ওযারতির ঠেলা
ছাব্বিশা অধ্যায়
১. আই. সি. এ.এইড
ওদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিঃ ল্যাংলির সহায়তায় ও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অবিরাম অধ্যবসায়ের ফলে যথাসময়ে ৫ কোটি টাকার ইণ্ডাষ্ট্রিয়াল মেশিনারি এইড মার্কিন সাহায্যের সুসংবাদ আমাদের কাছে আসিয়া পৌঁছিল। আমার আনন্দ দেখে কে? পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করার আমার এতদিনের স্বপ্ন সফল হইতে যাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তানী মন্ত্রীরা সবাই উল্লসিত হইলেন। পশ্চিম-পাকিস্তানী মন্ত্রীদের অনেকেই আমাকে কংগ্রেচুলেট করিলেন। অর্থ-উজির বন্ধুবর আমজাদ আলী তার মধ্যে একজন। প্রাপ্ত ৫ কোটি বিদেশী মুদ্রা দিয়া কি কি শিল্প প্রতিষ্ঠা করা যাইতে পারে, সে সম্পর্কে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান ও শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রী মুজিবুর রহমানের সহিত আলাপ করিয়া দফতরে-দফতরে যোগাযোগ করিতেছি এমন সময় প্রধানমন্ত্রী জনাব শহীদ সাহেব আমাকে ডাকিয়া বলিলেন : এই টাকা হইতে কিছু টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে দিতে হইবে। আমি ঘোর প্রতিবাদ করিলাম। বলিলাম : ‘এই টাকা পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য আনা হইয়াছে; এর এক কানাকড়িও পশ্চিম-পাকিস্তানের জন্য চান না বলিয়া অর্থমন্ত্রী ও অন্যান্য পশ্চিমা মন্ত্রীরা আমাকে কথা দিয়াছেন; এই টাকা নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠায় ব্যয়িত হইবে।’ ইত্যাদি অনেক যুক্তি দিলাম। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মাথা নাড়তে থাকিলেন। বলিলেন দেখ, এটা অবিচার হইবে। আমি শুধু পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নই, উভয় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। আগের-আগের প্রধানমন্ত্রীরা পূর্ব-পাকিস্তানের উপর অবিচার করিয়াছে বলিয়া আমি পশ্চিম-পাকিস্তানের উপর অবিচার করিব না। আর তুমি যে নয়া শিল্প প্রতিষ্ঠার যুক্তি দিতেছ সে যুক্তিও আমি খণ্ডন করিতেছি না। পশ্চিম পাকিস্তানের নূতন শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য আমি টাকা চাই না। চতি শিল্পের র্যাশন্যালিযেশনের জন্য তুমি টাকা দিতে পার।
বলিয়া শিল্প-দফতরের বিঘোষিত গেযেট নটিফিকেশনটি বাহির করিয়া রেড বু পেন্সিলে-দাগ-দেওয়া একটা অংশ আমাকে দেখাইলেন। আমি বুঝিলাম প্রধানমন্ত্রী কাগপত্র দেখিয়া প্রস্তুত হইয়াই আমাকে ডাকিয়াছিলেন। সত্যই আমারই বিঘোষিত শি-নীতি ঘোষণায় বলা হইয়াছে : পশ্চিম-পাকিস্তানে নয়া শিল্প প্রতিষ্ঠিত হইবে না বটে, তবে চতি শিল্প র্যাশন্যালাইয করিবার উদ্দেশ্যে টাকা ব্যয় করা চলিবে।
আমি হার মানিলাম। প্রধানমন্ত্রী মুচকি হাসিয়া বলিলেন : বেশি না, এই তহবিল হইতে মাত্র এক কোটি টাকা পশ্চিম-পাকিস্তানকে দিয়া পশ্চিমা-ভাইদেরে দেখাইয়া দাও, আমরা তাঁদের চেয়ে বেশী বিচারী লোক।
তাই হইল। ঘোষণা করা হইল, পূর্ব-পাকিস্তানের নয়া শিল্প প্রতিষ্ঠার বাবদ চার কোটি ও পশ্চিম-পাকিস্তানের চলতি শিল্প র্যাশন্যালাইয করার জন্য এক কোটি ব্যয় হইবে। উভয় প্রাদেশিক সরকারকে এই মর্মে অবগত করান হইল এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত করিতে তাগিদ দেওয়া হইল। যথাসময়ে পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের তরফ হইতে নয়া শিল্পের তালিকা লইয়া শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রী মুজিবুর রহমান সাহেব তাঁর অফিসারদের সহ করাচিতে আসিলেন এবং তথায় প্রস্তাবিত শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় দফতরসমূহকে অবহিত করাইলেন।
কিন্তু এই সময়ে আমরা জানিতে পারিলাম, ঐ সাহায্যের টাকা দ্বারা টেক্সটাইল মিল অর্থাৎ পাট ও কাপড়ের কল করা চলিবে না। অন্য যে সব শিল্প প্রতিষ্ঠা করা হইবে তাও মার্কিন সরকারের পক্ষ হইতে আই. সি. এ. নামক মার্কিনী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত হইতে হইবে। অতএব উক্ত চারকোটি বিদেশী মুদ্রার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান সরকার পাটকল ও কাপড়ের কল বাদে অন্যসব শিল্পের সংশোধিত স্কিম যথাসম্ভব শীঘ্র প্রস্তুত করিয়া কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন লইবেন এইরূপ নির্দেশ দেওয়া হইল। পূর্ব-পাক সরকার তদনুসারে নতুন করিয়া অনেকগুলি প্রজেক্ট তৈয়ার করিলেন।
অল্পদিনের পরেই আই. সি. এস.এ. প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে চার-পাঁচ জন ‘প্রজেক্ট লিডার’ আসিলেন। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের তৈয়ারী প্রজেক্টসমূহ পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়া দেখাই তাঁদের উদ্দেশ্য। ভাল কথা। আমাদের টাকা দিয়া সাহায্য করিবেন, টাকাগুলি সত্যসত্যই আমাদের শিল্পায়নের কাজে লাগিতেছে কি না দেখিবেন না? আমাদের সরকার যে সব প্রজেক্ট বানাইয়াছেন, তার প্রত্যেকটির কার্যকারিতা তদিক করিয়া দেখিলে আমরা ত নিশ্চিত হই। কারণ আমাদের এক্সপার্টদের চেয়ে মার্কিন মুলুকের মত শিল্পোন্নত দেশের এক্সপার্টরা নিশ্চই অধিকতর জ্ঞানী ও নির্ভরযোগ্য। প্রজেক্ট লিডাররা পূর্ব-পাকিস্তানে আসিলেন। বেশ কিছুদিন থাকিলেন। সবকিছু বিচার-বিবেচনা করিয়া পূর্ব-পাকিস্তান হইতে তাঁরা বিদায় হইলেন। আমরা জানিলাম, পূর্ব-পাক সরকারের প্রস্তুত প্রজেক্টগুলি তাঁরা পুংখানুপুংখরূপে ত্যদিক করিয়া তার মধ্যে ৫৮টি শিল্প অনুমোদন করিয়াছেন এবং প্রস্তাবিত শিল্পপতিদের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য যোগ্যতাও তাঁরা পরীক্ষা করিয়া ঝাড়াই-বাছাই করিয়াছেন।
শিল্পায়নের প্যান, বিদেশী মুদ্রা ও লাইসেন্সিং প্রাদেশিক সরকারের হাতে এইভাবে তুলিয়া দিতে পারিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছিলাম। কাজেই ব্যাপারটা আমি ভূলিয়াই গেলাম। অন্য ব্যাপারে মন দিলাম। দিতে বাধ্য হইলাম।
২. আওয়ামী লীগের অন্তর্বিরোধ
কারণ পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তর্বিরোধ জমাট বাঁধিয়া উঠিল। প্রেসিডেন্ট মওলানা ভাসানীর সাথে বাহ্যতঃ ও প্রধানত বৈদেশিক নীতি লইয়া ভিতরে-ভিতরে বিরোধ ছিলই। কাগমারি আওয়ামী লীগ সম্মেলনে এই বিরোধ উপরে ভাসিয়া উঠে। আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার প্রতিও মওলানা সাহেব বিরূপ হইয়া উঠেন। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তিনি প্রকাশ্যভাবে বলিয়া ফেলেন যে আতাউর রহমান মন্ত্রিসভা ২১ দফার খেলাফ কাজ করিতেছেন। কথাটা সত্য ছিল না। কারণ আতাউর রহমান মন্ত্রিসভা সাধ্যমত ২১ দফার কার্যক্রম কার্যে পরিণত করিয়া চলিতেছিলেন। শাসন-সৌকর্যের ব্যাপারে ও অফিসারদের ট্রেন্সফারাদি ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী স্বভাবতঃই এবং ন্যায়তঃই সকল আওয়ামী লীগ কর্মীদের খুশী করিতে পারিতেন না। তাঁরাই মওলানা সাহেবের কানভারি করিতেন বলিয়া আমার বিশ্বাস। মওলানা সাহেব স্বভাবতঃই সরকার-বিরোধী মনোভাবের লোক বলিয়া মাত্রা-ছাড়া তাবে তিনি নিজের দলের সরকারের নিন্দা করিতেন। তাতে আতাউর রহমান সাহেব ত অসন্তুষ্ট হইতেনই শহীদ সাহেবও হইতেন। একদিকে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও অপর দিকে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি নেতৃদ্বয়ের মধ্যে এই বিরূপ মনোব আমার কাছে অশুভ ও বিপজ্জনক মনে হইত। আমি জোড়াতালি যুক্তি দিয়া এই বিরোধ মিটাইবার চেষ্টা করিতাম। মওলানা সাহেবকে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের এবং জনপ্রিয় নেতৃত্বের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের অনুরোধ করিতাম। অপরপক্ষে দুই প্রধানমন্ত্রীকে বুঝাইবার চেষ্টা করিতাম যে সরকারের সমালোচনা করিয়া মওলানা সাহেব নিজেকে তথা প্রতিষ্ঠানকে জনপ্রিয় রাখিয়া ভালই করিতেছেন। বরঞ্চ তলে-তলে সহযোগিতার ভাব রাখিয়া বাইরে-বাইরে প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি সরকারী কার্যকলাপের সমালোচনা করেন, তবে তাতে পরিণামে লাভ আমাদেরই। কারণ আমাদের সরকার কোয়েলিশন মন্ত্রিসভা। আমাদের ইচ্ছা ও জনগণের দাবি মত সব কাজ সত্যই ত আমরা করিতে পারিতেছি না। এই ব্যাপারে আমি ভারতের কংগ্রেসের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিঃ সঞ্জীব রেডিড ও প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুর মধ্যে গোপন সহযোগিতা ও প্রকাশ্য সমালোচনার দৃষ্টান্ত দিতাম।
পক্ষান্তরে এই বিরোধে ইন্ধন যোগাইবার লোকেরও অভাব ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে এই বিরোধে বাতাস করিয়া এক শ একজন এক শ এক উপলক্ষে উহা বাড়াইবার চেষ্টা করি। কিন্তু কেন্দ্রে যিনি এটা করিতেন, তিনি একাই এক শ। ইনি স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্যা। এটা আমি বুঝিলাম যেদিন প্রধানমন্ত্রী আমাকে গোপনে বলিলেন : প্রেসিডেন্ট মির্যা মওলানা ভাসানীকে অবিলম্বে গেরেফতার করিবার জন্য তাঁর উপর খুবই চাপ দিতেছেন। আমি স্তঙ্কিত হইলাম। আমরা মন্ত্রিত্ব করিব, আর আমাদের সভাপতিকে গেরেফতার করিব আমরাই? লিডার আমার ভাব দেখিয়া বলিলেন : বিস্ময়ের কিছু নাই। সিক্রেট ফাইল দেখিলে তুমিও প্রেসিডেন্টের সাথে একমত হইবে। অনেক কথা কাটাকাটি হইল। অবশেষে তিনি আমাকে একটা বিশালফাইল গছাইলেন। বলিলেন : পড়িয়া দেখ।
পড়িয়া দেখিলাম। খুব মনোযোগ দিয়া। কয়েকদিন লাগিল। সিক্রেট ফাইল তা নিজ হাতে আয়রন সেফে রাখিতাম। রাত্রে-রাত্রে পড়িতাম। অন্য কেউ দেখিয়া না ফেলে। প্রধানমন্ত্রী টুওরে বাহিরে গিয়াছিলেন। তিনি ফিরিয়া আসিয়াই জিগ্গাসা করিবেন। পড়িলামও উকিল যেমন করিয়া নথি-পত্ৰ পড়ে প্রতি লাইনে-লাইনে। সবগুলি ফটোস্টেট কপি। হুবহু অরিজিনাল। পাকিস্তান ভারতীয় দূতাবাস হইতে যে সব চিঠি-পত্র দিল্লিতে ভারত সরকারের বৈদেশিক দফতরে লেখা হইয়াছে, তাতে মওলানা ভাসানীর নাম আছে। লেখকের সাথে ভাসানী সাহেবের কোনও এক লোকের মারফত কোনও একটি কথা হইয়াছে। এই বিশাল ফাঁইলের তিন-চারটি পত্রে তিন চার বারের বেশি মওলানা সাহেবের নাম নাই। তবু ঐ বিরাট ফাইলকেই মওলানার বিরুদ্ধে সিক্রেট ফাইল কেন বলা হইল, আমি তা বুঝিতে পরিলাম না। এই না বুঝার দরুন আরও বেশি করিয়া পড়িলাম। ভাবিলাম নিশ্চয়ই কিছু আছে, আমিই বোধ হয় বুঝিতে পারিনাই।
লিডার আসিয়াই জিগ্গাস করিলেন : ‘পড়িয়াছ ত?’ আমি ‘জি হাঁ’ বলিতেই আগ্রহভরে বলিলেন : ‘কি পাইলে?’ বলিলাম : ‘কেন মওলানাকে গেরেফতার করিতে হইবে, তার কোনও কারণ পাইলাম না।‘ প্রধানমন্ত্রী আশ্চর্য হইলেন। বল কি? তবে কি ঐ বিশাল ফাইলটায় কিছু নাই? যা যা আছে, খুঁটিয়া-খুঁটিয়া সব বলিলাম। তাঁর পর মন্তব্য করিলাম : ‘আমারে দিবার আগে আপনে নিজে কি তবে ওটা পড়েন নাই? আপনি পাইলেন, আমি পাইলাম না। তবে কি সার আমারে ভুল ফাইল দিয়া গেলেন?’ প্রধানমন্ত্রী হাসিলেন। ভূল ফাইল দেওয়া হয় নাই। তবে যে প্রেসিডেন্ট বলিলেন, ওটা পড়িলেই সাংঘাতিক সব কথা পাওয়া যাইবে। মওলানাকে আর এক মুহূর্ত জেলের বাইরে রাখা যয় না। প্রধানমন্ত্রী ও আমি একমত হইলাম : ওতে কিছু নাই। শুধু ফাইলের সাইয দিয়াই আমাদেরে কাবু করিবার উদ্দেশ্য ছিল।
৩. সেকান্দরী ফন্দি
লিডার যাই বুঝিয়া থাকুন আমি বুঝিয়াছিলাম, মওলানা ও শহীদ সাহেবের মধ্যে বিরোধ বাধাইবার এটা একটা সেকান্দরী কৌশল। আওয়ামী লীগে ভাংগন আনাই তাঁর উদ্দেশ্য। মির্যা শহীদ সাহেবকে দিয়া মওলানাকে আক্রমণ ক্লাইতে পারিলেন না। কাজেই তিনি মওলানাকে দিয়া শহীদ সাহেবকে আক্রমণ করাইবার আয়োজন করিলেন। কোথা দিয়া কি হইল বোঝা গেল না। হঠাৎ মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে ইস্তফা দিলেন। মওলানা সাহেবের ঘনিষ্ঠ বলিয়া পরিচিত দুই জন আওয়ামী নেতা একজন পূর্ব পাকিস্তানী শিল্পপতি সহ ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করিয়া গিয়াছেন। এইটুকমাত্র শুনিয়াছিলাম। তার সাথে মওলানার পদত্যাগে কোনও সম্পর্ক থাকে কেমন করিয়া? মওলানার পদত্যাগ যে আওয়ামী লীগের জন্য একটা ক্রাইসিস, আগামী নির্বাচনে যে এর ফল আমাদের জন্য বিষময় হইবে, একা আমি যেমন বুঝিলাম প্রধানমন্ত্রীকেও তেমনি বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম। প্রধানমন্ত্রী যেমন বুঝিলেন, মওলানা সাহেবও তেমনি বুঝিলেন অবশ্য বিভিন্ন অর্থে। অন্ততঃ তাঁকে তেমনি বুঝান হইল। তাই তিনি আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনের প্রাক্কালে পদত্যাগ করিলেন। মওলানা সাহেব নিশ্চয়ই আশা করিয়াছিলেন, কাউন্সিল মিটিং–এ তিনি জিতিবেন। কারণ এই সময়ে ছাত্র-তরুণদের বিপুল মেজরিটি মার্কিন-বিরোধী হইয়া উঠিয়াছে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলারদেরও অনেকেই সেই মত পোষণ করেন। কাগমারি সম্মিলনীতে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবের মতের মধ্যে আমরা যে আপোস ফমূলা বাহির করিয়া দিয়াছিলাম, সেটার আর দরকার নাই, মওলানার মনে নিশ্চয় এই ধারণা হইয়াছিল। যে কোনও কারণেই হোক মওলানা সাহেব মনে-মনে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়াই ফেলিয়াছিলেন যে, হয় তিনি সুহরাওয়ার্দী-হীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব করিবেন, নয় ত তিনি আলাদা পার্টি করিবেন। এটা আমি বুঝিতে পারি হাসপাতালে তাঁর সাথে আলাপ করিয়া। প্রথমতঃ তিনি পদত্যাগের ঘোষণাটি করিয়াছিলেন অস্বাভাবিক নযিরবিহীন গোপনীয়তার সাথে। সহ-কর্মীদের সাথে রাগ করিয়া পদত্যাগ করিলে মানুষ স্বভাবতঃ তাঁদেরে জানাইয়া পদত্যাগ করেন। এ ক্ষেত্রে মওলানা সাহেব প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান ও জেনারেল সেক্রেটারি মুজিবুর রহমানের সাথে এবং কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ সাহেবের সাথে বিরোধের জন্য পদত্যাগ করিয়াছেন, এটা ধরিয়া নেওয়া যাইতে পারে। স্বাভাবিক অবস্থায় তিনি তাঁর পদত্যাগপত্র সেক্রেটারি মুজিবুর রহমানের কাছে পাঠাইয়া দিতেন। মুজিবুর রহমান আতাউর রহমানকে এবং শেষ পর্যন্ত শহীদ সাহেবকে জানাইতেন। আওয়ামী লীগ মহলে হৈ চৈ পড়িয়া যাইত। আমরা সকলে ধরাধরি করিয়া তাঁকে পদত্যাগে বিরত করিতাম। এইটাই মওলানা এড়াইতে চাহিয়াছিলেন। সেইজন্য তিনি বিশ্বস্ত অনুগত মিঃ অলি আহাদকে নির্বাচন করেন। পদত্যাগপত্রটি আতাউর রহমান-মুজিবুর রহমান কাউকে না দেখাইয়া বামপন্থী খবরের কাগযে পৌঁছাইয়া দিবার ওয়াদা করাইয়া তিনি উহা মিঃ অলি আহাদের হাতে দেন। মিঃ অলি আহাদ সরল বিশ্বস্ততার সাথে অক্ষরে-অক্ষরে তা পালন করেন। এ কাজে তিনি মওলানা সাহেবের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য দেখাইয়া থাকিলেও প্রাতিষ্ঠানিক আনুগত্য ভংগ করিয়াছেন, এই অপরাধে মিঃ অলি আহাদকে সাসপেন্ড করা হয়। প্রতিবাদে ৯ জন ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বার পদত্যাগ করেন।
এমনি ক্রাইসিস মুখে লইয়া আওয়ামী লীগের কাউন্সিল বৈঠক হয় প্রধানতঃ মওলানা সাহেবের ইচ্ছামত। তার আগে-আগে প্রসারিত ওয়ার্কিং কমিটি ও পার্লামেন্টারি পার্টির যুক্ত বৈঠক দেওয়া হয়। মওলানা সাহেব তখন হাসপাতালে। আমিও। উভয়ে প্রায় সামনা-সামনি কেবিনে থাকি। প্রধানতঃ আমারই প্রস্তাবে মওলানা সাহেবকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ করিয়া সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। কখনো আমি ও মুজিবুর রহমান একত্রে কখনও আমি একা মওলানা সহেবকে ইস্তফা প্রত্যাহারের অনুরোধ-উপরোধ করি। পদত্যাগী ওয়ার্কিং কমিটি মেম্বরদের এবং মিঃ অলি আহাদ সম্পর্কে মওলানার ইচ্ছামত কাজ হইবে, এ আশ্বাসও আমরা দেই। কিন্তু মওলানা অটল। যা হয় কাউন্সিল মিটিং-এ হইবে, এই তাঁর শেষ কথা। কাউন্সিল মিটিং-এ তিনি জয়লাভ করিবেন, এটা তিনি আশা করিলেও নিশ্চিত ছিলেন না। সেই জন্য আগেই তিনি মিয়া ইফতিখারুদ্দিন ও জি. এম. সৈয়দ প্রভৃতি পশ্চিম পাকিস্তানী বামপন্থী নেতৃবৃন্দ ও শহিদ সাহেব কর্তৃক বিতাড়িত সাবেক আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি মিঃ মাহমুদুল হক ওসমানীর সাথে গোপন পরামর্শ করিতে থাকেন। এটা আমি জানিতে পারি হাসপাতালের লোকজনের কাছে। ডাক্তারের পরামর্শে আমি রোজ বিকালে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টের দিকে বেড়াইতে যাইতাম। সেখানে ঘন্টাখানেক ভোলা ময়দানে হাওয়া খাইতাম। একদিন হাসপাতালে ফিরিয়া আসিয়া শুনিলাম, ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা বদ্ধ দরজায় মওলানা সাহেবের সাথে পরামর্শ করিয়া গিয়াছেন। এটা চলে পর-পর কয়দিন। কাউন্সিল মিটিং-এ ভাসানী সাহেব হারিয়া যান। তবু কাউন্সিল মওলানাকে ইস্তাফা প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। মওলানা তদুত্তরে ন্যাপ গঠন করেন। ন্যাপ গঠনে প্রেসিডেন্ট মির্যার হাত ছিল এতে আমার কোনও সন্দেহ নাই। প্রধানতঃ তাঁরই চেষ্টায় করাচির শিল্পপতি এ কাজে অর্থ-সাহায্য করিয়াছিলেন। অথচ এই সময়েই প্রেসিডেন্ট মির্যা নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার প্রতিনিধিকে বলেন : প্রধানমন্ত্রী সুহরাওয়ার্দী ও আমি এক সংগে থাকিব। তাঁরমত যোগ্য লোক পাকিস্তানে আর হয় নাই। মির্যার ঐ উত্তির মধ্যে সবটুকু ভন্ডামি ছিল না। কিছুটা আন্তরিকতা ছিল। তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বিশেষতঃ ভাসানীর প্রভাবমুক্ত সুহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী রাখিতে সত্য-সত্যই উদগ্রীব ছিলেন বলিয়া আমার ধারণা হইয়াছিল। শেষ পর্যন্ত ওটা সম্ভব না হওয়ায় তিনি সুহরাওয়ার্দী-বিরোধী হইয়া পড়েন। সে কথা যথাস্থানে বলিব।
ঢাকা হইতে ফিরিয়াই কয়েকদিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মধ্যপ্রাচ্য ইংলন্ড ও আমেরিকা ভ্রমণে প্রায় দুই মাসের জন্য সফরে বাহির হন। বরাবরের মত আমাকেই অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীত্ব দিয়া যান। এই সময়কার দুই-তিনটি ঘটনা আমার বেশ মনে আছে।
৪. ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট
একটি ঘটে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট লইয়া। এটি ছিল ঢাকায়। পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ার জনাব আবদুল জব্বার ইহার সেক্রেটারী। কার্যতঃ তিনিই ইহার প্রতিষ্ঠাতা। শিল্পমন্ত্রী হিসাবে আমার এলাকাধীন এটা। আমি মন্ত্রী হওয়ার পর হইতেই জব্বার সাহেব আমার কাছে নালিশ করিতেছিলেন, পাকিস্তান সরকার বহু বছর ধরিয়া নিতান্ত অযৌক্তিকভাবে ইন্সটিটিউটের মযুরি ঠেকাইয়া রাখিয়াছেন। আমাকে এটার প্রতিকার করিতেই হহইবে। আমি ফাইল তলব করিয়া দেখিলাম বিরাট ব্যাপার। সব দফতর হইতেই ইন্সটিটিউটের রিকগনিশনের বিরোধিতা করা হইয়াছে। ইন্সটিটিউটের পরম হিতৈষী পশ্চিম পাকিস্তানী একজন তরুণ ইঞ্জিনিয়ার মিঃ আফর। তিনি এবং ইন্সটিটিউটের তৎকালীন চেয়ারম্যান পাকিস্তানের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার মিঃ মোহসিন আলী আমাকে ব্যাপারটা বুঝাইলেন। আমি বিস্মিত ও লজ্জিত হইলাম। এই ইন্সটিটিউট ভারত সরকার ও বৃটিশ সরকার কর্তৃক রিকগনাইযড। অপর দিকে দিল্লির ও লন্ডনের এই একই প্রকারের ইন্সটিটিউটও পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রিকগনাইযড। কিন্তু বিদেশ কর্তৃক স্বীকৃত নিজের দেশের এই ইন্সটিটিউট পাকিস্তান সরকার স্বীকার করেন না। অদ্ভুত না? জব্বার সাহেব বলিলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানী উক্ত দুইজন ইঞ্জিনিয়ার সমর্থন করিলেন যে, যদি উহার হেড় অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করা হয়, তবে উহার মযুরি পাইতে এক মুহূর্ত দেরি হইবে না।
আমি সমস্ত নথি পড়িয়া-শুনিয়া এবং সকল দিক বিবেচনা করিয়া লম্বা নোট লিখিলাম। তাতে ইন্সটিটিউট মনযুরির সুপারিশ করিয়া প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠাইলাম। নিয়ম মোতাবেক এ সম্পর্কে চূড়ান্ত আদেশ দিবার মালিক প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ফাইল দেখিয়াই ধরিয়া লইলেন এটা আমার পূর্ব-বাংলা-প্রীতির আরেকটা ব্যাপার। তিনি হাসিয়া বলিলেন : এটাও একুশ দফায় ছিল নাকি তাঁর হাসির জবাবে না হাসিয়া উত্তেজিত কণ্ঠে এ ব্যাপারে অবিচার ও আঞ্চলিক সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে প্রবল যুক্তি দিতে লাগিলাম। তিনি হাতের ইশারায় আমাকে থামাইয়া বলিলেন : ‘উত্তেজিত হইবার কিছু নাই। ধীরে-সুস্থে ভাবিবার অনেক আছে। আগুন যা জ্বালাইয়াছ, তাই আগে নিভাইতে দাও। আর নতুন করিয়া আগলাগাইও না।
আঞ্চলিক সংকীর্ণতার জন্যই এটা মনযুরি পাইতেছে না প্রধানমন্ত্রীর কথায় সে বিশ্বাস আমার আরও দৃঢ় হইল। আমি আমার যুক্তির পুনরাবৃত্তি করিতে লাগিলাম। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী বলিলেন : ‘দেখিতেছ না, সব দফতর হইতে মনযুরির বিরুদ্ধে সুপারিশ করা হইয়াছে?’ আমি জোর দিয়া বলিলাম : ‘সব দফতরের যুক্তি আমার নোটে খন্ডন করিয়াছি।‘ তিনি আবার তাঁর মুরুব্বিয়ানার হাসি হাসিয়া বলিলেন : ‘তুমি ভাবিতেছ খন্ডন করিয়াছ। আমি মনে করি কিছু হয় নাই। ভাল ইংরাজী লিখিলেই ভাল অর্ডার হয় না।‘
এই কথা.বলিয়া ফাইলটা এমনভাবে সরাইয়া রাখিলেন যে আমি বুঝিলাম এ ব্যাপারে আজ আর কথা বলা চলিবে না। এমনি ভাবে তিনি যে ফাইলটা নিজের দফতরে চাপা দিলেন, আমার শত তাগাদায়ও তিনি ঐ ব্যাপারে কিছু করিলেন না। এদিকে ঢাকা হইতে রিমাইন্ডার ও করাচি হইতে মিঃ যাফরের তাগাদা আমাকে অস্থির করিয়া ফেলিল। আমি একটা রিস্ক নিলাম। এর পরে এ্যাকটিং প্রধানমন্ত্রী হইয়াই আমি ঐ ফাইল তলব করিলাম এবং শিল্প-মন্ত্রী হিসাবে আমার নোটটার নিচে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আমি অনুমোদিত লিখিয়া দিলাম। পরে করাচিতেই ইন্সটিটিউটের উদ্বোধনী উৎসব হইয়াছিল প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফর হইতে ফিরিয়া আসিবার পর। ওঁরা আমাকেই উৎসবের প্রধান অতিথি করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু আমি বহুৎ অনুরোধ-উপরোধ করিয়া প্রধানন্ত্রীকে প্রধান অতিথি হইতে রাযী করিয়াছিলাম। তাঁর অমতে এ কাজ করিয়াছিলাম বলিয়া প্রধানমন্ত্রী আমাকে কোনদিন তিরস্কার করেন নাই।
৫. ওয়াহ কারখানা পরিদর্শন
আরেকটি ঘটনা আমার ওয়াহ অস্ত্রকারখানা পরিদর্শন। এটিই পাকিস্তানের প্রধান। অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি। আমার শখ হইল আমাদের জাতীয় অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিটি দেখিব। তদনুসারে টুণ্ডর প্রোগ্রাম প্রচারিত হইল। তৎকালীন ডিরেক্টর (বোধ হয় জেনারেল আযম খাঁ) আমাকে পিন্ডি হইতে আগাইয়া নিয়া যান। আমার অভ্যর্থনার বিপুল আয়োজন হইয়াছিল। হরেক বিভাগে আমার অভ্যর্থনার পৃথক-পৃথক ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। অভ্যর্থনা মানে অভিনন্দন-পত্র পাঠ ও বক্তৃতা নয়। সব মিলিটারি ব্যবস্থা। বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহারের নুমায়েশ। ফুলদল দিয়া কামান-বন্দুক সাজাইয়া রাখা হইয়াছে। আমি ট্রিগার টিপলাম। আওয়ায হইল। টার্গেট সই অর্থাৎ চানমারি হইল। আমার কোনও কৃতিত্ব ছিল না। ঠিকমত সই করিয়া বসাইয়া রাখা ইয়াছিল। এসব উৎসব শেষ করিয়া আমি বিভিন্ন গোলা-বারুদ, মানে এমিউনিশন, তৈয়ার দেখিলাম। এলাহি কারখানা। উৎসাহিত, আশান্বিত ও গৌরবান্বিত হইলাম। দেশ রক্ষার সব অস্ত্র-শস্ত্রই আমাদের নিজস্ব কারখানায় তৈয়ার হয়। তবে আর চিন্তা কি? ভয় কিসের? চার ঘন্টার মত পরিদর্শন করিলাম। মাঝখানে মধ্যাহ্ন ভোজনের আয়োজন করা হইয়াছিল ফ্যাক্টরির মধ্যেই। আমি যখন ফ্যাক্টরিতে বিভিন্ন জিনিস গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করি, সেই সময় দুই-একজন শ্রমিক আমার নিতান্ত কাছ ঘেষিয়া বাংলায় কথা বলিতে শুরু করেন। আমার কৌতূহল হয়। তাঁদের দিকে ফিরি। আমার চোখে বোধ হয় তাঁরা সহানুভূতি দেখিতে পান। নিজেদের অভাব-অভিযোগের কথা বলিতে শুরু করেন। এটা বোধ হয় ডিসিপ্লিন অথবা, মন্ত্রীর মর্যাদার খেলাফ। তাই উপরস্থ অফিসাররা তাঁদেরে ধমক দিয়া সরাইয়া দেন। কিন্তু পিছে পিছে তাঁরা ঘুরিতেই থাকেন। সুযোগ পাইলেই চুপে-চুপে দুই একটি কথা বলিয়াও ফেলেন।
কিন্তু কারখানায় বিরাটত্বে ও প্রডাকশনের বিপুলতায় আমি এমনি মুগ্ধ হইয়াছিলাম যে তাঁদের অভিযোগের দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারিলাম না। অফিসারদের সাথে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ আলাপ শুরু করিলাম। তাঁদের কৃতিত্বে আমার অফুরন্ত আনন্দ ও বুক-রা গৌরবের কথা উপযুক্ত ভাষায় প্রকাশ করিয়া অবশেষে বলিলাম : বলুন ত আমাদের কোন বস্তুর দৈনিক বা মাসিক বা বাৎসরিক তৈয়ারির পরিমাণ কত? আমার ভাবখানা এই যে তাঁরা বলিবেন আমি আমার নোটবই এ লিখিয়া নিব। পকেটে হাত দিলাম নোটবুকের তালাশে।
অফিসাররা খানিক এ-ওঁর দিকে চাহিলেন। তারপর ডিরেক্টর সাহেব বলিলেন : ‘মাফ করিবেন সার, আমরা বলিতে পারিব না। আমি বিস্মিত হইলাম। বলিলাম : তার অর্থ বলিতে পারিবেন না? না বলিবেন না?
সরলভাবে তিনি বলিলেন : ‘বলিতে মানা আছে এসব টপ-সিক্রেট।‘ আমি আরও তাজ্জব হইলাম। বলিলাম : ‘বলেন কি আপনেরা? আপনাদের প্রধানমন্ত্রী ও দেশরক্ষা মন্ত্রী হিসাবেও আমি জানিতে পারিব না আমাদের কত তৈয়ার হয়? তবে আমরা কি করিয়া জানিব আমাদের দরকার কত? কতই বা আমাদের আমদানি করিতে হইবে?’
আমার সব কথাই সত্য। তবে এসব ব্যাপার জানিতে হইলে প্রপার চ্যানেলে আসিতে হয়। আমি ডিফেন্স সেক্রেটারি, প্রধান সেনাপতি, এমন কি প্রেসিডেন্টের মারফত সবই জানিতে পারিব। ওঁরা জানিতে না চাওয়া পর্যন্ত প্রপার চ্যানেল হইবে না। ঐ চ্যানেলে অর্ডার না আসা পর্যন্ত কারখানার অফিসারগণ কারও কাছে কিছু বলিতে পারেন না।
আমি শুধু খুশী হইলাম না। গর্ব বোধও করিলাম। কি চমৎকার ডিসিপ্লিন। এ না হইলে আর দেশরক্ষা দফতরের কাজ হয়? সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়া বিদায় হইলাম।
৬. প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা
করাচি ফিরিয়াই ডিফেন্স-সেক্রেটারি মিঃ আখতার হুসেনকে ধরিলাম। তিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন। আমি বলিলাম আমার উদ্দেশ্যের কথা। তিনি বলিলেন : ‘বরঞ্চ প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞাসা করুন।‘ করিলাম প্রেসিডেন্টকে জিগগাস। তিনি প্রথমে তর্ক করিলেন, এসব খবরে প্রেসিডেন্ট বা মন্ত্রীদের দরকার কি? প্রধান সেনাপতিই যথেষ্ট। আমি তর্ক করিলাম। প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম কমাণ্ডার। তাঁর সব ব্যাপার জানা দরকার। প্রধানমন্ত্রী ও দেশরক্ষা মন্ত্রীরও অবশ্যই জানিতে হইবে। নইলে প্রস্তুতি হইবে। কিরূপে? আমি বিলাতের নযির দিলাম। প্রেসিডেন্ট শেষ পর্যন্ত স্বীকার করিলেন, তিনি কিচ্ছু জানেন না। প্রধান সেনাপতির সহিত যোগাযোগ করিতে তিনি আমাকে উপদেশ দিলেন। প্রধান সেনাপতি এই সময় হয় বিলাতে বা আমেরিকায় ছিলেন। আমি ডিফেন্স সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিলাম, প্রধান সেনাপতি ফিরিয়া আসা মাত্র বিহিত ব্যবস্থা যেন তিনি করেন।
কোনো ‘বিহিত ব্যবস্থা’ হইল না। অথবা বিহিত ব্যবস্থাই বোধ হয় হইল। আমাকে কিছু জানান হইল না। প্রধানমন্ত্রী ফিরিয়া আসা মাত্র আমি তাঁর কাছে নালিশ। করিব, স্থির করিয়া রাখিলাম।
নালিশ আর আমার করিতে হইল না। প্রধানমন্ত্রী ফিরিয়া আসার পর আমার সহিত প্রথম একক সাক্ষাতেই তিনি বলিলেন : এ সব কি শুনিলাম? তুমি দেশরক্ষার গোপন-তথ্য সম্বন্ধে অত কৌতূহলী কেন?
আমি স্তম্ভিত হইলাম। কি গুরুতর অন্যায় করিয়া ফেলিয়াছি। প্রধানমন্ত্রীকে সব খুলিয়া বলিলাম। দেখিলাম, অনেক কথাই তিনি জানেন। সব শুনিয়া এবং আমার উদ্দেশ্য ও যুক্তির বিবরণ শুনিয়া অবশেষে বলিলেন : তোমাকে এরা কত সন্দেহের চোখে দেখেন তা কি তুমি জান না? তুমি একুশ দফার রচয়িতা। তুমি সাবেক কংগ্রেসী। ভারতের অনেক নেতার তুমি বন্ধু।
আমি প্রতিবাদ করিয়াও অবশেষে তাঁর যুক্তি মানিয়া নিলাম। বলিলাম : ‘বেশ, আমার বেলা তাঁদের সন্দেহ আছে। কিন্তু আপনে? আপনে কি এসব ব্যাপার জানেন? আপনে শাসন-সৌকর্য হইতে শুরু করিয়া অর্থনীতির পোকা-মাকড় পর্যন্ত মারিতে দক্ষ। প্রধানমন্ত্রী ও দেশরক্ষা মন্ত্রী হিসাবে প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থার আপনে কতটুকু জানিয়াছেন?’ আমার কথাগুলি ফেলিয়া দিবার মত নয়। তিনি স্বীকার করিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মির্যার মতই তিনি যুক্তি দিতে লাগিলেন, দেশরক্ষাব্যবস্থা ছাড়াও মন্ত্রীদের অতসব কর্তব্য পড়িয়া রহিয়াছে যে ঐ সব কাজ করিয়া মন্ত্রীদের অবসর থাকা সম্ভবও নয়, উচিৎও নয়। বোঝা গেল, তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। মানে, আসল কথা জানেন। অর্থাৎ এ ব্যাপারে যে কিছু জানা উচিৎ নয়, এটা জানেন। তাই জিগ্গাসা করাও তিনি বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেন না।
আমার বাঘা প্রধানমন্ত্রী ও দেশরক্ষা মন্ত্রী সুহরাওয়ার্দীরই এই অবস্থা। আর-আর প্রধানমন্ত্রীদের কি ক্ষমতা ছিল, তা অনুমান করিলাম। বুঝিলাম, নামে-মাত্র পার্লামেন্টারি সরকার চলিতেছে দেশে। কিন্তু দেশরক্ষা দফতরে মন্ত্রীদের বা মন্ত্রিসভার বা আইন-পরিষদের কোনও ক্ষমতা নাই। সেখানে সামরিক কর্তৃত্ব চলিতেছে। লিডার যা বলিলেন, তার চেয়েও তিনি বেশি জানেন। আমরা যে কত অক্ষম, অসহায়, বোধ হয় তিনি আমার চেয়েও বেশি উপলব্ধি করেন। তিনি যে দুই-একবার প্রকাশ্যভাবে এবং অনেকবার আমদের কাছে বৈঠকে মার্শাল লর ডর দেখাইয়াছেন, তার কারণ নিশ্চয়ই আছে।
৭. পশ্চিম পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা
তৃতীয় ঘটনা পশ্চিম পাকিস্তানে পার্লামেন্টারি সরকার পুনর্বহাল। ডাঃ খান সাহেবের প্রধানমন্ত্রিত্বে লাহোরে রিপাবলিকানমন্ত্রিসভা চলিতেছিল। ডাঃ সাহেবের মেজরিটি বিপন্ন হওয়ায় সেখানে গবর্নর-শাসন প্রবর্তিত হয় ১৯৫৭ সালের এপ্রিল মাসে। তিন মাস চলিয়া যাইতেছে। রিপাবলিকানরা দাবি করিতেছেন, তাঁদের নিরংকুশ মেজরিটি হইয়াছে। তবু প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভা গঠনের অনুমতি দিতেছেন না। রিপাবলিকান পার্টির জোরে আমরা কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব করি। অথচ প্রদেশে সেই রিপাবলিকান পার্টির মন্ত্রিসভা হইতে দিতেছি না, এটা কত বড় অন্যায়, অপমানকর? দিন-রাত রিপলিকান নেতারা প্রধানমন্ত্রীকে তাগাদার উপর তাগাদা করিতেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী অনড়। শেষ পর্যন্ত কোনও কোনও রিপলিকান নেতা অভিযোগ করিতে লাগিলেন যে দৌলতানাগুরমানী-নেতৃত্বে মুসলিম লীগের সাথে শহীদ সাহেব একটা গোপন আঁতাত করিয়াছেন যার ফলে তিনি শেষ পর্যন্ত লাহারে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা কায়েম করিলে। এর পরিণামে শহীদ সাহেব শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রেও রিপালিকানের বদলে মুসলিম লীগের সাথে কোয়েলিশন করিবেন। শুধু রিপালিকান-নেতারা নন, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট মির্যাও আমাকে এ ধরনের কথা বলিয়াছেন অবশ্য রিপাবলিকানদের কথা হিসাবে।
আমি ওঁদের অভিযোগ ও সন্দেহে বিশ্বাস করিতাম না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ কাজ সমর্থনও করিতাম না। কেন তিনি আমাদের কোয়েলিশনী বন্ধুদের সাথে প্রাদেশিক রাজনীতিতে এই দুর্ব্যবহার করিতেছেন, তার কোনও কারণ পাইতাম না। লিডারকে জিগ্গাস করিলে তিনি ধমক দিতেনঃ পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতি তুমি কিছু জান না। এ ব্যাপারে কথা বলিও না।
কিন্তু তবু আমি বলিলাম। প্রেসিডেন্ট মির্যার কথা তুলিলে তিনি হাসিয়া বলিলেন : ‘প্রেসিডেন্ট ইয অল রাইট।‘ এর সমর্থনে তিনি আভাসে-ইংগিতে এমন দুচারটা কথা বলিলেন যা হইতে আমি বুঝিলাম মির্যা একদিকে রিপাবলিকানদেরে মন্ত্রিসভার দাবিতে উস্কানি দিতেছেন, অপরদিকে প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিতেছেন। রিপাবলিকানদের দাবি না মানিতে। দস্তুরমত ‘চোরকে চুরি করিতে এবং গিরস্তকে সজাগ থাকিতে বলার দৃষ্টান্ত আর কি! আমার সন্দেহের কথা প্রকাশ করা মাত্র লিডার কথাটাকে মাটিতে পড়িতে দিলেন না। এমন ধমক দিলেন যেন আমি কোন সাধু আউলিয়া-দরবেশের চরিত্রে সন্দেহ করিয়াছি। ফলে প্রধানমন্ত্রী কিছু করিলেন না। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি রিপাবলিকান-অসন্তোষ বাড়িয়াই চলিল।
এমন সময় তিনি লম্বা সফরে বিদেশে গেলেন। আমি তাঁর স্থলবর্তী হওয়া মাত্র রিপাবলিকানরা আমার উপর ঝাপাইয়া পড়িলেন। ওঁদের সবাই আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু হইলেও সৈয়দ আমজাদ আলীর উপদেশের প্রতিই আমি অধিকতর গুরুত্ব দিতাম। তিনিও আমাকে পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। শুধু অনুরোধ-উপরোধ নয়। রিপাবলিকানরা একটা কাজের কাজও করিলেন মুসলিম লীগ যখন কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব করিতেছিল, সেই সময় ১৯৫৫ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা গঠনে কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও আওয়ামী লীগের পরস্পর-বিরোধী দাবির মীমাংসার জন্য গবর্নরের সামনে ফিফিক্যাল ডিমনস্ট্রেশন করার (মেম্বর হাযির করার আদেশ দেওয়া হইয়াছিল। আমার মনে হয় যেন তারই জবাবে শহীদ সাহেব কিছুদিন আগে গবর্নর ওরমানীকে আদেশ দিয়াছিলেন, উভয় দলের শক্তির ফিষিক্যাল ডিমনস্ট্রেশন নিতে। সুহরাওয়ার্দী সাহেব বিদেশ সফরে যাওয়ার কিছুদিন পরে লাহোরে তাই হইল। সে ডিমনস্ট্রেশনে রিপাবলিকান পার্টি জয় লাভ করিল। কিন্তু এই ধরনের প্রক্লেমেশন বা তার রিভোকেশনে গভর্ণরের ‘রিপোর্ট’ দরকারশাসনতন্ত্রের বিধান অনুসারে। গুরমানী সাহেব কি রিপোর্ট দেন, তা দেখিবার জন্য সকলেই উৎকর্ণ হইয়া আছেন। রিপাবলিকান বন্ধুদের তাগাদার জবাবে আমি দুই-একবার বলিয়াছি : ‘আপনারা প্রেসিডেন্টকে দিয়া বলান না কেন?
প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন আমাদের গ্রীবাস নাধিয়াগলিতে। প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতির মধ্যে কথাবার্তার জন্য সেক্রোফোনের ব্যবস্থা থাকে। আমি অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হইলেই এই যন্ত্রটা আমার শোবার ঘরে পাতা হইত। সেক্রোফোনের ব্যবস্থা। গোপনীয় কথা আদান-প্রদানের জন্য। সাধারণ টেলিফোনের মত এটা ট্যাপ করা যায় না অর্থাৎ অন্য কেউ হাযার যন্ত্র লাগাইয়াও এর কথা বুঝিতে পারিবে না। কারণ ট্রান্সমিটিং বাক্সে কথাগুলি বলিলেই এলোমেলো হিজিবিজি হইয়া যায়। ঐ এলোমলো অবস্থাতে গিয়া রিসিভিং বাক্সে পড়ে। সেখানে গিয়া যেমনকার কথা তেমনি হইয়া যায়। বলা বাহুল্য এই পরিবর্তন এমন পলকে হয় যে আলাপের দুই পক্ষ সেটা বুঝিতেই পারেন না।
এবারও এই যন্ত্র আমার শোবার ঘরে পাতা হইয়াছিল। প্রেসিডেন্ট মির্যা কখনও এই সেক্রোফোনের মাধ্যমে, কখনও সাধারণ ট্রাংক কলে, আমার সাথে কথা বলিতেন। প্রায়ই বলিতেন। দিনে তিনবারও বলিতেন কোনও দিন। কোনও সংগত। কারণ নাই। হঠাৎ একদিন আমার মনে হইল প্রেসিডেন্ট সেক্রোফোনে যে সুরে কথা বলেন, সাধারণ ট্রাংক কলের কথায় যেন ঠিক সেই সুর থাকে না। সন্দেহ হওয়ায় আরও একটু মন দিয়া বিচার করিতে লাগিলাম। আমার সন্দেহ বেশ দৃঢ় হইল যে যখন ট্রাংক কলে কথা বলেন, তখন তিনি আমাকে খুব জোর দিয়া ধমকের সুরে বলেন : তুমি অনতিবিলম্বে লাহোরে রিপাবলিকান মন্ত্রিসভার হকুম দিয়া দাও। তাঁরা পরিস্কার মেজরিটি। তাঁদেরে মন্ত্রিসভা না দিলে কেন্দ্রে যদি তাঁরা তোমাদের বিরুদ্ধে যান, তবে আমাকে দোষ দিতে পারিবানা। ইত্যাদি ইত্যাদি। সবকলেই মোটামুটি এই ভাব।
কিন্তু সেক্রোফোনে যখন কথা বলেন, তখন তিনি নরম সুরে বলেন : তা ত বটেই, সবদিক দেখিয়া-শুনিয়াই ত তোমার কাজ করিতে হইবে। প্রধানমন্ত্রীর অবর্তমানে যা-তা একটা করাও ত তোমার উচিৎ না। হাঁ, সব দেখিয়া-শুনিয়া তুমি যা ভাল বুঝ তাই কর। সম্ভব হইলে রিপাবলিকান পার্টির দাবিটা বিচার করি। ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার সন্দেহ আরও দৃঢ় হইল। মির্যা আমার সাথেও সেই ‘চোর-গিরস্তের’ নীতি অবলম্বন করিয়াছেন। তিনি আসলে চান না যে আমি রিপাবলিকান মন্ত্রিসভা গঠনের হুকুম দেই। আমি মোটামুটি ঠিক করিয়া ফেলিলাম, গভর্নর গুরমানী যদি অনুকুল রিপোর্ট দেন, তবে আমি রিপাবলিকান মন্ত্রিসভার হুকুম দিয়া দিব। ভাবিতে-ভাবিতে গবর্নরের রিপোর্ট লইয়া স্পেশাল মেসেঞ্জার আসিয়া পড়িলেন। পড়িয়া দেখিলাম গবর্নর রিপাবলিকান পার্টির মেজরিটি দেখাইয়াছেন এবং ১৯৩ ধারা প্রত্যাহারের সুপারিশ করিয়াছেন। আমি কর্তব্য ঠিক করিয়া ফেলিলাম। কিন্তু যাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব তাঁকে জানান দরকার মনে করিলাম। আমি ওয়াশিংটনে টেলিফোন করিলাম। কোনও দিন ত এসব বড় কাজ করি নাই। একেবারে বিস্মিত হইলাম। আমার কল গেল আমাদের আর্মি হেড কোয়ার্টার পিণ্ডিতে। সেখান হইতে গেল লণ্ডনের আর্মি হেড কোয়ার্টারে। তাঁরা পাঠাইলেন ডিপ্লোমেটিক চ্যানেলে। নিউইয়র্ক বলিল ওয়াশিংটন, ওয়াশিংটন বলিল ফ্লোরিকা, ফ্লোরিডা বলিল সানফ্রানসিসকো। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে পাওয়া গেল কার্যালয়। কারণ আমি ছাড়িলাম না। প্রতিবারই আমি বলিলাম, প্রধানমন্ত্রীকে আমার চাইই। রাষ্ট্রীয় ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর গলা শুনিয়া ধরে জান আসিল। কিন্তু তাঁর ধমকে গলা শুকাইয়া গেল। আমি রিপাবলিকান মেজরিটি, গবর্নরের রিপোর্ট ও আমার মত সবই বলিলাম। তিনি সব শুনিয়া বলিলেন : ‘আমার ফিরিয়া না আসা পর্যন্ত স্থগিত রাখ। আমি জোরের সংগে বলিলাম : ‘এ অবস্থায় আর স্থগিত রাখিতে পারি না।‘ তিনি বলিলেন : ‘রাখিতেই হইবে।‘ আমি বলিলাম : ‘আমি ন্যায়তঃ ও আইনতঃ এটা করিতে বাধ্য।‘ তিনি বোধ হয় চারবার ‘না’ ‘না’ ‘না’ ‘না’ বলিয়া টেলিফোন ছাড়িয়া দিলেন। আমি খটখটাইলাম। লোহালো করিলাম। লণ্ডনের এক্সচেঞ্জ আমাকে জানাইলেন, প্রধানমন্ত্রী ফোন ছাড়িয়া দিয়াছেন।
বড়ই বিপদে পড়িলাম। জিগ্গাস না করিতাম তবে সেটা ছিল আলাদা কথা। এখন তাঁর মত জিগ্গাস করিয়া তাঁর ‘না’ পাইয়া কেমনে তাঁর কথা লংঘন করি? উভয় সংকটে পড়িলাম। আইনতঃ ও ন্যায়তঃ আমি গবর্নরের রিপোর্ট মোতাবেক কাজ করিতে বাধ্য। রিপাবলিকান বন্ধুরা লিডারের হুকুম ও আমার উপদেশ মতই ‘ফিফিক্যাল ডিমনস্ট্রেশন’ করিয়াছেন। যে গবর্নরের দিকে চাহিয়া লিডার এতদিন রিপাবলিকান পার্টিকে ঠেকাইয়া রাখিয়াছেন বলিয়া বন্ধুদের অভিযোগ সেই গবর্নরই যখন নিজ হাতে সুপারিশ করিয়াছেন, তখন লিডারের আর কি করণীয় রহিল? আমি নিজের রাজনৈতিক সহকর্মী আতাউর রহমান ও মুজিবুর রহমানের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করিলাম। লিডারের আপনজন ও হিতৈষী মেয়ে ও জামাই মিসেস আখতার সোলেমান ও মিঃ সোলেমানের মত সামনা সামনি জিগ্গাস করিলাম। সকলে মত দিলেন। বিশেষতঃ মিসেস ও মিস্টার সোলেমানকে প্রেসিডেন্টের ভাবগতিকটার কথাও বলিলাম। তাঁরা আমার সন্দেহে সম্পূর্ণ একমত হইলেন।
আমি অসুস্থতার দরুন নিজের বাসায় কেবিনেট মিটিং ডাকিয়া সিদ্ধান্ত নিলাম। রিপাবলিকান বন্ধুরা স্পষ্টতঃই উল্লসিত হইলেন। কারণ প্রধানমন্ত্রীর নিষেধের কথা তাঁরা কেমনে যেন জানিয়া ফেলিয়াছিলেন।
লিডারের নিষেধের মুখে আমার এই সাহস হইবে, এটা তাঁদের বিশ্বাস হয় নাই। মিটিং শেষে তাঁরা আমাকে জড়াজড়ি করিতে এমনকি পশ্চিমী কায়দায় আমাকে চুমা দিতে লাগিলেন। সৈয়দ আমজাদ আলী উল্লাসে বলিয়া ফেলিলেনঃ “ইউ আর টুডে দি টলেস্ট ম্যান ইন পাকিস্তান।
আমাকে আগেই জানান হইয়াছিল যে ডাক্তার খান সাহেবের বদলে সর্দার আবদুর রশিদকে পার্টি-লিডার করা হইয়াছে। কাজেই যথাসময়ে লাহোরে সর্দার আবদুর রশিদের প্রধানমন্ত্রিত্বে রিপাবলিকান মন্ত্রিসভা গঠিত হইয়া গেল।
আমি ধরিয়াই নিয়াছিলাম, লিডার আমার উপর রাগ করিয়াছেন। দেশে ফিরিয়া তিনি আমাকে ধমকাইবেন। কিন্তু কিছুই তিনি বলিলেন না। বিমানবন্দরে তিনি আমাকে তাঁর গাড়িতে তুলিয়া নিলেন। ধরিয়া নিলাম, গাড়িতেই বকা দিবেন। কিন্তু কিছু না। স্বাভাবিকভাবেই সব হালহকিকত পুছ করিতে লাগিলেন। যেটা ভয় করিতেছিলাম, আভাসে-ইংগিতেও আর সেদিকে গেলেন না। আমার বুকের বোঝা নামিয়া গেল। পরে মিঃ সোলেমান একদিন বলিয়াছিলেন, লণ্ডনেই তিনি শশুরকে সব ব্যাপার বলিয়াছিলেন : সব শুনিয়া প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছিলেন : আমি জানিতাম আবুল মনসুর ঠিক কাজই করিবে। লিডারের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা আরো নুইয়া পড়িল।
৮. সমাজতন্ত্রী দেশে বাণিজ্য মিশন
বাণিজ্যমন্ত্রী হইবার কয়েকদিন পরেই আমি ঘোষণা করিয়াছিলাম। আমাদের বাণিজ্য-নীতি রাজনৈতিক সীমা ডিংগাইয়া যাইবে। ‘আওয়ার ট্রেড-পলিসি উইল ট্রানস্যাণ্ড পলিটিক্যাল বাউণ্ডারিয’ কথাটা বলিয়াছিলাম পাক-ভারত-বাণিজ্য চুক্তির আসন্ন আলোচনার প্রেক্ষিতে। কয়দিন পরেই এই চুক্তির মেয়াদ বাড়াইবার আলোচনা শুরু করিবার কথা। কিন্তু কথাটা আসলে শুধু পাক-ভারত বাণিজ্য চুক্তির বেলায় বলি নাই। সাধারণবাণিজ্য-নীতি হিসাবেইতালিয়াছিলাম। আমারনয়াবাণিজ্য সেক্রেটারি মিঃ আযিয় আহমদই শুধু আমার এই ঘোষণার খোলাখুলি সমালোচনা করিলেন আমারই নিকট। কিন্তু পাক-ভারত বাণিজ্য-চুক্তির আলোচনায় আমার ঐ বিঘোষিত নীতির প্রয়োগ দেখিয়া তিনি খুশী হন। ক্রমে বাণিজ্য-নীতি সম্পর্কে আমাদের মধ্যেকার আলোচনা ঘনিষ্ঠ হয়।
ইতিমধ্যে আমার নীতি ঘোষণার পর চীন রুশ যুগোস্লাভিয়া চেকোস্লোভাকিয়া ইত্যাদি সমাজতন্ত্রী দেশের রাষ্ট্রদূতেরা ঘন-ঘন আমার সাক্ষাৎ চাইতে থাকেন এবং পাকিস্তানের সাথে যাঁর-তাঁর দেশের বাণিজ্য শুরু করিবার এবং বাড়াইবার নানা রূপ লোভনীয় প্রস্তাব দিতে থাকেন। এসব আলোচনার অনেক গুলিতেই মিঃ আযিয় আহমদ শামিল ছিলেন। তিনিও আকৃষ্ট হইলেন বলিয়া মনে হইল।
এসব প্রস্তাবের মধ্যে রুশিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়ার প্রস্তাবই আমার সর্বাগ্রে বিবেচনা করিবার ইচ্ছা হইল। কারণ এদের প্রস্তাবের মধ্যে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের প্রশ্ন ছিল না। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার খুব টানাটানি। এই অভাবের কথার জবাবেই উহারা প্রথমে বাটার-সিষ্টেমে বা বিনিময়-পন্থায় বাণিজ্যের কথা বলেন। এই বার্টার সিস্টেমও পাকিস্তানের জন্য সহজসাধ্য করিবার উদ্দেশ্যে তাঁরা প্রস্তাব দেন : (১) তাঁরা পাকিস্তানের আমদানিকৃত জিনিসের দাম পাকিস্তানী মুদ্রায় গ্রহণ করিবেন এবং দামের টাকা দিয়া পাকিস্তানী জিনিস খরিদ করিয়া যার-তাঁর দেশে পাঠাইবেন। (২) ঐ টাকার পরিমাণমত পাকিস্তানী জিনিস কোনও এক বছরে সবটুকু পাওয়া না গেলে বাকী টাকায় পর বছর ঐ জিনিস খরিদ করা হইবে। যতদিন সব টাকা পাকিস্তানী জিনিস খরিদে ব্যয়িত না হইবে, ততদিন ঐ টাকা পাকিস্তান সরকারের পছন্দমত পাকিস্তানী ব্যাংকে জমা থাকিবে।
আমি এই প্রস্তাবে উল্লসিত হইলাম। উভয় দেশের প্রতিনিধিদেবেলিলাম, তাঁদের দেশ হইতে আমরা শুধু যন্ত্রপাতি আমদানি করিব। কোনও বিলাস-দ্রব্য আমদানি করিব না। ঐ যন্ত্রপাতির মধ্যেও আমি জুটলুমের উপর বেশি জোর দিলাম। বিলাতের তৈয়ারী প্রতি জুট-লুমের দাম ছিল এই সময় পঁয়তাল্লিশ হইতে পঞ্চান্ন হাজার টাকা। তাতে ঐ সময় ২৫০ লুমের একটি ক্ষুদ্রতম পাট কল বসাইতেও আমাদিগকে সোওয়া কোটি হইতে দেড়কোটি টাকা বিদেশী মুদ্রা খরচ করিতে হইত। রুশিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া কয়েকটি শর্তে এর প্রায় অর্ধেক দামে লুম তৈয়ার করিয়া দিতে রাযী হইল।
প্রস্তাবগুলি আমার কাছে ত লোভনীয় হইলই, মিঃ আযিয় আহমদ ও মিঃ ইউসুফও পরম উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন। আমি খুশী হইয়া প্রধানমন্ত্রীকে সব কথা বলিলাম। তিনি প্রথমে চোখ বড় করিয়া সন্দেহ প্রকাশ করিলেন। খানিক আলাপের পর তিনি বলিলেন : এটা মস্তবড় ফরেন পলিসির কথা তা তুমি বুঝিতেই পারিতেছ। ভাল হয় যদি তুমি প্রেসিডেন্টের সাথে বিষয়টার আলোচনা কর। তবে আমার মনে হয় এ ব্যাপারে আমাদের ‘আস্তে চল’ নীতি অবলম্বন করাই উচিৎ। ওরা আমাদের ভাল করিবার জন্য অত ব্যস্ত হইয়া পড়িল কেন, সেটা চিন্তা করিতে হইবে না? ধর যদি পাকিস্তানের নিকট বিক্রয়-করা সব টাকা ওরা আমাদের ব্যাংকে জমা রাখে। চুক্তির জিনিস পাওয়া যায় না এই অজুহাতে ইচ্ছা করিয়া খরচ যদি না করে, এমনি করিয়া যদি কয়েক বছরের টাকা জমা করে এবং অবশেষে একদিন সুযোগ বুঝিয়া সবটাকা একসংগে চাইয়া বসে তবে আমাদের ব্যাংকে ‘রান’ হইয়া দেশে ইকনমিক ক্রাইসিস দেখা দিবে না?
আমি ভাবনায় পড়িলাম। আমি ফাইনান্সের কিছুই জানি না। পাবলিক ফাইনান্স ত নয়ই। পক্ষান্তরে আমার নেতা প্রধানমন্ত্রী একজন নামকরা ইকনমিক এক্সপার্ট। তিনি যা আশংকা করিয়াছেন, সব সত্য হইতে পারে। আমি ত ও-সব দিক ভাবিয়া দেখি নাই। কয়েকদিন পরে প্রেসিডেন্টের সাথে আলাপ করিব বলিয়া প্রধানমন্ত্রীর নিকট হইতে বিদায় হইলাম। পরদিনই রুশ-রাষ্ট্রদূতকে তলব করিলাম। আমাদের সন্দেহের কথা তাঁকে বলিলাম। সব শুনিয়া রাষ্ট্রদূত নিজের সরকারের সাথে আলোচনা করিবার সময় নিলেন। কয়েকদিন পরে আসিয়া বলিলেন : ‘বেশ, তবে আমরা পাকিস্তানে অর্জিত সব টাকাই বছর-বছর খরচ করিয়া ফেলিব কোনও টাকা জমা রাখিতে পারিব না। বছর-শেষে যদি কোনও টাকা অব্যয়িত থাকে, তবে তা পাকিস্তান সরকার বাযেয়াত করিতে পারিবেন।’
এবার আমার সরল মনও সন্দিগ্ধ হইল। এঁরা আমাদের এত ভাল করিতে চান কেন? কিন্তু অনেক চিন্তা করিয়াও সন্দেহের কিছু পাইলাম না। প্রধানমন্ত্রীর সহিত দেখা করিয়া সর্বশেষ প্রস্তাবটা তাঁকে শুনাইলাম। তিনি উচ্চ হাসিতে ছাত ফাটাইয়া বলিলেন : ‘সন্দেহ আরও গাঢ় হইয়াছে। তবে চল প্রেসিডেন্টের মতটাও জানা দরকার।‘ যা সন্দেহ করিয়াছিলাম, তাই হইল। প্রধান মন্ত্রী যা-যা আশংকা করিয়াছিলেন, প্রেসিডেন্টও ঠিক সেই সব সন্দেহই করিলেন। আমি যত তর্ক করিলাম, যত বলিলাম, এমন সোজা খরিদ-বিক্রির দ্বারা কমিউনিস্টরা আমাদের কি কি অনিষ্ট করিতে পারে, একটা অন্ততঃ দেখাইয়া দেন। একটাও তিনি দেখাইতে পারিলেন না। অথচ একটু নরমও হইলেন না। বরঞ্চ পাল্টা প্রশ্ন করিলেন : ‘তুমিই বা কমিউনিস্ট দেশসমূহের সংগে বাণিজ্য করিবার জন্য এত ব্যস্ত হইয়াছ কেন?’
প্রধানমন্ত্রীর চোখ-ইশারায় আমি বিরত হইলাম। আর তর্ক করিলাম না। তবু প্রেসিডেন্ট আমাকে সাবধান করিয়া দিলেন ওদিকে যেন আমি পা না বাড়াই।
আমার মনটা খারাপ হইল। এসব ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের কাছে জিগ্গাস করিতে গেলাম কেন? তাঁর কি এলাকা আছে এ ব্যাপারে? প্রধানমন্ত্রী না বলিলে আমি যাইতামও না তাঁর কাছে। প্রধানমন্ত্রীই বা গেলেন কেন গলা বাড়াইয়া প্রেসিডেন্টের সম্মতি লইতে?
কিছু দিনের মধ্যেই কারণ বুঝিলাম। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই করিয়াছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্টের সম্মতি চাহিয়াছিলেন প্রেসিডেন্টের সম্মতির জন্য নয়, রিপাবলিকান সহকর্মীদের সম্মতি লইতে। কয়েক দিনের মধ্যেই রিপাবলিকান মন্ত্রীদের এক একজন করিয়া অনেকেই আমাকে জিগ্গাস করিতে লাগিলেন, আমি নাকি রুশিয়ার কাছে পাকিস্তান মর্গেজ দিবার প্রস্তাব করিয়াছি? সুবিধাজনক বার্টার বাণিজ্যের কি কদর্থ?
রিপাবলিকান ভাইদের মধ্যে সব চেয়ে বাস্তববাদী ছিলেন অর্থ-ওযির সৈয়দ আমজাদ আলী। তাঁর কাছে আগে না বলিয়া প্রেসিডেন্টের কাছে যাওয়াটাই ভুল হইয়াছে। অতএব এর পর আমি আমজাদ আলীর পিছনে লাগিলাম। তিনি শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট দেশসমূহে একটি বাণিজ্য মিশন পাঠাইতে রাযী হইলেন। তবে বলিলেন তাতেও প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর অগ্রিম সম্মতি লওয়া দরকার।
আমি অতঃপর মিঃ আযিয আহমদের সাথে ব্যাপারটা আগাগোড়া ঢালিয়া বিচার করিলাম। বাণিজ্য-মিশনের আইডিয়াটা তিনি খুব পসন্দ করিলেন। শেষ পর্যন্ত সেই মিশনের নেতৃত্ব করিতেও তিনি সম্মত হইলেন। প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ-সফর কালে তাঁর এ্যাকটিনি করিবার সময় কেবিনেট মিটিং ডাকিয়া দিলাম। প্রেসিডেন্টও তখন নাধিয়াগলিতে বিশ্রাম করিতেছেন। আমজাদ আলী ও আযিয আহমদ আমার পক্ষে। কাজেই কোনও চিন্তা নাই। আযিয আহমদের সহিত পরামর্শ করিয়া পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান হইতে চারজন করিয়া আট জন প্রতিনিধির দল করা হইল। মিঃ আযিয আহমদ প্রতিনিধি দলের নেতা হইলেন। শেষ দিনে আমি মিঃ আযিয আহমদের উপরও একটা সারপ্রাই নিক্ষেপ করিলাম। সাপ্লাই এন্ড ডিভেলপমেন্টের ডিরেক্টর জেনারেল মিঃ বি. এ. কোরায়শীকে টেকনিক্যাল এডভাইযার হিসাবে ডেলিগেশনের সাথে জুড়িয়া দিলাম। তিনি ডেলিগেশনের মেম্বরের সমমর্যাদাসম্পন্ন হইবেন বলিয়া লিখিত আদেশ দিলাম।
এটা ছিল মিঃ কোরায়শীর সাথে আমার গোপন ষড়যন্ত্র। কোরায়শীকে আমি নিজ পুত্রের মত স্নেহ ও বিশ্বাস করিতাম। তিনিও আমাকে আপন পিতার মতই ভক্তি করিতেন এবং লোকের কাছে আমার তারিফ করিয়া বেড়াইতেন। পক্ষান্তরে মিঃ আযিয আহমদের যোগ্যতা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে আমার বিশেষ আস্থা ছিল বটে কিন্তু কমিউনিস্ট দেশ সমূহের ব্যাপারে তাঁর বিচার-বিবেচনার নিরপেক্ষতার প্রতি আমার ততটা আস্থা ছিল না। ওদের বিরুদ্ধে মিঃ আযিয আহমদ বায়াড় বলিয়াই তখনও আমার বিশ্বাস। সেজন্য কয়েকদিন আগেই আমি মিঃ কোরায়েশীকে গোপনে ডাকিয়া মনের কথটা বলিয়াছিলাম। বলিলাম : তৌলগেশনের নেতা হিসাবে মিঃ আযিয আহমদ যে রিপোর্ট দিবেন কোরায়শী সে রিপোর্ট-নির্বিশেষে একটি বিশেষ ও সিক্রেট রিপোর্ট আমার কাছে কনফিডেনশিয়ালি দাখিল করিবেন। কোরায়শীকে প্রকারান্তরে বুঝাইয়া আযিয আহমদের রিপোর্ট নিরপেক্ষ হইবে না বলিয়া আমি সন্দেহ করি। সেজন্য এবিষয়ে নীতি নির্ধাণের ভিত্তিরূপে কোরায়শীর রিপোর্টের উপর নির্ভর করিতে চাই। কাজেই কোরায়শীর দায়িত্ব অতিশয় গুরুতর।
‘দোওয়া করিবেন যেন আপনার আস্থার মর্যাদা রক্ষা করিতে পারি।’ এই বলিয়া কোরায়শী সালাম করিয়া বিদায় লইলেন। যথাসময়ে বাণিজ্য মিশন বাহির হইয়া গেল।
মোট পাঁচ ছয়টি দেশ সফর করিবার কথা। দুইটি বাকী থাকিতেই বাণিজ্য মিশন পিছনে ফেলিয়া কোরায়শী একাই দেশে ফিরিয়া আসিলেন। আসিয়াই আমার সাথে দেখা করিলেন। বলিলেন : মিঃ আযিয আহমদ তাঁর গোয়ন্দাগিরি ধরিয়া ফেলিয়াছেন। তিন চার দেশের সফর শেষ করিয়াই তিনি কোরায়শীকে একদিন গোপনে বলেন : অনারেবল মিনিস্টার তোমাকে যে উদ্দেশ্যে পাঠাইয়াছেন, তার আর দরকার নাই। তোমাকে আর কোনও সিক্রেট রিপোর্ট দাখিল করিতে হইবে না। আমার রিপোর্টই তাঁর মনোমত হইবে। দেশে দরকারী কাজ থাকিলে তুমি এখনই দেশে ফিরিয়া যাইতে পার। গিয়া অনারেবল মিনিস্টারকে বলিও, তোমার রিপোর্টটা আমিই লিখিতেছি।
কিরূপে মিঃ আযিয আহমদ অমন গোপনীয় বিষয়টা ধরিয়া ফেলিয়াছিলেন, কোরায়শী ও আমি অনেকক্ষণ মাথা খাটাইয়াও তা আবিষ্কার করিতে পারি নাই। ফলে উভয়েই একমত হইলাম : ধন্য মিঃ আযিয আহমেদের তীক্ষ্ণ অন্তদৃষ্টি।
সত্যই মিঃ আযিয আহমদ আমার মনের মত রিপোর্টই দিয়াছিলেন। কিন্তু মিশন দেশে ফিরিবার আগেই আমাদের মন্ত্রিত্ব গিয়াছিল। কাজেই রিপোর্টটা আমার হাতে আসে নাই। আসিয়াছিল আমার পরবর্তীর কাছে। তিনি অমন কমিউনিস্ট ধরনের রিপোর্টটা হজম করিতে পারেন নাই। সেজন্য সেটা পেশ করেন প্রেসিডেন্টের কাছে। প্রেসিডেন্ট অগ্নিশর্মা হন এবং রিপোর্ট বদলাইয়া দিতে মিঃ আযিয আহমদকে অনুরোধ করেন। তিনি প্রেসিডেন্টের অনুরোধ রক্ষা করিতে অসম্মত হন। এই লইয়া করাচির রাজনৈতিক মহলে এবং খবরের কাগযের সার্কেলে খুব হৈ চৈ পড়িয়া যায়। কিন্তু আযিয আহমদ স্বমতে অটল থাকেন। বাধ্য হইয়া তকালিন মন্ত্রিসভা ঐ রিপোর্ট চাপা দিয়াছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে মার্শাল লর আমলে এবং তারও পরে মিঃ আযিয আহমদের রিপোর্টের ভিত্তিতে আমাদের বাণিজ্য-নীতির যথেষ্ট পরিবর্তন হইয়াছে।
৯. সেকান্দরী খেল
কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝিলাম, প্রেসিডেন্ট মির্যা যেন কোনও নতুন খেলা শুরু করিয়াছেন। তিনি কথায়-কথায় আমার কাছে প্রধানমন্ত্রীর নিন্দা করেন। তিনি ইতিমধ্যে ইরান লেবানন তুরস্ক গিয়াছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ‘কেলেংকারি’র জন্য আর কান পাতা যায় না। আমেরিকা হইতে তিনি অনুরূপ রিপোর্ট পাইয়াছেন। প্রধানমন্ত্রীকে হুশিয়ার করা আমাদের উচিৎ। যেন কত সাধু, মহৎ হিতৈষী ব্যক্তি শহীদ সাহেব ও ঐ সংগে আমাদের কল্যাণ-চিন্তায় ঘুমাইতে পারিতেছেন না। ভাবখানা এই। আমি প্রেসিডেন্টের এই মতি পরিবর্তনের কারণ খুঁজিতে লাগিলাম। তিনি আমার ব্যক্তিগত কল্যাণের জন্যই যেন সবচেয়ে অধীর। আমাকে তিনি বুদ্ধিমান হইবার উপদেশ দিলেন। পাগলামি ছাড়। শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের সাথে ঝগড়া করা আহাম্মকি। ওযারতি স্থায়ী জিনিস নয়। আজ আছে কাল নাই। যে কয়দিন আছ আপনা কাম বানা লো। সবকুই বানায়া। আয়েন্দা ভি সবকুই বানায়েগা। আমার মনে পড়িত বিভিন্ন লোকের জন্য তাঁর স্লিপগুলির কথা। আমি হাসিয়া বলিতাম : ‘হামকো মাফ কিজিয়ে স্যার’ আমার স্ত্রীকে তিনি আমার সামনেই বলিতেন : ‘বেগম সাব, এ পাগলগো আপ সামালিয়ে।‘
আমার মনে পড়িল প্রধানমন্ত্রীর প্রতি প্রেসিডেন্টের রাগের কারণটা। প্রধানমন্ত্রী যথাসম্ভব শীঘ সাধারণ নির্বাচন দিতে চান। প্রেসিডেন্ট নানা যুক্তিতে তাড়াহুড়া না করার উপদেশ দেন। আর তাঁর হাতের পুতুল চিফ ইলেকশন কমিশনার মিঃ এফ. এম, খাঁকে দিয়া প্রধানমন্ত্রীর সব নির্দেশ ভণ্ডুল করিয়া দেন। ভোটার তালিকা ছাপা ও ব্যালট বাক্স তৈয়ারির অসুবিধার সব যুক্তি আমরা কাজের দ্বারা খণ্ডন করিয়াছি। তবু যখন চিফ ইলেকশন কমিশনার কেবিনেটের সব সিদ্ধান্তে আপত্তি করিতে থাকিলেন, তখন তাঁকে একদিন কেবিনেট সভার মধ্যেই ডাকা হইল। দুই-এক কথার পরেই তিনি স্পষ্ট বলিয়া বসিলেন : ‘আমি প্রেসিডেন্ট ছাড়া আর কারো এলাকাধীন নই।‘ কথাটা আংশিক সত্য। তিনি প্রেসিডেন্টের নিজস্ব নিয়োজিত ব্যক্তি ঠিকই। কিন্তু সেই জোরে সাধারণ নির্বাচন ঠেকাইয়া রাখিবেন এমন অধিকার তাঁর নাই। কিন্তু আমরা জানিতাম, তাঁর এই দুঃসাহসিক আচরণের হেতু কি? কাজেই প্রেসিডেন্টের অভিপ্রায় মত প্রথমে আমি ওয়াদা করিলাম, আগামী নির্বাচনে মির্যাকেই আমরা প্রেসিডেন্ট করিব। আতাউর রহমান ও মুজিবুর রহমানকে দিয়াও এমনি ওয়াদা করাইলাম। পূর্ব পাকিস্তানী সব কয়জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে দিয়াও এই একই আশ্বাস দেওয়াইলাম। সকলের ওয়াদা পাইবার পর তিনি যিদ ধরিলেন শহীদ সাহেবকে দিয়া এই ওয়াদা করাইতে হইবে। শহীদ সাহেব স্বভাবত এই ধরনের ওয়াদা করার বিরোধী। প্রথম প্রথম কিছুতেই তিনি এতে রাযী হইলেন না। অবশেষে আমাদের সকলের পীড়াপীড়ি অনুনয়-বিনয়ের ফলে তিনি একদিন গোপনে প্রেসিডেন্টের সাথে আলাপ করিলেন। উভয়েই সে আলাপে সন্তুষ্ট বলিয়া মনে হইল। ঐ ঘটনার কয়েকদিন মধ্যেই মির্যা সাহেব পরিষ্কাররূপে ‘নিউইয়র্ক টাইমসের’ প্রতিনিধিকে বলিয়াছিলেন : ‘প্রধানমন্ত্রী ও আমি কদাচ পরস্পরকে ছাড়িব না। শহীদ সাহেবের মত যোগ্য লোক পাকিস্তানে আর হয় নাই।‘
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেষোক্ত লম্বা টুওরে বিদেশ গেলেন। লণ্ডন বিমানবন্দরে রিপোর্টারদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলিয়াছিলেন : ‘আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আমি দুইজন লোকের কথা ভাবিতেছি। এই সংবাদটি পড়িয়াই প্রেসিডেন্ট সকাল ব্রেলা আমাকে ডাকিলেন। আমি যাইতেই কাগটি আমার হাতে দিয়া বলিলেন : এই দেখ তোমার নেতার কাণ্ড।’ আমি অবশ্য ঐ সংবাদের নানারূপ ব্যাখ্যার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু কোনটাই তাঁর পছন্দ হইল না। তিনি বলিলেন : ‘দুই জনের কথা বলিয়াছেন আমাকে ধাপ্লা দিবার জন্য। আসলে তিনি গুরমানীকেই প্রেসিডেন্ট করা স্থির করিয়াছেন।‘ এই প্রমানী ফোবিয়ায় তাঁকে বহু আগেই পাইয়াছে। আগেও আমরা যে আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দিয়াছি, তা সবই এই গুরমানীর বিরুদ্ধেই। তবু প্রধানমন্ত্রীর লওনের এই উক্তিটা আমাদের আগের সব প্রতিশ্রুতি নস্যাৎ করিয়া দিল। আমি এই বলিয়া বিদায় হইলাম যে, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরার পর তাঁর সাথে এক মিনিট আলাপ করিয়াই তিনি সন্তুষ্ট হইবেন এ বিশ্বাস আমার আছে।
কিন্তু এবার শহীদ সাহেব সফর হইতে ফিরিয়া এই ব্যাপারে মিয়াকে সন্তুষ্ট করিতে পারেন নাই। আমার বিশ্বাস এই কারণেই প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এই নিন্দা-কুৎসা প্রচার শুরু করিয়াছেন। এই সব কথা লিডারের কানে তুলিব-তুলিব ভাবিতেছি, এমন সময় একদিন প্রথমে ফিযে খা নুন এবং পরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে শুনিলাম, প্রেসিডেন্ট আমার বিরুদ্ধে সাংঘাতিক কুৎসা করিয়া বেড়াইতেছেন। শুনিলাম তাঁদের উভয়ের কাছে পৃথক-পৃথক ভাবে বলিয়াছেন : কোনও এক বিদেশী প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি বলিয়াছি : পূর্ব-পাকিস্তানকে আমি স্বাধীন রাষ্ট্র করিতে চাই। যে বিদেশী প্রধানমন্ত্রীর কথা তিনি বলিলেন, মাত্র মাসখানেক আগে তিনি পাকিস্তান সফর করিতে আসিয়াছিলেন। এ্যাকটিং প্রাইম-মিনিস্টার হিসাবে স্বভাবতঃই আমাকেই তাঁর অভ্যর্থনা-অভিনন্দন দিতে হইয়াছে। তাঁকে করাচির পার্শ্ববর্তী শিল্প এলাকা-বন্দরাদি দর্শনীয় জিনিস আমাকেই দেখাইতে হইয়াছে। প্রথম-প্রথম আমার সহিত তাঁর খুবই বনিয়াছিল। আলাপ করিয়াছি অনেক ধরনের। কিন্তু ঐ বিশেষ ধরনের কথা বলিবার কোনও কারণ বা সুযোগ ঘটে নাই। সব আলাপ হইয়াছে দেশের অফিসারদের সামনে তাঁদের উপস্থিতিতে। দুইজনে একা আলাপ করিবার প্রথম সূযোগেই ভদ্রলোকের প্রতি আমার ধারণা এমন খারাপ হইয়া যায় যে পরবর্তী সময়টা তাঁর সাথে কোনও সিরিয়াস আলাপ করিতে আমার মন চায় নাই। ঘটনাটা এই একটা বড় কাপড়ের মিল পরিদর্শন করিতে গিয়াছি। এক-এক রকমের বিভিন্ন ডিযাইন ও রং-এর কাপড়ের স্টলে যাই, আর আমাদের মাননীয় মেহমান বলেন : এর কাপড়টা আমার খুব পসন্দ হইয়াছে, ঐ কাপড়টা আমার বেগম সাহেবা খুব পসন্দ করিবেন। আর মিল-মালিক মেহমানের কথায় সংগে সংগে প্রত্যেক শ্রেণীর রং ও ডিযাইনের কাপড় দুই প্রস্থ করিয়া প্যাক করিতে বলেন। মিলমালিক ফ বলেন : প্যাক কর, মাননীয় মেহমান তত বলেন : এটা আমার খুব পছন্দের। ওটা আমার বেগমের পসন্দের। বেগম সাহেবা কিন্তু তাঁর সংগে আসেন নাই। নিজের দেশেই আছেন। তবু মাননীয় মেহমান নিজের ও বেগমের নামে বিদেশে অ-অত কাপড় পসন্দ করিতে লাগিলেন। আমি বুঝিলাম পসন্দ সাহেবেরই হউক, বেগম সাহেবেরই হউক, উভয় পসন্দেরই দুই দুই প্রস্ত কাপড়ের দুইটা বিশাল বিশাল প্যাকেট করা হইতেছে সাহেব ও বেগমের জন্যই। আমি লজ্জায় মরিতে লাগিলাম। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীরা বিদেশে গিয়া এমন স্থূপাকার জিনিস পসন্দ করিয়া আনেন, এমন কথা কখনো শুনি নাই। আর কোনও বিদেশী প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা করিবার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। এই অনভিজ্ঞতার দরুনই বোধ হয় আমি মেহমান সাহেবের এই ধুছিয়া পসন্দ করিবার কাজটা পসন্দ করিতেছিলাম না। ভদ্রলোকের চরিত্র সংইে আমার ধারণা ছোট হইয়া গেল। মনের ভাব মুখে লুকাইবার ব্যাপারে আমি কোনও দিনই বিশেষ দক্ষ ছিলাম না। এবারেও বোধ হয় তাই হইল। ভদ্রলোক বোধ হয় আমার বিরক্তি বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তাই এর পর দুই এক বার মালিকের ‘প্যাকেট কর’ আদেশের জবাবে তিনি বলেন : ‘থাক, আর প্রকার নাই।’ মিল-মালিক বোধ হয় নিজেই ইতিমধ্যে মেহমানের অসাধারণ লোভ দেখিয়া উত্যক্ত হইয়াউঠিয়াছিলেন। তিনি ঐ ‘থাক থাক, আর দরকার নাই’ এর জবাবে যেন যিদ করিয়াই বলিলেন : আপনার দরকার না থাকিলেও আমার দরকার আছে। আপনে আমাদের সম্মানিত মেহমান ত।
পরিদর্শন শেষে গেটে আসিয়া যা দেখিলাম তাতে আমার ভাল জিভ লাগিয়া গেল। দুইটা ট্রাক কাপড়ের বড় বড় প্যাকেটে আধ-বুঝাই।
আমি বোধ হয় রসিকতার লোভ সরণ করিতে না পারিয়া বলিলাম : বেগম সাহেবা ও সাহেবের কাপড়গুলির জায়গা এক ট্রাকেই হইত। দুইটায় দেওয়াটকি কোন বিশেষকারণআছে?
আমার রসিকতার জবাবে মিল-মালিক বলিলেন : ‘মেহমান ও তাঁর বেগমের কাপড় এক ট্রাকেই দেওয়া হইয়াছে। দ্বিতীয় ট্রাকের কাপড় মেহমানের নয়, আপনার।‘
আমি বিস্মিত হইলাম। রাগ সামলাইতে পারিলাম না। বলিলাম : আমাকে কাপড় কেন? আমি কি মেহমান? আমি এ কাপড় নিব না। ট্রাক হইতে মাল নামাইয়া ফেলুন।
মিল-মালিক অনেক চাপাচাপি করিলেন। বিস্ময়ের কথা এই যে মেহমানও সে অনুরোধে যোগ দিলেন। বলিলেন : আপনি না নিলে আমিও নিতে পারি না।
মনে-মনে বলিলাম : না নিলেই ভাল করিতেন। মুখে বলিলাম : না না আপনার কেস ও আমার কে সম্পূর্ণ আলাদা। আপনি মেহমান আর আমি এদের মন্ত্রী।
শেষ পর্যন্ত আমার যিদ বজায় রাখিলাম। আমাদের সামনেই ট্রাক হইতে ‘আমার কাপড়গুলি’ নামাইয়া রাখা হইল। তারপর আমরা আমাদের গাড়ি ছাড়িবার হুকুম দিলাম। স্পষ্ট দেখিলাম, মেহমানের মুখোনা কালা যহর হইয়া গিয়াছে।
এমনি লোকের সাথে গিয়াছিলাম আমি পূর্ব-পাকিস্তান স্বাধীন করিবার পরামর্শ করিতে। এটা মির্যার নিজস্ব বানান কথা। বরঞ্চ খোদ মির্যার কাছে আলাপে-আলাপে আমি দুই-একবার লাহোর প্রস্তাবের আক্ষরিক ব্যাখ্যা এবং বহুবচনের ‘এস’ হরফটা বাদ দেওয়ার ইতিহাস বর্ণনা করিয়াছি। হয়ত সেটাকেই বুনিয়াদ করিয়া তিনি এই কাহিনী তৈয়ার করিয়াছেন। সন্দেহ আরও দৃঢ় হইল, মির্যা কোনও প্ল্যান করিতেছেন।
এমন সময় কাটি চেম্বার-অব-কমার্সের আমাদের হিতাকাংখী একজন মেম্বর আমাকে জানাইলেন, প্রেসিডেন্ট হাউসে বসিয়া শিল্পী-বণিকরা আমার বিরুদ্ধে জোট পাকাইতেছেন। অতঃপর বন্ধুবর মাঝে-মাঝেই এইরূপ খবর দিতেন। বলিতেন আমার কার্যকলাপে তারা আগে হইতেই আমার উপর ক্ষেপা ছিলেন। মার্কিন সাহায্যের চার কোটি টাকা পূর্ব-পাকিস্তানে নিয়া যাওয়ায় তাঁরা রাগে অন্ধ হইয়া পড়িয়াছেন।
১০. লাইসেন্সের বিনিময়ে পার্টি-ফণ্ড
বন্ধুবরের খবর ক্রমেই সত্য প্রমাণিত হইতে শুরু করিল। ঝট পট কয়েকখানা ইজী সাপ্তাহিক বাহির হইল। তাতেই নানা ঢংগে প্রচার শুরু হইল : চার কোটি বিদেশী মুদ্রা এ্যাবযর্ব করিবার মত মূলধন পূর্ব পাকিস্তানীদের নাই। কাজেই চার কোটি টাকার লাইসেন্স পাইয়া পূর্ব পাকিস্তানীরা সব লাইসেন্সই বিদেশীদের কাছে বেচিয়া ফেলিবে। এই বিক্রয়টা যদি শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিকট হইত, তা হইলে অবশ্য বলিবার বিশেষ কিছু থাকিত না। কিন্তু বিপদ এই যে পূর্ব পাকিস্তানীরা ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের নিকট বেশী দামে লাইসেন্স বেচিয়া ফেলিবে।
এই যুক্তিটাই একটু প্রসারিত করিযা বলা হইল যে আওয়ামী লীগেরই যখন গভর্ণমেন্ট তখন সব লাইসেন্সই আওয়ামী লীগারদের মধ্যে বিতরিত হইবে। কিন্তু আওয়ামী লীগারদের মধ্যে কোনও ধনী লোক নাই। কাজেই লাইসেন্স বিক্রয় করিয়া তারা অনেক টাকা পাইরে। এই টাকা দিয়া তারা আগামী ইলেকশনে লড়িবে। সুতরাং আমদানি লাইসেন্স বিক্রয় করিয়া আওয়ামী লীগাররা পার্টি-ফণ্ড তুলিবে। ‘তুলিবে’টা অল্প দিনেই ‘তুলিতেছে’ ও পরে ‘তুলিয়াছে’ হইয়া গেল লাইসেন্স ইশু হইবার অনেক আগেই। শুধু ঐ সব সাপ্তাহিক কাগযের রিপোর্টার-সম্পাদকরাই এ ধরনের কথা বলিলেন না। পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদেরও কেউ-কেউ এই ধরনের বক্রোক্তি করিতে লাগিলেন।
তখন আমি চাটগাঁ টুওর করিতেছি। কাগযে পড়িলাম রিপাবলিকান দলের কেন্দ্রীয় নেতা ডাঃ খান সাহেব এক জনসভায় বলিয়াছেন : মন্ত্রীরা লাইসেন্স বিক্রয় করিয়া পার্টি-ফণ্ড তুলিতেছেন। করাচি ফিরিয়া প্রথম সাক্ষাতেই ডাঃ খান সাহেবকে ওটা জিগ্গাস করিলাম। তিনি দৃঢ়তার সংগে অস্বীকার করিলেন। ব্যাখ্যা করিয়া বলিলেন : করাচির এক রিপাবলিকান জনসভায় শ্রোতাদের মধ্য হইতে প্রশ্ন হইয়াছিল পার্টি ফণ্ডর কি হইবে? তহবিল ছাড়া ত কাজ করা যায় না। তারই উত্তরে ডাঃ খান সাহেব বলিয়াছেন : যার-তার পার্টি-ফণ্ড নিজেরা করিয়া লউন। আমি ত আর লাইসেন্স বিক্রয় করিয়া পার্টি-ফণ্ড তুলিতে পারি না। এটাকেই খবরের কাগযওয়ালারা ব্যাংগোক্তি মনে করিয়াছেন। তাঁর বক্তৃতা এত স্পষ্ট ছিল যে ওটাকে ভুল বুঝিবার কোনও উপায় ছিল না। মুসলিম-লীগাররা আমাদের বিরুদ্ধে কত কথা বলিবে, তাতে চঞ্চল হইবার কিছুই নাই। ডাঃ সাহেব এই প্রসংগে আফসোস করিলেনঃ পূর্ব পাকিস্তানে তবু তোমাদের নিজের একখানা খবরের কাগয় আছে। পশ্চিম পাকিস্তানে ত সবই মুসলিম লীগের।
ডাঃ খান সাহেবের কথা অবিশ্বাস করিবার কোনও কারণ ছিল না। তিনি সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার বা ব্যক্তিগতভাবে আমার অপসারণ চান, এরূপ মনে করিবার কোনও হেতু ছিল না।
কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট মির্যা নতুন ফেঁকড়া বাহির করিলেন। তিনি আমাকে ডাকিয়া বলিলেন : দেখ আবুল মনসুর, শহীদের সাথে আমার গরমিল হওয়ার কোনও কারণ নাই। শুধু তাঁর ঐ প্রিন্সিপাল প্রাইভেট সেক্রেটারি আফতাব আহমদটাই যত অনিষ্টের মূল। সে আসলে গুরমানীর লোক। তাকে প্রধানমন্ত্রীর দফতর হইতে তাড়াও। সব লেঠা চুকিয়া যাইবে। অন্যথায় আমাদের মধ্যেকার অশান্তি দূর হইবে না। কারণ সে প্রধানমন্ত্রীকে সব সময় কুবুদ্ধি দেয়। প্রধানমন্ত্রী তার পরামর্শেই চলেন।
লিডারের মত তীক্ষ্ণ-বুদ্ধি লোককে কেউ কুবুদ্ধি দিয়া বিপথগামী করিতে পারে, বিশেষতঃ আফতাব আহমদের মত লোক। এটা আমি বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। কিন্তু এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট যেরূপ অনাবশ্যক দৃঢ়তা দেখাইলেন তাতে আমি তাঁর কথা উড়াইয়াও দিতে পারিলাম না। কারণ গত কিছুদিন হইতে বাজারে খুব জোর গুজব রটিতেছিল যে সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার পতন আসন্ন। প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান ও মুসলিম লীগ পার্টির মধ্যে আপোস করাইয়া দিয়া সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার বদলে মুসলিম লীগ গবর্নমেন্ট গঠন করিবার চেষ্টা করিতেছেন। কথাটা লিডার ফুৎকারে উড়াইয়া দিলেও আমি তা পারিলাম না। মির্যাই মুসলিম লীগ দল ভাংগিয়া রিপাবলিকান দল করিয়াছিলেন। সেটা আবার জোড়া দেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব নাও হইতে পারে। আমি আফতাব আহমদের কথাটা অতি সাবধানে তুলিলাম। তাঁকে সরাইয়া প্রেসিডেন্টকে খুশী রাখিতে দোষ কি? আফতাব আহমদকে আপাততঃ একটা ভাল পদ দিয়া অন্যত্র পাঠাইলে আফতাবের তাতে আপত্তি হইবে না। কারণ তিনি সত্য সত্যই লিডারের ভক্ত ও হিতৈষী।
লিডার রাযী হইলেন না। তিনি আমাকে বুঝাইলেন : ওটা আসলে আফতাব আহমদকে সরাইবার দাবি নয়। ওটা ছুরির ধারাল দিকঃ থিন এণ্ড অব দি এইজ। এই দিনই লিডার আমাকে ঈশারায় জানাইলেন, আমার হাত হইতে শিল্প-বাণিজ্য দফতর নিয়া কোনও পশ্চিম পাকিস্তানী মন্ত্রীকে দেওয়াই মির্যার পরিণামের দাবি। আমি তখন বলিলাম : মির্যাকে হাতে রাখিবার জন্য প্রয়োজন হইলে আমার দফতর ত দফতর আমাকেই তাঁর সরাইয়া দেওয়া উচিৎ। কারণ যুক্ত-নির্বাচন প্রথায় সাধারণ নির্বাচনের জন্য তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব ‘অপরিহার্য’। লিডার জবাবে বলিলেন : এটা প্রিন্সিপালের কথাও বটে। প্রধানমন্ত্রী কাকে তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি রাখিবেন, প্রেসিডেন্ট তাতে হস্তক্ষেপ করিতে পারেন না। এটা মানিয়া নিলে ইতিহাস তাঁকে মাফ করিবে না। লিডার তাঁর পনে অটল থাকিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর এই দিককার অনমনীয়তায় মির্যা অন্য দিকে শক্ত হইলেন। তিনি রিপাবলিকান পার্টির অধিকাংশকে দিয়া দাবি উঠাইলেন গবর্নর গুরমানীকে সরাইতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের রুলিং পার্টি প্রাদেশিক রিপাবলিকান পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি করিলেন যে গুরমানী গবর্নর থাকিলে মন্ত্রিসভার কাজ সুষ্ঠুভাবে চালান অসম্ভব।
আমরা সকলেই বুঝিলাম, মির্যাই এই দাবির গোড়ায় আছেন। আফতাব আহমদকে সরাইতে না পারিয়া তিনি একেবারে মূলোচ্ছেদ করিবার ব্যবস্থাকরিয়াছেন। কিন্তু জানিয়া-বুঝিয়াও কিছু করিবার উপায় ছিল না। প্রধানমন্ত্রী নিজের দায়িত্বে কিছু করিতে রাযী না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কেবিনেটে দিলেন। রিপাবলিকানদের তয় ছিল আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা কেহ তাঁদেরে সমর্থন করিবেন না। কিন্তু কেবিনেট মিটিং-এ আমিই এ বিষয়ে প্রথম কথা বলিলাম এবং গুরমানীকে অপসারণের প্রস্তাব সমর্থন করিলাম। আমার যুক্তি ছিল শাসনতান্ত্রিক। পার্লামেন্টারি শাসন-ব্যবস্থায় প্রাদেশিক গবর্নরকে অবশ্যই মন্ত্রিসভার আস্থাভাজন হইতে হইবে। এর পরে এ বিষয়ে একমাত্র সর্দার আমিরে আযম ছাড়া আর কেউ বিরুদ্ধতা করিলেন না। তিনি শেষ পর্যন্ত এই ইশুতে পদত্যাগই করিলেন। কারণ তিনি গুরমানীর একজন খাঁটি অনুরক্ত লোক ছিলেন। যা হোক মানী সাহেবকে অপসারণের প্রস্তাব প্রায় সর্বসম্মতরূপে গৃহীত হইল। আমার সমর্থনের অর্থ রিপাবলিকান বন্ধুরা এই করিলেন যে প্রধানমন্ত্রীর গোপন ইংগিতেই আমি এটা করিয়াছি। তাতে লাভই হইল। রিপাবলিকান বন্ধুরা লিডারের উপর আস্থাবান হইয়া উঠিলেন।
শান্তিতেই দিন কাটিতে লাগিল। গুজব শান্ত হইল।