১৪. পাকিস্তান হাসিল
চৌদ্দই অধ্যায়
১. পার্লামেন্টারিয়ান হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা
আমি কলেজ জীবন হইতেই সক্রিয় রাজনীতি করিতেছিলাম বটে কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর শিক্ষা-প্রভাবে কতকটা এবং নিজের মোজ-মর্যির ফলে কতকটা, আমি কোনও নির্বাচনে প্রার্থী হই নাই। কিন্তু মুসলিম লীগে যোগ দেওয়ার পর তৎকালীন সেক্রেটারি বন্ধুবর আবুল হাশিমের প্রভাবে আমি ১৯৪৬ সালে একবার প্রাদেশিক আইন পরিষদের এবং দুইবার কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের (গণ-পরিষদ) মেষর হইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম। তিনবারই আমি নিরাশ হইয়াছিলাম। (১) প্রাদেশিক মুসলিম লীগ আমাকে প্রাদেশিক আইন পরিষদের প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দান করেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড আমার নাম বাতিল করিয়া আজাদ-সম্পাদক মৌঃ আবুল কালাম শামসুদ্দিনকে মনোনীত করেন। {2) আমি ১৯৪৬ সালের সেটেম্বর মাসে মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে গণ-পরিষদের মেম্বর নির্বাচিত হইলাম। গণ-পরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লী যাওয়ার জন্য তৈয়ারও হইয়াছিলাম। এমন সময় জিন্ন সাহেব গণ-পরিষদ বয়কট করার নির্দেশ দিলেন। আমার মেম্বরগিরি করা আর হইল না। {৩) এর পরে পাকিস্তানের জন্য স্বতন্ত্র গণ-পরিষদ গঠনের সময় মুসলিম লীগ আবার আমাকে মনোনীত করিলেন। বংগীয় ব্যবস্থা পরিষদের মুসলিম মেম্বরদের ভোটে গণ-পরিষদের মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হওয়ার বিধান ছিল। সিংগল ট্রান্সফারেবল পদ্ধতিতে এই ভোট দিবার নিয়ম ছিল। যে তিনজন মুসলিম মেম্বর আমার ভাগে পড়িয়াছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন মুসলিম লীগের ‘হুইপ’ অমান্য করিয়া আমার স্কুলে অন্য লোককে ভোট দিয়াছিলেন। ফলে আমি নির্বাচিত হইতে পারি নাই। এইভাবে তিন-তিন বার চেষ্টা করিয়াও আমি মুসলিম লীগের সেবক হিসাবে কেন্দ্রীয় অথবা প্রাদেশিক আইন পরিষদের মেম্বর হইতে পারি নাই। বুঝিলাম মুসলিম লীগের লোক হিসাবে মেম্বর হওয়া আমার বরাতেই ছিল না।
২. লীগের প্রচার সম্পাদক
বংগীয় আইন পরিষদের আসনে প্রাদেশিক লীগের-দেওয়া আমার নমিনেশন কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড বাতিল করিলেও আমি তাতে মোটেই মনক্ষুণ্ণ হইলাম না। বরঞ্চ মুসলিম-লীগের পাবলিসিটি সেক্রেটারি হিসাবে আমার সমস্ত শক্তি লীগ প্রার্থীদের জয়লাভের জন্য নিয়োজিত করিলাম। এ ছাড়া আমি প্রচারের ধারাই বদলাইয়া দিলাম। বন্ধুদের আশ্বাস সত্ত্বেও আমার মনের এই সন্দেহের ভাব দূর হয় নাই যে ধমীয় জাতিত্বের শ্লোগানে যে রাষ্ট্র দাবি করা হইতেছে, তাতে কৃষক শ্রমিকের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিরাপদ নয়। তাই আমি ইলেকশনী শ্লোগান ও যিকিরকে বিবৃতি-ইশতাহারে যথাসম্ভব গণমুখী করিতে লাগিলাম। আমার এখতিয়ার এই পর্যন্তই ছিল। কারণ মুসলিম লীগের ইলেকশন মেনিফেস্টো লিখিবার ভার আমার উপর ছিল না; তাতে হস্তক্ষেপ করিবারও আমার কোনও ক্ষমতা ছিল না। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তিন বছর আগে গৃহিত-জমিদারি-উচ্ছেদের প্রস্তাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া না-দেওয়া সম্পর্কে কোনও কথা ছিল না। এই নীরবতার পূর্ণ সুযোগ আমি গ্রহণ করিলাম। ‘লাংগল যার মাটি তার ‘বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদ চাই’ ‘কায়েমী স্বার্থের ধ্বংস চাই’ ‘শ্রমিক যে মালিক সে’, ‘জনগণের পাকিস্তান’ কৃষক-শ্রমিকের পাকিস্তান প্রভৃতি শ্লোগান তৈরি করিয়া পোস্টার প্ল্যাকার্ড ছাপাইয়া বস্তায়-বস্তায় মফস্বলে পাঠাইতে লাগিলাম। বিশেষ করিয়া আমার নিজের জিলা ময়মনসিংহে এটা করা অতি সহজ ছিল। এ জিলায়-কৃষক-প্রজা আন্দোলন জোরদার ছিল। এখানকার ছাত্র-তরুণরা প্রায় সকলেই জমিদারি-ধন-বিরোধী ছিল। এইসব ছাত্র-তরুণের দ্বারা গঠিত ভলান্টিয়ার বাহিনীর স্লোগান-যিকির ও পোস্টার প্ল্যাকার্ডে স্বভাবতই এইসব দাবি সহজেই স্থান পাইল।
৩. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদ
এছাড়া আরেকটা বড় সুযোগ মিলিল ময়মনসিংহ জিলার গফরগাঁও নির্বাচনী এলাকায় আমাদের প্রার্থী ছিলেন খান বাহাদুর গিয়াসুদ্দিন পাঠান। পাঠান সাহেব জিলা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি। তাঁর সাফল্যের উপর মুসলিম লীগের মান ইয্যত নির্ভর করিতেছিল। পাঠান সাহেব বিচক্ষণ প্রগতিবাদী রাজনীতি ও ভাল অর্গানাইযার হওয়া সত্ত্বেও নিজের এলাকায় তিনি জনপ্রিয় ছিলেন না। পক্ষান্তরে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মওলানা শামসুল হুদা খুবই জনপ্রিয় প্রজা-নেতা ছিলেন। কৃষক-প্রজা আন্দোলনে তাঁর দান ছিল অসামান্য। আগের সাধারণ নির্বাচনে তিনি কৃষক-প্রজা প্রার্থী হিসাবে তৎকালীন মুসলিম লীগ প্রার্থীকে বিপুল ভোটে হারাইয়া নির্বাচিত হইয়াছিলেন। মাত্র কয়েক বছর আগে তিনি ছিলেন আমার সম্মানিত সহকমী। অথচ মুসলিম লীগের অর্থাৎ পাকিস্তান দাবির সাফল্যের খাতিরে তাঁকেই পরাজিত করা দরকার হইয়া পড়িল। পাঠান সাহেবের সাফল্য নিশ্চিত করিবার জন্য আমি শহীদ সাহেব ও হালিম সাহেবের অনুমোদনক্রমে গফরগাঁয় একটি সম্মিলনীর আয়োজন করিলাম। জিলা মুসলিম লীগের সভাপতি মিঃ নূরুল আমিন সাহেবকে চেয়ারম্যান ও জিলার অন্যতম জনপ্রিয় বক্তা ও সংগঠক গফরগাঁর বাশেন্দা মিঃ আবদুর রহমান খাঁ সাহেবকে সেক্রেটারি করিয়া একটি শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হইল। ১৯৪৬ সালের ১২ই জানুয়ারি এই সখিনীর তারিখ নির্ধারিত হইল। জিলা মুসলিম লীগের সভাপতি অভ্যর্থনা সমিত্রি চেয়ারম্যান নূরুল আমিন সাহেব পাঠান সাহেবের সাফল্যে তেমন আগ্রহী নন, পাঠান সাহেব আমার কাছে এই অভিযোগ করায় আমি কনফারেন্সের পর-বিশ দিন আগে হইতেই প্রাদেশিক লীগের প্রচার দফতর গফরগাঁয় স্থানান্তরিত করিয়া সেখানেই বাসা বাঁধিলাম। গঠনতন্ত্র অনুসারে এটা হইল বটে জিলা সম্মিলনী, কিন্তু এটাকে প্রাদেশিক রূপ দিবার সমস্ত আয়োজন করিলাম। বহু সংখ্যক ডেলিগেট ও বিপুল জনতা সশিলনীতে সমবেত হইলেন। এই সম্মিলনীতে জনাব লিয়াকত আলী খাঁ, সার নাযিমুদ্দিন, জনাব শহীদ সুহরাওয়ার্দী, মওলানা আযাদ সোবহানী, জনাব আবুল হাশিম, মৌলবী তমিয়ুদ্দিন প্রভৃতি বহু খ্যাতনামা নেতা যোগদান ও বক্তৃতা করিলেন। জনাব লিয়াকত আলি খাঁ এই সম্মিলনীর সভাপতি হইলেন। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদের প্রস্তাবটি আমি স্বয়ং উপস্থিত করিলাম। এই জিলার জনৈক খ্যালামা এম, এল, এ. “বিনা-ক্ষতিপূরণে” কথাটা বাদ দিবার জন্য। সংশোধনী প্রস্তাবে উপস্থিত করিলেন। ফলে ক্ষতিপূরণের প্রশ্নটা সোজাসুজি সম্মিলনীর বিচার্য বিষয় হইয়া পড়িল। মঞ্চোপরি উপবিষ্ট দুই-এক জন নেতা বিনা-ক্ষতিপূরণের আমার প্রস্তাবে একটু অস্বস্তির ভাব দেখাইতেছিলেন। এবার সংশোধনী প্রস্তাব আসায় তাঁদের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সংশোধনী প্রস্তাব কেউ সেকেণ্ড করিলেন না। সংশোধনী প্রস্তাব সেকেণ্ড করা লাগে না। এই যুক্তিতে উক্ত প্রস্তাবককে বক্তৃতা করিতে দেওয়া হইল। কিন্তু সমবেত লক্ষাধিক লোকের ‘না’ ‘না’-ধ্বনিতে বক্তার গলার সুরতলাইয়া গেল। আর কোনও বক্তা নাই দেখিয়া সভাপতি নবাবযাদা লিয়াকত আলি খাঁ সায়ে মুচকি হাসিয়া প্রস্তাব ভোটে দিলেন। সংশোধনী প্রস্তাবের প্রস্তাবক ছাড়া আর কারো হাত উঠিল না। পক্ষান্তরে আমার মূল প্রস্তাবের পক্ষে সমস্ত প্যাভাল হারে জংগল হইয়া গেল। নবাববাদা সার নাযিমুদ্দিন প্রভৃতি নেতৃবৃন্দের দিকে চাহিয়া হাসিয়া ঘোষণা করিলেন : প্রস্তাব গৃহীত হইল। সভায় দীর্ঘক্ষণস্থায়ী হর্ষধ্বনি ও করতালি চলিল। আমার উদ্দেশ্য সফল হইল। মুসলিম লীগের প্রগ্রেসিভ গ্রুপের জয় হইল। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদে কমিটেড হইলেন। এই জিলা সর্মিলনীর নিয়মতান্ত্রিক ভিত্তি কি, তাতে গৃহীত প্রস্তাবের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্য কি, এসব কথা কেউ তুলিতে পারিলেন না। মুখে-মুখে ভলানটিয়ারদের মিছিলে, মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডদের কুচকাওয়াজে, নির্বাচনী সভাসমূহের প্রস্তাবাদিতে কিনা ক্ষতিপূরণের দাবি অন্ততঃ জনগণের বিচারে মুসলিম লীগের প্রকারী দাবিতে পরিগণিত হইল। কোনও দিক হইতে ইহার প্রতিবাদে টু শব্দটি হইল না। সকলে বুঝিয়া নিল, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। পাকিস্তান হাসিলের পরে মুসলিম লীগ মন্ত্রীরা এই ওয়াদা রক্ষা করেন নাই। সেটা ভিন্ন কথা। জমিদারি উচ্ছেদের বদলে ক্ষতিপূরণ দিয়া একোয়ার করার সময় লীগ নেতারা বলেন নাই যে তাঁরা বিনা-ক্ষতিপূরণের ওয়াদা করেন নাই। তাঁরা বলিয়াছিলেন যে একদম ক্ষতিপূরণ না দিলে জমিদারদের উপর অবিচার করা হয়। লীগ নেতারা যে শুধু জমিদারি উচ্ছেদের ব্যাপারেই সজ্ঞানে জন সাধারণের সাথে বিশ্বাস ভংগ করিয়াছেন, তাও নয়। লাহোর প্রস্তাবের ব্যাপারেও মুসলিম ঐক্য ও ‘কীটে-খাওয়া পাকিস্তানের যুক্তিতে এইরূপ বিশ্বাসভংগ করা হইয়াছে। নির্বাচনের আগের কথা নির্বাচনের পরে ভুলিয়া যাওয়া এবং সে ভুলার সমর্থনে উচ্চ বুলির যুক্তি দেওয়ার ইতিহাস আমাদের দেশে এটাই নূতন নয়।
এই সময় হইতে পাকিস্তান হাসিলের দিন পর্যন্ত মুতের ঘটনাবলী সকলেরই জানা। ঐ সব ঘটনার সাথে আমার দেখা রাজনীতির সোজাসুজি কোনও সম্পর্ক নাই বলিয়া সে সবের উল্লেখ বাদ দিয়া গেলাম। কিন্তু প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক হিসাবে ঐসব ঘটনার অনেকগুলির সাথে অন্ততঃ মনের দিক দিয়া এতটা জড়াইয়া পড়িয়াছিলাম যে ঐসব ঘটনার সুফল-কুফলের স্মৃতি আমার নিজের মন হইতে কিছুতেই মুছিয়া যাইতেছে না। এত এতদিন পরেও ওগুলি কাঁটার মতই আমার অন্তরে বিধিতেছে।
৪. গ্রুপিং-সিস্টেম
এই ধরনের ঘটনার একটি কেবিনেট মিশন প্ল্যান বা গ্রুপিং মম। ১৯৪৬ সালের ১৬ই মে কেবিনেট মিশন এই প্ল্যান ঘোষণা করেন। খবরের কাগষে ঐ গানটা পড়িয়াই আমার অন্তর নাচিয়া উঠে। মনে মনে ভাবি, এইটাই যেন আমি নিজে চিন্তা করিতেছিলাম। সুভাষ বাবুর কথা মনে পড়িল। তাঁর মধুর হাসিমাখা মুখোনা চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিল। হায়। তিনি যদি আজ বাঁচিয়া থাকিতেন।
আমরা নিচের তলার কর্মীরা প্রথম দৃষ্টিতেই প্ল্যানটাকে ভালবাসিয়া ফেলিলেও আমাদের নেতারা অত ব্যস্ততা দেখাইলেন না। প্রায় এক মাস চিন্তা-ভাবনা রিয়াজুল মাসের শেষদিকে এক সপ্তাহ আগে-পরে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় দলই কেবিনেট প্ল্যান গ্রহণ করিলেন। তখন আমার আনন্দ দেখে কে? আমি দেখিয়া আরও খুশী হইলাম যে আমার চেয়ে গোঁড়া পাকিস্তান-বাদী ও সনাতনী মুসলিম লীগাররা পর্যন্ত উল্লসিত হইয়াছেন। যাক, এতদিনে একটা দুঃসাধ্য সমস্যার সমাধান হইয়া গেল। চারদিকেই স্বস্তির নিশ্বাস।
কিন্তু দেশের আবহাওয়া ততদিনে এত বিষাক্ত হইয়া গিয়াছে যে মুসলমানরা যাতে হয় খুশি, হিন্দুরা হয় তাতে বেজার। বিষয়টা ভাল কি মন্দ তার বিচার করে না। কেবিনেট প্ল্যান গ্রহণ নিয়া তাই ঘটিল। এমন যে বামপন্থী বন্ধুরা যাঁরা এতদিন দিনরাত গান্ধী-জিন্না মিলনের শ্লোগান দিয়া কলিকাতার আকাশ-বাতাস মুখরিত করিতেছিলেন, তাঁদের মুখেও বিষাদের কাল ছায়া পড়িল। প্ল্যানটা নিশ্চয়ই মুসলমানের পক্ষে গিয়াছে। নইলে মুসলিম লীগ ওটা গ্রহণ করিল কেন? কংগ্রেস এত দেরি করিল কেন? মুসলমানরা এত উল্লাস করে কেন?
