কৃষক-প্রজা পার্টির ভূমিকা
বারই অধ্যায়
১. হক মন্ত্রিসভায় অনাস্থা
হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কৃষক-প্রজা-কর্মীদের অসন্তোষের ফলে ক্রমে সকল শ্রেণীর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিল। মন্ত্রীদের অন্তর্বিরোধের বিভিন্ন খবর সংবাদপত্রে বাহির হইতে লাগিল। শেষ পর্যন্ত মৌঃ সৈয়দ নওশের আলী সাহেবের সহিত মন্ত্রিসভার বিরোধ বাধিল। কিন্তু নওশের আলী সাহেব পদত্যাগ করিতে অস্বীকার করায় হক সাহেব নিজেই পদত্যাগ করিয়া নওশের আলীকে বাদ দিয়া পুনরায় দশজন মন্ত্রীর মন্ত্রিসভা গঠন করেন ১৯৩৭ সালে অক্টোবর মাসে। ফলে হক সাহেব ছাড়া তাঁর মন্ত্রিসভায় কৃষক-প্রজা পার্টির কেউ রহিলেন না। এইভাবে বৎসরাধিক কাল চলিয়া গেল। কৃষক-প্রজার কোন কাজই হইল না। ক্লাউড কমিশন গঠন করিয়া জমিদারি উচ্ছেদের প্রশ্নটা শিকায় তুলা হইল। এমনকি ১৯৩৫ সালে পাস-করা প্রাথমিক শিক্ষা আইন ও ১৯৩৬ সালের পাস-করা কৃষি-খাতক আইনটি পর্যন্ত প্রয়োগ করা হইল না।
কৃষক-প্রজা পার্টির কৃষক সমাজের পুঞ্জীভূত অভিযোগের সংগে কংগ্রেসের রাজনৈতিক বন্দী-মুক্তির প্রশ্নটা যোগ দিল। শহরে-মফস্বলে, রাস্তা-ঘাটে, হাটে বাজারে হক মন্ত্রিসভার নিন্দায় আকাশ-বাতাস মুখরিত হইতে লাগিল। কৃষক-প্রজা নেতা হক সাহেবের মন্ত্রিসভাকে জমিদার-মন্ত্রিসভা আখ্যা দেওয়া হইল। কথাটা সত্যও বটে। কারণ দশজন মন্ত্রীর মধ্যে ছয় জনই জমিদার। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৮ সালের এপ্রিলে বাজেট সেশনেই হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দেওয়া হইল। আশা করা গিয়াছিল হক মন্ত্রিসভার পতন অবশ্যম্ভাবী।
কিন্তু এই অনাস্থা প্রস্তাবই হক মন্ত্রিসভার শাপে বর হইল। ইহাতে মন্ত্রিসভার অন্তর্বিরোধই যে শুধু দূর হইল তা নয়, অন্ততঃ মুসলিম জনমতের মোড় ঘুরিয়া গেল। একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। মরহুম হাকিম মসিহুর রহমানের সাহেবের পুত্র হাকিম শামসুযযামানের ধর্মতলাস্থ ডিসপেনসারি আমাদের আড্ডা ছিল। এই খানে বসিয়া আমরা হক মন্ত্রিসভার মুন্ডপাত করিতাম। হাকিম সাহেব স্বয়ং হক সাহেবের নিন্দায় সবচেয়ে বেশি গলায় ছিলেন। অনাস্থা প্রস্তাব দেওয়ার পর তার সাফল্যের চেষ্টায় আমি কলিকাতায় আসিয়াছি। বরাবরের অভ্যাস মত হাকিম সাহেবের ডিসপেনসারিতে গেলাম। হাকিম সাহেব আমাকে দেখামাত্র বলিলেন : হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা দিয়া কৃষক-প্রজা পার্টি ঘোরর অন্যায় কাজ করিয়াছে। আমাকে অবিলম্বে এ কাজে পার্টিকে বিরত করিতে হইবে। আমি বিস্মিত হইয়া চলিলাম : আপনে এটা কি কইতেছেন? হক মন্ত্রিসভার নিন্দায় আপনে ত আমার চেয়ে অনেক বেশি যান। হাকিম সাহেব কিছুমাত্র অপ্রস্তুত না হইয়া বলিলেন : ‘ঠিক। এখনও তা করি। হক মন্ত্রিসভাকে আমি চাবুক মারতে চাই। কিন্তু আপনারা যে চাবুক ফেলে বন্দুক ধরেছেন।’
এই একটি মাত্র কথার মধ্যে হক মন্ত্রিসভার প্রতি মুসলিম জনমত প্রতিবিম্বিত হইয়াছে। ট্রেন-বাসের যাত্রীরা চা-খানার আলাপীরা এই কথাই বলিয়াছে। হক সাহেবের মন্ত্রিসভা আদর্শ মন্ত্রিসভা নয়, এ কথা সত্য কিন্তু এটা ভাংগিলে এর চেয়ে ভাল মন্ত্রিসভা হইবে না। যা হইবে তা এর চেয়ে খারাপ হইবে। তা হইবে পুরাপুরি। জমিদার মন্ত্রিসভা এই ধারণা জনসাধারণের মধ্যে সার্বজনীন হইয়া পড়িয়াছিল। তর্ক করিলে বলা হইত ও ‘হক মন্ত্রিসভা কৃষক-প্রজার কোন হিত করিতেছে না ঠিক, কিন্তু অহিতও কিছু করিতেছে না। এটাও কম কথা নয়’ এটাই ছিল সাধারণভাবে মুসলিম জনমত।
২. আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের ভবিষ্যদ্বাণী
হিন্দু জনমতের এক অংশ যে হক মন্ত্রিসভার সমর্থক তার প্রমাণ পাইলাম আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের দরবারে। আমি আচার্য রায়ের একজন অনুরক্ত ভক্ত ছিলাম। বিজ্ঞানের এক হরফ না জানিয়াও আমি আচার্য রায়ের একজন স্নেহের পাত্র ছিলাম। কলিকাতা ছাড়ার পরেও আমি সুযোগ পাইলাম আচার্য রায়ের বিজ্ঞান কলেজস্থ আস্তানায় হাযির হইতাম। ৯২ নং আপার সার্কুলার রোডস্থ বিজ্ঞান-কলেজের বিশাল ইমারতের পিছন দিককার একটি কামরাই ছিল এই বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর বাসস্থান। একটি দড়ির খাঁটিয়াই ছিল তাঁর শয়ন-শয্যা। এতে তিনি অর্ধশায়িত থাকিয়া ভক্তগণকে উপদেশ দিতেন। খাঁটিয়ার সামনে মেঝেয় পাতা থাকিত একটা বিশাল শতরঞ্জি। সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী ভক্তেরা এই শতরঞ্জিতে বসিয়াই তাঁর কথা শুনিতেন। আমিও তাঁদের মধ্যে বসিয়া গুরুদেবের উপদেশ শুনিতাম। আচার্য রায়ের কাজ ও চিন্তা-ধারার একটা দিক আমাকে মোহবিষ্ট করিয়াছিল। আচার্য রায় ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর মতই নির্বিলাস ‘প্লেইন লিভিং হাই থিংকিং’-এর চিন্তা-নায়ক। তবু আচার্য রায়ের নৈকট্য ও সান্নিধ্য আমার কাছে যেমন অনির্বচনীয় আকর্ষণীয় ছিল, মহাত্মাজীর নৈকট্যও তেমনি ছিল না। মহাত্মাজীর কঠোর বৈরাগ্যের দরবারের আবহাওয়ার মধ্যেও যেন এটা কৃত্রিম রাজকীয়তা বোঝার মত আমার বুকে পীড়া দিত। আচার্য রায়ের দরবারে এই কৃত্রিমতা আমি অনুভব করিতাম না। তার বদলে আমি যেন কল্পনায় প্রাচীনকালের মুনি-ঋষির তপোবনের শান্ত-শীতলতায় ডুবিয়া যাইতাম। তাঁর মত লোকের স্নেহ পাইবার কোনও যোগ্যতা বা অধিকার আমার ছিল না। তবু আমার প্রতি তাঁর অতিরিক্ত নেহাদর তাঁর অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বস্ত ছাত্রকেও বিস্মিত করিয়া দিত। অন্য কেউ তাঁকে যে কাজে– রাযী কইতে পারেন নাই, আমি তাঁকে অনেকবার তেমন কাজে রাযী করাইয়াছি। অসুস্থতাহেতু তিনি যে সব সভায় যাওয়া বাতিল করিয়াছেন, তার অনেক গুলিতে আমি গিয়া তাঁকে ধরিয়া আনিয়াছি। ১৯৩০ সালে আলবার্ট হলে নয়রুল-অভ্যর্থনার সভা ছিল এমনি একটি উপলক্ষ্য। উদ্যোক্তাদের সকলের এবং বিজ্ঞান কলেজের অধ্যাপকদের সমবেত চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আমি গিয়া আচার্য রায়কে ধরিয়া আনি। তিনি আমার কাঁধে তর করিয়া সভায় যোগ দেন।
