০৯. নির্বাচন-যুদ্ধ

নির্বাচন-যুদ্ধ
নয়ই অধ্যায়

১. সুদূরপ্রসারী সংগ্রাম

১৯৩৭ সালের এই নির্বাচন মুসলিম বাংলার ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। যুদ্ধটা দৃশ্যতঃ কৃষক-প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ এই দুইটি দলের পার্লামেন্টারি সংগ্রাম হইলেও ইহার পরিণাম ছিল সুদূর প্রসারী। আমরা কর্মীরা এই নির্বাচনের রাজনৈতিক গুরুত্ব পুরাপুরি তখনও উপলব্ধি করিতে পারি নাই সত্য কিন্তু সাধারণভাবে কৃষক প্রজাগণের এবং বিশেষভাবে মুসলিম জনসাধারণের অর্থনৈতিক কল্যাণ-অকল্যাণের দিক হইতে এ নির্বাচন ছিল জীবন-মরণ প্রশ্ন, এটা আমরা তীব্রভাবেই অনুভব করিতাম। ঐক্যবদ্ধভাবে কঠোর পরিশ্রমও করিয়াছিলাম সকলে। মুসলিম ছাত্র তরুণরাও সমর্থন দিয়াছিল আশাতিরিক্তরূপে।

পার্টি হিসাবে দুই দলের সুবিধা-অসুবিধা বিচার করিলে দেখা যাইবে উভয়পক্ষেরই কতকগুলি সুবিধা-অসুবিধা দুইই ছিল। মুসলিম লীগের পক্ষে সুবিধা ছিল এই কয়টি?

(১) মুসলিম জনসাধারণ মনের দিক দিয়া মোটামুটি মুসলিম সংহতির প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাস করিত।

(২) প্রজা-সমিতির অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও তাঁর সাথে মৌঃ তমিয়ুদ্দিন খাঁ খানবাহাদুর আবদুল মোমিন সহ অনেক প্রজা-নেতা মুসলিম লীগে যোগ দিয়াছিলেন। প্রবীণ প্রজা-নেতাদের অনেকে স্বন্ত্র প্রজা-পার্টি গঠনকরিয়াছিলেন।

(৩) মওলানা আকরম খাঁ এই সময় মুসলিম বাংলার একমাত্র দৈনিক আজাদ বাহির করেন, কৃষক-প্রজা পার্টির কোনও সংবাদপত্র ছিল না।

(৪) কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে নিখিল ভারতীয় ভিত্তিতে একটা নির্বাচনী মৈত্রী হয় তাতে বোশ্বই ফুক্ত প্রদেশ মাদ্রাজ ও বিহারে ঐ দুই প্রতিষ্ঠান যুক্তভাবে নির্বাচন-সংগ্রাম চালান। বাংলার নির্বাচনেও তার ঢেউ লাগে। কংগ্রেসের সমর্থক জমিয়তে-ওলামায়-হিন্দ মুসলিম লীগ প্রার্থীদের ভোট দিবার জন্য ফতোয়া জারি করেন।

(৫) মুসলিম লীগের তরফ হইতে প্রচার চালাইবার জন্য প্রচুর অর্থের ব্যবস্থা ছিল। পক্ষান্তরে কৃষক-প্রজা পার্টির কোনও তহবিল ছিল না। প্রার্থীরাও প্রায় সবাই গরিব।

পক্ষান্তরে কৃষক-প্রজা পার্টির অনুকূল অবস্থা ছিল এই কয়টি :

(১) কৃষক-প্রজা আন্দোলনের ও ব্যক্তিগতভাবে হক সাহেবের খুবই জনপ্রিয়তা ছিল। জমিদারি উচ্ছেদ, মহাজনি শোষণ অবসান, কৃষি খাতকের দুরবস্থা দূরকরণ প্রভৃতি গণদাবির মোকাবেলায় মুসলিম লীগের কোনও গণ-কল্যাণের কর্মসূচী ছিল না।

(২) কৃষক-প্রজা পার্টির কর্মীরা নির্বিলাস সমাজ সেবক দেশ-কর্মী। তাঁদের জনসেবার দৃষ্টান্ত জনগণের চোখের দেখা অভিজ্ঞতা। বিনা পয়সায় পায়ে হাঁটিয়া এরা প্রচার করিতেন। পক্ষান্তরে মুসলিম লীগের বড় লোক প্রার্থীদের কর্মীরা চটকদার বেশে প্রচারে বাহির হইতেন।

(৩) মুসলিম ছাত্র-তরুণরা সকলেই প্রতিবাদী প্রতিষ্ঠান হিসাবে কৃষক-প্রজা পার্টির সমর্থক ছিল।

(৪) নিখিল ভারতীয় ভিত্তিতে কংগ্রেস-লীগ মৈত্রী হওয়ায় বাংলার নাইট নবাবরা প্রজা-কর্মীদেরে কংগ্রেসের ভাড়াটিয়া বলিয়া গাল দিতে অসুবিধায় পড়িলেন। পক্ষান্তরে কংগ্রেস-লীগ মৈত্রী বাংলার কংগ্রেস মানিয়া না ওয়ায় তাঁদের অনেকে এবং অনেক খবরের কাগ কৃষক-প্রজা পার্টির প্রচার প্রপেগেণ্ডায় সমর্থন করেন।

(৫) পর পর কতকগুলি নাটকীয় ঘটনায় জনমত প্ৰজা-পার্টির দিকে উদ্দীপ্ত হয়ঃ (ক) হক সাহেবের পক্ষ হইতে (আসলে তাঁর অনুমতি না লইয়াই) ডাঃ আর. আহমদ বাংলার যে কোন নির্বাচনী এলাকা হইতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবার জন্য সার নাফিমুদ্দিনকে চ্যালেঞ্জ করেন। (খ) বাংলার লাট সার নাযিমুদ্দিনের পক্ষে ওকালতি করায় হক সাহেব লাট সাহেবের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধংদেহি বিবৃতি দিয়া দেশময় বাহু বাহ্ পান। (গ) সার নাযিমুদ্দিনের আপন জমিদারি পটুয়াখালি নির্বাচনী এলাকাই দ্বন্দ্ব যুদ্ধের ময়দান নির্বাচিত হওয়ায় ঘটনার নাটকত্ব শতগুণ বাড়িয়া যায়। সারা বাংলার, সারা ভারতের এবং শেষ পর্যন্ত সারা দুনিয়ার দৃষ্টি পটুয়াখালির দিকে নিবদ্ধ হয়।