দশ-পনর দিন না যাইতেই কংগ্রেসের নয়া প্রেসিডেন্ট পণ্ডিত নেহরু ১০ই জুলাই এক প্রেস কনফারেন্সে ঘোষণা করিলেন। কংগ্রেস কেবিনেট প্ল্যান গ্রহণ করিয়াছে বটে কিন্তু সার্বভৌম গণ-পরিষদ কংগ্রেসের মত মানিয়া চলিতে বাধ্য নয়।
কায়েদে-আযম ন্যায়তঃই এর প্রতিবাদে লীগের প্ল্যান গ্রহণ প্রত্যাহার করিলেন। সত্যিকার দেশপ্রেমিকদের মধ্যে হাহাকার পড়িয়া গেল।
কংগ্রেসের লুকাচুরিতে কেবিনেট মিশন বড়লাট ও বৃটিশ সরকার চুপ করিয়া তামাশা দেখিলেন। কায়েদে-আযম ১৬ই আগস্ট তারিখে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করিলেন ইংরাজ সরকারের বিরুদ্ধে।
ইংরাজসহ আমাদের সমাজের নাইট-নবাবরাও চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। এঁদের অনেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুসলিম লীগের আহবানে ইংরাজের দেওয়া উপাধি ত্যাগ করিলেন; বেশিরভাগ টিলামিছি করিতে লাগিলেন। কিন্তু ইংরাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের নামে সকলে ঘাবড়াইয়া গেলেন। এই দলের নেতা সার নাফিমুদ্দিন কলিকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউটের এক সভায় ঘোষণা করিলেন : আমাদের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ইংরাজের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দুর বিরুদ্ধে। হিন্দুরা দ্বন্ত এবং শেষ পর্যন্ত এগ্রেসিত হইয়া উঠিল।
১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কলকাতায় কেয়ামত নামিয়া আসিল।
৫. কলিকাতা দাংগা
১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট ও পরবর্তী কয়েকদিন কলিকাতায় যে হৃদয়বিদারক অচিন্তনীয় ও কল্পনাতীত সাম্প্রদায়িক দাংগা হইয়াছিল যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া এমন নৃশংসতা আর কোথাও দেখা যায় না। কলিকাতায় দুইটা মর্মান্তিক সাম্প্রদায়িক দাংগা হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ দুইটার সময়েই আমি কলিকাতায় উপস্থিত ছিলাম। একটা ১৯২৬ সালের এপ্রিলে। অপরটা ১৯৪৬ সালের আগস্টে। গভীরতা, ব্যাপকতা ও নিষ্ঠুরতা সকল দিক হইতেই ১৯৪৬ সালের দাংগা ১৯২৬ সালের দাংগার চেয়ে অনেক বড় ছিল। চল্লিশ বছরের আগের ঘটনা বলিয়া ছাব্লিশ সালের দাংগার নৃশংসতার খুঁটিনাটি মনে নাই। কিন্তু মাত্র বিশ বছরের আগের ঘটনা বলিয়া ছয়-চল্লিশ সালের চোখের দেখা অমানুষিক নৃশংসতা আজও ঝলমলা মনে আছে। মনে হইলেই সজীব চিত্রের মতই চোখের সামনে ভাসিয়া উঠে। গা কাঁটা দিয়া উঠ। স্বাভাবিক হৃদয়বান ব্যক্তির মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিবার কথা। ঘটিয়াও ছিল অন্ততঃ একজনের। আমার নিতান্ত ঘনিষ্ঠ আলীপুর কোর্টের এক ব্রাহ্মণ তরুণ মুনসেফ সত্য-সত্যই কিছুকালের জন্য মনোবিকার রোগে আক্রান্ত হইয়াছিলেন। রিটায়ার্ড জজ ও বয়স্ক উকিল-ব্যারিস্টারের মত উচ্চশিক্ষিত কৃষ্টিবান ভদ্রলোকদিগকে খড়গ রামদা দিয়া তাঁদের মহল্লার বস্তির মুসলমান নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধকে হত্যা করিতে দেখিয়াই ঐ তরুণ হাকিমের ভাবালু মনে অমন ধাক্কা লাগিয়াছিল। তিনি ছুটি লইয়া বেশ কিছু দিন মেন্টাল হাসপাতালে থাকিতে বাধ্য হইয়াছিলেন আমার অবস্থাও প্রায় ঐরূপই হইয়াছিল। আমার মহল্লায় হয়ত একজন মুচি ফুটপাথে বসিয়া মুসলমানদেরই জুতা মেরামত করিতেছে। হয়ত একজন হিন্দু নাপিত ফুটপাথে বসিয়া মুসলমানদের ক্ষৌরকাজ করিতেছে। হঠাৎ কয়েকজন মুসলমান আততায়ী ধারাল রুড বা বল্লম তার মাথায় গলায় বা পেটে এপার-ওপার ঢুকাইয়া দিল। মুহূর্তের মধ্যে ধড়ফড় করিয়া লোকটি সেখানেই মরিয়া পড়িয়া রহিল। বীরেরা জয়ধ্বনি করিতে করিতে চলিলেন অন্য শিকারের তালাশে। এমন নৃশংসতা দেখিলে কার না মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটিবে? অথচ এটাই হইয়া উঠিয়াছিল স্বাভাবিক মনোবৃত্তি। বিপরীতটাই ছিল যেন অস্বাভাবিক। হৃদয়বান মানব-প্রেমিক বলিয়া পরিচিত আমার জানা এক বন্ধু এই সময়ে একদিন আমাকে কৈফিয়ৎ তলবের ভাষায় বলিয়াছিলেন : কয়টা হিন্দু মারিয়াছেন আপনি? শুধু মুখে-মুখেই মুসলিম প্রীতি।
সত্যই এই সময় কলিকাতার বেশিরভাগ মানুষ তাদের মনুষ্যত্ব-বোধ হারাইয়া ফেলিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। একটা সংক্রামক ফ্রেবিতে যেন সবাই সমবেতভাবে উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু এই সামগ্রিক উন্মত্ততার মধ্যেও দু-একটা সাহসিক মানবিকতার দৃষ্টান্ত মহত্ত্বের উজ্জ্বলতায় ঝলমল করিতেছে। হিন্দু এলাকায় উত্ত জনতা-বেষ্টিত মুসলমান পরিবারকে রক্ষার জন্য হিন্দু নারী-পুরুষের বীরত্ব এবং মুসলিম এলাকায় ঐ অবস্থায় পতিত হিন্দু পরিবার রক্ষায় মুসলিম নারী-পুরুষের বীরত্ব ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা থাকার যোগ্য।
এই সাম্প্রদায়িক দাংগার প্রাথমিক দায়িত্ব সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বলিয়াছেন। স্বাভাবিক কারণেই তার অধিকাংশই পক্ষপাতদুষ্ট। প্রত্যক্ষদশী হিসাবে আমার নিজের বিবেচনায় এর প্রাথমিক দায়িত্ব মুসলিম লীগ-নেতৃত্বের। বড়লাট লর্ড ওয়াভেলের পক্ষপাতদুষ্ট কাজকে ‘ডাবলক্রসিং’ আখ্যাদিয়া যেদিন কায়েদে-আযম লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেদিন আমি সর্বাপেক্ষা বেশি আনন্দিত হইয়াছিলাম। বহুঁকাল কংগ্রেসের সেবা করিয়া আমি ও আমার মত অনেকেই নিয়মতান্ত্রিক দেন-দরবারের রাজনীতি অপেক্ষা সংগ্রামের পন্থার প্রতিই অধিকতর বিশ্বাসী হইয়াছিলাম। কংগ্রেস ছাড়িয়া মুসলিম লীগে যোগ দিবার সময়ও ঐ সংগ্রামী মনোভাব ফেলিয়া আসিতে পারি নাই। মুসলিম লীগ কোনদিন সংগ্রামের পথে যাইবে না, কংগ্রেসী বন্ধুদের এই ধরনের চ্যালেঞ্জের উপযুক্ত জবাব দিতে না পারিয়া অনেক সময় লজ্জা পাইতাম। এইবার তাঁদেরে বলিতে পারিলাম? কেমন, হইল ত? ধরিয়া দিলাম প্রত্যেক সংগ্রামে নবাগত মুসলিম লীগ নেতৃত্ব কিছুকাল ট্রেনিং লইবেন। আমরা সাবেক কংগ্রেসীদের মর্যাদা একটু বাড়িবে। কিন্তু ও মা! কায়েদে-আযম ১৬ই আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম-দিবস ঘোষণা করিয়া দিলেন। কিন্তু কোনও কার্যক্রম ঘোষণা করিলেন না। তবে একথা তিনি বলিয়াছিলেন : আজ হইতে মুসলিম লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ ত্যাগ করিল। আমরা ধরিয়া নিলাম সভা-সমিতিতে হুমকি দিয়া উত্তেজনাপূর্ণ প্রস্তাবাদি পাস হইবে। আমার অনেক হিন্দু বন্ধুর সাথে আলাপ করিয়া বুঝিয়াছিলাম হিন্দুরাও তাই ধরিয়া নিয়াছিল।