১৯৩৮ সালে এপ্রিল মাসে আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশনে হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কৃষক-প্রজা পার্টির পক্ষ হইতে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করা হয়। কংগ্রেস দল এক বাক্যে তা সমর্থন করে। দেশময় হৈ চৈ। কলিকাতা গরম। রেলে-ট্রামে হোটেল চাখানায় তুমুল বাদবিতন্ডা। এই সময় আমি একদিন আচার্য রায়ের দরবারে হাযির। আমাকে দেখিয়াই তিনি বলিলেন : ‘শোন মনসুর, আমি রাজনীতি বুঝি না। রাজনীতিক ব্যাপারে নাকও গলাই না কিন্তু আমার অনুরোধ হক মিনিস্ট্রির বিরুদ্ধে তোমরা যে অনাস্থা দিয়েছে, অবিলম্বে তা প্রত্যাহার কর।‘
জবাবে আমি হক সাহেবের বিশ্বাস ভংগ ও হক মন্ত্রিসভার অকর্ম ও কুকর্মের লম্বা ফিরিস্তি দিলাম। আচার্য রায়ের মন জয় করিবার মতলবে হক সাহেবের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগও আনিলাম। আচার্য রায় ধৈর্যের সাথে সব কথা শুনিলেন। বিশাল মোচের নিচে তিনি মুচকি হাসিতে থাকিলেন। আমার কথা শেষ হইলে তিনি তাঁর শীর্ণ হাতটি উচা করিয়া বলিলেন : “তুমি যা বললে সবই রাজনীতির কথা। আমি রাজনীতির কথা বলছি না। আমি বলছি বাংগালী জাতির ভবিষ্যতের কথা। সমস্ত রাজনীতিক সত্যের উপর আরেকটা বড় সত্য আছে। সেটা বাংগালী জাতির অস্তিত্ব। বাংগালী জাতির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নির্ভর করে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের উপর। ফযলুল হক এই ঐক্যের প্রতীক। আমি কংগ্রেসীদের ভারতীয় জাতীয়তা বুঝি না। আমি বুঝি বাংগালীর জাতীয়তা। এ জাতীয় প্রতিষ্ঠা করতে পারে একমাত্র ফযলুল হক। ফযলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাংগালী। সেই সংগে ফযলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি মুসলমান। খাঁটি বাংগালীত্বের সাথে খাঁটি মুসলমানত্বের এমন অপূর্ব সমন্বয় আমি আর দেখি নাই। ফযলুল হক আমার ছাত্র বলে এ কথা বলছি না। সত্য বলেই এ কথা বলছি। খাঁটি বাংগালীত্ব ও খাঁটি মুসলমানত্বের সময়ই ভবিষ্যৎ বাংগালীর জাতীয়তা। ফযলুল হক ঐ সময়ের প্রতীক। এ প্রতীক তোমরা ভেংগে না। ফযলুল হকের অমর্যাদা তোমরা করো না। শোন মনসুর আমি বলছি, বাংগালী যদি ফযলুল হকের মর্যাদা না দেয়, তবে বাংগালীর বরাতে দুঃখ আছে।”
কথাগুলি আচার্য রায় আমার চেয়ে সমবেত অধ্যাপক ও ছাত্রদের উদ্দেশ্য করিয়াই বলিয়াছিলেন বেশি। তাঁর কথাগুলি কোনও ব্যক্তির মুখ হইতে আসিতেছিল না। আমার মনে হইতেছিল কথাগুলি ভবিষ্যৎ বাণীর মতই বাহির হইতেছিল কোন গায়েবী ‘অরেকলের’ মুখ হইতে। আমি ভিতরে ভিতরে একেবারে মুষড়াইয়া গেলাম। মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কাজ করিবার উৎসাহ উদ্যম একেবারে হিম হইয়া গেল। আচার্য দেবকে কি একটা কৈফিয়ৎ দিয়া আমি ধীরে ধীরে বাহিরে আসিলাম। সারা রাস্তায় আমার কানে ও মনে আচার্য রায়ের কথাগুলি ঝংকৃত হইতে থাকিল। আজও এই ত্রিশ বছর পরেও সেই সব কথা আমার মনে ঝংকৃত হইতেছে। এটা কি ছিল দার্শনিক মানব প্রেমীর ভাবাবেগ? না, বিজ্ঞানীর বাস্তব-দর্শন? যখনই দেশ ও জাতির কথা, জনগণের কথা, ভাবিতে চাই তখনই এই দুই মহাপুরুষের মুখ আমার চোখে ভাসিয়া উঠে। কি করিতে গিয়া কি করিয়াছিলাম! আচার্য রায়ের নির্দেশ পার্টি নেতাদের কাছে। বলিয়াছিলাম বোধ হয়। কিন্তু কেউ বোধ হয় কানে তুলেন নাই।
৩. হক মন্ত্রিসভার কৃতিত্ব
আচার্য রায়ের মত শ্রদ্ধেয় ও প্রভাবশালী বিজ্ঞানীর এই অভিমত আমার মত অনেক হিন্দু নেতাকেও নিশ্চয়ই প্রভাবিত করিয়াছিল। যা হোক, কলিকাতার মুসলিম জনমত আমাদের বিরুদ্ধে একেবারে ক্ষিপ্ত হইয়া ফাটিয়া পড়িয়াছিল। অবশ্য একথাও ঠিক তারা যে যতটা ক্ষিপ্ত হইয়াছিল, ডিমনস্ট্রেশন হইয়াছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। শহীদ সাহেবের মত সংগঠনী প্রতিভা মিছিল-প্রসেশন দিয়া একেবারে কলিকাতা মাথায় তুলিয়া লইয়াছিলেন। এমনি এক উত্তেজিত সংঘবদ্ধ জনতা অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ও আমাকে আক্রমণ করিয়া আহত করিয়াছিল। আহত অবস্থায় আমরা পার্শবর্তী বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। ক্ষিপ্ত জনতা সে বাড়ি ঘেরাও করিল। অল্পক্ষণ পরেই হক সাহেব, নবাব হবিবুল্লাহ ও সার নাযিমুদ্দিন আসিয়া আমাদিগকে জনতার হাত হইতে রক্ষা করেন। আমাদের মধ্যে অকৃতজ্ঞ কেউ কেউ বলিতে লাগিলেন : ‘উহারাই আমাদের পিটাইবার জন্য আগে লোক পাঠাইয়া দিয়াছেন এবং পরে আমাদের রক্ষা করিতে আসিয়াছেন।‘ কৃষক-প্রজা পার্টির মেম্বারদের পক্ষে কলিকাতার রাস্তা-ঘাটে চলাফেরা বিপজ্জনক হইয়া পড়িল। অনাস্থা প্রস্তাব আলোচনার জন্য আইন পরিষদের বৈঠকের একদিন আগে হইতেই সমস্ত অপযিশন মেম্বরকে আইন পরিষদের দালানে স্থান দেওয়া হইল। এত করিয়াও আমরা হারিয়া গেলাম। হক মন্ত্রিসভা টিকিয়া গেল।
অনাস্থা-প্রস্তাবের ফলে একটি লাভ ও দুইটি অনিষ্ট হইল। লাভ হইল এই যে দেশের কিছু কাজ হইল। যে মন্ত্রিসভা বিশেষ কিছু কাজ না করিয়া প্রায় বছর কাল সময় কাটাইয়াছিল, তারাই ঝট পট করিয়া কতগুলি ভাল কাজ করিয়া ফেলিল। ১৯৩৮ সালের মধ্যেই সালিশী বোর্ড স্থাপন শেষ হইল। ১৯৩৯ সালের মধ্যে কৃষক প্রজার দাবি মত প্রজাস্বত্ব আইন পাস হইল ও মুসলিম লীগের দাবি মত কলিকাতা মিউনিসিপাল আইন সংশোধন করিয়া কর্পোরেশনে পৃথক নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন করা হইল। ১৯৪০ সালের মধ্যে মহাজনি আইন পাস হইয়া গেল। সালিশী বোর্ড প্রজাস্বত্ব আইন ও মহাজনি আইনে বাংলার কৃষক-প্রজা ও কৃষি-খাতকদের জীবনে এক শুভ সূচনা হইল। তারা কার্যতঃ আসন্ন মৃত্যুর হাত হইতে বাঁচিয়া গেল। ফলে হক মন্ত্রিসভার এই দুই-তিনটা বছরকে বাংলার মুসলমানদের জন্য সাধারণভাবে, কৃষক প্রজা-খাতকদের জন্য বিশেষভাবে, একটা স্বর্ণ যুগ বলা যাইতে পারে।
এই কৃতিত্বের বেশির ভাগ প্রাপ্য সাধারণভাবে অপযিশনের বিশেষভাবে কৃষক প্রজা মেম্বর ও কর্মীদের। মেম্বররা ঐ অনাস্থা প্রস্তাব না দিলে এবং কর্মীরা বাইরে আন্দোলন না করিলে এই সব কাজ অত সহজে হইত না। মুসলিম লীগ মন্ত্রীদের মধ্যে এক শহীদ সাহেব ছাড়া আর সবাই ছিলেন জমিদার। তাঁদের চেষ্টায় বা ষড়যন্ত্র হক সাহেব প্রধানমন্ত্রী হইয়াও অসহায়। সামসুদ্দিন সাহেব গোড়াতেই বাদ পড়ায় এবং নওশের আলী সাহেব অল্পদিনের মধ্যে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করিতে বাধ্য হওয়ায়, এবং অবশেষে হক সাহেব মুসলিম লীগে যোগ দেওয়ায় বাংলার এই মন্ত্রিসভা সত্য-সত্যই জমিদার সমর্থিত মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা হইয়া গিয়াছিল। কৃষক-প্রজার জন্য সত্যিকার কোনও কাজ হওয়া এই মন্ত্রিসভার দ্বারা কার্যত অসম্ভব ছিল। তেমন অবস্থায় এই অনাস্থা প্রস্তাবই মন্ত্রিসভার টনক নড়াইয়াছিল।
গণতন্ত্রে অপযিশনের কর্তব্য ও অবদান এটাই। অপযিশনের চাপ ও সমালোচনাই হক মন্ত্রিসভাকে এই সব ভাল কাজে বাধ্য করিয়াছিল। কিন্তু সবটুকু কৃতিত্ব হক মন্ত্রিসভাই পাইল। অপযিশন এক বিন্দু ধন্যবাদ পাইল না! হক মন্ত্রিসভা যিলাবাদে দেশের আকাশ-বাতাস মুখরিত হইল। পক্ষান্তরে অপযিশনের ভাগ্যে জুটিল নিন্দা। অমন ভাল মন্ত্রিসভার যারা বিরোধিতা করে, তারা দেশ-হিতৈষী হইতেই পারে না। অপযিশনের এই পরোক্ষ লোকসান ছাড়া আরও দুইটা প্রত্যক্ষ লোকসান হইল। এক কৃষক-প্রজা পার্টি দুই টুকরা হইয়া গেল। ৫৮ জন মেম্বরের মধ্যে ২৮ জন মাত্র মেম্বর লইয়া আইন পরিষদের মধ্যে কৃষক-প্রজা-পার্টি গঠিত হইল। বাকী ৩০ জন হক সাহেবের সমর্থক রূপে কোয়ালিশন পার্টির মেম্বর রহিয়া গেলেন। দুই হক সাহেব কৃষক-প্রজা সমিতির সভাপতিত্বে ইস্তফা না দিয়াই প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতিত্ব গ্রহণ করায় হক সাহেবের সমর্থক কৃষক-প্রজা মেধররা তাঁদের স্বাত্ম রক্ষার বা নিজস্ব কৃষক-প্রজা-সমিতি চালাইবার কাজে হক সাহেবের পদ-মর্যাদার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা পাইলেন না। সংগঠনের বিশেষ চেষ্টাও হক সাহেব করিলেন না। অথচ কৃষক-প্রজা-সমিতির সভাপতিত্বও ছাড়িলেন না। এত দ্বন্দ্ব কলহের মধ্যেও হক সাহেবের সহিত আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালই ছিল। পার্টির নেতাদের অনুরোধে একদিন আমি তাঁকে মুসলিম লীগ ও কৃষক-প্রজা-সমিতি উভয়টার সভাপতি থাকার মত স্ববিরোধী কাজ না করিয়া একটা হইতে পদত্যাগ করিতে অনুরোধ করিলাম। তিনি সুস্পষ্ট আন্তরিকতার সাথে জবাব দিলেন যে, মুসলিম বাংলাকে বাঁচাইতে হইলে মুসলিম লীগও করিতে হইবে, কৃষক-প্রজা-সমিতিও চালাইতে হইবে। তাঁর এই সুস্পষ্ট অসংগত কথার সমর্থনে তিনি শক্তিশালী যুক্তিও দিলেন। তিনি বলিলেন : বাংলার ক্ষেত্রে প্রজা-আন্দোলন ও মুসলিম-আন্দোলন একই কথা। মুসলিম লীগ ক যেমন ভারতীয় মুসলমানের জন্য দরকার কৃষক-প্রজা সমিতি করা তেমনি বাংগালী মুসলমানের জন্য দরকার। তিনি কৃষক-প্রজা-সমিতির সভাপতিত্ব ছাড়িয়া দিয়া এটাকে কংগ্রেস-নেতাদের হাতে তুলিয়া দিতে পারে না। তেমনি মুসলিম লীগের সভাপতিত্ব ছাড়িয়া দিয়া ওটাকে খাজা-গজাদের হাতে তুলিয়া দিতে পারেন না।
৪. কৃষক-প্রজা আন্দোলনের ভূমিকা
সে সব যুক্তি অনুসারে যদি হক সাহেব কাজ করিতেন তবে হয়ত একদিন তাঁর মত সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইত। কিন্তু তা হয় নাই। তাঁর সমর্থক কৃষক-প্রজা মেম্বরদের অস্তিত্ব আস্তে-আস্তে মুসলিম লীগের তলে চাপা পড়িয়া গেল। স্বয়ং হক সাহেব মুসলিম লীগের সভাপতি হওয়ায় কৃষক-প্রজা সমিতির ঐ অংশ কার্যতঃ মুসলিম লীগের মধ্যে মার্জ হইয়া গেল। পক্ষান্তরে ঐ একই অবস্থা-গতিকে কৃষক প্রজা সমিতির আমাদের অংশ আস্তে আস্তে কার্যতঃ কংগ্রেসের শাখা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইয়া গেল।
পরবর্তী দুই-তিন বছরের মধ্যেই বাংলার কৃষক-প্রজা পার্টির অস্তিত্ব লোপ পাইল। এই জন্যই অনেক রাষ্ট্র বিজ্ঞানী হক সাহেবকে বাংলার ম্যাকডোনান্ড বলিয়া থাকেন। অনেকের মতে মিঃ রামযে ম্যাকডোনান্ডই নিজ হাতে লেবার পার্টি গঠন করিয়াছিলেন। তিনি নিজ হাতেই তা ভাংগিয়া গিয়াছেন, হক সাহেবও বাংলার প্রজা-পার্টির যুগপৎভাবে সৃষ্টিকর্তা ও সংহার-কর্তা। বিলাতের লেবার পার্টি আবার পূনর্জন্ম লাভ করিয়াছে এবং অধিকতর শক্তিশালী হইয়াই জন্মিয়াছে। বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি এবারের মত চূড়ান্তভাবে মরিয়াছে। লেবার পার্টির পুনর্জন্মের কারণ তার উদ্দেশ্য এখনও সফল হয় নাই; ইংলন্ডে সমাজবাদ আজও প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। বাংলার কৃষক-প্রজা পার্টির আদর্শ সমাজবাদের মত সুদূরপ্রসারী কর্মপন্থা ছিল না। এর আদর্শও খুব বিপ্লবাত্মক হইলেও সেটা ছিল সীমাবদ্ধ। ‘লাংগল যার মাটি তার’ এটা কৃষক-প্রজা পার্টির বামপন্থী দলেরই শ্লোগান ছিল। নেতারা এতে বিশ্বাস করিতেন না। নেতাদের দৃষ্টি ছিল অন্যদিকে। বাংলার প্রজা-আন্দোলন একটা মুসলিম-আন্দোলন বটে। আচার্য রায় ঠিকই বলিয়াছিলেন, কৃষক-প্রজা নেতা হক সাহেব মাথার চুল হইতে পায়ের নখ পর্যন্ত মুসলমান। তাঁর নেতৃত্ব কাজেই নিজ কৃষক-নেতৃত্ব ছিল, ছিল মুসলিম নেতৃত্ব। প্রজা-পার্টির অভিযোগে শুধু অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি ছিল, সামাজিক মর্যাদার দাবিও ছিল আমার নিজের বেলা যেমন জমিদারের কাঁচারিতে মুসলমান প্রজাদের বসিবার আসনের এবং সম্মানজনক সোধনের দাবি হইতেই আন্দোলন শুরু হইয়াছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবিকল তাই হইয়াছিল। কংগ্রেসের এবং কিষাণ সভার বন্ধুরা বাংলার প্রজা-আন্দোলনকে মুসলমান জোতদারদের আন্দোলন বলিতেন। তাঁদের এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল না। কৃষক-প্রজা আন্দোলন যে সময় খুবই জনপ্রিয় আন্দোলন কৃষক-প্রজা-সমিতি যখন খুবই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, সেদিনেও বর্গাদারদেদখলী স্বত্ব দেওয়ার প্রশ্নে অনেক প্রজা নেতাই ছাঁৎ করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেন। সার আব্দুর রহিম, মৌলবী আবদুল করিম, খান বাহাদুর আবদুল মোমিন প্রভৃতি বড়-বড় মুসলিম নেতার প্রজা-সমিতির কর্মকর্তা থাকা হইতেই প্রজা-সমিতির মধ্যকার রূপ বোঝা যায়। সোজা কথায় প্রজা আন্দোলন ছিল সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আন্দোলন। সামন্ত-রাজদের বিপুল সংখ্যাধিক লোক হিন্দু হওয়ায় মুসলমানদের মধ্যবিত্তেরা এই সামন্ততন্ত্রের কোনও সুবিধা না পাওয়ায় মুসলমানদের মধ্যে প্রজা-আন্দোলনের এতটা জনপ্রিয় হইয়াছিল। সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে মুসলমান শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ক্রোধের কারণ এই হইতেই বোঝ যাইবে যে হিন্দু সামন্ত-রাজদের চাকুরি-বাকুরি ত দূরের কথা, যে কজন মুসলমান সামন্ত ছিলেন তাঁদের চাকুরিগুলিও মুসলমানরা পাইত না। চাকুরি-বাকুরি ছাড়াও সামন্ত-রাজেরা মামলা-মোকদ্দমা আমোদ-প্রমোদ বিলাস-বাসনে যে অজস্র টাকা ব্যয় করিতেন, তাও হিন্দুরা পাইত। কাজেই বাংলার এজা-আন্দোলন মূলতঃ এবং প্রধানতঃ হিন্দু সামন্ত-তন্ত্রের বিরুদ্ধে মুসলিম মধ্যবিত্তের আন্দোলন। এই আন্দোলনে সমাজবাদী ও সাম্যবাদী বামপন্থী এক দল কর্মী ছিলেন বটে, এবং তাঁদের চেষ্টায় প্রজা-আন্দোলন বাধ্য হইয়া কৃষক আন্দোলনের আকৃতি প্রকৃতিও কিছুটা পাইয়াছিল বটে, কিন্তু স্বাভাবিক ও ঐতিহাসিক কারণেই তাঁরা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব পান নাই। মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের মধ্যে হক সাহেবই ছিলেন একমাত্র গণ-নেতা ম্যান-অব-দি মাসে। তিনি বিপুল কর্মী সুচতুর টেকনিশিয়ান রাজনৈতিক ম্যাজিশিয়ান ও কৌশলী যোদ্ধা ছিলেন। তিনি জনগণের ভাষায় জনগণের যুক্তি দিয়া জনগণকে নিজের কথা বুঝাইতে পরিতেন। তাঁর কথায় ও কাজে ইমোশন ছিল। ঈর বুকে দরদ ছিল। কাজেই এ দরদী ভাব প্রবণ নেতাকে ভাবালু জনসাধারণ অতি সহজেই বুঝিতে পারিত।
৫. হক-নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য
এমন নেতা যেদিন এক পকেটের কৃষক-প্রজা পার্টি এবং আরেক পকেটে মুসলিম লীগ লইয়া মাঠে নামিলেন, এবং দুদিন আগে-কওয়া কথার বিপরীত কথা বলিতে লাগিলেন, জনসাধারণ সেদিনও তাঁর কথা মানিয়া লইল। ডাল ভাতের যুক্তি দিয়া দুদিন আগে তিনি মুসলিম লীগের ‘মুসলমান ভাই ভাইর’ যে কথাটাকে একটা হাস্যকর ভন্ডামি বলিয়া উড়াইয়া দিয়াছিলেন এবং জনসাধারণও উহাকে বিদ্রূপ করিয়াছিল, দুই দিন পরে সেই হাস্যকর কথাকেই তিনি জনপ্রিয় সত্যে পরিণত করিলেন। মুসলিম লীগ নেতাদের মুখে যেটা শুনাইত অবিশ্বাস্য হাস্যর উক্তি, হক সাহেবের মুখে সেটাই শুনাইত ঘোরতর সত্য কথারূপে। তিনি যেদিন মাঠে নামিয়া বলিলেন : প্রজা-সমিতিও দরকার, মুসলিম লীগও দরকার, তখন জনসাধারণও তাই বিশ্বাস করিল। আমরা কৃষক-প্রজা পার্টির ঝাণ্ডা খাড়া রাখিবার চেষ্টা করিয়া হক সাহেবের স্থলে মওলানা আব্দুল্লাহিল বাকীকে সভাপতি করিলাম। কৃষক-প্রজা সমিতির সংগঠনে মনও দিলাম। কিন্তু হক সাহেবের জনপ্রিয়তার সংগে সরকারী শক্তির যোগ হওয়ায় তার দুর্বার স্রোতের মুখে আমরা ভাসিয়া গেলাম।
আচার্য রায় ঠিকই বলিয়াছিলেন : হক সাহেব খাঁটি মুসলমানও বটে, তিনি খাঁটি বাংগালীও বটে। অনাস্থা প্রস্তাবে জিতিয়াও তিনি অল্পদিনেই বুঝিলেন একদিকে মুসলিম সংহতি প্রচারের দ্বারা অপরদিকে কৃষকপ্রজা পার্টিকে ধ্বংস করিয়া দুইদিক হইতেই তিনি বাংলার নেতৃত্ব অবাংগালীর হাতে তুলিয়া দিতেছেন। তিনি নিজে যাইতেছেন মুসলিম লীগের দিকে; আর তাঁর দুঃখের দিনের সহকর্মীদের ঠেলিয়া দিতেছেন তিনি কংগ্রেসের দিকে। এ দুইটার নেতৃত্বই বাংলার বাইরে। নিজে প্রধানমন্ত্রী হইয়াও মন্ত্রিসভার মধ্যে তিনি মাইনরিটি হইয়া পড়িয়াছেন এটা তিনি সহজেই বুঝিতে পারিলেন।
এটা তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন বিশেষভাবে প্রজাস্বত্ব আইন পাস করার সময়। কোয়েলিশন পার্টিতে সচ্ছল মেজরিটি থাকায় আইন পরিষদে বিলটি পাস হইল বটে কিন্তু লাট সাহেব উক্ত আইনের দস্তখত দিতে গড়িমসি করিতে লাগিলেন। উক্ত আইনের বড় লাটের অনুমোদন লাগিবে বলিয়াও লাটসাহেব মত প্রকাশ করিলেন। শোনা যায় স্বয়ং মন্ত্রীদের কারো-কারো কথায় লাট সাহেব ঐ রূপ করিয়াছিলেন। অবশেষে হক সাহেব পদত্যাগের হুমকি দিলে লাট সাহেব প্রজাস্বত্ব আইনে দস্তখত দেন। তাই হক সাহেব সাবধান হইবার চেষ্টা করিলেন। তিনি প্রজা নেতাদের সংগে আপোস করিয়া মন্ত্রিসভার ভিতরে অধিকতর শক্তিশালী হওয়া দরকার বোধ করিলেন। এ দরকার যরুরী হইয়া পড়িয়াছিল। ১৯৩৮ সালের অক্টোবর মাসে মৌঃ তমিমুদ্দিনের নেতৃত্বে একদল সদস্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রজা পার্টি নামে দল করিয়াই ইতিমধ্যে কোয়েলিশন পার্টি হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছিলেন। তাই হক সাহেব মৌ শামসুদ্দিন ও মৌঃ তমিযুদ্দিন উভয়কে মন্ত্রী করিয়া কৃষক-প্রজা পার্টি ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রজা পার্টি উভয় দলের সহিত মিটমাট করার প্রস্তাব দেন। উক্ত দুই পার্টির যুক্ত বৈঠকে কতিপয় শর্ত পেশ করা হয়। প্রধান মন্ত্রী সব শর্ত মানিয়া নেন। ইতিমধ্যে কৃষক-প্রজা। পার্টির দৈনিক মুখপত্ররূপে ‘কৃষক’ বাহির হইল। আমি তাঁর সম্পাদকতার ভার নিলাম। ফলে আমি কলিকাতার স্থায়ী বাশো হইলাম। তাতে পার্লামেন্টারি পলিটিকসে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়াইয়া পড়িলাম। সকলের চেষ্টায় ১৯৩৮ সালের নভেম্বর মাসে মৌঃ শামসুদ্দিন আহমদ ও মৌঃ তমিযুদ্দিন খাঁ হক মন্ত্রিসভায় প্রবেশ করিলেন। কৃষক-প্রজা সমিতির বিনা অনুমতিতে মৌঃ শামসুদ্দিন সাহেব মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিয়াছেন, এই অভিযোগে সমিতির কাউন্সিলের এক রিকুইযিশন সভায় অধিবেশন দেওয়া হইল। ২৩শে ডিসেম্বর হইতে তিন দিন ধরিয়া এই সভার অধিবেশন চলিল। অবশেষে হক সাহেব এই সভায় যোগদান করিলেন। হক সাহেবের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত কৃষক-প্রজা সমিতি ১২টি শর্তে শামসুদ্দিন সাহেবের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ অনুমোদন করিল। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ঐ সব শর্ত পূর্ণ করিতে না পারিলে হক সাহেব নিজেই পদত্যাগ করিবেন প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় বিক্ষুব্ধ কৃষক-প্রজা নেতৃবৃন্দ ও এম. এল. এ. গণ শান্ত হইলেন।
নির্ধারিত দিন আসিল, গেল। কিন্তু হক সাহেবের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখা হইল। ১২টি শর্তের একটিও পূর্ণ হইল না। ফলে কৃষক-প্রজা সমিতির ওয়ার্কিং কমিটি ও কৃষক-প্রজা পার্টির যুক্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হইল। শামসুদ্দিন সাহেবের বক্তব্য শুনিয়া ঐ ১২টি শর্তকে দুই ভাগে ভাগ করা হইল। তিনটিকে আশু পূরণের দাবি করা হইল। এই আশু শর্ত তিনটি পূরণের জন্য আরও পনর দিন সময় দেওয়া হইল। প্রস্তাবে বলা হইল এটাই শেষ কথা : এর পর আর সময় দেওয়া হইবে না। এই প্রস্তাবকে চরমপত্র হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিবার জন্য সমিতির প্রেসিডেন্ট মওলানা আবদুল্লাহ হিল বাকী ও আমাকে লইয়া একটা ডিপুটেশন গঠিত হইল।
তদনুসারে মওলানা সাহেব ও আমি হক সাহেবের ঝাউতলায় বাড়িতে গেলাম। তিনি পরম সমাদরে আমাদেরে অভ্যর্থনা করিলেন এবং শর্ত পূরণ করিতে না পারার অনেকগুলি যুক্তিপূর্ণ কারণ প্রদর্শন করিলেন। তার মধ্যে লাটের সাথে জমিদার মন্ত্রীদের গোপন ষড়যন্ত্রের কথাই বেশি। আমার ত বটেই স্বয়ং মওলানা সাহেবের দিলটাও নরম হইয়া গেল। হক সাহেব দুচার দিনের মধ্যে সবগুলি না হউক অন্ততঃ তিনটা আশু শর্ত পূরণ করিতে পারিবেন বলিয়া আশ্বাস দিলেন। আমরা আশ্বস্ত হইয়া বিদায় হইলাম।
৬. দুর্জ্ঞেয় হক সাহেব
কিন্তু হক সাহেব আমাকে ডাকিয়া ফিরাইলেন। আমি মওলানা সাহেবকে বিদায় দিয়া একা তাঁর ঘরে গেলাম। হক সাহেব আমাকে বসাইয়া রাখিয়া সেক্রেটারিয়েটে যাইবার সাজ-পোশাক পরিলেন। তারপর আমাকে লইয়া গাড়িতে উঠিলেন। সোজা গেলেন রাইটার্স বিল্ডিং-এ। প্রধানমন্ত্রীর কামরায় ঢুকিয়াই দেখিলাম নবাব হবিবুল্লাহ সহ কয়েকজন মন্ত্রী বসিয়া আছেন। আমার সংগে যরুরী কথা আছে বলিয়া তিনি অল্প কথায় সব কয়জন মন্ত্রীকে বিদায় করিলেন। একে একে মন্ত্রীরা সব বাহির হইয়া গেলে হক সাহেব নিজে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিলেন। প্রথমে সামনের বড় দরজাটা, তার পর অন্যান্য দরজা এবং শেষ পর্যন্ত সবগুলি জানালা নিজ হাতে বন্ধ করিলেন। ঠিক মত বন্ধ হইয়াছে কি না, ছিটকানিগুলি লাগিয়াছে কিনা, টিপিয়া-টিপিয়া দেখিলেন। আমি অবাক বিস্ময়ে বাংলার প্রধানমন্ত্রী বিশাল-বপু শেরে-বাংলা ফযলুল হক সাহেবের কার্যকলাপ দেখিতে লাগিলাম। আমার মত পদ-মর্যাদাহীন নগণ্য একটা লোকের সাথে যরূরী আলাপ করিবার জন্যই এত সাবধানতা অবলম্বন করিতেছেন, এটা বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। তবে কেন, কি উদ্দেশ্যে তিনি এত পরিশ্রম করিতেছেন? আমার কৌতূহল সীমা ছাড়াইয়া যাইতে লাগিল।
অবশেষে তিনি ফিরিয়া টেবিলের দিকে আসিলেন। কিন্তু নিজের চেয়ারে না বসিয়া আমার পাশের একটা চেয়ার টানিয়া আরও কাছে আনিয়া তাতে বসিলেন। তার পরও অতিরিক্ত সাবধানতা হিসাবে আরেক বার ডাইনে-বাঁয়ে তাকাইয়া ছোট গলায় বলিলেন : দেখ আবুল মনসুর, আজ যে কথা কইবার লাগি তোমারে এখানে লৈয়া আসছি, সেটা এতই গোপনীয় যে উপরে আরা ও নিচে তুমি আমি ছাড়া আর কেউ জানতে পারবে না। আর ওয়াস্তে ওয়াদা তুমি একথা কেউরে কইতে পারবা না। মরুবির কথা। আমি আর কি করিতে পারি। ওয়াদা করিলাম। তিনি আরেক টানে চেয়ারটা আমার আরও কাছে আনিয়া তীর বেলচার মত বিশাল হাতে আমার ডান হাতটা ধরিয়া ফেলিলেন। তারপরই দুই হাতে আমার হাতটা চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন : ‘শর্ত-টর্তের কথা ভুইলা যাও। আমি ওর একটাও পূরণ করতে পারব না। পারব না মানে করব না। ঐ সব শর্ত যদি আমি পূরণ করি, তবে কৃষক-প্রজা পার্টি ন্যায়তঃ কোয়ালিশন পার্টির অংগ হইয়া যাইতে বাধ্য। কিন্তু আমি তা চাই না। আমি চাই কৃষক-প্রজা পার্টি অপযিশনেই থাকুক। মুসলিম লীগওয়ালাদের সাথে আমার সম্পর্ক খুবই খারাপ। কখন কি হয় কওয়া যায় না। হৈতে পারে শীগগির আমাকে রিযাইন করতে হৈব। সে সিচুয়েশনে আমার একটা জাম্পিংগ্রাউও থাকার দরকার। বুঝলা ত?
আমি আর কি বুঝিব? বিস্ময়ে আমার ভালুজিত লাগিয়া গিয়াছিল। গলা শুকাইয়া গিয়াছিল। পা অবশ হইয়া আসিয়াছিল। মাথা তো তো করিতেছিল। কাজেই জবাব দিতেছিলাম না। তিনি আমার হাতে একটা যবর চাপ দেওয়ায় আমি চমকিয়া উঠিলাম। অনেক কষ্টে বলিলাম : তবে যে শামসুদ্দিনের পদত্যাগ কতেই হৈব।
আমার হাত হইতে নিজের ডান হাতটা আমার কাঁধে তুলিলেন। বলিলেন : ‘না সে পদত্যাগ করতে পারে না; তারে কিছুতেই পদত্যাগ করায়ো না। আসল কথা কি জান, আমি কোয়েলিশন পার্টিতে মাইনরিটি নই। কিন্তু ক্যাবিনেটে আমি মাইনরিটি। শামসুদ্দিন মন্ত্রী থাকলে আমার জোর বাড়ে। তুমিষুদ্দিনকে আমি পুরাপুরি বিশ্বাস করি না। তবু শামসুদ্দিন ক্যাবিনেটে থাকলে তুমিষুদ্দিন আমার পক্ষে ভোট দিব। কিন্তু সে বার হৈয়া গেলে তুমিষুদ্দিন খাজাদের সাথে যোগ দিব।‘
গোড়াতে হক সাহেবের এই অসাধু প্রস্তাবে আমি চাটয়া গিয়াছিলাম। কিন্তু ক্রমে তাঁর অসুবিধা উপলব্ধি করিলাম। তার যুক্তির সারবৃত্তান্ত আমি বুঝিলাম। তবু বন্ধুবর শামসুদ্দিনকে ওয়াদা খেলাফের অপরাধে অপরাধী করিতে এবং কৃষক-প্রজা পার্টির নির্দেশ অমান্য করায় উদ্বুদ্ধ করিতে মন মানিল না। বলিলাম : ‘সার, এটা হয় না। শামসুদ্দিন পার্টি ম্যান্ডেট অমান্য কৈরা যদি মন্ত্রিত্ব আঁকড়াইয়া থাকে, তবে তাঁর সুনাম নষ্ট হৈব, তার রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটব।’
হক সাহেব ধাক্কা মারিয়া আবার হাতটা ছাড়িয়া দিয়া গর্জিয়া উঠিলেন। বলিলেন : ওসব বাজে কথা আমার কাছে কইও না। আমি যদি শামসুদ্দিনের পিছনে দাঁড়াই তবে সে যাই করুক না কেন, তার রাজনৈতিক জীবন নষ্ট হবার পারে না। তুমি গিয়া তারে কও, আমি তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ভার নিলাম।
আমি খুবই বিভ্রান্ত হইয়া হক সাহেবের নিকট হইতে বিদায় নিলাম। কিন্তু আসল কথা। কার, কাছে বলিলাম না। সমিতির সভাপতি মওলানা বাকী সাহেবের নিকট হইতে মেরা আগেই রিপোর্ট পাইয়াছিলেন, হক সাহেব শীঘ্রই শর্ত পূরণ করিতেছেন। কাজেই আমার আর নূতন কি কথা থাকিতে পারে? ফলে আমাকে কেউ, বিশেষ কিছু জিগাস করিলেন না। মওলানা সাহেব পার্টি হাউসে থাকিতেন না, নিজের বাসায় থাকিতেন। কাজেই পরদিন সভার আগে তার সাথে আমার দেখা হইল না। পরদিন সভায় স্বয়ং সভাপতি সাহেবই হক-মোলাকাতের বর্ণনা দিলেন। তিনি বলিলেন : হক সাহেব শীঘ্রই শর্তগুলি অন্ততঃ তার বেশির ভাগ, পূর্ণ করিবেন ওয়াদা করিয়াছিলেন। কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট তারিখ দেন নাই। দীর্থ আলোচনার পর ঐদিন হইতে পনর দিন পরে পদত্যাগ করিতে শামসুদ্দিন সাহেবকে নির্দেশ দিয়া প্রস্তাব গৃহীত হইল। আমি পনর দিনের জায়গায় একমাস সময় দেওয়ার প্রস্তাব দিলাম। ইতিমধ্যে তিনমাসের বেশি সময় অতিবাহিত হইয়াছে এই যুক্তিকে আমার এক মাসের প্রভাব গ্রাথ হইল। সভাশেষে মওলানা সাহেব একা আমার সাথে কথা বলিলেন। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজিকার সভায় আমার অল্পভাষিতা মওলানা সাহেবকে চিন্তাযুক্ত করিয়াছে সে কথা তিনি বলিলেন। প্রসংগ ক্রমে আগের দিন হক সাহেবের সাথে আমার আর কি আলাপ হইল তাও জিগাস করিলেন। আমি অনেক দ্বিধা-সন্দেহ কাটাইয়া খুব সাবধানে অল্প কথায় হক সাহেবের প্রস্তাবের মূল কথাটা বলিলাম। ঐ সাথে এর সুবিধা ও যুক্তিটাও বলিলাম। মওলানা বাকী সাহেব ছিলেন তীবুদ্ধি দূরদর্শী রাজনীতিজ্ঞ। তিনি চট্ করিয়া কথাটা ধরিয়া ফেলিলেন। বলিলেন : ‘হক সাহেবের কথায় জোর আছে। এ কথা যদি সতায় আপনি বলিতেন তবে প্রস্তাব অন্য রকম হইত। যাক এখন আর সময় নাই। যা হইবার ভালই হইয়াছে। হক সাহেব যদি লীগের সহিত আংগিয়া আসেন, তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মত এই যে, তাঁকে আমাদের গ্রহণ করা উচিৎ।‘
হক সাহেবের সাথে মুসলিম লীগের বিরোধের কোনও লক্ষণ দেখা গেল না পনর দিন চলিয়া গেল।
৭. শামসুদ্দিনের পদত্যাগ
হক সাহেব শেষ পর্যন্ত তাঁর কথা রাখিলেন, অর্থাৎ একটি শর্ত পূরণ করিলেন না। কিন্তু আমি হক সাহেবের কথামত কাজ করিতে পরিলাম না। শামসুদ্দিনের সাথে গোপন আলাপে আমি হয়ত তাঁকে আভাসেইগতে হক সাহেবের মনের কথা বুঝিতে দিয়াছিলাম। ভাই শামসুদ্দিন পদত্যাগ করিতে প্রথমে অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেন। মন্ত্রী থাকার সুবিধার কথাও অনেক আলোচনা হইল। কৃষক-প্রজা পার্টির শর্তসমূহ নিশ্চিতরূপেই কৃষক-প্রজার স্বার্থের অনুকূল। প্রতমতঃ শামসুদ্দিন সাহেব মন্ত্রী থাকিয়া গেলে ঐগুলি ক্রমে ক্রমে পূর্ণ হইবার আশা থাকে। পদত্যাগ করিয়া ফেলিলে সে আশা থাকে না। দ্বিতীয়তঃ ইতিমধ্যে কৃষক-প্রজা পার্টির মুখপত্ররূপে দৈনিক ‘কৃষক’ বাহির করিয়াছিলাম। আমিই ওটার সম্পাদক। শামসুদ্দিন মন্ত্রী থাকিলে কাগজটা চালান সহজ হইবে। মন্ত্রী না থাকিলে কাগজ চালান খুবই কঠিন, হয়ত অসম্ভব হইবে। তৃতীয়তঃ ইতিমধ্যে ময়মনসিংহ জিলার টাংগাইল মহকুমার ভেংগুলা গ্রামে নিখিলবংগ কৃষক-প্রজা-সম্মিলনীর আয়োজন করা হইয়াছে। নবাবযাদা হাসান আলী অভ্যর্থনা সমিতির সেক্রেটারি ও আমি নিজে উহার চেয়ারম্যান। কৃষিমন্ত্রী হিসাবে শামসুদ্দিন সাহেব ঐ সম্মিলনী উদ্বোধন করিবেন। এসব কথা ঘোষণা ও প্রচার করা ইয়াছে। এই সময় তিনি পদত্যাগ করিলে কর্মীদের উৎসাহ উদ্যম দমিয়া যাইবে। সম্মিলনীর সাফল্য ব্যাহত হইবে। ঐ সংগে মন্ত্রিত্ব না ছাড়িবার প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া ও কুফলগুলির কথাও বিবেচনা করা হইল।
সমস্ত বিষয় ধীরভাবে বিবেচনা করিয়া অবশেষে মৌঃ শামসুদ্দিন ১৯৩৯ সনের ১৭ই ফেব্রুয়ারি এক সুদীর্ঘ বিবৃতিতে আদ্যোপান্ত সমস্ত বিষয় বর্ণনা করিয়া মন্ত্রিসভা হইতে পদত্যাগ করেন। কোনও পার্লামেন্টারি দল স্বীয় মন্ত্রীকে কল ব্যাক করা এবং কর্মসূচির ভিত্তিতে কোন মন্ত্রীর পদত্যাগ করা বাংলা ও ভারতের রাজনীতিতে ছিল উহাই প্রথম। সকলে মিলিয়া আমরা শামসুদ্দিন সাহেবের এই সাহসী পদত্যাগে ও স্বার্থত্যাগে তাঁকে ধন্যধন্য করিলাম।
৮. শেষ কৃষক-প্রজা সম্মিলনী
নির্ধারিত তারিখে (২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৯) ময়মনসিংহ জিলার টাংগাইল মহকুমার অন্তর্গত তেংগুলা গ্রামে নিখিল বংগ কৃষক-প্রজা সম্মিলনীর অধিবেশন বসিল। আশা ছিল কৃষিমন্ত্রী হিসাবে শামসুদ্দিন সাহেবকে লইয়া আমরা ভেংগুলা নিখিল বংগ কৃষক-প্রজা সম্মিলনী করিব। আমাদের বরাতে তা আর হইল না। তবু সম্মিলনীর সৌষ্ঠব ও সাফল্যের কোনও নি হইল না। নবাবযাদা হাসান আলী অভ্যর্থনা সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি হিসাবে সম্মিলনীর সাফল্যের জন্য শারীরিক পরিশ্রম ও অসংকোচে অর্থ ব্যয় করিতে কোনও কৃপণতা করিলেন না। অজ পাড়াগাঁয়ে নিখিল বংগীয় সম্মিলনীর এমন সুন্দর প্যাণ্ডাল সুউচ্চ মঞ্চ দুই ডজন লাউডস্পিকারসহ একাধিক মাইক্রোফোন, সমাগত নেতৃবৃন্দের থাকা-খাওয়া এমন সুবন্দোবস্ত ইতিপূর্বে, এবং দেখা গেল এর পরেও, আর কখনও হয় নাই। ডেলিগেট ও দর্শকসহ প্রায় লক্ষ লোকের সমাগম হইয়াছিল বলিয়া সকলে অনুমান করিয়াছিল। সভাপতি হিসাবে মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী সাহেব খুব সারগর্ত সুচিন্তিত অভিষণ দিয়াছিলেন। ভূতপূর্ব মন্ত্রী মৌঃ সৈয়দ নওশের আলী ও মৌঃ শামসুদ্দিন সম্মিলনীতে বিপুলভাবে সম্বধিত হইয়াছিলেন। হক সাহেবের বিরুদ্ধে যাওয়ায় এবং মন্ত্রিসভা হইতে পদত্যাগ করায় উক্ত নেতৃদ্বয় ও কৃষক-প্রজা সমিতি কিছুমাত্র জনপ্রিয়তা হারাইয়াছেন মনে হইল না। বরঞ্চ দুইটি ঘটনা হইতে মনে হইয়াছিল যে গণ-মনে কৃষক-প্রজা সমিতির প্রতি যথেষ্ট টান তখনও অটুট রহিয়াছে। একটি ঘটনা এই যে কলিকাতা হইতে নেতৃবৃন্দ আসিবার কালে পিংনা স্টিমার স্টেশনের স্থানীয় ম্যারেজ রেজিস্টারের নেতৃত্বে কতিময় খায়েরখাহ ইউ.বি.প্রেসিডেন্ট নেতৃবৃন্দকে কালা নিশান দেখাইবার চেষ্টা করিয়া বিফল হন। দ্বিতীয় ঘটনা এই যে করটিয়ার জনাব মঊদ আলী খান পন্নি (নবাব মিয়া) এক দল লোক লইয়া আমাদের সম্মিলনীতে গন্ডগোল বাধাইতে আসিতেছিলেন। পথেজনসাধারণ তাঁদের বাধা দেওয়ায় তাঁরা মধ্য পথহইতে ফিরিয়া যান।
ইহাই ছিল নিখিল বংগ কৃষক-প্রজা সম্মিলনীর শেষ অধিবেশন। প্রকাশ্য অধিবেশন ত আর হয়ই নাই। সমিতির কাউন্সিলের বৈঠকও এর পর হয় নাই। কৃষক-প্রজা পার্টিই পার্লামেন্টারি ব্যাপারাদি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিত। বড় জোর সমিতির ওয়ার্কিং কমিটি ডাকা হইত। প্রতিষ্ঠান হিসাবে কৃষক-প্রজা সমিতি নির্জীব ও নিষ্ক্রিয় হইয়া পড়িবার প্রধান কারণ ছিল এই যে, খোদ কৃষক-প্রজা আন্দোলনই তার তীক্ষ্ণতা ও তীব্রতা হারাইয়া ফেলিয়াছিল। ঢিমা-তেতালা-ভাবে হইলেও হক মন্ত্রিসভা কৃষক-প্রজা ও মুসলমানদের জন্য যথেষ্ট ভাল কাজ করিয়াছিলেন এবং করিতে ছিলেন। ১৯৩৮ সালে সালিশী বোর্ড স্থাপন, ১৯৩৯ সালের প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৪০ সালের মহাজনি আইন, প্রাথমিক শিক্ষা আইন অনুসারে স্কুলবোর্ড গঠন, কলিকাতা কর্পোরেশন আইন সংশোধন করিয়া পৃথক নির্বাচন প্রবর্তন, মাধ্যমিক শিক্ষা বিল আনয়ন ইত্যাদি কাজ করিয়া ও করিতে চাহিয়া মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে হক মন্ত্রিসভা দোষে-গুণে সবচেয়ে ভাল মন্ত্রিসভা বলিয়া জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাছাড়া হিন্দু সংবাদপত্রসমূহ ও নেতৃবৃন্দ হক মন্ত্রিসভার যে সব সমালোচনা নিন্দা ও প্রতিবাদ করিতেন, তার প্রায় কোনটাই জনগণের স্বার্থে করা হইত না। প্রায় সবগুলিই করা হইত হিন্দু বা কায়েমী স্বার্থের খাতিরে। এই পরিবেশে কৃষক-প্রজা পার্টির প্রকৃত জনস্বার্থমূলক সরকার-বিরোধিতাও ভুল বুঝা হইত। কৃষক-প্রজা পার্টি কংগ্রেসীদের সাথে হাত মিলাইয়া এই মন্ত্রিসভারই পতন ঘটাইতে চায়। মুসলিম গণ মনে এই সন্দেহ বদ্ধমূল হওয়ায় তাদের মুখে ভাল কথা শুনিতেও জনসাধারণ রাযী ছিল না। ইতিমধ্যে বিশ্বযুদ্ধ বাধায় এবং জাপান প্রায় ভারত দখল করে-করে অবস্থা আসিয়া পড়ায় সভা সমিতির ও প্রচারণা প্রায় অসম্ভব হইয়া পড়ে।
১৯৪০ সালের মার্চ মাস ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটা চিরস্মরণীয় ঐতিহাসিক, গুরত্বপূর্ণ মাস। এই মাসে মিঃ জিন্নার সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ গৃহীত হয়। আর বিহারের অন্তর্গত রামগড় নামক স্থানে মাত্র আধ মাইলের ব্যবধানে মওলানা আবুল কালাম আযাদের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের অধিবেশন এবং সুভাষ বাবুর সভাপতিত্বে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কংগ্রেসের (ফরওয়ার্ড ব্লক) সম্মিলনী হয়। কংগ্রেস প্রস্তাবে বলা হয়, চলতি যুদ্ধ বৃটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থে পরিচালিত হইতেছে। ভারতের স্বাধীনতা স্বীকার না করা পর্যন্ত কংগ্রেস এ যুদ্ধে সহযোগিতা করিতে পারে না। সুভাষ বাবুর সম্মিলনীতে সোজাসুজি সরকারের যুদ্ধ-প্রচেষ্টার বিরোধিতা করিবার সিদ্ধান্ত করা হয়।
১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ হক সাহেবের প্রস্তাবে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় মুসলমানদের রাজনৈতিক চিন্তাধারাও নূতন দিগন্তের দিকে আকৃষ্ট হয়। এটাই মুসলিম লীগের সর্বপ্রথম রাজনৈতিক পঠিটিভ পদক্ষেপ। লাহোর প্রস্তাবই মুসলিম ভারতের রাজনৈতিক আদর্শকে গোটা ভারতের রাজনৈতিক দাবির সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ করিয়া তুলে। মুসলিম লীগ তার ভারতের স্বাধীনতা বিরোধী থাকে না। হইয়া উঠে স্বাধীনতার দাবিদার। এদিকে হক মন্ত্রিসভার দ্বারা সালিশী বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বাংলার কৃষক-খাতকের অর্থনৈতিক জীবনে একটা আর্থিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। এইভাবে কৃষক-প্রজা সমিতির মূল দাবিগুলি আস্তে আস্তে মুসলিম লীগ কর্তৃক গৃহীত হওয়ায় স্বতন্ত্র শ্রেণী প্রতিষ্ঠান হিসাবে কৃষক-প্রজা সমিতির বাঁচিয়া থাকার একমাত্র রেইনডেটর যুক্তি ছিল শ্লোগান হিসাবে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদের দাবিটা। এ দাবির পিছনে জন মতের যে বিপুলতা দুইদিন আগে বিদ্যমান ছিল, প্রজাস্বত্ব আইন ও মহাজনি আইন পাস হওয়ার এবং সালিশী বোর্ড স্থাপনের পর সে বিপুলতা অনেকখানি হ্রাস পাইল স্বাভাবিক কারণেই। হক মন্ত্রিসভা এই সময় কার্যতঃ মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা হইয়া যাওয়ায় এবং প্রজা-খাতকদের কল্যাণকর এই সব আইন-কানুন এই মন্ত্রিসভার দ্বারাই সাধিত হওয়ায় মুসলিম জন-মত প্রায় সম্পূর্ণরূপে মুসলিম লীগের পক্ষে চালিয়া গেল।
৯. শেষ চেষ্টা
এইভাবে এই মুদ্দতটা হইয়া গেল আমার জন্য চরম বিভ্রান্তির যুগ। বস্তুতঃ আমার চিন্তারাজ্য এমন গোলমাল আর কখনো ঘটে নাই। চিন্তার অস্পষ্টতাহেতু মতের দৃঢ়তা আর আমার থাকিল না। সব কথায় এবং সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই আমি কিছু কিছু ভাল এবং কিছু কিছু মন্দ দেখিতে লাগিলাম। বলিতে লাগিলাম, কৃষক-প্রজা পার্টির এইটুকু কংগ্রেসের সেইটুকু আর মুসলিম লীগের ঐটুকু ভাল। ফলে আমার বন্ধুরা এই সময় আমার না দিলেন : ‘মিঃ এটাও সত্য ওটাও সত্য।‘ প্রকৃত অবস্থাও হইয়া উঠিয়াছিল তাই। তেজস্বী দৃঢ়তা ও স্পষ্টতার জন্য ‘কৃষকের’ সম্পাদকীয় গুলির যে সুনাম ছিল তা আর থাকিল না। অস্পষ্টতা ও দুর্বলতা ঢাকিবার জন্য নাকি তাতে ফুটিতে লাগিল ন্যায়শাস্ত্রের কচকচি। চিন্তায় দৃঢ়তা না থাকিলে লেখায় দৃঢ়তা আসিবে কোথা হইতে? অথচ কৃষক-প্রজা পার্টিকে বাঁচাইয়া রাখিতে হইলে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদের দাবিটাকে জোরদার করিতেই হইবে। এই উদ্দেশ্যে এই সময়ে আমরা তিন বন্ধু (থ্রি-মাস্কিটিয়ার্সই বলা যাইতে পারে) অধ্যাপক হুমায়ুন কবির, নবাবযাদা হাসান আলী ও আমি, কংগ্রেসী বামপন্থী, কিষাণ সভা ও কমিউনিস্টদের সাথে যোগাযোগ করিতে লাগিলাম। এই উপলক্ষ্যে মিঃ নীহারে দত্ত মজুমদার, কমরেড বংকিম মুখার্জী, কমরেড ভবানী সেন, কমরেড এম. এন. রায়, এমনকি স্বয়ং সুভাষ বাবুর সংগে দেন-দরবার চালাইলাম। কমিউনিস্ট বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র কমরেড রায় ছাড়া আর কারও সংগে অন্ততঃ আমার মতের মিল হইত না। বন্ধু হুমায়ুন কবির বোধ হয় আমার চেয়ে বেশি উত্যক্ত হইয়াছিলেন। এ ব্যাপারে একটা বড় মজার ঘটনা না বলিয়া পারিতেছি না। আমরা উভয়ে কমিউনিস্ট বন্ধুদের সাথে এই সময় ঘনিষ্ঠভাবে মিলামিশা করিতেছি। কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি এই সময়ে আমরা উভয়ে আস্থা হারাইয়াছি। কমিউনিস্ট বন্ধুদের সাথে আলোচনা করিয়া আমরা উভয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম যে, কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া আর কোন পার্টি দিয়া ভারতের স্বাধীনতা উদ্ধার হইবে না। আমাদের মনের গতিক যখন এই, এমনই একদিন আমরা ইডেন গার্ডেনে ক্রিকেট খেলা দেখিতে-দেখিতে এবং চীনাবাদাম খাইতে খাইতে এই সিদ্ধান্ত করিলাম যে, ভারতের স্বাধীনতার খাতিরে আমরা অগত্যা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিব। কিন্তু কমিউনিস্ট নেতৃত্বে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরদিনই আমরা ভারত ছাড়িয়া চলিয়া যাইব। কারণ কমিউনিস্ট শাসনের রেজিমেন্টেড ইন্টেলেকচুয়াল জীবন আমরা সহ্য করিতে পারি না। কমিউনিস্ট শাসন সম্পর্কে আমাদের তৎকালীন এই ধারণা ঠিক না হইতে পারে, কিন্তু দেশের স্বাধীনতার খাতিরে আমরা কতদূর ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলাম এতে সেটা বুঝা যাইবে। সংগে সংগে এটাও বুঝা যাইবে যে, কমিউনিস্ট মানে স্টালিনী, শাসন সম্পর্কে তৎকালে আমাদের ধারণা খুব ভাল ছিল না।
১০. চিন্তার নূতন দিগন্ত
কংগ্রেস-লীগ আপোসের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সমাধান যতই পিছাইয়া যাইতে লাগিল আমি ততই মুসলিম লীগের দিকে হেলিয়া পড়িতে লাগিলাম। আমার কংগ্রেসী নেতারা যতই ‘হিন্দু’ হইতে লাগিলেন, আমি ততই ‘মুসলিম’ হইতে লাগিলাম। আমার এই ‘মুসলিম’ত্বে অবশ্য ধর্মীয় গোড়ামি ছিল না; পর-ধর্ম বিদ্বেষেও ছিল না। ছিল শুধু তীব্র স্বকীয়তা ও আত্মমর্যাদাবোধ। স্বান্ত-চেতনা। হিন্দু ও মুসলমানের মতপার্থক্যটা এই সময় আমার কাছে বুনিয়াদী মানস পার্থক্য বলিয়া প্রতীয়মান হইল। অবস্থা এমন হইল যে, একদিন এক বন্ধু আমার ধর্ম-মত শুনিয়া বলিলেন : তুমি তা হৈলে নাস্তিক।
জবাবে আমি বলিলাম : নাস্তিক হৈলেও আমি মুসলমান নাস্তিক।
আরেকবার আমার আরেক বন্ধু আমার রাজ-নীতিক-অর্থ-নীতিক মত শুনিয়া বলিয়াছিলেন : তুমি ত কমিউনিস্ট।
জবাবে আমি বলিয়াছিলাম : তা কৈতে পার। তবে আমি মুসলমান কমিউনিস্ট।
এই ‘হিন্দু-মুসলিম কমিউনিযম’ সম্বন্ধে একটা মজার গল্প মনে পড়িতেছে। একবার বন্ধুবর কমরেড বংকিম মুখার্জী আফসোস করিয়া আমাকে বলিয়াছিলেন : ‘অক্টার্লনি মনুমেন্টের নিচে শ্রমিক জনসভায় চার ঘন্টা ধর্ম-বিরোধী বক্তৃতা করি। করতালিও পাই। কিন্তু সভাশেষে মুসলিম শ্রমিকরা টিপু সুলতানের মসজিদে এবং হিন্দু শ্রমিকরা কালী মন্দিরে ঢুকে পড়ে। এর কি করি বলুন ত?’
আমি বলিলাম : এটাই আসল সত্য। আমার মনে হয় চল্লিশ কোটি ভারতবাসীর সকলে এবং প্রত্যেকে যেদিন কমিউনিস্ট হৈয়া যাবে সেদিনও তারা হিন্দু কমিউনিস্ট ও মুসলিম কমিউনিস্ট এই দুই দলে বিভক্ত থাকবে।
কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি সম্বন্ধে এমন ধারণা লইয়া আমরা বেশিদিন রাজনৈতিক অস্পষ্ট পরিবেশের মধ্যে থাকিতে পারিলাম না। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজের অজ্ঞাতসারে মুসলিম লীগের মতবাদে দীক্ষিত হইয়া যাইতে লাগিলাম। হক সাহেবের মতবাদ এ বিষয়ে আমাকে অনেকখানি প্রভাবিত করিল। অথচ কিছুদিন আগেও আমি মনে করিতাম হক সাহেবের নিজস্ব কোন রাজনৈতিক মতবাদ নাই। বাংলার মুসলিম সমাজের যাতে ভাল হয়, সেটাই তার মতবাদ, চাই সেটা যা-কিছুই হউক। আমাকেও যেন ধীরে ধীরে এই রোগে পাইয়া বসিল। তাই বন্ধুরা যখন আমাকে বিদ্রূপ করিয়া ‘মিঃ এটাও সত্য এটাও সত্য’ বলিতেন, তখন অন্তর দিয়া দুঃখিত হইতাম না। জবাবে শুধু হাসিয়া বলিতাম : ফ্যানাটিক বা ডগমেটিক না হৈয়া র্যাশনালিস্ট হওয়ার ওটাই শাস্তি।