্ত মিডিয়াম। কথার মর্ম যাই হোক, আর যে মাধ্যমইে কথাগুলো বলা হোক, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কথায় ও আচরণে স্পষ্টতঃই প্রমাণিত হইয়াছে যে, আওয়ামী লীগের সহিত আলোচনা ব্যর্থ হইবার এবং ফলে পাকিস্তান দুই টুকরা করিবার মূল দায়িত্ব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার, আওয়ামী লীগের নয়।
৮. মিথ্যা অভিযোগ
আওয়ামী লীগকে দোষী সাব্যস্ত করিবার জন্য পরবর্তীকালের ৫ই আগস্ট) ‘হোয়াইট পেপারে’ আরো অনেক কথা বলা হইয়াছিল। তার মধ্যে প্রধান কথাটা এই যে, ২রা মার্চ হইতে আওয়ামী লীগের তথাকথিত অহিংস অসহযোগ অন্দোলন শুরু হওয়ার সাথে-সাথেই আওয়ামী লীগ ভলান্টিয়াররা এবং তাদের উস্কানিতে বাংগালীরা অবাংগালীদের উপর বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। কথাটা যে সত্য নয়, তার প্রমাণ ৫ই আগষ্টে প্রকাশিত ‘হায়াইট পেপার’ নিজেই। এই হোয়াইট পেপারের এপেক্সি ‘জি’তে যে হিংসাত্মক কাজের তালিকা দেওয়া হইয়াছে, তাতে ২৬-২৭শে মার্চের চাটগাঁর ঘটনা হইতে শুরু করিয়া ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত মুদ্দতের দিনানুক্রমিক হিসাব দেওয়া হইয়াছে। লক্ষণীয় যে এই সবই ২৫শে মার্চের পরের ঘটনা। সত্য হইলেও এগুলোকে আগ্রাসনী কাজ বলা চলে না। বড়জোর প্রতিশোধমূলক নৃশংসতা বলা চলে। এইসব বিবরণে কোনও-কোনও জায়গার নৃশংসতাকে ২৩শে মার্চ হইতে ১লা এপ্রিলের ঘটনাবলিয়া এজমালি আকারে দেখান হইয়াছে। ২৩/২৪-এর ঘটনা বলিয়া আলাদা কোনও নৃশংসতার কথা বলা হয় নাই। অসদুদ্দেশ্যটা সুস্পষ্ট।