ঝড়ে তছনছ
উনত্রিশা অধ্যায়
১. বজ্রপাত
৭ই অক্টোবর ১৯৫৮ সাল। রাত আটটা। রেডিওতে শুনিলাম, দেশে মার্শাল ল হইয়াছে। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্যা শাসন ‘এ্যাব্রোগেট’ করিয়াছেন। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা ও আইন-পরিষদ ভাংগিয়া দিয়াছেন। প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইউব খাঁকে প্রধানমন্ত্রী ও চিফ মার্শাল ল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিযুক্ত করিয়াছেন।
স্তম্ভিত হইলাম। রেডিওতে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সেনাপতির মুখে কথাটা না শুনিলে বিশ্বাস করিতাম না। ওঁদের মুখে শুনিয়াও বিশ্বাস করা সহজ হইল না। শাসন বাতিল করার ক্ষমতা এরা পাইলেন কোথায়? মিলিটারি কু করিতে যে শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা লাগে না, এটা আমি তখনও বুঝি নাই। কিন্তু শাসনতন্ত্র বাতিল করিয়া সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করিলে শাসনতন্ত্রের সৃষ্ট প্রেসিডেন্টও যে থাকেন না, এটাও কি ওঁরা বুঝেন নাই? না বুঝার কথা নয়। কাজেই কোথাও কোনও মারপ্যাঁচ আছে। যত মারপ্যাঁচই থাকুক, কোমরে যার জোর আছে, অর্থাৎ দেশরক্ষা বাহিনী যাঁর পক্ষে তাঁরই জয় হইবে, এটা বুঝা গেল। কিন্তু কেন কি উদ্দেশ্যে এই বিপ্লবের তছনছ করা হইল, বোঝা গেল না। রাজাহীন প্রজাতন্ত্র শাসনতন্ত্র বাতিল করার উদ্দেশ্য কি হইতে পারে?
অন্য কিছু চিন্তা করিবার ছিল না বলিয়াই এইসব সুস্পষ্ট নিরর্থক চিন্তা করিতেছিলাম। আর ভাবিবই কি ছাই। কোনই কূল-কিনারা করিতে পারিলাম না। কার সাথেই বা কথা বলিব? প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান করাচিতে। পার্টির সেক্রেটারি মুজিবুর রহমানও সেখানে। লিডার সুহরাওয়ার্দীও করাচিতেই থাকেন। কেউ নাই ঢাকায়। দলের মন্ত্রীদের কারো কারো খোঁজ করিলাম। না, কেউ বাসায় নাই। গবর্নর জনাব সুলতানুদ্দিন আহমদ অন্তরংগ বন্ধু-মানুষ। তাঁকে টেলিফোন করিতে হাত উঠাইলাম। দ্বিতীয় চিন্তায় বাদ দিলাম। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী কয়েকদিন আগে ঢাকায় আসিয়াছেন। অগত্যা তাঁকেই ধরিলাম। কথা হইল। তিনিও আমার মতই স্তম্ভিত। আর কিছু জানেন না। ইশারা-ইংগিতে বলিলেন : টেলিফোনে এ বিষয়ে আলাপ করা নিরাপদ নয়। ঠিকই ত! ছাড়িয়া দিলাম। বাসার কাছেই ‘ইত্তেফাক’ অফিস। অগত্যা সেখানে যাইব ভাবিলাম। এমন সময় গবর্নরের টেলিফোন পাইলাম। স্বয়ং তিনিই ধরিয়াছেন। বলিলেন : গাড়ি পাঠাইছি। চইলা আস। আর কিছু বলিলেন না।
গাড়ি আসিল। গবর্নমেন্ট হাউসে গেলাম। কথা হইল। তিনিও স্তম্ভিত হইয়াছে। আভাসে-ইংগিতেও কোনও আহট পান নাই। বলিলাম : কাজটা সম্পূর্ণ বে-আইনী। গবর্নর শাসনন্ত্র বজায় রাখিতে আইনতঃ ও ন্যায়তঃ বাধ্য। কাজেই তিনি এটা অগ্রাহ্য করিতে পারেন। স্বীকার করিলেন। কিন্তু এটাও তিনি বলিলেন : শাসন অনুসারেই প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ ছাড়া তিনি কিছু করিতে পারেন না। তিনি আসলে প্রধানমন্ত্রীর রবার স্ট্যাম্প মাত্র। বুঝিলাম তাঁর কথাই ঠিক। আরেকটা খবর দিলেন। তাঁর বেগম সাহেব করাচি গিয়াছিলেন। তাঁকে প্রেসিডেন্ট হাউসে নেওয়া হইয়াছে। খানিক আগে তাঁর সাথে কথা হইয়াছে। ব্যাপার-স্যাপার সুবিধার নয়। সাবেক আইজি মিঃ যাকির হোসেনকে যরুরী খবরে করাচি নেওয়া হইয়াছে। সুলতানুদ্দিনের দৃঢ় সন্দেহ তাঁর বদলে মিঃ যাকির হোসেনকেই গবর্নর করা হইতেছে। দেখা গেল, আমরা দুইজনই সমান নিরুপায়। উভয়ের মন খারাপ। আলাপ জমিল নাবাসায় ফিরিয়া আসিলাম। যাইতে-আসিতে দেখিলাম সারা শহর থমথমা।
বাড়ির সবাই স্তম্ভিত, বিষণ্ণ। কারও মুখে কথা নাই। কাজেই নির্বিবাদে নির্বিঘ্নে সবাই চিন্তা করিতে লাগিলাম। পরপর কয়েকটা ঘটনা মনে পড়িয়া গেল। একটা মাত্র তিন-চারদিন আগের ঘটনা। বাসায় একটা প্রেস-কনফারেন্স ডাকিয়াছিলাম। প্রায় জন পঁচিশেক সাংবাদিক সমবেত হইয়াছিলেন। আসন্ন নির্বাচনে শান্তি-শৃংখলার সংগে দেশের এই সর্বপ্রথম জাতীয় নির্বাচন সমাধায় সাংবাদিকরা কিরূপে সাহায্য করিতে পারেন, তা বলার জন্যই এই প্রস-কনফারেন্স। আমি নিজে ত্রিশ বছরের সাংবাদিক। রাজনীতিক কর্মী হিসাবে বহু নির্বাচন করার অভিজ্ঞতাও আমার আছে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হইতে তাঁদেরে দেখাইলাম ও সাংবাদিক ইচ্ছা করিলে শান্তি শৃংখলার সাথে নির্বাচন সমাধাও করিতে পারেন। আবার ইচ্ছা করিলে মারাত্মক অশান্তিও সৃষ্টি করিতে পারেন। সাংবাদিকরা সকলে আমার সাথে একমত হইলেন। যাঁর-তাঁর দলীয়-আস্থা-নির্বিশেষে তাঁরা নিরপেক্ষভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে তাঁদের কর্তব্য করিবেন, এই আশ্বাস দিয়া সন্ধ্যার অনেক পরে তাঁরা বিদায় হইলেন।
সাংবাদিকরা চলিয়া যাওয়ার পরও তিন-চারজন লোক থাকিলেন। এরা একেবারে পিছনের কাতারে ছিলেন বলিয়া তাঁদের দিকে এতক্ষণ বিশেষ লক্ষ্য করি নাই। এক-আধবার ওদিকে ন্যর দিয়াই বুঝিয়াছিলাম, ওঁরা আমার রোজকার মজলিসী বন্ধু। কিন্তু সাংবাদিকরা চলিয়া যাইবার পর দেখিলাম ওঁদের মধ্যে একজন আমার বন্ধু হইলেও রোজকার মজলিসী দরবারী লোক নন। তিনি আমার ল্যান্ডলর্ড মিঃ ই. এ. চৌধুরী। তিনিও মাঝে মাঝে আসেন। আমাকে বড়ভাই মানেন। আমিও তাঁকে ছোট-ভাই মানি। কিন্তু আমার দরবারী তিনি নন। কাজেই তাঁকে দেখিয়া অবাক হইলাম। বাড়িভাড়ার তাগাদায় আসেন নাই ত? হাসিয়া বলিলাম চৌধুরী, কবে থনে সাংবাদিক হৈলা? তিনি খুবই রসিক যুবক। আমার রসিকতার রস গ্রহণ করিয়া হাসিলেন। বলিলেন : কিন্তু ভাইসাব আমি ভাবতাছি, আপনে এই বৃথা পরিশ্রম ও অর্থ-ব্যয়টা করলেন কেন? আমি বিষয়ে বলিলাম: কোনটারে তুমি বৃথা পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় কইতেছ? চৌধুরী সাহেব গম্ভীর হইয়া পাল্টা প্রশ্ন করিলেন। ‘আপনে কি সত্যই বিশ্বাস করেন ইলেকশন হবে? আমি আরও বিশিত হইয়া বলিলাম : বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন কোথায়? ইলেকশনের দিন-তারিখ ত ঠিক য়াৈই গেছে।
অতঃপর চৌধুরী সাহেব দৃঢ় প্রত্যয়ের সুরে বলিলেন যে তাঁর নিশ্চিত বিশ্বাস নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের আগেই একটা কিছু ঘটিয়া যাইবে। তার অনেক আলামতই তিনি দেখিতেছেন। একটা আলামত এই যে মাত্র দুই-একদিন আগে তিনি নিজে দেখিয়াছেন চাঁটগা হইতে স্পেশ্যাল ট্রেন বোঝাই হইয়া মিলিটারি ঢাকার দিকে আসিতেছে। অতি উচ্চ হাসিতে তাঁর সন্দেহ দূর করিবার চেষ্টা করিলাম। বলিলাম। ও-সব স্মাগলিং বন্ধ করার জন্য ‘অপারেশন ক্লোড ডোরের’ আম্রোজন। তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করিলেন না। না করিবার অনেক কারণও বলিলেন। কেউ কাকেও বুঝাইতে পারিলাম না। যার-তার মত লইয়া বিদায় হইলাম।
এর পর মনে পড়িল, কয়েকদিন আগে বন্ধুবর আবু হোসেন সরকার ও মোহন মিয়াও এই ধরনের কথা বলিয়াছিলেন : শহরে বন্দরে ও রেল স্টেশনে সৈন্যবাহিনীর অস্বাভাবিক যাতায়াত দেখিয়াই তাঁরা বলিয়াছিলেন একটা কিছু যেন হইতেছে। ঐ অপারেশন ক্লোড ডোর দিয়া তাঁদেরও বুঝাইয়াছিলাম। তাঁরা যেন অগত্যা বলিয়াছিলেন : হৈতেওবা পারে।
২. পূর্বাভাস
সূতরাং দেখা গেল, আমি ছাড়া আর সকলেই যেন বিপদ আশংকা করিতেছিলেন। আজ বুঝিলাম, ওদের চেয়ে আমি কত নির্বোধ। নইলে এসব কথা আমার মনে বাজিল না কেন? অল্প কিছুদিন আগে করাচিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিঃ ল্যাংলি এবং তাঁরও আগে মার্কিন ফার্স্ট সেক্রেটারি মিঃ ড্যাদার সাথে পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন এ্যাটিচুড নিয়া আলাপ-আলোচনা করিতেছিলাম। উভয়েই পাকিস্তানী রাজনীতির সাম্প্রতিক ভাব-গতিতে দুর্ভাবনা প্রকাশ করিয়াছিলেন। আসন্ন নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানে মুসলিম লীগ জয়লাভ করিবে এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন করিবে, এসম্বন্ধে তাঁদের পূর্ব-ধারণা দৃঢ় ছিল। তাঁরা বিশ্বাস করিতেন আওয়ামী লীগ মার্কিন-বিরোধী। আওয়ামী লীগের সুস্পষ্ট মত সিটো বাগদাদ প্যাক্টের বিরুদ্ধে এটা তাঁদের জানা কথা। মওলানা ভাসানী বাহির হইয়া যাওয়ার পরও আওয়ামী লীগে এই মতের লোকই বেশি। কিন্তু ভাতে তাঁদের ভয়ের কোন কারণ নাই। আওয়ামী লীগের অধিকাংশের মত যাই থাকুক, তাঁদের অবিসম্বাদিত নেতা সুহরাওয়ার্দীকে মার্কিন-নেতারা বিশ্বাস করেন। তিনি নীতি হিসাবেই ইংগ-মার্কিন বন্ধুত্বে বিশ্বাসী। মুসলিম লীগও মার্কিন সমর্থক, এ বিশ্বাসও তাঁদের দৃঢ়। সুতরাং আগামী নির্বাচনের পরে যখন পূর্ব-পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করিবে, তখন কেন্দ্রে দুই পার্টির কোয়েলিশন সরকার হইতেই হইবে। এই কোয়েলিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী সুহরাওয়ার্দী ছাড়া আর কেউ হইতে পারেন না। সুতরাং মার্কিন-সমর্থক পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ও সুহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকারও মার্কিনঘেষা হইতে বাধ্য। মার্কিন দূতাবাসের চিন্তা-ধারা যখন এই পথে, ঠিক সেই সময় সর্দার আবদুর রব নিশতারের মৃত্যুতে খান আবদুল কাইউম খা মুসলিম লীগের সভাপতি হন। সভাপতি হইয়াই তিনি মার্কিনীদের প্রতি কটু-কাটব্যে মওলানা ভাসানীকেও ছাড়াইয়া গেলেন। বিরাট-বিরাট জনসভায় তিনি এই ধরনের বক্তৃতা করিয়া বিপুল সম্বর্ধনা-অভিনন্দন পাইতে লাগিলেন। সারা পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র এবং খোদ করাচিতে মুসলিম লীগ-সমর্থক বিরাট জনতা মার্কিন দূতাবাসের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের ও মার্কিনী দালাল বলিয়া কথিত ইস্কান্দর মির্যার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাইতে লাগিল। ঠিক এই সময়েই মার্কিন-দূতাবাসের ঐসব অফিসারকে বিষণ্ণ ও পাকিস্তানের ভবিষ্যত সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন দেখিয়াছিলাম। আসন্ন নির্বাচনের ফলে পাকিস্তান পশ্চিমা রাষ্ট্র গোষ্ঠী হইতে বাহির হইয়া যাইবে, স্বয়ং সুহরাওয়ার্দীও আর ঠেকাইয়া রাখিতে পারিবেন না। এ সম্পর্কে তাঁদের মনে এই সময়ে আর কোনও সন্দেহ দেখিলাম না। আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট মির্যা আর প্রেসিডেন্ট হইতে পারিবেন না। এই সন্দেহ হওয়ার পর হইতে তিনিও নানা কৌশলে নির্বাচন ঠেকাইবার চেষ্টায় ছিলেন। আমার সন্দেহ, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হইয়াও আমেরিকানরা এই কারণে এই সময়ে পাকিস্তানের আসন্ন নির্বাচনের বিরোধী হইয়া উঠিয়াছিলেন। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট মির্যার সাথে তাঁদের যোগাযোগ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এই কারণে আমার মনে হয় পূর্ব-পাকিস্তান আইন-পরিষদে বিরোধী দলের গুণ্ডামি, কেন্দ্রে ফিরোয় খাঁর মন্ত্রিসভায় খামখা রদ বদল, পোর্টফলিও লইয়া অর্থহীন বিসম্বাদ ইত্যাদি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একই অদৃশ্য হস্ত পর্দার আড়াল হইতে এই পুতুল নাচ করাইয়াছিল। এমন কি সি. আই. এ.-র হাত থাকাও অসম্ভব নয়।
৩. কর্ম শুরু
পরদিন। ৮ই অক্টোবর। সেক্রেটারিয়েট-ভবনে একটা মিটিং ছিল। কয়েকদিন আগে পূর্ব-পাকিস্তান সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উৰ্দ্ধগতি দাম সম্বন্ধে তদন্ত করিবার জন্য কমোডিটি-প্রাইস-কমিশন নামে একটি কমিশন নিযুক্ত করিয়াছিলেন। আমাকে এই কমিশনের চেয়ারম্যান করা হইয়াছিল। এই কমিশনেরই প্রথম বৈঠক ছিল ৮ই অক্টোবর সকাল নটায়। সেক্রেটারিয়েট-বনে। মার্শাল ল জারি হওয়ায় কমিশনের বৈঠক মোটেই হইবে কি না, জানিবার জন্য আমি কমিশনের সেক্রেটারি মিঃ কেরামত আলী সি. এস. পি.-কে টেলিফোন করিলাম। তিনি জানাইলেন তিনি কোনও বিপরীত নির্দেশ পান নাই। কাজেই কমিশনের কাজ চলিবে। নির্ধারিত সময়ে বৈঠকে উপস্থিত থাকিতে তিনি আমাকে অনুরোধ করিলেন। আমি গেলাম। আমার সভাপতিত্বে সভার কাজ শুরু হইল। সব মেম্বররাই উপস্থিত হইলেন। দশ-বারজন মেম্বরের মধ্যে জন-তিনেক এম, এল এ ছাড়া আর সবাই সেক্রেটারি ও ডি. আই. জি. স্তরের অফিসার। নিয়ম-পদ্ধতি সম্বন্ধে প্রাথমিক আলোচনা শেষ হইবার আগেই কমিশনের সেক্রেটারির বাহিরে ডাক পড়িল। তিনি ফিরিয়া আসিয়া জানাইলেন যে কমিশনের সর্বশেষ পযিশন জানার জন্য গবর্নমেন্ট হাউসে নির্দেশ চাহিয়া ফোন করা হইয়াছে। সে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কমিশনের কাজ আর আগাইতে পারে না। অতএব, আমরা সভার কাজ বন্ধ করিয়া চা-বিস্কুট-পান-সিগারেট খাওয়ায় মন দিলাম। হাযার বিপদেও মানুষ খোশালাপে বিরত হয় না। জানাযার নমাযে ও দাফনে সমবেত মানুষও গল্প করে। আমরাও খোশালাপ শুরু করিলাম। মার্শাল ল সম্বন্ধেও। মার্শাল ল’টা সে জাতির বিপদ, অন্ততঃ পূর্ব-পাকিস্তানে মার্শাল ল’র সমর্থনে কোনও লোক পাওয়া যাইবে না, আমার এই আস্থা ও বিশ্বাস এক ফুৎকারে মিলাইয়া গেল এই বৈঠকেই। মার্শাল ল’র পরে এটাই আমার বাহিরের লোকের সাথে প্রথম মিলন। সমবেত লোকেরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত চিন্তাশীল লোক। আমি দেখিয়া মর্মাহত হইলাম যে এই উচ্চ পদস্থ অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল সরকারী কর্মচারীদের অনেকেই এটাকে জাতির বিপদ বলিয়া মনে করেন নাই। বরং কাজে কথায় ও মুখ-ভংগিতে মনে হইল এতে যেন তাঁদেরই জয় হইয়াছে। মনটা দমিয়া গেল। আর কোনও উৎসাহ থাকিল না। গবর্নমেন্ট হাউস হইতে হাঁ-সূচক কোনও নির্দেশ আসিল না। সাইনিডাই সভা ভাংগিয়া দিয়া বিদায় হইলাম। আর কি কি বিপদ আসিতে পারে, তার অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।
৪. গেরেফতার
বেশিদিন ভাবিতে হইল না। অতঃপর যা শুরু হইল, তা রাজনীতি নয় রাজা নীতি। ১০ই অক্টোবরের রাত দুইটার সময় প্রায় ভাংগিয়া-ফেলার-মত দরজা-ধাক্কা ধাক্কিতে ঘুম ভাংগিল। দরজা খুলিতেই দেখিলাম এলাহি কাণ্ডা আংগিনা-ভরা সশস্ত্র পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী। আমাকে গেরেফতার করিতে আসিয়াছে। বেশ, ধরিয়া নিয়া যান। না, বাড়ি বানা-তল্লাশ হইবে। কারণ নিরাপত্তা আইনে নয়, দুর্নীতি দমন আইনে। বলিলাম ও দুর্নীতি দমন আইনে এমন অগ্রিম গেরেফতার করার ত বিধান নাই। আগে নোটিশ দিতে হইবে। কেস করিতে হইবে। তারপর না গেরেফতার? পুলিশ বাহিনীর নেতা ডি. এস. পি.। তিনি হাসিয়া বলিলেন : এতদিন আইন তাই ছিল বটে, এখন তা বদলান হইয়াছে। মিঃ যাকির হোসেন গবর্নর হইয়া সন্ধ্যার দিকে ঢাকা ফিরিয়াই গবর্নমেন্ট হাউসে পুলিশ ও অন্যান্য বড়-বড় অফিসারদের কনফারেন্স করিয়াছেন। সেখানেই তিনি দুর্নীতি দমন আইন সংশোধন করিয়া অর্ডিন্যান্স জারি করিয়াছেন। ডি. এস. পি. সাহেব এই কনফারেন্স হইতেই সোজা আমার বাসায় আসিয়াছেন। তিনি এক কপি আইনের বই ও তার লাইনের ফাঁকে হাতের-লেখা সংশোধনটি দেখাইলেন। বলিলেন : অর্ডিন্যান্সের সারমর্ম ঐ। গবর্নর সাহেব করাচি হইতে তালিকা লইয়াই আসিয়াছেন। তালিকাভুক্ত সবাইকে গেরেফতারের জন্য চারিদিকে পুলিশ অফিসাররা বাহির হইয়া গিয়াছেন। ডি.এস.পি. সাহেব ঘনিষ্ঠতা দেখাইয়া বলিলেন : সবাই আপনার মত বড়-বড় নেতা। আরও ঘনিষ্ঠভাবে বলিলেন : মোটমাট চৌদ্দজনের তালিকা। কে কে, আভাসে-ইংগিতে তাও বলিয়া ফেলিলেন। সব শুনিয়া আমি বলিলাম। কিন্তু ডি.এস.পি. সাহেব, ঐ অর্ডিন্যান্স গেযেট না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ হইতে পারে না। ডি.এস.পি, হাসিয়া বলিলেন সে বিষয়ে। কোন চিন্তা করিবেন না সার, গেযেট একস্ট্রা-অর্ডিনারি ছাপার জন্য ই. বি. জি. প্রেমে কপি চলিয়া গিয়াছে। আপনাদের কোর্টে নেওয়ার আগেই ছাপা হইয়া আসিয়া পড়িবে। অগত্যা আমি সন্তুষ্ট, ইংরাজিতে যাকে বলে স্যাটিসফাইড, হইলাম। বলিলাম :
তবে খানা-তল্লাশ শুরু করেন। তাঁরা শুরু করিলেন। রাত্র দুইটা হইতে বেলা দশটা পর্যন্ত আটটি ঘন্টা বাড়িটা তছনছ করিলেন। আলমারি, বাক্স, সুটকেস, তোষক, বালিশ, বিছানার উপর-নিচ, বাথরুম, পাকঘর, আমার মোটামুটি বড় লাইব্রেরির বড়-বড় আইন পুস্তকের মলাট-পাতা, কিছু বাদ রাখিলেন না। দীর্ঘ আট ঘন্টা ধরিয়া এই তছনছু চলিল। বেলা দশটার দিকে আমাকে এনটি-কোরাপশান আফিসে নেওয়া হইল। সেখানে গিয়া যাঁদেরে পাইলাম, এবং অল্পক্ষণ মধ্যেই যাঁদেরে আনা হইল, সব মিলাইয়া হইলাম আমরা মোট এগার জন। তাঁদের মধ্যে জনাব হামিদুল হক চৌধুরী, জনাব আবদুল খালেক, জনাব শেখ মুজিবুর রহমান, এডিশনাল চিফ সেক্রেটারি মিঃ আষগর আলী শাহ, চিফ ইঞ্জিনিয়ার মিঃ আবদুল জব্বার প্রভৃতির নামই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ডি.আই.জি, মহীউদ্দিন আহমদের আগমন অপেক্ষায় আমাদের বসাইয়া রাখা হইল। ঘন্টা দুই-তিন অপেক্ষা করা হইল। তাঁর দেখা নাই। অবশেষে সমবেত এস.পি.ডি.এস.পি.রাই আমাদের পৃথক-পৃথক বিবৃতি নিতে লাগিলেন এক-একজন করিয়া। সম্পত্তির তালিকা। আয়-ব্যয়ের হিসাব। লম্বা লম্বা বিবৃতি। এসব করিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। ইতিমধ্যে আসামীদের সকলের বাড়ি হইতেই খানা আসিয়াছিল। পরিবারের লোকজনকেও আসিতে দেওয়া হইয়াছিল। তাঁরাই দুইটা-তিনটার দিকে আমাদের খাওয়াইয়া গিয়াছেন।
অবশেষে সন্ধ্যার সময় আমাদের এস.ডি.ওর এললাসে হাযির করা হইল। এজলাসে এস.ডি.ও, সাহেব একা নন। তাঁর পাশে বসা কর্নেল স্তরের একজন মিলিটারি অফিসার। আমাদের পক্ষের উকিলরা যামিনের দরখাস্ত করিলেন। কোন এযাহার ছাড়াই আমাদের গেরেফতার করা হইয়াছে, সে কথা বলিলেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা মতে আমাদের যামিন দিতে বাধ্য, এই মর্মে অনেক আইন নযির দেখাইলেন। পাবলিক প্রসিকিউটরযামিনের বিরুদ্ধকরিলেন। আসামীরাসবাই প্রভাবশালী জনপ্রিয় নেতা। এরা বাহিরে থাকিলে সমস্ত তদন্ত কার্যই ব্যাহত হইবে।
এস.ডি.ও, সাহেব কথা বলিলেন না। চোখ তুলিয়া আমাদের বা উকিলদের দিকে একবার নযরও করিলেন না। মাথা হেট করিয়া যেমন বসিয়াছিলেন, তেমনি বসিয়া আমাদের দরখাস্তে ‘রিজেক্টেড’ লিখিয়া বাহির হইয়া গেলেন। আমাদেরে জেলখানায় নেওয়া হইল। সবাইকে নেওয়া হইল পুরানা হাজতে। শুনিতে যত খারাপ;আসলে অত খারাপ নয়। বরঞ্চ জেলের মধ্যে একটা সবচেয়ে ভাল জায়গার অন্যতম। প্রকাণ্ড একটা হলঘর। সবাই এক সংগে থাকা যায়। এটাই এ ঘরের আকর্ষণ। দিনে ত বটেই রাতেও সব একত্রে, সভা করিয়া, তাস-দাবা খেলিয়া কাটান যায়।
৫. জেল খানায়
এখানে ঢুকিয়াই পাইলাম মওলানা ভাসানীকে! তাঁকে অবশ্য করাপশান আইনে ধরা হয় নাই, ধরা হইয়াছে নিরাপত্তা আইনে। যে আইনেই হউক, আমরা সবাই মেঝেয় ঢালা বিছানা করিয়া রাত কাটাইলাম। তাতে কোনই অসুবিধা হইল না। কারণ সারারাত দেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আলোচনায় ব্যস্ত রহিলাম।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ যেন আমাদের ‘জেলের মধ্যে অত সুখ’ সহ্য করিতে পারিলেন না। পরদিনই মওলানা ভাসানীকে ‘সেলে’ নিয়া গেলেন। তারপর এক-এক করিয়া মুজিবুর রহমান, আবদুল খালেক ও আমাকে পৃথক-পৃথক সেলে আবদ্ধ করিলেন। প্রথম-প্রথম মানসিক কষ্ট হইল খুবই। কিন্তু সহিয়া উঠিলাম। তখন নিজের চেয়ে বন্ধুদের জন্য চিন্তা হইল বেশি। আমি নিজে লেখক ও পাঠক। দিন-রাত হাবি-জাবি লিখিয়া ও বই পড়িয়া সময় কাটাইতে লাগিলাম। কিন্তু বন্ধুরা না লেখেন, না পড়েন। সুতরাং ‘সেলে’ ওঁদের দিন কিভাবে একাকী কাটে সে দুশ্চিন্তা আমাকে পাইয়া বসিল। এত কষ্টেও একটা খবর পাইয়া নিজের কথা ভুলিয়া গেলাম। ২৮শে অক্টোবরের খবরের কাগযে পড়িলাম প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্যা স্টেপ ডাউন করিয়াছেন। প্রেসিডেন্টির গদি ত্যাগ করিয়াছেন। চিফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর ও প্রধানমন্ত্রী জেনারেল আইউব খা প্রেসিডেন্টের আসনে উপবিষ্ট হইয়াছেন। হাসিব কি কাঁদিব হঠাৎ স্থির করিতে পারিলাম না। নিজের ফাঁদে নিজে পড়িবার এমন দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক ইতিহাসে ত নাই-ই, নীতি কথার বই-এ ছাড়া আর কোথায় পড়িয়াছি, তাও মনে করিতে পারিলাম না। হায় বেচারা মির্যা। ইলেকশন ঠেকাইয়া প্রেসিডেন্টি কায়েম করিবার উদ্দেশ্যেই নিশ্চয় ঐ ‘বিপ্লব’ করিয়াছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টগিরিই ছাড়িতে হইল। বিপ্লব ঘোষণার মাত্র একুশদিন পরেই খবরের কাগযে পড়িলাম, তিনি সস্ত্রীক বিলাত চলিয়া গেলেন। বলা হইল, সেখানেই তিনি স্থায়ীভাবে থাকিবেন। ‘বিপ্লব’ ঘোষণা করিবার অব্যবহিত পরেই তিনি বক্তৃতা করিয়াছিলেন : এ বিপ্লবের বিরুদ্ধতা বরদাশত করা হইবে না। যাদের এটা পসন্দ হইবেনা, তারা সময় থাকিতে দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাউক। হায় কপাল! সকলের আগে এবং সম্ভবতঃ একা তাঁকেই সময়ে থাকিতে দেশ ছাড়িতে হইল।
বাইরে আমাদের পরিবার-পরিজন যামিনের জন্য রোজ এ-কোট-ও-কোট করিতেছিল। তাই সরকার ইতিমধ্যে আমাদের তিন জনকেই নিরাপত্তা আইনে বন্দী করিয়া যামিনের সমস্যার সমাধান করিয়া ফেলিলেন। পরে জানিয়াছিলাম, মওলানা সাহেব ও মুজিবুর রহমানের জন্য আমার দুশ্চিন্তা ছিল নিতান্ত অনাবশ্যক। তাঁরা সকাল-সন্ধ্যা সজীর বাগান করিয়া মরিচ-বেগুনের ও নানা প্রকারের মৌসুমী ফুলের চারা লাগাইয়া আনন্দেই কাল কাটাইতেছেন। নিজের হাতে লাগানো গাছের ফুল ত তাঁরা উপভোগ করিবেনই, এমন কি, মরিচ-বেগুন দিয়া ভর্তা-চাটনিও খাইয়া যাইবার সিদ্ধান্ত তাঁরা করিয়া ফেলিয়াছেন। মুজিবুর রহমান আর এক ধাপ আগাইয়া গিয়াছেন। অন্য ওয়ার্ড হইতে একটা ফজলী আমের চারা (কলম নয়) জোগাড় করিয়া নিজের সেলের ছোট আংগিনায় লাগাইয়াছিলেন। জেলার-সুপারকে বলিয়াছিলেন, ঐ গাছের আম খাইয়া যাইবার জন্য তিনি মন বাঁধিয়াছেন। মুজিবুর রহমানের মনের বল দেখিয়া অফিসাররা অবাক হইয়াছিলেন। কিন্তু বেচারা আবদুল খালেক সেলের একাকিত্ব সহিতে পারিলেন না। তিনি ছিলেন হার্টের রোগী। ঘোরতর অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। তাঁকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বদলি করা হইল। ডাক্তারদের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত তাঁকে মুক্তি দেওয়া হইল। ইতিমধ্যে হামিদুল হক চৌধুরী, আযগর আলী শাহ ও আবদুল জব্বার সাহেবের বিভিন্ন তারিখে যামিনে খালাস হইয়া গেলেন। ওঁরা কেউ নিরাপত্তা বন্দী ছিলেন না। এইভাবে শেষ পর্যন্ত আমরা জন-চারেক আওয়ামী লীগারই জেলখানায় থাকিলাম নিরাপত্তা বন্দী হিসাবে। তিন-চার মাসেও ‘গ্রাউড অব ডিটেনশন’ না দেওয়ায় আমার দ্বিতীয় ছেলে মহবুব আনাম আমার মুক্তির জন্য হাইকোর্টে রীট করিল। অসুস্থ শরীর লইয়াও সুহরাওয়ার্দী সাহেব জোরালো সওয়াল-জবাব করিলেন। আমার বিচার স্প্যাশাল বেঞ্চে গেল। সেখানেও সুহরাওয়ার্দী সাহেব লম্বা সওয়াল-জবাব করিলেন। শেষ পর্যন্ত ২৯শে জুন ১৯৫৯ সাল হাইকোর্টের স্প্যাশাল বেঞ্চ আমাকে খালাস দিলেন।
ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে তিনটা দুর্নীতি দমন আইনের কেস দায়ের হইয়াছিল। মুজিবুর রহমান, ক্যাপটেন মনসুর আলী, কোরবান আলী, আবদুল হামিদ চৌধুরী ও নুরুদ্দিন আহমদ সাহেবানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির কেস হইয়াছিল। আমরা আসামীরা সবাই আওয়ামী লীগার। আওয়ামী লীগাররাই দুর্নীতিবায এটা দেখানোই এই সব কেসের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। শেষ পর্যন্ত আদালতের বিচারে কারো বিরুদ্ধেই কোনও মামলা টিকে নাই। কথায় বলে, ভালরূপ কাদা ছুড়িতে পারিলে কাদা গেলেও দাগ থাকে। আমাদের বিরুদ্ধে কেসগুলো কে বা কারা কি উদ্দেশ্যে করিয়াছিলেন, এটা অবশ্য দেশবাসীই শেষ বিচার করিবে। কিন্তু এ ব্যাপারে দুই-একটি ঘটনার উল্লেখ না করিয়া পারিতেছি না।
৬. দুর্নীতির অভিযোগ
আমাদেরে গেরেফতার করার দুই-এক দিন পরেই গবর্নর যাকির হোসেন আমাদের সাথে জেলখানায় দেখা করেন। কথা প্রসংগে বলেন : তার ইচ্ছায় আমাদেরে গ্রেফতার করা হয় নাই। কেন্দ্রের হুকুমেই এটা হইয়াছে। এর কয়দিন পরে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্যা খবরের কাগযের রিপোর্টারদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন? পূর্ব-পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের গেরেফতার সম্বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকার কিছুই জানেন না। পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছামতই ওঁদের গেরেফতার করা হইয়াছে। এরও কিছুদিন পরে তঙ্কালিন আই.জি.ও অস্থায়ী চিফ সেক্রেটারি জনাব কাযী আনওয়ারুল হক মেরেবানি করিয়া আমার সাথে দেখা করেন। কাযী আনওয়ারুল হকের মরহুম পিতা কাজী এমদাদুল হক, আমাদের সাহিত্যিক-গুরু ছিলেন। সেই উপলক্ষে আমি কাযী আনওয়ারুল হককে ছোট ভাই-এর মতই স্নেহের চোখে দেখিতাম। তিনিও বোধ হয় আমাকে বড় ভাই-এর মতই সম্মান করিতেন। জেলখানার সাক্ষাতে তাঁর সে-শ্ৰদ্ধার ভাব অক্ষুণ্ণ পাইলাম। তিনি দরদ-মাখা গলায় বলিলেন : আপনার মত লোকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ হওয়ায় আমরা অনেকেই অন্তরে ব্যথা পাইয়াছি। কিন্তু সার, আপনারও দোষ আছে। চার কোটি টাকার এতবড় একটা বদনাম খবরের কাগয়ে ছড়াইয়া পড়িল, আপনি তার কি প্রতিকার করিলেন? আমি বিস্ময়ে বলিলাম। বলেন কি কাযী সাহেব? আমি প্রতিবাদ করি নাই? যে মর্নিং নিউয এই বদনামের প্রচারক, তারা আমার প্রতিবাদ ছাপে নাই সত্য কিন্তু করাচির ‘ডন ও ঢাকার সব কাগযে বিশেষতঃ ইত্তেফাকে পুরা প্রতিবাদ ছাপা হইয়াছে। আপনি পড়েন নাই?
পড়িয়াছি নিশ্চয়ই। কাযী সাহেব বলিলেন। কিন্তু আমি প্রতিবাদের কথা বলি নাই। প্রতিকারের কথা বলিয়াছি। আপনার মানহানি মামলা করা উচিত ছিল।
মামলা করার আমার ইচ্ছা, শহীদ সাহেবের বাধা দান, সব কথা কাযী সাহেবকে বলিয়া উপসংহারে বলিলাম। কিন্তু কাযী সাহেব, খবরের কাগযে রাজনীতিক নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পড়িয়াই বিনা-তদন্তে এর আগে কাউকে গেরেফতার করিয়াছেন কোনও দিন? রাজনীতিক দলাদলিতে কত অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগই ত হয়। সেসব দোষাদুবিই যদি মামলা দায়েরের বুনিয়াদ হয়, তবে আপনারা আছেন কিসের জন্য? এতক্ষণে কাযী সাহেব স্বীকার করিলেন এসব রাজনৈতিক ব্যাপার। উপরের হুকুমেই সরকারী কর্মচারিরা এটা করিতে বাধ্য হয়। আমি প্রেসিডেন্ট মিষ ইস্কান্দরের ঘোষণার দিকে কাযী সাহেবের মনোযোগ আকর্ষণ করিলে তিনি মুচকি হাসিলেন, কিছু বলিলেন না।
ব্যক্তিগত কথা বাড়াইয়া পাঠকদের ধৈর্যের উপর যুলুম করিতে চাই না। শুধুদুই একটা কথা বলিয়াই এ ব্যাপারে ইতি করিতে চাই। আমি পারমিট-লাইসেন্সের মালিক বাণিজ্যমন্ত্রী। শিল্পপতিদের ভাগ্যবিধাতা শিল্পমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর উপর আমার বেজায় প্রভাব। তাই পারমিট-লাইসেন্সের বদলা আমি চার কোটি টাকা পার্টি-ফণ্ড তুলিয়াছি। যে দেশে স্কুল-মাদ্রাসা মসজিদ-হাসপাতালের তহবিলও শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি হইয়া যায়, সেখানে চার কোটি টাকার পার্টি-ফন্ড হইতে আমি ব্যক্তিগত সুবিধা কিছুই গ্রহণ করিব না, এমন অবাস্তব কথা বিশ্বাস করিবার মত আহামক লোক আমাদের দেশে একজনও নাই। কাজেই তারা যদি মনে করিয়া থাকে, ঐ টাকা দিয়া আমি অন্ততঃ বেনামিতে পাকিস্তানের বড় বড় শহরে কয়েকখানা বাড়ি-ঘর করিয়াছি, দুই-চারটা শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করিয়াছি, তবে দেশবাসীকে দোষ দেওয়া যায় না। চার কোটি টাকার এতসব বড়-বড় পর্বত যখন মাত্র দশ-পরে হাজারের তিনটি কেসের মুষিক প্রসব করিল, তখন যারা বিস্মিত হইয়াছিল, তারা দুঃখিত হয় নাই। আর যারা দুঃখিত হইয়াছিল তারা বিস্মিত হয় নাই। তিনটি কেসের প্রথমটি আয়ের চেয়ে সম্পত্তি বেশি করার অভিযোগ। মার্কিন সাহায্যের পূর্ব-পাকিস্তানের অংশ চার কোটি টাকার সবটাই আমি মারিয়া দিয়াছি, এই ধারণা হইতেই অভিযোগটা উঠিয়াছিল। যারা অভিযোগটা করিয়াছিল তারা নিজেরাই ওটায় বিশ্বাস করে নাই। ইট ওয়ায টু বিগ টু বিলিত। কিন্তু চার কোটি না হউক, চল্লিশ লক্ষ, চল্লিশ লক্ষ না হউক, চার লক্ষ, চার লক্ষ না হউক চল্লিশ হাজার টাকাও এতবড় প্রতাপশালী শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রী ডান হাত–বাঁ হাত করে নাই! এতবড় বেওকুফকে কোনও প্রধানমন্ত্রী তাঁর শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রী করিতে পারেন, এটা। স্বয়ং পুলিশও বিশ্বাস করিতে পারে নাই। তাই তাঁরা পূর্ব-পাকিস্তান চাষ করিয়া শেষ পর্যন্ত বহু অর্থব্যয়ে উচ্চপদস্থ অনেক পুলিশ কর্মচারি পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাইয়াছিল। ঐসব সুযোগ অভিজ্ঞ তীক্ষ্ণবুদ্ধি পুলিশ কর্মচারি, যাঁরা ত্রিশ হাত কুয়ার নিচে হইতে চোরাই মাল উদ্ধার করিতে পারেন তাঁরা, দীর্ঘদিন পশ্চিম পাকিস্তানের শহর-নগর ও ব্যাংকাদি চাষ করিলেন। নিরাশ হইয়া ফিরিয়া আসিলেন। বোধ হয় রাগ করিয়া বলিলেন : এত শুনিলাম। কিছু পাইলাম না। এতবড় ক্ষমতাশালী মন্ত্রী হইয়াও কিছুকরিল না। লোকটা মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যই না। আসলে লোকটা একটা ইডিয়ট। অগত্যা ফাইনাল রিপোর্ট দিলেন। বাকি থাকিল দুইটা। তার একটাতে এক ভদ্রলোক আমার আত্নীয় বলিয়া পরিচয় দিয়া এক শিল্প-ব্যবসায়ীর নিকট হইতে তের হাযার টাকা আদায় করিয়াছিলেন। মন্ত্রীর সাথে ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের দেখা নাই। কোনও মন্ত্রী বা পদস্থ লোকের নাম করিয়া অন্য কেউ কিছু করিলে মন্ত্রী বা পদস্থ লোক অপরাধী হন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত একথা বিশ্বাস করিলেন না। গেল সে কেসও। বাকি থাকিল একটি। এটি করাচিতে। ঐ ভদ্রলোক কলিকাতা হইতে টেক্সট বুক আমদানির জন্য দশ হাজার টাকার লাইসেন্স পাইয়াছিলেন। তিনি টেক্সট বুক কমিটির বই-এর একজন পাবলিশার। আমার মন্ত্রিত্বের বহু আগে হইতেই তিনি পাবলিশার ও ছাপাখানার মালিক। তিনি ঐ টাকায় টেক্সট বুক আমদানিও করিয়াছিলেন। কিন্তু সেই পুস্তক নিজের জিলায় না দিয়া ঢাকার বাজারে বিক্রয় করিয়াছেন, এই তাঁর অপরাধ। অপরাধ যদি হইয়াই থাকে, তবে তা করিয়াছেন তিনি। অথচ পুলিশ তাঁর নামে মামলা করিয়া মামলা লাগাইলেন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আমার নামে। বাণিজ্যমন্ত্রী লাইসেন্স না দিলে ত তিনি ঐ অপরাধ করিতে পারিতেন না। এটাই বোধ হয় ছিল পুলিশের যুক্তি। কিন্তু গবর্নমেন্ট পুলিশের এই যুক্তি মানিলেন না। মামলা স্যাংশনের জন্য যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে গেল, পুলিশের দুর্ভাগ্যবশতঃ তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মিঃ হবিবুল্লা খান যিনি অল্পদিন আগেও ছিলেন একজন সেশন জজ। তিনি মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেন। জনাব হবিবুল্লা খান সাহেবকে অশেষ ধন্যবাদ। তিনি ঐ নির্দেশ না দিলে আমার মত অসুস্থ লোক করাচি কেস করার টানা-হেচড়া সত্যই বরদাশত করিতে পারিতাম না। এটাও খান সাহেব নিশ্চয়ই বিবেচনা করিয়াছিলেন।
এইভাবে শারীরিক দুর্গতির হাত হইতে আমি রক্ষা পাইলাম। কিন্তু মানসিক দুর্গতি কাটিল না। দুর্নীতির অভিযোগের এই বিশেষ দিকটি লইয়া আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করিয়াছি। মন্ত্রীদের ঘুষ-রেশওয়াত খাওয়ার অভিযোগ সম্বন্ধে আমি একটা বিশেষ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি। কায়েমী স্বার্থীদের ভুঞ্জিত অধিকারের মনোপলিতে হাত দিলেই আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ হইবে। এটা আসলে দুর্নীতি করিতে রাযী না হওয়ার দুর্নীতি। মন্ত্রী হইয়া যদি ওদের ভুঞ্জিত অধিকারের হাত না দেন, তবে আপনি খুব ভাল মন্ত্রী। এক-আধটু খোঁচা-টোচা মারিয়া তুষ্ট হইয়া হাত গুটাইলে আরও ভাল। এইভাবে আপনি আরামে তাঁদের মনোপলি মুনাফার ‘ছটাকখানি অংশও পাইতে পারেন। মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পরেও গুড কণ্ডাক্টের পুরস্কার স্বরূপ পেনশনও পাইতে থাকিতে পারেন।
পক্ষান্তরে যেকোনও সংস্কার প্রবর্তন করিয়া যদি আপনি ওদের ভুঞ্জিত অধিকার নষ্ট করেন, যদি ওদের ‘দই–এর হাড়িতে কৃষ্ট বা লাঠির বাড়িতে ঘৃষ্ট’ কোনটাই না হন, তবে আপনার কপালে দুঃখ আছে? ‘ভাল’ কথায় যদি আপনি নিজের ভাল না বুঝেন, তবে ‘আপ ক্যা সমঝা? আওয়াম কা রাজ আ গিয়া? জনাব, ভুল যাই এ ইয়ে খেয়াল। পিছে বুরা না মানিয়ে।‘
৭. সুহরাওয়ার্দী গেরেফতার
মার্শাল ল’র পৌনে চার বছর পশ্চিম পাকিস্তানে মার্শার ল-বিরোধী কোনও আন্দোলন হইয়াছে কি না জানি না। কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানে হয় নাই। বরঞ্চ প্রথম কয়েক মাস যেন জনসাধারণকে এতে খুশীই মনে হইয়াছিল। আমাদের রাজনীতিকদেরে সিভিল মিলিটারি গবর্নমেন্ট চাকুরিয়ারা যত দোষই দেন না কেন, আমাদের একটা গুণ তাঁদের স্বীকার করিতেই হইবে সেটা এই যে জনমতের বিরুদ্ধে আমরা কিছু করি না। কোনও একটা রাজনৈতিক কাজকে আমরা নিজেরা যত ভাল বা মন্দ মনে করি না কেন, যতক্ষণ জনমত পক্ষে আসা সম্ভবপর না দেখি, ততক্ষণ তার পক্ষে বা বিপক্ষে কোনও কাজ করি না।
যথাসময়ে জনগণের মধ্যে বাস্তব চেতনা ফিরিয়া আসার পরও রাজনীতিক নেতা কর্মীরা কোনও আন্দোলনের সংকল্প করেন নাই। ইচ্ছা বা চিন্তা যে করেন নাই, তা নয়। চিন্তাও করিয়াছিলেন, ইচ্ছাও করিয়াছেন। কিন্তু উচিৎ মনে করেন নাই। একটা হোট নযির দিলেই চলিবে। অত অসুখ, গায়ে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর ও পায়ের বুড়া আংগুলের প্রদাহহেতু পা ফুলিয়া যাওয়ার জুতা-ছাড়া পর-পর কয়টা দিন হাইকোর্টে বক্তৃতা করিয়া সুহরাওয়ার্দী আমাকে খালাস করিলেন। জেলখানা হইতে বাড়ি ফেরা-মাত্র ঐ অসুখ শরীরেই তিনি আমাকে দেখিতে আসিলেন। ঐ শরীর নিয়া আমার জন্য অত কঠোর পরিশ্রম করায় আমার স্ত্রী ও আমি লিডারের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাইলাম। তিনি হাসিয়া বলিলেন : শুধু মৌখিক কৃতজ্ঞতায় তিনি সন্তুষ্ট হইবেন না। তিনি আমার কাছে একটা বড় ফিস্ চান। সে ফিস হইতেছে গণ-আন্দোলনের একটা স্কিম। আমাদের মধ্যে আমিই একমাত্র কংগ্রেস-ট্রইও কম। কাজেই এটা করা আমার ডিউটি। প্রধানতঃ এই কারণেই তিনি আমার খালাসের উপর এত গুরুত্ব দিয়াছেন।
লিডারের চোখে-মুখে প্রবল আগ্রহ ও দৃঢ় সংকল্প দেখিলাম। কিন্তু আমি যখন বুঝাইলাম বিনা-প্রস্তুতি ও বিনা-ট্রেনিং-এ গণ-আন্দোলন শুরু করিলে পরিণামে তাকে অহিংস রাখা যাইবে না এবং তাতে রাষ্ট্রের ও খোদ গণ-আন্দোলনের ক্ষতি হইবে, তখন চট করিয়া লিডার তা বুঝিয়া ফেলিলেন। গণ-ঐক্য গণ-আন্দোলনের জন্য অপরিহার্য এবং সে গণ-ঐক্য আসিতে পারে শুধু নেতা-কর্মীদের ঐক্যের মারফত। অতঃপর লিডার সেই দিকেই মনোনিবেশ করেন। ফলে সে সময়ে দেশে কোনও আসন্ন আন্দোলন ছিল না। কিন্তু যেখানে অশান্তি বা আন্দোলন নাই সেখানেও উস্কানি দিয়া অশান্তি সৃষ্টি করায় আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র উস্তাদ।
তাই তারা ১৯৬২ সালের ৩১শে জানুয়ারি করাচিতে জনাব শহীদ সুহরাওয়ার্দীকে নিরাপত্তা আইনে গেরেফতার করিল। পরদিন ১লা ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইউব ঢাকায় তশরিফ আনিলেন। বিমান বন্দরেই তিনি ঘোষণা করিলেন: বিদেশীর অর্থ-সাহায্যে পাকিস্তান ধ্বংস করিতে যাইতেছিলেন বলিয়াই সরকার মিঃ সুহরাওয়ার্দীকে গেরেফতার করিয়াছেন।
৮. আমরাও জেলে
পূর্ব-পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা বিশেষতঃ ঢাকার ছাত্র-তরুণ ও জনসাধারণ বিক্ষোভে ফাটিয়া পড়িল। পনর দিন ঢাকায় রাস্তায়-রাস্তায় কি কি ঘটিয়াছিল এবং তার পরেও বহুদিন পূর্ব-পাকিস্তানের সর্বত্র কি প্রচণ্ড বিক্ষোভ। চলিয়াছিল, তা সকলের চোখের দেখা ব্যাপার। আমার উল্লেখের প্রয়োজন করে না। আমার সে মোগ্যতাও নাই। কারণ ৬ই ফেব্রুয়ারির রাত্রেই আমাকে আমার চতুর্থ পুত্র মনযুর আনাম (তখন ইউনিভার্সিটির ছাত্র-সহ গেরেফতার করা হয়। জেলখানায় অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই ইত্তেফাক সম্পাদক মিঃ তফাযযল হোসেন (মানিক মিয়া), শেখ মুজিবুর রহমান, কফিলুদ্দীন চৌধুরী, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, মিঃ কোরবান আলী, মিঃ তাজুদ্দিন আহমদ প্রভৃতি প্রায় বিশ-বাইশ জন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী (অধিকাংশই আওয়ামী লীগার) আমাদের সহিত একই ওয়ার্ডে মিলিত হইলেন। আমরা জেলখানায় থাকিতে-থাকিতেই প্রেসিডেন্ট আইউব নয়া শাসনতন্ত্র ঘোষণা করিলেন। ঐ সময়েই ২৭শে এপ্রিল (১৯৬২) শেরে-বাংলা এ. কে.ফযলুল হক এন্তেকাল করিলেন। আমরা শোকে সত্যসত্যই মুহ্যমান হইলাম। শোক-চিহ্ন স্বরূপ আমরা কাল ব্যাজ পরিতে জেলকর্তৃপক্ষের অনুমতি চাহিলাম এবং কাল সালু অথবা ছাতির কাপড় যা পাওয়া যায়, আমাদের নিজস্ব পয়সা হইতে তা কিনিয়া দিতে অনুরোধ করিলাম। জেলকর্তৃপক্ষ আমাদের প্রার্থনা মনযুর করিলেন। আমদের সাথে অন্যান্য ওয়ার্ডের রাজবন্দীরা এবং দেখাদেখি সাধারণ কয়েদীরাও কাল ব্যাজ পরিলেন। আমরা গোড়াতে সাতদিনের জন্য ব্যাজ ধারণের অনুমতি পাইয়াছিলাম বটে কিন্তু বহুদিন আমরা সে ব্যাজ খুলি নাই। জেলকর্তৃপক্ষও ব্যাজ খুলিবার তাকিদ দেন নাই।
৯. নয় নেতার বিবৃতি
নয়া শাসন ঘোষণার দুই মাস মধ্যে উহা জারি হয়। জারি হওয়ার পর দিনের মধ্যেই পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিনিধি-স্থানীয় নয় জন নেতা ঐ শাসনতন্ত্র অগ্রাহ্য করিয়া এবং নয়া গণ-পরিষদ কর্তৃক শাসন রচনার প্রস্তাব দিয়া এক বিবৃতি প্রচার করেন ২৫শে জুন। এই বিবৃতি খুবই জনপ্রিয় হয় এবং ‘নয় নেতার বিবৃতি’ বলিয়া প্রচুর খ্যাতি লাভ করে। পূর্ব-পাকিস্তানের সর্বত্র জনসাধারণ, তাদের প্রতিনিধি-স্থানীয় বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান যথা উকিল-মোখতার লাইব্রেরি, চেম্বার-অব-কমার্স, বিভিন্ন সভা-সমিতি-এসোসিয়েশন বিপুলভাবে এই বিবৃতির সমর্থন করে। আমি এই সময়ে দুরন্ত পুর্যাল এফিউশন রোগে গুরুতর অসুস্থ হইয়া পড়ি। তাতে আঠার দিন সংজ্ঞাহীন বা কোমায় ছিলাম। অনেকদিন হাসপাতালে ছিলাম। হাসপাতাল হইতে মুক্তি পাইবার পরেও উহার পুনরাক্রমণ হওয়াতে আবারও মাসখানেকের মত হাসপাতালে থাকিতে হইয়াছিল। অবশ্য সম্পূর্ণ আরোগ্য হইতে আমার প্রায় দুই বছর লাগিয়াছিল। কিন্তু প্রাথমিক সংকট কাটিয়া যাওয়ার পরই আমি নয় নেতার বিবৃতিতে জনগণের সমর্থন ও উল্লাস দেখিয়া অতিশয় আনন্দিত হইয়াছিলাম। এবং তাতেই আমার রোগ অর্ধেক সারিয়া গিয়াছিল। আমার ঐ মারাত্মক রোগে আমার নেতা সহকর্মীরা, তদানীন্তন গবর্নর জনাব গোলাম ফারুক, তৎকালীন হাসপাতাল-প্রধান ডাঃ কর্নেল হক, বিশেষজ্ঞ ডাঃ শামসুদ্দিনের নেতৃত্বে হাসপাতালের সকল ডাক্তাররা আমার জন্য যেভাবে রাত-দিন পরিশ্রম খোঁজ-খবর ও তত্ত্বাবধান করিয়াছিলেন, সে কথা আমার কৃতজ্ঞতার সাথে চিরকাল মনে থাকিবে।
যা হোক এরপর শহীদ সাহেব মুক্তি পাইয়া পূর্ব-পাকিস্তানে আসেন এবং নয় নেতার বিবৃতি সমর্থন করেন। এই সময় তিনি পূর্ব-পাকিস্তানে সর্বত্র সভা-সমিতি করিয়া বেড়ান। দেশের সর্বত্র জীবন ও জাগরণের সাড়া পড়িয়া যায়। আমি এই সময় হাসপাতাল হইতে ছুটি পাইয়াছি বটে, কিন্তু ঘরের বাহির হইতে পারি না। সভা সমিতিতেও যোগ দিতে পারি না। কাজেই লিডারের ঐসব ঝটিকা সফরে সংগী হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। কিন্তু খবরের কাগয পড়িয়া, অপরের মুখে, বিশেষতঃ লিডারের নিজ-মুখে, ও-সবের বিবরণ ও তাৎপর্য শুনিয়া আমি গণতন্ত্রের আসন্ন জয়ের সম্ভাবনায় উদ্দীপিত হইয়া উঠিতাম।
১০. পার্টি রিভাইভ্যাল
এই মুদ্দতের সবচেয়ে বড় বিচার-বিবেচনার বিষয় ছিল রাজনীতিক পার্টিসমূহ পুনরুজ্জীবিত করা-না-করার প্রশ্নটি। তার বিশেষ কারণ ছিল এই, যে-বিপ্লবী নেতারা মার্শাল ল’ করিয়া সব পার্টি ভাংগিয়া তাদের টেবিল-চেয়ার নিলাম করাইয়া এবং কাগয-পত্র পোড়াইয়া দিয়াছিলেন এবং সব পার্টি-ফন্ড বাযেয়াফত করিয়াছিলেন, তাঁরাই এখন পলিটিক্যাল পারটি এ্যাক্ট নামক আইন জারি করিয়াছেন। নিজেরা পাকিস্তান মুসলিম লীগ নামে পার্টি করিয়াছেন। অপর-অপর লোককে যার-তার পার্টি জিয়াইয়া তুলিবার উস্কানি দিতেছেন। পার্লামেন্টারি আমলের পার্টি-চেতনা, পার্টি-স্পিরিট ও পার্টি-মনোবৃত্তি চার বছরের মার্শাল ল’তেও আমাদের মধ্য হইতে সম্পূর্ণ দূর হয় নাই। কাজেই বর্তমান পরিবেশে বর্তমান স্বৈরতন্ত্রের মোকাবেলায় পার্টি-অক্ষমতা সম্বন্ধে সকলে সমান সচেতন হন নাই। এ অবস্থায় সর্বোচ্চ স্তরের পার্টি-নেতৃবৃন্দের মধ্যে শহীদ সাহেবই প্রথম পার্টি রিভাইভ্যালের বিরুদ্ধতা করায় আমাদের জন্য এটা ছিল গর্বের বিষয়। কিন্তু অনেকে তাঁকে লও বুঝিয়াছিলেন। শহীদ সাহেব তৎকালে সর্ববাদি-সক্ষত মতে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ নেতা হওয়ায় অন্যান্য দলীয় নেতাদের কেউ-কেউ মনে করেন সুহরাওয়ার্দী পার্টি রিভাইভ্যালের বিরুদ্ধতা করিতেছেন নিজে একচ্ছত্র আধিপত্য রক্ষার জন্য। কোনও পার্টি না থাকিলে সুহরাওয়ার্দী একমাত্র নেতা; আর সব পার্টি রিভাইত হইলে সুহরাওয়ার্দী অন্যতম নেতা; . এটা তাঁদের চোখে সহজেই ধরা পড়িল। কিন্তু এটা ধরা পড়িল না এবং সাধারণতঃ ধরা পড়ে না যে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের অবর্তমানে সকলের পার্টিও ঠোটো জগন্নাথ’ মাত্র।
কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানে সব নেতারাই যার-তাঁর পার্টি রিভাইভ করিয়া ফেলিলেন। এ ব্যাপারে জামাতে-ইসলামীর নেতা মওলানা আবদুল আলা মওদুদীই রাস্তা দেখাইলেন। অন্যান্য পার্টি-নেতারা তাঁর অনুসরণ করিলেন। তাঁরা অবশ্য যুক্তি দিলেন : পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের মত রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন না হওয়ায় সেখানে পার্টি রিভাইত না করিয়া কোনও কাজই করা যাইবে না। ফলে লিডার পশ্চিম পাকিস্তানে রিভাইভ্যাল ও পূর্ব-পাকিস্তানে নন রিভাইভ্যাল এই দ্বৈতনীতি অবলম্বন করিতে বাধ্য হইলেন। এই অবস্থায়ই তিনি জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এন. ডি. এফ.) গঠন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা যাঁর-তাঁর পার্টি রিভাইভ করিলেও পূর্ব-পাকিস্তানে তাঁদের পার্টি-কার্যকলাপ– প্রসারিত করিবেন না, এই ধরনের আশ্বাস তাঁরা লিডারকে দিলেন। কিন্তু ঐ দ্বৈত নীতি শহীদ সাহেবের মত সবল ও সুউচ্চ নেতা ছাড়া আর কাকেও দিয়া কার্যকরী করা সম্ভব ছিল না। সেজন্য শহীদ সাহেব পূর্ব-পাকিস্তানের সকল দলের নেতাদেরই রিভাইভ্যাল-বিরোধী রাখিবার কার্যকরী পন্থা অবলম্বনের চেষ্টায় তৎপর হন। এটা লিডারের কাছে যেমন সুস্পষ্ট ছিল, অপর সকলের কাছেও তেমনি সুস্পষ্ট ছিল যে আর যে পার্টি যাই করুক, যতদিন ন্যাপ ও আওয়ামী লীগ রিভাইব না হইতেছে, ততদিন গণ-ঐক্যের কোনও ক্ষতিই কেউ করিতে পারিবেন না। পূর্ব পাকিস্তানে আসল গণ-সমর্থিত পার্টি বলিতে এই দুইটি। আর এখানকার ছাত্র-তরুণসহ গোটা জনসাধারণ রিভাইভ্যালের বিরোধী। শহীদ সাহেবের ঝটিকা সফরের বিরাট-বিরাট জনসভার বক্তৃতায় এই গণ-ঐক্য দিন দিন অধিকতর শক্ত ও মযবুত হইতেছিল।
১১. এক দফা জাতীয় দাবি
লিডার তাঁর সফরের ফাঁকে-ফাঁকে ঢাকায় আসিলে আমার রোগশয্যায় আমাকে দেখিতে আসিতেন। স্বভাবতঃই তাঁর সাথে উঁচুস্তরের অন্যান্য নেতারাও থাকিতেন। এমনি এক সাক্ষাতে সংগী নেতাদের সামনেই তিনি বলিলেন যে ন্যাপ-নেতারা তাঁর কাছে মিনিমাম প্রোগ্রাম হিসাবে চৌদ্দ-পরটা দফা উপস্থিত করিয়াছেন। প্রসংগক্রমে বলা ভাল যে অনেকেই মনে করিতেন, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের উদ্দেশ্য হিসাবে শুধু গণন্ত্র পুনর্বহালের মত অস্পষ্ট ও জনগণের দুর্বোধ্য কথার বদলে ধরা ছোঁয়ার মত একটি সুস্পষ্ট আদর্শ দরকার। তারই নাম দেওয়া হইয়াছিল মিনিমাম প্রোগ্রাম। বিভিন্ন পার্টি-নেতারা এই মিনিমামই লিডারের খেদমতে পেশ করিতেছিলেন। এটা অন্যায়ও ছিল না, অনধিকার চর্চাও ছিল না। তবু মিনিমাম দাবির দফা-সংখ্যা এত বেশি দেখিয়া আমাদের বাস্তব-বুদ্ধির অভাবেই বোধ হয় লিডার বিব্রত বোধ করিতেছিলেন। আমি লিডারকে বলিলাম : অত বেশি দফার দাবি তিনি না মানিতে পারেন, তবে তাঁর নিজেরও এক দফা দাবির দৃঢ়তা কিছুটা শিথিল করিতে হইবে। খানিক আলোচনার পর তিনি এ বিষয়ে চিন্তা করিয়া আমার মত তাঁকে জানাইতে উপদেশ দিলেন।
কয়েকদিন পরে কিছুটা ভাল হইয়া মানিক মিয়ার বাড়িতে লিডারের সাথে দেখা করিলাম এবং এ বিষয়ে আমার চিন্তার ফল তাঁকে জানাইলাম। তিনি মোটামুটি নিমরাযী হইয়া আমাকে খুব সংক্ষেপে একটি বিবৃতি মুসাবিদা করিতে আদেশ দিলেন। বলিলেন : উভয় পাকিস্তান হইতে ৫০ জন করিয়া মোট এক শ’ নেতার বিবৃতি হইতে হইবে। আমি লিডারের আদেশমত ফুলঙ্কেপ শিটের এক পৃষ্ঠায় একটি বিবৃতির মুসাবিদা করিলাম। তাতে নয় নেতার বিবৃতির সারকথার উপর বুনিয়াদ করিয়া দু-এক দফার দাবি খাড়া করিলাম। উহাই টাইপ করিতে আতাউর রহমান সাহেবের কাছে দিলাম। টাইপ করার সময় আতাউর রহমান আমাকে ফোনে জানাইলেন যে আমার মুসাবিদাটা অতিরিক্ত মাত্রায় ছোট হইয়া গিয়াছে। দু-এক যায়গায় একটু বাড়াইয়া লেখিলে ভাল হয়। তবে তিনি আমার মুসাবিদায় হাত না দিয়া ঐ ধরনের একটা মুসাবিদা করিতে চান। আমার আপত্তি আছে কি না। আমি সানন্দে সম্মতি দিলাম। পরের দিন আমরা দুই মুসাবিদারই টাইপ কপি লইয়া লিডারের সাথে দেখা করিলাম। তিনি উভয় মুসাবিদাই মনোযোগ দিয়া পড়িলেন। আমারটা ফুলঙ্কেপ এক পৃষ্ঠা। আতাউর রহমান সাহেবেরটা দেড় পৃষ্ঠা। তবু লিডার বলিলেন। তিনি আরও ঘোট বিবৃতির মুসাবিদা চাহিয়াছিলেন। উভয় মুসাবিদায়ই খানিকক্ষণ চোখ বুলাইয়া অবশেষে বলিলেন : তোমরা দুইজনে যখন দুইটা করিয়াছ, তখন আমিও একটা করি। কি বল? আমরা সানন্দে সাগ্রহে রাযী হইলাম। পরের দিন তিনি ফুলঙ্কেপের আধা পৃষ্ঠার একটি মুসাবিধা আমাদেরে দেখাইলেন। তাতে তিনি ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র পুনর্বহালকেই আমাদের একমাত্র জাতীয় দাবী করিয়াছেন। সুস্পষ্ট ধরা-ছোঁয়ার মত এবং জনগণের বোধগম্য হওয়ার দিক হইতে এমন পরিক্ষার দাবি আর হইতে পারে না। আমরা তা স্বীকার করিলাম। কিন্তু ঐ শাসনতন্ত্র পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন স্বীকৃত হয় নাই; তার ফলে আমরা উহাতে দস্তখত করিতে অস্বীকার করিয়াছিলাম; কাল ও অবস্থার পরিবর্তনে পূর্ব-পাকিস্তানীদের দাবিদাওয়া আরও বেশি দানাবাঁধিয়াছে। ইত্যাদি যুক্তি দিয়া লিডারের মুসাবিদায় আমরা আপত্তি করিলাম। কিন্তু সংগে সংগেই একথাও আমরা বলিলাম যে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা যদি এই বিবৃতিতে অগ্রিম ওয়াদা করেন যে ৫৬ সালের শাসনতন্ত্র অনুসারে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের জাতীয় পরিষদের প্রথম বৈঠকেই তিন বিষয়ের কেন্দ্রীয় ফেডারেশন ও উভয় অঞ্চলকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিয়া শাসনন্ত্র সংশোধন করা হইবে, তবে আমরা, লিডারের মুসাবিদা ঐরূপ সংশোধিত মতে গ্রহণ করিতে প্রস্তুত আছি।
১২. শেষ বিদায়
লিডার আমাদের কথাটা ফেলিয়া দিলেন না। চিন্তা করিলেন। নোট করিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের বুঝাইবার দায়িত্ব নিলেন। আমাদের প্রস্তুত থাকার আদেশ-উপদেশ দিয়া তিনি করাচি চলিয়া গেলেন। সেখানে অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। চিকিৎসার জন্য যুরিখ লণ্ডন বৈরুত গেলেন। আর আসিলেন না। তাঁর বদলে আমাদের দুর্ভাগ্যের ঘোর অন্ধকার ছায়া লইয়া আসিল তাঁর লাশ। ১৯৬৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর তিনি বৈরুতের এক হোটেলে এন্তেকাল করিলেন। তাঁর আত্মীয়-স্বজন তাঁকে করাচিতে দাফন করিতে চাহিলেন। কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানবাসী দাবি করিল তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে পূর্ব-পাকিস্তানের মাটিতে দাফন করিতে হইবে। তাই হইল। পূর্ব পাকিস্তানের অপর প্রাণপ্রিয় নেতা শেরে বাংলার পাশে তাঁকে দাফন করা হইল।
তারপর-তারপর দু’চারদিন আগে-পিছে ন্যাপ ও আওয়ামী লীগ উভয় প্রতিষ্ঠানই রিভাইভ হইয়া গেল। ফলে ঐ দূরদর্শী মহান নেতার উপদেশ কার্যতঃ তাঁরই অনুসারীরা অগ্রাহ্য করিলেন। একমাত্র পূর্ব-পাকিস্তানের এন, ডি. এফ. অন্ততঃ মতবাদের দিক দিয়া মহান নেতার ওসিয়ত পার্টিহীন গণ-ঐক্যের কথা ক্ষীণ কণ্ঠে বলিয়া যাইতে থাকিল।
এরপরে দেশের রাজনীতিতে যা-যা ঘটিয়াছে তার সবগুলিকেই ডিভিয়েশনের অরিজিনাল সিনের স্বাভাবিক পরিণতি বলা যাইতে পারে। পার্লামেন্টারী ব্যবস্থায় যা করা সম্ভব ও উচিৎ, বর্তমান বুনিয়াদী গণতন্ত্রের অবস্থাতেও তাই করা যায় মনে করিয়া ১৯৬২ সাল ও ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে নেতারা সিরিয়াসলি অংশ গ্রহণ করিলেন। পরিণামে যা অবশ্যম্ভাবী তাই হইল। বিশেষতঃ ১৯৬৫ সালের নির্বাচনটাই গণতন্ত্রী নেতাদের চৈতন্য উদয়ের জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিৎ ছিল। মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নার জনপ্রিয়তা ও প্রাইমারি ভোটারদের বিপুল সমর্থনও অপযিশনকে জিতাইতে পারে নাই। পারিলে আইউব শাসনতন্ত্রকে অগণতান্ত্রিক বলা যাইত না।
ঐ সনেরই অপর উল্লেখযোগ্য ঘটনা পাক-ভারত যুদ্ধ। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’ ‘শত্রুতা নয় বন্ধুত্ব’ই পাকিস্তান ও ভারতের বাঞ্ছণীয় সম্পর্ক, এই খাঁটি সত্য ও বাস্তব কথাটা প্রেসিডেন্ট আইউব যতবার যত জোরে বলিয়াছেন, তেমন আর কোনও পাকিস্তানী নেতা বলেন নাই। তথাপি ভাগ্যের পরিহাস, তাঁরই আমলে এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটা ঘটিল যা পার্লামেন্টারি আমলে কোনও পক্ষই কল্পনাও করে নাই।
অথচ তার মাত্র পাঁচ বছর আগে ১৯৬০ সালেই সিন্ধু অববাহিকা চুক্তির মত মহাপরিকল্পনাটা স্বাক্ষরিত হয় এবং সে উপলক্ষে পণ্ডিত নেহরু প্রথম ও শেষবারের মত পাকিস্তান পর্দাপণ করেন। এর সবটুকু প্রশংসা প্রেসিডেন্ট আইউবের এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে। সেই সংগে এও মানিতে হইবে যে যতদিন কাশ্মির বিরোধ
মিটিবে, ততদিন ভারতের সাথে অন্য কোন ব্যাপারে কথাই বলিব না, এ যুক্তিটাও ঠিক নয়। সিন্ধু অববাহিকা চুক্তির শিক্ষা এই।
১৯৬৭ সালে অপযিশন দলের বিপ্লবী যুগের সব চেয়ে বড় কাজ পি. ডি. এম. গঠন। এর প্রথম বৈশিষ্ট্য এই যে ১৯৬৫ সালের ‘কপের’ মৃত এটা শুধু নির্বাচনী মৈত্রী নয়। দ্বিতীয়তঃ পূর্ব-পাকিস্তানের গ্রহণযোগ্য একটা শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর উপর এর বুনিয়াদ। শহীদ সাহেবের শেষ ইচ্ছাই এতে রূপ পাইয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সকল দলের নেতারা এই সর্বপ্রথম তিন বিষয়ের ফেডারেল কেন্দ্র মানিয়া লইয়াছেন। ইহা নিশ্চিত রূপেই পাকিস্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের শুভ সূচনা।