২. পটুয়াখালি দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ

একদিকে ইংরাজ লাটের প্রিয়পাত্র সার নাযিমুদ্দিনের পক্ষে সরকারী প্রভাব ও ক্ষমতা এবং নাইট-নবাবদের দেদার টাকা, অপরদিকে খেতাববিত্তহীন বৃদ্ধ এজা নেতা হক সাহেবের পক্ষে তাঁর মুখের বুলি ‘ডাল-ভাত’ ও সমান বিত্তহীন প্রজা কর্মীরা। রোমান্টিক আদর্শবাদী ছাত্ররা স্কুল-কলেজের পড়া ফেলিয়া বাপ-মায়ের দেওয়া পকেটের টাকা খরচ করিয়া চারিদিক হইতে পটুয়াখালিতে ভাংগিয়া পড়িল। এর ঢেউ শুধু পটুয়াখালিতে সীমিত থাকিল না। সারা বাংলার বিভিন্ন নির্বাচন কেন্দ্রেও ছড়াইয়া পড়িল। হক সাহেব খাজা সাহেবের প্রায় ডবল ভোট পাইয়া নির্বাচিত, হইলেন। তাঁর বরাবরের নিজের নির্বাচন কেন্দ্র পিরোজপুর হইতেও তিনি নির্বাচিত হইলেন।

আমার নিজের জিলা ময়মনসিংহে আমাদের বিপুল জয়লাভ হইল। আমি নিজে না দাঁড়াইয়া কৃষক-প্রজা প্রার্থীদের জিতাইবার জন্য দিনরাত সভা করিয়া বেড়াইলাম। কঠোর পরিশ্রম করিলাম আমারই মত গরিব সহকর্মীদেরে লইয়া। ফলে এ জিলার প্রধান প্রধান লীগ নেতা খান বাহাদুর শরফুদ্দিন, খান বাহাদুর নূরুল আমিন, খান বাহাদুর গিয়াসুদ্দিন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, মৌঃ আবদূল মোননম খাঁ প্রভৃতি সকলকে ধরাশায়ী করিলাম। জিলার মোট যোলটি মুসলিম সীটের মধ্যে কৃষক-প্রজা পার্টি পাইয়াছিল এগারটি, মুসলিম লীগ পাইয়াছিল মাত্র পাঁচটি। উল্লেখযোগ্য যে, জিন্না সাহেব স্বয়ং ময়মনসিংহ জিলাতেই অনেকগুলি নির্বাচন কেন্দ্রে সভা-সমিতি করিয়াছিলেন। তাঁর মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নির্বাচন বিশারদ ও ময়মনসিংহের মুসলিম ভোটারদের মনে দাগ কাটতে পারেন নাই।

৩. নয়া টেকনিক

বরিশালের পরে ময়মনসিংহ জিলাতেই কৃষক-প্রজা পার্টি সবচেয়ে বেশিহারে আসন দখল করিয়াছিল। ময়মনসিংহ জিলার এই অসামান্য সাফল্যের কারণ ছিল তিনটি। এই তিনটি কারণই ছিল এই জিলার কৃষক-প্রজা কর্মীদের প্রচার-প্রপেগেণ্ডার টেকনিক। আত্ম-প্রশংসার মত শোনা গেলেও বলা দরকার যে তিনটি টেকনিকই আমার নিজের উদ্ভাবিত। সহকর্মীদেরে ঐ টেকনিকের ব্যাপারে আগেই তালিম দিয়া লইয়াছিলাম। একটি এই : এ জিলার কৃষক-প্রজা বক্তারা মুসলিম লীগের ‘মুসলিম সংহতির শ্লোগানকে সামনাসামনি আক্রমণ, ফ্রন্টাল এটাক, করিতেন না। মুসলিম জমিদারের সংগে মুসলিম প্রজার, মুসলিম মহাজনের সাথে মুসলিম খাতকের সংহতির কথা বলা হাস্যকর, এ ধরনের মামুলি যুক্তিত ছিলই। এছাড়া অবস্থা ভেদে এবং স্থান ভেদে দরকার-মত আমাদের বক্তারা এই যুক্তি দিতেন : ‘আমরাও মুসলিম সংহতি চাই। তবে আমাদের দাবি এই যে সে মুসলিম-সংহতি হইবে কৃষক প্রজাদের কুটিরের আংগিনায়, নবাব-সুবাদের আহসান-মনযিল বা রাজ-প্রসাদে নয়। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে জমিদার-মহাজন আর কয়জন? শতকরা পঁচানব্বই জন মুসলমানই আমরা কৃষক। কাজেই আমরা কৃষক-প্রজা কর্মীরা বলি : হে মুষ্টিমেয় মুসলমান জমিদার-মহাজনেরা, আপনারা নিজেরা, পৃথক দল না করিয়া মুসলিম সংহতির খাতিরে চলিয়া আসুন পঁচানব্বই জনের দল এই কৃষক-প্রজা-সমিতিতে। এর পরে মুসলিম লীগের বক্তারা হাজার সংগতির কথা বলিয়াও সেখানে দাঁত ফুটাইতে পারিতেন না।

আমাদের দ্বিতীয় টেকনিক ছিল এইরূপ। আমাদের বক্তারা তাঁদের বক্তৃতায় বলিতেন : আমাদের বক্তৃতা ও যুক্তি-তর্ক শুনিলেন। কোন দলকে আপনারা ভোট দিবেন, আজই এই মুহূর্তে তা স্থির করিয়া ফেলিবেন না। কয়েকদিন পরেই এখানে মুসলিম লীগের সভা হইবে। আপনারা দলে দলে সে সভায় যোগদান করিবেন। মন দিয়া তাঁদের বক্তৃতা শুনিবেন। আমাদের যুক্তি ও তাঁদের যুক্তি মিলাইয়া তুলনামূলক বিচার করিবেন। তারপর ঠিক করিবেন, কোন দলকে আপনারা ভোট দিবেন। আমাদের বক্তাদের এই ধরনের বক্তৃতার মোকাবিলায় মুসলিম লীগ বক্তারা তাঁদের সভায় বলিতেন : ‘কৃষক-প্রজার লোকেরাও এখানে সভা করিতে আসিবে। তাদের কথা শুনিবেন না। তাদের সভায় যাইবেন না। ওরা মুসলিম-সংহতি-ধ্বংসকারী হিন্দু-কংগ্রেসের ভাড়াটিয়া লোক। ওদেরে ভোট দিলে মুসলমানদের সর্বনাশ হইবে।

এই দুই সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের বক্তৃতায় মুসলিম জনসাধারণ স্বভাবতঃই কৃষক–প্রজা পার্টির সমর্থক হইয়া পড়িত। যে দল অপর পক্ষের বক্তৃতা শুনিয়া পরে কর্তব্য ঠিক করিতে বলে, তারা নিশ্চয়ই অপর দলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই সাধারণ কাণ্ড-জ্ঞান মুসলিম জনসাধারণের আছে এটা যাঁরা বিশ্বাস করেন নাই তাঁরাই রাজনীতিতে হারিয়াছেন।

আমাদের তৃতীয় টেকনিক ছিল উভয় পক্ষের যুক্ত নির্বাচনী সভার আয়োজন করার দাবি। আমাদের বক্তারা কোন অঞ্চলে গিয়াই প্রস্তাব দিতেন। কি দরকার অত টাকা-পয়সা খরচ ও অতশত পরিশ্রম করিয়া দুইটা মিটিং করিয়া জনসাধারণকে তকলিফ দিবার? দুই পক্ষ মিলিয়া একটা সভা করা হউক। খরচও কম হইবে। লোকও বেশি হইবে। উভয় পক্ষের সমান সংখ্যক বক্তা সম-পরিমাণ সময় বক্তৃতা করিবেন। আমাদের পক্ষের এই প্রস্তাবে মুসলিম লীগাররা স্বভাবতঃই আপত্তি করিতেন। যেখানেই আপত্তি করিয়াছেন, পরিণাম তাঁদের পক্ষে সেখানেই খারাপ হইয়াছে। আমাদের প্রস্তাবটা ছিল দুধারি তলওয়ার : মানিলেও আমাদের জিত, না মানিলেও আমাদের জিত।

৪. উত্তর টাংগাইল

এই টেকনিকে সবচেয়ে বেশি ম্যাজিকের কাজ হইয়াছিল টাংগাইল মহকুমার মধুপুর-গোপালপুর নির্বাচন-কেন্দ্রে। এখানে নবাবযাদা সৈয়দ হাসান আলী আমাদের প্রার্থী। আর প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ সাহেব মুসলিম লীগ প্রার্থী। নবাবযাদা ব্যক্তিগতভাবে প্রগতিবাদী তরুণ হইলেও ‘অত্যাচারী জমিদার’ বলিয়া পরিচিত নবাব বাহাদুর নবাব আলীর পুত্র। পক্ষান্তরে ইব্রাহীম খাঁ সাহেব জনপ্রিয় শিক্ষাবিদ, সুপরিচিতি সাহিত্যিক ও প্রবীণ সমাজসেবক। তাছাড়া স্বয়ং জিল্লা সাহেব এই নির্বাচনী-কেন্দ্রে খুব ধূমধামের সাথে জন-সভা করিয়াছেন। এসবের ফল হইল এই যে নির্বাচনের মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে একদিন নবাবযাদা সকালবেলা আমার বাসায় হাযির। তার মোটর ধূলায় সাদা। নিজের চেহারা তাঁর উস্কুখুস্কু। কয়দিন ধরিয়া না জানি শেভও করেন নাই। গোসলও করেন নাই। অমন সুন্দর চেহারাখানা একদম মলিন। কত রাত ঘুমান নাই। চোখ লাল। চোখের চারধারে কালশিরা পড়িয়া গিয়াছে। এমন। অসময়ে তাঁকে দেখিয়া বিস্মিত হইলাম। উদ্বিগ্নও হইলাম। কারণ জিগ্গাসা করিলাম। তিনি বলিলেন : ইলেকশনে জিতার তাঁর কোনই চান্স নাই। তিনি বড়জোর এক আনি ভোট পাইবেন; পনর আনিই পাইবেন প্রিন্সিপাল সাহেব। এ অবস্থায় ইলেকশনে লড়িয়া কোনও লাভ নাই। তিনি হাজার দশেক টাকা খরচ করিকেন বাজেট করিয়াছিলেন। অর্ধেকের বেশি খরচ হইয়া গিয়াছে। বাকী টাকাটা তাঁর নিজের ইলেকশনে নিশ্চিত অপব্যয় না করিয়া অন্যান্য গরিব প্রার্থীর পিছনে খরচ করা উচিৎ। এই কথাটা বলিবার জন্যই এবং বাকী টাকাটা লইয়াই তিনি আমার কাছে আসিয়াছেন। তিনি আর ইলেকশন করিবেন না, কর্মীদেরে তা বলিয়া আসিয়াছেন।

আমি এক ধ্যানে তার কথাগুলি শুনিলাম। এক দৃষ্টে তাঁর দিকে চাহিয়া রহিলাম। বড় লোকের আদরের দুলাল। কাঁচা সোনার মত চেহারা। জীবনে কোনও সাধ অপূর্ণ রাখেন নাই বিলাসী বাবা। কোনও নির্বাচনে হারেনও নাই আজো। অল্পদিন আগে কৃষক-প্রজা টিকিটে বিপুল ভোটাধিক্যে লোক্যাল বোর্ড ও ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডে নির্বাচিত হইয়াছেন। মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান হইয়াছেন। আর আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই তরুণ মনে এমন আঘাত। পাইয়াছেন। সেটাও বড় কথা নয়। সে পরাজয়ের নিশ্চিত সম্ভাবনার সামনে কি অপরূপ বীরত্বের সাথে বুকটান করিয়া দাঁড়াইয়াছেন। না, এ তরুণকে হারিতে দেওয়া হইবে না।

এক নাগাড়ে অনেক দূর ট্রেন ও সাইকেল ভ্রমণ করিয়া অনেকগুলি সভা করিয়া মাত্র গতরাতে বাসায় ফিরিয়াছি। ভালরূপ খাওয়া-ঘুমও হয় নাই। আবার এই দশটার গাড়িতেই আরেকটা সভা করিতে যাইবার কথা। এক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত করিয়া ফেলিলাম। নবাবযাদার নির্বাচনী এলাকাতেই যাইব। নবাবযাদাকে বলিলাম শেভ গোসল করিয়া চারটা ডাল-ভাত খাইয়া একটু বিশ্রাম করিতে। আমিও তাই করিলাম। সন্ধ্যার দিকে ধনবাড়ি পৌঁছিলাম। অনেক রাত পর্যন্ত পরবর্তী দিনসমূহের জন্য প্ল্যান প্রোগ্রাম করিলাম। সকাল হইতে সভা করিয়া চলিলাম। তিনদিনে তিনটা বড় সভা করিলাম। আর পথের ধারের সভা-সোড় সাইড মিটিং করিলাম উনিশটা। হাটের সভা করিলাম না। কর্মীরা ঢোল ও চোংগা লইয়া আগে-আগে চলিয়া যাইতেন। এক সভা শেষ করিতে-করিতে দুই-তিন মাইল দূরে আকেটা সভার আয়োজন হইয়া যাইত। সভা মানে দুই তিন পাঁচ সাতশ লোকের জমায়েত। বড় সভা যে কয়টা করিলাম তার দূইটা ছিল যুক্ত সভা।

যুক্তসভার মধ্যে খোদ ভূয়াপুরের সটাই ছিল সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। এটা ইব্রাহিম খাঁ সাহেবের কর্মক্ষেত্র। এই স্থানটাকে উন্নত করার কাজে প্রিন্সিপাল সাহেব তাঁর কর্মজীবনের বেশির ভাগ ব্যয় করিয়াছেন। এই ভূয়াপুরেই নির্বাচনী যুক্ত স। অঞ্চলের সবচেয়ে মান্যগণ্য সবচেয়ে বয়োজ্যষ্ঠ এক মুরুব্বিকে সভাপতি করা হইল প্রিন্সিপাল সাহেবের প্রস্তাব-মত। কথা হইল। তিনি আর আমি মাত্র এই দুই জন বক্তৃতা করিব। আমাদের বক্তৃতা শেষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নবাবযাদা দাঁড়াইয়া জনসাধারণকে শুধু একটা সেলামালেকুম দিবেন।

প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ রাজনীতি, সাহিত্য-সাধনা ও প্রজা-আন্দোলন সব ব্যাপারেই আমার নেতা ও মুরুব্বি। ছাত্রজীবনেও তিনি ছিলেন আমাদের নেতা ও ‘হিরো’। তাঁরই সংগে নির্বাচনী বক্তৃতার লড়াই করিতে হইতেছে। এর একটু ইতিহাস আছে। প্রিন্সিপাল সাহেব ময়মনসিংহ প্রজা-আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা। নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি টাংগাইল মহকুমা প্রজা-সমিতির প্রেসিডেন্ট। কাজেই স্বভাবতঃই তিনি নির্বাচনে প্রজা-সমিতির মনোনয়ন চাহিয়া দরখাস্ত দিলেন। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে একটা চিঠিও দিলেন। প্রজা-সমিতি তাঁর মত যোগ্য ব্যক্তি ও প্রবীণ নেতাকে মনোনয়ন দিবে নিশ্চয়ই। কিন্তু একটু অসুবিধা হইল এই যেনবাবযাদা হাসান আলী এবং প্রিন্সিপাল সাহেব একই এলাকার লোক। মনোনয়ন চাইলেন উভয়ে একই এলাকা হইতে। আমি বিষম বিপদে পড়িলাম। নবাবদাকে নিজ এলাকা হইতে নমিনেশন না দিলে আর দেওয়াই যায় না। তিনি তরুণ ও অপরিচিত। যা-কিছু পরিচয় তাঁর বাপের নামে। প্রজাদের পক্ষে সেটা সুপরিচয় নয়। পক্ষান্তরে প্রিন্সিপাল সাহেব সারা বাংলায় সুপরিচিত। যে কলেজের তিনি প্রিন্সিপাল সেই করটিয়া কলেজ মধ্য টাংগাইল নির্বাচকমণ্ডলীতে অবস্থিত। তাঁর শক্তির উৎস যে ছাত্র-শক্তি, সেই ছাত্র বাহিনী মধ্য টাংগাইলে অবস্থিত। কলেজের সেক্রেটারি টিয়া স্টেটের মোতায়ারি নবাব মিয়া সাহেব (মসউদ আলী খান পন্নী) মধ্য-টাঙ্গাইলে দাঁড়াইলে প্রিন্সিপাল সাহেবের যে অসুবিধা ও বেকায়দা হইত তাও হয় নাই। কারণ নবাব মিয়া সাহেব দাঁড়াইয়াছেন দক্ষিণ টাংগাইল নির্বাচনী এলাকাতে। এসব কথাই আমি প্রিন্সিপাল সাহেবকে পত্রে ও মূখে বুঝাইলাম। এর উপরও আরও দুইটা কথা বলিলাম। এক, তাঁর মত শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ব্যক্তিকে এ জিলার যেকোন নির্বাচনী এলাকা হইতে পাস করাইয়া আনিবার মত প্রভাব ও জনপ্রিয়তা এজা-সমিতির আছে এবং তা করিবার গ্যারান্টিও আমি দিলাম। দুই, নবাবযাদাকে তাঁর জমিদারির বাহিরে অন্য কোন নির্বাচনী এলাকাতে খাড়া করিলে লোকেরা বলিবে অত্যাচারী জমিদার হিসাবে নিজের জমিদারিতে তোট পাইবেন না বলিয়াই নবাবযাদা অন্যখানে দাঁড়াইয়াছেন। অতএব হয় নবাদকে মংপুর-গেপালপুরে দাঁড় করাইতে হয়, নয়ত তাঁকে এক বাদ দিতে হয় এই উত্মকুল রক্ষার জন্য নবাবদা ও প্রিন্সিপাল সাহেবের কেসটা কেন্দ্রীয় গামেন্টারি বোর্ডের কাছে দেওয়া হইল। তাঁরাও আমার সমর্থন করিলেন। নবাদাকে উত্তর-টাঙ্গাইল ও প্রিন্সিপাল সাহেবকে মধ্য-টাংগাইলে মনোনয়ন দেওয়া হইল।

কিন্তু প্রিন্সিপাল সাহেব আমাদের মনোনয়ন অগ্রাহ্য করিয়া উত্তর-টাংগাইলে মনোনয়নপত্র দাখিল করিলেন এবং মুসলিম লীগের টিকিট চাইলেন। মুসলিম লীগ প্রিন্সিপাল সাহেবের মত দেশ-বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবককে লুফিয়া নইলেন। এইভাবে এক কালের প্রজা-নেতা আমার সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক গুরুর বিরুদ্ধে ক্যানভাস করিবার জন্য আমি ভুয়াপুর আসিয়াছি।

বক্তৃতাও করিলাম দরদ দিয়া প্রাণ ঢালিয়া। একটা অশ্রদ্ধাপূর্ণ শক্ত কথাও বলিলাম না। শুধু ঘটনা-পরম্পরা বর্ণনা করিয়া গেলাম। প্রিন্সিপাল সাহেবও সুবক্তা রসিক বাগ্মী। কিন্তু মামলা ছিল তাঁর খুবই জটিল। সব পার্টির মতই প্রজা-সমিতিরও মনোনয়ন চাওয়ার নিয়ম ছিল, দরখাস্তে স্পষ্ট করিয়াই লেখা থাকিত : ‘প্রজা-পার্টির মনোনয়ন মানিয়া হব। মনোনয়ন না পাইলে প্রতিদ্বন্দিতা হইতে সরিয়া দাঁড়াই। স্বাধীনভাবে বা অন্য কোনও পার্টির মনোনয়ন লইয়া নির্বাচন লড়িব না।‘ আমি এই প্রতি- সভায় উপস্থিত করিলাম। প্রিন্সিপাল সাহেব স্বভাবতই স্বীকার করিলেন। তারপরে তাঁর বক্তৃতা আর ভাল জমিল না। নবাবযাদা ডবলের বেশি ভোট পাইয়া মাত করিলেন।

৫. অমানুষিক খাটুনি

এই নির্বাচন উপলক্ষে আমরা সকলেই অমানুষিক পরিশ্রম করিয়াছিলাম। স্বয়ং নবাব হাসান আলী ও মৌঃ আসাদুদদৌলা সিরাজীর মত সুখী লোকেরাও গভীর রাতে পাস্ত্রে থটিয়া নদী-নালা পার হইয়াছেন। অনেক সহকমী লইয়া আমি অন্ধকার রাতে সাইকেল কাঁধে করিয়া মাইলের পর মাইল বালুচর পার হইয়াছি। এই সবের শারীরিক প্রতিক্রিয়া অন্ততঃ আমার উপর অদ্ভুত হইয়াছিল। যেদিন তোটাভুটি শেষ হয়, সেদিন নিশ্চিত জয়ের রগন চিত্র আঁকিতে-আঁকিতে সন্ধ্যার কিছু আগে বাসায় ফিরিলাম। অনেক দিন পরে শেত-গোসল করিয়া পরিতৃপ্তির সংগে খাইয়া সন্ধ্যার সময় দরজা বন্ধ করিয়া শুইয়া পড়িলাম। আন্দায় ছয়টা-সাতটা হইবে। আমার ঘুম না ভাংগা পর্যন্ত আমাকে ডিটার্ব না করিতে নির্দেশ দিয়া শুইলাম। পরদিন রাত্রি নয়টার সময় আমার ঘুম ভাংগে। অর্থাৎ একঘুমে আমি ছাৱিশ ঘন্টা কাটাইয়া ছিলাম। এই সময়টার মধ্যে আমার বাড়িতে প্রথমে দুশ্চিন্তা ও পরে কান্নাকাটি পড়িয়াছিল। মহল্লায় জানাজানি হইয়া গিয়াছিল বন্ধু-বান্ধবের ভিড় হইয়াছিল। জানালা দিয়া আমার পেটের উঠানামা দেখিয়াই আমার জীবিত থাকা সম্বন্ধে তাঁরা নিশ্চিত হইয়াছিলেন। এই ছাবিশ ঘন্টায় আমার ক্ষুধা পেশাব পায়খানা লাগে নাই। আমার স্ত্রী বলিয়াছেন, তিনি জানালার ফাঁকে খুব লক্ষ্য রাখিয়াছিলেন, এই ছারিশ ঘন্টায় আমি তিনবারের বেশি পাশ ফিরি নাই।

৬. জয়-পরাজয়ের খতিয়ান

এত সাধের ইলেকশন, এত শ্রমের জয়, সব গোলমাল হইয়া গেল নির্বাচনের পরে। দেখা গেল, একশ উনিশটা মুসলিম আসনের মধ্যে কৃষক-প্রজা পার্টি মাত্র তেতাল্লিশটা পাইয়াছে। আমাদের হিসাব মতে মুসলিম লীগ পাইয়াছে মাত্র আটত্রিশটা। আমাদের দেশে, বিশেষতঃ মুসলিম সমাজে, তখনও পার্টি-সিস্টেম ও পার্টি-আনুগত্য সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা দানা বাঁধে নাই। কাজেই সুস্পষ্ট ইওর উপর দুইদলের মুখামুখি নির্বাচন-যুদ্ধ হওয়ার পরও দেখা গেলে যে কোন দলের ঠিক কতজন নির্বাচিত হইয়াছেন, তা অস্পষ্টই রহিয়া গিয়াছে। দেখা গেল, অনেক অদলীয় মেরও নিজেদের সুবিধামত দুই দলের কোনও একদলে ভিড়িয়া পড়িতেছেন। ফলে শেষ পর্যন্ত হিসাব-নিকাশ করিয়া বুঝা গেল মুসলিম লীগ পার্টির মহিলা ও শ্রমিক সদস্য সহ ষাটজনের বেশি সদস্য হইয়া গিয়াছেন। টানিয়া-বুনিয়া আমরাও আমাদের আটান্ন জন মৈন আছেন দাবি করিতে লাগিলাম। এছাড়া পঁচিশ জন ইউরোপীয়ান ও চারজন এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এই মোট উনত্রিশ জন সদস্য লাট সাহেবের ইশরায় মুসলিম লীগ দলকেই সমর্থন করিবেন। এটা এরূপ ধরা কথা। যাঁরাই মন্ত্রিসভা গঠন করিবেন, তফসিলী হিন্দুদের অন্ততঃ কুড়িজন মেম্বর তাঁদেরই সমর্থন করিবেন, এটাও স্পষ্ট বোঝা গেল। এ সব হিসাব করিয়াও কিন্তু মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভা গঠনের সম্ভাবনা ছিল না। তৎকালে আইন পরিষদে মোট মেম্বর-সংখ্যা ছিল আড়াইশ। তার মধ্যে বিশেষ নির্বাচক-মণ্ডলীর প্রতিনিধিসহ মুসলমান ১২২, বর্ণহিন্দু ৬৪, তফসিলী হিন্দু ৩৫, ইউরোপীয়ান ২৫ ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ৪। বৰ্ণহিন্দু ও তফসিলীদের মিলাইয়া যাটের উপর ছিলেন কংগ্রেসী। এঁরা মুসলিম লীগকে কিছুতেই সমর্থন করিবেন না। মাদ্রাজা-বোম্বাই ও যুক্ত-প্রদেশের লীগ-কংগ্রেস আপোস সত্ত্বেও বাংলায় এই পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল। এ অবস্থায় সমস্ত শ্বেতাংগ সদস্য, এক ডজন হিন্দু রাজা মহারাজ ও কুড়িজন তফসিলী হিন্দু মুসলিম লীগকে সমর্থন করিলেও তাঁরা মন্ত্রিসভা গঠন করিতে পারেন না। পক্ষান্তরে কৃষক-প্রজা সমিতি তা পারে। কারণ কৃষক-প্রজা পার্টি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। একমাত্র জামিদারি উচ্ছেদের চরমপন্থী দাবির জন্যই অধিকাংশ বর্ণহিন্দু এই পার্টির বিরোধী। এটাই ফয়সালা হইয়া যাইবে হিন্দুসমাজে নির্বাচন-যুদ্ধ হক সাহেবের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার দ্বারা। গোড়াতে শ্বেতাংগরা হক সাহেব ও তাঁর দলকে সমর্থন করিবেন না বটে, কিন্তু একটা মন্ত্রিসভা গঠিত হইয়া গেলে তারা সে মন্ত্রিসভাকে সমর্থন করিবেন ইহাই শ্বেতাংগদের নীতি।

৭. কংগ্রেস-প্রজা পার্টি আপোস চেষ্টা

এ অবস্থায় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় দলই কৃষক-প্রজা পার্টির সংগে আপোস করিতে চাইলেন। কংগ্রেস মতি গ্রহণ করিবে না, এটা আগেই ঘোষণা করায় আমরা কংগ্রেসের সহিত কোয়েলিশন করাই অধিকতর সুবিধাজনক মনে করিলাম। কারণ এতে হক সাহেবের প্রধান মন্ত্রিত্ব অবধারিত হয়। কৃষক-প্রজা দলের বেশি লোককে মন্ত্রী করা যায়। পক্ষান্তরে মুসলিম লীগের প্রধান মন্ত্রিত্বের দাবি আছে। কাজেই মুসলিম লীগের প্রসারিত হাত অগ্রাহ্য করিয়া আমরা কংগ্রেসের সহিত কথা চালাইলাম। কংগ্রেসের সহিত মূলনীতিগত ঐক্যমত থাকায় আপোসের শর্ত নির্ধারণ অতি সহজ মনে হইল। কতিপয় বড়-বড় শর্ত ঠিক হওয়ার পরই বিশেষ ধরুরী কাজে আমি ময়মনসিংহ চলিয়া আসিলাম। কথা থাকিল, সব চূড়ান্ত হওয়ার সময় আমি আবার আসিব। মৌঃ সৈয়দ নওশের আলী, মৌঃ শামসুদ্দিন, মৌঃ আশরাফুদ্দিন চৌধুরী, অধ্যাপক হুমায়ুন করিব, নবাবযাদা হাসান আলী প্রভৃতি আমার চেয়ে যোগ্য বন্ধুরা আলোচনার দায়িত্ব নেওয়ায় আমি নিশ্চিন্তে ময়মনসিংহে চলিয়া আসিলাম। দুই তিন দিন যাইতে না-যাইতেই হক সাহেবের টেলিগ্রাম পাইয়া ছুটিয়া গেলাম। হক সাহেব বড় খুশী। তিনি খুশীতে তাঁর বেলচার মত হাত দিয়া আমার পিঠে থাপ্পড় মারিতে লাগিলেন। কংগ্রেস আমাদের সকল শর্ত মানিয়া লইয়াছে। আমিও উল্লসিত হইলাম।

সেদিনই রাত্রি আটটায় মিঃ জে. সি. গুপ্তের বাড়িতে ডিনার। সেখানে চূড়ান্ত শর্তাবলী উভয় পক্ষের নেতৃবৃন্দ কর্তৃক স্বাক্ষরিত হইবে। উভয় পক্ষে আট অথবা দশ জন করিয়া বোল অথবা কুড়ি জনের ডিনার। আমাদের পক্ষে হক সাহেব, সৈয়দ নওশের আলী, শামসুদ্দিন, আশরাফুদ্দিন, নবাবযাদা খানবাহাদুর হাশেম আলী, অধ্যাপক কবির, ডাঃ আর. আহমদ ও আমি প্রভৃতি, কংগ্রেস পক্ষ হইতে মিঃ শরৎ বসু, নলিনী সরকার, ডাঃ বিধান রায়, জে এম.দাশগুপ্ত, কিরণ শংকর রায়, সন্তোষ কুমার বসু, ধীরেন্দ্র নাথ মুখার্জী ও জে.সি. গুপ্ত প্রভৃতি। হৃদ্যতার আবহাওয়ার মধ্যেই আলাপ-আলোচনা চলিল। শর্তাবলী আগেই ঠিক হইয়া গিয়াছে বলিয়া আপোস রফার কোনও কথাই উঠিল না। শুধু ভবিষ্যৎ লইয়াই রংগিন চিত্র আঁকার প্রতিযোগিতা চলিল। ডিনার খাওয়া হইল। মিঃ গুপ্ত আমিরী-বাদশাহী আনার জন্য মহর ছিলেন। ডিনারে ভাই হইল। খাওয়ার পরে শর্তাবলী দস্তখতের সময় আসিল। গুপ্ত সাহেব আগেই সব টাইপ করাইয়া রেডি রাখিয়াছিলেন। তিনি সে সব কাগয হাযির করিলেন। নেতাদের ইশারায় তিনি শর্তনামাটি পড়িয়া শুনাইলেন। শর্তনামার ক্ষুদ্র ভূমিকায় দেশের এই সন্ধিক্ষণে কংগ্রেস ও কৃষক-প্রজা পার্টির মত দুইটি প্রগতিবাদী প্রতিষ্ঠানের কোয়ালিশনের আবশ্যকতা সংক্ষেপে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বর্ণনা করা হইয়াছে। তারপরেই ক্রমিক নম্বর দিয়া মন্ত্রিসভার করণীয় কার্যাবলীর তালিকা দেওয়া হইয়াছে। তাতে কংগ্রেস ও কৃষক-প্রজা সমিতির ইলেকশন মেনিফেস্টোর প্রধান-প্রধান ধারা যথা জাতীয় দাবি, রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি, প্রজা স্বত্ব আইন, মহাজনী আইন, কৃষি ঋণ, সালিশী বোর্ড, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা ইত্যাদি সমস্ত প্রগতিমূলক কার্যক্রমই ছিল। মিঃ গুপ্তের পড়া শেষ হইলে করতালি-ধ্বনিতে কার্যক্রমটি অভিনন্দিত হইল।

করতালি-ধ্বনি থামিলে আমি দাঁড়াইলাম। আমি সেই দিনই মফস্বল হইতে আসিয়াছি বলিয়া এই প্রথম কার্যক্রমটি শুনিলাম। অতি চমৎকার হইয়াছে। এটাকে আইডিয়াল মেগনাকার্টা-অব-বেংগল বলা যায়। মুসাবিদাকারীকে ধন্যবাদ। কংগ্রেস ও কৃষক-প্রজা নেতাদেরে ধন্যবাদ। এ সব কথা বলিয়া শেষে বলিলাম : আমার সামান্য একটু সংশোধনী প্রস্তাব আছে। নেতাদের উজ্জ্বল মুখ হঠাৎ অন্ধকার হইয়া যাইতেছে দেখিয়া তাড়াতাড়ি যোগ করিলাম : এটাকে সংশোধন বলা অন্যায় হইবে শুধু ক্রমিক, নম্বরের একটু ওলট-পালট মাত্র।

৮. কংগ্রেস-নেতাদের অদূরদর্শিতা

মিঃ গুপ্তের পঠিত শর্তনামায় ক্রমিক নম্বর ছিল এইরূপ: (১) স্বরাজ দাবির প্রস্তাব গ্রহণ, (২) রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি, (৩) প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন, (৪) মহাজনী আইন পাস ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি প্রস্তাব করিলাম যে শুধু ২নং দফাঁকে ৩নং ও ৪নং দফার নিচে আনিয়া ক্রমিক নম্বর সংশোধন করা হউক। আমার এই প্রস্তাবের সমর্থনে আমি যা বলিলাম তার সংক্ষিপ্ত সার-মম এই রাজনৈতিক বন্দী মুক্তির প্রশ্নে লাট সাহেব যদি ভেটো করেন তবে মন্ত্রিসভাকে আলু-সম্মানের খাতিরে পদত্যাগ করিতে হইবে। কংগ্রেস-নেতাদের কেউ কথায় কেউবা মাথা ঝুকাইয়া আমার কথায় সায় দিলেন)। সে অবস্থায় আইন-পরিষদের পুননির্বাচন হইতে পারে। (এ কথায়ও কংগ্রেস নেতারা সায় দিলেন)। সে নির্বাচনে কৃষক-প্রজা সমিতি মুসলিম লীগের কাছে হারিয়া যাইবে। কারণ সকলেই জানেন, নির্বাচনের সময় তারা কৃষক প্রজা-সমিতিকে কংগ্রেসের লেজুড় আখ্যা দিয়াছে এবং কৃষক-খাতকের কল্যাণের সমস্ত ওয়াদাকে ভাওতা বলিয়া অভিহিত করিয়াছে। এখন যদি কৃষক ও খাতকদের হিতের কোনও আইন পাস না করিয়াই আমরা রাজনৈতিক ইতে পদত্যাগ করি, তবে মুসলিম লীগের সেই মিথ্যা অভিযোগকে সত্য প্রমাণ করা হইবে। অতএব আমার নিবেদন এই যে, মন্ত্রিসভা আগে কৃষক-প্রজা সমিতির ওয়াদা-মাফিক প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন করিবেন, ধাতকদেরে রক্ষার জন্য মহাজনি আইন পাস করিবেন, এবং কৃষি-খাতকদের জন্য সালিশী বোর্ড গঠন করিবেন। এসব কাজ করিবার পর রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির ব্যবস্থা করিবেন, এবং বিনা বিচারে আটকের আইন বাতিল করিকেন। লাট সাহেব এতে বাধা দিলে আমরা মন্ত্রিসভা হইতে এবং আইন-পরিষদ হইতে সদলবলে পদত্যাগ করিব, পুননির্বাচনের দাবি করিব। গোটা দেশবাসী আমাদের সমর্থন করিবে। সে নির্বাচনে কংগ্রেস সমস্ত হিন্দু সীট এবং কৃষক-প্রজা সমিতি সমস্ত মুসলিম শীট দখল করিবে।

সমবেত মুসলিম নেতাদের প্রায় সকলেই আমার কথার সমর্থন করিলেন। কিন্তু কংগ্রেস-নেতারা তা করিলেন না। তাঁরা আবেগময়ী ভাষায় বলিলেন রাজনৈতিক বন্দী-মুক্তির প্রশ্নটা জাতীয় সম্মান-অসম্মানের প্রশ্ন। বিশেষতঃ আন্দামান দ্বীপে তখন শত শত বাংগালী রাজনৈতিক বন্দী অনশন করিয়া জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে উদ্বেগজনক সময় অতিবাহিত করিতেছেন। এই প্রশ্নের সাথে কৃষক-খাতকের অর্থনৈতিক প্রশ্নের তুলনা হইতে পারে না।

উভয় পক্ষ হইতেই যুক্তি-তর্ক দেওয়া হইতে লাগিল। কিন্তু উভয় পক্ষ অটল রহিলেন। চার-পাঁচ ঘন্টা আলোচনায় এই অচল অবস্থার কোনও অবসান ঘটিল না। রাত প্রায় একটায় সময় সভা ভাগিয়া গেল। সকলেই বিমর্ষ হইয়া মিঃ গুণ্ডের বাড়ি হইতে বাহির হইলাম।

এই ঘটনা ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু-নেতাদের অদূরদর্শী অনুদারতায়কিতাবে ছোট-ছোট ব্যাপার হইতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে দূরত্ব প্রসারিত হইয়াছে, এই ঘটনা তার একটা জামান প্রমাণ। যদি ঐদিন কংস কৃষক-প্রজা পার্টিতে আপোস হইয়া যাইত, তবে কি হইত একবার অনুমান করা যাক। হক সাহেবের মত সবল ও জনপ্রিয় নেতা কংগ্রেসের পক্ষে থাকিতেন, মুসলিম লীগে যাইতে বাধ্য হইতেন না। বাংলার কৃষক-প্রজারা কংগ্রেসের প্রতি আস্থাশীল হইত।

অধ্যাপক হুমায়ুন কবির নবাবধাদা হাসান আলী ও আমি নবযাদার বাড়িতে বসিয়া চরম অস্বস্তির মধ্যে ব্যাপারটার পর্যালোচনা করিলাম। কংগ্রেস-নেতাদের আবেগময়ী বক্তৃতার জবাবে শেষ পর্যন্ত আমরা রাজনৈতিক বন্দী মুক্তির দফাটা দুই নরে রাখিতেও রাখী হইয়াছিলাম, কেবল শর্ত করিয়াছিলাম যে লাট সাহেব ঐ প্রস্তাব ভেটো করিলে মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করিবেন না। পদত্যাগ যদি করিতেই হয়, তবে প্রজাস্বত্ব ও মহাজনি আইন পাস করার পরই তা করা হইবে। কংগ্রেস-পক্ষ তাতেও রাযী হন নাই। আমরা তিন বন্ধুতে পর্যালোচনা করিয়া একমত হইলাম যে শরৎ বাবুকংগ্রেস-নেতাদের এই মনোতাবে অসন্তুষ্ট ও দুঃখিত হইয়াছেন। তিনি এই ইশুতে আপোস-রফা ভাংগিয়া দিতে রাখী ছিলেন না। অতএব আমরা ঠিক করিলাম রাজনীতির পাশ কর শরৎ বাবুর সাথে একা দেখা করিতে হইবে। এই রাত্রেই করিতে হইবে। কারণ আমাদের চক্ষে ঘুম নাই। আর একরাত্রে কত কি হইয়া যাইতে পারে।

৯. কংগ্রস-কৃষক প্রজা আপোস-চেষ্টা ব্যর্থ

যেমন কথা তেমনি কাজ। আমরা তিন বন্ধুতে গেলাম হক সাহেবের বাড়ি। তাঁকে অনেক বুঝাইয়া নিয়া গেলাম শরৎ বাবুর বাড়িতে। রাত্রি তখন আড়াইটা কি তিনটা। অনেক ডাকাডাকি করিয়া দারওয়ানকে জাগাইলাম। তার আপত্তি ঠেলিয়া ভিতরে গেলাম। হক সাহেবের নামের দোহাই-এ দারওয়ান অনিচ্ছা সত্ত্বেও উপরে গেল। প্রায় পনর বিশ মিনিট পরে মিসেস বোস নিচে নামিয়া আসিয়া জানাইলেন। তিনি খুবই দুঃখিত, শরৎ বাবুর মাথা ধরিয়াছে। বেদনায় ছটফট করিয়া এইমাত্র তিনি একটু সুমাইয়াছেন। তিনি কিছুতেই তাঁর ঘুম ভাংগাইবেন না।

আমরা অগত্যা নিরাশ হইয়া ফিরিয়া আসিলাম। হক সাহেব শরৎ বাবুর উপর যা রাগিয়াছিলেন, তার সবটুকু ঢালিলেন আমাদের উপর। বিনা বাক্যব্যয়ে হক সাহেবের গালাগালি মাথায় লইয়া তাঁকে তাঁর বাসায় পৌঁছাইয়া দিলাম। আমরা সকলে একমত হইলাম যে কংগ্রেস নেতৃত্বের দোষে আজ বাংলার কপাল পুড়িল। পরবর্তী ঘটনাবলী আমাদের এই আশংকার সত্যতা প্রমাণ করিয়াছে।

ও-দিকে গুপ্ত সাহেবের বাড়িতে আমাদের আলোচনা-সভা চলিতে থাকা কালে মুসলিম লীগের এজেন্টরা কাছে-ন্যদিকেই ওৎ পাতিয়া সময় কাটাইতেছিলেন। আমাদের আপোস-রফা ভাংগিয়া যাওয়ার পরক্ষণেই তারা আমাদের সেক্রেটারি মৌঃ শামসুদ্দিন আহমদকে একরূপ কিডন্যাপ করিয়া ঢাকার নবাব বাহাদুরের বাড়িতে নিয়া যান। মুসলিম লীগ নেতাদের অনেকেই সেখানে অপেক্ষা করিতেছিলেন। শামসুদ্দিন সাহেবের সহিত তারা আলোচনা করেন। শরৎ বাবুর বাড়ি হইতে সবে মাত্র আমরা হক সাহেবের বাড়িতে পৌঁছিয়াছি, অমনি শামসুদ্দিন সাহেব হাঁপাইতে-হপাইতে খবর লইয়া আসিলেন, হক সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী মানাসহ কৃষক-প্রজা পার্টির সমস্ত কার্যক্রম মানিয়া লইয়া মুসলিম লীগ আমাদের সাথে কোয়ালিশন করিতে রাযী হইয়াছেন। তখনকার মানসিক অবস্থায় হক সাহেব স্বভাবতঃই সোল্লাসে ঐ প্রস্তাব মানিয়া লইলেন। আমরাও অগত্যা সম্মতি জানাইলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *