২৩. ওযারতি শুরু

ওযারতি শুরু
তেইশা অধ্যায়

. সেক্রেটারিদের মোকাবেলা

কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রী হইয়াই আমি দুই দফতরের সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারি, ডিপুটি সেক্রেটারিদের এবং এটাচড় ডিপার্টমেন্টসমূহের বিভাগীয় প্রধানদের এক সম্মিলিত কনফারেন্স ডাকিলাম। কোন দিন মন্ত্রিত্ব করি নাই। কাজেই পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার কিছুই ছিল না। শুধু উপস্থিত-বুদ্ধি খাটাইয়া সাধারণ বুদ্ধির কাওনের বক্তৃতা করলাম। আমি জানিতাম, ‘আমার বৃদ্ধি-শুদ্ধি নাই’ একথা বলার মত বুদ্ধিমানের কাজ আর হইতে পারে না। কাজেই আমি সেই পন্থাই ধরিলাম। বক্তৃতায় বলিলাম : ‘যে কাজের ভার আমার উপর পটিয়াছে, তার কিছুই আমি জানি। আপনারাই আপনাদের অভিজ্ঞতা দিয়া আমাকে ঠিক পথে চালাইবেন। তাঁরা যে শুধু অভিজ্ঞতাই নয়। লেখাপড়া ও বিদ্যা-বুদ্ধিতেও তাঁরা সকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শ্রেণীর প্রতিভাবান ছাত্র ছিলেন। ছিলেন বলিয়াই ঐ সব সরকারী চাকুরি পাইয়াছেন। আমি নিছমানের ছাত্র ছিলাম বলিয়াই চেষ্টা করিয়াও সরকারী চাকুরি পাই। নাই। চাকুরি পাই নাই বলিয়াই ওকালতি ধরিয়াছিলাম। বাংলার প্রবচন যার নাই অন্য গতি সেই ধরে ওকালতি ও শুনাইলাম। ঐ ওকালতি করিতে করিতে জনগণের দাবি দাওয়া লইয়া রাজনৈতিক সংগ্রাম করিয়াছি। তাদের ভোটে নির্বাচিত হইয়া আইন সভার মেম্বর ও মন্ত্রী হইয়াছি। মন্ত্রীরূপে আজ তাঁদের উপরে বসিয়াছি বটে কিন্তু তাতেই জ্ঞান-বুদ্ধিও আমার তাঁদের চেয়ে বেশি হইয়া যায় নাই। আমার দায়িত্ব ও অধিকার জনগণের মংগলের জন্য নীতি নির্ধারণ করা। আর অফিসারদের কর্তব্য সে নীতি নির্ধারণে আমাকে উপদেশ দেওয়া ও সহায়তা করা। উপদেশ দিয়াই তাঁদের কর্তব্য শেষ। তাঁদের উপদেশ গ্রাহ্য করার অধিকার মন্ত্রীর আছে। তাঁদের পসন্দ না হইলেও মন্ত্রীর আদেশ তাঁদের পালন করিতে হইবে।

২. অবস্থা পর্যবেক্ষণ

মাত্র বার জন আওয়ামী লীগ মেম্বর লইয়া লিডার প্রায় পঞ্চাশ জনের কোয়েলিশনের মন্ত্রিসভা গঠন করিয়াছেন। কোয়েলিশনের অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানী।

সুতরাং ইহাদের দয়ার উপরেই আমাদের মন্ত্রিসভা একান্তভাবে নির্ভরশীল। এদের প্রায় সকলেই অল্পদিন আগে পর্যন্ত মুসলিম লীগার ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্যার প্ররোচনায় এরা মুসলিম লীগ ছাড়িয়া রিপাবলিকান পার্টি গঠন করিয়াছেন। স্পষ্টতঃই প্রেসিডেন্ট মির্যার প্রভাব এঁদের উপর অসীম। ইস্কান্দর মির্যার কুনযরে পড়িলেই আমাদের মন্ত্রিত্ব খতম। তেমন দুর্ঘটনা যেকোন সময়ে ঘটিতে পারে, সে সম্বন্ধে আমরা গোড়া হইতেই সচেতন ছিলাম। প্রধানতঃ যুক্তনির্বাচনের ভিত্তিতে যথাসম্ভব সত্বর সাধারণ নির্বাচন করাইবার উদ্দেশ্যেই লিডার মন্ত্রিত্ব গঠনের দায়িত্ব নিয়াছিলেন। আমি লিডারের সহিত একমত হইয়াও বলিয়াছিলাম যে ঐভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করাইতে হইবে ঠিকই, কিন্তু কিছু-কিছু কাজ না করিলে জনগণ আমাদের ভোট দিবে কেন? লিডারের নীরব সমর্থন লাভ করিয়া আমি কালবিলম্ব না করিয়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প-এলাকা সফর করিলাম। শিল্প-বৈষম্যের মোটামুটি একটা ধারণা হইল। দেখিলাম, পূর্ব পাকিস্তানে শুধু যে প্রয়োজনীয় শিল্প প্রতিষ্ঠাই হয় নাই, তা নয়। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিল্প স্থাপিত হইয়াছে। এমন বহু শিল্প সেখানে স্থাপিত হইয়াছে, কাঁচামালের জন্য যাদের প্রায় সর্বাংশেই আমদানির উপর নির্ভর করিতে হয়। পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানের কত কাঁচামাল পড়িয়া রহিয়াছে; তাদের ব্যবহারের জন্য কোনও শিল্প স্থাপিত হয় নাই। পশ্চিম পাকিস্তানের এই শিল্প চালু রাখিতেই আমাদের অনেক বিদেশী মুদ্রা খরচ হইয়া যাইতেছে।

. হাই লেভেল কনফারেন্স

শাসনতন্ত্র অনুসারে বিশেষ ধরনের কতিপয় শিল্প ছাড়া সব শিল্পই প্রাদেশিক বিষয়। কিন্তু শাসনন্ত্র প্রয়োগের আট মাস পরেও সমস্ত শিল্প কার্যতঃ আগের মতই কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই আছে। বাণিজ্য কেন্দ্রীয় বিষয়। কাজেই আমদানি রফতানির ব্যাপারে পূর্ব-পাকিস্তানীদের করাচির দিকেই চাহিয়া থাকিতে হইতেছে। সফর শেষ করিয়া লিডারের নীরব অনুমোদন ধরিয়া লইয়া ঘোষণা করিলাম। ‘অতপর আমাদের শিল্পায়ন পূর্ব-পাকিস্তানমুখী হইবে। নয়া সব শিল্প পূর্ব-পাকিস্তানে স্থাপিত হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানে আর কোনও নয়া শিল্প স্থাপিত হইবে না।

এর পর প্রথম সাক্ষাতেই লিডার আমাকে বলিলেন : এসব কি পাগলামি শুরু করিয়াছ তুমি?

লিডারের সামনেই দু-চারজন পশ্চিম পাকিস্তানী মন্ত্রী ও অফিসার বসা ছিলেন। আমি ঈষৎ হাসিয়া জবাব দিলাম : ‘ইলেকশনের জন্য প্রস্তুত হইতেছি, সার।‘ যেন মাটির নিচে হইতে সুড়ং বাহিয়া একটা আওয়ায় হইল : হুম। এই বিশাল আওয়াযকে আমার কাজে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিবাদ মনে করিয়া ওঁরা সবাই খুশী হইলেন। আমি কিন্তু আমার নেতার মুখে কোনও বিরক্তি আবিষ্কার করিতে পারিলাম না। মুখে তিনি ওসম্বন্ধে কিছু বলিলেনও না আমাকে। অতএব আমি নির্ভয়ে নিজের কাজ করিয়া চলিলাম। শিল্প-দফতরের তৎকালীন সেক্রেটারি মিঃ আব্বাস খলিলীর পরামর্শে উৎসাহে ও সহযোগিতায় আমি শিল্প-বাণিজ্য বিষয়ে একটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মিলনী ডাকিলাম আমাদের মন্ত্রিত্ব গ্রহণের দুই মাসের মধ্যে। কেন্দ্রীয় শিল্প বাণিজ্য দফতরের সেক্রেটারিদ্বয়সহ অন্যান্য অফিসাররা, প্রাদেশিক শিল্প-বাণিজ্য দফতরের মন্ত্রিদ্বয়সহ অফিসাররা এই সম্মিলনীতে যোগ দিলেন। কেন্দ্রীয় বাণিজ্য দফতরের এই সম্মিলনীর বৈঠক বসিল। কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রী হিসাবে আমিই এই সম্মিলনীর সভাপতিত্ব করিলাম। পরম হৃদ্যতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার আন্তরিক আগ্রহের আবহাওয়ার মধ্যে সম্মিলনীর কাজ চলিল। অনেক ভুল বুঝাবুঝির অবসান হইল? অধিকার দেওয়া-নেওয়ার অত্যাবশ্যক উদারতার দ্বার খুলিয়া গেল। শাসনতান্ত্রিক অনেক দৃশ্যতঃ দুঃসাধ্য সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান বাহির হইয়া পড়িল। সম্মিলনীতে যে কয়টি প্রস্তাব গৃহীত হইল, তার মধ্যে এই কয়টা প্রধান :