কিন্তু দুইটা ঘটনা হিন্দু-মনে স্বভাবতঃই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করিল। এক, খাজা নাযিমুদ্দিন সাহেব ঘোষণা করিলেন। আমাদের সংগ্রাম ভারত সরকারের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দুদের বিরুদ্ধে। দুই, প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেবের নির্দেশে বাংলা সরকার ১৬ই আগস্ট সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করিলেন। প্রথমটি সুস্পষ্ট যুদ্ধ ঘোষণা। দ্বিতিয়টির ব্যাখ্যা আছে। প্রধানমন্ত্রী হয়ত অন্তত আশংকা করিয়াই সরকারী কর্মচারীদের নিরাপত্তার জন্য আফিস-আদালত ছুটি দিয়াছিলেন। পরবর্তী ঘটনায় বোঝাও গিয়াছিল যে ঐ দিন ছুটি না থাকিলে উভয় সম্প্রদায়ের অনেক সরকারী কর্মচারির জীবনহানি
কিন্তু আগে এটা বুঝার উপায় ছিল না। সরকারী ঘোষণায় বলাও হয় নাই। হইলেও হিন্দুরা বিশ্বাস করি না। মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা হইলেই লীগের পার্টি প্রোগ্রামকে সরকারী ছুটির দিন গণ্য করা হইবে, এটা কোনও যুক্তির কথা নয়। কংগ্রেস মন্ত্রিসভারা তা করেন নাই। কাজেই হিন্দুরা খুব ন্যায়-ও যুক্তিসংগত ভাবেই এই আশংকা করিল যে মুসলিম লীগ-ঘোষিত হরতাল পালনে হিন্দুদিগকে বাধ্য করা হইবে। নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুরা আগে হইতেই প্রস্তুত ছিল। এর প্রমাণ পাওয়া গেল ঘটনার দিনে।
গড়ের মাঠের অক্টারলনি মনুমেন্টের উত্তরে ও কার্যন পার্কের দক্ষিণে বিরাট খেলার মাঠে সভার আয়োজন করা হইয়াছে। শহীদ সাহেব, হাশিম সাহেব প্রভৃতি নেতৃবৃন্দ মঞ্চোপরি উপবিষ্ট। আমরা একদল শ্রোতা মঞ্চের নিচে চেয়ারে উপবিষ্ট। সভার কাজ শুরু হয়-হয়। এমনি সময় খবর আসিল বেহালা, কালিঘাট, মেটিয়াবুরুজ, মানিকতলা ও শ্যামবাজার ইত্যাদি স্থানে-স্থানে মুসলমানদিগের উপর হিন্দুরা আক্রমণ করিয়া অনেক খুন-জখম করিয়াছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই লহ-মাখা পোশাক-পরা জনতা রক্ত-রঞ্জিত পতাকা উড়াইয়া আহত ব্যক্তিদের কাঁধে করিয়া চার দিক হইতে মিছিল করিয়া আসিতে শুরু করিল। চারদিকেই মাতমের আহাজারি ও প্রতিশোধের যিকির। তাদের মুখে শোনা গেল হিন্দুরা শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর বিনা-কারণে হামলা করিয়াছিল। হিন্দুরা দোকানে ঘরে ও ছাদে ইট-পাটকেল ও লাঠি-সোটা আগেই যোগাড় করিয়া রাখিয়াছিল। হিন্দুদের পক্ষ হইতে অবশ্যই বলা হইয়াছিল যে মিছিলের লোকেরা রাস্তার পাশের হিন্দু দোকানদারদেরে জোর করিয়া দোকান বন্ধ করাইতে গিয়াছিল। ফলে বিরোধ বাধে। এটা সম্ভব। মুসলিম জনতার জোর করিয়া হিন্দু দোকান বন্ধ করাইতে যাওয়ার দুই-একটা নযির আমার নিজেরই জানা আছে। তবে এসব ক্ষেত্রে সংঘাত বাধে নাই। হিন্দু দোকানদাররা ডরে-ভয়ে দোকান বন্ধ করিয়াছিল। এসব ক্ষেত্রেও হিন্দুরা বাধা দিলে যে সংঘর্ষ হইত, তাতে সন্দেহ নাই।
কলিকাতায় স্বভাবতঃই হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের জান-মালের ক্ষতি হইয়াছিল অনেক বেশি। এই খবর অতিরঞ্জিত আকারে পূর্ব বাংলায় পৌঁছিলে নোয়াখালি জিলায় হিন্দুরা নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়। তারই প্রতিক্রিয়ায় বিহারের হিন্দুরা তথাকার মুসলমানদিগকে অধিকতর নৃশংসতার সাথে পাইকারীভাবে হত্যা করে। ফলে সাম্প্রদায়িক দাংগার ব্যাপারে বাংলা-বিহার একই যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই যুদ্ধ চলে প্রায় চার মাস ধরিয়া। উভয় পক্ষে কত লোক যে হতাহত ও কত কোটি টাকার সম্পত্তি যে ধ্বংস হইয়াছিল তার লেখা-জোখা নাই। পরবর্তীকালে দেশ ভাগের সময়ে অবশ্য আরও বহু প্রদেশে দানবীয় নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটিয়াছিল। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত বাংলা-বিহারের সাম্প্রদায়িক দাংগাই নৃশংস অমানুষিকতার সর্বাপেক্ষা লজ্জার নিনি। অনেক অতি-সাম্প্রদায়িক মুসলমান আজও সগর্বে বলিয়া থাকে কলিকাতা দাংগাই পাকিস্তান আনিয়াছিল। এ কথা নিতান্ত মিথ্যা নয়। এই দাংগার পরে ইংরাজ হিন্দু-মুসলিম তিনপক্ষই বুঝিতে পারেন, দেশ বিভাগ ছাড়া উপায়ান্তর নাই।
৬. পার্টিশনে অবিচার
১৯৪৭ সাল হইতে ১৯৫০ সাল এই তিনটি বছর সক্রিয় রাজনীতির সংগে আমার সব বিশেষ ছিল না। ইত্তেহাদের সম্পাদক হিসাবে আমার সাথে রাজনীতিকরা মাঝে-মাঝে যতটুক পরামর্শ করিতেন এবং আমি সম্পাদকীয় প্রবন্ধাবলীতে যতটুক অতিমত প্রকাশ করিতাম, সেই টুকুকেই আমার রাজনীতি বলা যাইতে পারে। তবে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে মশগুল না থাকার দরুন এই মুহূর্তে দর্শক ও বিচারক হিসাবে আমার যোগ্যতা অনেক বেশি করিয়া বাড়িয়া ছিল, নিতান্ত বিনয়ের সাথে এ দাবি আমি করিতে পারি।
পরবর্তীকালে বিদেশী ও নিরপেক্ষ লোকদের অনেকেই স্বীকার করিয়াছেন, পার্টিশনে পাকিস্তানের উপর অবিচার করা হইয়াছে। রেফারেন্ডামে বিপুল মেজরিটি পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেওয়া সত্ত্বেও সিলেটের করিমগঞ্জ ভারতের ভাগে ফেলা, সমস্ত গৃহীত মূলনীতির বরখেলাফে পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জিলা ভারতের ভাগে ফেলা, সুস্পষ্টতই ইচ্ছাকৃত পক্ষপাতমূলক অবিচার। কাশ্মীর ও ত্রিপুরার সাথে ভারতের কন্টিগিউটি রক্ষার অসাধু উদ্দেশ্যেই এ সব কাজ করা হইয়াছিল। কৈফিয়ৎ স্বরূপ বলা য়ু কায়েদে-আযম লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে পাকিস্তানের প্রথম বড়লাট না করিয়া নিজেই বড়লাট হইয়া পড়ায় পাকিস্তানের উপর রাগ করিয়াই মাউন্টব্যাটেন ব্রেডক্লিফকে দিয়া এসব অবিচার করাইয়াছেন। জিন্না সাহেব বড়লাট হইবার ব্যক্তিগত লোভটা সংবরণ করিতে পারিলে পাকিস্তানের উপর মাউন্টব্যাটেন অত অবিচার করিনো। চাই কি কিছু সুযোগ-সুবিধাও করিয়া দিতেন।
যে কারণেই হউক পাকিস্তানের উপর অবিচার যে ইচ্ছাকৃতভাবে করা হইয়াছিল, এটা আজ সুস্পষ্ট এবং সাধারণভাবে স্বীকৃত। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান টিকিবে না, কাজেই এসব অবিচার কালের বিচারে মূল্যহীন হইয়া যাইবে, এই ধারণা হইতেই ঐসব পক্ষপাতমূলক বিচার করা হইয়াছিল। সেসব অবিচারের ধরন ও পরিমাণ এমন ছিল যে পাকিস্তানের পরিমাণ বিলুপ্তি ত্বরান্বিত করাই স্বাভাবিক ছিল। এ অবস্থায় অত সব প্রতিকুলতা কাটাইয়া পাকিস্তান যে বাঁচিয়া আছে এটাই একটা বিষয়ক ব্যাপার। আমাদের বরাত গুণ।
তবে পাকিস্তান হাসিলের বিজয়োল্লাসের প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের মধ্যে উপরের তলার নেতারা কি নিচের তলার কর্মীরা আমরা এ সব কথায় তত গুরুত্ব দেই নাই আনন্দে বিঘু হইবে ভয়ে। কিন্তু এত উল্লাসের মধ্যেও দুইটা ব্যাপারে আমি স্তম্ভিত না হইয়া পারি নাই। একটি রাজনৈতিক আদর্শের কথা। অপরটি পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের কথা। অবশ্য দুইটার জন্যই আমি মনে-মনে কায়েদে-আযমকেই দায়ী করিয়াছিলাম। কিন্তু আদর্শের ব্যাপারটা এককভাবে কায়েদে-আযমের নিজের কাজ। জিন্ন সাহেবের রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদে আমার পূর্ণ আস্থা ছিল। তিনি কোনও অন্যায় অগণতান্ত্রিক বেকায়দা কথা বলিলে বা কাজ করিলে আমি মনে খুবই ব্যথা পাইতাম। পাকিস্তান হওয়ার পরে-পরেই এমন কথা তিনি দুইটি বলিয়াছিলেন : প্রথমটি এই : পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব . গ্রহণের জন্য দিল্লী হইতে করাচি রওয়ানা হওয়ার সময় তিনি বলিয়াছিলেন : “আমি ভারতের নাগরিক হিসাবে পাকিস্তানে যাইতেছি। পাকিস্তানের জনগণ আমাকে তাদের সেবা করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করায় আমি তাদের সেবা করিতে যাইতেছি। নৃর্ড মাউন্টব্যাটেন বৃটিশ নাগরিক হইয়াও যেমন ভারতবাসীর সেবা করিতেছেন, আমিও ঠিক তেমনি করিতে যাইতেছি।”
কথাটা শোনা মাত্র আমার মনে ব্যথার যে কাঁটা ফুটিয়াছিল, সে টাটানি আজো সারে নাই। প্রথমতঃ এটা কোনও জরুরী শাসনতান্ত্রিক কথা ছিল না। একথা বলার কোনও দরুকারই ছিল না। দ্বিতীয়তঃ বিদেশী হিসাবে আমাদের গভর্নর-জেনারেল হইয়া আমাদের সেবা করিতে আসিতেছেন এটা কোনও গৌরবের কথা ছিল না, আমাদের দিক হইতে ত নয়ই, তাঁর নিজের দিক হইতেও না। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সংগে নিজের তুলনা করিয়া তিনি কি আনন্দ পাইলেন তা আমি আজও বুঝি নাই। তিনি ছিলেন নয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানের স্রষ্টা ও পাকিস্তানী জাতির পিতা। পক্ষান্তরে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ছিলেন মুমূর্ষ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের শেষ প্রতীক।
কায়েদে আযমের আর যে কথাটি আমাকে পীড়া দিয়াছিল, তা বাংলাভাষা সম্পর্কে তাঁর ঢাকার বক্ততা। পঁচিশ বছর ধরিয়া জিন্ন সাহেবকে চিনিতাম। এই পঁচিশ বছরের মধ্যে মাত্র পাঁচ বছর তাঁর বিরোধী ছিলাম। বাকী কুড়ি বছরই তাঁর সমর্থক ছিলাম। তাঁর মুখে এমন গুরুতর ব্যাপারে এমন অবিবেচকের কথা আশা করি নাই। তিনি বাংলা বা উর্দু কোনও ভাষাই জানিতেন না। তবে এটা তিনি জানিতেন যে বাংলা অধিকাংশ পাকিস্তানীর মাতৃভাষা। আর জানিতেন তিনি গণতন্ত্র মাতৃভাষার তাৎপর্য। কাজেই কায়েদ-আযমের মুখে মাত্র একবারের মত ঐ গণতন্ত্রবিরোধী কথার মানে আমি আজও উপলব্ধি করি নাই।
পরপর তিনটি ঘটনা আমাকে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ভাবাইয়া তুলিয়াছিল। (১) ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে মুসলিম লীগ যখন কেন্দ্রীয় সরকারে যোগদান করে, তখন জিন্না সাহেব মুসলিম বাংলার কোনও প্রতিনিধিকে মন্ত্রী করেন নাই। জিনা-নেতৃত্বে মুসলিম-বাংলার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তখন হইতেই আমার দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। বন্ধুদের কাছে আমার দুশ্চিন্তার কথা বলিয়াছিলাম। ১৯১১ সালে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ সম্পর্কে নিখিল ভারতীয় মুসলিম নেতৃত্বের মনোভাব ও ১৯১৬ সালের লাখনৌ প্যাকটে বাংলার মুসলিম মেজরিটিকে চিরতরে কোরবানি করিবার ইতিহাসের নফিরও উল্লেখ করিয়াছিলাম কিন্তু অনেক বন্ধুই আমার ঐ সন্দেহকে নব-দীক্ষিতের ইমানের কমজোরি বলিয়া উড়াইয়া দিয়াছিলেন।
(২) ১৯৪৬ সালে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ইলেকশনে জয়লাভ করিবার পর নাহোর-প্রস্তাবকে বাঁকা পথে আমূল পরিবর্তন করিয়াছিলেন নির্বাচিত মেম্বাররা দিল্লীর লেজিসলেটার্স কনভেনশনে। এই পরিবর্তনের চেয়ে পরিবর্তনের পন্থাটাই আমার চিন্তার কারণহইয়াছিল বেশি।
(৩) বাংলা বিভাগের সময় বাংলার মুসলমানের স্বার্থের চেয়ে গোটা পাকিস্তানের স্বার্থের দিকে বেশি নযর রাখা হইয়াছিল। গোটা পাকিস্তান’ অর্থ ছিল কার্যতঃ পশ্চিম পাকিস্তান।
এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে শেষ বিষয়টি সম্বন্ধেই আমার অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত। তাই আমি এখানে ঐ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলিব। ভবিষ্যতের ইতিহাস লেখকদের জন্য এইসব ছোট-খাট ঘটনাও প্রয়োজনীয় হইতে পারে।
৭. কলিকাতার দাবি
দেশ বিভাগে রেডক্লিফ পাকিস্তানের প্রতি যতই অন্যায় করিয়া থাকুন কেন, কলিকাতার উপর পাকিস্তানের দাবি অগ্রাহ্য করা সহজ ছিল না। এটা সহজ করিয়া দিলেন স্বয়ং লীগ নেতৃত্ব ১৯৪৪ সালের ৩রা জুন ন্যাশন্যাল পার্টিশন বা আন্দাযী বিভাগ ঘোষণার সাত দিনের মধ্যেই স্বয়ং সূহরাওয়ার্দী গভর্ণমেন্টই ঢাকাকে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঘোষণা করিয়াছিলেন। ঢাকা শহরের চার দিকের কুড়ি মাইল এলাকা রিকুইযিশন করিয়া কলিকাতা গেযেটে নোটিফিকেশনও জারি করিয়াছিলেন। তথাপি সার নাফিমুদ্দিনের দলের সন্দেহ তাতে ঘুচে নাই। তাঁদের মনে তখনও সন্দেহ ছিল যে কলিকাতা পাকিস্তানের ভাগে পড়িলে পূর্ব-বাংলার রাজধানী কলিকাতাতেই থাকিয়া যাইবে। এটা স্পষ্টতঃই তাঁদের ভিত্তিহীন সন্দেহ। কারণ কলিকাতা পূর্ব বাংলার ভাগে পড়িলেও উহাকে রাজধানী রাখা উচিৎ হইত না। পূর্ব-বাংলার গণপ্রতিনিধিরা তা করিতেনও না। কিন্তু মুসলিম লীগের খাজা-নেতৃত্ব এ ব্যাপারে অতি মাত্রায় ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। সে জন্য ৫ই আগস্ট সুহরাওয়ার্দী সাহেবকে হারাইয়া সার নাযিমুদ্দিন নেতা নির্বাচিত হইবার পরদিন হইতেই ‘কলিকাতা রক্ষার আন্দোলন একদম মন্দীভূত হইয়া গেল। বংগীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগ যুক্তভাবে তখন ‘কিপ ক্যালকাটা’ আন্দোলন চালাইতেছিল। সবগুলি মুসলিম সংবাদপত্রই আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন ম্যাপ চার্ট ও স্ট্যাটিসটিকস দিয়া কলিকাতা পূর্ব বাংলায় থাকার যুক্তি দিতেছিলাম। মুসলিম ছাত্রলীগ মিছিল ও জনসভা করিতেছিল। হক সাহেব পর্যন্ত এই আন্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন। বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী ও বেংগল পার্টিশন কাউন্সিলের মেম্বর সুহরাওয়ার্দী সাহেব দার্জিলিং-এ গভর্নর সার আর, জি, ক্যাসি সাহেবের সহিত আলোচনা করিয়া আমাদের এইরূপ আভাস দেন। চরিশ পরগণার বারাকপুর, বারাসত, তাগর-ও বশিরহাট পূর্ব-বাংলার ভাগে ফেলিয়া এবং কলিকাতা ও দার্জিলিং উতয় শহরকে উভয় বাংলার কমন শহর ঘোষণা করিয়া বাংলা বাটোয়ারা করিতে গবর্নর রাযী হইয়াছেন এবং সেই মতে ঊর্ধ্বতন মহলে প্রভাব বিস্তার করিবার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছেন। গবর্নর কলিকাতাকে পূর্ব বাংলার অংশে ফেলিবার জোর আন্দোলন চালাইয়া যাইতেও সুহরাওয়ার্দী সাহেবকে উপদেশ দিয়াছিলেন। সুহরাওয়ার্দী সাহেবের নিকট হইতে এইরূপ আশ্বাস পাইয়া আমরা ‘কলিকাতা রাখ’ আন্দোলন আরও জোরদার করি। বৃদ্ধ হক সাহেব পর্যন্ত এই আন্দোলনে আমাদের সাথে নামিয়া আসেন। কিন্তু কিছুদিন যাইতে-না-যাইতেই আমরা লীগ-নেতাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করিলাম। হক সাহেব ও শহীদ সাহেব প্রকাশ্যভাবে কলিকাতা রাখার আন্দোলন সমর্থন করিতেছিলেন। কিন্তু দেখা দেখা গেল কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ বাউণ্ডারি কমিশনের সামনে হক সাহেব ও শহীদ সাহেবকে সওয়াল-জওয়াব করিতে না দিয়া যুক্ত প্রদেশের মিঃ ওয়াসিমকে উকিল নিযুক্ত করিলেন এবং জনাব হামিদুল হককে তাঁর সহকারী করিলেন। মুসলিম লীগের অনেকে ও ছাত্রলীগের সকলেই এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ করিলেন। হক সাহেব খবরের কাগযে বিবৃতি দিলেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হইল না। এমন সময়ে খাজা নাফিমুদ্দিন সাহেব নেতা নিযুক্ত হইবার পরদিন হইতেই প্রকাশ্যভাবে উল্টা বাতাস বহিতে লাগিল। পূর্ব-বাংলার এবং খাজা-গ্রুপের অনেক নেতা একাধিক দিন ‘ইত্তেহাদ’ অফিসে আমার সাথে সাক্ষাৎ করিয়া কলিকাতা রাখার আন্দোলন বন্ধ করিতে অনুরোধ করিলেন। কলিকাতা ছাড়িয়া দেওয়ার অসংখ্য লাভ ও সুবিধা সম্পর্কে অনেক যুক্তি-তর্ক দিলেন। তাঁদের যুক্তিগুলির মধ্যে একটি বড় যুক্তি এই ছিল যে কলিকাতা ছাড়িয়া দিলে সমস্ত দায়শোধ করিয়াও পূর্ব বাংলা নগদ তেত্রিশ কোটি টাকা পাইবে। এই টাকা দিয়া আমরা পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকা শহরকে নিউইয়র্ক শহর করিয়া ফেলিতে পারিব। বক্তারা খাজা নাযিমুদ্দিন ও চৌধুরী হামিদুল হক সাহেবের বরাত দিয়া এই হিসাবের অংক আমার সামনে পেশ করিলেন। আমি যদিও তাদের যুক্তি মানিলাম না, তথাপি তাঁদের-দেওয়া এই আর্থিক যুক্তিটা আমার কলিকাতা রাখার উৎসাহে কিছুটা পানি ঢালিতে সমর্থ হইল। তারপর ‘আজাদ’ ‘স্টার-অব-ইণ্ডিয়া ‘মনিং নিউয’ ইত্যাদি খাজা-সমর্থক কাগযগুলি আস্তে-আস্তে ‘কলিকাতা রাখ আন্দোলন হইতে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিলেন। তাঁরা এইরূপ উদার নীতিকথা বলিতে লাগিলেনঃ “আমরা যাই বলি না কেন এটা স্বীকার করিতেই হইবে যে কলিকাতা হিন্দু-প্রধান স্থান। আমরা মুসলমানরা এখানে মাইনরিটি একথা ত আর অস্বীকার করা যায় না। মেজরিটিকে উৎখাত করিয়া মাইনরিটি আমরা কলিকাতা রাখিতে চাই না। এটা গণবিরোধী হইবে। তাছাড়া হিংস্র উপায়ে আমরা কলিকাতা রাখার পক্ষপাতী নই।” গত দুইমাস ধরিয়া যাঁদের কলমের মুখে কলিকাতার দাবিতে অগ্নিস্ফুলিংগ বিচ্ছুরিত হইতেছিল, খাজা নাযিমূদ্দিন নেতা নির্বাচিত হওয়ার তিন দিনের মধ্যেই তাদের মুখেই অহিংসার বাণী ও মেজরিটি-মাইনরিটির যুক্তি শোনা যাইতে লাগিল। এক ইত্তেহাদেই আমরা কলিকাতার কথা বলিয়া যাইতে থাকিলাম। খাজা-গ্রুপের কলিকাতার হিন্দু মেজরিটির যুক্তি মানিয়া লইলে ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা প্রভৃতি জিলা শহরের, বস্তুতঃ পূর্ব-বাংলার অধিকাংশ জিলা নগরের হিন্দু মেজরিটির যুক্তিও স্বতঃই আসিয়া পড়ে। এসব কথাও বলিতে লাগিলাম। কিন্তু কে শুনে কার কথা?
৮. মার্কেট ভ্যালু বনাম বুক ভ্যালু
আমি বুঝিলাম, সকলেই বুঝিলেন, কলিকাতা আমরা হারাইয়াছি। কাজেই তখন বিজয়ী খাজা-গ্রুপের বন্ধুদের বলিলাম : ‘আপনাদের কথামতই কলিকাতা ছাড়িয়া দিলাম। এইবার তেত্রিশ কোটি টাকাটা আদায়ের ব্যবস্থা করুন।‘ নেতারা এ-বিষয়ে নিশ্চিত থাকিতে আমাকে আশ্বাস দিলেন। বুঝা গেল, অতঃপর বাটোয়ারা কাউন্সিলের উপর সব নির্ভর করিতেছে। প্রাদেশিক বাটোয়ারা কাউন্সিলে তখন গবর্নর চেয়ারম্যান, পশ্চিম বাংলার পক্ষে নলিনী সরকার ও ধীরেন মুখার্জী; পূর্ব-বাংলার পক্ষে খাজা নাষিমুদ্দিন ও শহীদ সুহরাওয়ার্দী। কেন্দ্রীয় পার্টিশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ভারতের পক্ষে সর্দার প্যাটেল ও মিঃ এইচ. এম. প্যাটেল এবং পাকিস্তানের পক্ষে লিয়াকত আলি খাঁ ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলি। চারটি ব্যাপারে প্রাদেশিক পার্টিশন কাউন্সিল একমত হইতে না পারায় নিয়ম অনুসারে ঐ চারটি বিষয় কেন্দ্রীয় পার্টিশন কাউন্সিলে পাঠান হয়। ঐ চারটি বিষয়ের মধ্যে সরকারী বাড়ি-ঘরের মূল্য-নির্ধারণের নীতিই ছিল প্রধান। পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিরা দাবি করেন যে বর্তমান বাজার মূল্যে মোর্কেট ভ্যালু) সরকারী বাড়ি-ঘরের দাম হিসাব করিতে হইবে। পক্ষান্তরে পশ্চিম বাংলার প্রতিনিধিরা দাবি করেন যে আদি মূল্যে বুক ভ্যালু) ও-সবের দাম ধরিতে হইবে। প্রাদেশিক পার্টিশন কাউন্সিলে পূর্ব বাংলার বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা ছিলেন রেভিনিউ সেক্রেটারি ও পার্টিশন কাউন্সিলের অন্যতম সেক্রেটারি খান বাহাদুর মহবুবুদ্দিন আহমদ ও তৎকালীন সুপার ইঞ্জিনিয়ার {পরে চীফ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বার সাহেব। ‘ইত্তেহাদ’ আফিসে আমার রুমে ইহাদের প্রায়ই বৈঠক হইত। ইহাদের উপদেশ মতই আমি এই ব্যাপারে সম্পাদকীয় লিখিতাম এবং সংবাদ প্রকাশ করিতাম। এঁদের সংগে আলোচনা করিয়াই আমি সরকারী সম্পত্তি বন্টনে মার্কেট ভ্যালু ও বুক ভ্যালুর তাৎপর্য বুঝিতে পারি। মার্কেট ভ্যালুটা সকলেই বুঝেন। শহরে-বন্দরে বিশেষতঃ কলিকাতায় জমি ও বাড়ি-ঘর ইত্যাদি স্থাবর সম্পত্তির দাম আগের চেয়ে শত-সহস্রগুণ যে বাড়িয়া গিয়াছে এটা সুস্পষ্ট। কিন্তু বুক ভ্যালু বা আদি দাম যে খরিদ-দাম বা নির্মাণ-মূল্যও নয়, তারও কম, একথা সকলের বুঝিবার কথা নয়। উক্ত বিশেষজ্ঞদ্বয়ের নিকট হইতে আমি জানিতে পারি যে সরকারী হিসাব-মতে প্রথম শ্রেণীর ইমারতসমূহের দাম প্রতি বছর শতকরা একটাকা করিয়া কমিয়া যায়। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর ইমরাতসমূহ কমে প্রতিবছর শতকরা দুইটাকা। মেশিনাদি-সরঞ্জামের ডিপ্রিসিয়েশন ও উয়ার এও টিয়ার যে নীতিতে ধরা হয়, বাড়ি-ঘরের ডিপ্রিসিয়েশনও সেই নীতিতেই ধরা হয়। ফলে কলিকাতার সরকারী বাড়ি-ঘর ইত্যাদি স্থাবর সম্পত্তির কোনটা একশ বছরে আর কোনটা পঞ্চাশ বছরে মূল্যহীন যিরোতে পরিণত হইয়াছে। এ কথার অর্থ এই যে কলিকাতার সরকারী বাড়ি-ঘর ভারত ও পশ্চিম বাংলা যিরো’ মূল্যে পাইবে। এইজন্য পশ্চিম বাংলা ও ভারতের প্রতিনিধিরা ‘বুক ভ্যালুর উপর অত জোর দিতেছিলেন। পক্ষান্তরে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিরা মার্কেট ভ্যালু দাবি করিতেছিলেন।
৯. পার্টিশন কাউন্সিলের ভূমিকা
খাজা নাযিমূদ্দিন শহীদ সাহেবকে পরাজিত করিয়া মুসলিম লীগ পার্টির লীডার হল ৫ই আগস্ট তারিখে। তার মানে তিনিই পূর্ব-বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হইয়াই অক্টোবর মাসের শেষ দিকে তিনি সুহরাওয়ার্দী সাহেবের স্থলে হামিদুল হক চৌধুরী সাহেবকে পার্টিশন কাউন্সিলের মেম্বর করেন। কাজেই ঐ সময় হইতে এ ব্যাপারের দেন-দরবার ও পরামর্শ আমি শহীদ সাহেবের বদলে হামিদুল হক চৌধুরী সাহেবের সহিতই করিতাম। আমার জ্ঞানবুদ্ধিমত পরামও তাঁকেই দিতাম। আমি দেখিয়া খুশী ও নিশ্চিত হইলাম যে শহীদ সাহেবের মতই চৌধুরী সাহেবও বুক ভ্যাল ও মার্কেট ভ্যালুর তাৎপর্য বুঝেন এবং পূর্ব-বাংলার আর্থিক জীবনে এই প্রশ্নের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। ইতিপূর্বে তিনি তেত্রিশ কোটি টাকা পাওয়ার যে আশায় কলিকাতা ত্যাগে আমাদেরে রাযী করিয়াছিলেন, মার্কেট ভ্যালু ছাড়া সে টাকা যে পাওয়া যাইবে না, সেটাও তিনি বুঝিতেছিলেন। সুতরাং এদিক হইতে আমি আশ্বস্ত হইলাম। কিন্তু কেন্দ্রীয় পার্টিশন কাউন্সিলে বাংলার কোন প্রতিনিধি না থাকায় এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকিবার পরামর্শ আমরা ও অফিসাররা সকলেই এক বাক্যে দিতে থাকিলাম। এ বিষয়ে অতিরিক্ত সাবধানতার দরকার এইজন্য যে শুধু পশ্চিম বাংলা ও ভারত যে কলিকাতার সম্পত্তির বুক ভ্যালু দেওয়ার পক্ষপাতী, তা নয়। কেন্দ্রীয় পশ্চিম পাকিস্তানীরাও বুক ভ্যালুর পক্ষপাতী। কারণ লাহোর করাচি পেশওয়ার কোয়েটা ইত্যাদি স্থানের সরকারী দালান-ইমারত ও স্থাবর সম্পত্তির বাজার মূল্য অনেক হইবে এবং সে মূল্য পশ্চিম পাঞ্জাব সরকার ও কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার ভারত সরকার ও পূর্ব পাঞ্জাব সরকারকে দিতে বাধ্য থাকিবেন। অথচ চুক্তি অনুসারে কলিকাতার সম্পত্তির দামটা পাইবে পূর্ব-বাংলা সরকার। কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার এর এক পয়সাও পাইবেন না। মুসলিম বাংলার স্বার্থ সম্পর্কে অতীতের নিখিল ভারতীয় মুসলিম নেতৃত্ব যেরূপ ব্যবহার করিয়াছেন, তাতে কলিকাতা ভারতকে বিনামূল্যে দিয়া তার বদলা লাহোরা বিনামূল্যে পাইতে তাঁদের বিবেকে একটুকুও বাধিবে না। এ সব কথা উক্ত অফিসারদ্বয় ও আমরা অনেকেই নেতৃবৃন্দকে বিশেষতঃ চৌধুরী হামিদুল হক সাহেবকে বুঝাইলাম। তিনি আমাদিগকে নিশ্চিন্ত থাকিতে আশ্বাস দিলেন।
কিন্তু আমরা আশ্বাস পাইলাম না। অতঃপর পার্টিশন কাউন্সিলের পরবর্তী সভা ঢাকায় হইল। আমরা কিছুই জানিতে পারিলাম না। সরকারী দলের মুখপত্র ‘আজাদে (২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭)-এর খবরটা ছিল এইরূপ: গতকাল (২৪-৯-৪৭) পার্টিশন কাউন্সিলের সভা ঢাকায় হইয়াছে। পূর্ব-বাংলার গভর্নর (সার ফ্রেডারিক বোর্ন) সভাপতিত্ব করিয়াছেন। সম্পত্তি দায় বিভাগ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছে। পরবর্তী সভা হয় কলিকাতায় ৮ই নবেম্বর।
এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যে কি, তা আমরা জানিতে পারি এক মাস পরে ১ই ডিসেম্বর তারিখে। ঐ তারিখে কেন্দ্রীয় পার্টিশন কাউন্সিলের ভারতীয় প্রতিনিধি সর্দার প্যাটেল ভারতীয় গণ-পরিষদে ঘোষণা করিলেন : “সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণের নীতি সম্পর্কে পাকিস্তানের সাথে আমাদের যে বিরোধ ছিল আপোসে তা মিটিয়া গিয়াছে। বুক ভ্যালুতে সম্পত্তির মূল্য নির্ধারণ স্থির হইয়াছে।” ছাত্রনেতা রাজনৈতিক নেতা ও আমরা সকলে চঞ্চল হইয়া উঠিলাম। হামিদুল হক চৌধুরী সাহেবের বেনিয়াপুকুর রোডের বাড়িতে তাঁদের ভিড় হইল। কেমন করিয়া এটা হইল? আমাদের পক্ষে বুক ভ্যালুতে কে রাজি হইলেন? এখন আমাদের তেত্রিশ কোটি টাকা পাওয়ার কি হইবে? তিনি আমাদের মতই অবতা প্রকাশ ও হায়-আফসোস করিলেন। তিনি শীঘ্রই প্রধানন্ত্রী খাজা নাযিমূদ্দিন, কেন্দ্রীয় পার্টিশন কাউন্সিলে আমাদের প্রতিনিধি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করিয়া যা হয় একটা ব্যবস্থা করিবেন বলিয়া সকলকে আশ্বাস দিয়া বিদায় করিলেন।
বেশ কিছুদিন পরে হামিদুল হক সাহেব এক বিবৃতিতে ঘোষণা করিলেন। হিসাবের হেরফেরে আমরা তেত্রিশ কোটি পাইলাম না বটে তবে ওজেবাদ করিয়াই আমরা পশ্চিম বাংলা ও ভারত সরকারের নিকট হইতে নেট নয় কোটি পাইব। সকলে ছাতি পিটিয়া হায়-হায় করিলাম। কোথায় তেত্রিশ কোটি? আর কোথায় নয় কোটি? কিন্তু আমাদের ছাতি পেটার বেদনার উপশম হইবার আগেই আবার মাথায় হাত মারিবার দরকার হইল। কারণ মিঃ হামিদুল হক চৌধুরীর কথাটা মাটিতে পড়িবার আগেই মিঃ নলিনী রঞ্জন সরকার এক বিবৃতি দিলেন। তিনি হিসাব-নিকাশ করিয়া দেখাইলেন যে সব হিসাব করিয়া ভারত ও পশ্চিম বাংলার কাছে পূর্ব-বাংলার পাওনা হইয়াছে মোট তিন কোটি, আর পূর্ব-বাংলার কাছে ভারত ও পশ্চিম বাংলার পাওনা হইয়াছে নয় কোটি। পূর্ব-বাংলা আগে পশ্চিম বাংলা ও ভারতের নয় কোটি শোধ করিবে। তারপর তার পাওনা তিন কোটি টাকা পাইবে। অর্থাৎ ওজেবাদ করিয়া শেষ পর্যন্ত পূর্ব-বাংলার, পাওনা নয়, দেনা থাকিল ছয় কোটি। হায় কপালতেত্রিশ কোটি যোগের বদলে ছয় কোটি বিয়োগ। নলিনীবাবুর এই ঘোষণায় মিঃ হামিদুল হক চৌধুরী কেন মূৰ্ছা গেলেন না, আমরাই বা বাঁচিয়া থাকিলাম কিরূপে, আমি আজিও তা বুঝি নাই। বোধ হয় এই সানায় যে শুধু রেডক্লিফ একা আমাদেরে ঠকাইতে পারেন নাই; আমরা সকলে মিলিয়াই আমাদেরে ঠকাইয়াছি। তার উপর সত্য যুগ কলি যুগ হইয়াছে। সত্য যুগে ছিল ‘শুভংকরের ফাঁকি, তেত্রিশথনে থনে তিনশ গেলে তিরিশ থাকে বাকী’; আর কলিযুগে : ‘শুভংকরের ফাঁকি, তেত্রিশথনে থনে শূন্য গেলে দেনা থাকে বাকী।‘