(১) শাসনতন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ শিল্প ছাড়া আর সব শিল্পের পূর্ণ ও একক কর্তৃত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে দেওয়া হইল।

(২) আমদানি-রফতানির ব্যাপারে কাচিস্থ চিফ কন্ট্রোলার অফিসের কতৃত্বের অবসান করা হইল। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য চাটগাঁয়, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য লাহোরে এবং ফেডারেল অঞ্চলের জন্য করাচিতে তিনটি স্বাধীন ও অন্য-নিরপেক্ষ আমদানি-রফতানি কন্ট্রোলার-অফিস স্থাপিত হইল।

(৩) পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন ও সরবরাহের সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় সাপ্লাই এণ্ড ডিভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের চাটগাঁ শাখা আপগ্রেড করিয়া একজন এডিশনাল ডাইরেক্টর-জেনারেলের পরিচালনাধীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজন মিটাইবার চূড়ান্ত ক্ষমতা দেওয়া হইল।

(৪) ব্যবস্থা হইল, বৈদেশিক মুদ্রার দুই প্রদেশের ও করাচির অংশ পূর্বাহ্নে ভাগ করিয়া দেওয়া হইবে এবং চাটগাঁর কন্ট্রোলার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের, লাহোরের কন্ট্রোলার পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের এবং করাচির কন্ট্রোলার কেন্দ্রীয় বাণিজ্য দফতরের সহিত পরামর্শ করিয়া লাইসেন্স বিতরণ করিবেন।

৪. স্পেশাল কেবিনেট মিটিং

এইসব সিদ্ধান্তের সব কয়টাই নীতি-নির্ধারক বিধায় এবং ওসবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকার ও এলাকা সংকুচিত হইতেছে বলিয়া নিয়মানুসারে ওতে কেবিনেটের অনুমোদন দরকার; আমি সে অনুমোদন চাহিলাম। কেবিনেটের বিশেষ বৈঠকে আমার প্রস্তাব পেশ করা হইল। সে কেবিনেট মিটিং-এর কথা আমি জীবনে ভুলিতে পারিনা।

প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কেবিনেট রুমে এই বৈঠক। মিটিং শুরু হইবার আগেই আমরা অনেকে হাযির হইয়াছি। পশ্চিম পাকিস্তানী সহকর্মীদের অনেককেই দেখিলাম গম্ভীর। সেদিনকার আলোচ্য বিষয় লইয়া আমাকে কেউ-কেউ ঠাট্টা করিয়া বলিলেন : ‘আপনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী না প্রাদেশিক মন্ত্রী তা আমরা বুঝিতে পারিতেছি না।’ বুঝিলাম, ঝড় উঠিবার পূর্ব লক্ষণ। আমাকে প্রবল বাধার সম্মুখীন হইতে হইবে। এঁদের সাথে এক হাত লড়িবার জন্য প্রস্তুত হইলাম।

কিন্তু কেবিনেট মিটিং-এ আমার উপর হামলা হইল সম্পূর্ণ আশংকাতীত দিক হইতে। কেউ কিছু বলিবার আগে প্রধানমন্ত্রীই আমাকে হামলা করিলেন। বুঝিলাম, শত্রুপক্ষের সেনাপতিত্ব নিয়াছেন স্বয়ং আমার নেতা। এজন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। হামলাও কি যেমন-তেমন? দক্ষ তীরন্দাযের ক্ষিপ্রতায় ও কৌশলে লিডার আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করিতে লাগিলেন। বড়ই বেকায়দায় পড়িলাম। তিন ঘন্টাব্যাপী কেবিনেট মিটিং ত নয়, দস্তুরমত সেশন আদালত। আমি যেন আসামীর কাঠগড়ায়। চার্জ যেন নরহত্যা বা হত্যার চেষ্টা। সুহরাওয়ার্দীর মত কুশাগ্র-বুদ্ধি সুদক্ষ ব্যারিস্টার মার্কিন বা ফরাসী আইন মোতাবেক আসামীকে জেরা করিতেছেন। সে জেরায় আমার প্রস্তাবের যৌক্তিকতা, শাসনতান্ত্রিক বাধা-নিষেধ, পাকিস্তানের অখণ্ডত, শক্তিশালী ঐকিক কেন্দ্র বনাম ফেডারেল কেন্দ্রের তুলনামূলক গুণাগুণ, কিছুই বাদ গেল না। এমন কি আমার অখণ্ড পাকিস্তানী দেশ-প্রেমের প্রতি কটাক্ষ পর্যন্ত হইয়া গেল। আমি সাধ্যমত সব কথার জবাব দিতে লাগিলাম। কিন্তু সুহরাওয়ার্দীর জেরার সামনে সম্বিৎ রাখা চলে কতক্ষণ? আমার জিভ ও গলা শুকাইয়া আসিতে লাগিল। প্রথমে অপমানে, তার পরে অভিমানে, আরও পরে রাগে আমি ফুলিতে লাগিলাম। কিন্তু তবু লিডারের দয়া হইল না। মাঝে-মাঝে জেরার ফাঁকে-ফাঁকে আমি কেবিনেট কলিগদের দিকে ন্যর ফিরাইতে লাগিলাম। পূর্ব পাকিস্তানী সকলের মুখেই দরদ ও সহানুভূতি দেখিলাম। আমার বিপদে তাঁদের মুখ শুকনা। পক্ষান্তরে পশ্চিমা ভাইদের মুখ হাসিতে উজ্জ্বল। তাঁরা সবাই শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষপাতী; সুতরাং শক্তি বিকেন্দ্রীকরণের বিরোধী। আমার লিডারের মতও তাই বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। প্রধানমন্ত্রীর হাতে তাঁদের স্বার্থ নিরাপদ বলিয়া তাঁরা নিশ্চিন্ত। কাজেই আমার নিজের লিডারের হাতে আমি নাকানি-চুবানি খাইতেছি দেখিয়া তাঁরা নিশ্চয়ই ব্যাপারটা উপভোগ করিতেছেন।

৫. শহীদ সাহেবের অপূর্ব কৌশল

বিকেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে তাঁদের যা যা বলিবার ছিল, যেসব কথা অহরহ তাঁদের মুখে শুনিয়াছি, সেসব কথাই প্রধানমন্ত্রী তাঁদেরই মত করিয়া তাঁদেরই ভাষায়, তাঁদের চেয়েও অনেক জোরালোভাবে, বলিতে লাগিলেন। এমনকি যে সব কথা তাঁরা কোনও দিন বলেন নাই, হয়ত ভাবেনও নাই, সেই ধরনের কথাও তিনি অনেক বলিলেন। কত কথা তুলিয়া-তুলিয়া তিনি আমাকে প্রশ্ন করিলেন : এ সম্বন্ধে তোমার কি বলিবার আছে? এ সমস্যায় তোমার সমাধান কি? এ আপত্তি তুমি খাও কি করিয়া? ইত্যাদি ইত্যাদি। যেসব বেকায়দার আতেক্কা প্রশ্নের জবাব আমি তাড়াতাড়ি দিতে পারি নাই, সেসব ক্ষেত্রে তিনি ধমকের সুরে তুমি কি বলিতে চাও?–বলিয়া আমার মুখে উত্তর যোগাইয়া দিলেন। আমি তাতে সাহায্য পাইলাম বটে কিন্তু বিষম অপমানও বোধ করিলাম। আমার প্রস্তাব অগ্রাহ্য হইবে, বহুক্ষণ আগেই তা বুঝিয়া ফেলিয়াছিলাম। এতক্ষণে সম্মানটুকুও গেল। মনে মনে ঠিক করিলাম, কেবিনেট মিটিং-এর পর গোপনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করিয়া পদত্যাগ করিয়া চুপেচুপে দেশে ফিরিয়া যাইব। মাত্র দুই মাস মন্ত্রিত্ব করিয়াই মন্ত্রীগিরির সাধ আমার মিটিয়াছে। কাজেই অতঃপর বেপরোয়াভাবে কথা বলিতে শুরু করিলাম। পশ্চিমা বন্ধুরা আমার রাগ দেখিলেন কিন্তু কোনও কথা বলিলেন না। আমাকে তাঁরা একটি প্রশ্নও করিলেন

। তার দরকারই ছিল না। তাঁদের সব কথাই ত প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলিতেছেন। তবু যদি তাঁদের মধ্যে কেউ কখনো-সখনো কোনও কথা বলিতে বা আমাকে কোন প্রশ্ন করিতে চাহিয়াছেন, তৎক্ষণাৎ প্রধানমন্ত্রী মুচকি হাসিয়া হাতের ইশারায় তাঁকে নিরস্ত করিয়াছেন। ভাবটা এই : তোমরা আর কি করিবে? আমিই একে ফিনিশ করিতেছি। ফলে কেউ কিছু বলিলেন না। তিন ঘন্টাব্যাপী কেবিনেট মিটিং কার্যতঃ হইয়া গেল প্রধানমন্ত্রী ও আমার মধ্যে কথা কাটাকাটির বৈঠক। তার পরিণামও সকলেরই একরূপ জানা। কাজেই সবাই নীরব। আমাকে এমনভাবে নাস্তানাবুদ করিয়া নাকানি-চুবানি খাওয়াইয়া হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী চেয়ারটা পিছনে ঠেলিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন। আমরাও সকলে দাঁড়াইলাম। হাতের ইশারায় আমাদিগকে বসিতে বলিয়া তিনি কেবিনেট রুমের এটাচড বাথরুমের দিকে অগ্রসর হইলেন। বাথরুমের দরজার হ্যাণ্ডেল ঘুরাইয়া দরজাটা ঈষৎ ফাঁক করিয়া তিনি আমাদের দিকে ফিরিয়া তাকাইলেন। বলিলেন : ‘আবুল মনসুর, তুমি আমাকে কনভিন্‌স্‌ড্‌ করিতে পারিয়াছ। এইবার তুমি তোমার কলিগদেরে কনভিনস করিবার চেষ্টা কর।’ বলিয়াই তিনি বাথরুমে ঢুকিয়া পড়িলেন।

আমি স্তম্ভিত হইলাম। প্রধানমন্ত্রী কনভিন্‌স্‌ড্‌ হইয়াছেন? আমার লিডারকে আমি কনভিন্‌স্‌ড্‌ করিতে পারিয়াছি? বিশ্বাস হইল না। আমাকে বিদ্রূপ করিলেন না ত? দ্বিধায় পড়িলাম। লিডারের স্বভাবত তা নয়। তবে এটা কি? কলিগদেরে কনভিন্স্ করিতে তিনি আমাকে উপদেশ দিলেন কেন? কাঁদের কথা বলিয়াছেন, বুঝিলাম। কিন্তু কনভিন্স করিব কি? আমি মাথা তুলিয়া কারোর দিকে চাহিতেই পারিলাম না। ঘাড়সোজা না করিয়া চোখ যতটা কপালের দিকে তুলা যায় তা তুলিয়া কলিগদের মুখ-ভাব দেখিবার চেষ্টা করিলাম। সবাই পাশের লোকের সাথে কানাকানি ফিসপাস করিতেছেন। কেউ কোনও কথা বলিলেন না। আমাকে কোন প্রশ্নও করিলেন না। প্রশ্ন আর কি করিবেন? কে করিবেন? পশ্চিমা বন্ধুরা? তাঁরা ত জিতিয়াই গিয়াছেন? আমার মত পরাজিত পর্যদস্ত ভুলুণ্ঠিত আহত সৈনিকের গায় ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’ মারিয়া লাভ কি? কাজেই তাঁরা কানাকানি করিয়াই চলিলেন। আমার দিকে ভ্রুক্ষেপও করিলেন না।

এমনিভাবে দশ-পনর মিনিট কাটিয়া গেল। বাথরুমের দরজা খোলার আহট পাইলাম। সকলে সে দিকে চাহিলাম। প্রধানমন্ত্রী ভোয়ালিয়ায় চোখ-মুখ মুছিতে মুছিতে বাহির হইলেন। ঐ অবস্থায় প্রশ্ন করিলেন : ‘আবুল মনসুর, তুকি কি তোমার কলিগদেরে কনভিনস করিতে পারিয়াছ? এ প্রশ্নের আমি কি জবাব দিব? কনভিন। করিব কি আমি যে ইতিমধ্যে একটি কথাও বলি নাই। কাজেই নিরুপায় সহায়হীনের একটুখানি জোর-করা শুক হাসি হাসিলাম মাত্র। প্রধানমন্ত্রী চোখ-মুখ ও হাত মুছা শেষ করিয়া ঈষৎ পিছন হেলিয়া হাতের তোয়ালিয়াটা বোধ হয়। বাথরুমের টাওয়েল স্ট্যাণ্ডে রাখিলেন এবং যেন কতই চিন্তা করিতেছেন এমনিভাবে ধীরে ধীরে আসিয়া নিজের আসনেবসিলেন। আমরা সবাই দাঁড়াইয়াছিলাম। আমরাও বসিলাম। প্রধানমন্ত্রী আমার দিকে ভূক্ষেপ না করিয়া পশ্চিমা বন্ধুদের দিকে চাহিয়া বলিলেন : আমি মনে করি, আবুল মনসুর যদি এই-এই কয়েকটা সংশোধনী গ্রহণ করে, তবে আমরা তার প্রস্তাব গ্রহণ করিতে পারি। এই বলিয়া তিনি নিতান্ত মামুলি ভাষিক ও ব্যাকরণিক কয়েকটা সংশোধনী পেশ করিলেন এবং পশ্চিমা বন্ধুদের দিকে চাহিয়া বলিলেন : কি বলেন আপনারা?

তাঁরা আর কি বলিবেন? প্রধানমন্ত্রী এতক্ষণ তাঁদের সমর্থন করিয়াছেন, এখন তাঁদের কর্তব্য প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন করা। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বকিয়া তাঁদের খুশী করিয়াছেন। এইবার তাঁদের উচিত প্রধানমন্ত্রীকে খুশী করা। সকলে এক বাক্যে বলিলেন : আপনি যা ভাল বুঝেন।’

প্রধানমন্ত্রী এতক্ষণে ঘাড় ফিরাইয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন : দেখ, যদি তুমি এই-এই সংশোধনী গ্রহণ কর তবে কেবিনেট তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করিবে। বুঝিলে আমার কথা? তুমি এতে রাযী? এতক্ষণে আমি যেন লিডারকে কিছু-কিছু বুঝিতে পারিতেছিলাম। তাঁর চোখ যেন আমাকে ইশারা করিল : সহজে রাযী হইও। আমি সে ইশারা মানিলাম। মাথা নাড়িলাম। আপত্তি করিলাম। ও-সব সংশোধনী গ্রহণ করিলে আমার স্কিমগুলিই অর্থহীন বেকার হইয়া পড়ে, এমনিভাব প্রকাশ করিলাম। ঝাঁকাঝাঁকি করিলাম। নৈরাশ্য দেখাইলাম। আমার স্কিমগুলি অবিকৃত গ্রহণ করিবার অনুরোধও করিলাম। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী অটল-অনড়। ভাবটা যেন ‘হয় গ্রহণ নয় বর্জন’। অগত্যা শেষ পর্যন্ত আমি হার মানিলাম। আমার প্রস্তাব গৃহীত হইল। আমার ঘাম দিয়া জ্বর ছাড়িল। লিডার আমাকে কংগ্রেচুলেট করিলেন। দেখাদেখি সকলেই করিলেন। এতক্ষণে আমি বুঝিলাম, তেমন কড়া শীতের মওসুমেও আমার জামা কাপড় ঘামে ভিজিয়া গিয়াছে।

প্রধানমন্ত্রী কেবিনেট রুম হইতে বাহির হইয়া সোজা দুতলায় উঠিবার লিফটে চড়িলেন। আমাদের কাউকে কিছু বলিবার সুযোগ দিলেন না। তাঁর সাথে লিফটে উঠিবার জন্য আমাদের কাউকে ডাকিলেন না। লিফট এক লাফে দুতালায় উঠিয়া গেল। আমরা সকলে গাড়ি বারান্দার দিকে চলিলাম। আশাতীত জয়ের পুলকানন্দে আমি এরূপ বাহ্যজ্ঞানহীন। হঠাৎ কার হাত আমার কাঁধে পড়িল। আমার চমক ভাংগিল। দেখিলাম, অর্থমন্ত্রী সৈয়দ আমজাদ আলী। তাঁর সুন্দর মুখের স্বাভাবিক মিষ্টি হাসি ক্রুর ভ্রূ-ভংগিতে বিকৃত করিয়া দুষ্টামিপূর্ণ ভাষায় বলিলেন : অভিনয়টা পারফেক্ট হইয়াছে। সারারাত ধরিয়া রিহার্সেল দিয়া ছিলেন বুঝি?

৬. মকফাইট?

আমি বরাবরই অল্প-বুদ্ধি লোক। বন্ধুবরের রসিকতাটা ভাল বুঝিতে পারিলাম না। কিন্তু আন্দায করিলাম। তবু বোকার মত তাঁর দিকে চাহিয়া রহিলাম। এবার তিনি সহজ-সুন্দর স্বাভাবিক মিষ্টি হাসিটা ফিরাইয়া আনিয়া বলিলেন : প্রাইম মিনিস্টার ও আপনি যে মকফাইটটা করিলেন, তার কথাই আমি বলিতেছি। কাজ ত হইয়াই গিয়াছে। এখনও অভিনয় চালাইয়া যাওয়ার দরকার কি?

লিডারের তিন-তিন ঘন্টাব্যাপী পারফরমেন্সের আগাগোড়া ছবিটা নূতন রূপের চাকচিক্যে আমার চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিল। সত্যই তাই নাকি? তাই ত কত জায়গায় তাঁর কত প্রশ্নের জবাব তিনি নিজেই আমার মুখে তুলিয়া দিয়াছেন। পুলক আনন্দ গর্ব-অহংকার ও বিনয়-কৃতজ্ঞতার ঢেউ-এর নিচে আমি তলাইয়া গেলাম। হে মহান নেতা, এমন করিয়া তুমি আমাকে জিতাইয়া দিয়াছ? আমাকে নীরব দেখিয়া বন্ধুবর আমার হাত ধরিয়া টানিয়া নিতে নিতে বলিলেন : ভয় নাই, আমি কাউকে বলিয়া দিব না। কেউ বুঝেন নাই। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে হিপনোটাইড করিয়া ফেলিয়াছিলেন।

একটু থামিয়া আবার তিনি বলিলেন : আপনি যাই মনে করেন ভাই সাহেব, প্রধানমন্ত্রী অমন না করিলে আপনার প্রস্তাব পাশের কিছুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না।

কথায়-কথায় আমরা বিশাল লাউঞ্জটা পার হইয়া গাড়ি বারান্দার সামনে আসিয়া পড়িয়াছিলাম। আমার গাড়িটা আগে আসিয়া গাড়িবারান্দাটা আটকাইয়া রাখার দরুন আমজাদ আলীর গাড়িটা দূরে দাঁড়াইয়া আছে। তিনি হাত উঠাইয়া আমাকে সালাম করিয়া হাসি-মুখে হনহন করিয়া নিজের গাড়ির দিকে ছুটিলেন।

একদৃষ্টে অথবা দৃষ্টিহীনভাবে তাঁর দিকে চাহিয়া-চাহিয়া আবার আমি বাহ্যজ্ঞান হারাইলাম। প্রাইভেট সেক্রেটারি অথবা বডিগার্ডের ডাকে আমার চমক ভাংগিল। আমি গাড়িতে চড়িবার জন্য সিঁড়িতে পা দিবার আগে একবার ছাদের দিকে ভক্তিভরে তাকাইলাম। ঠিক উপরেই প্রধানমন্ত্রীর বেডরুম।

৭. বিদেশী মুদ্রার অভাব

কেবিনেটে আমার স্কিম অনুমোদিত হওয়ার সংগে সংগেই আমি ফাইনান্স মিনিস্টার জনাব আমজাদ আলীর পিছনে লাগিলাম। চাহিলাম তাঁর কাছে আমার প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা। তিনি তাঁর স্বাভাবিক মিঠা-মধুর হাসি হাসিয়া বলিলেন : ‘বিদেশী মুদ্রা নাই ভাই সাহেব, সে কথা আগেই বলিয়াছি।‘ একথা সত্য। কেবিনেটে আমার স্কিম আলোচনা হওয়ার সময় এই ধরনের কথা তিনি বলিয়াছিলেন : আমরা পূর্ব পাকিস্তানীরা ওটাকে আমার স্কিম রুখিবার একটি ধাপ্পা মনে করিয়াছিলাম। কাজেই তখন ও-কথায় আমি কোনও গুরুত্ব দেই নাই। কিন্তু এখন দিলাম। আমি রাগিয়া গেলাম। বলিলাম : পূর্ব-পাকিস্তানের প্রয়োজনের বেলা টাকা ত থাকিবেই না। বরাবর আপনারা এসব করিয়াছেন। আর চলিবে না। টাকা আমাকে দিতেই হইবে। যেখান হইতে পারেন। আমার রাগ দেখিয়া বন্ধুবর হাসিলেন। বলিলেন : ‘ভাইসাব, যেদিন খুশী আপনি আমার দফতরে আসুন। সব কাগপত্র দেখুন। অফিসারদের সাথে নিজে আলোচনা করুন। সব অফিসারকে আপনার সামনে হাযির করিয়া আমি সরিয়া পড়িব। আপনি ইচ্ছামত সব কাগপত্র দেখিয়া এবং অফিসারদেরে জেরা করিয়া সব খবর নিবেন। তাতে যদি আমার কথা সত্য প্রমাণিত হয়, তবে আপনি বিশ্বাস করিবেন ত?’

বড় কঠিন কাজ। কঠিন ফরমায়েশ। আমি অর্থনীতির কিছু জানি না। অর্থ। দফতরের কাগপত্র কি বুঝিব? কাজেই প্রথমে অসম্মতি জানাইলাম। বলিলাম। ‘আমি কাগপত্র চাই না, চাই টাকা। আপনি অর্থমন্ত্রী। যেখান হইতে পারেন টাকা আনিয়া দেন।‘

কিন্তু মিষ্টভাষী বন্ধুবরের টানে শেষ পর্যন্ত রাযী হইলাম। তাঁর চেম্বারে বসিয়া সেক্রেটারিজয়েন্ট সেক্রেটারিসহ অনেক অফিসারের সাথে পুরা দুইদিন আলোচনা করিলাম। আঁরা কাগপত্র দেখাইলেন। আমি বুঝিলাম, সত্যই বিদেশী মুদ্রা নাই। শুধু যে বর্তমানে নাই, তাও নয়। আগামী প্রায় দুই বৎসরের আনুমানিক আয়ও অগ্রিম ব্যয় হইয়া গিয়াছে। এমন সব খরচের খাতে বিদেশী পক্ষের সাথে এ রকম পাকাঁপাকি চুক্তি হইয়া গিয়াছে যে একতরফা তার একটা চুক্তি বাতিল করিবার উপায় নাই।

আমি শুকনা-মুখে অর্থমন্ত্রীর নিকট হইতে বিদায় হইলাম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব বিস্তারিত রিপোর্ট করিয়া তাঁর উপদেশ চাইলাম। তিনি গম্ভীর ও চিন্তাযুক্ত হইলেন। বলিলেন : ‘আমি ত আগেই তোমাকে হুশিয়ার করিয়াছিলাম, তোমার এই লক্ষ ঝম্পে কোন কাজ হইবে না। এখন লাভটা কি হইল? পূর্ব-পাকিস্তানীদের মধ্যে জাগাইলে বৃথা আশা। আর পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যে সৃষ্টি করিলে নাহক দুশমনি।‘

আমি বিশেষভাবে চাপিয়া ধরিলাম। বলিলাম : আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা ভাবিবেন না। একটা কিছু উপায় বাহির করুন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আপনি খালি হাতে পূর্ব পাকিস্তানী ভোটারদের কাছে যাইতে পারেন না। কি জবাব দিবেন তাদের কাছে?

আগামী ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে সাধারণ নির্বাচন করাইব, এ বিষয়ে আমরা তখন দৃঢ়সংকল্প। প্রধানমন্ত্রীই এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অনড়। সুতরাং আমার এই কথাটায় বোধহয় আগামী নির্বাচনের কথাটা তাঁর মনে পড়িল। তাঁকে চিন্তাযুক্ত দেখা গেল। লিডারের চিন্তায় সাহায্য করিবার আশায় আমি বলিলাম : ‘মার্কিন বন্ধুরা আপনার খাতিরে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কিছু করিবেন না?’

অন্য সময় হইলে কি অন্য কেউ একথা বলিলে লিডার বোধ হয় চটিয়া যাইতেন। কারণ এই সময় আওয়ামী লীগের ভিতরের একদল-সহ বামপন্থীরা সুহরাওয়ার্দী সাহেবকে গোপনে ‘মার্কিন দালাল’ বলিয়া গাল দিতেছিলেন। এ অবস্থায় এটাকে বক্রোক্তি মনে করা অসম্ভব ছিল না।

কিন্তু আজ আমার ব্যাকুল আগ্রহাতিশয্য দেখিয়াই বোধ হয় ঐ ধরনের কোন সন্দেহই তাঁর মনে আসিল না। মুহূর্তমাত্র ভাবিয়া তিনি ফোন উঠাইয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিঃ ল্যাংলিকে ঐদিন বিকালে চারটার সময় চায়ের দাওয়াত দিলেন। আমাকে ঐ সময় হাযির থাকিতে বলিলেন।

৮. মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাহায্য প্রার্থনা

চায়ের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সোজা বিষয়ী কথা পাড়িলেন। পূর্ব-বাংলার শিল্পায়নের জন্য সাহায্য দিতে হইবে। মিঃ ল্যাংলি সহজেই রাযী হইলেন সুপারিশ পাঠাইতে। জানাইলেন, পূর্ববর্তী সরকারের আমলেই মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে দশ মিলিয়ন ডলার (পাঁচ কোটি টাকা) ‘কমডিটি এইড’ রূপে দেওয়া স্থির করিয়াছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা না আনায় ঐ সাহায্য অব্যবহৃত অবস্থায় পড়িয়া আছে। উহাকেই ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এইডে রূপান্তরিত করিয়া দেওয়া যাইতে পারে। সেজন্য আইন পাস করিতে হইবে। মার্কিন রাষ্ট্রে উহাই নিয়ম। রাষ্ট্রদূত তা করাইবার ভার নিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করিলেন কয়েকজনকে ব্যক্তিগত পত্র লিখিতে।

মিঃ ল্যাংলির ভরশায় এবং প্রধানমন্ত্রীর তৎপরতায় আমি আশ্বস্ত ও নিশ্চিন্ত হইয়া অন্যান্য বিষয়ে মন দিলাম।

৯. আন্ত-আঞ্চলিক বৈষম্য

বাণিজ্য-দফতরের বিষয়াদি অধ্যয়ন করিতে গিয়া আমার ধারণা হইল আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দুইটি ত্রুটি দেশের বিশেষ ক্ষতি করিতেছে। একটি, ভারতের সংগে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রয়োজন ও সম্ভবমত বাড়িতেছে না। দ্বিতীয়টি, কমিউনিস্ট দেশসমূহের সাথে আমাদের কোনও ব্যবসা-বাণিজ্যিই হইতেছে না। এই দুইটিই রাজনৈতিক কারণসস্তুত। কাশ্মিরের অধিকার লইয়া ভারতের সাথে আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক অতিশয় তিক্ত। কাজেই তার সাথে বাণিজ্যক সম্পর্ক বাড়াইবার চেষ্টা হয় নাই। ফলে আমাদের দুইটি বড় লোকসান হইতেছে। এক, আমরা পাটের একটা বড় ও ভাল খরিদ্দার হারাইতেছি। দুই, ভারত হইতে সস্তাদরে অল্প ভাড়ায় যে কয়লা পাইতে পারিতাম তা হইতে বঞ্চিত হইতেছি। এছাড়া আরও একটি ব্যাপারে আমরা ভারতের সহিত সদ্ভাবের সুযোগ নিতে পারি। ধরুন, নোয়াখালি, কুমিল্লা ও সিলেটের সীমান্তবাসী বহু পাকিস্তানী নাগরিক পুরুষানুক্রমে পার্শ্ববর্তী ভারতীয় জমি চাষাবাদ করিয়া ধান এদেশে আনে। ইহারা জিরাতিয়া বলিয়া পরিচিত। ভারতের সহিত কোন চুক্তি না থাকায় ইহাদের প্রতি নানারূপ যুলুম করা হইতেছে। এদের সংখ্যা অনেক। এদের জন্য একটা চুক্তি করা আশু প্রয়োজন। তাছাড়া আমাদের পূর্ব পাকিস্তানে একটিমাত্র সিমেন্ট কারখানা। কলিকাতা তার হেড অফিস। তার কাঁচামাল চুনাপাথর আনা হয় ভারতীয় এলাকা হইতে রোপওয়ে বা দড়ির ঝোলানো সকুর সাহায্যে। যদিও কারখানাটির ক্যাপাসিটি এক লক্ষ টনের উপর, কিন্তু তাতে উৎপন্ন হয় মাত্র ৪৭ হাজার টন। পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বার সাহেব আমাকে জানাইয়াছেন, বর্তমানেই আমাদের সিমেন্টের চাহিদার পরিমাণ দেড়লক্ষ টনের উপর। আগামী সনেই এর পরিমাণ দাঁড়াইবে আড়াই লক্ষ টন। কাজেই বর্তমানেই আমাদের একলক্ষ টন বাহির হইতে আমদানি করা দরকার। পশ্চিম পাকিস্তানই এই ঘাটতি মিটাইতে পারে। কিন্তু জাহাজের অভাবে ঐ সিমেন্ট আমদানির পরিমাণও যথেষ্ট নয়; জাহাজ ভাড়ার দরুন দামও অনেক বেশি। সময় মত সরবরাহও হয় না। এতে পূর্ব-পাকিস্তানের সরকারী ও বেসরকারী সমস্ত নির্মাণ কাজ ও উন্নয়নমূলক কাজ সাংঘাতিকভাবে ব্যাহত হইতেছে।

আমি এইসব সমস্যা লইয়া শিল্প-দফতরের সেক্রেটারি মিঃ আব্বাস খলিলী ও বাণিজ্য দফতরের সেক্রেটারি মিঃ কেরামতুল্লার সাথে এবং তাঁদের সহকারীদের সাথেও বিস্তারিত আলোচনা করিলাম। মিঃ খলিলী এসব ব্যাপারে খুব উৎসাহ ও উদ্যম দেখাইলেন। কিন্তু মিঃ কেরামতুল্লাকে তেমন উৎসাহী দেখিলাম না। আমার মনে হইল, তিনি নিজেই ক্লান্ত ও নিরুৎসাহ হইয়া পড়িয়াছেন। উভয়েই প্রবীণ আই. সি. এস.। অনেকদিন ধরিয়া যার-তাঁর ডিপার্টমেন্টের হেড আছেন। কিন্তু মিঃ কেরামতুল্লাহ যেন প্রাণহীন হইয়া পড়িয়াছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর সংগে আমার স্কিম ও সে সম্পর্কে সেক্রেটারিদের ভাব-গতিকের আলোচনা করিলাম।

১০. সেক্রেটারিয়েটে ওলট-পালট

কয়েক দিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী অবস্থার প্রতিকার করিলেন। তিনি মিঃ কেরামতুল্লার বদলে মিঃ আযিয় আহমদকে বাণিজ্য দফতরের সেক্রেটারি নিযুক্ত করিলেন। এই নিয়োগের পিছনে একটা ইতিহাস আছে। আমি অল্পদিনেই বুঝিয়াছিলাম যে চাকুরি-বাকুরির ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানীদের সুবিধা করিতে গেলে সেক্রেটারি-জেনারেলের অফিসের বিলোপ সাধন করিতে হইবে। শাসনতন্ত্রে চাকুরি বাকুরির ব্যাপারে প্যারিটি আনয়নের বিধান থাকা সত্ত্বেও সেক্রেটারি-জেনারেলের দফতর সকল চেষ্টা ব্যাহত করিয়া দিতেছিল। এই দফতর থাকা পর্যন্ত এর অনুমোদন ছাড়া চাকুরি-বাকুরিতে কিছু করিবার উপায় ছিল না। আমি গোপনে প্রধানমন্ত্রীকে আমার মনোভাব জানাইলাম। দেখিলাম, তিনিও সেই চিন্তাই করিতেছেন। বলিলেন : ‘আমার ইচ্ছাও তাই। কিন্তু প্রশ্ন এই যে ঐ দফতর ভাংগিয়া দিলে আযিয আহমদকে কোথায় বসাইবে?’ আমি বলিলাম : ‘কেন, তাঁকে কোথাও এম্বেসেডর করিয়া পাঠাইয়া দিন। তাঁর ভাই মিঃ গোলাম আহমদও এম্বেসেডর আছেনই।’ প্রধানমন্ত্রী বলিলেন : ‘সরকারী কর্মচারীরা এম্বেসেডরিতে যাউক, এটা আমি পছন্দ করি না। আমার মনে হয় আমাদের কূটনৈতিক দফতরকে সজীব ও সক্রিয় করিতে হইলে রাজনৈতিকদের মধ্যেই ঐ সব পদ সীমাবদ্ধ করা দরকার। সরকারী কর্মচারীদের মন ধরাবাঁধা নিয়মের কাঠামোতে গড়া। তাঁরা কূটনীতিক ব্যাপারে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন না। কাজেই আমি নূতন করিয়া সরকারী কর্মচারীদেরে কূটনৈতিক চাকুরিতে পাঠাইব ত নাই, বরঞ্চ যাঁরা আছেন, তাঁদেরও উঠাইয়া আনিব। অতএব সেক্রেটারিয়েটের মধ্যেই কোথাও আযিয আহমদের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত আমি তাঁকে সেক্রেটারি-জেনারেলের পদ হইতে সরাইতে পারি না।‘

এর কয়েকদিন পরেই বাণিজ্য দফতরে আমার নূতন স্কিম নয়ানীতি ও এর কার্যকারিতার খাতিরেই সেক্রেটারি বদলের কথা উঠিল।

খানিক মিয়া একটু চিন্তা করিয়া প্রধানমন্ত্রী নাটকীয় ভংগিতে আমার দিকে শাহাদত আংগুলের একটা তীর নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন : ‘ইউ। ইউ টেক হিম অ্যা ইওর কমার্স সেক্রেটারি।‘

আমি ঘাবড়াইয়া গেলাম। মিঃ আযিয় আহমদ শুধু সর্বজ্যেষ্ঠ আই.সি.এস.ই নন। ‘মোস্ট স্টিফনেকেড বুরোক্র্যাট’ বলিয়া তাঁর বদনাম বা সুনাম আছে। মন্ত্রীদের কোনও কথা তিনি শোনেন না। মন্ত্রীদেরই তিনি কানি আংগুলের চার পাশে ঘুরান। কথাটায় আমার বিশ্বাসও হইয়াছিল। পূর্ব-বাংলার চিফ সেক্রেটারি থাকা অবস্থায় জনাব নূরুল আমিনের আমলে একবার তিনি হাইকোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া বলিয়াছিলেন : ‘আমি প্রধান মন্ত্রীসহ সমস্ত মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সিক্রেট-ফাইল রাখি এবং তা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠাই। পূর্ব বাংলার প্রধান মন্ত্রী বা কেবিনেট এই কাজের জন্য চিফ সেক্রেটারির বিরুদ্ধে কোনও স্টেপ নিয়াছিলেন বলিয়া শোনা যায় নাই। বরঞ্চ লোকে বলাবলি করিত আসলে চিফ সেক্রেটারিই পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী।

আমি প্রধানমন্ত্রীকে আমার আশংকার কথা বলিলাম। তিনি অভয় দিয়া বলিলেন : ‘ভয় পাইও না। আযিয় আহমদের আর যত দোষই থাকুক, তিনি খুব যোগ্য ও দক্ষ অফিসার। তুমি তাঁকে নেও। আমি ত আছিই। কোনও অসুবিধা হইলে পরে দেখা যাইবে।’ এইভাবে পাকিস্তান সরকারের সর্বাপেক্ষা দোর্দণ্ডপ্রতাপ ‘আড়ষ্ট-গ্রীব বুরোক্র্যাট জনাব আযিয আহমদ আমার মত সাদাসিধা ‘লেদাভূষা’ মন্ত্রীর সেক্রেটারি নিযুক্ত হইলেন।

১১. একটি গুরুতর লোকসান

এই সঙ্গে আমার আরেকটি গুরুতর লোকসান হইল। বাণিজ্য দফতরের সেক্রেটারি বদলাইবার সময় প্রধান মন্ত্রী শিল্প-দফতরের সেক্রেটারিও বদলাইলেন। মিঃ আব্বাস খলিলীর জায়গায় মিঃ মোহাম্মদ খুরশিদকে শিল্প-দফতরের সেক্রেটারি করা হইল। আমি প্রধান মন্ত্রীর নিকট নালিশের ভাষায় কথাটা বলিতে গেলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করিলেন। বলিলেন : তোমার কথা মতই ত আমি খলিলীকে সরাইয়াছি।

প্রকৃত ঘটনা এই যে আমি সত্যই একদিন মিঃ খলিলীর বিরুদ্ধে এবং অপরদিন শিল্প-বাণিজ্য উভয় দফতরের বিরুদ্ধে বলিয়াছিলাম। উভয়ের বিরুদ্ধে অভিযোটা করি অপযিশনে থাকিতে। সেটা ছিল এইরূপ : প্রায় পাকিস্তানের সৃষ্টি-অবধি এই দুইজন সেক্রেটারি একই দফতরের সেক্রেটারিগিরি করিতেছেন। ফলে তাঁরা যাঁরা-তাঁর দফতরকে নিজের জমিদারি মনে করিয়া থাকেন। চলেনও জমিদারের মতই। অফিসারদের প্রতি ব্যবহারও তাঁদের ব্যক্তিগত কর্মচারির মতই।

আর মন্ত্রী হইবার পর খলিলী সাহেবের বিরুদ্ধে বলিয়াছিলাম যে মন্ত্রীদের তিনি মৌসুমী পাখী মনে করেন। কোন এক ক্লাবে বসিয়া বন্ধুদের কাছে মন্ত্রীদেরে ‘সিযন্যাল বার্ড বলিয়াছিলেন এবং সেক্রেটারিরাই আসল শাসনকর্তা, মন্ত্রীরা কিছু না, এই ধরনের উক্তি করিয়াছিলেন। শ্রোতাদের মধ্যে কেউ-কেউ আমার কাছে নালিশ করায় আমি মিঃ খলিলীর কৈফিয়ৎ তলব করি। তিনি হাসি-মুখে সব কথা স্বীকার করিয়া তার যে ব্যাখ্যা দেন, তাতে আমি সন্তুষ্ট হই এবং উচ্চহাস্য করিয়া তাঁর ব্যাখ্যা গ্রহণ করি। এই ঘটনা সম্পর্কে ক্লাবে বন্ধুদের সাথে কথা বলিতে গিয়া মিঃ খলিলী আবার মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কটুক্তি করিয়াছেন বলিয়া আবার আমার কাছে খবর আসে। খলিলী সাহেব তারও যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেন। আমি তাঁর ব্যাখ্যায় এবারও সন্তুষ্ট হই। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রধান মন্ত্রীর চেম্বারে কথাটা উঠে। তিনি কার কাছে সবই শুনিয়াছিলেন। আমি ঘটনার বিবরণ সত্য বলিয়া স্বীকার করিলাম। আমি নিজেই যে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করিয়াছিলাম, তাও সত্য। কিন্তু মিঃ খলিলীর ব্যাখ্যা যে যুক্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য এবং তা যে গ্রহণ করিয়াছি, সব কথাও বলিলাম। প্রধানমন্ত্রী আর কিছু বলিলেন না। শুধুমাত্র তাঁর স্বভাবসিদ্ধ একটা ‘হুম’ করিয়া অন্য কাজে মন দিলেন। তার পরেই এই বদলি। আমার সব কথার উত্তরে তিনি বলিলেন : খুরশিদ ভোমার সব স্কিম ও প্ল্যানে তোমার সমর্থন ও সহায়তা করিবেন। আমি তোমার ধ্যান-ধারণার কথা তাঁকে ভাল করিয়া বুঝাইয়া দিয়াছি। তুমি শুনিয়া খুশি হইবে যে খুরশিদ নিজেকে আসলে সিলেট জিলার অধিবাসী বাংগালী মনে করেন। বলিয়া হাসিলেন এবং আমাকে হাসাইবার চেষ্টা করিলেন।

১২. বাণিজ্য-দফতরের সেক্রেটারি

বাণিজ্য সেক্রেটারি হিসাবে মিঃ আযিয আহমদের সাথে প্রথম-প্রথম খুব সাবধানে কথা বললাম। তিনি কিন্তু প্রথম হইতেই বিনয়-নম্রতা ও আনুগত্যের পরকাষ্ঠা দেখাইতে লাগিলেন। তথাপি তিনি যে পরিমাণে যত বেশি ভদ্রতা ও আনুগত্য দেখাইলেন, আমি সেই পরিমাণে ততবেশি সাবধান হইলাম।

কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই মিঃ আযিয আহমদের প্রতি আমার ধারণা বদলাইতে লাগিল। আমার প্রতি তাঁর ভক্তি ও আনুগত্যের মধ্যে কোনও চালাকি বা ভন্ডামির আঁচ পাইলাম না। কারণ যেসব ব্যাপারে তিনি আমার সাথে একমত হইতেন না, সেসব বিষয়ে খুব জোরের সংগেই আমার সাথে তর্ক করিতেন। আমাকে অনড় দেখিলে শেষ পর্যন্ত বলিতেন : ‘আমার উপদেশ যা দিবার ছিল, তা দিলাম। আমার কর্তব্য এখানেই– শেষ। এরপর আপনি যে আদেশ দিবেন, তাই বলবৎ হইবে এবং আমি অক্ষরে অক্ষরে তাই পালন করিব। বস্তুতঃ আমাদের শিক্ষা এবং বৃটিশ আমলাতান্ত্রিক ঐতিহ্যই তাই।

আমি তাঁর এই নীতি খুবই পসন্দ করিলাম। আমরা মন্ত্রীরা ভুল করিলে যেসব সেক্রেটারি আমাদের ভুল দেখাইয়া দেন, ভুলটাতেও সমর্থন দিয়া হাঁ হুযুর’ করিয়া আমাদেরে খুশী করেন না, তাঁদেরে আমি খুবই পসন্দ করি। একথা আমি তাঁকে খোলাখুলিই বলিলাম : নিজে কোনদিনই ‘হাঁ হুযুরি’ রাজনীতি করি নাই। অপরে আমার নিকট তা করুক, এটাও আমি চাই না।’

১৩. ভারত ও কমিউনিস্ট দেশের বাণিজ্য

কাজেই মিঃ আযিয আহমদের সহিত আমার বনিল ভাল! আমি ভারতের সাথে ও কমিউনিস্ট দেশের সাথে আমাদের দেশের বাণিজ্যের সম্ভাবনা ও তার ভাল দিক দেখাইলাম। ইতিমধ্যে আমার এক ঘোষণায় বলিয়াছিলাম : ‘আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক রাজনৈতিক সীমান্ত ডিংগাইয়া যাইবে।‘ সে কথাটা তাঁকে বুঝাইয়া-বলিলাম। আমার মতবাদের সমর্থনে ইংরাজ জাতির বাণিজ্য-নীতি, বিশেষতঃ যুদ্ধের সময়েও সে নীতি বলবৎ রাখার প্রথার কথা বলিলাম। মিঃ আযিয আহমদ খুবই মার্কিন ভক্ত হওয়ার এবং পাক-মার্কিন-চুক্তি-আদির দরুন এ ব্যাপারে তাঁর মনে কোনও দ্বিধা সন্দেহ থাকিতে পারে মনে করিয়া আমি তাঁকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম যে ইংরাজের এই বাণিজ্য-নীতিতেও ইংগ-মার্কিন বন্ধুত্বে কোনও বিঘ্ন ঘটে নাই।

আমার এতসব বক্তৃতার পর মিঃ আযিয আহমদ পাক-ভারত বাণিজ্য-ব্যাপারে আমার সহিত একমত হইলেন। কমিউনিস্ট দেশের সাথে বাণিজ্যের ব্যাপারে তিনি রাযী হন কয়েক মাস পরে। তার আগে প্রাইম মিনিস্টার ও প্রেসিডেন্টের সহিত আলোচনা করিতে তিনি আমাকে উপদেশ দেন। এটাকে আমি আমার আংশিক সাফল্য মনে করিলাম। কারণ দেখিলাম, ভারত-বিরোধী মনোভাব তাঁর মুসলিম লীগারদের চেয়েও তীব্র। তবে তিনি ছিলেন বাস্তববাদী। পাকিস্তানের ভালর জন্য তিনি সব কাজে রাযী ছিলেন। অতএব নিছক বাণিজ্যিক সম্পর্কের দিক দিয়া তিনি আমার মতবাদ গ্রহণ করিলেন। পাক-ভারত বাণিজ্য চুক্তি রিনিউ করিবার সময় আগত-প্রায়। কাজেই আমি তাঁকে আমার সংকল্প বিস্তারিতভাবে বলিলাম। কেবিনেটে পেশ করিবার জন্য কাগ্যপত্র তৈয়ার করিতে আদেশ দিলাম। আমার সংকল্পিত পাক-ভারত বাণিজ্য চুক্তির অন্যতম প্রধান নূতনত্ব ছিল এই যে বরাবরের ন্যায় এক-বৎসর মেয়াদী চুক্তির বদলে আমি তিন-বৎসর-মেয়াদী চুক্তির পক্ষপাতী ছিলাম। তিনি সহজেই আমার মত গ্রহণ করিলেন। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা হইতে দেখা গিয়াছিল যে আমদানি-রফতানি লাইসেন্স ইস্ত করা ও অন্যান্য আনুষংগিক আয়োজন করিতে-করিতেই বৎসরের বেশি সময় উত্তীর্ণ হইয়া যায়। উভয় পক্ষ হইতে মেয়াদ বাড়াইবার জন্য দেন দরবারও করিতে হয়। এতে অনেক সময় আমদানি-রফতানি দ্রব্যের মৌসুম পার হইয়া যায়।

১৪. ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি

ভারতের সাথে বাণিজ্যিক ব্যাপারে আরেকটি বিষয়ে আমার পূর্ব-ধারণা ছিল। এটা পশ্চিম-বাংলায় নির্মিত ছায়াছবির ব্যাপার। পশ্চিমবাংলায় উন্নত ধরনের ছায়াছবির নির্মাণ দ্রুতগতিতে অগ্রসর হইতেছিল। তারই স্বাভাবিক উপসর্গরূপে তথায় অভিনেতা-অভিনেত্রী ও ফিল্ম স্ক্রিপ্ট লেখকও হ হ করিয়া বাড়িতেছিল। পূর্ব বাংলায় ছায়াছবি নির্মাণের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। বইও রচিত হয় নাই। অভিনেতা অভিনেত্রীও পয়দা হয় নাই। এ অবস্থা আমাকে খুবই পীড়া দিত। অথচ এর প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা ও সম্ভাবনা ছিল না। পশ্চিম-বাংলার ছবিতে স্বভাবতঃই পূর্ব-বাংলা ছাইয়া গিয়াছিল। কলিকাতার ছবি-নির্মাতাদেরই এজেন্টরা ঢাকায় বসিয়া ছবি-প্রদর্শনীর ব্যবসা করিত। দুই-একজন পাকিস্তানী যারা কোনও ফাঁকে এই ব্যবসায়ে ঢুকিয়াছিল, তারাও পশ্চিম পাকিস্তানী। পূর্ব-বাংলার ফিল্ম-শিল্প গড়নে তাদের কোনও স্বার্থ বা চেতনা ছিল না। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু ফিল্ম রচনার যথেষ্ট উদ্যোগ-আয়োজন চলিতেছিল। এসবের প্রতিকার সম্বন্ধে কতিপয় পূর্ব পাকিস্তানী উৎসাহী লোকের সাথে আমি আগেই আলোচনা করিয়াছিলাম। তাতে আমার এই বিশ্বাস হইয়াছিল যে, সরকারী উৎসাহ ও সহায়তা না পাইলে পূর্ব বাংলায় ফিল্ম-শিল্প গড়িয়া উঠিবে না। ফলে মনে-মনে স্থির করিয়াছিলাম গবর্নমেন্ট হাতে পাইলে প্রথম সুযোগেই এটা করিব। সত্যসত্যই সরকার যখন হাতে আসিল, তখন জনাব আতাউর রহমান ও জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরামর্শ করিয়া প্রদেশে শিল্প-উন্নয়ন কর্পোরেশন স্থাপন করা ঠিক হইল। আর এদিকে কেন্দ্রে আমি এই সংকল্প করিলাম যে পূর্ব-বাংলায় যারা ফিল্ম-শিল্প গড়নে ওয়াদাবদ্ধ হইবেন, শুধু তাঁদেরই ভারতীয় ফিল্ম আমদানির লাইসেন্স দেওয়া হইবে। আসন্ন পাক-ভারত চুক্তির এটা অন্যতম শর্ত হইবে বলিয়া সেক্রেটারি মিঃ আযিয আহমদকে জানাইয়া দিলাম।

বাণিজ্য-দফতর সম্বন্ধে এই ব্যবস্থা করিয়া আমি পূর্ব-পাকিস্তান সফরে আসিলাম। পূর্ব-পাকিস্তানের সিমেন্ট ও চিনি-শিল্প পরিদর্শন এবারের সফরের আমার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। পূর্ব-পাকিস্তানের আমদানি-রফতানি কন্ট্রোলার পদের জন্য একজন উপযুক্ত অফিসার তালাশও এ সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। এই নূতন পদটি সৃষ্টি করিয়া অবধি এ বিষয়ে খুবই চিন্তাযুক্ত ছিলাম। পদটি যে কত বড় বিশাল দায়িত্বপূর্ণ পদ সেটা আমি ভাল করিয়াই বুঝিলাম। যাকে-তাকে এ পদ দেওয়া যাইবে না। সততা, সাধুতা ও সাহস এ পদের জন্য অত্যাবশ্যক। আমি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সুহরাওয়ার্দী ও প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান উভয়ের সংগেই আলোচনা করিয়াছিলাম। তাঁরা বিভিন্ন অফিসারের নাম করিয়াছিলেন। মনে-মনে তাঁদেরই তালিকা করিয়া নিজে দেখিবার জন্যই এবারে পূর্ব-পাকিস্তানে আসিলাম।

সিমেন্ট সম্পর্কে পূর্ব-পাকিস্তানের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সংগে পরামর্শ করিয়া ঢাকা-সিলেট বসিয়াই সিদ্ধান্ত করিলাম ও আদেশ দিলাম। সাপ্লাই এণ্ড ডিভেলাপমেন্ট-এর ডিরেক্টর জেনারেল মিঃ বি. এ. কোরেশীকে সংগে লইয়াই আসিয়াছিলাম। তাঁকে সংগে নিয়াই ছাতক সিমেন্ট ফেক্টরিতে গেলাম। ফেক্টরি কর্তৃপক্ষের সংগে আলাপ করিয়া বুঝিলাম, এই পরিমাণ টাকার মেশিনারি আমদানি লাইসেন্স পাইলে ছয় মাসের মধ্যে তাঁদের ফেক্টরিতে সাতচল্লিশ হাজারের জায়গায় এক লক্ষ টন সিমেন্ট উৎপাদন করিতে পারেন। তাঁরা বলিলেন : দুই-তিন বৎসর ধরিয়া তাঁদের দরখাস্ত কেন্দ্রীয় সরকারের দফতরে পড়িয়া আছে। মিঃ কোরেশীকে জিগাসা করিয়া ওঁদের অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পাইলাম। তৎক্ষণাৎ আমি প্রয়োজনীয় পরিমাণে লাইসেন্স ইস্তর আদেশ দিয়া দিলাম। সে লাইসেন্স তাঁরা পাইয়াছিলেন। সিমেন্ট উৎপাদনও প্রায় একলক্ষ টন করিয়াছিলেন। কিন্তু মন্ত্রী হিসাবে তা দেখিয়া আসিতে পারি নাই।

কনট্রোলার পদের জন্য উপযুক্ত অফিসারও আমি এই সফরেই পাইয়াছিলাম। ইনি ছিলেন মিঃ শফিউল আযম। তিনি তখন খুলনার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। আমি তাঁর সাথে কথা বলিয়া তাঁর কাজ-কর্ম দেখিয়া এতই সন্তুষ্ট হইলাম যে তাঁকে আমার কাজের জন্য সবচেয়ে যোগ্য লোক মনে করিলাম। তৎক্ষণাৎ সেইখানে বসিয়াই তাঁকে আমার অভিপ্রায় জানাইলাম। তিনি স্বভাবতঃই খুশী হইলেন। কিন্তু আপত্তি জানাইলেন এবং আপত্তির কারণও প্রকাশ করিলেন। চাটগাঁয় কনট্রোলার অফিস। চাটগাঁ তাঁর বাড়িও। কাজেই আত্মীয়-স্বজনের চাপ পড়িবে। চাকরিটাও ত চাপের চাকরি। কাজেই তিনি অসুবিধায় পড়িবেন। আমি মনে মনে ভাবিলাম। এই রকম বিবেকবান লোকই ত আমি চাই। বলিলাম : ‘তোমার আপত্তি আমি মানিলাম না। তুমি প্রস্তুত হও।’ তিনি প্রস্তুত হইয়াছিলেন। আমি করাচি ফিরিয়াই তাঁকে সেখানে কয়েকদিন ট্রেনিং দেওয়াইলাম। আমার পরিকল্পনা ও চিন্তাধারার সাথে তাঁকে পরিচিত করিয়া চাটগাঁ কনট্রোলার করিয়া পাঠাইয়া দিলাম। তিনি পরম যোগ্যতা ও সাধুতার সাথে সে কাজ চালাইলেন।

১৫. দুর্ঘটনায় আহত

কিন্তু চিনি-শিল্প সম্বন্ধে কিছুই সুবিধা করিতে পারিলাম না। প্রথম মিলদর্শনা শুগার মিল পরিদর্শন করিতে গিয়া সেখানেই দুর্ঘটনায় আহত হইলাম। দুর্ঘটনাও একেবারে অদ্ভুত এ্যাসিডেন্ট। সারা মিল ভন্ ভন্ করিয়া ঘুরিলাম। ষাট বৎসরের বুড়া তরুণ সাহেব ম্যানেজারদের আগে-আগে এক শ ফুট উঁচা লোহার রডের সিঁড়ি বাহিয়া সুউচ্চ ট্যাংকগুলির মাথায় উঠিলাম নামিলাম। তরুণ সাহেবরা বলিলেন : আমার চলাফেরা দেখিয়া তাঁরা পর্যন্ত ঘাবড়াইয়া যাইতেছেন। কিন্তু কিছু হইল না। সারা মিল দেখিয়া অবশেষে লেবার কোয়ার্টার দেখিতে গিয়াই বিপদে পড়িলাম। গরুর খুড়ের বর্ষাকালের গাতা শুকনার দিনে ‘গোস্পদ’ হইয়া আছে। এই গোস্পদই আগামী বর্ষায় ‘গোস্পদে বিম্বিত যথা অনন্ত, আকাশ’ হইবে। এই গোস্পদের একটিতে আমার ছেলেবেলার-ফুটবল-খেলায় ভাংগা পাটা পড়িল। হাঁটু মচকাইয়া গেল। আমি যে পড়িলাম, আর উঠিতে পারিলাম না। আমাকে ধরাধরি করিয়া সেলুনে আনা হইল। দেখিতে-দেখিতে হাঁটু ফুলিয়া ইয়া-বড় কলাগাছ হইয়া গেল। স্থানীয় সকল ডাক্তার সাধ্যমত চেষ্টা করিলেন। কিছুই হইল না। সেদিনকার সব প্রোগ্রাম ক্যানসেল হইল। ডাক্তাররা উপদেশ দিলেন, আগামী সব প্রোগ্রামও ক্যানসেল করিয়া ঢাকায় ফিরিয়া আসিতে। কিন্তু আমার কপালে আরও কষ্ট ছিল। কাজেই ডাক্তারদের এবং সংগীয় অফিসারদের উপদেশ মানিলাম না। বলিলাম : ‘শেতাবগঞ্জ ও গোপালপুরের কল দেখিয়া যাইব। কাল সকালেই ভাল হইয়া যাইব। এখানে যদি কোনও বিশ্বস্ত হোমিওপ্যাথিক ডিস্পেনসারি থাকে, তবে সেখান হইতে এক মাত্রা আর্নিকা ২০০ আনাইয়া খাওয়াইয়া দেন। তাই করা হইল। আনিকা খাইয়া আমি বাতি নিবাইয়া ঘুমাইয়া পড়িলাম। বলিলাম : ‘পার্বতীপুরের আগে আমাকে কেউ ডাকিবেন না।‘

পার্বতীপুরে আসিয়া দেখিলাম রাজশাহী বিভাগের কমিশনার সংশ্লিষ্ট জিলাসমূহের জিলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ উপস্থিত আছেন। তাঁরা সকলে একমত হইয়া বলিলেন আমার ঢাকায় ফিরিয়া যাওয়া উচিৎ। আমি বুঝিলাম আনিকা বরাবরের মত কাজ করে নাই। কাজেই রাযী হইলাম। তাড়াতাড়ি ঢাকা ফিরা দরকার। কিন্তু ফের ঈশ্বরদী-পোড়াদহ হইয়া ঘুরিয়া যাইতে অনেক সময় লাগিবে। কাজেই ফুলছড়ি হইয়া যাইতে হইবে। কিন্তু ঐ লাইন মিটার গজের। আমি বাহির হইয়াছি ব্রডগজের সেলুনে। সুতরাং সেলুন ছাড়িয়া সাধারণ গাড়ি ধরিতে হইল। শুধু টানা-হেঁচড়া। আর কোনও অসুবিধা না। তারপর ফুলছড়ি ঘাটে ট্রেন হইতে স্টিমারে নেওয়া হইল ইযি চেয়ারে শোওয়াইয়া। ইযিচেয়ার! শুনিতে বড় আরাম। কিন্তু চারজন কুলির কাঁধে যিন্দা লাশের মত প্রায় আধ মাইল যাওয়া, তারপর স্টিমার ঘাটের স্লোপে নামা, খাড়া সিঁড়ি দিয়া দুতলায় উঠা এমন সব কীর্তি-কাণ্ড বোধ হয় মৃত অবস্থায় খুব আরামের কিন্তু যিলা অবস্থায় খুব সুখের নয়।

স্টেশন হইতে সোজা হাসপাতালে নেওয়া হইল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিশেষ যত্ন নিলেন। বিশেষতঃ ডাঃ শামসুদ্দিন ও ডাঃ আসিরুদ্দিন দিন-রাত খাঁটিলেন। চারদিনের দিন অপরের কাঁধে ভর করিয়া দাঁড়াইতে পারিলাম। প্রাইম মিনিস্টার যরুরী বার্তা পাঠাইলেন : ‘অসম্ভব না হইলে এখনি চলিয়া আস’। ডাক্তাররা সম্মতি দিলেন বটে কিন্তু বলিলেন, আর কয়েকটা দিন থাকিয়া গেলে সম্পূর্ণ সারিয়া উঠিতাম।

অপরের কাঁধে অ করিয়া বিমান বন্দরে গেলাম। ধরাধরি করিয়া বিমানে তোলা হইল। করাচিতেও সেইভাবে পৌঁছিলাম। ধরাধরি করিয়া বাসার দুতলায় ভোলা হইল। আমার অবস্থা দেখিয়া প্রধানমন্ত্রী আমার দূতালায় কেবিনেট মিটিং নিলেন। ভ্রমণের ঝাঁকিতে আমার অবস্থা খারাপ হইয়াছিল। বিছানায় শুইয়া আমি কেবিনেট করিলাম। অর্থাৎ আমার শোবার ঘরেই কেবিনেট মিটিং হইল। বিছানা ছাড়িবারও আমার শক্তি ছিল না।

অথচ ঘটনাচক্রে এটাই সেই কেবিনেট-সভা যাতে অন্যান্য ব্যাপারের সাথে পাক-ভারত বাণিজ্য চুক্তির পাকিস্তানের পক্ষের দাবি-দাওয়া স্থিরীকৃত হইবে। সেইজন্যই প্রধানমন্ত্রী আমাকে যরুরী তাগাদা দিয়া ঢাকা হইতে আনিয়াছেন এবং আমার উপস্থিতির ব্যবস্থা হিসাবে আমার শোবার ঘরেই কেবিনেট মিটিং দিয়াছেন। আমি বাণিজ্য সেক্রেটারি মিঃ আযিয আহমদকে আগেই তৈয়ার করিয়া রাখিয়াছিলাম। কেবিনেট সেক্রেটারিয়েট হইতে প্রচারিত হইবার আগেই মিঃ আযিয় আহমদের রচিত কাজের কাগযপত্র (ওয়ার্কিং পেপার) আমাকে দেখাইয়া নেওয়া হইয়াছিল। কাজেই আমার বিশেষ কিছু বলিতে হইল না। মাঝে-মাঝে মিঃ আযিয় আহমদের কথার ঈষৎ সংশোধন করিয়া আমার মনোভাব প্রকাশ করিতে হইয়াছিল মাত্র। কেবিনেট আমার সবগুলো প্রস্তাব গ্রহণ করিল। কিন্তু সংকট দেখা দিল আমার দিল্লি যাওয়া লইয়া। আমি বর্তমানে দিল্লি যাওয়ার সম্পূর্ণ অযোগ্য। এটা মন্ত্রী স্তরের আলোচনা। শুধু সেক্রেটারি দিয়া হইবে না। মন্ত্রী একজনকে পাঠাইতেই হইবে। অথচ অন্য কোনও মন্ত্রী দিয়া আমার ভরসা নাই। প্রধানমন্ত্রীও আর কাহাকেও পাঠাইতে রাযী নন। মিঃ আযিয আহমদেরও মত তাই। আমাকেই যাইতে হইবে। তবেই দিল্লির বৈঠক পিছাইতে হয়। এদিকে চুক্তির মেয়াদ শেষ হইতেও বেশি বাকী নাই। আমাকে আরোগ্য হইয়া দিল্লি যাওয়ার যোগ্য হওয়াতক বর্তমানে চুক্তির মেয়াদ বাড়ান দরকার। ডাক্তারদের মত নেওয়া হইলঃ পনর দিনের কমে আমাকে খাড়া করা। যাইবে না। ভারত সরকারকে সব অবস্থা বলিয়া চলতি বাণিজ্য-চুক্তি এক মাস বাড়াইয়া দেওয়া হইল। পনর-বিশ দিন পরে একদিন দিল্লি যাওয়ার দিন তারিখ করা হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *